#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ২৪+২৫ |
রথি তার মায়ের বুকে চুপটি মেরে লুকিয়ে আছে। তার আঁখিপল্লব ভার হয়ে আছে। সেই ভারের কারণটি বোধহয় মায়ের বুকে ঘুমানোর বেহায়াপনা। পৃথিবীর সকল প্রশান্তি অনুভব হচ্ছে তার। মা আঁটকে আঁটকে সিক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
-‘কতদিন পরে তোকে পেলাম রে মা। আমার ভেতরটা ঠান্ডা হলো। তুই আমায় ক্ষমা করেছিস তো মা?’
-‘এসব কী বলছো তুমি মা? এভাবে কেউ সন্তানের কাছে ক্ষমা চায়? তোমায় ভালোবাসি মা, তাই প্লিজ ক্ষমা শব্দটা উঠিয়ে আমায় ছোট করিও না!’
-‘পাগলি! ক্ষমা সুন্দর এবং মহৎ গুণ! সেই ক্ষমার নিকট ছোট বড় কেউ-ই অসমান নয়। আমি বড় হয়ে আমার ছোট মেয়েটার প্রতি না বুঝে অন্যায় করেছি, এর জন্য ক্ষমা না চেয়ে কীভাবে থাকি?’
-‘ওইযে বললে না, ‘না বুঝে’। আমি জানি মা, তোমায় ভুল বোঝানো হয়েছিলো তাই এমন করেছো। প্রকৃতপক্ষে আমি তোমার উপর রেগে নই। তাহলে ক্ষমা চাইছো কেন বারবার? এবার ক্ষমা চাইলে আমি সত্যি সত্যি-ই চলে যাবো!’
মা আমায় পরম আদরে বুকে আগলে নিয়ে বললো,
-‘উহু। তুই আমার সাথেই থাকবি আর আজই তোকে বাড়ি নিয়ে যাবো!’
কেবিনের বাইরে থেকে দরজার ছোট কাচ দিয়ে একমনে মা-মেয়ের ভালোবাসা দেখে চলেছে নাশিদ। তার মনটা কিছুটা ব্যথিত হলেও সে মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলো এবং সেখান থেকে সরে বেঞ্চিতে গিয়ে বসলো। রথি তার মাকে ছেড়ে মাথা উঠিয়ে বললো,
-‘আ..আজই?’
-‘হ্যাঁ। এই হাসপাতাল, টাতালে আমি থাকতে পারবো না। আমি আমার বাসায় যাবো!’
-‘কিন্তু মা, আজ তোমায় ডিসচার্জ দিবে না!’
মা সাইফের জবাবে প্রতিত্ত্যুর না করে রথিকে বললো,
-‘বাইরে নাকি নাফিসার ভাই আছে? ওকে দিয়ে ব্যবস্থা করে দে না রথি!’
রথি খানিকটা ইতস্তত হয়ে বলে,
-‘আ.. আচ্ছা মা দেখছি!’।
বলেই রথি ধপ ধপ পা ফেলে কেবিনের বাইরে চলে যায়।
_________________________________
-‘এই নাফু শুন!’
-‘বলো ভাবী!’
-‘কিছু জানার ছিলো!’
-‘কী ভাবী?’
-‘রথি আর দেবরজির মাঝে কী কোনো রিলেশন আছে?’
নাফিসা থতমত খেয়ে যায়। কী বলবে ভেবে পায় না। ভাবী রুদ্ধদ্বার স্বরে বলে উঠলো,
-‘লুকিয়ে লাভ নেই নাফু। আমি গতকাল রাতে রথিকে নাশিদের ঘরে দেখেছি আর নাশিদ রথির কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিলো!’
নাফিসা বুঝলো আর লুকিয়ে লাভ নেই তাই সে তপ্তশ্বাস ফেলে বললো,
-‘তোমার ধারণা ঠিক ভাবী! রথি আর ভাইয়ার রিলেশন আছে। তারা, দে বথ ফল ইন লাভ!’
ভাবী কিছুক্ষণ বিস্মিত দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে রইলো নাফিসার পানে। অতঃপর নাফিসার দিকে অনাকাঙ্ক্ষা হাসি দিয়ে বললো,
-‘ধুর বোকা, ভয় পাচ্ছো কেন? মাকে কিছুই বলবো না আমি। আর আমি নিজেও এই বিষয়ে কবেশ খুশি। ভালোবাসা খুবই পবিত্র জিনিস! এটা আমরা ইয়াং জেনারেশন একটু বেশি-ই বুঝি, বুঝলে?’
নাফিসা হাসলো! এদিকে মনিকা সকাল বেলা নাশিদের ঘরের দিকে যেতেই দেখলো বাহিরে নাশিদের বেডশিট পরে আছে আর তা সার্ভেন্ট কাপড়ের ঝুঁড়িতে তুলছে।দ মনিকা দ্রুত পা চালিয়ে সেই স্থানে গিয়ে সার্ভেন্টের উদ্দেশ্যে বললো,
-‘দাঁড়াও! ওই লাল ওটা কী?’
বলেই মনিকা ঝুঁড়ি থেকে বেডশিটটা নিয়ে রক্তের দাগগুলো পরোখ করতে লাগলো। সার্ভেন্ট মৃদু স্বরে বলে উঠলো,
-‘এটায় রক্ত লাগা ম্যাডাম! তাই..’
-‘তাই কী? রক্ত কীভাবে লাগবো?’ স্বগোতক্তি কন্ঠে বলে উঠলো মনিকা।
-‘ছোট স্যার কাল আহত হয়ে এসেছিলো। তার রক্তই বেডশিটে লাগানো!’
-‘কেউ ছিলো তার সাথে?’
সার্ভেন্ট খানিকটা ভড়কে গেলো মনিকার প্রশ্নে। মনিকা অগ্নিময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই ক্ষিপ্ত হয়ে বললো,
-‘কী লুকোতে চাইছো? যা বলছি সাফ সাফ বলো স্টুপিড!’
সার্ভেন্ট ভয়ে কেঁপে উঠলো। সে নিজের পায়ে দৃষ্টি স্থির করে আমতা আমতা করে বললো,
-‘রথি ম্যাডাম ছিলো। উনি-ই ছোট স্যারের খেদমত করেছিলো!’
_________________________________
নাশিদ রথির মায়ের ডিসচার্জের ব্যবস্থা করে দেয়। রথি মাকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে পেছন থেকে নিজেই চালিয়ে যেতে গেলো। সবার পিছে মার্জান তাতানকে নিজের সাথে জড়িয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে থমথমে গলায় বলতে লাগলো,
-‘আমায় কেউ বুঝলো না রে বাবা। আমি যে তোকে বাঁচাতে আর তোর ফুপির ভালোর জন্যই দূরে পাঠাতে চেয়েছিলাম। জানি আমি ভুল পথে সবটা ঠিক করতে চাইছিলাম তাই বলে সবটা না জেনে তোর বাবা আমায় ডিভোর্স দিবে বলে দিলো? কেউ একটাবারের জন্যেও জিজ্ঞেস করলো না এসব আমি কেন করেছি? তাতান, তাতান বাবা! আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবো না রে।’
তাতান চুপটি করে তার মায়ের কথাগুলো শুনলো। তার হাতে মার্জানের চোখ মুছে দিয়ে বললো,
-‘কেঁদো না আম্মু!’
সাইফ এবং নাশিদ ধরে মাকে সিএনজিতে বসিয়ে দিলো। মা উঠে বসতেই মার্জান তাতানকে নিয়ে অপরপাশ দিয়ে বসলো। আর সাইফ ড্রাইভারের পাশে বসলো। সাইফ ঠান্ডা কন্ঠে রথির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
-‘নাশিদকে বিদায় দিয়ে আয়!’
রথি কিছু না বলে সিএনজির থেকে বেশ কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা নাশিদের দিকে পা চালালো। নাশিদ তখনো নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। এক অজানা কারণে তার বুকের বা পাশটা চিনচিন ব্যথা অনুভব করছে। হয়তো প্রিয় মানুষটা দূরে চলে যাবে ভেবে। রথি নিষ্প্রভ চাহনি নিক্ষেপ করলো নাশিদের কাতর ভরা আঁখিপল্লবের দিকে। পুণরায় দৃষ্টি অদলবদল হয়। রথি থমথমে গলায় বলে উঠলো,
-‘সাবধানে থাকবেন। ওষুধ ঠিকমতো নিবেন!’
-‘হুম।’
-‘নিজের খেয়াল রাখবেন।’
-‘হুম।’
-‘হুম, হুম করছেন কেন?’
-‘অনেককিছু বলতে চেয়েও পারছি না।’
বলেই নাশিদ রথির দিকে দুই পা এগিয়ে দুই হাত নিজের হাতে নিয়ে কাতর কন্ঠে বলে উঠলো,
-‘এই বউ, কীভাবে থাকবো তোমায় ছাড়া? আমার এখনই কেমন দম আটকে আসছে। দেখো ঠিকমতো নিঃশ্বাসটাও আসছে না! কেন এমন লাগছে বলো না? কী জাদু করেছো এ-কদিনে? পারছি না আমি, আমার ইমোশনালকে কান্ট্রোল করতে! প্লিজ সলিউশন দাও!’
রথি পুণরায় নাশিদের আকুতিভরা চোখের দিকে তাকায়। নাশিদের চোখে জল। রথি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আঁখিজোড়ার দিকে। রথি কখনো কল্পনাও করেনি কেউ তাকে এতোটা ভালোবাসবে। রথি নাশিদের দিকে একমনে তাকিয়ে রইলো, কিছুই বলতে পারলো না। নাশিদ মিনুতির স্বরে রথির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
-‘এ..একবার জড়িয়ে ধরবে আমায়, বউ?’
এবার রথির চোখে জল চলে এলো। রথি নাশিদকে ছুটে জড়িয়ে ধরলো। নাশিদও পরম যত্নে তার হৃদপূর্ণিমাকে আগলে নেয়। দুজনের চোখ দিয়েই অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পরছে। দুজনের ব্যথাটা হচ্ছে ‘দূরত্ব’! হয়তো অপ্রকাশিত কিন্তু নিরবে দুজন দুজনকে ছাড়া থাকার ব্যথাটা উপলব্ধি করতে পারছে। যেন কতো দূরে চলে যাবে! রথি দেরী করলো না। নিজ হাতে নাশিদের চোখ মুছে দিয়ে মৃদু স্বরে বললো,
-‘আপনি একজন পুলিশ অফিসার! বউয়ের জন্য কেঁদেকেটে এভাবে চোখ-নাক লাল করে ফেললে মানুষ আপনাকে বউপাগল বলবে। বলবে বউ ছাড়া এই ইনসান কিছুই বুঝে না!’
-‘মানুষের কথা আমি শুনতে যাবো কেন? তারা কী করে জানবে আমার কাছে তোমার মূল্য?’
-‘ঠিক আছে হয়েছে। এখন ছাড়েন, মায়েরা অপেক্ষা করছে।’
নাশিদ রথির কপালে তার ওষ্ঠ্য-জোড়া ঠেকিয়ে দূরে সরে এলো। রথি এই স্পর্শে কেঁপে উঠলো। অতঃপর নাশিদ হেসে বলে, ‘যাও।’
রথি প্রতিত্ত্যুরে হাসি উপহার দিয়ে চলে গেলো। আর নাশিদ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। রথি পিছে ফিরে একপলক নাশিদের দিকে তাকালো। অতঃপর হাত নাড়িয়ে বিদায় দিয়ে সিএনজিতে উঠে বসলো। সিএনজি নাশিদের চোখের আড়াল হতেই সে নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো।
রথি বাড়ি ফিরে মায়ের জন্য আগে কিছু রেঁধে নিলো। রান্না শেষ করে দ্রুত খাইয়ে ওষুধ দিলো। ওষুধ খেয়েই মাকে শুইয়ে দিয়ে পরম যত্নে মায়ের চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলো। মাও ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করে চোখ বুঝলো এবং কিছুক্ষণের মাঝেই ঘুমিয়ে গেলো। মা ঘুমাতেই রথি ওয়াশরুম গিয়ে লম্বা একটা শাওয়ার নেয়। শাওয়ার নিয়ে রুমে আসতেই বাইরে থেকে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনলো। কন্ঠস্বর সাইফ এবং মার্জানের তা রথির বুঝতে বাকি রইলো না। সে দ্রুত বের হতেই তাতানের সামনাসামনি হলো। রথি হাঁটু গেড়ে বসে তাতানের উদ্দেশ্যে বললো,
-‘যাও তাতান, দিদুনের কাছে গিয়ে বসো।’
তাতান মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। রথি উঠে দাঁড়ায় এবং দ্রুত পা চালিয়ে সাইফের ঘরের দিকে চলে যায়। রুমে গিয়ে রথি স্তব্ধ হয়ে যায়। মার্জান সাইফের পা ধরে ক্ষমা চাইছে। বারংবার বলছে যেন তাকে ডিভোর্স না দেয়া হয়, তাতানকে তার থেকে দূরে না সরানো হয়! কিন্তু সাইফ শুনতে নারাজ। সাইফ নিজের রসগ দমাতে না পেরে পা ঝাড়া দেয়, যার ফলে মার্জান তাল সামলাতে না পেরে খাটের কোণায় ছিটকে যায়। কপাল লেগে কপালের এক অংশে কেটে রক্ত পরছে। রথি ছুটে মার্জানের কাছে গেলো। রথিকে দেখে সাইফ কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। রথি মার্জানকে ধরে উঠাতেই সাইফ স্পষ্ট ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
-‘রথি, ও যেন আজই ওর বাবার বাড়ি চলে যায়। তিন মাস পর সময়মতো ডিভোর্স পেপার পেয়ে যাবে। আমি যেন ওর ছায়াও এই বাড়ির ত্রি-সীমানায় না দেখি!’
বলেই সাইফ প্রস্থান করলো। মার্জান এবার রথির দিকে ফিরে মিনুতি করে বলে,
-‘প্লিজ রথি তোমার ভাইয়াকে বোঝাও! আমি ডিভোর্স চাই না। তাতানকেও…’
-‘ভাইয়া যখন বলছে চলে যাও। দেখো তুমি থাকলে ভাইয়া তোমায় মিনিটের জন্যেও শান্তিতে থাকতে দিবে না তাই চলে যাওয়াই ভালো!’
-‘রথি বিশ্বাস করো, আমি তা…’
রথি মার্জানের বাকি কথা না শুনে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সেই রুমটাতে মার্জান একাই পরে রইলো। মার্জান এক চিৎকার দিয়ে ধপ করে মেঝেতে বসে রইলো।
-‘কেন কেউ শুনতে চাইছো না? আমি সব আমার তাতানের জন্যে করেছি! তোকে দূরে না সরালে আমার তাতানকে শামুন দূরে নিয়ে যেতো, অনেক দূরে। আমার তাতানকে বাঁচানোর জন্যে ওকে আমি ঘরে রাখিনি! আমার ওইটুকুনি বাচ্চাকে হোস্টেল পাঠাতে বাধ্য ছিলাম! একজন মা তার সন্তানকে বাঁচাতে সবকিছু করতে পারে রে রথি! সব!’
সেদিন রাতে সাইফ আর বাড়ি ফিরলো না। মার্জানও ঘর থেকে বের হয়নি। নিজেকে ঘর-বন্দি করে রেখেছিলো। মার্জান সাইফকে অনেকবার ফোন করেছিলো কিন্তু সাইফ কল ধরেনি। জাস্ট একটা মেসেজ করেছিলো।
-‘তুমি যতদিন বাড়িতে থাকবে, আমি ততদিন ফিরবো না! নাও চয়েজ ইজ ইওর’স!’
রথি মা, তাতান আর মার্জানকে সামলাতে সামলাতে হাঁপিয়ে গেছে। আজ তার কোচিং যাওয়া হয়নি। মা সুস্থ না হওয়া অবধি তার কোচিং যাওয়া সম্ভব না। সারাদিনের ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিতেই নাশিদকে বড্ড মনে পরলো। রথি উঠে বসে বিছানার দিকে তাকায়। তাতান এবং মা দুজনেই ঘুম। রথি নিজে শোয়ার জন্যে নিচে বিছানা করে শুয়েছিলো আর তাতান তার জায়গায় ঘুমিয়েছে। রথি উঠে টেবিল থেকে নিজের ফোন নিয়ে আবারও তার বিছানায় আসলো। ডায়াললিস্ট থেকে ‘পুলিশম্যান’ নামটা পেতেই কল দেয়। কিন্তু রিং হওয়ার পরেও কল রিসিভ হলো না। রথি আর কল দেয়ার সাহস পায় না। হয়তো নাশিদ ঘুমোচ্ছে। এমনিতেও তো নাশিদ আহত, তার ঘুমের প্রয়োজন। এসব ভেবে রথি ফোন রেখে নিজ কল্পনাতে নাশিদকে ভাবতে লাগলো। এতদিনের কাটানো মুহূর্তগুলো, আজকের সকালের মুহূর্ত সবটা একে একে মনে করছে আর সুখের ভেলায় ভাসছে। প্রিয়মানুষদের সাথে কাটানো সোনালী সময়গুলোর সুখটা প্রকাশ করে বোঝানো যায় না। এই সোনালী মুহূর্তগুলো একান্তই ব্যক্তিগত!
_________________________________
-‘রথির সাথে তোমার কী সম্পর্ক? সত্যি করে বলো নাশিদ!’
নাশিদ মিনিটখানেক চুপ থেকে রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠলো,
-‘আমার বউ হয় ও! শুনেছেন? বিয়ে করেছি তাকে। আমার বিয়ে করা বউ দেখেই গতরাতে সে আমার সেবা-যত্ন করেছে। আর কিছু জানতে চান?’
নাশিদের কথায় লিভিংরুমের পরিবেশটা পিনপতন নীরবতায় ছেয়ে গেলো। সকলেই অত্যন্ত হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নাশিদের দিকে। মনিকা হতবিহ্বল হয়ে বলে,
-‘ফাইজলামির লিমিট আছে! আর এটা কোন ধরণের বেয়াদবি নাশিদ? মা হই আমি তোমার!!’
নাশিদ তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়। অতঃপর সার্ভেন্টকে বলে কিছু কাগজ আনায় সে। সেই কাগজই কাবিননামা। নাশিদ কাবিননামা তার বাবার হাতে দিতেই সে সবটা পড়লো। পড়ে নিজেও সে স্তব্ধ। বাবাকে এমন থম মেরে বসে থাকতে দেখে নেওয়াজ তার বাবার থেকে কাগজটা নিয়ে নিজে পড়তে থাকে। মনিকা ভ্রুযুগল একত্রিত করে থমথমে গলায় বললো,
-‘কী লেখা আছে ওটায়, নেওয়াজ?’
-‘সত্যি-ই বিয়ে হয়েছে মা!’
নাশিদ এবার তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
-‘বিশ্বাস হলো তো? এখন এই অর্পিকে বিদায় করুন বাড়ি থেকে। আপনি কী ভেবেছেন? লুকিয়ে গুটি চালবেন অথচ আমি টের পাবো না? এই নাশিদের মন এতো সস্তা না যে ওর মতো চিপ গার্লের প্রতি উইক হবো।’
-‘মুখ সামলে কথা বলো। আমি তোমার ম…’
-‘ওহ প্লিজ! এক কথা বলে বলে নিজেকে নিজেই অপমান করবেন না। আপনি নিজেও ভালো করে জানেন এবং আমিও, আপনি আমার মা নন।’
বাবা ব্যতীত উপস্থিত সকলেই হতভম্ব হলেন। মনিকা নিজেও নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। নাশিদ সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বললো,
-‘আমি আমার মতামত জানাচ্ছি, রথিকে শীঘ্রই ধুমধাম করে ঘরে তুলবো। এর মাঝে যেই ব্যাগড়া দেয়ার চেষ্টা করবেন তার জন্য মোটেও ভালো হবে না! আর মিসেস মনিকা, আপনাকে তো জানিয়েই দিলাম আমি সত্যিটা জেনে গেছি তাই এখন আপনি একা একা এক রুমে বাবার সঙ্গে আমার নিন্দা না করে প্রকাশ্যে করুন। আমি আপনার সেই সুযোগ আজ করে দিলাম। আপনার যদি আমায় সহ্য-ই না হয় তাহলে ফাইন, আপনার মহলে আমি থাকবো না। আমি আমার রথিকে নিয়ে গাছতলাতেও স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারবো!’
শেষোক্ত কথাগুলো বলার সময় নাশিদের চোখগুলো অসংখ্য লাল হয়ে গেছিলো। সকলের আড়ালে চোখের কোণ মুছে সে লম্বা লম্বা পা ফেলে সিঁড়ির দিকে চলে গেলো।
রুমে গিয়ে ডিরেক্ট বেলকনিতে গিয়ে বসে পরলো। বারংবার নাক টানছে সে। ডিভানে বসে নিশ্চুপ হয়ে তার দৃষ্টি বাহিরে স্থির করলো। তার কর্ণধারে বাবার বলা প্রতিটি কথা বারংবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। নাশিদ চোখ বুঝে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইলো। সাময়িক শান্তির প্রয়োজন তার। আফসোস আজই রথি চলে গেছে। রথিকে ছাড়া নাশিদ আরও ব্যাকুল হয়ে উঠলো। রথি থাকলে হয়তো তাকে আশ্বাস দিতো এবং তার দুঃসময়ে সঙ্গ দিতো। নাশিদ চোখ খুলে তার অতীতে ডুব দেয়।
প্রায় সময়ই নাশিদ বাবার সাথে দেখা করতে আসলে মনিকার নাশিদকে নিয়ে বিরক্তি ভরা কথা শুনতো যা নাশিদকে কষ্ট দিতো। কিন্তু সে এসব শুনেও তাদের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করতো। নাশিদের সামনেও যেহেতু মনিকা স্বাভাবিক আচরণ করছে তাই নাশিদ ওসব কথাবার্তা ভুলে যেত। কিন্তু তার ভেতরে একটা সংকোচ থেকেই যেত। হয়তো নাশিদের দ্বারা বড়রকম কোনো ভুল হয়েছে যার জন্য তার মা তার প্রতি অসন্তুষ্ট।
নাশিদ সিলেট চলে যায়। এর মাঝে সে বাড়ি ফিরতো না বললেই চলে। সেখানে কয়েক বছর পার করে আবারও ঢাকায় আসে। প্রথম কিছুদিন ভালো থাকলেও নাশিদ আবারও তার মায়ের ও ধরণের কথাবার্তা শুনতো। বাবা-মায়ের ঝগড়াঝাঁটিও দেখেছে। এতদিনে নাশিদ যথেষ্ট ম্যাচিউরড হয়েছে। তাই তার বিষয়টা মোটেও ভালো লাগেনি। একপ্রকার মনমরা থাকতো সবসময়। কিন্তু মনিকার বাহিক্য ব্যবহারে নাশিদ কিছু বলতে পারতো না। মূল কথা হলো প্রমাণ ছাড়া ধারণা অনুযায়ী কিছু জিজ্ঞেস করাও ঠিক হবে না। যতোই হোক সে একজন পুলিশ অফিসার এবং প্রমাণের মূল্য সে ভালোভাবেই বুঝে। একদিন বাবা লিভিংরুমে বসে ছিলো। নাশিদও ছিলো পাশে। সেদিন বাবা অফিসের জরুরি ফাইলের জন্য নাশিদকে ঘরে পাঠায়। নাশিদ বাবার কাবার্ডে ফাইল খুঁজতে খুঁজতে একটা ডেথ সার্টিফিকেট পায়। সেই সার্টিফিকেটে ‘নীলিমা’ নাম লেখা। নাশিদ প্রায়ই শুনতো তার মা মানে মনিকা ‘নীলিমা’ নামের কাউকে কথা শোনাতো। তাই নাশিদ সেই ডেথ সার্টিফিকেট সাবধানে নিজের কাছে রেখে দেয় এবং এটা নিয়ে রিসার্চ শুরু করে। অনেক খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে এই সার্টিফিকেটি আর কারো না নাশিদের জম্মদাত্রী মায়ের।
তার সামনে এতো এতো প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও সে কিছুই বিশ্বাস করতে পারছিলো না। তাই সে ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে ডিরেক্ট তার বাবার সঙ্গে দেখা করে। বাবা সবটা শুনে বেজার হয়ে বলতে শুরু করলো,
-‘হ্যাঁ! তোমার মা মনিকা নয়, নীলিমা আমার দ্বিতীয় স্ত্রী তোমার আপন মা।’
-‘তাহলে… তাহলে এসবের মানে কী?’ বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলো নাশিদ। বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগলো,
-‘তোমার মা ছিলো আমার প্রথম ভালোবাসা। তখন আমি সবে তোমার দাদার কোম্পানিতে জয়েন করছি আর তোমার মা কলেজে পড়ে। তোমার মাকে কথা দেই জয়েন করলেই তাকে বিয়ে করে ঘরে তুলবো। তোমার মা ছিলেন এতিম, চাচার ঘরে বড় হয় সে। সেই চাচারই একমাত্র মেয়ে মনিকা!’
-‘তার মানে ওনারা সম্পর্কে বোন ছিলেন?’
-‘হ্যাঁ। তোমার মাকে দেয়া কথামতো আমিও জয়েন হয়ে তার বাড়িতে বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে যাই। কিন্তু সেখানেই ঘটে বিপত্তি। চাচা তার ঘরে বিবাহযোগ্য মেয়েকে ফেলে নীলিমাকে আমার হাতে তুলে দিবে না। হয় মনিকাকে বিয়ে করতে হবে নয়তো এই বাড়ি থেকে বের হতে হবে। মূলত তাদের লোভ ছিলো আমাদের সম্পত্তির প্রতি। মনিকাও আমাদের এই সম্পর্ক সম্পর্কে অবগত ছিলো। এদিকে আমার মা মনিকাকে দেখেই পছন্দ করে ফেলে। সেই সময়ে নীলিমা কলেজে ছিলো তাই মা আর নীলিমাকে দেখেনি। মা সেদিনই আমাদের জোর করে আকদ করিয়ে ফেলে। মনিকা চায়নি এমনটা হোক তাও…’
-‘তারপর?’
-‘তারপর আর কী? কিছুদিন পর মনিকা এবং আমার বিয়ে হয়ে যায়। এদিকে তোমার মা এই দুঃখ সইতে না পেরে কয়েকবার আত্মহত্যা করতে চাইছিলো কিন্তু তার আগেই সে বেঁচে যায়। দিনদিন তার অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিলো। আমি চেয়েও তার কাছে যেতে পারতাম না কারণ মা আমায় তখন কসম কাটিয়ে রেখেছিলো। এভাবে বছরের পর বছর কেটে যায়, মনিকার কোল আলো করে নেওয়াজ আসে। নেওয়াজ জম্মের এক বছরের মাথায় মা মারা যায়। এদিকে আমি ভেতরে ভেতরে তোপ্রে তোপ্রে মরেছি নীলিমাকে ছাড়া। নীলিমা ততদিনে মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছিলো। সে এতোটাই পাগলামি করতো যে তারা ওকে বিয়ে দেয়ার সাহস পায়নি। বোনের এই হাল দেখে মনিকা নিজেও বিধ্বস্ত ছিলো। তাইতো সে কোনোদিক না দেখেই নীলিমার সাথে আমার বিয়ের ব্যবস্থা করে। নীলিমাকে অনেক ভালোবাসতো মনিকা, অনেক। বলা চলে দুই বোন একে অপরের জন্য সবকিছু করতে পারতো। কয়েকবছর শ্বাশুড়ির জন্যে চুপ থাকলেও সে আর কিছু না করে থাকতে পারেনি। নীলিমাকে বিয়ে করার পর তাকে আমার অনেক সময় দিতে হয়েছে। দুই বছরের মাথায় গিয়ে সে স্বাভাবিক হয়। আবার বছর ঘুরতেই তুমি আসো। আমরা সবাই সুখেই ছিলাম। আবার এটা ভেবো না মনিকাকে আমি সময় দেইনি। তাকেও যথেষ্ট সময় দিয়েছিলাম। এভাবেই তুমি আস্তে ধীরে বড় হতে লাগলে, হাঁটতে শুরু করলে, আধো আধো বুলিতে কথা বলতে শিখলে। তখন আরেক সুখবর এলো যে নতুন অতিথি মানে নাফিসা আসছে। আমরা সকলে খুব খুশি ছিলাম। কিন্তু নাফিসাকে জম্ম দিতে গিয়ে তোমার মা চিরতরে আমাদের থেকে হারিয়ে গেলো। সে যাওয়ার আগে মনিকার হাতে নাফিসা এবং তোমাকে তুলে দিয়ে গেছে। মনিকা বোনকে কথা দেয় তোমাকে আর নাফিসাকে নিজের সন্তানের মতো মানুষ করবে।
নাফিসার দিক থেকে তার কথার খেলাফ না করলেও তোমার দিক দিয়ে একটু গোলমাল করে ফেললো। নীলিমা চলে যাওয়ার পরে তিনজনকে মনিকার একা সামলাতে হবে ভেবে তোমাকে আমি সবসময় নিজের কাছে রাখতাম, গল্প করতাম, পড়াতাম ইভেন তোমার জন্যই আমি বাসায় অফিসের কাজ করেছি। আর তুমিও ছিলে বাবা ভক্ত। কিন্তু মনিকার মতে নেওয়াজের থেকে তোমায় বেশি ভালোবাসি তাই নেওয়াজকে দূরে রাখতাম। নাফিসা তখনো অনেক ছোট। এজন্যই মনিকা তোমার প্রতি কিছুটা ক্ষিপ্ত। জানো বাবা, মনিকাকে দেখে মাঝেমধ্যে ভাবি মানুষ সময়ের ব্যবধানে কতোটা বদলে যায়। অথচ আমি তার কাজ কমানোর জন্যই নিজেও এক সন্তানের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নেই। নেওয়াজ বেশিরভাগ সময় পড়াশোনা আর খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। আমার কাছে ওর যখন ইচ্ছা তখনই আসতো, আমিও আর জোর করে নিজের কাছে তাকে বসিয়ে রাখতাম না।’
নাশিদ চুপচাপ সবটা শুনলো। কোনোরূপ অভিব্যক্তি প্রকাশ না করেই নিজের ঘরে চলে গেলো। বাবা ডেথ সার্টিফিকেটার দিকে তাকিয়ে তপ্তশ্বাস ফেলে বললো,
-‘নীলিমা, তোমার ছেলেটা কতো বড় হয়েছে খেয়াল করো না? আজ তোমার সম্পর্কে সব সত্যি বলে দিয়েছি। এবার আমি একা নই, তোমার ছেলেও তোমাকে মনে করবে, মা বলে মনে মনে ডাকবে!’
নাশিদ এবার আকাশের অসংখ্য তারার মধ্যে বাচ্চাদের মতো সবচেয়ে বেশি ঝলমলে তারাটা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। সেই ঝলমলে তারার মাঝেই হয়তো তার মাকে খুঁজে পাবে এবং অনেক অনেক অভিযোগ করবে!
~চলবে।