হৃদপূর্ণিমা পর্ব -০৫

#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ০৫ |

মূসার কেস শেষ করে নাশিদ সবে শান্তিতে বসেছে তখনই নয়ন এক বাক্স লাভ লেটার সশব্দে রাখলো। নাশিদ একবার বক্সের দিকে তো আরেকবার নয়নের দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো। নাশিদ ভ্রু কুচকে বললো,

-‘এগুলো কী নয়ন?’

-‘আপনার লাভ লেটার। প্রতিদিন আপনার জন্য লাভ লেটার আসে স্যার, মূসার কেস সেরে তো আপনি পুরো পাবলিক ফিগার হয়ে গেছেন। রোজ রোজ যেই পরিমাণ লেটার আসে, আমি জাস্ট স্পিচলেস!’

-‘জাস্ট শাট আপ নয়ন! এগুলো ফেলো বলছি। এসব আজারে কাজ দেখা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই তোমার?’

নয়নের দাঁত কেলানো বন্ধ হয়ে গেলো নাশিদের ধমকে। সে মুড অফ করে বাক্সটি নিয়ে জানালা দিয়ে চিঠিগুলো ফেলে দিলো। সেই রাস্তা দিয়েই রথি যাচ্ছিলো আর সব চিঠি তার উপরেই পরলো। নাশিদ নয়নকে আবার দেয় ধমক! নয়ন চিঠি ফেলা বন্ধ করে চুপ করে দাঁড়িয়ে যায়।

-‘কমসেন্স নাই তোমার? বলি কী আর করছো কী? তোমায় কে বলেছে এসব জানালা দিয়ে ফেলতে?’

-‘আপনি-ই তো বললেন ফেলে দিতে।’

নাশিদ মাথা নিচু করে দুই হাতে নিজের চুলগুলি মুঠ করে ধরলো। নয়ন একবার জানালার দিকে তো আরেকবার হাতের চিঠিগুলোর দিকে তাকালো।

থানার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম তখনই যেন আমার উপর চিঠির বর্ষণ শুরু হয়ে যায়। এসবে আমার চরম রাগ হলো। একবার উপরে তাকিয়ে হাতে কয়েকটি চিঠি নিয়ে থানায় ঢুকে গেলাম। একজন কর্মচারী আমাকে তাদের স্যারের কাছে নিয়ে যেতেই দেখলাম চিঠিগুলো পরেছে ওনার কক্ষ থেকেই। এবার আমার ক্রোধ আরও বেড়ে যায়। যার হাতে চিঠির বক্স ছিলো তাকে বলে উঠলাম,

-‘আপনি কী পাগল? এভাবে আমার উপর চিঠি ফেলার মানে কী? ওটা রাস্তা, মানুষ ওখান দিয়ে চলাচল করে। আপনার মাঝে যদি এইটুকু কমনসেন্স না থাকে তাহলে আপনি কেমন পুলিশ? চিঠির জায়গায় যদি অন্যকিছু হতো আর আমার যদি কোনরকম ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতো তাহলে তার দায়ভার কী আপনি নিতেন?’

মেয়েলি কন্ঠ পেয়ে নাশিদ মাথা তুলে তাকালো এবং রথিকে দেখে সে খানিক চমকে গেলো। বিয়ে বাড়ির রথি এবং বর্তমান রথির মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য লাগছে।
আমি এবার অফিসারের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যাবো তৎক্ষনাৎ ওনাকে দেখে আমার মুখ অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যায়। এ যে নাশিদ, নাফিসার ভাই। উনি তাহলে এই থানায় দায়িত্বে আছে? দুজনই দুজনের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নয়ন ততক্ষণে জলদি কাউকে দিয়ে রাস্তায় পরা চিঠিগুলো পরিষ্কার করতে বলে দেয়। নাশিদ অস্ফুট সুরে বলে উঠে,

-‘তুমি রথি, রাইট?’

আমার মুখ দিয়ে যেন কথা বের হচ্ছে না। ওনার সামনে আমি কীসব বলে ফেললাম, এখন উনি আমার সম্বন্ধে কী ধারণা করবেন? আমি বাজে মেয়ে? পরমুহূর্তে ভাবলাম, আমি তো ভুল কিছু বলিনি। ভেবে নিজেকে কিছুটা শান্ত করলাম এবং একটা কথাই বললাম,

-‘হুম। আপনার কর্মচারীদের একটু কমনসেন্স শিখিয়ে দিয়েন। নয়তো দেখা যাবে পুলিশ সাধারণ মানুষকে নয় সাধারণ মানুষ পুলিশকে সেবা দিচ্ছে!’

বলেই আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে চলে আসলাম। কেন যেন ওনার ওই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত আমার সহ্য হয় না, অস্বস্তি অনুভব হয়।

নাশিদ এখনো রথির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে রথির কথাগুলো সে ঠিকমতো হজম করতে পারেনি। এতদিন কেসের মাঝে ডুবে থাকার কারণে তার মগজ থেকে এই “রথি” একদমই মুছে গেছিলো। আবারও এই রথি তার মগজে হানা দিলো। আবারও সে রথির রহস্য জানতে পূর্বের ন্যায় আগ্রহী হয়ে উঠে। সেদিন নাশিদ নয়নকে আচ্ছাশিড় বকাঝকা করলো। কারণ, তার কারণে বাইরের মেয়ে এসে জ্ঞান দিয়ে গেছে যা নাশিদ এখনো হজম করতে পারছে না।
নয়নও সেদিন থেকে নিজেকে শোধরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো।

কোচিং সেন্টারে যেতে একটু দেরী-ই হয়ে গেলো। কোনরকমে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করতেই ফাহাদ স্যারের সঙ্গে দেখা হলো।

-‘কী ব্যাপার রথি? আজ দেরী হলো যে?’

থানার কথা বলতে চেয়েও রথি বললো না। থানা এবং নাশিদ, এই দুটো শব্দ রথি নিজের মাঝেই রাখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তাই “এমনি” বলে ফাহাদকে পাশ কাটিয়ে ক্লাসে ছুটে গেলো। সারা ক্লাসেও নাশিদের সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ভুলতে পারলো না। কই এতদিন তো নাশিদের কথা এতবেশি মনে পরেনি তাহলে আজ এসব চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে কেন? ওনাকে থানায় দেখতে পেয়ে?

এই মাসের বেতনের হিসেব করতে করতে হেঁটেই বাসায় ফিরছিলাম তখনই আমাদের এলাকার বখাটে শামুন আমার পথ আটকে দাঁড়ালো। আমি তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই শামুন বুকের বা পাশে হাত দিয়ে বলে,

-‘হায়! মে মার যাওবা! এভাবে তাকিও না, এখানে লাগে!’

-‘ফাইজলামি একদম ভালো লাগে না শামুন, পথ ছাড়!’

-‘আগে হ্যাঁ বলে দাও, ছেড়ে দিবো।’

-‘কিসের “হ্যাঁ”?’

-‘ওইযে, তিন মাস আগে যেটা বলেছিলাম, সেটার উত্তর!’

আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বুকে দুইহাত গুঁজে বললাম,

-‘আমি মরে গেলেও তোকে আমার উত্তর “না”-ই থাকবে। সাবধান করছি, আমার থেকে দূরে সরে যা। নয়তো তোর এমন হাল হবে তুই তা এই জীবনেও ভুলতে পারবি না!’
আমার কথায় শামুন ফিক করে হেসে দেয়।

-‘যা হবে না জেনেও এক কথা দিয়ে ভয় দেখাও এটা বেশ ভালো লাগে। তোমার তেঁজ তো আরও বেশি। তাইতো হুট করে তোমায় পুরো মনটা দিয়ে দিলাম। যাইহোক, আমি তোমার জন্য সব করতে রাজি, জাস্ট! অন্য ছেলের প্রতি দুর্বল হলে তোমার কী হাল করতে হয় তাও আমার জানা আছে। তুমি আমার ওকে? বাই ডার্লিং!’

বলেই আমার থুঁতনিতে হাত দিতে যাবে তখনই আমি দু’কদম পিছিয়ে গেলাম। শামুন হাসতে হাসতে আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেলো আর আমি বিষন্ন মনে বাড়িতে ফিরলাম। বাড়ি ফেরার সময় যেন আমার পা চলছিলো না। ইচ্ছে করছিলো সব ফেলে এমন একটা দুনিয়ায় চলে যাই যেখানেই শুধুই আমার নিজস্ব রাজত্ব চলবে, একান্তই নিজস্ব রাজত্ব। সেখানে কেউ থাকবে না।

সন্ধ্যার পর নাফিসা, নেওয়াজ, তার বউ এবং নাশিদ একসাথে ঘুরতে বের হয়। কিছুদিন আগেই নেওয়াজ ও তার বউ তনু হানিমুন থেকে ফিরেছে। নাফিসা আর তনু কথা বলে বলে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং বিভিন্ন আলাপ করছে। নেওয়াজ কেএফসির থেকে দুটো জুস নিয়ে আসে। অতঃপর নাশিদকে এক গ্লাস দিয়ে নিজেরটা পাইপ দিয়ে খেতে শুরু করে। নাশিদ আনমনেই জুসটা খাচ্ছে। নেওয়াজ অনেকক্ষণ ধরেই নিজের ভাইয়ের আচরণ লক্ষ করছে। এবারও নাশিদের আনমনা তার চোখ এড়ালো না।

-‘কী ব্যাপার নাশিদ? এমন আনমনা দেখাচ্ছে কেন তোকে? অনেকক্ষণ ধরেই আমি তোকে লক্ষ করছি, কোনো কী সমস্যা?’

-‘না ভাইয়া। তেমন কিছু না!’

-‘আমার থেকে কিছু লুকানোর চেষ্টা করছিস?’

-‘আরে নাহ।’

-‘আমার সাথে চালাকী করবি না নাশিদ!’

-‘ফাইন! বলছি, থানায় এক মেয়ে ইনডাইরেক্টলি আমায় জ্ঞান দিয়ে গেছে।’

বলেই পুরো কাহীনি সংক্ষেপে তুলে ধরলো। তবে নাশিদ জানালো না রথি নাফিসারই বেস্টফ্রেন্ড। অচেনা মেয়ে বলে পুরো ঘটনাটিই সে তুলে ধরলো। নেওয়াজ নাশিদের এসিস্ট্যান্টের কর্মকান্ডে হু হা করে হেসে উঠলো। এমন বলদও পুলিশের চাকরি মানে নাশিদেরই এসিস্ট্যান্ট! হাস্যকর।

-‘যাক, আশা করছি মেয়েটার কথায় নয়নের মাথা খুলবে। হায়রে কাহীনি লাভ সেটারময়।’

নাশিদ উত্তরে কিছু বললো না। নেওয়াজ আবারও নাশিদকে খুচিয়ে বলে উঠলো,

-‘তুই বিয়ে করলেই দেখবি মেয়েরা তোর পিছে ঘুরা বন্ধ করে দিছে। আসলে তুই তো আমার মাহশাল্লাহ ভাই তো তাইতো মেয়েদের লাভ লেটার নিতে নিতে বেচারা নয়ন মাঝখান দিয়া ফাইসা গেছে। বিয়ে করে ফেল, আমি তো করেই ফেললাম। সো তোর লাইন ক্লিয়ার বস!’

-‘নো ওয়ে। কোনো আলতু ফালতু মেয়েদের আমার জীবনে জায়গা নেই! আর এদের কাউকে বউ বানানো তো বিলাসিতা!’

-‘তাহলে তোর কেমন মেয়ে পছন্দ?’

-‘আত্মনির্ভরশীল, সাধারণ একজন! এইটুকুই আমার এনাফ ভাইয়া!’

নেওয়াজ চুপ করে গেলো। কারণ সে জানে এরকম মেয়ে হারিকেন দিয়ে সারাজীবন খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। আর পেলেও তারা নাশিদের পার্সোনালিটির সঙ্গে ম্যাচ করবে না। নেওয়াজের মতে তার ভাই তার একজন আদর্শ। হ্যাঁ নাশিদ তার ছোট ভাই হওয়া সত্ত্বেও নেওয়াজ নাশিদকে আদর্শ হিসেবে মানে এবং ভালোবাসে। একচুয়ালি নাশিদ মানুষটাই এমন, তার মধ্যে কী কী জ্ঞান, বিচক্ষণতা লুকিয়ে আছে সবটাই যেন রহস্য। নাশিদকে কখনো অচেনা কারো সঙ্গে মিশতে দেখেনি, সেই ছোটবেলা থেকেই। হয়তো উপলব্ধি করেছিলো, তার এই দুনিয়ায় আপন মা বলতে কেউ নেই।

ভাবতেই নেওয়াজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হ্যাঁ নেওয়াজ জানে নাশিদ তার আপন ভাই নয়। যখন নাশিদের মা মারা যায় তখন নাশিদ মাত্র ২ বছর বয়সী ছিলো আর নেওয়াজ ছয় বছর বয়সী। আর নাফিসা, সে তো দুনিয়ার আলো দেখতেই তার মা দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে। নেওয়াজের এখনো ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, ওই টুকুনি দুই বাচ্চার পরিস্থিতি কী-রূপ ছিলো, তার মা কীভাবেই না দুজনকে একত্রে সামাল দিয়েছিলো। সবটা আজও তার চোখে ভেসে উঠে। চাইলেও ভুলতে পারে না। তবে সে নাশিদকে এবং নাফিসাকে আজও বুঝতে দেয়নি তাদের সৎ ভাই হচ্ছে নেওয়াজ। কারণ সে চায় না বাকি সৎ ভাইদের মতো নিজের চরিত্র খারাপ করতে। সে একজন আদর্শ ভাই হবে বলেই প্রতিজ্ঞা করেছে।

~চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here