#মুহূর্তে
পর্ব-৫৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
মৃণা ছুটে এলো তীর্থের কাছে। তীর্থের এক হাত ধরে নিজের পেটে রেখে বলল, “তীর্থ এটা তোমার সন্তান। তোমার অংশ। তোমার কি ওকে নিয়ে কোনো অনুভূতি নেই? বিন্দুমাত্র না?”
তীর্থ তার হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, “দাঁড়াও একটুখানি।”
তীর্থ তার রুমে যেয়ে কিছুক্ষণ পর ফিরে আসলো। মৃণার হাতে কিছু নগদ টাকা এবং চেক দিয়ে বলল, “তুমি এসবের জন্য এসেছিলে তাই না? তুমি টাকা ছাড়া অন্য কিছু বুঝ না। আমিই পাগল ছিলাম তোমার সাথে দুই বছর থেকেও তা বুঝতে পারি নি। এই টাকা দিয়ে তুমি যা করার করো। বাচ্চা রাখো বা ফেলে দেও। তোমার ইচ্ছা। কিন্তু আমার সামনে আর আসবে না।”
কথাগুলো বলে যেতে নিলেও আবার ফিরে তাকাল তীর্থ, “আমি এতদিন সবার দোষ দিয়ে এসেছি। কিন্তু আমার ভুল ছিলাম। দোষ আমারও ছিলো। তাই যদি বাচ্চার কোনো প্রয়োজন পড়ে তাহলে আমি টাকা দিয়ে সাহায্য করবো। এছাড়া আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। যে বাচ্চা দুটোর সাথে আমি মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে ছিলাম তাদের জন্য কখনো ভালো বাবা প্রমাণিত হই নি, তো এই বাচ্চা তো আমার না চাওয়া। ওকে ভালোবাসা দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। তোমার অর্থ কম পড়লে আমাকে কল দিও।”
“কিন্তু… ”
মৃণা কিছু বলতে নিলেই তীর্থ তাকে থামিয়ে দেয়। তার মা’কে ভেতরের রুমে পাঠিয়ে বলে, “দেখ মৃণা এটা বলবে না যে এই বাচ্চা আমাদের ভালোবাসার অংশ। তুমি কখনো আমার ভালোবাসা ছিলে না, এটা তুমিও জানো। তুমি আমার কিছু মুহূর্তের প্রয়োজন ছিলে। তা অনুভূতির দিক থেকে হোক অথবা শারীরিক দিক থেকে। তেমনটা আমিও কখনো তোমার জন্য অর্থের প্রয়োজন ছাড়া কিছুই ছিলাম না। হয়তো আমাদের একে অপরের প্রতি আকর্ষণ ছিলো কিন্তু ভালোবাসা কখনো ছিলো। আমি এই জীবনে কাউকে যদি পবিত্রতার সাথে ভালোবাসি তাহলে সে কবিতা। কেবল কবিতা। আমি অলরেডি সব হারিয়ে ফেলেছি। তুমি যদি টাকার কারণে এখনো আমার সাথে থাকতে চাও তাহলে আমি বলে দেই আমার বিজনেসও ঘাটতিতে যাচ্ছে। আর এটা আজকাল পুরো শহর জানে। তোমারও জানা উচিত।”
এতটুকু বলে কিছুক্ষন চুপ করে থাকে তীর্থ। মৃণার উত্তরের অপেক্ষা করে। কিন্তু মৃণা কোন উত্তর দেয় না। তীর্থ তাচ্ছিল্য হেসে বলে, “আমি জানতাম, তোমার কেবল টাকার প্রয়োজন ছিলো। টাকা পেয়ে গেছো। এখন যেতে পারো।”
তীর্থ মৃণার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো।
.
.
রাতে কবিতা আবিরকে খাবারের জন্য ডাকতে বারান্দায় এসেছিলো। কিন্তু তার কথা শুনে সেখানেই থেমে যায়, “হ্যাঁ মা, এইতো খাব। আর বাসাটা সুন্দর আছে তুমি চিন্তা করো না। দেখা করতে আসব কবে? আসবো কয়েকদিনেই। এখানে আগে সব সেটেল হোক।”
মা’য়ের কথা বলতে শুনে কবিতার বুকের ভেতর মুচড়ে উঠে। আজ প্রায় আট বছর হতে এলো, সে তার মা’য়ের সাথে কথা বলে নি, তাকে দেখে নি। চোখে জল ভেসে এলো তার। সে সেখান থেকে যেতে চাইলো। তখনই তার ভাইকে বলতে শুনলো, “কবিতা? সে আছে মা ঠিকঠাক। তুমি যেহেতু বলছ চেষ্টা করবো ওকে আনার। আমি জানি না ও আসবে কি-না?”
কবিতা খানিকটা চমকে উঠে তার কথা শুনে। সে দাঁড়িয়ে যায়। আবির আরও বলে, “মা কান্না করো না। আমি জানি তোমার ওকে মনে পড়ে কিন্তু ওর রাগও তো জায়েজ। ওর সাথে যা তুমি এবং ভাই করেছ তা একদম ভুল ছিলো। আজ যদি আসলে ওর বিয়ে জয়ের সাথে হতো তাহলে আজ ওর স্ত্রীর জায়গায় আমাদের কবিতা থাকতো। ওই অমানুষটা এই নেশায় নিজের স্ত্রীর কী জঘন্য অবস্থা করেছিলো। মেয়েটা যে কারও কাছে সাহায্য চাইবে সে অবস্থাও ছিলো না। বন্দী করে রাখতো। শেষমেশ আত্নহত্যা করলো মেয়েটা। আজ ওর মেয়ের জায়গায় আমাদের কবিতা থাকতে পারতো। আর তোমরা ওকে ওই জাহান্নামে জোর করে দিতে চেয়েছিলে। আমি ওকে কোন মুখে বলি তোমাদের সাথে কথা বলতে?”
“ভাইয়া…”
কবিতার কন্ঠ শুনে আবির পিছনে তাকায়, “কবিতা তুই?”
“মা আমার সাথে কথা বলতে চায়?” গলা কেঁপে উঠে কবিতা।
“তুই কথা বলবি?” আবির ফোনে উৎসুক গলায় বলে, “মা..মা কবিতা তোমার সাথে কথা বলবে। নেও মা কথা বলো।”
আবির কবিতাকে ফোনটা দেয়। সে ফোন কাঁপা-কাঁপা হাতে দিয়ে কানের কাছে রাখে। ফোনের ওপাশ থেকে কোনো শব্দ ভেসে আসে না। কেবল আসে তো কান্নার আওয়াজ। কবিতার শরীর কাঁপছিলো, সাথে নিশ্বাসও। সে কান্নাভেজা গলায় ডাকে, “মা আছো?”
মা’য়ের কন্ঠের পূর্বে এমন সময় তার বড় ভাই কবিরের কন্ঠ শোনা যায়, “আজ এত বছর পর তোমার মেয়ের কেন কথা বলতে মন চাইলো বুঝো না? ওই ছেলে ছেড়ে দিয়েছে না তাকে এখন তো তার টাকার অভাব পড়ছে। এখন এসে আমার ঘাড়ের উপর বসবে তাও আবার নিজের বাচ্চাগুলোকে নিয়ে। ওই ছেলেকে আমার অনুমতির বিরুদ্ধে বিয়ে করেছিলো না? একদম ঠিক হয়েছে ওর সাথে।”
কবিতার গা জ্বলে উঠে কথাটা শুনে। মাথায় রক্ত উঠে যায়। তার মা’য়ের কন্ঠে প্রথম শব্দটা শুনেও সে ফোন কেটে দেয়। আবিরের হাতে ফোন দিয়ে বলে, “কথা বলার ইচ্ছা মরে গেছে।”
.
.
আইদের চিন্তায় মাথা ব্যাথায় ফেটে যাচ্ছে। তিন দিন হতে চলল, মৃণার কোনো খবর নেই। এমন না যে তার মৃণার কোনো চিন্তা হচ্ছে। কিন্তু তার মাঝে পালিত সে নিষ্পাপ প্রাণ তার জন্য তার ভীষন চিন্তা হচ্ছে। যে প্রাণটি এই পৃথিবীতে আসেনি তার জন্য আইদের বুক কাঁপছে। এই সম্পর্কের কি নাম সে জানে না। সব সম্পর্ক তো আর রক্তের হয় না। মায়ার কিছু বাঁধনও থাকে।
আইদ খুব চিন্তা করে কেবল তীর্থের বাসার কথা চিন্তা করতে পারল। এছাড়া মৃণার যাবার অন্য কোন জায়গা নেই। সে রওনা দেয় বাসার উদ্দেশ্য। এমন সময় তার ফোন আসে হাস্পাতাল থেকে। মৃণার জন্য। সে দ্রুত সেখানে পৌঁছায়। সেখানে যেয়ে তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। যে প্রাণটির জন্য তার হৃদয়ে শূন্যতা অনুভব হচ্ছিল সে আর এই পৃথিবীতে নেই। মৃণার মিস্কেরেজ হয়ে গেছে। সে কেবিনে যায়। মৃণা সেখানে শুয়ে ছিলো। নির্জীব হয়ে। তার দৃষ্টি শূন্য। দরজা দিয়ে আইদকে ঢুকতে দেখেই সে হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করে। আইদ কাছে আসতেই তার হাত ধরে বলে, “আইদ… আইদ দেখ না তারা কি বলছে? আমার বাচ্চাটাও না’কি আমায় ছেড়ে চলে গেছে। আমি আর তাকে অনুভব করতে পারছি না। এমনটা কেন হলো আমার সাথে? কেন?”
আইদ স্থির ছিল কিছু মুহূর্ত। তার দৃষ্টি শূন্য। মৃণা তার হাতে মুখ লুকিয়ে কাঁদছিলো। সে এক ঝাড়নে নিজের হাত সরিয়ে নিলো। শীতল গলায় বলল, “তুমি তো এটাই চাইতে? তাহলে এখন নাটক করছ কেন?”
বিস্ময়ে মৃণার কান্নাও বন্ধ হয়ে আসে। সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আইদের দিকে। আইদ আবারও বলে, “তোমাকে আমি বলেছিলাম তুমি বাচ্চাটা জন্ম দেবার পর আমাকে দিয়ে দিও। তাও তুমি তার খুন করে ফেললে? একবার বুক কাঁপে নি তোমার? আমি এদিকে চিন্তায় মরে যাচ্ছিলাম আর তুমি এত বড় হোটেলে বিলাসিতা করছিলে। বিলাসিতা করবার সময় ছিলো তোমার কাছে একটা ফোন ধরার সময় ছিলো না?”
“সে পার্টিতে কোথায় যেন আমার ফোন পড়ে গিয়েছিলো আইদ।”
“তোমার কাছে এত বড় হোটেলে থাকার টাকা ছিলো একটা কল করার ছিলো না? আর এত টাকা কোথায় পেলে তুমি?”
“ওই…তীর্থ…”
“ওহ তাহলে তুমি তার কথায় এবার নিজের বাচ্চাকে খুন করেই ফেললে। তোমার বাচ্চার জান টাকার সামনে এত তুচ্ছ ছিলো?”
“তুমি আমাকে ভুল বুঝছ। শাওয়ারে যেয়ে পা পিছলে পরে গিয়েছিলাম। আমি কীভাবে…”
“তাহলে তুমি সেখান থেকে খবর দিতে বের হলে কীভাবে? রুমে কি তোমার সাথে অন্যকেউ ছিলো? তোমার কোনো কথার উপর আমার বিশ্বাস নেই। তুমি নিজের স্বার্থের জন্য সব করতে পারো।”
“আমি আমার বাচ্চাকে ইচ্ছা করে কেন মারবো?” হতদম্ব হয়ে প্রশ্ন করে মৃণা।
“কেন তুমি আগে এমনটা করতে চাও নি? এতদিন আমার বাসায় থাকার জন্য বাচ্চাটা রেখেছিলে। এখন তো আর এই বাচ্চা তোমার স্বার্থ পূরণ করতে পারবে না।”
মৃণা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আইদের দিকে। এটা সত্য যে সে অতীতে ভুল করেছে। অনেক পাপ করেছে। কিন্তু সে এখন সত্যি বলছে। মা হবার অনুভূতি সে বুঝতে পারছে। বুক জ্বলছে তার। তার অংশ ছিলো এই বাচ্চাটা। প্রায় ছয়মাস তার মাঝে বেড়ে উঠেছে। কীভাবে ইচ্ছা করে মারতে পারে সে তার অংশকে। শেষ করতে পারে মা হবার অপূর্ব অনুভূতিকে। কিন্তু আইদের কথার উওর সে দিতে পারে না। তার মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হয় না। গলায় যেন একগুচ্ছ শব্দ জমে আছে। সে কাঁপা-কাঁপা হাত দিয়ে আইদকে স্পর্শ করতেই সে পিছিয়ে যায়। নম্র কিন্তু অগ্নি দৃষ্টিতে মৃণার দিকে তাকিয়ে বলে, “খবরদার আমাকে স্পর্শও করবে তো। তোমার স্পর্শ থেকে ঘৃণা হয়। আসলে বাচ্চাটা এই পৃথিবীতে না এসে মন্দ হয় নি, নাহয় তুমি তাকেও নিজের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করতে। ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি নারীরা মমতাময়ী হয়। তোমাকে দেখে কথাটা আর বিশ্বাস করতে মন চাইছে না। আর কখনো ভুলেও আমার সামনে আসবে না। আজ সত্যি তোমার চেহেরা দেখতেও ঘৃণা লাগছে আমার। এই জীবনে আমি আর কোনোদিন তোমার চেহেরা দেখতে চাই না।”
আইদ চলে গেল।
মৃণা কেবল তাকিয়ে রইলো তার চলে যাওয়া দেখে। কিন্তু কিছু বলতে পারলো না। খুব ডাকতে মন চাইছিলো তাকে। থামাতে মন চাইছিলো। কিন্তু কেন যেন গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছিল না। কেবল তার হৃদয় কাঁপছিলো। নিজেকে খুবই একাকী মনে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো তার পৃথিবীটা এখানেই শেষ।
.
.
দুইবছর পর,
কলিংবেলটা বাজতেই কবিতার মা দৌড়ে যেয়ে দরজা খুললেন। আজ আবিরের আসার কথা। ঢাকা থাকা সত্ত্বেও বছরে হাতে গুণা কয়বার আসে সে। লজ্জায় তার কাছে যাওয়াও হয় না। কবিতার সাথে চোখ মেলানোর সাহস হয় না তার।
দরজা খুলে আবিরকে দেখতেই সে খুশিতে আত্নহারা হলেন। তাকে জড়িয়ে ধরলেন, “তোকে কতমাস পরে দেখছি। মা’কে একটু দেখতে আসতে মন চায় না, তাই না?”
“মা তোমার জন্য অন্য কাওকেও নিয়ে এসেছি।”
মা তাকে ছেড়ে একটু অবাক হয়ে তাকালেন। মেইন গেইট দিয়ে আরও দুইজন ঢুকে। তাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন মা। তার চক্ষু দিয়ে অশ্রুজল বইতে শুরু করে। বিস্ময়ে তার চোখ দিয়ে কোটর থেকে বেরিয়ে এতে চাইলো। কবিতা এসেছে। তার মেয়ে। আর কবিতার কোলে ছোট আরেকটি মেয়ে। দেখতে একদম ছোটকালের কবিতার মতো। আজ এতটা বছর পর সে তার মেয়েকে চোখে দেখছে। তাকে দেখে নড়তে পারে না মা। স্থির রইলো। কাঁপছিলো সে।
কবিতা তার সামনে দাঁড়ায়। সেও কিছু বলতে পারে না। চুপ করে থাকে। হঠাৎ করেই মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে। শব্দ শুনে কবিরের বউ তার মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে আসে। সেও অবাক হয় কবিতাকে দেখে। বিয়ের পর সে কবিতাকে কেবল ছবিতেই দেখেছে। আজ প্রথম দেখছে।
মা অস্থির হয়ে কবিতার জন্য রান্নাবান্না করছে। সব তার পছন্দের খাবার। এদিকে কবিরের বউ সুমা কবিতার সাথে গল্প করছে। আর কুহু এবং তার মেয়ে খেলছে।
“তোমার ছেলে আসে নি?”
“ও আসবে না বলে কান্নাকাটি করছিলো। ওর একটা আংকেল আছে তাকে ছাড়া কিছু বুঝে না। তাই আসবে না।”
“তোমার ছবি আমি সংবাদপত্রে দেখেছি। প্রথমে তো তোমাকে চিনতেই পারি নি। পরে মা বলল সেটা তুমি। সেদিন তার খুশি কে দেখে। আজ প্রথম সামনা-সামনি দেখছি তোমাকে। তুমি সামনা-সামনি বেশি সুন্দর। কাউকে বলো না তোমার শপ থেকে আমিও দুটো শাড়ি কিনেছি। উনি জানলে অনেক রাগ করবে তাই আমার মা’য়ের বাড়িতে রেখে দিয়েছি।”
কবিতা হাসে, “আপনার জন্য আমিও উপহার এনেছি। বিয়ের পর আপনার সাথে প্রথম দেখা তাই উপহার আনলাম। কবির ভাইয়া বাসায় নেই?”
কথাটা শুনে একটু মলিন হয়ে যায় সুমার মুখ। তাকে কিছুটা ভয়ার্ত দেখা যায়, “কিছুক্ষণের মধ্যে দুপুরের খাবার খেতে আসবে।”
“আপনি এমন ভয় পাচ্ছেন কেন ভাবি?”
“না মানে তোমার সাথে রাগ তো। আর উনার মেজাজ চওড়া থাকে জানোই তো। উনি কিছু বললে মনে নিও না কেমন? আচ্ছা তোমার না’কি টিভিতে ইন্টারভিউ আসবে? আসারই দরকার অনেক ভালো কাজ করছ তুমি মহিলাদের এভাবে কাজ দিয়ে।”
“এখনো তো কাজ ছোট, ভাবি। বড় পথে যেতে এখনো সময় আছে। সবে এই পথে পা দিলাম। পথ পেরোতে সময় আছে।”
কলিংবেল বাজতেই ঘাবড়ে উঠে দাঁড়ায় সুমা। ভয়ার্ত গলায় বলে, “মনে হয় তোমার ভাই এসেছে।”
সে দৌড়ে যেয়ে দরজা খুলে। কবিরের কন্ঠ শোনা যায় বাহির থেকেই, “দরজা খুলতে এত সময় লাগে? কি করছিলে এতক্ষণ? আর বাহিরে এত জুতা কার? তোমার বাপের বাড়ি থেকে আবার কেউ এসেছে না’কি?”
কবির ভিতরে ঢুকে কবিতাকে দেখে চমকে যায়। কবিতা তাকে দাঁড়িয়ে সালাম দিলেও সে উওর দেয় না। উল্টো রাগী স্বরে বলে, “তোর লজ্জা করে নি আমার বাসায় ঢুকতে?”
কবিরের কন্ঠ শুনে আবির তার বাবার সাথে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। মা’ও রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। সবার চোখেমুখে চিন্তা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কবিতা একটুও সংকোচ করে না। উল্টো হেসে হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে বলে, “আপনার বাসা? আমি তো জানতাম বাসাটা বাবা বায়ানিয়েছে। আজও তা বাবারই নামে। আমি আমার বাবার বাসায় এসেছি আপনার কী?”
কবির হতদম্ব হয়ে যায় উত্তরটা শুনে। কবিতা তার সামনে যেয়ে আবার হাতে একটি কার্ড দিয়ে বলে, “আপনার দুইবছর পূর্বে ভয় ছিলো আমি আমার বাচ্চাদের সহ আপনার ঘাড়ে বসে খাব তাই এই দু’বছর ধরে চিন্তা করে রেখেছি কোনো সময় নিজের শপ দিতে পারি তাহলে মা বাবার পর ওপেনিং কার্ড আপনাকেই দিব। বসুন্ধরা এবং উওরায় দুটো শপ নিয়েছি। অবশ্যই আসবেন।”
কবিতা মা’য়ের কাছে যেয়ে বলে, “মা আজকের মতো যাই। তোমাকে এবং বাবাকে আবির ভাইয়া নিতে আসবে তখন তার সাথে যাবে কিন্তু।”
“আজ কেন যাবি। থেকে যা কয়দিন।”
“না মা, কাজ আছে যেতে হবে।”
“তোর জন্য খাবার রান্না করেছি, তা অন্তত খেয়ে যা।”
“আজ নয়, নাহলে পরে খোঁটা শুনবে যে অন্যকারো সব খাবার আমাকে খাইয়ে শেষ করে দিলে। বাসা এলে ইচ্ছামতো রান্না করে খাওয়াবে ঠিকাছে?”
মা কান্না করে দিলেন। কবিতা তাকে সামলে, বাবার কাছ থেকে বিদায় নিলো। বের হবার পূর্বে তার ভাবির কাছ থেকে বিদায় দিয়ে তাকে একটি কার্ড দিয়ে বলল, “এটা এন জি ও এর কার্ড। যদি আপনার সাথে কখনো অতিরিক্ত খারাপ আচরণ হয় অথবা আপনার মেয়েকেও বড় হলে নিজের স্বার্থের জন্য অযোগ্য কোনো ছেলের হাতে তুলে দেয় তাহলে এখানে ফোন দিলেই হবে তারা সাহায্য করবে।”
সুমা অবাক হয়ে তাকায় কবিতার দিকে। কবির ধমক দিয়ে বলে, “তুই এখানে আমার বউয়ের কান ভরতে এসেছিস?”
“তুমি তোমার বউয়ের সাথে যে সুরে কথা বলো তাতে দেওয়াটা প্রয়োজন মনে হলো। আর মেয়ের কথা বলাটা বাধ্যতামূলক। আমাকেও তো মেয়ের মতো পেলে বড় করেছিল অবশেষে নিজের জিদে কি করতে চেয়েছিলে তা আমরা সবাই জানি। চলো আবির ভাইয়া।”
কবিতা যেতে নিলেই কবির বলে, “নিজের পছন্দ মতো বিয়ে করে কি উলটে ফেলেছিস? অবশেষে ছাড়াছাড়ি হয়েই গেল না’কি?”
কবিরের মুখে কেমন অদ্ভুত হাসি। যেন পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে সে। কিন্তু কবিতা রাগ, দুঃখ কিছুই দেখায় না। সে বলে, “অন্তত যখন বিয়ে করেছি তখন সে ভালো ছিলো। জীবনের কোন মুহূর্তে মানুষ কেমন হয়ে যায় কে জানে? এই’যে আপনি আমাকে এত আদরে বড় করেছিলেন, অবশেষে নিজের ইগোর জন্য অমানুষিক ব্যবহার করা লোকটার সাথে আমার বিয়ে করাতে চেয়েছেন। আমি একবারও জেদ করি নি যে আমার তীর্থকেই বিয়ে করা লাগবে। কারণ আমার জন্য আপনাদের মূল্য ওর থেকে বেশি ছিলো। কিন্তু আপনি আমাকে ওর সাথে বিয়ে করতে বাধ্য করেছেন।”
কবিতা ফিরে সেখান থেকে চলে গেল। আর একটিবারও ফিরে তাকাল না।
.
.
ঢাকায় আসতে আসতে অনেক রাত হয় সবার। তাই সেদিন কাব্যকে নিতে যায় নি কবিতা। সে কথনের কাছে। কথন ছাড়া কিছুই বুঝে না সে। তার সাথে থাকলে কান্নাও করে না। এমনকি কয়মাস আগে কথন কাজে ঢাকার বাহিরে গিয়েছিলো সেখানে যাবার একসাপ্তাহ পর কাব্যের কান্না কে দেখে। তখন কথনকে ফোন দিয়ে ডাকতে হয় কবিতার। তখন যে লজ্জা পেয়েছিলো সে বলার বাহিরে।
সকালে কথন হাস্পাতালেই কাব্যকে নিয়ে আসে। যেহেতু একটু তাড়াতাড়ি এসে পড়েছিল তাই সে প্রনয়ের সাথে হাস্পাতালের পাশের ক্যাফেটেরিয়াতে আড্ডা জমাল। কাব্য চকোলেট মিল্কসেক আর পিজ্জা খাচ্ছিলো। প্রণয় কথনকে জিজ্ঞেস করে, “কাব্যকে নিয়ে যাওয়া একটি ফ্যামিলি কিছু বলে না।”
“কি বলবে? মা তো অনেক আদর করে ওকে। ওকে পেলে আমার কথাও তার ধ্যানে থাকে না।”
“কারণ তারা জানেনা কাব্য কবিতা ছেলে।”
কথন কফিতে চুমুক দিতে নিয়েছিলো। প্রণয়ের কথা শুনে সে একটু চমকে উঠে। কথাটা সত্য। তার ঘরের সবাই কবিতার উপর রাগ। কেবল জবা ছাড়া। মা’য়ের ব্যাপারটা সে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা। কবিতার উপর রাগ থাকলেও কবিতা তার খুব প্রিয়। অন্যদিকে তার বোন শিউলি আপু কবিতার নাম শুনতে পারে না। তার দুই চোখের কাঁটা যেন কবিতা।
প্রণয় আবারও জিজ্ঞেস করে, “আমি বুঝতে পারছি না তুই এত বছর ধরে কবিতার সাথে আছিস। তার পাশে আছিস। তাও কেন বলছিস না যে তুই ওকে ভালোবাসিস?”
“ও ভাবে আমি ভালো বন্ধু হয়ে পাশে আছি। যদি ভালোবাসি কথাটা জানে তাহলে রাগ করতে পারে। হয়তো আমাকে আর কখনো আশেপাশে আসতে দিবে না। কোন কথা বলবে না। তাই কিছু অনুভূতি গুপ্তই ভালো। ওর পাশে তো আছি। ওকে খানিকটা দেখতে পাই, কথা বলতে পারি, ওর হাসিতে মুগ্ধ হতে পারি। এই অনেক।”
“এই কতদিন? তোর পরিবার তোকে বিয়ে করানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। দেখিস কথন বেশি দেখি না হয়ে যায়। এছাড়া ভেবে দেখ কবিতা যদি অন্যকোথাও থেকে জানতে পারে?”
.
.
কবিতা কথনকে খুঁজতে এসে জানতে পারে সে এখনো আসে নি। কথনের পরিচিত হওয়ায় নার্স তাকে রুমে বসতে দেয়। কিছুক্ষণের অপেক্ষার পরই দরজায় শব্দ শোনা যায়। কবিতা ভাবে কথন এসেছে তাই উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু এ যে কথন নয়। তার বড় বোন শিউলি।
কবিতা খানিকটা অস্বস্তি বোধ করে। এতবছরে সে আর কখনো কথনের পরিবারের সাথে দেখা করে নি লজ্জায়। কথনের সাথে তার সমঝোতা থাকলেও ঘরের সবাই জানতো দুইজনে বিয়েতে রাজি। কথনের পরিবারের সবাই তাকে খুব ভালোবাসতো। কবিতার মনে হয় তাদের অনুভূতির সাথে একপ্রকার খেলা করেছে সে। তাই লজ্জায় আর কখনো তাদের সামনে যায় নি। তাকে দেখেই শিউলির চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল, “তুমি…. তুমি এখানে কেন? তোমার সাহস কি করে হয় আমার ভাইয়ের সাথে দেখা করতে আসার? তুমি যেভাবে আমার ভাইয়ের মনের সাথে খেলেছ এরপরও তোমার মন ভরে নি?”
কবিতা চুপ করে কথা কথাগুলো শুনলো। প্রথম কথাগুলো কবিতার স্বাভাবিক লাগলেও শেষ বাক্যেই খটকা লাগে তার,”কথনেত মনের সাথে খেল করেছি?”
#মুহূর্তে
পর্ব-৫৬
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
কবিতা চুপ করে কথাগুলো শুনলো। প্রথম কথাগুলো কবিতার স্বাভাবিক লাগলেও শেষ বাক্যেই খটকা লাগে তার,”কথনের মনের সাথে খেলা করেছি?”
শিউলি রাগান্বিত স্বরে বলে, “একদম নাটক করবে না আমার সাথে। তুমি আমার ভাইয়ের জীবন নষ্ট করে দিয়েছ।”
“আপু আপনি কি বলছেন আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
“বুঝতে পারছো না? আমার ভাইকে এত কষ্ট দিয়েও তুমি বুঝতে পারছ না তুমি কি করছ?”
কবিতা মাথা নাড়ায়। শিউলি কবিতার হাত ধরে টেনে নিজের সাথে নিয়ে যায়। গাড়িতে করে কথনের বাসার সামনে এসে থামে। তারপর কিছু সময়ের জন্য উপরে যেয়ে ফিরে আসে। কবিতার হাতে একটি ডায়েরি দিয়ে বলল, “তাহলে এটা পড়ে বুঝো আমি কথাগুলো কেন বলছি। আর খবরদার আমার ভাইয়ের আশেপাশে আসার চেষ্টা করবে না। তোমার জামাই তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে বলে আবার আমার ভাইকে নিজের পিছনে ঘুরানোর যে পরিকল্পনা করছো তুমি তা বাদ দিয়ে দেও।”
কবিতা খানিকটা লজ্জাবোধ করে শিউলির এমন কথায়, “আপু এমন কিছু না আমি শুধু কাব্যকে নিতে….”
“কাব্য? কাব্য তোমার ছেলে?” বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে শিউলি।
“জ্বি। আপনারা জানেন না?”
শিউলি নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রন করার যথেষ্ট চেষ্টা করল। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কবিতাকে বলে, “কথন আমাদের বলেছে কাব্য ওর বন্ধুর ছেলে। দেখ কবিতা আমার তোমার বিয়ের কথাটা বলা ঠিক হয় নি। কিন্তু তুমিও বুঝ তোমার কারণে কথনের জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ওর বিয়ের বয়স পাড় হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ও বিয়ে করছে না। আমাদের পুরো পরিবার ওকে নিয়ে অনেক চিন্তিত। দয়া করে ওর থেকে দূরে থাকো। আমি তোমাকে অনুরোধ করছি।”
কবিতা সংকোচ নিয়ে বলল, “আপু আপনি ভুল বুঝছেন। কথন এবং আমি কেবল ভালো বন্ধু। আপনি সম্ভবত ভুল বুঝছেন। কথন আমাকে না, অন্য এক মেয়েকে ভালোবাসে। সে আমাকে ওই মেয়ের কথা বলেছে।”
“আর তার নাম কি?”
কবিতা দ্বিধায় পড়ে গেল। কথন কখনো মেয়েটার নাম বলে নি তাকে। সে কি বলবে বুঝতে পারে না। শিউলি বলে, “তুমি এখন হাস্পাতালে না যেয়ে এই ডায়েরিটা পড়ো আমি যা বলতে চাচ্ছি তুমি নিজেই বুঝে যাবে।”
কবিতা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে। তার কথানুযায়ী শিউলি তাকে তার শপে দিয়ে আসে। জায়গাটার কাজ শেষ। দুইদিন পর শপের ওপেনিং হবে। তাই এখনো কেউ নেই। এখানে আসবাবপত্র ছাড়াও কিছু নেই। আজ সন্ধ্যা থেকে সব পণ্য আনা হবে। তাই নীরবে এসে ডায়েরি পড়া শুরু করে কবিতা।
“মেয়েটা আস্তো এক পাগল। পাগল বললেও ভুল হবে। পাগলের দাদী। প্রথম দিনই তার প্রমাণ পেয়ে গেছি।”
এতটুকু পড়েই কবিতা মুখের বিকৃতি ঘটে। সে গম্ভীর মনোভাব নিয়ে ডায়েরিটা পড়া শুরু করেছিলো আর শুরুতেই পড়ে তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “সাহস কত বড় আমাকে পাগল বলার। আমি এত শান্ত, শিষ্ট, ভদ্র একটা মেয়ে ছিলাম আমাকে পাগল বলতেছে, বেয়াদ্দব একটা। নিজে পাবনার পাগলখানার পাগলের… পাগলের কিছু একটা।”
কবিতা আবারও ডায়েরি পড়া শুরু করে,
“প্রথমদিনই মাথার বারোটা বাজায় দেয় আমায়। এরপর জানি এই পাগল মেয়েটাকে আমার সাথে বিয়ের করানোর চিন্তায় আছে সবাই। ওই পাগল মেয়েছে আমার জন্য যে বাছাই করলো সবার মাথার তার কী ছিঁড়ে গেছে না’কি? অবশ্য মেয়েটা এতও খারাপ না। মনের ভালো আছে। কথাবার্তাও মিষ্টি। গতকাল আমাদের বাসায় আসার পর যেন সবাই ওকে ছাড়া কিছু বুঝেই না। আমার নিজের ঘরেই অতিথির মতো ফিল হচ্ছিল। মেয়েটা আমাকে অনুরোধও করলো, আমি যেন তাকে নিয়ে কবিতা লিখি। লেখার চেষ্টা করছি, হচ্ছে না। তবে অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো আজ। ও নিজের নবীনবরণের জন্য শাড়ি পরে সেজেছিলো। ওকে একবার দেখার পর চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। দেখে মনে হচ্ছিল শুভ্রপরীকে দেখছি। মুহূর্তের জন্য আমার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছিল না। দৃষ্টি আটকে পড়ে সামনে দাঁড়ানো শুভ্রপরীর উপর। হৃদয়ে অদ্ভুত এক কম্পন জাগলো।
কবিতা যখন আমায় জিজ্ঞেস করে, “দেখুন আজ আমি প্রথম শাড়ি পরলাম। আর জেবা আপু কত সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে আমাকে। কেমন লাগছে আমাকে?”
আমি তখন বলতে চাইছিলাম, ‘স্নিগ্ধ, পবিত্র এবং আসমান থেকে নেমে আসা হুরপরীর মতো লাগছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত তোমার হাসি দেখে পরীও লজ্জা পাবে।’ কিন্তু কথাটা বলতে পারছিলাম না। কেমন লজ্জা লাগছিলো। দ্বিধাবোধ হচ্ছিলো। আগে তো কখনো এমন হয় নি। আমি সবসময়ই সরাসরি কথা বলার মানুষ। তাহলে আজ হঠাৎ এমন কেন হলো?”
~কথন
২১.০৮.২০১৩
“ডায়েরির দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় আজ লিখছি। অথচ লেখাটা একই মানুষের জন্য। আমার ডায়েরি লেখাটা তেমন পছন্দের নয়। আর বিশেষ কোনো মানুষের জন্য তো একদমই নয়। তবুও লিখছি। আজ আমার সিনিয়র মারা যাবার পর তার বাসায় গেলাম সব কলিগরা মিলে। সেখানে পেলাম কবিতাকেও। ওকে আজ প্রথম কাঁদতে দেখেছিলাম। ওর কান্না কেন যেন বিষাক্ত লাগছিলো আমার কাছে। একদম সহ্য হচ্ছিলো না। অবশেষে এই না অসহ্য হবার কারণটা আমার জানা নেই। সম্ভবত কান্নাটা তার ব্যক্তিত্বের সাথে যায় না একারণে? কে জানি? তবে এতটুকু বলব তার হাসিটা আমার অত্যন্ত প্রিয়। ও হাসলে বাতাসে অন্যরকম অনুভূতি ছড়িয়ে যায়। খুব মিষ্টি দেখায় ওকে। মায়াবী দেখায়।
‘মিষ্টি তোমার হাসি মায়ায়
ভুলেছি আমি এই পৃথিবী,
এই জগৎ
এবং জগতের প্রমোদ ছায়া।’
ছিঃ! কি বাজে একটি ছন্দ লিখলাম। এই ছন্দ মেয়েটাকে শোনালে সম্মান রাখবে না সে। ভালো কিছু ভাবতে হবে।”
~কথন
২৫.০৮.২০১৩
“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, আমি এই তিনবার একই মেয়ের জন্য ডায়েরিটা লিখছি। তবে না লিখে পারলাম না। এটা আসলে একটু আজব। অন্যরকম। সবার থেকে আলাদা। খানিকটা মিষ্টি, একটু বদমেজাজী। এক বন্ধুর বিয়েতে গিয়েছিলাম। মা’য়ের কথায় ওকেও নিয়ে যেতে হলো। সেখানে যেয়ে উর্মি আমাদের একসাথে দেখে শুরু করল অন্য নাটক। কবিতাকে উল্টাপাল্টা কিছু কথাও বলছিলো। আমার রাগ উঠলেও অন্যের অনুষ্ঠানে এসে কিছু বলতে পারছিলাম না। কিন্তু কবিতা চুপ রইলো না। উল্টো উর্মিকে জবাব দিয়ে তার মুখ বন্ধ করে দিলো। ওর এমন রূপ দেখে আমি ইম্প্রসই হয়েছি। তবে কথা শুনিয়েও তার রাগ কমে নি। সে অনুষ্ঠান ছেড়ে চলে গেল। আমার সব ছেড়ে যেতে হলো তার পিছনে। সে রাতে ঝুম বৃষ্টি নামল। সে লাল রঙের একটি পোশাক পরেছিলো। অন্ধকার জাগতে বিদ্যুৎ চকমকানোর মাঝে একটা ভয়ানক সৌন্দর্যের দর্শক হয়েছি আমি। তার কাজলমাখা চোখদুটো বৃষ্টির মাঝে লেপ্টে যাচ্ছিল। সে লেপ্টে যাওয়া কাজলভরা চোখদুটো দেখে আমার হৃদয় দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলো। আচ্ছা আমি কী তার প্রেমে পড়ে যাচ্ছি?”
~কথন
২২.১১.২০১৩
“জবা বিয়ের আগে ফটোশুট করতে যাবে বলে অস্থির হয়ে ছিলো। আমাকেও জোর করে নীল পাঞ্জাবী পরিয়ে নিলো। একপ্রকার বাধ্য করল আমাকে নীল পাঞ্জাবিটা পরতে। তখন কারণটা আমি জানতাম না। জানলাম কিছুক্ষণ পরে। জবা কবিতার বাসার সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে তার অপেক্ষা করছিলো। আমার সামনে দিয়ে দরজা থেকে বেরিয়ে এলো আসমানী। আমি চেয়েও চোখ সরাতে পারছিলাম না। কবিতা পড়েছিল আসমানী রঙের শাড়ি এবং রূপালী রঙের গয়না। হাল্কা সাজ। সে হাল্কা সাজেই তাকে এত রূপবতী দেখাচ্ছে। আমি তাকে দেখে চোখ সরাতে পারছিলাম না। বেহায়ার মতো হা করে তাকিয়ে ছিলাম। জবা আমাকে বড় একটা লজ্জা দিলো এরপর খুব কষ্টে চোখ সরালাম। তবুও সারারাস্তা গাড়ির আয়নায় কেবল তাকেই দেখছিলাম। ফটোশুটের সময় জবা আমাকে কবিতার সাথে ক’টা কাপল পিক তোলার জন্য জোর করল। মুখে বিরক্ত হলেও মনে মনে খুব খুশি ছিলাম। সেদিন প্রথম ওকে এতটা কাছে থেকে দেখলাম। ওর কাজলমাখা চোখ দেখে নিশ্বাস নিতে ভুলে যাচ্ছিলাম। আচ্ছা আমি কি না চাওয়া সত্ত্বেও ওকে ভালোবেসে ফেলেছি?
তুমি চুপি চুপি আরও কিছু গল্প বলে যাও
আমি শুনবো নীরবে
তুমি আমার স্বপ্নজগতে এসো
আমি ডুবে থাকব তোমার কাজলমাখা কৃষ্ণনগরীতে।
আচ্ছা এই ছন্দটা কী কবিতাকে শুনাবো? নাহ, থাক।
কিছু অনুভূতি নিজ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখা উচিত।
~কথন
১২.১২.২০১৩
কবিতার ফোন বেজে উঠলো। কথন ফোন করছে তাকে। সম্ভবত সে এসেছিলো জেনেছে কথন। সে কল ধরে। কিন্তু কথা বলতে পারছিলো না সে। কথন তাকে ভালোবাসে। এতবছর ধরে ভালোবেসে এসেছে। এতবছর ধরে তাকে না পেয়েও অন্যকাওকে বিয়ে করে নি। একথা সে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না।
“হ্যালো কবিতা, তোমার না আসার কথা ছিলো কাব্যকে নেওয়ার জন্য?” ফোনের ওপাশ থেকে কথন বলে। কবিতা কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি কাব্যকে বাসায় দিয়ে উওরার শপে আসতে পারবেন একটু?”
“তোমার কন্ঠ এমন শুনাচ্ছে কেন? তুমি ঠিক আছো তো?”
“আপনি আসুন।”
“ওকে ওকে, আমি আমার ডিউটি প্রণয়কে করতে বলে আসছি। রাস্তায় কাব্যকে বাসায় দিয়ে আসব।”
“হঁ”
কবিতা ফোন কেটে দিলো। আবছা দৃষ্টিতে তাকাল ডায়েরির দিকে। ডায়েরিতে শত পৃষ্ঠার মতো লেখা আছে। প্রতিটি পৃষ্ঠায় তার গল্পই লেখা। সে সবগুলো পড়েও না। পড়তে পারে না। কেমন অস্বস্তি লাগে তার। অপরাধবোধ হয়। গুণে গুণে পঁচিশটার মতো পৃষ্ঠা পড়ে। তারপর শেষ পৃষ্ঠা পড়ে,
“তুমি সে চাঁদ যাকে দূর থেকে ভালোবাসা যায় কিন্তু তাকে ছোঁয়ার সাধ্য আমার নাই। তুমি আমাকে ভালোবাসো নি কবিতা। কেন ভালোবাসো নি?”
শেষ পৃষ্ঠাটা সেদিনের লেখা যেদিন কবিতা তাকে তীর্থের কথা বলেছিলো। কবিতার ভীষণ কষ্টের অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে তার বুকের ভেতর কামড়ে ধরে রেখেছে কেউ। কথন এতবছর যার জন্য অকারণে অপেক্ষা করে এসেছে সে মেয়েটা কবিতাই? এত বছর ধরে কি করে কোনো স্বার্থ ছাড়া কথন তাকে ভালোবাসতে পারে? বিনিময়ে কিছু না চেয়ে? তাকে পাবে না জেনেও।
কবিতা চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করতেই চোখের কোণা দিয়ে এক বিন্দু অশ্রজল বয়ে পড়ে। ভীষণ অবাক হয় কবিতা। তার অপরাধবোধ হওয়াটা মানা গেলেও কথন তাকে ভালোবাসে এই জেনে তার এত কষ্ট হচ্ছে কেন? সম্ভবত এই অপূর্ণ ভালোবাসার কষ্ট অনুভব করেছে এই কারণে। বুক পুড়ে, জ্বলে, শূন্য লাগে নিজেকে। তবুও কিছু করা যায় না। নিরুপায় থাকি আমরা। এই অসুখের ঔষধ নেই যে। আছে তো কেবল বেদনার নিবাস।
কবিতা বিড়বিড় করে বলে, “আমারও আর কাওকে ভালোবাসার সাধ্য নেই কথন। একবার ভালোবাসা পেয়ে হারিয়ে দেখেছি। সহ্য করেছি হৃদয়ক্ষরণ। আর এই কষ্ট সহ্য করার সাহস আমার নেই। তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারো না। এভাবে অপেক্ষা করতে পারো না। তোমার অন্যকাওকে ভালোবাসা উচিত। না আমি আর কখনো অন্যকাওকে ভালোবাসতে পারবো, আর না ভালোবাসায় বিশ্বাস করতে পারবো। আমি এখন অনুভূতিহীন। প্রেম নিবাসে আর চরণ রাখার চেয়ে নির্বাসনে যাওয়াটায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করব আমি।”
কিছুক্ষণ পর রুম প্রবেশ করে কথন। দরজা খুলে অবাক হয়ে বলে, “তুমি একা কী করছো কবিতা? আর এত তাড়াহুড়ো করে ডাকলে যে?.”
কথন একগাল হেসে কক্ষে প্রবেশ করছিল, কিন্তু যে মুহূর্তে কবিতার হাতে তার ডায়েরিটি দেখলো তার ঠোঁটের হাসি মলিন হয়ে গেল। মুখে ছড়িয়ে পড়লো ভয় ও চিন্তার ছাপ। কবিতার কাছে এই ডায়েরিটা এলো কীভাবে?
*আগামী দুইদিনও একটানা গল্প দিব।*
চলবে…
[