মুহুর্তে পর্ব -১৩+১৪

#মুহূর্তে
পর্ব-১৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

ধ্রুব ভার্সিটি থেকে বের হয়ে রাগের মাথায় কল দেয় তার মা’কে, “আম্মু তুমি আমাদের এলাকার কাজি অফিসে আসো। আমি এই মুহূর্তে তাহিরাকে বিয়ে করতে চাই।”
তাহিরা ধ্রুবর পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিলো। ধ্রুবকে রাগের সময় কিছু বললে তার রাগ বেড়ে যায়, এই কারণে চুপ থাকাটাই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু এই কথা শুনে তাহিরা হতবাক হয়ে যায়। ধ্রুবর হাত থেকে ফোন নিয়ে শিল্পা আক্তারকে জানায় ধ্রুব রাগে এ-সব বলছে। তার আসার প্রয়োজন নেই। ফোন রেখেই সে বকা দেয় ধ্রুবকে, “তোর মাথা কী খারাপ হয়ে গেছে? রাগের মাথায় কী যা তা বলছিস আন্টিকে ফোন দিয়ে?”
“যা তা বলি নি। আমি তোকে বিয়ে করব। তারপর দেখব কেউ আমাদের সম্পর্ক নিয়ে খারাপ কথা কীভাবে বলে।”
“একটা থাপ্পড় দিব। তুই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কে আমি কখন বিয়ে করব? কেউ কোনো খারাপ কথা বলেছে এর মানে এই নয় যে আমার তাদের কথা মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য প্রমাণ দেওয়া লাগবে।” অনেকটা ক্রোধিত স্বরে বলে তাহিরা। এরপর শান্ত হবার চেষ্টা করে বলে, “আমি বাসায় যাব। মাথা ব্যাথা করছে।”
ধ্রুব মলিন গলায় বলে, “আমি বাইক বের করছি।”
“না, তুই রাগে। আপাতত বাইক চালানো ঠিক হবে না। বাইকের চাবি লিমনকে দিয়ে রিকশা ঠিক কর।”

তাহিরা বাসায় এসে দেখে ঘরে তালা দেওয়া। সম্ভবত দাদী বাহিরে গেছে। ভাগ্যিস তাহিরা সকালেই চাবি নিয়ে গিয়েছিলো! তাহিরার পিছনে ধ্রুব ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “মা আর দাদীমণি তো আমাদের বিয়ে ঠিকই করেছে। আমরা আজ বিয়ে করি বা ক’বছর পর পার্থক্য কী?”
“ধ্রুব প্লিজ দয়া করে একই কথা বারবার বলিস না। বিরক্ত লাগে। এই কারণেই আন্টিকে মানা করেছিলাম তোকে বলতে। শুন পার্থক্য হলো, আমি পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করব। তারপর বিয়ের কথা চিন্তা করব।”
“আমি কি বিয়ের পর তোর পড়াশোনা অফফ করাব না’কি?”
“আমি জানি তুই আমার পড়াশোনা বন্ধ করাবি না। উল্টো তুই সবসময় আমাকে সাপোর্ট করেছিস কিন্তু আমার ইচ্ছা থাকতে পারে না? আর আমি কি কোথাও পালিয়ে যাব না’কি? তুইও এইখানে আছিস, আমিও আছি। সবাই আছে। বিয়ে হতে হলে, একদিন না একদিন হবেই।”
“আচ্ছা, তোর ইচ্ছার আমি সম্মান করব।”

ধ্রুব তাহিরাকে সোফায় বসিয়ে তার জন্য একগ্লাস ঠান্ডা পানি এনে দেয়। জুঁইয়ের কথার তার নিজেরই এখনো অশান্তি লাগছে তাহলে তাহিরার অবস্থা তো সে ভাবতেও পারছে না। তাহিরা পানি পান করে গ্লাস টেবিলে রাখার পর ধ্রুব তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে তাকে একবার ভালো করে যাচাই করে। তাহিরার ঠোঁটের এক অংশে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। ধ্রুব তার গালে হাত রেখে বুড়ো আঙুল দিয়ে তার ঠোঁটের সে অংশে আঙুল বুলিয়ে দেয়। নরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় সেদিকে। তারপর আলতো করে চুমু খায় সে ঠোঁটের সে অংশে এবং বলে, ” তুই না থাকলে আজ ওই মেয়েকে খুন করে ফেলতাম। ওর সাহস কি করে হয় তোকে এত বাজে কথা বলার?”
তাহিরারও মনে পড়ে সে কথাগুলো।
“তুই ওর চরিত্র নিয়ে কী বলছিলি? ওর মা-বাবাকে কী বলতি তুই?”
তাহিরার কথা শুনে ধ্রুবর মুখের রং উড়ে যায়। সে অপ্রস্তুত হয়ে উঠে, “আরে ওই’যে আমার সাথে কথা বলতো এইটাই। ওর আগের বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকাপের দুইদিন পর আমার সাথে তার যতসব আলাপ।”
“এত ছোট বিষয় নিয়ে ওকে হুমকি দিলি আর ও চুপ হয়ে গেল?”
“অতিরিক্ত ভাবছিস তুই ফুলটুসি। এক কাজ কর তুই আরাম কর। আমি খাবারের জন্য কিছু নিয়ে আসি।”
ধ্রুব তাহিরার চোখের দিকে একটিবারও তাকায় না। তার থেকে দৃষ্টি লুকিয়ে কথাগুলো বলে। তাহিরা তা ঠিক ধরতে পারে। ধ্রুবর এমন ব্যবহার তাহিরার মনে সন্দেহের প্রদীপ জ্বালায়। ধ্রুব উঠে যেতে নিলেই তাহিরা তার হাত ধরে নেয়। নিজেও উঠে দাঁড়িয়ে ধ্রুবর মুখোমুখি হয়ে প্রশ্ন করে, “তুই আমার কাছ থেকে মিথ্যা বলছিস। কি লুকাচ্ছিস তুই আমার কাছ থেকে?”
“অতিরিক্ত ভাবছিস তুই।”
“ধ্রুব, আমি যা জিজ্ঞেস করেছি তার সত্যি করে উওর দে।” কঠিন গলায় প্রশ্ন করে তাহিরা।
ধ্রুবর মাথা নত। সে আমতা-আমতা করে বলে, “তাহিরা আমি তোকে কথাটা জানাতাম সঠিক সময়ে। প্লিজ রাগ করিস না। আমি…আমি ওর সাথে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটিয়েছিলাম।”
প্রথম মুহূর্তে তো তাহিরা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। নিশ্চয়ই সে ভুল শুনছে। ধ্রুব এমন করতে পারে না। কখনো না। পরের মুহূর্তেই ধ্রুব তার বাহু ধরে তাকে বুঝানোর চেষ্টায় জুটে যায়, “ফুলটুসি দেখ তুই আমার কথা শুন। এইটা তোর সাথে ওয়াদা করার আগের কথা। তখন ভুল হয়ে গেছে। আমার মাথায় কখনো আসেও নি আমি আসলে তোকে ভালোবাসতে পারি। গাঁধা আমি। সারাজীবন তোর যত্ন নিলাম, তোর থেকে এক মুহূর্তের জন্যও দূরত্ব সহ্য হতো না, তোর প্রতি এতটা পজিসিভ ছিলাম অথচ একবার মাথায় আসে নি আমি তোকে ভালোবাসতে পারি। সত্যি বলছি তোকে ওয়াদা করার পর আমি কোনো মেয়ের সাথে কথাও বলি নি। জুঁইয়ের সাথে ভুলে এমনটা হয়ে গিয়েছিলো।”

অন্তরটা কেঁপে উঠে তাহিরার। সে স্তব্ধ হয়ে যায়। সে অনুভব করতে পারছে তার কাঁপুনি, তার বুকে প্রচন্ডভাবে আঘাতের পীড়া। সে অনুভব করতে পারছে ধ্রুবর সাথে কাটানো প্রতিটি স্মৃতি ঘোলাটে হয়ে আসা। তার দৃষ্টি মেঝেতে স্থির থাকে। সে প্রশ্ন করে, “জুঁই ছাড়া অন্যকারো সাথে এমন কিছু করেছিস?”
“তাহিরা আমি ভুলে….”
“করেছিস কি’না আমি তা জিজ্ঞেস করেছি।” তাহিরা ধ্রুবর চোখে চোখ রেখে রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করে। তার দৃষ্টি ক্ষোভে ভরা। ধ্রুব চোখ মেলাতে পারে না তাহিরার সাথে। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ উওর দেয়। তারপর আবার তাহিরার গালে হাত রেখে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করে, “তখন ভুল হয়ে গেছে ফুলটুসি। আর হবে না। আই প্রমিজ।”
“তুই কী আমার সাথেও শারীরিক সম্পর্ক করার জন্য আমার সাথে আছিস?”

“কী! তুই এইটা ভাবতেও কীভাবে পারিস?” ধ্রুবর গলার স্বরও উঁচু হয়ে আসে। কথাটা শুনে তার মাথাও খারাপ হয়ে যায়। তাহিরা তাকে নিয়ে এমনটা ভাবতেও কীভাবে পারে? সে আবারও একইসুরে বলে, “তাহিরা তোর মাথা ঠিক আছে? আমি তোকে নিয়ে কখনো এমনটা চিন্তাও করি নি। আমি তোকে ভালোবাসি। আমি তোকে কখনো কোনোভাবে কষ্ট দেবার কথা ভাবতেও পারি না।”
“কেন আমার মন আছে, ওই মেয়েদের মন নেই?”
“আমার অন্যকারো কিছুতে আসে যায় না।”
তাহিরা তার দুইহাত ধ্রুবর বুকে রেখে সজোরে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। শত চেষ্টার পরও তার চোখের জল আটকাতে পারে নি সে। সে চিৎকার করে বলে, “ভুল বলছিস তুই। তোর কাছে নিজের সুখ সর্বোপরি। আমাকে তুই কষ্ট দিতে পারিস না তাই না? এই জীবনে আমাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট তুই দিয়েছিস। তোর জন্য আমি কত রাত নিজের চোখের পানি ঝরিয়েছি এই ধারণাও তোর নেই। তুই আমার কোলে মাথা রেখে অন্যমেয়েদের সাথে প্রেমালাপ করতি তখন আমার মনের অবস্থা একবার ভেবে দেখেছিস?”
ধ্রুব অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় তাহিরার দিকে। তার দিকে এগিয়ে যেয়ে বলে, “আমি তখন কি জানতাম না’কি যে তোর মনে আমার জন্য কিছু আছে অথবা আমি তোকে ভালোবাসি।”
“ওইটাই তো। যখন তোর নিজের মনের কথা অনুভব হলো তখন তুই ছুটে এলি আমার কাছে। কারণ তোর ভয় লাগছিল যে আমি অন্যকাওকে বিয়ে করে নিব। আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না। তুই আমাকে হারিয়ে ফেলবি। তুই আমাকে ছাড়া থাকতে পারবি না। তুই কষ্ট পাবি। সবকিছু তোর, তোর এবং তোরই জন্য। অন্যকারও কোনো অনুভূতি নেই। আমি তোকে এত করে বলতাম কাওকে পছন্দ না করলে অকারণে তাদের মনের সাথে খেলিস না। তুই আমার কথা শুনেছিলি? আর আজ শুনছি তুই তাদের সাথে….ছিঃ! কোনো ছেলে আমার শরীর নিয়ে এইভাবে খেললে তোর কেমন লাগতো?”
“তাহিরা!” আর্তনাদ করে উঠে ধ্রুব।
তাহিরা ধ্রুবর মুখের সামনে আঙুল তুলে বলে, “চুপ। একদম চুপ। তোর আমার এক কথায় এমন রাগ উঠে গেল আর তুই যে ওই মেয়েদের সাথে এমন করেছিস তাদের মনে কি চলছে তা বুঝতে পারবি? আজ জুঁইকে তুই এতকিছু বলে আসলি তাও এতটা দৃঢ় কন্ঠে অথচ তুই ওর কাছে অপরাধী।”
“কেউ দুধ খাওয়া বাচ্চা না যে ঠিক-বেঠিক বুঝতে পারে না। আমি কারও সাথে কোনো জোর করি নি। আমার যতটা ভুল ছিলো ওদেরও ততই ভুল ছিলো। আমি অপরাধী হলে কেবল তোর কাছে।”
ধ্রুব এসে তাহিরার হাত ধরতেই তাহিরা এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে নেই। বলে, “আমি এই মুহূর্তে তোর চেহেরাও দেখতে চাই না। এইখান থেকে যা।”
ধ্রুব তাহিরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, “আমার ভুল হয়ে গেছে আমি মানছি। কিন্তু দয়া করে আমার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিস না।”
তাহিরার নিশ্বাস আটকে আসছিল। কান্নার চোটে সে কথাও ঠিক মতো বলতে পারছিলো না। সে বহু কষ্টে বলল, “ধ্রুব, দয়া করে এইখান থেকে চলে যা। আমার তোর চেহেরা দেখতেও কষ্ট হচ্ছে। তোর কন্ঠ শুনে বিরক্ত হচ্ছে। তোর ছোঁয়া থেকে…. ঘৃণা লাগছে আমার।”

ধ্রুব আচমকায় ছেড়ে দেয় তাহিরাকে। কিছু মুহূর্ত আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় সে তাহিরার দিকে। তার দৃষ্টিও নম্র। চোখদুটো লালচে। সে আর কথা বাড়ায় না। চলে যায় সেখান থেকে।

তাহিরা নিজেকে সামলাতে না পেরে বসে পড়ে মেঝেতে। তার শরীরটা ভীষণ অবশ লাগছে। তার মাথা ঘেরাচ্ছে। বুকের ভেতর ব্যাথা করছে। মনে হচ্ছে যেন কেউ ধারালো ছুরি দিয়ে বারবার আঘাত করেছে তার বুকের ভেতর।

অনেকটা সময় সেখানে বসে চোখের জল ঝরায় তাহিরা। তারপর বহু কষ্টে উঠে নিজের কক্ষের দিকে পা বাড়ায়৷ রুমে যেয়ে আয়নায় একবার নিজেকে দেখে। তার চোখদুটো ফুলে লাল হয়ে গেছে। ঠোঁট দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। তাহিরা অসহায় দৃষ্টিতে নিজের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রয়। তার জীবনটা এমন কেন? তার মা বাবা যাবার পর থেকে কেবল ধ্রুবই ছিলো তার একমাত্র খুশির কারণ অথচ সে খুশিটাও সময়ের সাথে সাথে বিষের মতো তিক্ত হয়ে গেল। মাঝেমধ্যে নিজেকে দেখেই আফসোস হয় তার। সান্ত্বনা দিতে ইইচ্ছা হয়, কিন্তু পারে না।

ভাঙচুরের শব্দ আসছে। নিশ্চয়ই পাশের বাসায় ধ্রুব ভাঙচুর করছে। তার এখন দ্রুত ধ্রবর কাছে যেয়ে তাকে থামানো উচিত ছিলো, কিন্তু সে গেল না। আয়নায় তাকিয়ে নিজের জীবন নিয়ে আফসোস করতে করতে হাতের চুড়িগুলো রুক্ষভাবে খুলতে থাকলো। এরই মধ্যে দু’টো কাঁচের চুরি ভেঙে ঢুকে যায় তার হাতে। কিন্তু সে ‘টু’ শব্দও করে না। অনেকসময় শরীর আঘাতটা মনের আঘাতের কাছে কিছুই মনে হয় না।
.
.
কবিতা অপেক্ষা করছিলো তীর্থের। সে চেঞ্জিং রুমে গেছে। কবিতা তার শাড়ির সাথে মিলিয়ে তীর্থের জন্য একটি সাদা শার্ট নিয়েছে। যদিও তার প্রথম ইচ্ছা ছিলো তীর্থকে পাঞ্জাবি পরাবে কিন্তু তার কোনো সাদা পাঞ্জাবিই ভালো লাগে নি। যা ভালো লেগেছে তা হয়তো কালো, নাহয় রঙিন।
কবিতা আশেপাশের শার্টগুলো আবারো যাচাই করছিলো। এমন সময় চেঞ্জিং রুম থেকে বের হয় তীর্থ, “কবিতা ঠিক লাগছে?”
কবিতা ডাক শুনে তাকায় তীর্থের দিকে। তাকে দেখেই কবিতার চোখদুটো কপালে উঠে যায়। তীর্থের তমাটে রঙে সাদা কালারের শার্টটা ফুটে আছে। সে মনে মনে বলে, ‘ঠিক লাগছে? সেই লেভেলের হট লাগতেছে। কিন্তু এইটা মুখে বলা যাবে না। বললে ভাব নেওয়ার চান্স থাকবে না।’

কবিতা তার পাশের দুইটা মেয়ের কথা শুনে। দুইজনই তীর্থকে নিয়ে কথা বলছিলো। তীর্থকে কতটা আকর্ষণীয় লাগছে এই নিয়ে। কবিতা সরু চোখে তাকায় দুইজনের দিকে। তার ইচ্ছা করল দুইজনের ঠোঁটে পিন মেরে দিতে। সে একপ্রকার দৌড়ে যেয়ে দাঁড়ায় তীর্থের সামনে যেন মেয়ে দুটো তীর্থকে দেখতে না পারে। সে পা’য়ের পাতা উঁচু করে তীর্থের চুলগুলো আঙুল দিয়েই আঁচড়ে দিলো। তারপর শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বলল, “আপনাকে এমন শার্টে কত মানায়। আর আপনি ওগুলো কি পরে থাকেন? আপনাকে একদম গুন্ডা টাইপ লাগতো আর আজ একদম জেন্টালম্যান লাগছে। আজ যেয়ে দাঁড়ি এবং চুলটাও ঠিক করে নিবেন। একদম নায়ক লাগবে।”
“কি করব ছোটবেলা থেকে গুছিয়ে দেবার মতো কেউ ছিলো না।”
“কেন? আপনাকে এভাবে দেখে আংকেল আন্টি আপনাকে কিছু বলতো না?”
“আমার কাছে কেউ ছিলো না।”
কবিতা চমকে তাকায় তীর্থের দিকে কেবল একপলকের জন্য। তার ঠোঁটের হাসি প্রায় নাই হয়ে যায়। তীর্থ জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলে, “চিন্তা করো না দুইজনই বেঁচে আছে, কেবল আমার সাথে নেই।”
কবিতা স্পষ্ট দেখতে পারছিলো তীর্থের মুখে ভেসে উঠা কষ্ট। তাই সে নিজের ঠোঁটে হাসি এঁকে তীর্থের হাত ধরে তাকে এক আয়নার সামনে নিয়ে যায়। খুশিমনে জিজ্ঞাসা করে, “দেখেন কত ভালো দেখাচ্ছে।”
তীর্থ আয়নাতে দেখতে পারছিলো তাকে ও কবিতাকে। হ্যাঁ, আজ দুইজনকে মানাচ্ছে। একসাথে বেশ মানাচ্ছে। সে একগাল হেসে তাকাল কবিতার দিকে, “অনেক ভালো দেখাচ্ছে।”
কবিতা প্রথমে ভাবলো তীর্থ কেবল নিজের কথা বলছে। কিন্তু আয়নায় তীর্থকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার ভুল ধারণা ভাঙে। তীর্থ তার দিকে তাকিয়ে আছে। লজ্জায় মাখা মাখা হয়ে যায় সে। চোখ নামিয়ে বলে, “চলুন যাওয়া যাক।”

তীর্থ পেমেন্ট করে সেখান থেকে বের হয়ে যায়। বাইকে উঠে মাঝরাস্তাতেই কবিতা আবদার করে সে ফুসকা খাবে। তীর্থ রাস্তার একপাশে বাইক থামায়। কবিতা ফুসকা ওয়ালা মামার কাছে যেয়ে বলে, “মামা ঝটপট দুই প্লেট ফুসকা তৈরি করুন। একটা অনেক ঝাল হবে।”
তীর্থ থামায় তাকে, “আমার ফুসকা পছন্দ না। তুমি খাও।”
কবিতা এমন মুখ করলো যেন এমন আজব কথা সে আগে কখনো শুনে নি, “আয়হায় কী বলেন এইসব? ফুসকা কার পছন্দ হয় না? আমি তো পাড়লে ফুসকাকে জাতীয় ফাস্টফুড বানায় দিতাম।”
তীর্থ হাসে, “আমার ভালো লাগে না।”
কবিতা চুপ করে আশেপাশে কি যেন দেখে তারপর তীর্থকে সেখানে দাঁড়াতে বলে দৌড়ে কোথাও চলে যায়। কিছুক্ষণ পর উপস্থিত হয় একটা কোক ও বার্গার নিয়ে। তীর্থের হাতে তা ধরিয়ে বলল, “লিমন ভাইয়ার কথা শুনেছিলাম অনুষ্ঠানের কাজে ব্যস্ত থাকায় কিছু খান নি। এমনটা করা একদম উচিত না। যত যাই হোক ঠিক সময়ে খাবার খাওয়া উচিত বুঝলেন?”
তীর্থ মনে মনে ভীষণ খুশি হয় তার জন্য কবিতা ভাবে এই কারণে। কিন্তু মুখে বিশেষ কিছু বলে না। কবিতাকে ফুসকা খেতে দেখে সে। কেমন মিষ্টি লাগে তাকে। চোখ বন্ধ করে ফুসকাটা মুখে দেয়। আবার একটুপর লাফিয়ে উঠে। ঝালের কারণে তার চোখ মুখ লাল হয়ে যায় তবুও সে সম্পূর্ণ প্লেট খেয়ে শেষ করল। তাকে দেখে তীর্থ অবাক না হয়ে পারলো না। তার মনে হলো মেয়েটা এত আজব কেন? পরের মুহূর্তেই তার মনে হয়, এতটা আজব বলেই হয়তো এতটা ভালো লেগেছে তার কবিতাকে।

খাওয়া-দাওয়ার পরও তারা ভার্সিটিতে গেল না। সোজা গেল রমনায়। সারাদিন ঘুরাঘুরি করে বিকেলে রওনা দেয় বাসার জন্য। তবে বাসায় যাওয়ার পূর্বে ভার্সিটিতে জরুরী কাজে যেতে হতো তীর্থর। তীর্থের হঠাৎ মনে হলো এইটা তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন। এত সুন্দর মুহূর্ত সে শেষ কবে কাটিয়েছিলো তার মনে নেই, কিন্তু তার এইটা মনে আছে আজ পনেরো বছর পর সে এতটা হাসলো। আর সে এটাও বুঝতে পারছে কবিতার প্রতি সে মুহূর্তে মুহূর্তে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এই দুর্বল হওয়াটা কি উচিত না’কি তাও সে জানে না।

আচমকায় দমকা হাওয়া ছুঁয়ে গেল। চারদিকে সুরভিমাখা বাতাস। হাল্কা বৃষ্টি ঝরতে শুরু করে। কবিতা আকাশের দিকে তাকাল। তীব্র হাওয়ায় বৃষ্টির ছোঁয়াটা স্বপ্নের মতো লাগছিলো তার। আজকের দিনটা এমনিতেই স্বপ্নের মতো সুন্দর ছিলো, এর উপর এই অসময়ের বৃষ্টি তার ভালোলাগা বাড়িয়ে দিলো। তার হঠাৎ করেই ইচ্ছা হলো তীর্থের কাঁধে মাথা রাখার জন্য কিন্তু তা তো হয় না। তাদের মধ্যে তো এমন কোনো বিশেষ সম্পর্ক নেই। তীর্থ ভার্সিটির সামনে বাইক দাঁড় করিয়ে বলল, “তুমি এইখানে বসো আমি পাঁচমিনিটের মাঝে আসছি। তারপর তোমাকে বাসায় দিয়ে আসব।”
কবিতা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। তীর্থের প্রতি তার অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে। তীর্থের যাওয়ার সময়ও কবিতা অপলক তাকিয়ে রইলো তীর্থের দিকে। তীর্থ যাবার পরও কবিতার দৃষ্টি থাকে দরজার দিকেই। প্রায় দশ মিনিট পর তীর্থ লিমনের সাথে কথা বলতে বলতে বের হলো। একপলক তাকাল কবিতার দিকে। কবিতা রাস্তার ওপাড়েই বাইকে বসা ছিলো। তীর্থের হাসিটি দেখে তার নিজের হাসিও গাঢ় হলো। কিন্তু তার হাসিটি উধাও হতেও মুহূর্তেখানিক সময় লাগে না।

কবিতা দেখল কয়েকজন এসে কথা বলছিল তীর্থের সাথে। তাদের কথোপকথন স্বাভাবিক বলে মনে হলো না তার। কিছুক্ষণ পরই সেখানে মারামারি শুরু হয়ে যায়। তাও ভয়ানকভাবে। তীর্থের বন্ধুরা এসেও সেখানে যোগ দেয়। অপর দলের কাওকেই আগে কবিতা দেখে নি। কবিতা স্তব্ধ হয়ে যায়। সে জীবনে কখনো এমন ভয়াবহ দৃশ্য আগে সামনা-সামনি দেখে নি। ভয়ে সে কাঁপতে থাকে। তার চোখে দিয়েও পানি বয়ে যায়। বিশেষ করে তীর্থের এমন রূপ সে মেনে নিতে পারে না। আজ যে ছেলে সারাদিন তার সাথে এত মিষ্টিভাবে কথা বলল তার এত ভয়ানক রূপ সে দেখবে সে ভাবতে পারে নি। কবিতা দেখল হঠাৎ করে একজন তীর্থের মাথায় আঘাত করেছে। তীর্থের মাথা বয়ে বয়ে রক্ত পড়ছে। কবিতা আর নিজেকে সামলাতে পাড়ল না। সে ছুটে গেল তীর্থের কাছে। গন্ডগোলের মাঝে কবিতা যেতে নিলেই লিমন তাকে থামায়, “ভাবি আপনি এইখানে কি করেন?”
কবিতা প্রায় কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করে, “আপনারা মারামারি কেন করছেন?”
“তাদের সাথে আগের থেকেই আমাদের নানান ঝামেলা ছিলো। এর উপর আজ না’কি ধ্রুব ভাই তার বোনের সাথে কি করছে। এই জায়গা সুবিধার না, আপনি যান এইখান থেকে।”
“কিন্তু তীর্থকে অনেক জোরে মেরেছে। ওর মাথা দিয়ে রক্ত পড়ছে।”
“আমরা ভাইকে দেখে নিব আপনি যান।”
“আমি তীর্থর চিকিৎসা না করা পর্যন্ত কোথাও যাব না।আমি পুলিশকে কল দিচ্ছি।”
“ভাবি জেদ কইরেন না। আচ্ছা আমি কোনো ভাবে পাঠাই ভাইকে।”

ইতিমধ্যে অনেকে আহত হয়েছে। আহত হবার পর মারামারির অবস্থা আগের থেকে শান্ত। কিন্তু রক্ত পড়ার কারণে তীর্থের প্রচন্ড মাথা ঘুরাচ্ছিলো। এরইমধ্যে লিমন এসে তীর্থকে কবিতার কথা জানালো। তীর্থ ভেবেছিল কবিতা এতক্ষণে চলে গেছে। সে কবিতাকে দেখে হতবাক। সে দৌড়ে যায় কবিতার কাছে। অস্থির হয়ে বলে, “তুমি এখানে কি করছ?”
কবিতা উত্তর দেয় না। তীর্থের দিকে তাকিয়ে কান্না করতে থাকে। তাকে কান্না করতে দেখে তীর্থ তার দুইগালে হাত রেখে নরম সুরে বলে, “তুমি প্লিজ এইখান থেকে যাও। প্লিজ।”
“আপনাকে এই অবস্থায় ছেড়ে…. ”
“এইসব আমার জন্য স্বাভাবিক কবিতা। তুমি যাও। আমি চাই না তুমি আমার এই পৃথিবী দেখো।”
কবিতার চোখ দুটো বড় হয়ে এলো। সে শক্ত করে তীর্থের শার্ট ধরে ভয়ার্ত গলায় বলল, “আপনার পিছনে…”
তীর্থ সাথে সাথে বুকে জড়িয়ে ধরে কবিতাকে শক্ত করে। আঘাতের শব্দও পায় সে। যখন তীর্থ তাকে ছাড়ে তখন সে দেখে তীর্থের ঘাড় গড়িয়ে রক্ত পড়ছে। মুহূর্ত না গড়াতেই তীর্থ তার পিছনে ফিরে ছেলেটার হাত থেকে লাঠিটা নিয়ে অমানুষের মতো তাকে মারতে থাকে। কবিতা শঙ্কিত হলো। বিস্ময়ে তার মুখ দিয়ে কথাও বের হচ্ছিলো না। তীর্থের এমন ভয়ানক রূপ তার সামনে না আসলেও পারতো। এই মানুষটার প্রতি তার ভালোটা না লাগলেও হতো। কিন্তু এখন সম্ভবত একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে। তার মনে জন্ম নিয়েছে তীর্থের জন্য এক অতি সুন্দর অনুভূতি এবং আজ জন্ম নিলো কুৎসিত ভয়।

কিছুক্ষণ পরই সামনের দলের লোকেরা পালিয়ে যায়। ঝগড়া শেষে কাছের এক ফার্মেসিতে যেয়ে তারা ব্যান্ডেজ করছিল। কবিতাও একপাশে শঙ্কিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার সাদা শাড়িতে রক্ত লেগেছে আছে। তার নয়, তীর্থের।
রতন বলছিল, “ধ্রুব মানুষ পাইলো না পাঙা নেওয়ার জন্য। সে তো নাই। ভুগতে হইলো আমগো।”
“থাক ভাই। বন্ধু তো আমগোই।” তার পাশে বসা ছেলেটা বলে। তীর্থের ধ্যান তাদের কারও কথায় নেই। সে তো অপলক তাকিয়ে আছে কবিতার দিকে। ভয়ে মেয়েটা কুঁকড়ে গেছে। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে এক কোণায়।কান্নায় সম্পূর্ণ মুখটা লাল হয়ে গেছে। চোখ ও ঠোঁট কেমন ফোলা। ব্যান্ডেজ শেষে তীর্থ কবিতার কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোমার কোথাও ব্যাথা লাগে নি তো?”
কবিতা মাথা নাড়িয়ে না করে, “আপনার কী বেশি ব্যাথা করছে?”
“উঁহু, এইসব আমার জন্য স্বাভাবিক। আসো তোমাকে আমি বাসায় দিয়ে আসি। তোমার দেরি হয়ে গেছে।”
তীর্থ হাত বাড়িয়ে কবিতাকে ছুঁতে গেলেই কবিতা পিছিয়ে গেল, “আমি রিকশা নিয়ে চলে যাব।”
তীর্থ চমকে উঠে কবিতার এমন ব্যবহারে। হঠাৎ তার বুকের ভেতর শুরু হয় অসহ্যকর তুফান।
“তুমি কী আমার কাছ থেকে ভয় পাচ্ছ কবিতা?”
কবিতা এইবারও মাথা তুলে তাকাল না তীর্থের দিকে, “আপনি ঠিক আছেন এটা দেখার জন্যই ছিলাম এতক্ষণ নিজের খেয়াল রেখেন। লিমন ভাইয়া উনার সাথে থাকবেন অনেক রক্ত ঝরেছে উনার। আমি আসি।”
বলেই যত দ্রুত সম্ভব কবিতা সেখান থেকে চলে গেল। তীর্থ সেখানে নিথর হয়ে দাঁড়িয়েই রইলো। তার মাথায় একটিই প্রশ্ন ঘুরছিলো। কবিতা কী তাকে আজকের পর থেকে ঘৃণা করবে?

কলিংবেলের শব্দ শুনে তাহিরা মুখে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। তারপর যে দরজাটা খুলে সে। দরজাটা খুলতেই সে দেখে। কবিতা দাঁড়ানো। তার চোখ-মুখ লাল। তার সাদা শাড়িতে রক্ত ভরা। তাকে দেখেই বুক কেঁপে উঠল তাহিরার। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে তোর? এ’কী অবস্থা?”
কবিতা কান্না করতে করতে জড়িয়ে ধরে তাহিরাকে, “আপু আমার অনেক ভয় লাগছে। আমি এইখানে থাকব না। আমি বাড়িতে যাব। আপু আমি এখনই বাড়িতে যাব।”

একদিকে তাহিরা নিজের সাথে এক লড়াই করছে, আর অন্যদিকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে কবিতাকে। কবিতা শান্ত হয় শেষ রাতে। বুঝাই যাচ্ছিলো বেশ ভয় পেয়েছে সে। তাহিরা জানে, কবিতা বাহির থেকে নিজেকে যতই শক্ত দেখানোর চেষ্টা করুক, তার মনটা ভীষণ নরম। তাহিরারও এইখানে দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। সে নিজেকে কীভাবে সামলেছে তার উওরই পাচ্ছে না। কিন্তু সে এতটুকু জানে ধ্রুবর চেহেরাটাও সে দেখতে চাইছে না। আর না তার সাথে কথা বলতে চাইছে। ধ্রুবকে নিয়ে ভাবতেই কথাগুলো তার কানে ভাসে। তার বুকের ভেতরের ব্যাথাটা বাড়ে। তার দম বন্ধ হয়ে আসে। আজ তার হঠাৎ মনে হলো তার মা বাবার সাথে সে মরে গেলে কী বিশেষ কোনো ক্ষতি হতো?

তাহিরা সিদ্ধান্ত নিলো কবিতাকে নিয়ে সে কাল সকালেই কুমিল্লা যাবে। কবিতাদের বাড়ি। কবিতারও ভালো লাগবে আর সেও ক’টা দিন ধ্রুবর থেকে দূরে থাকবে। যদিও দাদী প্রথমে এই নিয়ে অনেক চিৎকার চেঁচামেচি করে কিন্তু পরে রাজি হয়। সেও সিদ্ধান্ত নেয় কবিতা ও তাহিরা যাবার পর সে নিজেও ক’টা দিন নিজের বোনের বাড়িতে বেড়াতে যাবে। অনেকবছর যাওয়া হয় না।

যেই কথা সেই কাজ। পরেরদিন সকালে কবিতা ও তাহিরা রওনা দেয় কাউকে এই বিষয়ে না জানিয়েই।
#মুহূর্তে
পর্ব-১৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

শেষ দুপুরের সোনালী রোদ্দুর এসে পড়ছিলো তাহিরার উপর। ছাদের এককোণে দাঁড়ানো সে। আকাশের দলবাঁধা কবুতরের উড়াল দেখতে ভালোই লাগছিলো তার। তার পিছন থেকে হাসির শব্দ, চিৎকার চেঁচামেচি। কবিতা সহ তার সকল কাজিনরা কানামাছি খেলছে। তাহিরাকেও জোর করেছিলো কিন্তু তার মন নেই এইসবে। তার মন তো পড়ে আছে তার কাছে যার থেকে সে খুব করে পালাতে চাইছে। কিন্তু সে জানে অবশেষে তার দুয়ারেই যেতে হবে তাহিরার। প্রচন্ড ভালোবাসে যে তার পাশের ঘরের উচ্ছন্ন ছেলেটাকে। সে জানে নিজেকে যতই দূর রাখুক তবুও ধ্রুবর বুকেতেই তার ঠাই। অতিরিক্ত ভালোবাসে সে ধ্রুবকে। সম্ভবত নিজের থেকেও বেশি। এই কারণে মাঝেমধ্যে ঘৃণাও হয় নিজের উপর। এমন একটা মানুষকেই তার কেন ভালোবাসতে হলো? কিন্তু এইবার সে নিজের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে চেষ্টা করবে ধ্রুবকে ভুলানোর। এইবারের আঘাতটাও যে গাঢ়!

হঠাৎ করে খালামণির কন্ঠ শুনে সে, “কবিতা…. এই কবিতা কতক্ষণ ধরে তোর ফোন বাজছে। কানে শুনিস না না’কি?”
কবিতা বিরক্তি নিয়ে বলে, “মা তুমিও না, আর সময় পাও না। এই একজন হাতে এসেছিলো। তোমার এখনই কথা বলতে হলো।”
কবিতা আগের থেকে অনেকটা স্বাভাবিক। এইখানে এসে তাকে ফুরফুরে লাগছে। সারাক্ষণ হাসি-খুশি, বাচ্চাদের মতো লাফা-লাফিতেই আর খেলাতেই তার দিন কাটে। কেউ বলতেই পারবে না চারদিন আগে মেয়েটার ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিশ্বাস আটকে এসেছিলো।

কবিতা বিরক্তি নিয়ে তার চোখের ওড়না খুলে নিচে যায়। তার ফোনে পনেরোটা মিসকল ভেসে আছে। সে অবাক। এতগুলো কল কে দিবে তাকে! কবিতা ফোনটা হাতে নিতেই ফোন আবারও বেজে উঠে। এইবার কবিতা ফোন ধরে বলে, “হ্যালো, কে?”
“কবিতা তুমি…ঠিক তুমি বলছ?”
বুকের ভেতর ধক করে উঠে। ফোনের ওপাশে তীর্থের কন্ঠ। কতদিন পর কন্ঠ শুনলো তার। হঠাৎ এক ভালোলাগার অনুভূতি এসে তাকে কাবু করে। পরের মুহূর্তে তার মনে পরে সে ভয়ানক সন্ধ্যাটা। রক্তিম আকাশের নিচে এক কুৎসিত দিক দেখেছিলো সে তীর্থের। সে শঙ্কিত হয়ে যায়। কাঁপা-কাঁপা কন্ঠে বলে, “আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেলেন? দেখুন আমি বাড়িতে এসেছি। কেউ আপনার সাথে কথা বলতে শুনলে আমার সমস্যা হবে। রাখলাম।”
কবিতা তার কানের কাছ থেকে ফোন দূরে নিতেই তীর্থের কথা শুনে থমকে যায়, “কবিতা আমার কথা শুনো, শিল্পা আন্টি আর নেই।”
“কী! কী বলছেন এইসব?”
“দুইদিন আগে এক্সিডেন্টে সে মৃত্যুবরণ করেন। ধ্রুবর অবস্থা অনেক খারাপ। সে খাবার খাচ্ছে না, কিছু বলছে না, কাঁদছেও না। আমাদের ভীষণ চিন্তা হচ্ছে কবিতা। আমার ওকে নিয়ে খুব ভয় কবিতা। তুমি যত দ্রুত সম্ভব তাহিরাকে নিয়ে আসো। ও ছাড়া কারও ধ্রুবকে সামলানোর ক্ষমতা নেই।”
“আমরা আসছি। আজই আসছি।”

কবিতা ছুটে গেল তাহিরার কাছে। তার নিশ্বাস ঘন। তাকে অস্বস্তিতে দেখাচ্ছে। তাহিরা কবিতার এমন এলোমেলো অবস্থা দেখে হেসে দেয়, “তোর এ’কি অবস্থা!”
“তোমার ফোন কোথায় আপু?”
তাহিরা চুপ করে রইলো। ধ্রুবর সাথে যেন যোগাযোগ না হয় এ-কারণে সে ফোন বন্ধ করে রেখেছিলো।
কবিতার চোখে পানি ভেসে আসে। তাহিরা এইবার হড়বড়িয়ে যায় কবিতাকে দেখে। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী হলো তোর?”
“আপু শিল্পা আন্টি আর নেই।”
তাহিরার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। সে আর্তনাদ করে উঠে, “ফাজলামোর একটা সীমা থাকে কবিতা।”
“আই উইশ এইটা ফাজলামো হতো। তীর্থ কল করেছিলো। ধ্রুব ভাইয়ার অবস্থা ভীষণ খারাপ।”
তাহিরার হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে উঠলো। সে পড়ে যেতে নিলেই কবিতা ধরে নেয় তাকে। তাহিরা মেঝেতে বসে অঝোরে কাঁদতে শুরু করে। অনেকটা সময় কাটে। সে চুপ। এতক্ষণে বাড়িতে উপস্থিত সবাই এসে সেখানে একজোট হলো। খালা তাকে ধরে পানি খাইয়ে সে। তাহিরা বহু কষ্টে বলে, “খালামণি আমার এখনই ঢাকায় পৌঁছাতে হবে।”
“এখন না মা, আবির আগে আসুক। কাজে শহরের বাহিরে গেছে। কাল বিকেলে আসবে। ওর সাথে গেলেই হবে।”
“কী বলছেন এইসব? আমার মা মারার যাবার পর উনিই আমাকে মা’য়ের আদর দিয়েছিল। এতদিনে মনে হয় উনার কবরও দেওয়া হয়ে গেছে। উনাকে শেষবারের মতো দেখার ভাগ্যটাও আমার হলো না। কিন্তু উনাকে করা শেষ ওয়াদা রক্ষার জন্য আমার যেতে হবে। আমার এখনই বের হতে হবে।”
কবিতা ছটফট করে উঠে দাঁড়ায়, “আমি ব্যাগ নিয়ে আসছি।”

দুইজনে সাথে সাথে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সারাটা রাস্তায় এক মুহূর্তের জন্যও তাহিরার কান্না থামে নি। বাসস্ট্যান্ডে তাদের নিতে আসে লিমন ও পলাশ। বাসায় পৌঁছে দেখে বাড়িতে থমথমে অবস্থা। কিছু প্রতিবেশি ও ধ্রুবর বন্ধু ছাড়া কেউ-ই নেই। ধ্রুবর কোনো আত্নীয় আসে নি। লিমন থেকে জানতে পারে এক্সিডেন্ট হয়েছিলো রাস্তা পাড় হবার সময়। তাহিরার নাম্বার বন্ধ থাকায় তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি। কেবল ধ্রুবর ফোনে কবিতা ও তার দাদীর নাম্বার ছিলো। ফোনটাও পাওয়া যাচ্ছে না। তার সাথে যোগাযোগ করার কোনো উপায় পাওয়া গেল না। বহুকষ্টে তীর্থ কবিতার নাম্বার যোগাড় করেছে। শিল্পার মৃত্যুর খবর শুনে ধ্রুবর কোনো আত্নীয় কবর জেয়ারতের জন্যও আসে নি। একটিবার ধ্রুবর খবরও নেয় নি ফোন করে। এর উপর ধ্রুবর অবস্থা খুব খারাপ। তাহিরা ও কবিতা বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই তীর্থের সামনে পড়ে তারা। তীর্থ এক দুই না ভেবে তাহিরাকে উঁচু স্বরে বলে, “তোমার মাথায় কী জ্ঞান বুদ্ধি বলতে কিছু আছে? ফোন বন্ধ রাখতে হলে ফোন ব্যাবহার করে লাভ কী? এইদিকে ধ্রুবর অবস্থা খারাপ আর ওদিকে তুমি ঘুরে বেড়াচ্ছ?”
কবিতা তাহিরার সামনে এসে দাঁড়ায়। সে শীতল গলায় বলে, “না বুঝে শুনে কথা বলবেন না। আপনার থেকে ধ্রুব ভাইয়ার জন্য আপুর চিন্তা শতগুণ বেশি সাথে শিল্পা আন্টি না থাকার বেদনাও। আপুর কাছে উনি মা’য়ের মতো ছিলেন।”
তীর্থ কবিতার কথার পিঠে কিছু বলতে পারে না। সে চুপ করে যায়।
“ধ্রুব… ও কোথায়?” কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে তাহিরা।
“ওর রুমে। কিছু খাচ্ছে না, কোনো কথা বলছে, ঘুমাচ্ছে না, এমকি কাঁদছেও না। ওকে এতবার বললাম কেঁদে নিজের মন হাল্কা করতে কিছু এক ফোঁটা জলও বের করে নি চোখ দিয়ে। কেমন নিথর হয়ে বসে আছে।”
তাহিরা দৌড়ে যায় ধ্রুবর রুমে।

চারদিকে অন্ধকার। দরজা খোলায় বাহির থেকে একটুখানি রশ্মি ভেতরে এলো। বিছানার এককোণে বসা ধ্রুব। তার হাতে একটি ছবির ফ্রেম। ছবিতে তার দুইপাশে তার মা ও তাহিরা দাঁড়ানো। সে ফ্রেমটাই বুকের কাছে রেখে এই দুইদিন কাটিয়েছে ধ্রুব। হঠাৎ একটি ছায়ামূর্তির দর্শন পায় ধ্রুব। সে বিরক্তি নিয়ে বলে, “আমার কারও সাথে কথা বলার ইচ্ছা নেই।”
ছায়ামূর্তিটি তবুও এগোল। এগিয়ে এলো তার কাছে। তার রুমের বাতি জ্বলে। তার সামনে তাহিরা। অন্তরটা কেঁপে উঠে ধ্রুবর। তাহিরা এসে তার গালে হাত রাখে। তার সম্পূর্ণ মুখটায় কেমন বেদনার ভাব ছড়ানো। তাহিরার হাতের স্পর্শতেই ধ্রুবর শুষ্ক চোখটা ভিজে গেল।

তীর্থ বাতি জ্বালিয়ে একপলক তাকায় ধ্রুবর দিকে। তারপর সে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। কবিতা অভিযোগের সুরে বলে, “আপনি দরজা বন্ধ করছেন কেন? আমি দেখা করব তো ধ্রুব ভাইয়ার সাথে।”
” এখন না। একটু একা সময় প্রয়োজন ওর। তাহিরা সাথে ওকে একা কিছুক্ষণ থাকতে দেও।”
কবিতা কথা এগোল না। ঘরটাতে চোখ বুলাতেই তার কান্না পেল। শিল্পা আন্টির সাথে তার খুব কম মুহূর্ত আছে কিন্তু কেন যেন তার খুব কষ্ট হচ্ছে। মনে পড়ছে শিল্পা আন্টির কথা।

তীর্থের কেমন যেন অশান্তি লাগছিলো কবিতার চোখের জল দেখে। বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথা করতে শুরু করল। কারও চোখের জল দেখলে বুক ব্যাথা করতে পারে এই ব্যাপারটা তার জানা ছিল না। তীর্থ হাত বাড়িয়ে কবিতার গালের জল আলতো করে মুছে দিল।

তীর্থের হাতের স্পর্শ পেতেই কবিতা চমকে তাকায় তার দিকে। হঠাৎ করে এক পা পিছিয়ে যায়। তার মনে পড়ে সেই রক্তিম সন্ধ্যার কথা। সে দেখতে পায় তীর্থের মুখের মলিনতা তবুও তার চোখের সামনে ভাসছিলো এই হাত দিয়েই কাউকে অমানুষের মতো মারার দৃশ্যটা। যে হাত দিয়ে আদর করে এখন তার চোখের জল মুছে দিচ্ছে সে হাত দিয়েই সেদিন কাউকে খুব মেরেছিলো তার সামনে দাঁড়ানো লোকটা। ভাবতেই শিউরে ওঠে সে। তার চোখ পড়ে তীর্থের মাথার ব্যান্ডেজের উপর। তাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে তার আঘাত এখন কেমন? ব্যথা করে কি? কিন্তু সে পারলো না। ভয়ে তার বুক কাঁপছে। সে সেখান থেকে চলে গেল।

লিমন তীর্থের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, “ভাই আপনি কি ঠিক আছেন?”
“হুম। ওদিন ও ভয় পেয়েছে। ভয় পাওয়াটাও স্বাভাবিক। ওর দূরে ছুটে যাওয়া স্বাভাবিক। আমার কষ্টের নগরীতে ওকে মানায় না’রে। আমার পৃথিবী ওর জন্য না। আমি এই ব্যাপারটা জানি। এইজন্য ওর থেকে দূরে সরতে চাই, কিন্তু পারি না। প্রতি মুহূর্ত আমি ওর প্রতি আরও দুর্বল হয়ে পড়ছি।”
“সব ঠিক হইয়া যাইব ভাই।”
তীর্থ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেখানে আর দাঁড়ায় না, চলে যায় ড্রইংরুমে। এক দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। তার থেকে দূরে এক সোফায় বসে কাঁদছে কবিতা। তীর্থ যতবার কবিতাকে দেখেছে ততবারই তার স্বাধীন মনোভাব, দুষ্টুমি আর সাহস দেখেছে। তার নরম দিকটা দেখা যায় খুব কম। অথচ এ দিকটা তার সবচেয়ে বেশি পছন্দের।

কলিংবেল বাজে। দরজা খুলে লিমন। সে রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে, “ভাই আন্টির ছাত্র কয়জন আসছে। খাবার নিয়া আসছে।”
তার পিছনে একজন বলল, “ঘরে চুলা জ্বালানো যেহেতু মানা তাই খাবার নিয়ে এলাম। গত দুইদিন আমাদের বন্ধুরা এনেছিলো। তাই আজ আমরা নিয়ে এলাম।”
তীর্থ মাথা নাড়ায় কেবল। কে কোনদিন খাবার এনেছে এতে তার কিছুই আসে যায় না। এ বিষয় নিয়ে বলার কি আছে সে বুঝতে পারল না। তারা আসুক বা না আসুক এতে তার কিছু আসে যায়ও না। কিন্তু ইতিমধ্যে একজনের প্রতি তার মনোযোগ গেল। সবার শেষে একটি লোক এলো এবং তার ধ্যান গেল কবিতার উপর। সে এক প্রকার ছুটে যায় কবিতার কাছে। চমকাল তীর্থ। লোকটা শিল্পা আন্টির মৃত্যুর দিনও উপস্থিত ছিলো। তাকে আগে দেখেছে মনে হলো কিন্তু চিনতে পারলো না। আজ কবিতার কাছে যাওয়ার পর তার মনে হলো এই লোকটা ভার্সিটিতে একদিন দেখা করতে এসেছিলো কবিতার সাথে। সম্ভবত এই লোকের সাথেই তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। নামটা বলেছিলো কবিতা।
কথন!

কক্ষে প্রবেশ করবার কিছু মুহূর্তেই কবিতার দর্শন পায় সে। তাকে দেখে অবাক হয় নি। ডক্টর শিল্পার সাথে সে পরিচিত। কিন্তু তাকে কান্না করতে দেখে তার খারাপ লাগে। মেয়েটাকে কাঁদলে একটুও মানায় না। সে দ্রুত এগিয়ে যেয়ে বসে কবিতার পাশে। তার মনে হলো কবিতাকে সান্ত্বনা দিলে তার কান্না আরও বাড়বে তাই সে স্বাভাবিক গলায় বলল, “এভাবে কাঁদছ কেন? একদম পেঁচার মতো দেখাচ্ছে।”
হতদম্ব হয়ে কবিতা তাকায় কথনের দিকে। বিস্ময়ে সে কান্নাও ভুলে যায়, “আপনি এই সময় ফাজলামি করছেন আমার সাথে?”
“ফাজলামি কোথায় করলাম? সত্যি বলছি। একতো গোল মুখ তোমার। এর উপর কান্নার সময় যেভাবে চোখ মুখ কুঁচকে নিলে একদম পেঁচার মতো দেখাচ্ছিলো।”
কবিতা মুখ ফুলিয়ে তাকায় কথনের দিকে। তার চোখে মুখে রাগের ছাপ। সে ক্রোধে মেঝেতে লাথি মেরে বলল, “আপনাকে তো … আপনাকে একবারে ওই… ধ্যুর কিছু মাথায়ও আসে না।”
রাগে কবিতা হনহনিয়ে বেরিয়ে যেতেই কথন বলে, “খাবার এনেছিলাম কিন্তু। আম্মুর হাতের যে গরুর মাংস ওদিন তোমার অনেক পছন্দ হয়েছিলো তাও আছে।”
কবিতা যত দ্রুত গিয়েছিলো তার থেকে দ্বিগুণ গতিতে ফিরে এলো। কথনের হাতের থেকে ব্যাগ নিয়ে বলল, “দুপুর থেকে কিছু খাই নি। আমার পেটে ইঁদুররা কাবাডি খেলছে।” বলেই সে কুড়কুড় করে খাবার নিয়ে গেল। যাবার পূর্বে লিমনকে আদেশের সুরে বলে, “লিমন ভাইয়া অন্যান্য প্যাকেটও নিয়ে আসেন।”
কথন হেসে দিলো কবিতার এমন কান্ডে। তার হাসিতে গড়াগড়ি খেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এমন শোকের বাড়িতে তা মানানসই নয়। কথনের এক বন্ধু এসে তাকে জিজ্ঞেস করে, “মেয়েটা তোর চেনা।”
“হ্যাঁ।”
“দেখতে সুন্দর আছে, মেয়েটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবি?”
কথনের হাসিটা হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায়। সে চোখ ঘুরিয়ে তাকায় তার বন্ধুর দিকে। শীতল কন্ঠে বলে, “ওর সাথে আমার বিয়ের কথা চলছে।”
তার বন্ধু কেমন জোরপূর্বক হাসলো। আমতা-আমতা করে বলল, “আরে তাহলে তো ভাবির মতো আমার। ভাবির মতো সুন্দর আরকি।” তারপর এক গভীর নিশ্বাস ফেলল।

কথন তার কথায় বিশেষ পাত্তা দিলো না। সে রুমে চোখ বুলিয়ে পায় তীর্থকে। এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল সে। তার সামনে যেয়ে স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করে, “ধ্রুবকে দেখছি না। ওর কী খবর?”
সে অবাক হলো। তীর্থ তার দিকে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে দৃষ্টিতে অসহায়, আহত এবং রাগান্বিত ভাব। কথন পরের মুহূর্তে ভাবলো এটা তার কল্পনা। যে মানুষকে সে চিনেও না সে মানুষ কেন তার উপর এমন অনুভূতি রাখবে?
তীর্থ কঠিন গলায় তাকে উওর দিলো, “ধ্রুব ভেতরে আছে। তাকে ডিস্টার্ব করা যাবে না।”
.
.
দরজা বন্ধ হবার শব্দ শুনে তাহিরা একপলক তাকায় দরজার দিকে। সাথে সাথে অনুভব করে ধ্রুবর হাতজোড়া তাকে শক্ত করে ধরে নিয়েছে। সে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করে। তার সকল অভিমান, রাগ, কষ্ট একপাশে রাখে। এই সময় ধ্রুবর তাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
ধ্রুবর মুখ সে দেখতে পারছিলো না। তার কেবল কাঁপানো গলার স্বর শুনতে পায় তাহিরা, “সে…দিন সকালে উঠে তোকে পাই নি। তোর ফোনও বন্ধ। দাদীও যেতে চাইল বনানী। তাকে নামিয়ে তোর খালার বাসার ঠিকানা নিয়েছিলাম। বিকেলেই উঠলাম তোর কাছে…যাবার জন্য। মাঝরাস্তায় ফোন আসে, মা’য়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমি তখনই ফিরে যাবার জন্য রওনা দিলাম। হাস্পাতালে পৌঁছে দেখি। উনি বেডে শুয়ে ছিলেন। সে রাতে তার সাথে দেখা করতে দেয় নি আমাকে বেয়াদব ডাক্তারগুলো। তার চিকিৎসার বাহানায়। ভোরে ফজরের আযানের পরপরই ডাক্তার বলে সে আর নেই। তাহু জানিস আমি অনেক ডাকলাম মা’কে। মা সবসময় আমার এক ডাকে আমার কাছে চলে আসতো। কিন্তু সে সাড়াই দিলো না। তাহি সে উঠে নি আর। আমি এত করে ডাকলাম। তার ছেলের একটা কথা সে শুনে নি। তুই আমার সাথে রাগ করে কেন গেলি? মা তোর সব কথা শুনতো। তুই একবার বলতি যেন আমাকে ছেড়ে না যায়। সে… সে ছাড়া যে আমি একা হয়ে যাব। বাবাও ছোট বেলায় আমাকে ছেড়ে চলে গেল। সে আমাকে বলেছিলো সে কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না। তাহলে কেন নিজের কথা রাখে নি সে? আমার কথা একবারও ভাবে নি।” তাহিরা অনুভব করতে পারছিলো তার পেটের কাছের পোশাকটা ভিজে গেছে ধ্রুবর চোখের জলে। ধ্রুব তাহিরাকে ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। এই প্রথম তার চেহেরা পরিষ্কার দেখতে পায় সে। কী বাজে অবস্থা হয়েছে তার! চোখের নিচে কালিতে ভরে গেছে। মুখটা নিষ্প্রাণ দেখাচ্ছে। খোচাখোচা দাঁড়ি উঠেছে গালে। তার চোখেমুখে পানিতে ভিজে গেছে। সে আজ পর্যন্ত এত বাজে অবস্থায় দেখে নি ধ্রুবকে।

ধ্রুব তাহিরার দুইগালে হাত রেখে অস্থির হয়ে বলে, “তাহু তুই আমাকে ছেড়ে যাবি না তো? তুইও মা’য়ের মতো আমাকে ছেড়ে যাস না প্লিজ। আমি মরে যাব। একদম মরে যাব। তুই আমাকে ছেড়ে গেলে আমি কার জন্য বাঁচব?” ধ্রুব একবার নিজের দুই হাতের দিকে তাকিয়ে দ্রুত তা সরিয়ে নেয় তাহিরার গাল থেকে, “আমি তোকে বিয়ের আগে ছুঁবও না, আই প্রমিজ। তবুও তুই আমাকে ছেড়ে যাস না।”
তাহিরা নিজেই ব্যাকুল হয়ে যাচ্ছিল ধ্রুবর এই অবস্থা দেখে। কেমন উন্মাদের মতো ব্যবহার করছিলো ধ্রুব। কী করবে সে? কীভাবে সামলাবে সে ধ্রুবকে?

ধ্রুব হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে পড়ে। অসহায় কন্ঠে বলে, “তাহু তুইও কী আমাকে একা ফেলে চলে যাবি? মা, বাবা, সবাই আমাকে ফেলে চলে গেছে। আমি অনেক খারাপ যে তাই। তুই প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাস না। তুই যেভাবে বলবি আমি সেভাবে চলবো। তাও তুই আমাকে ছেড়ে যাস না। তুই ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই।”
তাহিরা সাথে সাথে ধ্রুবর সামনে বসে তার দুইগালে হাত রেখে নরমসুরে বলল, “আমি কোথায় যাব তোকে ছেড়ে?”
তাহিরা ধ্রুবর কপালে একটা চুমু খেল। তারপর জড়িয়ে ধরে ধ্রুবকে। সে জানে না এমন সময় কি বলতে হয়। মা হারানোর কষ্ট কোনো সান্ত্বনা দিয়ে কমে না। কিছুতেই কমে না। সে শূণ্যস্থানটা এই জীবনে কেউ পূরণ করতে পারে না। তার মনে আছে যখন তার মা-বাবা মারা গিয়েছিলো, সবাই তাকে অনেক সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছে। লাভ হয় নি। বরং তার কষ্ট বেড়েছে।

ধ্রুবর বুকে মাথা রাখতেই সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাহিরাকে। যেন একটু ছাড় দিলেই সেও উড়াল দিয়ে হারিয়ে যাবে তার দৃষ্টির কাছ থেকে। কেমন কাঁপানো গলায় বলল, “তুই আমাকে ছেড়ে গেলে আমি সত্যি মরে যাব।”
তাহিরা শক্ত করে তার চোখ চেপে ধরল। ধ্রুবর শার্ট আঁকড়ে ধরলো। তার বুকে প্রচন্ড পীড়ন হচ্ছে। তার দুঃখ থেকে বেশি ধ্রুবর জন্য। তার মনে পড়ে শিল্পা আন্টি কাছে তার ওয়াদাটির কথা। সে একসময় ওয়াদা করেছিলো, সে কোনোমতেই ধ্রুবকে একা ছাড়বে না। সারাজীবন তার কাছে থাকবে। শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত।

চলবে….

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here