#মুহূর্তে
পর্ব-১১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
কথন চোখ সরিয়ে নেয়। কবিতার সিটবেল্ট লাগিয়ে আবার নিজের সিটে বসে উওর দেয়, “সিটবেল্ট লাগাচ্ছিলাম। শুনো, বিয়ে ক্যান্সেলের ব্যাপারটা কি কয়েকমাস পরে বললে ভালো হয়?”
“হঠাৎ?”
“আমি চারমাস পর আমেরিকা যাচ্ছি আগের ইন্টারশিপ করার জন্য। আবার আমার ছোট বোনের বিয়ে। এর আগে অন্যকোথাও মেয়ে না দেখতে পারে এইজন্যই বলা। আমার বিয়ে করার মোটেও ইচ্ছা নেই।”
“আমার সমস্যা নেই। আমার জন্যও ভালো হবে। আচ্ছা আপনার বাসায় যেতে কতক্ষণ?”
“আধাঘন্টা।”
“তাহলে আপনার প্রেমকাহিনীটা শুনা যায়। ওদিন বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমার মুড ছিলো না। আজ সময় আছে। আপনি বলুন আমি খেতে থাকি।”
কথনের আজ কবিতাকে তার অতীত শোনাতে মোটেও মন চাইলো না। কারণটা না জানায় সে জোর করেই কবিতাকে বলে গল্পটা তবে ছোট করে, “ওর নাম উর্মি ছিলো। কলেজে একসাথে পড়তাম। ও একদিন আমাকে প্রেমপত্র দেয়। উর্মি দেখতে খুব সুন্দর ছিলো। আমাদের কলেজের সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে ছিলো। তাই আমিও এক্সেপ্ট করে নিলাম। তারপর কথা বলতে বলতে আমারও ভালো লেগে যায়।”
কবিতা মুখে খাবার রেখেই বলে, “সুন্দর দেখে প্রেম করলেন? জানেন এমন রূপ দেখে প্রেম করলে প্রেম টিকে না। রুপ দেখে তো আর ভালোবাসা হয় না।”
কথন হাসে, “তাহলে প্রেমগুরু আপনি বলেন কীভাবে ভালোবাসা হয়?”
“আসলেই তো ভালোবাসা কীভাবে হয়?” ভীষণ চিন্তায় পড়ল কবিতা। তারপর হঠাৎ তার মনে হল তীর্থের গভীর চাহনির কথা। তার ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি এঁকে উঠে। সে বলে, “হয়তো কারও গভীর দৃষ্টি যখন অন্তরে যেয়ে গেঁথে যায় তখন তার ভালোবাসায় ডুবে যেতে ইচ্ছে হয়।”
কথন আড়চোখে কবিতার দিকে তাকালো। তাকে এভাবে হারিয়ে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কাউকে ভালোবাসো না’কি?”
কবিতা অপ্রস্তুত হয়ে নড়েচড়ে বসল। মাথা নিচু করে বলল, “এমন কিছু নয়।”
কথোপকথন বাড়ায় না কথন। কবিতার সাথে তার আসলে বিয়ে করার তো কোনো ইচ্ছা নেই। তাহলে অকারণে কারও ব্যক্তিগত জীবনে ঘাটাঘাটি করার মানে হয় না।
কবিতা এক চামচ পেস্ট্রি এগিয়ে দিয়ে বলে, “আমি খাইয়ে দেই নিন। কেকটা অনেক মজার।”
“এটাকে কেক বলে না।”
“কেক বলে না?” বিস্মিত গলায় বলে কবিতা, “আমি তো জানতাম কেক-ই বলে। কেক না বললে কি বলে?”
“ডায়বেটিস।”
কথনের কথা শুনে মুখ বানায় কবিতা। কথন আবারও বলে, “কত মিষ্টি এইখানে জানো?”
“আপনাকে বিয়ে না করার জন্য আরেকটা বাহানা পেলাম অনুকে দেবার জন্য। আপনার সাথে বিয়ে করানোর জন্য ও পাগল হয়ে গেছে। আপনি তো ডাক্তার। আপনার সাথে বিয়ে করলে কিছু খেতে নিলেই মানা করবেন। আর আমার খাবার অনেক পছন্দ। বিশেষ করে মিষ্টি খাবার।”
সম্পূর্ণ রাস্তায় কোনো প্রকার নিরবতা ছিলো না। দুইজনের মাঝে অনেক কথা হয়। সব অহেতুক কথা-বার্তা। কিন্তু বাসায় যেয়ে দুইজন কোনো কথাই বলতে পারে না। কবিতাকে কথনের মা এবং বোনেরা ছাড়েই না। মেয়েটা এমনিতেই বাঁচাল। নিজের কথার মাঝে তিনজনকে বেঁধে রাখে। কথন তার মা এবং ছোটবোনকে কবিতার সাথে মিশতে দেখে বেশি অবাক না হলেও তার বড় বোনকে যখন দেখে কবিতার সাথে হেসে হেসে আলাপ করছে তখন সে অবাক না হয়ে থাকতে পারে না। তার বড়বোন গম্ভীর ও শক্ত ধরনের মেয়ে। কথন এবং কথনের ছোট বোন জবার সাথে সে কবে এমন হেসে কথা বলেছিলো তার মনে পড়ে না। তবে তাকে দেখে মনে হলো সে কবিতার সাথে কথা বলে ভীষণ খুশি। কথন সেখানে বেশিরক্ষণ বসে না। ভোরে কাজে হাস্পাতালে গিয়েছিল সে। এখন সে ক্লান্ত। তাই নিজের রুমে যেয়ে ঝটপট করে শাওয়ার নিয়ে নিলো।
কবিতা কথনের বাসায় এসে অবাক হয়ে যায়। এত সুন্দর পরিপাটি বাসা সে আগে দেখে নি। বাসাটা একদম সাধারণ রাখা। বেশি আসবাবপত্র দিয়ে ভরা না। কিন্তু অন্যরকম মাধুর্যে ভরা। সাধারণের মাঝেও অসাধারণ। বাসাটার প্রতিটি রুমে কথনের মা’য়ের হাতে গড়া জিনিস। মাটির জিনিসপত্র, শপিজগুলোতেও বাংলাদেশের গ্রামীণ ছোঁয়া আছে, আর প্রতিটি রুমে রয়েছে অসংখ্য ফটোফ্রেম। ফটোফ্রেমে কথনের মা’য়ের হাতে করা সুতোর কাজের পেইন্টিং। তা দেখে ভীষণ উৎসুক হয় কবিতা। এমনটা সে আগে দেখে নি। কিছু সময়ের মধ্যেই কবিতা সবার সাথে মিশে যায়। অনেক কথা বলে সকলের সাথে। পরে নাস্তা বানানোর কথা বলে কথনের মা এবং বড় বোন উঠে যায়। তার ছোট বোন পড়ার বাহানা ধরে তাকে দিয়ে যায় কথনের রুমে। সে ভালোমতো জানে তাদের উদ্দেশ্যটা কি। কিন্তু এতে বিশেষ কিছু বলে না। কেন যেন, সে কথনের সাথে মোটেও অস্বস্তিবোধ করে না। বিষয়টা অবাক করার মতো। এর পূর্বে কেবল দুইদিন দেখা হয়েছে কথনের সাথে কিন্তু তার সাথে স্বস্তিবোধ করে কবিতা।
কবিতা কথনের রুমে এসে তাকে পায় না। কথন বলেছিলো সে গোসল করতে গেছে। সম্ভবত বের হয় নি। পায়চারি করছিলো কবিতা রুমটায়। কথনের রুমটা সম্পূর্ণ ঘর থেকে একদম ভিন্ন। এইখানে গ্রামীণ কোনো জিনিসপত্র নেই। সবটা মর্ডান ধাঁচের। রুমের রঙটা হাল্কা ধূসর রঙের এবং আসবাবপত্র সব সাদা-কালো। রুমের এককোণে বুকশেলফ রাখা। সেখানে যেয়ে দাঁড়ায় কবিতা। পড়ার বইয়ে সবটা ভরা। এত্ত পড়াশোনা করে কথন! এর মাঝে দশ পনেরোটা উপন্যাসের বই পেল কবিতা। সবগুলো প্রেমের উপন্যাস। একটি বই বের করে খুলল। প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা,
‘এই হৃদয়ের আনাচে-কানাচেতে
তোমার দেখা পাই,
মন ভোলানো রূপকথায়
তুমি বিহীন কেউ নাই।”
লেখাটা দেখেই মৃদু হাসে কবিতা। ডাক্তারবাবু কবিতা লিখতে জানে এই ধারণা তার মোটেও ছিলো না। উপন্যাসের বইয়ের দুই পৃষ্ঠা উল্টে সে দেখতে পায় একই হাতের লেখায় দুটো লাইন লেখা,
‘হৃদয়হরণের এক গল্পকথন
তোমার সে দৃষ্টিতে লেখা আমার মরণ।”
কথন বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখে কবিতা তার বুকশেলফের সামনে দাঁড়ানো তার হাতে একটা উপন্যাসের বই এবং তার ঠোঁটের কোণে গাঢ় হাসি।
“কী করছ?” কথনের কন্ঠে পিছনে ফিরে কবিতা। সাথে সাথে প্রশ্ন করে, “আপনি কাব্য লিখতে পারেন?”
“না।”
“তাহলে এগুলো কে লিখেছে?”
“এগুলো তো কাব্য না। কলেজের দিনে উপন্যাস পড়ার সময় কিছু লাইন মাথায় আসতো তাই লিখে রাখতাম। কলেজের পর থেকে আর উপন্যাস পড়া হয় নি তাই লাইনগুলোও লেখা হয় নি। উর্মির লেখাগুলো পছন্দ ছিলো তাই পড়ে লিখে রাখতে হতো। ওকে প্রেমপত্র দিতে হতো, নাহয় মুখ ফুলিয়ে বসে থাকতো। প্রেমপত্র লেখা এক জ্বালা এবং প্রেম করা আরেক জ্বালা।”
“জ্বালা কেন?”
“বলে বুঝাতে পারব না। অভিমান সহ্য করো, রাগ ভাঙাও, কান্নাকাটি সহ্য করো, সকল আবদার পূরণ করা।প্রথম প্রথম সব ভালো লাগলেও একসময় সবটা বিরক্ত লাগতে শুরু করে। এইসবের কারণে তোমার স্বপ্নের পথ থেকে সরে যাও। মানসিক চাও পড়ে। সময়ের সাথে সাথে ভালোবাসা কমতে থাকে। এই কারণেই আমি মনে করি প্রেম ভালোবাসা কেবল ভ্রম। ভ্রম ছাড়া কিছুই নয়।”
“কাওকে সত্যি ভালোবাসলে কি এ কাজগুলো করতে ভালো লাগে না? ভালোবাসলে তো এইসব বোঝা হয়ে দাঁড়ায় না। কুমিল্লায় আমাদের পাশের বাসায় একটি আপু থাকতো। তার বিয়ের চৌদ্দ বছর হলো। পাঁচ বছর প্রেম করে বিয়ে করেছিলো। অথচ তাদের মাঝে কখনো এমন বিরক্তি দেখতে পাই নি। এমন না তাদের মধ্যে ঝাগড়া হয় না। তিনবেলা খাবার থেকে তাদের মনে হয় ঝগড়া বেশি প্রয়োজন। ছোট ছোট ব্যাপারে ঝগড়া করে অথচ তাদের ভালোবাসা যেন প্রতিদিন বাড়ে। প্রতিদিন দেখে মনে হয় নতুনভাবে প্রেম করছে। আমারও না এমন কাউকে লাগবে, যে আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসবে এবং সারাজীবন ভালোবেসেই যাবে।”
কথন চেয়ারের উপর তোয়ালে রেখে কবিতার কাছে যেয়ে দাঁড়ায়। তার হাত থেকে উপন্যাসের বইটি নিয়ে একটিবার চোখ বুলায় বইয়ে, “প্রেমের গল্পকথা উপন্যাসে মানায়, জীবন কয়েক পৃষ্ঠায় শেষ হয়ে যায় না। আর বাস্তবে কেবল ভালোবেসে জীবন কাটে না।”
“আপনাদের ব্রেকাপ কেন হয়েছিলো?”
“আমার মনে হচ্ছিলো ওর কারণে আমার পড়াশোনা নষ্ট হচ্ছে। সারাদিন ওর এটেনশন লাগবে। কথা না বললে অভিমান করে বসে থাকতো। এমনকি আমার পরিবারের সাথে সময় কাটানোটাও ওর ভালো লাগতো না। তারপর না পেরে আমি বলেছি কয়েকবছরের জন্য ব্রেক নেই। আমি নিজের ক্যারিয়ার গড়ার পর তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাব। সেদিন অনেক চিল্লাচিল্লি করেছিলো। তারপর অভিমান করলো। সে অভিমানেই বিয়ে করে নিলো।”
“মনে পড়ে তার কথা?”
“মাঝেমধ্যে মনে পড়ে। অনেক সময় জুড়ে জীবনের অংশ ছিলো মনে পড়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু কষ্ট হয় না। বিয়ের পর কয়েকদিন খারাপ লেগেছিল কিন্তু একসময় মনে হলো এটাই ভাগ্যে ছিলো। আর যা হয়েছে এতটাও খারাপ হয় নি।”
“আপনি আমার জন্য একটা কবিতা লিখবেন? আমার কবিতা বেশ পছন্দ।” কবিতার কথায় কথন তাকায় তার দিকে। কবিতাকে উৎসুক দেখাচ্ছে। উৎসুক হবার পর তার চোখেমুখে বাচ্চামো ভাবটা এসেছে। অথচ খানিকক্ষণ পূর্বেও গম্ভীর কথাগুলো বলার সময় তাকে পূর্ণবধিত দেখাচ্ছিলো। কথন হাসলো তাকে দেখে, “বললাম তো, আজকাল এইসবের চর্চা নেই। সময় পাই না।”
“ওহ।” নিরাশ দেখায় কবিতা। কথন জিজ্ঞেস করে, “তোমার কবিতা কেন পছন্দ? তোমার নাম কবিতা বলে?”
“আপনি কীভাবে জানলেন? আমার আম্মু আব্বু আমার নাম কবিতা রেখে দিলো অথচ আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে নিয়ে একটা কবিতা লেখে নি। আর আমার তেমন কোনো গুণ নেই। কিন্তু আমার প্রেমের গল্প কবিতা পড়া, সিনেমা দেখা ভীষণ পছন্দের। আপনি প্লিজ আমার জন্য একটা কবিতা লিখবেন? প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”
কথন হেসে বলে, “ঠিকাছে সময় পেলে লিখব।”
কবিতা লাফিয়ে উঠে। তাকে অতিরিক্ত খুশি দেখাল। সে বলল, “কি নিয়ে লিখবেন?”
“তুমি যে বিনা মগজের মেয়ে তা নিয়ে।”
কবিতার উৎসুকভাব নিমিষেই হাওয়া হয়ে যায়, “আপনি তো বেশ বাজে। আপনার কি আমার এমন কোনো কিছু ভালো লাগে নি যে আমার প্রশংসনীয় একটি কাব্য লিখবেন।”
কথনকে হাসতে দেখে কবিতা তার শার্টের হাতা ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে, “কিছু জিজ্ঞেস করছি আমি।” তারপর অহেতুক ক্রোধ দেখানোর জন্য তার ঠোঁট উল্টে নেয়।
কথনের ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমি হাসি। কবিতা বুকশেলফের পাশে দাঁড়ানো। সে কবিতার দুই কাঁধের দুইপাশে হাত দিয়ে তার দিকে একটু ঝুঁকে দাঁড়ায়। সম্মোহনী কন্ঠে বলে, “লাগে তো। তোমার ঠোঁটজোড়া অতিরিক্ত সুন্দর। আমি নিশ্চিত যেকোনো ছেলে একবার তাকালে তাকিয়ে থাকতে চাইবে। এমনকি অনেকে চুমুও খাইতে চাইবে। যেমন আমার ইচ্ছা করছে তোমার নিখুঁত ঠোঁটজোড়ায় চুমু খেতে।”
কবিতার নিশ্বাস সেখানেই আটকে গেল। সে চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো কথনের দিকে। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে।
কবিতার ভীত দৃষ্টি দেখে ফিক করে হেসে দেয় কথন। কবিতার কাছ থেকে সরে যেয়ে বলে, “চিন্তা করো না আমি তোমাকে চুমু খাচ্ছি না। চুমু খাবার জন্য আমার দুইটা জিনিস নিয়ে বিশেষ কারণ লাগে। এক, আমি তাকে ভালোবাসি কি’না? দুই, সে আমাকে ভালোবাসে না’কি? আর এই দুটো কারণের একটি কারণও আমাদের মাঝে নেউ। তবে হ্যাঁ, তোমার ঠোঁটজোড়া বেশ সুন্দর তা সত্যি। অন্য বিশেষ কিছু তেমন গভীরভাবে লক্ষ্য করি নি।”
“আপনি তো বেশ লুচ্চা। আপনাকে আমি মোটেও এমন ভাবি নি। আপনি আমার ঠোঁট খেয়াল করলেন তাও….” কবিতা সামনের কথাটুকু বলতে পারলো না। সেখান থেকে রাগে মুখ ফুলিয়ে চলে গেল।
কবিতার এমন প্রতিক্রিয়া দেখে কথনের আরও বেশি হাসি পায়। এতটুকু কথা মেয়েটা এত বড় ভাবে নিবে সে মোটেও তা ভাবে নি।
সারাদিন সবার সাথে ভালোই দিন কাটে কবিতার। সবাইকে দেখে তার আফসোসও লাগছিলো আসলে এইটা তার শশুড়বাড়ি হবে না কিন্তু কথন তার স্বামী হবে না এই স্বস্তিও তার ছিলো। সারাদিন কাটিয়ে রাতে বাড়িতে যায় কবিতা। কিন্তু এর পূর্বে জেবা জোর করে কবিতার নবীনবরণে সে নিজের হাতে তাকে সাজিয়ে দিবে। কবিতা প্রথমে মানা করে, সে ভালো করে জানে যে তারা সবাই মিলে কথন ও কবিতাকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য চেষ্টা করছে। তার মধ্যেই কোনো এক পরিকল্পনায় তাকে ডাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জেবার জোর করায় কবিতা আর না করতে পারলো না।
.
.
পাঁচদিন পর,
কবিতাকে ভীষণ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। একটি সাদা রঙের জামদানি পড়েছে সে। সাদা জমিনে সোনালী কাজ। তার চুলগুলো পিঠ ছড়ানো। দুইহাত ভর্তি চুড়ি। চোখে কাজল, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপ্সটিক। তাকে ভীষণ সুন্দর করে সাজায় জেবা। কবিতা আয়নাতে নিজেকে দেখে তো প্রথমে চিনলোই না। কিছু মুহূর্ত অবাক হয়েই তাকিয়ে থাকে আয়নায়। এর পূর্বে সে কখনো এত সাজে নি। তারপর জেবাকে বলে, “আপু এটা আমি? সত্যি আমি?”
জেবা কবিতার গাল টেনে বলে, “আসলেই তুমি।”
কবিতা খুশি মনে লাফিয়ে লাফিয়ে বিছানার কাছে যায়। সেখানে বসা তাহিরা এবং কথনের মা।
“আপি, আন্টি দেখেন আমার কত সুন্দর করে সাজিয়েছে জেবা আপু।”
কথনের মুগ্ধ হয়ে বললেন, “সাজের কারণে না। মাশাল্লাহ দিলে তুমি এমনিতেই দেখতে খুবই সুন্দর।”
প্রশংসা শুনে একগাল হাসে কবিতা। তাকায় তাহিরার দিকে। তাহিরাও বলে, “অসম্ভব সুন্দর লাগছে তোকে।”
“আপু তোমাকেও আজ একদম পরীর মতো লাগছে।”
তাহিরাকেও জেবা সাজিয়ে দিয়েছে। সে পরেছে কমলা রঙের একটি জামদানি। তার চুলে খোঁপা করা। খোঁপায় বাঁধা বেলিফুল। সকাল সকাল ধ্রুব ফুল নিয়ে এসে তাহিরাকে দিয়ে আবদার করেছিলো খোঁপা করে বেলিফুলের মালা মাথায় গুঁজতে। ধ্রুবর আবদার ফেলতে পারে নি সে।
কথন ভীষণ বিরক্তি নিয়ে অপেক্ষা করছিল কবিতা ও তাহিরার। এমনিই তাদের জন্য আজ দেরি করে হাস্পাতালে যাচ্ছে সে। কিন্তু এত দেরি কে করে? অবশেষে না পেরে নিজেই তাদের ডাকতে এলো।
“মা আর কতক্ষণ আমার দেরি হয়ে যা….” দরজা দিয়ে ঢুকতেই তার দৃষ্টি পড়ে এক শুভ্রপরীর উপর। সে কথা বলতে ভুলে যায় কিছু মুহূর্তের জন্য। দৃষ্টি আটকে পড়ে তার সামনে দাঁড়ানো শুভ্রপরীর উপর। তার মনে হলো হার্টবিটও এক মুহূর্তের জন্য মিস হয়ে গেছে।
কবিতা উৎসুক গলায় কথনকে জিজ্ঞেস করে, “দেখুন আজ আমি প্রথম শাড়ি পরলাম। আর জেবা আপু কত সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে আমাকে। কেমন লাগছে?”
কথন বলতে চাইল, “স্নিগ্ধ, পবিত্র এবং আসমান থেকে নেমে আসা হুরপরীর মতো লাগছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত তোমার হাসি দেখে পরীও লজ্জা পাবে।”
কিন্তু তা সে বলল না। চোখ নামিয়ে নিলো সে। কেবল বলল, “সুন্দর লাগছে। তৈরি হলে নিচে এসো। আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি।”
এই বলেই সে বের হয়ে যায়। বের হয়ে বহু কষ্টে সে নিশ্বাস ফেলে। তারপর নিজেই অবাক হয় নিজের উপর। সে তো এমন না। আজ পর্যন্ত তার মনের কথা কখনো মনে রাখে নি সে। যা মুখে এসেছে তা বলে দিয়েছে। তাহলে আজ কেন সে তার মনের কথা বলতে পারে নি?
#মুহূর্তে
পর্ব-১২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
কথন কবিতা ও তাহিরাকে ভার্সিটি গেটের সামনে নামিয়ে দেয়। দরজার বাহিরের থেকে গান-বাজনার শব্দ শোনা যাচ্ছে। অর্থাৎ অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। মাঠেই বড় করে আয়োজন করা। গান বাজছে। স্টেজে নাচ হচ্ছে। তাহিরা ও কবিতা দরজা দিয়ে ঢুকতেই লিমন তাদের বলল, “ভাবি আপনাদেরই অপেক্ষা করছিলাম। ধ্রুব ভাই বলল আপনারা এসে পড়ছেন। আপনাদের নিতে আসতে।”
“আর আপনার ধ্রুব ভাই কীভাবে জানল?” কবিতা প্রশ্ন করেই তাকায় তাহিরার দিকে। ধ্রুবকে তাহিরা পছন্দ করতো তা তার আগের থেকে জানা। কিন্তু ধ্রুবর চরিত্র সম্পর্কে মোটেও ধারণা ছিলো না কবিতার। ভার্সিটি আসার পর সে জানতে পারে এবং ধ্রুবর বিরুদ্ধে কথাও বলে তাহিরাকে। তার বোনের মতো এত ভালো মেয়ে এমন কোনো ছেলের সাথে জীবন কাটাতে পারে না যে প্রতিদিন ভিন্ন মেয়ের সাথে ঘুরে বেড়ায়। ক’দিন ধরে ধ্রুব ও তাহিরার মাঝে কিছু চলছে। তা ঠিকই বুঝতে পারে কবিতা। কিন্তু দুইজন মুখে কিছু বলে না। ধ্রুবকেও আজকাল কোনো মেয়ের সাথে দেখা যায় না। দুইজনের মাঝে ঠিক কি হচ্ছে বুঝতে পারে না কবিতা।
সামনের সিটগুলোর মধ্যে ধ্রুব বসা ছিলো। লিমন তাদের সেখানেই নিয়ে গেল। ধ্রুব তাহিরাকে দেখে তার সামনে এসে একগাল হেসে বলে, “তোকে বলেছিলাম না এই রঙ তোর উপর বেশি মানাবে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে তোকে।”
“জ্বি না, আমার উপর সাদা রঙ বেশি মানায় বলেই আপনি আমাকে এই শাড়ি পরতে বলেছেন। যেন আমাকে বেশি সুন্দর না দেখায় তাই না?”
জোরপূর্বক হাসে ধ্রুব। প্রশ্নটা এড়িয়ে যাবার জন্য কবিতার দিকে তাকিয়ে বলে, “কবিতা তোমাকে প্রথম শাড়িতে দেখলাম। সুন্দর লাগছে।”
কবিতা উওর দেয় না। জোরপূর্বক হেসে একটি সিটে বসে পড়ে। তাহিরা এবং ধ্রুবও তার পাশে এসে বসে। দুইজনে গল্প করছিলো অনেক। কবিতা ভাবলো কথা শুনে বোঝা যাবে তাদের মাঝে কি চলছে। বুঝা গেল না। সাধারণ কথা-বার্তা। নিরাশ হয় কবিতা, তার সাথে কথা বলার মতো কেউ নেই। অনু আজ আসে নি। তার কাছে এইসব অনুষ্ঠান ভীষণ বিরক্তির।
কবিতা পাশে তাকিয়ে খেয়াল করে তীর্থ একজনের সাথে কথা বলতে বলতে তার পাশে এসে বসে। সে কথা বলায় ব্যস্ত। তার দিকে একবার তাকায়ও না তীর্থ। গম্ভীরমুখে কথা বলছিলো তীর্থ। কবিতা হাঁটুর উপর কনুই রেখে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রইল তীর্থর দিকে। গম্ভীরমুখে তাকে ভালোই লাগে। আকর্ষণীয় দেখায়।
কথা শেষে গম্ভীরমুখ নিয়েই তীর্থ ধ্রুবকে ডাক দিয়ে মুখ ফিরায়। হঠাৎ-ই তার মুখের ভাব পরিবর্তন হয়। চোখদুটো বড় বড় করে তাকিয়ে রয় সে কবিতার দিকে। কবিতাও তাকিয়ে ছিলো তার দিকে। ইচ্ছে করেই মুখ ফিরায় নি। কেন যেন তীর্থ যেভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকে তা দেখতে ভালো লাগে। মনে হয় এই জগতে তার থেকে বেশি সুন্দর কাওকে দেখে নি তীর্থ। এমন মুগ্ধতা ছেয়ে থাকে তার দৃষ্টিতে।
তীর্থের মুগ্ধতা ভরা দৃষ্টি যাচাই করতে করতে যখন ক্লান্ত হয় কবিতা তখন জিজ্ঞেস করে, “এভাবে তাকিয়ে থেকে কী দেখছেন?”
ঘোর কাটলো যেন তীর্থের। সে চোখ নামিয়ে নেয় সাথে সাথে। লজ্জাও পায়। কোনো উওর দেয় না।
কবিতার হাসি গাঢ় হয়। সে তীর্থের দিকে একটুখানি ঝুঁকে বলে, “এমন করে তাকিয়ে থাকাটাকে বেহায়াপনা বলে।”
“তাহলে তো তোমার দোষ।”
“আমার দোষ কীভাবে?” বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করে কবিতা।
“আগে কখনো বেহায়াপনা করি নি। এই প্রথম, তাও তোমায় দেখে। তাহলে এইটা কী তোমার দোষ নয়? তোমাকে এত সুন্দর দেখালে আমার দোষ কোথায়?”
তীর্থের কথা শোনার পর তার পাশে বসে থাকা লিমন বলে, “ভাই…ভাই আপনে এইটা কী কইলেন? কেমনে কইলেন? ভাই আপনার জ্বর আইসে? আপনে ঠিক আছেন?”
“বিরক্ত করিস না-তো।” তীর্থ ধমক দিলো লিমনকে। কিন্তু এতে লিমনের উপর কোনো প্রভাব পড়ে না। সে উঁচু স্বরে বলে, “ধ্রুব ভাই আপনে শুনলেন তীর্থ ভাই আজ প্রথম কাওরে প্রশংসা করছে। দাঁড়ান আমি এখনই পলাশ আর রতন ভাইরে বইলা আসি। এটা তো আকস্মিক ঘটনা।”
তীর্থ ভীষণ লজ্জিত হয় এইসব শুনে। কিন্তু কবিতার কেন যেন এই দৃশ্য ভীষণ মজার লাগে। সে খিলখিল করে হেসে উঠে।
লিমন যেতেই ভীষণ লজ্জায় পড়ে তীর্থ। সবার সামনে এমন কান্ড কেন করতে হলো তার? ভীষণ রাগও উঠলো। মুহূর্তে না গড়াতেই এক মিষ্টি হাসির শব্দ তার কানে এসে ভাসে। তীর্থ তাকায় তার পাশের চেয়ারে বসা রূপবতীর দিকে। সাদা রঙ তার উপর অসম্ভব সুন্দর লাগছে। তাকে স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে, পবিত্র লাগছে। তীর্থের হঠাৎ-ই মন চাইলো একটি শীতের সকাল হোক, চারদিকে কুয়াশা পড়তে থাকুক, নিস্তব্ধ হোক এক পথ। সে পথে হাত ধরে হাঁটবে সে তার পাশে বসা মেয়েটির সাথে। ঠিক এমনভাবেই সেজে থাকবে সে। পরে থাকবে সাদা জামদানী। খুবই ছোট একটি কল্পনা, অথচ এই কল্পনাতেই তার মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। কবিতার হাসি দেখে তার ঠোঁটের কোণেও হাসি এঁকে এলো।
কিছু সময় পর তাহিরার এক বান্ধবী তাকে ডেকে নিয়ে গেল। ধ্রুবও অন্য কারও সাথে কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তীর্থ সুযোগ পেয়ে বলে, “শুনো।”
“হুঁ” কবিতা স্টেজের গানের প্রদর্শন দেখছিলো।
“তোমাকে…. মানে বলছিলাম কি তুমি একদিন শুধু চোখে কাজল দিয়ে সেজে এই শাড়িটি পরবে?”
তীর্থের এমন আবদার শুনে কবিতা তাকায় তার দিকে। মিটিমিটি হেসে জিজ্ঞেস করে, “কেন আপনার দেখতে মন চাচ্ছে?”
“না মানে…এমনিতেই বলছিলাম।”
“আপনার মানিব্যাগে আপনার প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা আছে?”
এমন প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে যায় তীর্থ, “আছে। কিন্তু কেন
বলোতো।”
“আপনার জন্য একটা শার্ট অথবা পাঞ্জাবি কিনব তাই। গেঞ্জির উপর এমন জিন্সের জ্যাকেট পড়ে কেউ অনুষ্ঠানে আসে? কালারও একদম মিসম্যাচ। আপনাকে এক কালারের শার্টে বা পাঞ্জাবিতে কত হ্যান্ডসাম লাগবে জানেন?”
“তুমি এখন যাইতে চাইছ?”
“নবীনবরণ কী আজ না?”
তীর্থ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে।
“তো আমরা এখনই যাচ্ছি। আসুন।”
তীর্থ কবিতাকে মানা করলো না। তারা তখনই বের হয় অনুষ্ঠান থেকে। তীর্থ তার বাইক বের করার পর কবিতা হুমকির সুরে বলে, “দেখেন আগে কখনো আমি বাইকে উঠি নি আস্তে চালাবেন। এক্সিডেন্ট করলে অবিবাহিতই মরতে হবে। একটা প্রেমও করতে পারলাম না এই পর্যন্ত।”
“কেন তোমার না বিয়ে ঠিক হলো, শুনলাম।” খুব গম্ভীর শুনাল তীর্থকে। তীর্থ কথাটা বলার সময় একপলক তাকায়ও না কবিতার দিকে। কবিতা সাবধানে তীর্থের বাইকে উঠে বসে, “এখনো বিয়ে ঠিক হয় নি। আমাদের পরিবার রাজি কিন্তু কথন ও আমি না।”
“কথন কে?” তীর্থ বাইক স্টার্ট করে। বাইক চালু হতেই কবিতা শক্ত করে তীর্থের কাঁধ ধরে নেয়। তীর্থ একপলক বাইকের আয়নায় কবিতাকে দেখে নেয়। কী অপরূপ দেখাচ্ছে তাকে!
গতকাল কবিতার বিয়ের কথা শুনার পর থেকে তার মনে হচ্ছিলো তার বুকের ভেতর একটা ভারী পাথর রেখেছে কেউ। ভারী হয়ে আসছিলো তার বুকটা। সে ভারী ভাবটা আর নেই। উল্টো তার মাঝে এতটা ভালোলাগা কাজ করছে। যতটা ভালো লাগা গত একযুগ ধরে লাগে নি, তা আজ লাগছে। আচ্ছা, মেয়েটা কী জাদু জানে?
“কথন সে ছেলের নাম, যার সাথে বিয়ে ঠিক হলো।” কবিতার কন্ঠে ঘোর ভাঙে তীর্থে।
“ওহ, তো বিয়ের জন্য মানা করার কারণ?”
“উনি প্রেম অথবা বিয়েতে জড়াতে চায় না। আগে নিজের ক্যারিয়ারে কিছু করতে চায়। আর আমি…..” থেমে যায় কবিতা। সে কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। কথন সুদর্শন, ভদ্র, তার পরিবার ভালো, তার ভবিষ্যতও উজ্জ্বল এবং সবচেয়ে বড় বিষয় তার মনোভাব কবিতার সাথে মিলে। আসলেই তো, সে বিয়ের জন্য রাজি না কেন?
“তুমি?” প্রশ্ন করে তীর্থ।
“ঠিক জানি না। আমাদের দেখা হলে ঝগড়া ছাড়া কথা হয় নি, সম্ভবত এই কারণে। আবার তাকে মনেও ধরে নি।”
“অন্যকাওকে ধরেছে?” প্রশ্নটায় একটু হকচকিয়ে যায় কবিতা। আয়নায় একপলক তীর্থকে দেখে বলে, “ঠিক জানি না।”
.
.
তাহিরা কথা বলছিল তার ক্লাসের বান্ধবীদের সাথে। বাহিরে শব্দ বেশি হওয়ায় তারা ভেতরে এসে গল্প করছিলো। হঠাৎ একটি মেয়ে এসে তার গালে জোরে চড় মারে। তাহিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মেয়েটির দিকে। মেয়েটির সাথে একসময় ধ্রুবর অনেক কথা হতো। তার নাম জুঁই। তাহিরা ওয়াদা করার পর ধ্রুব আর কোনো মেয়ের সাথে যোগাযোগ রাখে নি। জুঁইও তার মাঝে একজন। এ-কারণে জুঁই রেগে আছে তাহিরার উপর। তার সন্দেহ তাহিরাই ধ্রুবর এমন ব্যবহারের কারণ। জুঁই ধমকের সুরে তাহিরাকে বলে, “তোকে বলেছিলাম? তোকে বলেছিলাম ধ্রুবর কাছ থেকে দূরে থাকতে? বলি নাই? তোর সাহস কত বড় ওকে আমার কাছ থেকে দূর করার।”
“জুঁই প্লিজ এইখানে তামাশা করো না। আমরা অন্য কোথাও যেয়ে কথা বলি।”
“কেন অন্যকোথাও যাব? ও, তুই কেমন মেয়ে তা সবাই জানলে তোর খারাপ লাগবে?” জুঁই আরও উঁচু স্বরে কথা বলতে শুরু করে, “অন্যের প্রেমিককে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিজের বশে করার সময় লোকের কথা মাথায় আসে না?”
“দেখ জুঁই তুমি আমাকে ভুল ভাবছ।”
“আমি ভুল ভাবছি? আমি নিজে শুনেছিলাম তুই ধ্রুবকে বলেছিলি যেন আমার সাথে কথা না বলে। তারপরও ধ্রুব আমার সাথে কথা বলছে দেখে তোর সহ্য হয় নি। তাই তুই….” তাহিরা জুঁইয়ের কথা কেটে বলে, “কারণ আমি চাই নি তুমি কষ্ট পাও। আমি কখনো চাই নি ধ্রুবর জন্য কোনো মেয়ে কষ্ট পাবে। তুমিও জানো ও তোমাকে আসলে ভালোবাসতো না। আমি প্রতি মেয়ের বেলায় এই কথাই ওকে বুঝাই। তোমার জন্যই তো আমি এই কথাটা বলেছিলাম।”
“ওহ সাট আপ।” আর্তনাদ করে উঠে জুঁই, “তোর বদ নজর আগের থেকে ছিলো ওর উপর। তাই তুই এমন করেছিস। নিজের শরীর ওর কাছে বিলিয়ে দিয়ে ওঁকে নিজের বশে করেছিস তাই না? এই কারণেই তো ও একবার আমার দিকে তাকায়ও না। এমন বেশ্যাগিরি করে কত ছেলের থেকে টাকা বের করেছিস তুই?”
জুঁইয়ের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল তাহিরা। তার চোখ ভিজে গেল। সে নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। এত বড় অপবাদ কখনো তার শুনতে হবে সে কখনো ভাবে নি। আজ পর্যন্ত কেউ তার চরিত্রের উপর প্রশ্ন তুলে নি।
“এইখানে হচ্ছেটা কী?” দরজা থেকে ধ্রুবর কন্ঠ শুনে তাহিরা সেদিকে তাকায়। ধ্রুবর পাশে তাহিরার এক বান্ধবী দাঁড়ানো সম্ভবত সে-ই ডেকে এনেছে ধ্রুবকে।
ধ্রুব তাহিরার দিকে তাকায়। তার নয়নজোড়ায় পানি ছলছল করছিলো। মুহূর্ত না গড়াতেই এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে তার গালে। ধ্রুব অস্থির হয়ে যায়। তার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে। সে তাহিরার দিকে এগোতেই মাঝপথে জুঁই তার সামনে এসে দাঁড়ায়। তাকে অস্থির দেখায়। সে ছটফটিয়ে ধ্রুবর হাত ধরে বলে, “ধ্রুব…. ধ্রুব আমি জানি ওর কারণে তুমি আমাকে ইগনোর করছ। তুমি আমার কথা একবার তো শুনবে। আমি নিশ্চিত… নিশ্চিত যে ও তোমার টাকার জন্য তোমাকে ফাঁসিয়েছে। তোমার বাড়িতে ভাড়া থাকতে থাকতে এখন বাড়ির উপর রাজত্ব করার শখ জেগেছে ওর।”
ধ্রুব বিরক্তি নিয়ে তাকায় জুঁইয়ের দিকে, “তোমার আমাকে বলতে হবে না তাহিরা কেমন। ওর টাকার প্রতি কোনো লোভ নেই। ও অন্যান্য মেয়েদের মতো নয় যে টাকার কারণে আমার পিছনে দৌঁড়াবে। তাহিরা আজ পর্যন্ত আমার কাছ থেকে এক পয়সাও নেয় নি। আমি ওকে ছোটবেলা থেকে চিনি এন্ড গেস হোয়াট কয়েকশো বছর সাধনা করলেও ওর মতো ভালো হওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব না।”
ধ্রুব এক ঝটকায় জুঁইয়ের হাত সরিয়ে তাহিরার সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। তাহিরা গালভেজা জল আলতো আঙুলে মুছে বলে, “সরি ফুলটুসি, আমার কারণে তোর এত আজেবাজে কথা শুনতে হলো।” ধ্রুব কান ধরে নরম দৃষ্টিতে তাকায় তাহিরার দিকে, “সরি।”
তাহিরার পাশের মেয়েটি এগিয়ে এসে অভিযোগের সুরে জানায়, “ধ্রুব তুই জানিস এই মেয়ে কি বলেছে তাহিরাকে?”
মেয়েটি কিছু বলতে নিলেই তাহিরা থামায় তাকে। ধ্রুবর দৃষ্টি সরু হয়। সে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে, “কী বলেছে?”
মেয়েটি উওর না দেওয়ায় ধ্রুব আবার উঁচু স্বরে প্রশ্ন করে, ” আমি জিজ্ঞেস করছি কী বলেছে লিমা?”
“বলেছে যে তাহিরা না’কি… ইশশ কীভাবে বলি আমি?”
“জলদি বল।”
লিমা চোখ বন্ধ করে এক নিশ্বাসে বলে, “ও না’কি শরীর বিলিয়ে তোকে বশে করেছে। তোকে ছাড়া অন্যান্য ছেলের থেকে না’কি এ…এভাবে টাকা নিয়েছে এসব বলেছে। বে…বেশ্যা শব্দও ব্যবহার করেছে।”
কথাটা শুনতেই চমকে উঠে ধ্রুব। সে তাহিরার দিকে তাকায়। এই বাক্য শুনে তার চোখেও জল ভেসে উঠে। মাথায় রক্ত চড়ে যায়। সে তার পাশে থাকা চেয়ার এক লাত্থিতে দূরে সরিয়ে দেয়। রুমটায় জোরে এক শব্দ হয়ে উঠে। সে পিছনে ফিরে জুঁইয়ের গলা টিপে ধরে সোজা।
আর্তনাদ দিয়ে উঠে সে, “তোর সাহস কীভাবে হয় আমার তাহিরার চরিত্রে প্রশ্ন তোলার? তুই কে? তোর চরিত্রের গুণগান শুনাব সবাইকে?”
রুমের সবাই হতবাক এই কান্ড দেখে। ধ্রুবকে কেউ কখনো এর পূর্বে রাগে দেখে নি। আর মেয়েদের সাথে খারাপ ব্যবহার তো দূরের কথা তাদের সাথে উঁচু স্বরে কখনো কথাও বলে নি সে।
তাহিরা দ্রুত যেয়ে ধ্রুবর হাত ধরে বলে, “কী করছিস তুই? ছাড় ওকে।”
ধ্রুবর মেজাজ তাহিরার উপরও গরম হয়, “মাঝখানে আসবি না তাহিরা। দূরে সরে দাঁড়া।”
জুঁইকে একটা বাজে গালি দিয়ে সে আবারও বলে, “যার নিজের চরিত্রের ঠিক ঠিকানা নেই সে আবার আমার তাহিরার চরিত্রে প্রশ্ন তুলছে? তোর কি ইচ্ছা চরিত্র কেমন তা আমি তোর মা বাপ আর সম্পূর্ণ ঢাকা শহরকে জানাই?”
জুঁইয়ের মুখ ভয়ার্ত হয়ে এলো। সে নিজেকে ধ্রুবর কাছ থেকে ছাড়াতে চাইলেও পাড়লো না। কিছু বলবে যে তার শক্তিও পাচ্ছে না সে। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। হঠাৎ কাশতে শুরু করে সে। তাহিরা বহু কষ্টে ধ্রুবর কাছ থেকে ছাড়ায় জুঁইকে।
ধ্রুব এক ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দেয় জুঁইকে তারপর তাহিরার হাত ধরে বলে, “নিজের মতো সবাইকে ভাববি না। আমার তাহিরা পবিত্র। ওর চরিত্রে কোনো দাগ নেই। আর আমার ও তাহিরার সম্পর্কে জানতে চাস? আমি ওকে ভালোবাসি এবং কেবল ওকেই ভালোবাসি। আর আমি ওকেই বিয়ে করব।”
ধ্রুব তাহিরাকে টেনে নিজের সাথে নিয়ে যায়।
ধ্রুব ভার্সিটি থেকে বের হয়ে রাগের মাথায় কল দেয় তার মা’কে, “আম্মু তুমি দ্রুত আমাদের এলাকার কাজি অফিসে আসো। আমি এই মুহূর্তে তাহিরাকে বিয়ে করতে চাই।”
চলবে….
[