মুহুর্তে পর্ব -৫৭+৫৮ ও শেষ পর্ব

#মুহূর্তে
পর্ব-৫৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

কথন একগাল হেসে কক্ষে প্রবেশ করছিল, কিন্তু যে মুহূর্তে কবিতার হাতে তার ডায়েরিটি দেখলো তার ঠোঁটের হাসি মলিন হয়ে গেল। মুখে ছড়িয়ে পড়লো ভয় ও চিন্তার ছাপ। কবিতার কাছে এই ডায়েরিটা এলো কীভাবে?

কথন বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করে, “তোমার কাছে এই ডায়েরি এলো কীভাবে?”
কবিতা উঠে দাঁড়ায়। কথন এর সামনে যে বলে, “ডায়েরি কে দিলো তার থেকে বড় প্রশ্ন তো এটা এই ডায়েরির ভেতর কি লেখা তাই না?”
ভয়ে কথনের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সে কাঁপছিলো। সে চায় না কোনমতে কবিতাকে হারাতে। কবিতা কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা সে বুঝতে পারছে না। শুধু সে কবিতা থেকে দূরে যেতে চায় না।

“সম্পূর্ণ ডাইরিতে শুধু আমাকে নিয়ে লেখা। এর অর্থ কি?” কবিতার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না কথন। কেবল মাথা নিচু করে রাখে। উত্তর না পেয়ে সে আবারও জিজ্ঞেস করে, “আপনি আমাকে ভালোবাসতেন?”
এবারও কোন উত্তর দেয় না কথন।
“আজও ভালোবাসেন?”
চোখ নামিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সে। কবিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “ধন্যবাদ।”
এবার কথন চমকে তাকায় কবিতার দিকে, “কী?”
“ধন্যবাদ আমাকে এত ভালোবাসার জন্য। আমি বলেছিলাম আপনি যে মেয়েটিকে ভালোবাসেন সে সৌভাগ্যবান। আমি সে মেয়েটি জেনে ভালো লাগলো কিন্তু অপরাধবোধও হচ্ছে আমার, আমার কারণে আপনি এত কষ্ট পেয়েছেন, এত সহ্য করেছেন।”
“আমি তোমায় ভালোবেসেছি এতে তোমার দোষ কোথায়?”
“জানি না। তবুও আমার গিল্টি ফিল হচ্ছে। আপনি আমায় ভালোবেসে কিছুই পান নি। তাহলে ভালোবাসা ছাড়েন নি কেন?”
“যেহেতু তোমাকে ভালোবাসাটা আমার হাতে ছিলো না, তোমাকে ভুলাটাও আমার বশে নেই। আমি ভেবেছিলাম তুমি রাগ করবে।”
“রাগ করব কেন? কাওকে ভালোবাসা তো অপরাধ নয়। কিন্তু সে ভালোবাসার দোহাই দিয়ে ভুল পথ বাছাই করাটা অপরাধ। আপনি কখনো নিজের অনুভূতি আমার উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন নি। আমার ভেঙে পড়া পরিস্থিতিতে আপনি চাইলেই আমাকে ভুলভাল বুঝিয়ে নিজের স্বার্থে আমার উপর প্রেশার ক্রিয়েট করতে পারতেন। মানুষ ব্রেকডাউনের মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি আবেগী থাকে। সে আবেগের সময় সহজেই তাকে অনুভূতিতে ভাসানো যায়। এই কথাটা আপনিই আমায় বলেছিলেন। কিন্তু আপনি এমন করেন নি। উল্টো আমাকে নিজের জন্য দাঁড়াতে শিখিয়েছেন। নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন। আর সবচেয়ে বড় কথা, আমার সফরে অনুপ্রাণিত করে শক্ত করেছেন। দয়া বা সহানুভূতি দেখিয়ে আমার দুর্বলতা বাড়ান নি। নিঃস্বার্থভাবে এতবছর আমার সাথে থেকেছেন।”
“উঁহু, নিঃস্বার্থভাবে নয়।” কথন একটু এগিয়ে আসে কবিতার দিকে, “স্বার্থ দিয়েই করেছি। তুমি যখন নিজের উপর গর্ব করবে তখন তোমার চোখে আলাদা এক চমক থাকবে, তোমার ঠোঁটে অন্যরকম হাসি থাকবে, তোমার স্বপ্ন পূরণের অন্যরকম অনুভূতি থাকবে। তা দেখার লোভ ছিলো।”
“আমি আপনার ভালোবাসাকে সম্মান করি কিন্তু তা মেনে নিতে পারব না। আমি ভালোবাসা খুব কাছের থেকে দেখেছি। ভালোবাসার মানুষকে পেয়েছি। তার পরিবর্তন দেখেছি। তার বিশ্বাসঘাতকতা দেখেছি। হৃদয় ভাঙ্গার কষ্ট সহ্য করেছি। ভালোবাসা হারিয়েছি। এই ভালোবাসার অগ্নিকূপে আবার পা দেবার সাহস আমার নেই।”

কথন কবিতার হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, “আমি তোমার সাথে কখনো এমন করবো না কবিতা। তোমাকে তো রাণীর মতো রাখবো।”
“মানুষ সময়ের সাথে কখন কিভাবে পরিবর্তন হয় তা আমরা নিজেও জানি না। মানুষকে নয়, এখন ভালোবাসাকে বিশ্বাস করতে ভয় হয়। আর আমার না করার কারণটা ঠিক আপনি নয়, আমি। এই’যে আপনাকে বললাম, আমি ভালোবাসাকে বিশ্বাস করতে পারবো না, ভালোবাসতে পারব না। আপনি অনেক ভালো কথন। আপনি এমন এক মেয়েকে ডিসার্ভ করেন যে আপনাকে অনেক ভালোবাসবে। নিঃস্বার্থভাবে। আমাকে ভালোবেসে আপনি এত বছরের মতো কষ্ট ছাড়া কিছুই পাবেন না। আর আমি তা চাই না।”
কবিতা তার হাত সরিয়ে নিলো। কথন কিছুক্ষণ শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কবিতার দিকে। কবিতা আবারও বলল, “আমি নিজে আপনার জন্য মেয়ে দেখব। আপনার মন মতো। আমার থেকে হাজারগুন ভালো হবে ও। আপনাকে ভালোবাসবে, আপনার যত্ন নিবে, আপনাকে…. ”
কথাটা শেষ হবার পূর্বেই কথন কবিতার হাত ধরে নিজের দিকে টেনে আনে। চোখে চোখ রেখে বলে, “আমার অন্য কাউকে নয়, কেবল তোমাকে লাগবে।”
“আপনি বুঝতে পারছেন না কেন? আপনি আরও ভালো কাওকে ডিসার্ভ করেন।”
“তোমার থেকে ভালো কাওকে আমি পাই নি।”
“এটা আপনা ভুল ধারণা। আমার থেকে সব দিকে হাজারোগুণ বেশি ভালো মেয়ে আপনি পাবেন।”
“তবুও আমার কেবল তোমাকে লাগবে।”
কবিতা করুণ চোখে তাকায় কথনের দিকে। তার গলা কেঁপে উঠে, “দয়া করে এমন করেন না। আপনিও জানেন যে আমি…আমি আর কখনো ভালোবাসতে পারবো না। বিয়েও করতে পারবো না। আপনি কেন একথা বুঝতে পারছেন না?”
“তুমি আমাকে ভালোবাসবে এবং আমাকেই বিয়ে করবে। তার জন্য যত সময় লাগুক আমি অপেক্ষা করবো।”
“উফফ আপনি এত জেদ কেন করছেন? আমি বারবার বলছি আপনি আরও ভালো কাওকে পাবেন।” কবিতা আর্তনাদ করে উঠে। বিরক্ত হয়ে পিছিয়ে যায়। কিন্তু কথন তবুও শান্ত গলায় বলে, “দেখ বিয়ে করলে আমি মেয়েটাকে ভালোবাসতে পারবো না। এদিকে আমি তোমাকে আবারও হারিয়ে কষ্ট পাব আর মেয়েটা আমার সাথে থেকেও আমাকে না পেয়ে। আর আমি এমন করতে পারবো না। ভাগ্য আমার বড় এক সুযোগ দিয়েছে তা হাতছাড়া করাটা বোকামি ছাড়া কিছুই না।”
“আর আপনি চেষ্টা না করে কিভাবে বুঝলেন যে আপনি অন্যকাওকে ভালোবাসতে পারবেন না?”
“ট্রাই করেছিলাম বুঝেছ। কিন্তু কোনো মেয়েকেই আর মনে ধরে নি। তোমার মতো এলিয়েন এক পিসই আছে।”
“আমাকে দেখে আপনার পাগল মনে হয়?”
“দেখ এই কয়বছর একটু গম্ভীরমুখে থেকেছ বলে এই না যে তোমার মাঝের এলিয়েনগিরি ছুঁ মন্তর হয়ে গেছে।”
“আপনার সাথে গম্ভীরভাবে কোনো কথা বলা যাস্ট ইম্পসিবল।”
কবিতার রাগে হনহন করে বেরিয়ে যেতে নিলো। কথন হাত ধরে নিলো তার। তার সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “এতদিন তো তোমাকে হারানোর ভয় ছিলো তাই কিছু করি নি। কিন্তু এখন তোমাকে পাবার কোনো সুযোগ আমি ছাড়বো না। তুমি আমাকে ভালোবাসবে কবিতা। তোমার হৃদয় আমার নামে লিখে দিতে বাধ্য হবে তুমি।”
“একটি নারী আপনাকে ভালোবাসতেও পারে, একটি মা না। এখন আমার জন্য আমার থেকেও বেশি আমার সন্তানরা গুরুত্বপূর্ণ। তাদের ঘিরেই আমার জীবন। তাই বলছি, জেদ ছেড়ে দিন। আপনার সামনে সম্পূর্ণ জীবন পড়ে আছে।”
কবিতা নিজের হাত ছাড়িয়ে চলে গেল সেখান থেকে। কথন পিছনে ফিরে কবিতার যাবার দিকে তাকিয়েই রইলো।
.
.
আজ শুক্রবার। অনু প্রতি শনিবার কুহু এবং কাব্যকে তীর্থের বাসায় নিয়ে যায়। কবিতা ডিভোর্সের সময় তীর্থকে ওয়াদা করেছিলো কাব্য এবং কুহুর থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করবে না তাকে। অবশ্য সেখানে বেশিক্ষণ থাকে না তারা। তাই অনুর সেখানেই থাকতে হয়।

কবিতা সাধারণত কাজ থেকে ছুটি নেয় না। সাপ্তাহে প্রতিদিনই তার কাজ থাকে। শুক্রবার এবং শনিবারে তো কাজের চাপ সবচেয়ে বেশি থাকে। আজও রীতিমতো রাতে আসে সে কাজ থেকে। বাসায় এসে দেখে বাচ্চারা খেলা করছে তাহিরার সাথে। অনু অফিসের কাজ করছিলো। সে অনুর সাথে বসে বলে, “আপু আজ থেরাপির জন্য যায় নি তাই না? তাকে জোর করে না নিলেই যাবেই তো না। একদম বাচ্চাদের মতো করে। আগামীকাল জোর করে নিয়ে যাব। আচ্ছা শুন কি হয়েছে, আগামী শুক্রবার একটি পার্টির আমন্ত্রণ পেয়েছি। সেখানে না ব্যবসায়ী অনেকে আসে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যাব না। আমি সেখানে যেয়ে আরও অস্বস্তিবোধ করবো। কিন্তু পরে ভাবলাম এটা ব্যবসার জন্য ভালো হবে। আমি তো বেশি কাওকে চিনিও না। তাই সেখানে গেলে ….”
কবিতার সম্পূর্ণ কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই অনু বলে, “তীর্থের বিয়ের জন্য মেয়ে ঠিক করেছে।”

কবিতা থমকে যায়। চমকে তাকায় অনুর দিকে। এক ঢোক গিলে। তারপর আচমকায় স্বাভাবিকভাবে উঠে ব্যাগ আলমারিতে রাখতে রাখতে বলে, “তো আমি কী করবো? তার জীবন। সে বিয়ে করুক বা না করুক আমার কী?”
“আমি বুঝতে পারছি না, সে লোক তোকে এত যন্ত্রণা দিয়ে জীবনে এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তুই পারছিস না? মেয়েটা তাদের বাসায়ও এসেছে। কোন আত্নীয় লাগে তাদের। কেমন যেন মেয়েটা, ভালো না খারাপ তাও বুঝতে পারছিলাম না। এত সুন্দর মতো খোঁটা মেরে মেরে কথা বলছিলো ভাই। আর আজ সারাদিন তোর শাশুড়ী…মানে এক্স-শাশুড়ীকে দেখলাম। উনার মতো ভালো মানুষ যেন পৃথিবীতে দুইটা নেই। আর তোর সময় কত জল্লাদগিরি করতো। জানিস বিয়েটা কেন করছে? তার ব্যবসায়ের ক্ষতিপূরণের জন্য। তার সব ব্যবসা তো ডুবেই গেছে। আবার নতুন করে শুরু করার জন্য তো টাকা লাগবে। কত খবিশ চিন্তা কর। তোকে এত কষ্ট দেবার পর নিজে নেচে নেচে বিয়ে করছে। আমার যে তখন কত রাগ উঠছিলো। ইচ্ছা করছিলো জুতা দিয়ে কয়টা পিটিয়ে আসি। আর মেয়েটাও কি জিনিস রে ভাই, সব জেনেশুনে তাকে বিয়ে করছে? ওর সাথে বিয়ের পর অন্য মেয়ের কাছে যাবে না এর গ্যারান্টি কী?”
“আমাদের এত ভাবতে হবে কেন? তারা যা ইচ্ছা করুক।”
“কারণ তুই করছিস না। সে অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে পারলে তুই কথন ভাইয়াকে কেন বিয়ে করতে পারবি না?”
“কারণ এটা আমার ইচ্ছা। আমি তাকে বিয়ে করতে চাই না। আমি কাওকেই বিয়ে করতে চাই না। আমি আমার বাচ্চাদের এবং তোদের সাথে খুশি আছি। অন্যকোনো ঝামেলায় ফাঁসতে চাই না আমি। তীর্থের বিয়ে হলে কাব্য এবং কুহুর উপর কোনো প্রভাব পড়বে না। আমার ব্যাপার ভিন্ন। তাদের পরিবার বলতে এখন কেবল তাদের মা আছে।”
“কথন ভাইয়া তোর আগে তোর বাচ্চাদের নিজের দিকে করে রেখেছে।” বিড়বিড় করে বলল অনু। কবিতা জিজ্ঞেস করে কী বলছিস?”
“আমি? কিছু না তো।”
“কিছু না বললেই ভালো। আমি যেন এই ব্যাপারে আর কোনো কথা না শুনি। আমি গোসল করে আসি।”

কবিতা বাথরুমে যেয়ে ঝর্ণা ছেড়ে তার নিচে দাঁড়ায়। নীরব সে, নিস্তব্ধ। চোখ বন্ধ করে তাকায় উপরের দিকে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠে তার এবং তীর্থের কাটানো কতগুলো স্মৃতি। কাঁপতে থাকে সে। মাথা ঘুরিয়ে উঠে। বুকের ভেতর জ্বলতে থাকে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে সে। সে খুব করে চেষ্টা করছে তার চোখের জল আটকানোর। কিন্তু তারা অবাধ্য। কবিতা তার মুখ চেপে ধরে। ভেঙে পড়ে কান্নায়। আচ্ছা কারও জন্য হৃদয়ে চরম ঘৃণা থাকলেও কি তাকে ভালোবাসা যায়?
.
.
পরের সাপ্তাহে কবিতা চিন্তা অনুযায়ী পার্টিতে যায়। সেখানে কেমন অদ্ভুত লাগে তার। সে আগে কখনো এমন বিজনেস পার্টিতে আসে নি। তাই কীভাবে কেমন করে কথা বলতে হয় সে জানে না। তার সব কাজ এতদিন অনলাইনেই হয়েছিলো। তাই হঠাৎ এসব দেখে ভয় লেগে যায় তার। সেখানে তার পরিচিত বলতে অল্পকয়জন ছিলো। কিন্তু তাদের সাথে কথা বলতে যেয়েও ভয়ে কলিজা শুকিয়ে আসছিলো কবিতার। সে আলাদা যেয়ে দাঁড়ালো একটু। পানি পান করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। আবার আগের স্থানে যেতে নিলেই কবিতা থেমে যায়। নড়তে পারে না। তার পা দুটো যেন খুব ভারী হয়ে গেছে। নিশ্বাসও ফেলতে কষ্ট হচ্ছে তার। তার সামনে তীর্থ দাঁড়ানো। একটি লোকের সাথে কথা বলছে। তার পাশে একটি মেয়ে দাঁড়ানো। মেয়েটাকে সে চিনে। তীর্থের দূরের আত্নীয় হয়। নাম নদী। ওর সাথেই কী তীর্থের বিয়ে ঠিক হয়েছে? ভাবতেই বুকের ভেতর কামড়ে উঠে তার।

ভাবতে ভাবতেই তীর্থের দৃষ্টিও তার দিকে পড়ে। তার চোখেমুখেও বিস্ময়ের ভাব। আজ কতমাস পর দু’জনে একে অপরের মুখোমুখি হলো। দুইজনে কিছু মুহূর্ত একে অপরের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তীর্থ তার দিকে এগিয়ে আসতে নেয়। তখনই তার বাহু ধরে নেয় নদী। কবিতার চোখ যেয়ে আটকায় সে হাতে। তার বুকের যন্ত্রণা বাড়ে। নিজে অনিচ্ছাতেই চোখ দিয়ে গড়িয়ে বলে এক বিন্দু অশ্রুজল। ঠিক সে মুহূর্তেই কেউ একজন তার চোখের উপর হাত রাখে। কানের কাছে মুখ এনে মুগ্ধতা ভরা গলায় বলে, “তোমার কাজলমাখা নয়নে আমার প্রাণ আসে যায় কিন্তু সে নয়নে আমার জল সহ্য হয় না।”
#মুহূর্তে
পর্ব-৫৮
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

সে মুহূর্তেই কেউ একজন তার চোখের উপর হাত রাখে। কানের কাছে মুখ এনে মুগ্ধতা ভরা গলায় বলে, “তোমার কাজলমাখা নয়নে আমার প্রাণ আসে যায় কিন্তু সে নয়নে আমার জল সহ্য হয় না।”

কবিতা তার চোখের সামনে থেকে হাত সরিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। কথনকে দেখে অবাক হয় সে, “আপনি এখানে কি করছেন?”
“অনু পাঠাল। বলল আমি এসে যেন তোমার খেয়াল রাখি। এখন মনে হচ্ছে ওর কথাটা মেনে ভুল করি নি প্রয়োজন ছিলো।” কথন তীর্থের দিকে তাকিয়ে বলল। তার দৃষ্টি কঠিন। কবিতার মনে পড়ে এর আগেও দুজনে মারামারি করে একে অপরকে আহত করেছিল তাই সে কথনের হাত ধরে সেখান থেকে নিয়ে যায়।

তীর্থ কথনকে কবিতার সাথে দেখে ক্রোধিত হয়। সে হাত শক্ত করে মুঠো করে নেয়। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। মাথায় রক্ত উঠে যায় তার। তার পাশে থেকে নদী বলে, “আপনি ওদিকে কেন যাচ্ছেন? আপনাদের মাঝে তো সব শেষ। কবিতা ভাবি…মানে কবিতা অন্যকারো সাথে হাত ধরে ঘুরছে। উনি মুভ অন করেছে। আপনারও এখন করা উচিত। আন্টি আমার সাথে আপনার বিয়ে ঠিক করেছে রাজি হয়ে যান। একবারে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
নদী হাসিমুখে কথাগুলো বলে। তীর্থ কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই তার মুখের হাসি উড়ে যায়। ভয়ে বুক কেঁপে উঠে তার। সাথে সাথে সে হাত ছেড়ে দেয়। তীর্থ কবিতার দিকে যায়।

কবিতার কাছে যেতে নেবার সময় মাঝ রাস্তায় তীর্থ তার পুরনো এক বিজনেস পার্টনারের সাথে দেখা হয়। ঠিক বিজনেস পার্টনার বললে ভুল হবে। ব্যবসায়ের শুরুর দিকে থেকে কাঁচামাল নিতো সে। খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো কিন্তু কিছু কারণে তা আর থাকে না।
“আরে মিস্টার তীর্থ, কেমন আছেন?”
“জামাল সাহেব আপনি? আপনাকে যখন কল দিয়েছিলাম আপনার এসিস্ট্যান্ট বলল আপনি না’কি ঢাকার বাহিরে।”
জামাল সাহেব হেসে বলে, “আপনি হয়তো বার বার ফোন দিয়েছিলেন। এতবার ফোন দিলে সে এমনই বলে।”
তীর্থ লজ্জা বোধ করে। কিছুটা সংযত হয়ে বলে, “আমি একটু কাজের কথা বলার জন্য কল দিয়েছিলাম।”
“আমার সাথে কাজের কথা? আমার মতো ছোট ব্যবসায়ীর সাথে আপনার কি কাজের কথা থাকতে পারে? আপনি না বলেছিলেন, আপনি আমার মতো ছোট ব্যবসায়ীদের হাতের মুঠোয় রাখেন। আমরা তো আপনার সামনে বসারও যোগ্য না। আপনার কারখানায় তো সব দামী দামী কাঁচামাল আসে। ওহ আপনার তো ব্যবসা একদম ডুবে গেছে। খবরটা শুনেছিলাম। তো বলেন কি কথা বলবেন।”

তীর্থ লজ্জায় কিছুক্ষণ চুপ থাকে। সে আগে কারও সামনে এভাবে এত লজ্জা পাবার পরও অনুরোধ করে নি। কিন্তু তার কিছু করার নেই। কম দামে ভালো কাঁচামাল তার কাছেই পাওয়া যায়। তাই প্রয়োজনে তার এমনটা করতেই হবে। তারপর বলে, “আমি আপনার কাছ থেকে ক্ষমা চাচ্ছি। আমার আপনার সাথে এমন ব্যবহার করা উচিত হয় নি। আমরা কি অতীত ভুলে আবার একসাথে কাজ শুরু করতে পারি না।”
“বুঝলে তীর্থ আমার বয়স তো কম হয় নি। তোমার মতো এমন অনেককে এই জীবনে দেখেছি। কাজের সময় সবাই খুব নমনীয়তার সাথে কথা বলে। কিন্তু যখন একটু উন্নতি করে তখন তার মাঝে একপ্রকার অহংকার এসে পড়ে। সে নিজেকে খুব বড় মনে করতে থাকে। অহংকারে অন্ধ হয়ে যায়। আমি তোমার বাবার বয়সের ছিলাম তারপরও তুমি আমাকে যেভাবে অপমান করলে তা আমি কীভাবে ভুলে যাই বলো? মানুষের এক বাজে স্বভাব আছে জানো? খানিকটা উন্নতি করলে নিজেকে মহান ভাবতে শুরু করে। আকাশে উড়তে শুরু করে। কিন্তু তারা এটা ভুলে যায় যে আকাশে উড়াল দেবার পর যখন জমিনে এসে পড়ে তখন তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। এমন মানুষ নিজের ভিত্তি ভুলে যায়। তুমিও ভুলে গিয়েছিলে। তুমি বয়সে ছোট বলে ক্ষমা করে দিতে পারি কিন্তু তোমার সাথে আর কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব না।”
জামাল সাহেব যেতে নিলেই তার কাছে অনুরোধ করে বলল, “আংকেল আমি ক্ষমা চাচ্ছি তো। দয়া করে আরেকটা সুযোগ দিন।”
“দেখ আমি আগের থেকেই কয়েকজনের সাথে কাজ করছি। এর মধ্যে একজনের কাছে আমার অধিকাংশ কাঁচামাল যায়। তাই অন্যকাওকে দেবার মতো পণ্য হবে না। মেয়েটা আমাকে অনেক সম্মান করে। গত কয়বছরে অল্প থেকে শুরু করে অনেক বড় হয়েছে অথচ আজও আমার সাথে সে প্রথমদিনের মতো আময়িকভাবে কথা বলে। এখন তাকে কমিয়ে দিয়ে তো আমি তোমাকে দিতে পারি না। ওই’যে মেয়েটা।”
জামাল সাহেব তীর্থকে হাতের ইশারায় কবিতাকে দেখাল। তীর্থ কবিতাকে দেখে আর কিছু বলে না। চুপ করে যায়। জামাল সাহেব বলে, “আমি আসি। পরে কথা হবে।”

জামাল সাহেব সেখান থেকে কবিতার কাছে যায়, “আরে কবিতা মামনী কেমন আছো? তোমাকে এমন উদাসীন দেখাচ্ছে কেন?”
কবিতা জামাল সাহেবকে দেখে জোরপূর্বক হেসে বলে, “না আংকেল এমন কিছু না। আপনি বলেন কেমন আছেন? আর আন্টি কেমন আছে?”
“আমি তো ভালো। তোমার আন্টিও বেশ ভালো আছে। তোমার কথা ওদিন জিজ্ঞেস করছিলো।” জামাল সাহেব কথনের দিকে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করে, “উনি তোমার হাসবেন্ড?”
কথাটা শুনে কথনের মন উড়ু উড়ু করলেও কবিতা ছটফট করে বলে দেয়, “না না আংকেল।”
“তাহলে বয়ফ্রেন্ড? মাশাল্লাহ একসাথে অনেক মানায় তোমাদের। বিয়ে করছ কবে?”
কথন ঝটপট উওর দেয়, “ও যেদিন রাজি হয়।”
কবিতা আড়চোখে কথনের দিকে তাকিয়ে কনুই দিয়ে তার পেটে মারল। আর জামালকে বলল, “আংকেল এমন কিছু না। ভুল ভাবছেন আপনি। উনি আয়ার বন্ধু হয়।”
জামালসাহেব হাসে, “যা ভাবছি তা তো ঠিকই মনে হচ্ছে। আর ভুল হলে ঠিক করে নিও। দুইজনকে একসাথে অনেক মানায়।”
“আহ আংকেল মনের কথা বলে দিলেন।” কথন একগাল হেসে বলে। কবিতা অগ্নিদৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই কথন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। আরো কিছুক্ষণ কথা বললেন জামান সাহেব। তারপর চলে গেলেন। তার যাবার পর কথন কবিতাকে বলে, “দেখলে মানুষ তোমার আমার জুটিকে কত পছন্দ করেছেন। কেবল তোমারই পছন্দ হয় না।”
কবিতা বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। সাথে সাথে কথন ঠোঁটে আঙুল রেখে বলে, “ঠিক আছে চুপ করলাম, নাহয় রাগে জংলী বিড়ালের মতো কখন খামচে দেও কে জানে।”
“আপনাকে তেমনই করা উচিত। গত সাপ্তাহ থেকে অনেক জালাচ্ছেন। আপনাকে বললাম বিয়ের জন্য অন্য মেয়ে দেখতে। আপনি বসে বসে আমাকে দেখেন।”
“ছিঃ ছিঃ আমি আমার বউ ছাড়া অন্যকারো উপর নজর দেই না।”
“উফফ বিরক্তিকর।” কবিতা কাঁদোকাঁদো গলায় বলে। কথনও তাকে ভেঙিয়ে একইভাবে বলে, “উফফ বিরক্তিকর।”
কবিতা বিরক্ত হয়ে মুখ ফুলিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।

কথন হেসে তার পিছনে যেতে নিয়েছিলো। কিন্তু সে দেখে তীর্থ তার দিকে এগিয়ে আসছে। কথন তার সামনে যেয়ে দাঁড়ায়, “তুমি কবিতার কাছে কেন যাচ্ছ?”
কথনকে দেখে তীর্থের গা জ্বলে উঠে, “তোমার কী?”
“তুমি না কবিতার কাছে যেতে পারবে, আর না না ওর সাথে কথা বলতে পারবে।”
এবার মাথায় রক্ত উঠে যায় তীর্থের, “আর একথা বলার তুমি কে? কোন অধিকারে তুমি এই কথা বলছো?”
“হয়তো আমার কোনো অধিকার নেই। কিন্তু ওকে এত কষ্ট দেবার পর ওর সাথে কথা বলারও অধিকার হারিয়ে ফেলেছ তুমি। কীজন্য কথা বলতে চাও? ওর যন্ত্রণা আবারও মনে করাতে? তোমার বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনী মনে করাতে?”
কথাটা শুনে একটু দেবে গেল তীর্থ। সে আর কিছু বলতে পারলো না। কথন আবারও বলল, “আমি কয়েক বছর আগে ওকে তোমার কাছে ছেড়ে গিয়েছিলাম। তুমি ওকে সামলে রাখতে পারো নি। আমি এতবছর পর যখন ওকে হাস্পাতালে দেখেছিল ওকে আমি চিনতেও পারি নি। আগের কবিতাকে কোথাও পাই নি। ও কোথায় যেন হারিয়ে গেছিল। ওর হাসি, ওর চঞ্চলতা, ওর স্বপ্ন সব ছিনিয়ে নিয়েছ তুমি। বহু কষ্টে ও আবার ফিরে আসছে। প্লিজ ওর কাছে যেয়ে আর ওর কষ্ট বাড়িও না। যদি এক মুহূর্তের জন্য হলেও কবিতাকে আসলে ভালোবাসো তাহলে ওর থেকে দূরে থাকো।”
কথাগুলো বলেই কথন কবিতার কাছে চলে গেল। তার যতটুকু বলার ছিলো, সে বলেছে। বাকিটুকু তীর্থের উপর।
.
.
তীর্থ আর অনুষ্ঠানে থাকলো না। সেখান থেকে চলে এলো। বাসায় এসে নদী তাকে নানান প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে,
“সেখানে থেকে এভাবে এসে পড়লেন কেন? আপনার এক্স-ওয়াইফকে দেখে? আপনি এখনও ওর কথা ভাবেন?”
তীর্থ উত্তর দেয় না। সে যেয়ে সোফার উপর বসে থাকে। নিস্তব্ধ। তার মা-ও জিজ্ঞেস করতে থাকে, “কি’রে তোরা এত জলদি চলে আইলি কেন? সেখানে না কোন ব্যবসায়ীদের লগে কথা কইতি কাজের লাইগা।”

নদী রাগে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল, “তার এক্স-ওয়াইফকে দেখে চলে এসেছে।”
“মানে কবিতা? কবিতাও সেখানে গেছে?”
“জ্বি, আরও অন্য ছেলের হাত ধরে ঘুরছিল। আর এদিকে আপনার ছেলে আমাকে ইগনোর করছে, রাগ দেখাচ্ছে। আমাকে তার কি মনে হয় হ্যাঁ?”
তীর্থের মা নদীর কাঁধে হাত রেখে বলল, “থাক মা রাগ কইরো না। ওই একটু এমনই। তুমি শান্ত হইয়া বসো, আই তোমার লাইগা পছন্দের কিছু রান্না করে আনি।”
নদী তীর্থের মা’কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে, “দূরে সরেন। আপনি যে এসব নাটক এখন করছেন তা আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি। আপনাকে আমার মা ঠিক বলে দুই মুখা মানুষ। কাজ থাকলে মুখে অমৃত, কাজ শেষে বিষ। আপনার ছেলেকে আমি পছন্দ করতাম বলে বাবা বিয়ে জন্য রাজি হয়েছেন। নাহলে এমন কী আছে তার কাছে? আমার বাবা তার ব্যাবসায়ের জন্য টাকা দিতে রাজি তাও কি ঢং করছে! আমি তাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি এটা তার ভাগ্য।”

তীর্থ দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করে উঠে, “কে বলেছে তোমাকে করতে? তোমাকে কে বলেছে বিয়ে করে ধন্য করতে আমাকে?”
তীর্থের চিৎকার শুনে ভয়ে চুপ হয়ে গেল নদী। তীর্থের মা তার পাশে যেয়ে বলে, “এভাবে বলিস না বাবা। তোর ব্যবসা শেষ হয়ে গেছে রে। এখন খাওয়ার কিছু না থাকলে এই বাড়ি বেঁচতে হইবো। চুপ কর। চুপ কর।”
কথাটা শুনে সাহস পায় নদী। সেও বলে, “সেটাই। নিজের মা’য়ের কথা শুনুন, নাহয় দুইদিন পর পথের ফকির হয়ে যাবেন। আপনার বাজে স্বভাবের কারণেই তো কবিতা আপনাকে ছেড়ে এত খুশিতে আছে।”
তীর্থের চোখের সামনে ভেসে উঠে কবিতা এবং কথনের হাতধরা দৃশ্য। মাথায় রক্ত উঠে যায় তার। সে সামনে থাকা কাঁচের টেবিলটা এক লাথি দিয়ে ভেঙে ফেলে। রাগে তার চোখ লালচে হয়ে গেছে। সে আঙুল তুলে বলে, “খবরদার কবিতাকে এর মাঝে আনলে একদম খুন করে ফেলব। আমি আর একবারও যেন তোমাকে আমার চোখের সামনে না দেখি।”

তীর্থ নিজের রুমে চলে এলো। রাগে পায়চারি করতে লাগলো সারাটা রুমে। কিন্তু রাগ কমলো না। তার চোখের সামনে শুধু কবিতা চেহারা ভাসছে। সে প্রথমদিন তাকে দেখা থেকে তার ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত। কেমন শূন্য লাগছে বুকের ভেতর। তার বাচ্চাদের কথাও আজ খুব মনে পড়ছে। কুহু এবং কাব্যকে প্রথম কোলে নেবার অনুভূতিটা মনে পড়ছে। কেন সে এভাবে নিজের সুখের সংসারটা ধ্বংস করে দিলো? মুহূর্তেই শেষ করে দিলো সবটা। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখলে হয়তো আজ তার কাছে তার কবিতা থাকতো। তার বাচ্চারা থাকতো। কেন করল সে এমন পাপ? কেন? কেন? কেন?

তীর্থ রাগে দিশেহারা হয়ে গেল। এক এক করে রুমের সব ভাঙতে শুরু করলো। তার মা দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল। সে দরজা খুলে না। মেঝেতে বসে পড়ে সে। তার হাত দিয়ে কাঁচ আটকে আছ। রক্ত ঝরছে। চোখ দিয়ে অশ্রুজল বইসে তার। তার চোখের সামনে ভেসে উঠে সে তুফানের রাতে মৃণার মাঝে বিলীন হওয়াটা। সে ধ্বংসের মুহূর্তটা কী তার জীবন থেকে মুছে যেতে পারতো না?
.
.
“অনু তোর ভাইয়ের সাথে ডেটে গেছে।” কবিতা বাসাতে এসে তাহিরার কাছে অনুর কথা জিজ্ঞেস করতেই এই উওর পায়। সে হাসে, “সারাক্ষণ একসাথে ঘুরেফিরে জিজ্ঞেস করলেই বলছে, আমাদের মাঝে এমন কিছুই নেই।”
তাহিরা এবং কথন হাসে কথাটা শুনে। বিশেষ করে কবিতার বলার ভঙ্গি দেখে। কবিতা বলে, “তোমরা বসো, আমি চা নিয়ে আসছি।”
কবিতা সবার জন্য চা বানিয়ে আনে। অন্যদিকে কথন তাহিরার সাথে তার চিকিৎসা নিয়ে কিছু কথা বলে। কবিতা ফিরে আসার পর কুহু মুখ ফিরিয়ে বলে, “মা আংকেল আমাকে গল্প শুনতে দেয় না। খা’মণি আমাকে গল্প শুনায়। আংকেল খা’মণির সাথে কথা বলে।”
কাব্য পড়ছিলো। সে কুহুর কথা বলে, “আংকেল তো জরুরী কথা বলে। গল্প তো পড়ে শুনতে পারবে তুমি।”
কুহু মুখ ফুলিয়ে নেয়, “ভাই পঁচা। আংকেল পঁচা। সবাই পঁচা। আমি গল্প শুনবো। খা’মণি গল্প শুনাবে।”
কথন কুহুর গাল টেনে বলে, “আংকেলও কুহুর সাথে গল্প শুনবে। কুহু তো আংকেলকে কত ভালোবাসে।”
“না। কুহু একা শুনবে। যা যা।”
কথনকে ধাক্কা দিতে দিতে উঠায় কুহু। কথন কবিতার দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমার মেয়ে আমাকে দুই পয়সারও ইজ্জত দিলো না। চলো ছাদে যাই।”

আকাশে আজ চন্দ্রিমার রশ্মি তীব্র। কথন ও কবিতা ছাদে উঠে দাঁড়ায়। কবিতা বলে, “আজ জ্যোৎস্না চারপাশে ছড়িয়ে আছে।”
“জ্যোৎস্নার কথা বাদ দেও। মেয়েটা তো একদম তোমার মতো হয়ে গেল এখন?”
“আমার মেয়ে আমার মতো হবে না?”
কথন মুখ লটকিয়ে নেয়, “এটাই তো সমস্যা। এখন তোমার সাথে সাথে ওকেও পটাতে হবে। কাব্য তো এক’পায়ে তৈরি থাকবে আমাকে বাবা করার জন্য। তোমার থেকে এখন আমাকে পছন্দ করে ও।”
কবিতা হেসে চায়ের চুমুক দিয়ে বলে, “আপনাকে হাজার বলেও লাভ নেই। এক কথা বারবার বলতে হয়রান হন না?”
“তোমাকে এত বছর ধরে ভালোবেসে হয়রান হই নি, বলে হয়রান হবো?”
কবিতা চা’য়ে চুমুক দিতে যেয়েও থেমে যায়। তার চায়ের কাপ ছাদের বর্ডারের উপর রেখে তাকায় কথনের দিকে। তার হাসিটা মলিন হয়ে যায়। সে করুণ চোখে তাকায় কথনের দিকে, “আপনি দয়া করে আমাকে ভালোবাসা ছেড়ে দিন।”
কথন কিছু মুহূর্ত কবিতার দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে উঠে। যেন বিষয়টা ভীষণ মজার। কবিতার রাগ উঠে এই দৃশ্য দেখে, “আমি ফাজলামো করছি না।”
কবিতার এমন রাগ দেখে কথন হাসি থামায়। সে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি এঁকে কবিতার সামনে এসে ঝুঁকে তার মুখোমুখি হয়। চোখে চোখ রাগে। নরমসুরে বলে,
“তোমাকে ভালোবেসে এই জীবন নির্বাসন করে দিতে পারব, তোমাকে ভালোবেসে নিজেকে দিশেহারা করে দিতে পারব, তবুও তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না।”
কবিতা কথনের চোখ থেকে চোখ সরাতে পারে না। কথনের এমন গভীর দৃষ্টিতে যেন হারিয়ে গেল সে। হঠাৎ তার বুক কেঁপে উঠে। চোখ সরিয়ে নেয় সে, “আমাদের মনে হয়, আমরা এক বিশেষ ব্যক্তিকে ছাড়া কখনো বাঁচতে পারবো না। কথাটা ভুল। সবাই বাঁচে। হয়তো ভালোও থাকে। কেবল মনের দিক থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে।”
কথন কবিতাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার দুই হাত নিজের হাত নিয়ে আলতো করে ধরে। তার ছলছলে চোখে আবারও চোখ রাখে, “আমি আমার মনকে সুস্থ রাখতে চাই, তোমারও।”
“আমার পক্ষে আর সম্ভব না কথন। আমার মনের পক্ষে ভালোবাসাটা অসম্ভব। আর আমি তো একা নই, আমার জীবনে আরও দুইজন আছে।”
“আমি তোমার আগে তাদেরকে আমার জীবনে রাখবো। তাদের কখনো বাবার কমতি অনুভব হতে দিব না। ওয়াদা করছি।”
“এমন সবাই বলে।”
“সবাই চোখে চোখ রেখে মিথ্যা বলতে পারে না।”
কবিতা চমকে উঠে, “আমি তাদের জীবনের এত বড় সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারি না।”
“আমি অপেক্ষা করবো।”
“আর কত?”
“তোমার জন্য হলে আমার সারাজীবনের অপেক্ষাও কম পড়বে।”
কবিতার ঠিক এই মুহূর্তেই নিজের অতীতের সিদ্ধান্ত নিয়ে আফসোস হলো। ঠিক এই মুহূর্তেই তার মনে হলো কেন সে কথনকে বাছাই করে নি? কথন কেন তাকে নিজের মনের কথা বলে নি?
তার নয়ন দিয়ে অশ্রুজল বয়ে সে। সে রাগে কথনের কলার ধরে তাকে জিজ্ঞেস করে, “এত ভালোবাসলে কেন আমার কাছে ভালোবাসার কথা স্বীকার করেন নি? আপনাকে আমি একটি কবিতার আবদার করেছিলাম, আপনি সম্পূর্ণ ডায়েরি আমার নামে লিখেছেন, তা দেখান নি কেন? যখন আমি আপনাকে বললাম যে আমি অন্যকাওকে ভালোবাসি তখন কেন আপনি এভাবে আমাকে আপন করার জেদ করেন নি? কেন?”
কবিতা রাগে কথনের বুকে মারতে থাকে। কথন কিছুই বলে না। সে নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কবিতার দিকে। সে আচমকায় কবিতার দুই গালে হাত রেখে বলে, “কারণ আমি প্রতি মুহূর্তে কেবল তোমার সুখ চেয়েছিলো। আমার ভালোবাসা এতটা স্বার্থপর নয় যে তোমার খুশি ছিনিয়ে তা পাবার চেষ্টা করবো।”
আকস্মিক ভাবে কবিতা শান্ত হয়ে যায়। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কথনের দিকে। তবুও তার বুকের যন্ত্রণা কমে না। মুহূর্তের জন্যও না। আজ আসমানের বুকে ভেসে থাকা কেন্দ্রবিন্দু চন্দ্রিমা তাদের উপর জ্যোৎস্নার বর্ষণ করছে।
.
.
“খা’মণি গল্প শেষ কেন? রাজকুমার কী তাহলে রাজকন্যাকে বিয়ে করে নি?” কুহু আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে তাহিরাকে। কাব্য পাশেই বসে পড়ছিল। সে বিরক্ত হয়ে বলল, “এই রাজকন্যা, রাজকুমারী বাদ দিয়ে স্কুলের পড়া পড় তো। এসব গল্প দিয়ে কিছু হয় না।”
কুহু মুখ ফুলিয়ে তাকায় কাব্যের দিকে, “ভাইয়া তুই চুপ। তুই ভালো না। পঁচা। কুহুও রাজকন্যা হবে।” কুহু আবার তাহিরাকে জিজ্ঞেস করে, “খা’মণি গপ্পের কী রাজকন্যা রাজকুমারকে বিয়ে করেছে?”
তাহিরা কুহুকে কোলে নেয়, “তুমি রাজকন্যা হবে?”
কুহু দ্রুত মাথা নাড়ায়।
তাহিরা হেসে তার গালে চুমু খেয়ে বলে, “রাজকন্যা হতে হলে রাজকুমারকে বিয়ে করতে হয় না। আর তুমি রাজকন্যা হবে না। তুমি হবে রাণী। যেন কোনো রাজকুমার তোমাকে কষ্ট না দিতে পারে। তোমার মা’য়ের মতো শক্ত হবে। নিজের পা’য়ে দাঁড়াবে। নিজের সাথে অন্যদের কথা ভাববে। নিজের সাথে অন্যেরও সাহস হবে।”
“উঁহু খা’মণি গপ্পের কথা বলো না। গপ্পে কী তারা বিয়ে করেছে? তারা কী জীবন একসাথে কাটিয়েছে? তাদের কী ভালো এন্ডিং হয়েছে?””
তাহিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে মলিন হাসি ঠোঁটে এঁকে চোখ বন্ধ করে বলে, “জীবনে হ্যাপি এন্ডিং অথবা স্যাড এন্ডিং বলতে কিছু নেই। জীবন চলমান। এর গল্প কখনো শেষ হয় না। প্রতিটি মানুষের জীবনের এক গল্প আছে। প্রতিটি গল্পের চরিত্র আছে। জীবন যেমন প্রতিটি মুহূর্তে বদলায় তেমন জীবনে থাকা চরিত্র বদলায়, সম্পর্ক বদলায়, জীবনের কাহিনীও বদলায়। তোমার জীবনের গল্পের সমাপ্তি কখন হয় জানো? যে মুহূর্তে তুমি তোমার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করো ঠিক সে মুহূর্তেই তোমার জীবনের গল্পের সমাপ্তি ঘটে।”

সমাপ্ত।

1 COMMENT

  1. Allah golpota ordek porar por mone hoyeche dom bondho hoye jabe😥😰🥺🥺akjon meye ki vabe pare onno aarekti meyer shongshar vhangte🤧🤧🤮 ……
    Ar amader deshe Tirther moto amon hajaro purush aache jara khoniker mohe valobashar bishshash bangge…💔💔💔💔Abar kothon er moto o onek aache jara valobashar manusher khushir jonno hajaro tegh shikar kore😞😣😖😳 obosheshe akta kothao bolbo golpota khub valo hoyeche❤❤❤🧡🧡

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here