#আমার_আকাশে_তারা_নেই
#লাবিবা_আল_তাসফি
পর্ব: ৭
সময় গড়িয়ে ঘড়ির কাঁটা আটটার ঘরে থামল। ড্রয়িং রুমে সকলে বিরস মুখে ইহান আর টিনার আসার অপেক্ষা করছিল। সেই বিকেল থেকে একাধারে তাদের কল করে চলছে কিন্তু কেউই কল ধরছেনা। নাজমুল সাহেব ভেবে পান না তার ছেলে এতটা দায়িত্বহীন কিভাবে হল। তার চোখে মুখে বিরক্তি স্পস্ট। শারমিন বেগমের প্রেশার বেড়ে যাওয়ায় সে আপাতত রুমে রেষ্ট করছে। ইরা কিছুক্ষণ পরপর ইরানের ফোনে কল দিচ্ছে কিন্তু বরংবার সে আশাহত হচ্ছে। অবশেষে রাত নয়টায় তারা বাসায় ফেরে।
ড্রইংরুমের পা রাখতেই আজমল সাহেব কঠিন কন্ঠে ইরানকে প্রশ্ন করে,
–‘এই রাত ৯টা অব্দি কোথায় ছিলে তোমারা?’
এমন প্রশ্নে ইহান অবাক হয়। সে কি এখনো ছোট বাচ্চা ছেলে যে তাকে এই সামান্য ব্যাপারে জেরা করা হবে! তবুও সে হাসি মুখেই উত্তর দেয়,
–‘একটু শপিং মলে গিয়েছিলাম বাবা তাই দেরি হল।’
–‘বুঝলাম কিন্তু তোমার ফোন কোথায়?’
ফোনের কথা মনে পড়তেই ইহান পকেট থেকে ফোন বের করে। ফোন বের করতেই সে অবাক। ৫২ টা মিসডকল উঠে রয়েছে। ফোন সাইলেন্ট থাকায় সে টের পায়নি।
–‘সরি বাবা আসলে ফোনটা সাইলেন্ট ছিল। কোন সমস্যা হয়েছে? এতবার কল কেন?’
ইরান কিছুটা চিন্তিত স্বরে বলে। কিন্তু নাজমুল সাহেব তার কথার উত্তর দেয় না। সে ইরানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা টিনার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করে,
–‘ওর ফোন না হয় সাইলেন্ট ছিল, তোমার ফোন কোথায়?’
আসলে ইরা টিনাকেও অনেকবার কল করেছে কিন্তু টিনা ইচ্ছে করে কল ধরেনি। সে ভেবেছিল কল ধরলে হয়তো তাদেরকে দ্রুত ফিরে আসার জন্য বলবে। কিন্তু সে ইরানের সাথে কিছুটা সময় কাটাতে চেয়েছিল। তাই সে ইচ্ছে করে কল ধরেনি।
–‘আ…আসলে আমি খে.. খেয়াল করিনি।’
আমতা আমতা করতে লাগল টিনা।
–‘কাল সকালে বাড়ি ফিরে যাবে তুমি। আশা করি দ্বিতীয়বার আর বলতে হবে না।’
নাজমুল সাহেবের কথা শুনে টিনার মুখটা ছোট হয়ে গেল। সে শুধু মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।
–‘এটা কেমন কথা বাবা! এভাবে কেন বলছ?’
ইহান কিছুটা অবাক হয়ে জানতে চাইল। কিন্তু এবারও নাজমুল সাহেব চুপ রইলেন। ইহান কোন উত্তর না পেয়ে নিজ রুমের দিকে চলে গেল। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে গিয়ে তার ইচ্ছার কথা মনে পড়ল। মেয়েটা কোথায় গেল? শরীর ঠিক আছে তো? আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত একবারও সামনে আসেনি। হঠাৎ কিছু একটা ভাবতেই ইরানের বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। ইরা কেন অতবার কল কেন দিয়েছিল? ইচ্ছের কিছু হলোনাতো? কথাটা ভাবতেই তার বুক ভারী হয়ে এলো। দ্রুত পায়ে ইরার রুমে গেল।
–‘ইরা! রুমে আছিস?’
–‘হ্যাঁ ভাইয়া ভেতরে আয়।’
ইহান ভেতরে ঢুকে প্রথমেই পুরো রুমে চোখ বুলায়। কিন্তু না সে কোথাও ইচ্ছেকে দেখতে পায়না। ইহানের বুকটা ধক করে ওঠে। তবেকি সে যা ভেবেছিল তাই সত্যি?
–‘তোর ভাবী কোথায়? কোথাও দেখছিনা যে?’
ইরা এবার ভাইয়ের দিকে তাকালো। ভাইকে কেমন অস্থির দেখাচ্ছে। ইরা ভেবেছিল ইহানকে সে কিছু কঠিন কথা শুনাবে। কিন্তু তার অস্থিরতা দেখে তার আর ভাইকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা হলোনা।
–‘এটা বলার জন্যই তোমায় কল দিয়েছিলাম ভাইয়া। তখন যদি কলটা ধরতে তাহলে হয়তো ভাবি এখন এখানেই থাকত।’
কথাটুকু বলে থামল ইরা। ইহান তখন ইরার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে। থাকতো মানে? ইচ্ছে কি তবে এখানে নেই? কোথায় তাহলে? এত এত প্রশ্ন যেকে ধরে ইহানকে।
–‘কোথায় ইচ্ছে?’
ইহানের প্রশ্নে ইরা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করে,
বিকেলে তারা বের হওয়ার কিছু সময় পরেই ইচ্ছের বাবা মোশাররফ মোড়ল আসেন। সাথে হাসান ও এসেছে। মূলত হাসানকে ইচ্ছের শশুর বাড়ির লোকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যই আসা মোশাররফ মোড়লের। হাসান সামনের মাসেই জার্মান চলে যাবে। যাওয়ার আগে একবার ইচ্ছের শ্বশুর বাড়ির দেখে যেতে চেয়েছে। ইরা তখন রেডি হয়ে বের হচ্ছিল। কিন্তু তাদের দেখে সে আর বাহিরে যায় না। বাড়িতে মেহমান রেখে বাহিরে বের হওয়াটা বেমানান লাগে। তাই সে আমাদের জন্য হালকা চা নাস্তা তৈরি করে নিয়ে আসে। নাজমুল সাহেব তখন বাড়িতেই ছিলেন। তারা সকলে মিলে গল্প করছিল। কিছুক্ষণের মাঝেই ইচ্ছে ফিরে আসে। এই মুহূর্তে ইচ্ছেকে দেখে সবাই অবাক হয় কারণ তারা বের হয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি।
–‘কিরে মা এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি যে? ঘোরা শেষ?’
ইচ্ছে ভাঙ্গা মন নিয়ে বাসায় পৌছে নিজের বাবাকে দেখে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারেনা। এই ছোট্ট মনটা ভাঙতে ভাঙতে সেখানে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সে এ পর্যন্ত কাউকে জানতে দেয়নি তার আর ইহানের ব্যাপারে। সবাই তাদের একটি সুখী দাম্পত্তি ভাবত। সে ঐ মূহুর্তে সকলের সামনে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ধুকড়ে কেঁদে উঠে।
–‘বাবা প্লিজ আমাকে তোমার সাথে নিয়ে চলো। এখানে থাকলে এবার আমি মরে যাব। আমার মনের সাথে সাথে আমার দেহটাও মরে যাবে।’
ইচ্ছের এমন আহাজারি মোশাররফ মোড়লের হৃদয় নাড়িয়ে তুলে। তার মেয়ে কি তবে এখানে ভালো নেই? সে কি ভুল জায়গায় মেয়ে বিয়ে দিল? নাজমুল সাহেব, শারমিন বেগম তারাও অবাক হয়ে যায়। হঠাৎ মেয়েটার কি হলো? এসব কেন বলছে?
–‘ইচ্ছে! মা আমাকে বল কি হয়েছে? বাবাকে শুধু একবার বল মা।’
ইচ্ছে তখনও কেঁদে চলছে। প্রত্যেকটা মেয়েরই সবথেকে প্রিয় চরিত্র তাদের বাবা। বাবার সংস্পর্শে থাকলে তারা আরো বেশি আদুরে হয়ে যায়। সেই বাবাকে যদি দুঃখের সময় পাওয়া যায় তাহলে তার বুকে মাথা রেখে কেঁদেও সুখ পাওয়া যায়।
পরিবেশ কেমন থমথমে হয়ে আছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। হাসান ব্যাথাতুর চোখে ইচ্ছের দিকে চেয়ে আছে। তার পিচ্চিটা এতটা কষ্টে আছে অথচ কখনো কাউকে বুঝাতেই দিল না। সত্যিই তার পিচ্চিটা অনেক বড় হয়ে গেছে।
–‘ভাই সাহেব আপনিই বলেন কি ডিসিসন নিবেন ইচ্ছে ইহানের ব্যাপারে। যতদূর বুঝলাম আপনার ছেলে হয়তো আমার মেয়েকে মেনে নিতে পারছে না।’
বলে মোশাররফ মোড়ল নাজমুল সাহেবের দিকে তাকালেন। নাজমুল সাহেব তখন নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। সে অত্যন্ত লজ্জিত যে সে ইহানের মত ছেলের বাবা এটা ভেবে। তাকে চুপ থাকতে দেখে শারমিন বেগম বললেন,
–‘আমার মনে হয় ইহানকে ডাকা উচিত। তারপর নাহয় একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে।’
এতক্ষণে হাসান মুখ খুলল। এতক্ষণ সে নিরব দর্শকের মত সব দেখেছে।
–‘আমার ও সেটাই ঠিক বলে মনে হচ্ছে। তার থেকেও জানা দরকার তার সমস্যা ঠিক কোন জায়গায়।’
মোশাররফ মোড়ল মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন। ইচ্ছে তখনো তার বাবার বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে চলছে। আজ যে মেয়েটার মন পুরোপুরি ভাবে ভেঙ্গে গেছে!
তখন থেকেই ইহানকে কল করা শুরু হয় কিন্তু লাভ হয়না। ঘন্টা পেরিয়ে যেতেই মোশাররফ মোড়ল উঠে দাঁড়ান।
–‘আজ তবে আসি ভাই সাহেব। আপনাদের ছেলে ফিরলে আপনারা নাহয় তার থেকে সবটা শুনে নিবেন।’
তিনি ইচ্ছের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলেন,
–‘চল মা তোকে এখানে ফেলনা হয়ে পড়ে থাকতে হবেনা।’
তার কথায় শারমিন বেগম চমকে তাকান।
–‘কি বলেন ভাই! ইচ্ছে কোথায় যাবে? ও কোথাও যাবে না।’
শারমিন বেগম ইচ্ছের কাছে এসে ইচ্ছেকে জড়িয়ে ধরে।
–‘এই তুই তোর এই মা কে ছেড়ে কোই যাবি হ্যা? তোর কষ্ট হবেনা এই মাকে ছেড়ে থাকতে? তোকে ইহানের সাথে থাকতে হবেনা তুই আমার কাছে থাকবি।’
বলতে বলতে শারমিন বেগম এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন। কিন্তু মোশাররফ মোড়ল তার কথাতেই স্থির ছিলেন। সে তার মেয়েকে কিছুতেই এখানে রেখে যাবেননা। শারমিন বেগমের কান্নায় ইচ্ছের মন গলেছিল। সে বাবাকে সাহস করে বলেওছিল,
–‘বাবা আমি মায়ের কাছে থেকে যাই। মা বাবা ইরা আপু এরা সবাইতো আমায় অনেক ভালোবাসে।’
ইচ্ছের কথাতেও মোশাররফ মোড়ল তার কথার নড়চড় করেননি।
চলবে……..