সুঁই সুতোর আসক্তি পর্ব -০২

#সুঁই_সুতোর_আসক্তি
#পর্বঃ০২
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

সকালে ঘুম থেকে উঠে কায়াসা নিজেকে বিছানায় পায় তবে তার এখন কাল রাতের কথা কিছুই মনে নেই।সে প্রতিদিনের মতো উঠে বিছানা ঘুছিয়ে চোখ ডলতে ডলতে ওয়াশরুমের দিকে যেতে তাকে।তবে ওয়াশরুমে যেতে তার চোখ পড়ে আয়নায়।সে তাড়াতাড়ি আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়।কায়াসা একবার আয়নার দিকে তাকাই তো একবার নিজের দিকে।হঠাৎ করেই কানে হাত দিয়ে সে একটা চিৎকার দিয়ে ওঠে।

” কি হয়েছে ম্যাডাম?কোন সমস্যা?”একটা মেয়ে দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করে কায়াসাকে।

মেয়েটা দেখে কায়াসা ভয়ে পিছিয়ে যায়।

” কে আপনি?আর আমি কোথায়?আমার জামা কোথায়?এসব কি?”

” আমি এই বাড়ির মেইড সুমি।আপনি এখন গেস্ট রুমে আছেন?”

” এটা কার বাড়ি?”

” এটা আদ্রিক স্যারের বাড়ি।উনিই কাল রাতে আপনাকে নিয়ে এসেছেন।উনি যখন আপনাকে নিয়ে এসেছিলে আপনি তখন অজ্ঞান ছিলেন।আপনার ড্রেস ভেজা ছিল তাই আমি চেঞ্জ করে দিয়েছি।”

কায়াসা ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে থাকে কাল রাতের কথা আর তার আস্তে আস্তে সব মনে পড়ে যায়।

” আমার জামাটা কোথায়?ওটা আমাকে একটু এনো দেবেন?”

” জ্বি ম্যাডাম এখুনি এনে দিচ্ছি।”

সুমি নামের মেইডটা তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে চলে যায় আর কয়েক সেকেন্ড পরেই কায়াসার জামাটা নিয়ে আসে।কায়াসা সুমির হাত থেকে জামাটা নিয়ে ওয়াশরুম চলে যায়।কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে বেরিয়ে আসে কায়াসা।তারপর দরজা খুলে আস্তে আস্তে রুমটা থেকে বেরিয়ে আসে।কায়াসা বেরিয়ে দেখে বাড়িটা অনেক বড় আর পুরো বাড়িটা সাদা রঙের,দেয়ালে অন্যকোন রঙের ছিটে ফোঁটা সে দেখতে পাইনা।কায়াসা হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ি কাছে চলে আসে।তবে সে যখনি নামতে যাবে তখনি কারো কথা শুনে থেকে যায়।শব্দটা আসছে সিঁড়ি ডান দিকে ঘরটা থেকে।কায়াসা কৌতুহল নিয়ে সেদিন এগিয়ে যায়।দরজা হালকা করে খোলা রয়েছে।কায়াসা সেই খোলা জায়গা দিয়ে দেখার চেষ্টা করে ভেতরে কে আছে।কায়াসা দেখে একটা লম্বা চওড়া লোক কালো কোর্ট,প্যান্ট পড়ে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে।লোকটার মুখ কায়াসা সরাসরি না দেখলেও সামনে থাকা আয়নাতে তার প্রতিবিম্ব দেখতে পায়।কায়াসা ভাবতে থাকে ” আরে এটা তো সেই কাল রাতের লোকটা।তার মানে ওনার নামই আদ্রিক।”

আদ্রিক পেছন ফিরে কারো সাথে কথা বলছে তবে আদ্রিকের কথা শুনে ভয়ে কায়াসার বুক কেঁপে উঠে।

” কিডনি বের করা হয়ে গিয়েছে?”

“…….”

” ওকে,তাহলে এটাকে যেখানে পৌঁছানোর সেখানে পৌঁছে দাও।আর কাজ যেন ঠিকঠাক ভাবে হয়।যদি কোন ভুল হয় তো এরফল কিন্তু ভালো হবেনা।”

এটা বলেই আদ্রিক ফোনটা কেটে দিয় আর ঘুরে কোথাও চলে যায়,যা কায়াসা দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পাইনা।আদ্রিকের কথা শুনে কায়াসার মনে ভয় ঢুকে যায়।

” এই লোকটা কি কোন ইলিগেল অর্গান ব্যবসায়ী?হতে পারে।না আমাকে এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালাতে হবে।হ্যাঁ,যেভাবেই হোক এই রাক্ষসের খপর থেকে আমাকে বাঁচতে হবে।”

কায়াসা দৌড়ে আবারো সেই গেস্ট রুমে চলে আসে।সে ভাবতে থাকে এখন সে কি করবে।তখনিই তার চোখ পড়ে বিছানার চাদরটার উপর।কায়াসা ঝটপট চাদরটা বারান্দার রিলিং এর সাথে বেঁধে ফেলে।কিন্তু সে নামতে পারবে তার আগেই তাকে খুঁজতে খুঁজতে আদ্রিক সেখানে চলে আসে।এরপরের ঘটনাতো আপনারা জানেনই।

ফ্ল্যাসবেক এন্ড…..

” ঘেউ…ঘেউ……”

” আব্বু……” হঠাৎ কুকুরের আওয়াজ শুনে ভয় পেয়ে যায় কায়াসা।সে নিজেকে আরো ঘুটিয়ে নেয়।ছোটবেলা থেকেই কোন এক কারণে সে কুকুরকে প্রচুর ভয় পাই।এখন একটা অন্ধকার তালাবদ্ধ রুমে একা একটা কুকুরের সাথে সে আছে ভাবতেই কায়াসা জোরে জোরে কান্না করতে থাকে।

” প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন,আমার ভয় করছে।প্লিজ আমার ভুল হয়ে গিয়েছে।আমি আপনার ব্যপারে কাউকে বলবোনা।আমি আপনার সবকথা শুনবো তবুও আমাকে এখান থেকে বের করুন প্লিজ।” অঝোরে কান্না করতে করতে আদ্রিকের উদ্দেশ্য কথাগুলো বলতে থাকে কায়াসা।তবে তার এতো কাকুতি মিনতি আদ্রিকের কানে পৌঁছাচ্ছে না।এদিকে কুকুরটাও বারবার ডেকেই চলেছে।এদিকে অন্ধকার,অন্যদিকে কুকুর তারপর দুর্বল শরীর।এতো সবকিছু মিলিয়ে কায়াসা আবারো অজ্ঞান হয়ে যায়।

চোখে খুলে কায়াসা নিজেকে আবারো সেই রুমটা আবিষ্কার করে যেখানে সে সকালে ঘুম থেকে উঠেছি।কায়াসা ধরফরিয়ে উঠে বলে।সে প্রথমে পুরো রুমটাকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়।না এটা সেই ভয়ানক অন্ধকার রুমটা না।কায়াসা বাইরে তাকিয়ে দেখে বাইরে পুরো অন্ধকার হয়ে গিয়েছে,এরপর সময় দেখার জন্য সে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাই,দেখে ঘড়ির কাঁটাটা বরাবর ৮টায় অবস্থিত।কায়াসা গায়ে জরানো কাঁথাটা সরিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় আর তারপর দরজা খুলে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে।ভয়ে ভয়ে কায়াসা সামনে এগোচ্ছে,তা না হলে না জানি আবার কি না কি শুনে ফেলে আর তার জন্য আবারো তার শাস্তি ভোগ করতে হয়।

সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসে কায়াসা।নিচে পুরো খালি,একদম নিরব।একটা মানুষকেও দেখতে পাইনি সে।হঠাৎ কায়াসার কানে আসে কোথাও থেকে টুংটাং শব্দ আসছে তবে তা খুবই হালকা।মনোযোগ দিয়ে না শুনলে কেউ বুঝতেও পারবেনা।শব্দ অনুসরণ করে কায়াসা এসে পৌঁছায় রান্নাঘরে
বিশাল আকৃতির একটা রান্নাঘর,তবে এখানে শুধু একটাই মানুষ দেখতে পেয়েছে কায়াসা।

” সুমি?” সংকোচ নিয়ে বলে কায়াসা।

” আরে ম্যাডাম আপনি উঠে গিয়েছেন।কষ্ট করে নিচে নেমে আসলেন কেন?উপর থেকে আমাকেই ডাকতেন আমি চলে আসতাম।”

” না তার দরকার ছিলনা।আচ্ছা বাড়ির সবাই কোথায় জানেন?কাউকেই তো দেখলাম না।”

” বাড়িতে এই সময় অন্য মেইউরা থাকেনা।রাতে শুধু আমিই থাকি।বাকিরা শুধু সকালেই থাকে।”

” আর ওনার পরিবারের লোকজন?”

” স্যারের পরিবারের কেউ নেই।উনি একাই থাকেন এই বাড়িতে।”

” আপনার স্যার কোথায় এখন?ওনাকে তো দেখলাম না।”

” স্যার কিছু কাজের জন্য বাইরে গিয়েছেন।”

” কখন ফিরবেন উনি?”

” হয়তো রাত হবে ফিরতে।”

” ও আচ্ছা।(কবে যে এই রাক্ষসপুরী থেকে বের হতে পারবো-মনে মনে)আচ্ছা আপনি আমাকে একটু কফির সামগ্রীগুলো দিতে পারবেন?”

” আপনি কফি খাবেন ম্যাডাম?আচ্ছা আপনি বসুন আমি এখনুনি বানিয়ে আনছি।”

” আরে না না আপনাকে এতো কষ্ট করতে হবেনা,আমি নিজেই বানিয়ে নিতে পারবো।আমার নিজের কাজ নিজের করতে ভালো লাগে।তো আপনি শুধু আমাকে জিনিসগুলো দিলেই হবে।”

সুমি তাক থেকে সব প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নামিয়ে দিয়ে নিজের কাজ করার জন্য রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

চুলোয় পানি দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোনে আদ্রিকের বলা কথাগুলো ভাবছে কায়াসা।তবে অসাবধানতার কারণে কোনকিছু ছাড়াই খালি হাতে গরম পাত্রটা ধরার কারণে কায়াসার ডান হাতটা হালকা পুড়ে যায়।কায়াসা তাড়াতাড়ি পাশে থাকা বেসিনটাতে গিয়ে হাতে পানি দিতে থাকে।হাতের জ্বালা কিছুটা কমলে কায়াসা কফি বানিয়ে আবারো গেস্ট রুমে চলে আসে।কায়াসা আবারো রুমটাতে চোখ বুলিয়ে একটা টিভি দেখতে পাই।কায়াসা রিমোটটা খুঁজে বের করে টিভি দেখতে থাকে।

টিভি দেখতে দেখতে কখন যে অনেকটা সময় পার হয়ে গিয়েছে সেটা কায়াসা বুঝতেই পারিনি।দরজায় টোকা পড়াতে কায়াসা টিভি থেকে চোখ সরিয়ে নেয়।

” জ্বি আসুন।”

” ম্যাডাম,স্যার এসেছেন।উনি আপনাকে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকছেন।”

” আচ্ছা আপনি যান আমি আসছি।(ধুর,এখন কি ওই রাক্ষসের সাথে আমাকে খাবার খেতে হবে।এ্যাঁ……..”)

টিভি বন্ধ করে কায়াসা নিচে নেমে আসে।আদ্রিক আগে থেকেই ডাইনিং টেবিলে বসে মোবাইলে কিছু করছিল।কায়াসাকে দেখে সে মোবাইল রেখে খাবার খাওয়া শুরু করে।কায়াসা গুটিগুটি পায়ে আদ্রিকের সামনে এসে বসে।কায়াসা বসতেই সুমি তাকে খাবার দেয়।খাবারগুলো দেখে কায়াসার মন খুশিতে নেচে উঠে কারণ সব তার প্রিয় খাবার।কিন্তু সে যখন খেতে যাবে তখনিই তার মনে পড়ে তার হাত তো পুড়ে গিয়ে।মন খারাপ করে কায়াসা চামচ দিয়েই খাবার খেতে থাকে।খাবার খেতে খেতে কায়াসার চোখ যায় আদ্রিকের খাবারের দিকে।আদ্রিকের খাবারগুলো দেখে কায়াসা নাক-মুখ কুচকে নেয়।কারণ আদ্রিক ভেজিটেবল সুপ আর সালাদ খাচ্ছিল যা কায়াসার মোটেও পছন্দ না।সে আর সেদিকে না তাকিয়ে নিজের খাওয়াতে মন দেয়।আদ্রিকের খাওয়া শেষ হলেও সে চলে যায় না,টেবিলেই বসে থাকে।অল্প করে কায়াসা প্লেট সরিয়ে রাখে কারণ হাতের জন্য সে আর খেতে পারছেনা।কায়াসার খাওয়া হয়ে গেলে আদ্রিক উঠে চলে যায় আর কায়াসা টেবিলের প্লেটগুলো সুমির সাথে রান্নাঘরে রেখে আসে।কায়াসা আরো কাজ করতে চেয়েছিল কিন্তু সুমি থাকে জোর করে পাঠিয়ে দেয়।

” এই ইডিয়েট শোনো।”

হঠাৎ আদ্রিকের আওয়াজ শুনিয়ে কায়াসা ঘাবড়ে গিয়ে পিছিয়ে যায়।আদ্রিক সোফায় বসে আছে।

” এদিকে এসো।”

” কেন?” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে কায়াসা।

” আসতে বলছি ভালো মেয়ের মতো চলে আসবে।এতো কথা কেন জিজ্ঞেস করছো?এদিকে আমার পাশে বসো।” গম্ভীর আর রাগী ভাবে বলে আদ্রিক।

আদ্রিকের কথা শুনে কায়াসা মুখ ফুলিয়ে তার পাশে গিয়ে বসে।

” দেখি ডান হাতটা দাও।”

” কেন?”

” আবারো প্রশ্ন করছো।আমার অকারণে প্রশ্ন করা মোটেও ভালো লাগেনা।হাত দাও।”

কায়াসা মুখ ফুলিয়ে হাতটা এগিয়ে দেয়।আদ্রিক একটা মলম দিয়ে পোড়া জায়গাটাতে লাগিয়ে দেয়।

” যাও ঘুমিয়ে পড়ো।” এটা বলে আদ্রিক চলে যেতে নেয়।

” আমি বাড়ি কখন যাবো?”

” যখন আমার ইচ্ছে হবে আমি তখন তোমাকে তোমার বাড়ি পৌঁছে দেবো।”

” কিন্তু আপনি কে,হ্যাঁ?আমি কি আপনার সম্পত্তি যে আপনার ইচ্ছে হলে বন্দী করে রাখবেন আর ইচ্ছে হলে মুক্তি দেবেন?”

” অনেক বেশি কথা বলো তুমি।মনে হয় সকালের শাস্তিটা ভুলে গিয়েছো।আবার মনে করিয়ে দিতে হবে মনে হয়।”

শাস্তির কথা শুনে ভয় পেয়ে যায় কায়াসা।

” যদি বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে থাকো তো চুপচাপ গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।আমি আর একটাও সিঙ্গেল ওয়ার্ড তোমার মুখ থেকে শুনতে চাইনা।”

আদ্রিক আর কোন কিছু না বলে নিজের রুমে চলে যায়।আদ্রিকের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে করতে কায়াসাও গেস্ট রুমে চলে আসে।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here