হৃদপূর্ণিমা পর্ব -০৬

#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ০৬ |

]

বিষন্ন নিকষ কালো রাত! চারপাশে শোঁ শোঁ শব্দে শীতল বাতাস বইছে। এই রাতে মই বেয়ে ছাদে উঠছে রথি। তাদের পুরো ছাদ টিনের হলেও বাথরুম এবং কিচেনের উপর দিয়ে ইট-সিমেন্টের ঢালাই করা। সেখানে ছোট সাইজের গাজী টাংকি। সেই গাজী টাংকির পাশে বড়-জোর দুজন মানুষ বসার মতো জায়গা আছে। আর এই ছোট জায়গাটি-ই রথির মন খারাপের সঙ্গী। মই বেয়ে উঠে সে টাংকির সঙ্গে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে পরে এবং অদূর আকাশের পানে তাকিয়ে রয়। তার ভেতরের বেদনাগুলো চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসছে। এ জীবনে এতো কেন কষ্ট? কেন গরিব হলে এতো কষ্ট, এতো লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়?
গরিব বলে কী তারা মানুষ নয়? আজ রথির তার বাবার প্রতি অনেক অনেক অভিমান জমেছে। কেন সে চলে গেলো? সে থাকলে যে তার দুর্দিন শুরু হতো না। রথি চোখের জল ফেলতে ফেলতে আকাশের পানে তাকিয়েই বলতে শুরু করলো,

-‘দেখছো বাবা? তোমার মেয়েকে ছায়া দেয়ার মতো কেউ নেই, একটি ভরসার হাত নেই যেখানে নিজে একটু সুরক্ষা অনুভব করবো। তোমার রাজকন্যা এখন খেটে মরে, এলাকার মানুষদের ভোগের বস্তু হয়ে গেছে। তার নির্দিষ্ট কোন সম্মান নেই, যে যেখানে পারছে অধিকার খাটাচ্ছে, খোটা দিচ্ছে। এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না বাবা। তুমি না বলতে তোমার মেয়েকে যেই বাজে কথা বলবে তুমি তার জিহবা কেটে হাতে ধরিয়ে দিবে? এখন তুমি কোথায় পালালে বলো তো? তুমি যখন ছিলে তখন তো এতকিছু হয়নি? যেদিন ঘুমের মধ্যেই চলে গেলে তারপর থেকেই আমার প্রিয় ভাবীটাও বদলে গেলো সাথে আমি আমার পড়াশোনা ছেড়ে শিক্ষকতা করছি আর রাস্তায় যার তার কথা শুনছি। বাবা বিশ্বাস করো, আমি আর পারছি না। অনেক সহ্য করেছি, আর কতো করবো? জানো মা আজও লুকিয়ে তোমার জন্য কাঁদে। আর আমি বুঝেও কিছু বলার ভাষা পাই না। কেন জীবনটা এতটা এলোমেলো হয়ে গেলো?’

বলেই দুই হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে ডুঁকরে কাঁদতে লাগলো। সময় এভাবেই অতিবাহিত হতে লাগলো কিন্তু কেউই রথির বেদনা মিশ্রিত অভিযোগ শুনলো না, কেউ না।

পরেরদিন এভাবেই আনমনা হয়ে কোচিং হতে রথি বাড়ি ফিরছিলো তখনই দূরে থানার সাইনবোর্ড দেখতে পায়। “থানা” শব্দটি দেখেই রথির মন খারাপ কেটে গিয়ে নাশিদকে ঘিরে তার ভাবনা শুরু হলো। আচ্ছা নাশিদ কী এখন থানাতেই আছে? ভাবতে ভাবতেই থানার পথে যেতে লাগলাম। পুলিশম্যানের জানালার সামনে আসতেই পা-দুটো উঁচু করে ওনার কক্ষে উঁকি দিলাম। হু, পুলিশম্যান ফাইল ঘাটতে ব্যস্ত। এসব মোটা মোটা ফাইলগুলিতে কী আছে তা জানার বেশ ইচ্ছে আছে আমার। হুট করে সেই স্ক্রু ঢিলাকে দেখে উঁকি দেয়া বাদ দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে বাড়ির দিকে চলে গেলাম। স্ক্রু ঢিলাটা হচ্ছে ওই পুলিশ যে কিনা আমার উপর চিঠির বর্ষণ করিয়েছিলো। একে স্ক্রু ঢিলাতেই বেশি স্যুট করে। কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়? প্রতিদিনের মতো আজও ওই লম্পট শামুনের সঙ্গে দেখা। এই লম্পট অলরেডি আমার হাফ লাইফ বরবাদ করে দিয়েছে। এ ছেলে মানুষ, এলাকার নামকরা বখাটে, বেশি কিছু বলতেও পারি না। চুপ করে সহ্য করতে হয়। শামুন প্রতিদিনের মতোই কিছুক্ষণ জ্বালিয়ে বিদায় হলো। আমি সেখানেই মূর্তির ন্যায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম।
এভাবে রোজ আমি থানায় উঁকি দিতে শুরু করি। কেন জানি না পুলিশম্যানকে উঁকি দিয়ে দেখতে ভালো লাগে। এক মুহুর্তের জন্য হলেও আমার বেদনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসি। আচ্ছা এমন কেন হয়? ওনার সাথে তো আমার কোনরকম পার্সোনাল পরিচয় নেই। কখনো প্রাণ খুলে জাস্ট এক মিনিটও কথা বলিনি। তাহলে? এ কেমন অনুভূতি?

আজও ফেরার সময় থানায় উঁকি দিলাম কিন্তু আজ উনি অনুপস্থিত। ওনাকে না দেখতে পেয়ে আমি মনমরা হয়ে বাড়ি ফিরলাম। মায়ের সামনে চেয়েও হাসি-খুশি থাকতে পারিনি, বারবার ওনাকে নিয়েই ভাবছিলাম। যখন ওনার কথা বেশি ভেবে ফেলি তখন মাথায় এক চাটি মেরে আম্মুকে রান্নার কাজে সাহায্য করতে চলে যাই নয়তো আগামী দিনের লেকচারের প্রস্তুতি নিতে থাকি। এ ছাড়া অন্য কাজ নেই আমার।

এভাবে আরও কিছুদিন কেটে গেলো। প্রায় সময়ই উঁকি দিয়ে ওনাকে পেতাম না, তখন ভিষণ মন খারাপ হতো। ভাবীও নাকি তার বাবার বাড়ি গেছে তাই আপাতত শান্তিতে আছি, ডাকাডাকির ঝামেলায় নেই।

নাফিসা রেডি হয়ে নাশিদের রুমে আসতেই দেখলো নাশিদ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সারারাত ডিউটি করে এখন সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নাশিদের ঘুম দেখে নাফিসার আর নাশিদকে ডাকতে ইচ্ছে হলো না। কিন্তু এখন না ডেকেও যে উপায় নেই। আগামী মাসে তাদের ভার্সিটিতে একটি প্রোগ্রাম আছে, কয়েকজন টিচার বলেছে রথি যেন অবশ্যই আসে। নাফিসা ভাবলো অনেকদিন রথির সঙ্গে দেখা হয় না। ফোনে বলার চেয়ে বরং এক কাপ চায়ের সাথে সরাসরি বসেই জানালো। নাফিসা একা যেতে চেয়েছিলো কিন্তু তার মা বারণ করেন। বলেন নাফিসাকে যেন নাশিদ পৌঁছে দিয়ে আসে। তাই নাফিসা বাধ্য। আর রথি ওদের ডিপার্টমেন্টের টপার এবং খুবই শান্ত-শিষ্ট ছিলো বিধায় টিচাররা ওকে বেশ পছন্দ করতো। যখন অনার্স থার্ড ইয়ারে এসে রথি পড়াশোনা ছেড়ে দেয় তখন ওদের ইয়াকুব স্যার এবং আঞ্জুমান ম্যাম দুই-তিন দিন পরপরই রথির বাসায় গিয়ে ওদের বোঝাতো। কিন্তু রথি রাজি হয়নি৷ অবশেষে আঞ্জুমান ম্যাম হার মেনে চলে যাওয়ার আগে রথিকে বলে যায়,

-‘যদি কখনো দরকার হয় এই ম্যাম আর স্যারকে স্মরণ করিও। ইনশাল্লাহ পাশে থাকবো!’

রথি সামান্য হেসে “জ্বী” শব্দটিই মুখে উচ্চারণ করেছিলো। রথি প্রথমদিকে শান্ত-শিষ্ট আর বোকাসোকা হলেও সময় এবং পরিস্থিতির ব্যবধানে অনেকটা বদলে গেছে। এখন সে আত্মনির্ভরশীল একজন নারী।

নাফিসা উপায় না পেয়ে নাশিদকে ডাকলো। নাশিদ প্রথমে রেসপন্স না করলেও পরে উম..হা বলে আবারও ঘুমিয়ে যেত। নাফিসা উপায় না পেয়ে বিষন্ন মনে নাশিদের বেডে বসলো এবং নাশিদের উদ্দেশ্যে বললো,

-‘তাড়াতাড়ি উঠ না ভাই! রথির বাসায় যেতে যে লেট হবে।’

ঘুমের মাঝেও “রথি” নামটা কানে লাগতেই নাশিদ চট করে উঠে বসলো। নাশিদ আচমকা উঠে বসায় নাফিসা অবাকের চরম পর্যায় চলে আসে। নাফিসা গোল গোল চোখে নাশিদের দিকে তাকিয়ে থাকে। নাশিদ নাফিসার এমন তাকানো দেখে প্রসঙ্গ বদলে বললো,

-‘কী সমস্যা? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? আর জলদি ওঠার তাড়া দিচ্ছিলি কেন?’

-‘রথির বাসায় যেতাম। মা বলেছে তোর সাথে যেতেম’

-‘এই ভর-দুপুরে কী উপলক্ষ্যে?’ ভ্রু কুচকে বলল্প নাশিদ।

-‘নেক্সট মান্থ ভার্সিটিতে প্রোগ্রাম আছে। সেই প্রসঙ্গেই।’

-‘কেন রথি কী জানে না? তুই কেন আলাদাভাবে ওকে বলতে যাবি?’

-‘ও তো গতবছর লেখাপড়া ছেড়েছে!’

নাশিদ থমকে গেলো। নাফিসার বলা এই একটি মাত্র বাক্য যেন নাশিদের মাথার উপর দিয়ে গেলো।

-‘মানে কেন?’

-‘আর্থিক সমস্যার জন্য। তোকে বলেছিলাম না, মেয়েটার জীবনে অনেক কষ্ট? আলাদা থেকে মা এবং নিজের ভরণপোষণের দায়িত্ব তার কাঁধে। তার মায়ের চিকিৎসার জন্য একটা ভালো শাড়ি তো দূর জামা পর্যন্তও কিনেনি ভাই, তাইতো ওরকম পুরানো শাড়ি পরে নেওয়াজ ভাইয়ের বিয়েতে এসেছিলো। মাঝে মধ্যে ওর জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজেকে চিন্তা করি আর আঁতকে উঠি, তাকে ছায়া দেয়ার মতো কেউ নেই!’

নাশিদ চুপচাপই সবটা শুনলো। তার যে এসব শুনে খারাপ লাগেনি তা সে অস্বীকার করবে না। নাশিদের ইচ্ছে করছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে। কিন্তু রথি কী সেই সাহায্যের হাত গ্রহণ করবে? নাশিদ কিছুক্ষণ ভাবান্তর হয়ে বলে,

-‘কীসের জব করে?’

-‘একটা কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করছে!’

নাশিদ বিছানা থেকে নেমে হাতে তোয়াল নিয়ে ওয়াশরুম যেতে যেতে বলে,
-‘নিচে গিয়ে অপেক্ষা কর, আমি আসছি!’

নাফিসা মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। এই রথি চরিত্রটা তার কাছে যেন রহস্যের ভান্ডার। দেখে বোঝাই যায় না এইটুকুনি একটি মেয়ে এতটা অসহায়, ভেতরে কতটুকু পোড়া দাগ তার মাঝে বিদ্যমান। আচ্ছা নাফিসা তো বললো মা এবং রথির ভরণপোষণ, এর মানে কী রথির বাবা নেই? ও মাই গড!
কিন্তু নাশিদের এতটা কেন খারাপ লাগছে! নাশিদ রথির ভাবনা সাইডে ফেলে গোসল সেরে নিলো। অতঃপর রেডি হয়ে নাফিসাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

কোচিং থেকে বিষন্ন মনে বাসায় ফিরছি। আজও পুলিশম্যানকে থানায় পেলাম না। এর পুলিশ হওয়ার কী দরকার ছিলো? সারাদিন চোরে ডাকাতের পিছে ছুটো। বিড়বিড় করতে করতেই বাসার গেটের দিকে চোখ যেতে থমকে দাঁড়ালাম। পা যেন সামনে চলছে না। হা করে পুলিশম্যানকে দেখছি। উনি আমার বাসার সামনে কী করছেন? ওনার পাশের মেয়েটির দিকে খেয়াল হতেই দেখলাম নাফিসা। কিছুক্ষণ ভাবাশূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মাঝেই দেখতে পেলাম ওরা ভেতরে ঢুকছে। তখনই আমার ছোট বাসভবনের কথা মনে হলো। একপ্রকার ছুটে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওদের পথ আটকে গেলাম। রথিকে চোখের পলকে সামনে দেখতে পেয়ে নাশিদও কিছুটা থমকে যায়!

~চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here