দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব -১২ ও শেষ পর্ব

#দ্বিতীয়_বসন্ত
লেখনীতে: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-১২(শেষ)
“কোনো এক শুক্ল প্রহরে,
এলে তুমি হৃদয়হরণী!
কৃষ্ণপক্ষের আঁধারিতে,
ধরিত্রীতে তুমি আমার বসন্তরানী!”
_______তিথি

ছন্দটা একা একা আউরিয়ে রুদ্ধ কৃষ্ণ অন্তরিক্ষে নজর বুলায়। আজো অমাবস্যা। চন্দ্রমা আজ নেই তাই তারকাখচিত আকাশ একটা কালো চাদরের মতো মনে হচ্ছে। কালো চাদরে কেউ যেনো কিছু জ্বলজ্বল করা পাথর দিয়ে সাঁজিয়েছে তাই মনে হচ্ছে।
রিথীকে বাড়ি পৌঁছে আসার পর থেকে আকাশের দিকে তাকিয়েই বসে আছে রুদ্ধ। তার মা খেতে ডেকে গেলেও খেলো না, সন্ধ্যাতে ভারি নাস্তা করেছে বলে। ঘড়ির কাঁটায় এখন রাত ১২.১৭ মিনিট। তার মানে ২৯ সেপ্টেম্বর দিনটা শেষ। রিথীকে কি মেসেজ করবে? এটাই ভাবছে। কিছুক্ষণ ভেবে, এতোক্ষন আউরানো ছন্দটা টেক্সট করে দেয়।

রিথীও তখন ব্যালকনিতে ছিলো। রুদ্ধের পাঠানো ছন্দটা দেখে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে মলিন হাসি ফোঁটে। নিজেও একটা ছন্দ ভাবে আর সেটা পাঠায়,

“বহু প্রতিক্ষিত সে,
দূর অজানায় তার বাস!
রাত-দিন আঁধার আমার,
আজও তারই ফেরার আভাস।”
______তিথি

রিথী জানে এটা দেখে রুদ্ধর খারাপ লাগবে তবে এটাই তার মনকুটিরের ছন্দ যা সে উপেক্ষা করতে পারে না। হলোও তাই! রুদ্ধর হৃদয় ক্ষরিত হলো অদৃশ্য ব্যাথায়। রুদ্ধ আর কোনো মেসেজ না করে বসে থাকে। মিনিট দশেক পর রুদ্ধর ফোনের মেসেজ টোন বাজে। রুদ্ধ সেটা ওপেন করলে দেখে সেখানে লেখা,

“সে ফিরবে না জেনেও ভালোবাসি ও বাসব। তবে যে আমার অপেক্ষায়, তাকে ফেরাবো না। তার ভালোবাসার স্নিগ্ধ মায়ায় একসময় আমিও জড়িয়ে যাবো। আমার জীবনে দ্বিতীয় বসন্ত হওয়ার জন্য ধন্যবাদ!”

রুদ্ধর মনে খুশির ঢেউ খেলে যায়। তার বসন্তরানী তাকে গ্রহণ করেছে। তার ভালোবাসাকে সাদরে গ্রহণ করেছে। রুদ্ধ এতোটাই খুশি যে সে রিথীকে কল করে বসে।

রিথী কল রিসিভ করে খানিক সময় চুপ রয়। বিপরীতে রুদ্ধও চুপ রয়। তবে রুদ্ধর খুশির প্রতিধ্বনি হিসেবে আনন্দের শ্বাস-প্রশ্বাসের ধ্বনি রিথী শুনতে পাচ্ছে। রিথী মুচকি হেসে বলে,

–উহুম! পিচ্চি ছেলে তাহলে খুব খুশি! নাচতে নাচতে হাত-পা ভাঙবে না তো! দেখো কিন্তু! আমি কিন্তু ল্যাংড়া ছেলের সাথে থাকবো না। এটা বলে দিলাম।

ফোনের অপরপাশে রুদ্ধর কপালের ভাঁজ গাড়ো হচ্ছে সে রিথীকে বলে,
–তোমাকে মানা করেছি না, আমাকে পিচ্চি বলবা না। মাত্র তিন মাসের ছোট তোমার। আমাকে আপনি করে বলবা। বুঝতে পেরেছো? নাহলে পরেরবার বললে মুখ বন্ধ করার নিঞ্জা টেকনিক জানা আছে।

রিথী ডোন্টকেয়ার ভাব নিয়ে বলে,
–কিভাবে?

রুদ্ধ দুষ্ট হাসে। তারপর ফিসফিসিয়ে বলে,
–তোমার ঠোঁট দুটোকে নিজের করে নিবো!

রিথীর শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। ছেলেটা এতো বেঁফাস কথা কেনো বলে! রিথী মৃদু শব্দে বলে,

–দেখুন! আপনি এধরনের কথা বলবেন না। মুখে লাগাম দিন। হুহ! যতোসব বাজে কথা!

রুদ্ধ নিঃশব্দে হাসে। তারপর বলে,
–আমার বউকেই বলছি। অন্য কাউকে তো বলি নাই। তাই আমাকে বাজে বলবা না।

এভাবে কিছুক্ষণ কথা বলার পর কল কেটে দেয়। রুদ্ধর মনে ভালোবাসা পাবার খুশি আর রিথীর নতুন বসন্ত বরণের ও তার জন্য পুরাতনের পাশেই এক নির্দিষ্ট জায়গা তৈরির প্রচেষ্টা।

_____________
দেখতে দেখতে আবারো প্রকৃতিতে বসন্ত ঋতু এসে গেছে। চৈত্র মাস বাংলা বর্ষপঞ্জীতে। আজ রুদ্ধ ও রিথীর প্রথম বিবাহবার্ষিকীর আগের দিন আর রিথী ও রুদ্ধের হলুদ সন্ধ্যা। প্রথম বিবাহবার্ষিকীতেই ওদের আনুষ্ঠানিক বিয়ে হবে। এই কয়েকমাসে রিথী রুদ্ধকে মেনে নিয়েছে। রিথীর মনে এখন নিদ্র ও রুদ্ধ সমস্থানে অবস্থানরত। রুদ্ধর এতো ভালোবাসাই বাধ্য করেছে রিথীকে রুদ্ধর প্রতি ভালোবাসা অনুভব করতে। রুদ্ধ তার বসন্তরানীকে তার ভালোবাসার বসন্তে ঠিক আগমন করিয়েছে।

হলুদ জামদানি শাড়ি ও কাঁচা ফুলের গহনায় সজ্জিত রিথী। এখন ওকে স্টেজে নিয়ে যাবে। রিথীকে নিয়ে যেতে রিনি, রিথীর বান্ধুবী রিয়া, জান্নাত ও মালিহা এসেছে। সানভিকে মালিহা এনেছে তবে সারিকাকে আনেনি। সানভির জন্য সানভির মা কানাডার এক বাঙ্গালি ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে। সানভির উডভির নাম “শারাফ রিজোয়ান”। শারাফ পেশায় সাইকাট্রিস্ট। শারাফও সানভির সাথে এসেছে এখানে। সানভির ক্রেডিট ট্রান্সফার করে কানাডা নিয়ে যাবে শারাফ।

রিথী ওদের সাথে বের হতে নিবে তখনি রুদ্ধর কল আসে রিথীর ফোনে। বাকিরা ফোনের স্ক্রিনে রুদ্ধর নাম দেখে রম্যাত্নক হয়। ওদের রম্যতা দেখে রিথীর লজ্জা লেগে যায়। রিথী ওদের থেকে দূরে ব্যালকনিতে গিয়ে কল রিসিভ করে বলে,

–এখস কল করছেন কেনো? আমি স্টেজে যাবো এখন। কথা বলার সময় নেই।

রুদ্ধ কাঁদো স্বরে বলে,
–রাদিয়া(রুদ্ধর বোন) ও বাকি কাজিনরা আমাকে রেখে তোমাদের ওখানে চলে গেছে। আমাকে সাথে নেয়নি। তুমিই বলো! আমার বউকে আমি হলুদ লাগাবো না?

রিথীর হাসি পেয়ে যায় রুদ্ধের এমন বাচ্চাদের মতো কাঁদো কাঁদো ভয়েন শুনে। রিথী খানিকটা জোড়ে হেসে ফেলে। রিথীর হাসি শুনে ফোনের অপরপাশে রুদ্ধ ঠোঁট উল্টে ফেলে। রিথী একটু মজা করে বলে,

–আহাগো! সোনাগো! বড্ড কষ্ট হচ্ছে বলো!

রুদ্ধ এবার কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
–খুব হাসি পাচ্ছে তোমার তাই না! নো চিন্তা বেইবি! আই এম কামিং। আমি অলরেডি ড্রাইভিং করছি। আমি সহ আমার কিছু বন্ধুরাও আছে। তোমার সামনে হাজির হবো আর পনেরো মিনিট পর। ততোক্ষণ তুমি স্টেজে যাবে না।

রিথীর মন হঠাৎ আঁতকে উঠে। হারানোর ভয় ওর মনে। রিথী কঠোর স্বরে চিল্লিয়ে বলে,

–স্টপ দা কার! স্টপ দা কার রাইট নাউ!

রুদ্ধ বেকুব হয়ে যায়। কারন জিজ্ঞেস করলে রিথী বলে,
–তোমার বন্ধুদের কাউকে বলো ড্রাইভ করতে। তুমি ড্রাইভ করবে না। এখনি ড্রাইভিং ছাড়ো।

রুদ্ধ অবাক হয়ে যায়। ও ড্রাইভ করলে কি সমস্যা? কিন্তু রিথীর জোড়ালো কথায় মানতেই হলো। রুদ্ধের এক বন্ধু ড্রাইভিংয়ে গেলো। রিথীও ক্ষান্ত হলো।
পনেরো মিনিট পর রুদ্ধ এলো আর রিথীও স্টেজে গেলো। প্রথম হলুদ রিথীর গায়ে রিথীর বাবা-মা দিলো তারপর রুদ্ধ হলুদ দিয়ে আবার নিজের বাড়িতে চলে যায়।

হলুদে নিদ্রর পরিবারো এসেছিল। তারাও রিথীর জন্য দোয়া করে। খুব সুন্দর করে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হয়। একটু জলদিই শেষ করো কারন রিথী রাত জাগবে না বেশি। তাই শেষ করে দ্রুত। এরপর রিথীর হাতে ওর কাজিন ও বান্ধুবীরা মেহেদী আঁকে আর রিথী মেহেদীর দুই হাতের এক পাতা শুকোনোর পর দুই হাতের আরেক পাতায় দেওয়ার সময় ঘুমিয়ে গেছে। ওরা ঘুমন্ত রিথীর হাতেই বাকি ডিজাইন করে।

______এসে গেছে কাঙ্খিত মূহুর্ত। রিথী লাল বেনারসিতে ও ব্রাইডাল লুকে নিজেকে সাঁজিয়েছে। রুদ্ধও সোনালি শেরওয়ানীতে। দুজনকে চোখ ধাঁধানো সুন্দর লাগছে। কাজি কবুল বলতে বললে রিথী সময় নিয়ে কবুল বলে আর রুদ্ধের যেনো ট্রেন ছুটে যাচ্ছে তাই কাজি বলতে দেরি কিন্তু রুদ্ধের কবুল বলতে দেরি নেই। সবাই এটা নিয়ে অনেক হাসে।

অপরদিকে কিছুটা দূর থেকে সানভি রিথী ও রুদ্ধের হাসি ভরা মুখ দেখছে। ওর কষ্ট হচ্ছে। চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা অশ্রু পড়লে শারাফ তার হাত দিয়ে মুছে দেয়। সানভিও তাকায় শারাফের দিকে। শারাফ নিজে সানভির কাউন্সিলিং করছে। সানভির সত্যটা মানে সানভি যে রিথীকে সুইসাইড করতে বাধ্য করেছিল পরোক্ষ ভাবে সেটা রুদ্ধ যখন জানতে পারে তখন রুদ্ধ পুরো ভরা ক্যাম্পাসে সানভিকে থাপ্পড় মারে ও অপমান করে।

সানভি ও সারিকা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। সারিকাই সানভিকে উস্কাচ্ছিল। তখন রুদ্ধর এক বন্ধু শুনে ফেলে আর রুদ্ধকে বলে। তারপর ভরা ক্যাম্পাসে দুজনকে থাপ্পড়!

ওইদিনের পর থেকে সানভি নিজের ঘরে ভাংচুর করতো আর রিথীকে মেরে ফেলবে এমন সব কথা বলতো। সানভির মা তখন কানাডা থেকে শারাফকে আসতে বলে। এরপর থেকে শারাফ সানভিকে কাউন্সিলিং করছে।

_____________________________________________
কনে বিদায় সন্ধ্যাতে হয়েছে। কান্না করে রিথী ও রিথীর পরিবারের বেহাল দশা। সন্ধ্যার ফ্লাইটে করে রিথী ও রুদ্ধ চট্টগ্রাম চলে যায়। চট্টগ্রামে নিদ্রদের পারিবারিক কবরস্থানে নিদ্রর কবরের সামনে যায় রিথী ও রুদ্ধ। রিথী কনে সাঁজে ও রুদ্ধ বর সাঁজে। রিথী কবরটার দিকে তাকিয়ে থাকে আর চোখ দিয়ে অশ্রকণারা ঝরতে থাকে। রিথী বলে,

–দেখো নিদ্র, আজ আমি বউ সেঁজেছি। তোমার তো আমাকে বউ সাঁজে দেখার ইচ্ছে ছিল। দেখো তোমার এংড়িবার্ডকে সুন্দর লাগছে না? আবার বিয়ে করছি বলে যে তোমায় ভুলে যাবো তা কিন্তু না। আমার মনে এখন তুমি ও রুদ্ধ পাশাপাশি আছো। দুজনকেই আমি ভালোবাসি। একজনকে ভাগ্য ছিনিয়ে নিলো আর আরেকজনকে পাইয়ে দিল দ্বিতীয় বসন্ত রূপে। আমার জন্য ওপাড়ে অপেক্ষা করো। আমার সময় হলে আমি চলে আসবো। ওপাড়ে ভালো থেকো ভালোবাসা!

রিথী আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ায় না। রুদ্ধকে ছেড়েই কবরস্থান থেকে বেড়িয়ে যায়। মহিলারা কবরস্থানে যেতে পারে না তবে এটা পারিবারিক তাই রিথী যেতে পেরেছে। রিথী চলে গেলে রুদ্ধ নিদ্রর কবরের দিকে তাকিয়ে বলে,

–আপনি চিন্তা করবেন না নিদ্র, আমি আপনার এংড়িবার্ডকে আমার বসন্তরানী রূপে সারাজীবন আগলে রাখবো। আপনাকে সে কখনো ভুলবে না। আমার মাঝে সে আপনাকে পাবে। নিজেকে আপনার মতো অনেকটা বানিয়েছি জানেন! যেমনঃ আগে কেউ কিছু বললে সাথে সাথে জবাব দিতাম। এখন তা করি না রিথীর বেলায়। আগে ঝাল খেতে পারতাম না কিন্তু এখন ঝাল খাওয়া শিখে গেছি। নাহলে বলেন, আমি শুকনো মরিচ কিভাবে খাই! বন্ধুদের সাথেও আমি ঝাল খাওয়ার কম্পিটিশনে জিততে পারতাম না। ঝাল খেলে আমার পরে সব বমি করে বের করে দিতে হতো। আচ্ছা সে যাইহোক! আপনি ভালো থাকবেন।

রুদ্ধও চলে যায়। কবরস্থানের বাহিরে গিয়ে রিথীর হাত ধরে আগে থেকে ক্যাব বুক করে রেখেছে সেটাতে উঠে ওরা পতেঙ্গা সিবিচে যায়। সেখানের একটা হোটেলে থাকবে আজ রাতে ওরা। পতেঙ্গা বিচে গিয়ে সমুদ্রতটে দুজন হাত ধরে হাঁটতে থাকে।
ভালোবাসাময় এক দ্বিতয় বসন্তের সাথে রিথী তার বাকি জীবন পাড়ি দেওয়ার পদচারণা। রুদ্ধ তার বসন্তরানীর হৃদয়ে বসন্ত আনতে পেরেছে। এনেছে দ্বিতীয় বসন্ত!

______________________সমাপ্ত___________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here