#দ্বিতীয়_বসন্ত
লেখনীতে: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-৯(বোনাস)
রুদ্ধ নিজের জন্মদিনের দিন ভোর সকালে রিথীকে মেসেজ করে সোজা রিথীদের বাড়িতে চলে যায়। সকাল সকাল চলে যায় যাতে রিথী ভার্সিটিতে যাওয়ার আগে পৌঁছাতে পারে।
রিথী নামাজ পড়ে আবার একটু ঘুমিয়ে নিয়েছিল। সকাল ৭ টায় ঘুম থেকে উঠে অভ্যাস বশত ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখার সময় মেসেজ নোটিফিকেশন দেখে সেটা ওপেন করে। তাতে লিখা,
“এই বসন্তরানী! আজ তো বসন্তের শেষ দিন ও আমার ২১ তম জন্ম বসন্ত। আজও কি এক দিনের জন্য বসন্ত বরণ করবে না!
কবি সুফিয়া কামালের কবিতায় আছে জানো,
‘কুহেলি উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে! তাহারেই পড়ে মনে ভুলিতে পারিনা কোনমতে।’
শীতের রিক্ততা তোমাকে এতোটাই গ্রাস করেছে যে বসন্তকে তুমি বরণ করছো না। ঋতুরাজকে আজ বিদায় জানাতে তাকে বিদায় সম্ভাষণ তো দিতে পারো! তবে তোমার ঋতুরাজ কিন্তু বিদায় নিবে না। সে তুমি যাই করো।”
রিথী স্তব্ধ বিমূঢ় হয়ে বসে রইল। রিথীর মনে হচ্ছে, এটা রুদ্ধ! কারন বারংবার কেউ এভাবে কেনো বলবে? তাছাড়া রুদ্ধ বলেছিলো, ওর জন্মদিন এপ্রিলে। তাহলে রুদ্ধ কি তাকে ভালোবাসে! কিন্তু সে তো বাসে না। রুদ্ধ কেনো নিজে যেচে এক বিধবা মেয়েকেই ভালোবাসতে গেলো?
রিথীর সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। সে ফ্রেশ হতে গেল অতঃপর ডাইনিংয়ে গেল নাস্তা করতে। রিথী সবেমাত্র মুখে এক নলা ভাত নিয়েছে তখনি কলিংবেলের শব্দ হয়। রিথীর কাকি মিসেস তানজিনা দরজা খুলে। উনার রুদ্ধকে চিনতে অসুবিধা হয় না কারন ভাসুরের কাছ থেকে রুদ্ধের ছবি দেখেছে। মেয়ে জামাই বলে কথা! কি করবে ভেবে পাচ্ছে না মিসেস তানজিনা। তিনি রুদ্ধকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে জলদি করে রিথীর মা মিসেস রোজীকে ডাকতে যান।
রুদ্ধ ড্রয়িং রুমে একা বসে আছে মিনিট পাঁচেক হলো। ডাইনিং রুমে রিথী খবরটা পাওয়া মাত্র সে আর ভাত মুখে নিতে পারছে না। রুদ্ধ ড্রয়িংরুমের দেয়ালে চোখ ফিরাচ্ছে বারবার। দেয়ালে প্রজাপতি ও ওয়ালমেট দিয়ে সাঁজানো। পুরো রুমে দুইটা সিঙ্গেল সোফা, একটা ত্রিপল সোফা, টি টেবিল, ডেস্কের মতো কাঠের তৈরি বেধিতে একুরিয়াম রাখা ও একটা দেয়াল সোকেস। বেশ গোছালো। রুদ্ধর চোখ যায় ড্রয়িংরুমের দরজার পর্দার দিকে, সেখানে একটা বছর তিনেকের বাচ্চা পর্দার আড়ালে লুকিয়ে আছে। রুদ্ধ সোফা থেকে উঠে বাচ্চাটার কাছে যায় তারপর হাঁটু ভেঙে বসে বাচ্চাটার গাল ধরে বলে,
–তোমার নাম কি বাবু?
বাচ্চাটা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। মেয়ে বাচ্চা হলে হয়তো ভয়ে চলে যেতো তবে বাচ্চাটা ছেলে তাই সে অচেনা আগুন্তককে যাচাই করছে। রুদ্ধ আবারো বলে,
–তোমার নাম বলবে না? আচ্ছা আগে আমি আমার নাম বলছি। আমার নাম রুদ্ধ শেখ। এবার তোমার নাম বলো?
পিচ্চিটা সাহস পেলো। সে তার আধোআধো বুলিতে বলে,
–আমাল নাম ছেহনেওাত তুজ। (শেহনেওয়াজ তূর্য)
বাচ্চাটার নাম শুনে রুদ্ধ ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। তখন মিসেস রোজী কিছু নাস্তা যেমন দুই ধরনের ফল, ভাপা-পিঠা, আর কফি বানিয়ে আনে। মিসেস রোজী সহাস্যে বলে,
–তুমি কিছু মনে করো না বাবা, ও এখনো ঠিক করে উচ্চারন করতে পারে না। ওর নাম, শেহনেওয়াজ তূর্য। সে কিন্তু তোমার শালা হয় সম্পর্কে। কয়েকমাস পর চার বছর হবে ওর।
পিচ্চিটা তার জেঠিকে বলে,
–ও বলআম্মি(বড়আম্মু), এই লোকটা কে?
মিসেস রোজী খাবার গুলো টেবিলে রেখে তূর্যকে কোলে তুলে নেয়। এরপর বলে,
–এটা তোমার একটা ভাইয়া। তোমার বড় আপুর বর সে।
তূর্য তার জেঠির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলে,
–বলআপিল(বড় আপি) তো একটা বল(বর) আতে(আছে)। নিদ(নিদ্র) ভাইয়া।
মিসেস রোজী কিভাবে বাচ্চাটাকে বুঝাবে ভেবে পেলো না। আর রুদ্ধও চুপ করে আছে। মিসেস রোজী রুদ্ধকে খেতে বলে তূর্যকে কোলে করে নিয়ে চলে যায়। মিস্টার বাশার একটু মর্নিং ওয়াকে গিয়েছিলেন সে বাড়ি ঢোকার পর রুদ্ধ আসার খবরে ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসে। রুদ্ধ তার শ্বশুরের সাথে কুশল বিনিময় করে। মিস্টার বাশার রুদ্ধের দিনকাল কেমন যাচ্ছে তা জিজ্ঞেসা করে। তারপর রুদ্ধ বলে যে, সে রিথীকে নিয়ে একটু ঘুরতে যেতে চায়। মিস্টার বাশার আপত্তি করে না। মেয়ে জামাই মেয়েকে নিয়ে একটু বেরোবে তো সমস্যা তো নেই। মিস্টার বাশার রুদ্ধকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে ভিতরের ঘরে চলে যায়।
রুদ্ধরে সাথে রিথীর বোনেরা, কাকা ও কাকি শুভেচ্ছা বিনিময় করে। মিস্টার বাশার রিথীকে বুঝায় রুদ্ধের সাথে যাবার জন্য। রিথী না পারতে রাজী হয়। রুদ্ধ এরপর সকলের সম্মতি নিয়ে রিথীকে নিয়ে বেরোয়। রুদ্ধ নিজের গাড়ি এনেছে তাই ড্রাইভিং সে নিজেই করবে। রিথীকে ফ্রন্ট সিটে বসিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে।
রিথী একটা হলুদ ও লালের মিশেলে থ্রিপিস পড়েছে। পুড়োই রাধাচূড়া ফুলের মতো সাঁজ। বসন্তের কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়া ফুলের সমারোহে গাছ ও রাস্তায় বিছানো থাকে। রিথী জানালা দিয়ে বাহিরের দৃশ্য দেখছে। আর রুদ্ধ মাঝে মাঝে আড় চোখে রিথীকে দেখছে। রিথী হলুদ-লাল থ্রিপিসের সাথে হলুদ হিজাব পড়েছে। মুখে ক্রিম, পাউডার, কাজল ও লিপস্টিক ছাড়া আর কোনো সাঁজ নেই। হাতে ঘরি পড়েছে শুধু। আর রুদ্ধ একটা সাদার মধ্যে লাল সুতার কাজ করা পাঞ্জাবি পড়েছে। চুলগুলো কপালে এসে পরে আছে রুদ্ধর।
ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে এসে থামে ওরা তারপর গাড়ি পার্ক করে লেকের পাশের এক নিরিবিলি বেঞ্চে গিয়ে বসে। রিথী এক দৃষ্টিতে লেকের পানির দিকে তাকিয়ে আছে। রুদ্ধই নিরবতা ভেঙে বলে,
–আজ আমার জন্মদিন। উইশ করবে না?
রিথী তাকায় রুদ্ধের দিকে এরপর স্মিত হাসি দিয়ে বলে,
–শুভ জন্মদিন।
রুদ্ধ রম্য স্বরে বলে,
–শুধু এটুকুই! এটাও বলো যে, যেনো আমার মন বাসনা পূরন হয়।
রিথী ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
–তোমার মন বাসনা যদি যুক্তিসহ হয় তো হবে। তবে অহেতুক কিছু পূরন হয় না।
রুদ্ধ সম্মোহিত গলায় বলে,
–আমার মন বাসনা তো তুমি বসন্তরানী!
চমকে তাকায় রিথী। সে ধারনা করতে পেরেছিল হয়তো ওই মেসেজ গুলো রুদ্ধ করে। আর এখন তো শিওর হয়ে গেলো। রিথী চমকানো স্বরে বলে,
–তুমি আমাকে মেসেজ করতে? কিন্তু কেনো?
রুদ্ধ রিথীর কানের মুখ এগিয়ে ফিসফিস করে বলে,
–আমার বউ! আমি মেসেজও করতে পারবো না? বউয়ের সাথে তো সব করা যায়েজ। তাইনা বসন্তরানী!
রিথীর শরীর মৃদু কেঁপে উঠে। এই ছেলের কথাবাত্রা জানি কেমন!
রিথীকে আচানক কেঁপে উঠতে দেখে রুদ্ধ বলে,
–আমি ছোঁয়ার আগেই এতো কাঁপাকাঁপি? তাহলে যখন আমি তোমাকে…
রুদ্ধ আর বাক্যটাকে সম্পূর্ণ করে না। রিথী কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে,
–দেখ আমি তোমার বয়সে বড় তাই কথা বুঝে বলবে।
রুদ্ধ হাই তুলে বলে,
–উহু। তুমি আজকে আমাকে “তুমি” সম্ভোদনে বলেছো কিন্তু তোমার মুখে “আপনি” সম্ভোদনটাই বেশি সুন্দর। কারন আমার তোমাকে “আপনি” বলা উচিত তবে সেটা তুমি আমায় বলবে আর আমি তোমাকে “তুমি” করে বলবো। আর তোমাকে দেখে মনে হয়না তুমি অতো বড়। বড় হও বা ছোট হও তুমি আমার বউ তাই আমি তোমাকে যে নামে খুশি বলবো। আমার বউ তুমি। হুহ!
রিথী বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। আসলেই এই ছেলের নামের মতোই কাউকে বাকরুদ্ধ করার মতো ক্ষমতা আছে। রিথী আর কিছু বলে না। এরপর ওরা দুজন আশেপাশের ফাস্টফুড খেয়ে ঘোরাফেরা করে। দুপুরের লাঞ্চ করে রুদ্ধর নিজের বাসায়। রুদ্ধ তার মায়ের সাথে রিথীর সখ্যতা করানোর জন্যই নিয়ে যায়। বিকেলে রুদ্ধ রিথীকে বাড়ি পৌঁছে দিতে গেলে সেখানেই রাতে সবার জোরাজোরিতে থেকে যায়। রিথী বলেছিল চলে যেতে তবে সেটা রুদ্ধর কান পর্যন্ত যায়নি শুধু মিসেস রোজী শুনেছিল। মিসেস রোজী মেয়েকে চুপ করিয়ে দেয় তৎক্ষণাৎ।
রুদ্ধর তো ভাবতেই ভালো লাগছে যে বিয়ের পর প্রথম পহেলা বৈশাখ বউয়ের মুখ দেখে শুরু হবে।
চলবে ইনশাআল্লাহ,