#টক_ঝাল_মিষ্টি (পর্ব ১)
নুসরাত জাহান লিজা
বিয়ে নিয়ে মায়ের অনবরত ঘ্যানঘ্যানের সাথে যখন বাবা একাত্মতা পোষণ করলেন তখন লাবণ্যর বিস্ময়ের সীমা বোধহয় আকাশ ছাড়াল! উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরু একসাথে মিললো কী করে এটাই বোধগম্য হচ্ছে না। লাবণ্য জন্মের পর থেকে দুজনকে কোনো বিষয়ে কখনোই একমত হতে দেখেনি। একজন ডানে গেলে আরেকজনের সবসময় বাম দিকটাই পছন্দ হয়, একজন আলো, তো অন্যজন তখন আঁধারের যাত্রী। একজন পূর্নিমা হলে অন্যজন অবশ্যই ঘোর অমাবস্যা। আজ হঠাৎ আলো-আঁধারি মিলেমিশে একাকার, এটাই বিস্ময়ের কারণ। তবে প্রবল বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটা কাটতেই প্রচণ্ড রাগ হলো। এতকিছু থাকতে ওর বিয়ের ব্যাপারেই কেন বাবা-মাকে একমত হতে হবে! ধূর!
সকাল সকাল ফোন করেই মা বললেন, “তোর কোনো ভুজুংভাজুং আর শুনব না এবার। কাল বাসায় আয়, পরশু ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে তোকে।”
“মানে কী?”
“মানে হলো, বিয়ের জন্য ছেলে আর ওর পরিবার আসবে, তোকে দেখবে, কথা বলবে। পছন্দ হলে বিয়ে ফাইনাল।”
“মা, এভাবে হয় নাকি! বলা নেই কওয়া নেই হুট করে একটা ছেলে ধরে নিয়ে আসবে আর বিয়ে করতে বললেই হয়ে গেলো নাকি?”
“হবে না কেন? জগতের বেশিরভাগ বিয়ে এভাবেই হয়েছে। তুই কোনো রাজকন্যা না যে ঢাকঢোল পিটিয়ে শাহী এলান জারি করে স্বয়ম্বরের আয়োজন করব, তুই গিয়ে যাকে পছন্দ তার গলায় বরমাল্য ঝুলাবি!”
“আমি নিজেকে রাজকন্যা বলিওনি। তাই বলে আমার কোনো পছন্দ-অপছন্দ থাকবে না। মাত্র মাস্টার্স শেষ করলাম। জীবনটাই দেখলাম না ঠিক করে।”
“বিয়ে হলে তো মরে যাচ্ছিস না যে জীবন দেখতে পারবি না, অন্ধও তো হচ্ছিস না! এত পছন্দ, অপছন্দ চিন্তা করলে এতদিনে নিজেই একটা যোগ্য ছেলে পছন্দ করতি। আমরা তো না করতাম না।”
মা এবার বেশ আঁটঘাট বেঁধে পানিতে ছিপ ফেলেছে, যে কোনো মুহূর্তে বড়শিতে আটকা পড়তে হবে বুঝতে পেরে শেষ ভরসা হিসেবে বাবাকে চাইল। এতটুকু আত্মবিশ্বাস ছিল যে বাবা নিশ্চয়ই মায়ের সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন, বিয়েটাও ভেস্তে যাবে! কিন্তু বাবা ওর ভরসায় পানি ঢেলে দিয়ে বললেন,
“মা রে, এবার রাজি হয়ে যা। ছেলেটা সত্যি খুব ভালো। তোর শফিক আঙ্কেলের বোনের ছেলে। আর দেখতে এলেই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না৷ তুই কালই বাসায় চলে আয়।”
এবার প্রথম কোনো বিষয়ে এই দুজনকে একমত হতে দেখে মেজাজ খারাপ হতেও ভুলে গেল কিছুক্ষণের জন্য। এমন ঘোরতর বিস্ময়ের সাক্ষী হতে হবে এটা সে ভাবতে পারেনি। লাবণ্য জীবনে এখন অব্দি যত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদের দুজনের মধ্যে বৈপরীত্যের কারণে যেকোনো একজন সেটা অবশ্যই সাপোর্ট করেছে৷ তাই সবসময় উতরে গেছে সবকিছুতেই। এবারই প্রথম বিপত্তি বাধল।
তবে বহুকাল আগে যে তারা একই স্রোতের যাত্রী ছিলেন তার সাক্ষ্য বহন করছে ওর ‘লাবণ্য’ নামটা। লাবণ্য নামটা বেশ সুন্দর হলেও নিজের এই নামটা বহুদিন ধরেই ওর অপছন্দের তালিকায়। তার একটা বিশেষ কারণ আছে অবশ্য। ইন্টারমিডিয়েটের ক্লাস শুরু হবার পরে দেখা গেল কাকতালীয়ভাবে ওদের ব্যাচে অমিত নামের একটা ছেলেও ভর্তি হয়েছে, তাতেই গোলযোগ শুরু। সেসময় দুজনের নামকে জড়িয়ে বন্ধু-বান্ধবরা লাবণ্য’র কান, মস্তিষ্ক এবং মন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। ওই ছেলেও স্বভাবে একেবারে বাঁদর প্রজাতির হওয়ায় লাবণ্য রীতিমতো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। বাসায় এসে কেঁদে কেটে বায়না করেছিল, ওর নামটা যেন বদলে দেয়া হয়। কিন্তু বাবা-মা দুজনেই তাতে ভেটো দিয়ে বসেন। ‘শেষের কবিতা’ বইটা নাকি তাদের ভালোবাসার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল। সেজন্যই নাকি এই নামটা রাখা এবং এটা বদলানো অসম্ভব। যত উদ্ভট, যুক্তিহীন কাজ দু’জনের। এই দুইজন যে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন সেটাই লাবণ্যর কাছে অষ্টম আশ্চর্যের বিষয়!
আজ আরও বেশ কয়েকবার এই মুহূর্তে বিয়েতে অসম্মতি প্রদান করে মানানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। বাবা বুঝিয়ে বললেন,
“শোন মা, আগে আয়, কথা বল। যদি ভালো না লাগে তখন পরেরটা পরে দেখা যাবে। আর বললামই তো, দেখতে এলেই তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না।”
অগত্যা ভাঙা মনোরথে পরেরদিনের সকাল সকাল বাস ধরার উদ্দেশ্যে গোছগাছ করে রওনা দিল।
***
লাবণ্য বাসে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল, একজনের ডাকে সম্বিৎ ফিরল,
“এক্সকিউজ মি, বাসে উঠলে আমার বমি হয়। জানালার পাশের সিটটায় যদি আমাকে বসতে দিতেন?”
এমনিতেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে, এরমধ্যে এমন কথায় মেজাজের পারদ করেক ডিগ্রি চড়ল।
কপালে বিরক্তির ভাজ পড়ল, বিষ দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল,
“জানালার পাশে না বসলে আমার সাফোকেটিং লাগে।”
“ওকে, পরে কিন্তু আমাকে দোষ দেবেন না।”
লাবণ্যর এসব খুব ভালো মতো জানা আছে, জানালার পাশে বসার ধান্দা। সে পাত্তা না দিয়ে গান শোনায় মনোনিবেশ করল, সেইসাথে বিয়ে কী করে ভেস্তে দেওয়া যায় তাই ভাবতে থাকল। কিন্তু মনোযোগ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না, পাশের ছেলেটা উচ্চস্বরে ফোনে কথা বলতে শুরু করেছে। ন্যুনতম ভদ্রতা এই ছেলে জানে কিনা সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক হলো। লম্বা জার্নিটা যে মোটেও সহজ হচ্ছে না সেটা ভাবতেই মাথাটা টনটনিয়ে উঠল।
হেডফোন ভালো করে কানে গুঁজে দিয়ে আবারও বাইরে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করল লাবণ্য, কিন্তু পাশের গাধা প্রাণীটার জন্য মনোযোগ বারবারই ব্যহত হলো। অথচ প্রথম দেখে যথেষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত চেহারাই মনে হয়েছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই ধারণা ফিঁকে হতে থাকল।
“এই যে, হ্যালো..এক্সকিউজ…”
লাবণ্য চোখ খুলে তাকাতেই সে বলল, “আপনার কাছে পানি আছে?”
লাবণ্য উত্তর না দিয়ে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে এগিয়ে দিতেই বোতলে মুখ লাগিয়ে তৃপ্তি সহকারে ঢকঢক করে গিলে নিল। এরপর সেটা ফেরত দেবার সময় হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলল,
“স্যরি, স্যরি.. আমি আসলে বুঝতে পারিনি। এটা আমার কাছেই থাকুক, সামনের স্টপেজে নামলে পানি কিনে দেব আপনাকে।”
পৃথিবীর সব বিরক্তি তখন লাবণ্যের মুখে এসে ভর করেছে যেন। ভ্রু কুঁচকে একবার পূর্ণ দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল।
“আমি অনিকেত, আপনার নাম?”
“আমার নাম জেনে আপনার কোনো কাজ নেই। দয়া করে মুখটা একটু বন্ধ রাখুন প্লিজ।”
ওর কঠিন কথায় অনিকেত নামের ছেলেটার মধ্যে তেমন কোনো প্রভাব পড়ল বলে মনে হলো না। নাম নিয়ে কথা না বললেও আজকের আবহাওয়া, বাংলাদেশ সহ সারাবিশ্বের অর্থনীতি, ভূগোল, বিজ্ঞান, সাহিত্য, খেলাধূলা কোনোটাই বাদ গেল না আলোচনার বিষয়বস্তু থেকে। এটাকে অবশ্য আলোচনা না বলে বকবক বলাই ভালো। প্রায় ঘণ্টা খানেক সহ্য করার পরে কঠিন কথা বলার জন্য লাবণ্য নিজেকে প্রস্তুত করে বলল,
“আমার কী মনে হচ্ছে জানেন, একটা ভ্রাম্যমাণ রেডিও স্টেশন সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি। ব্রেক ফ্রি টেলিকাস্ট চলছে। বন্ধ করার কোনো সুইচ খুঁজে পাচ্ছি না।”
এবার কিছুটা যেন ম্লান হলো অনিকেতের মুখটা। মাথা পেছন দিকে এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করল। লাবন্য স্বস্তি পেলেও সূক্ষ্ম একটু খারাপ লাগাও কাজ করল। এভাবে কাটকাট কথা বলতে চায়নি, কিন্তু নিরুপায় হয়ে বলতেই হলো। নইলে যে কথার তুবড়ি ছুটছিল, তাতে লাবন্যর মাথা খারাপ হয়ে রাস্তায় দৌড়ানো বাকি ছিল বোধহয়!
কিছুদূর ভালোই গেল, ওদিকটাও বেশ শান্ত। কিন্তু খানিক বাদেই সবচাইতে ভয়ংকর ঘটনাটা ঘটল। অনিকেত সত্যি সত্যি হড়হড় করে বমি করে দিল। লাবণ্যকে ডিঙিয়ে জানালার দিকে মাথা নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল, পুরোপুরি সফল হওয়ার আগেই ঘটনা ঘটে গেল বলে লাবন্যের ওড়নার এক পাশেও কিছুটা লেগে গেল। গা গুলিয়ে আসতে চাইছে, ওর নিজেরও এখন বমি বমি লাগছে। অত্যন্ত কঠিন কিছু কথা মুখে এলেও কিছুই বলল না। শুধু দৃষ্টিতে আগুন ঝরিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। অনিকেতের চোখে অপরাধবোধের চিহ্ন দেখেই চুপ করে রইল। এবার তো আর বেচারার দোষ নেই।
তবে অনিকেত কিছুটা অস্থির হয়ে উঠল, লাবন্যের কাছ থেকে নেওয়া বোতল দিয়েই ওড়নায় লাগা অংশটুকু ধুয়ে দিতে এলে লাবন্য হকচকিয়ে উঠে বলল,
“আরে কী করছেন, আপনি পাগল নাকি..”
“আপনি অস্থির হবেন না, একটু হাত দিয়ে উড়নাটা ধরে এদিকে নিয়ে আসুন আমি ধুয়ে দিই।”
লাবণ্য তাই করল, ধোয়া হলেও গা গুলানো ভাবটা থেকে গেল। বাইরে থেকে বেশ চমৎকার বাতাস আসছে, ধুলোবালিও চোখে ঢুকছে। চুলগুলো ভীষণ বিরক্ত করছে বলে চুল বেঁধে নিল। আজ সূর্য বোধহয় ততটা তেতে নেই। সহনীয় গরম, বাতাসটা ভালো লাগছে বেশ। ফুরফুরে একটা ব্যাপার আছে বাতাসে। গা গুলানো ভাবটা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পেল। শুধু পাশে বসা মূর্তিমান যন্ত্রণাটা ছাড়া বাকিসব চলনসই, উপভোগ্যই বলা যায়।
***
যাত্রাবিরতি শেষে বাসে উঠে লাবণ্য এবার অনিকেতকে জানালার পাশের জায়গাটা ছেড়ে দিল। বলা তো যায় না আবার কী হয়! অনিকেত একগাল হেসে খোঁচা দিয়ে বলল,
“ঠ্যালার নাম বাবাজী।”
লাবণ্যর পক্ষে এখন আর মাথা ঠিক রাখা সম্ভব হলো না, “কী বলতে চাইলেন স্পষ্ট করে বলুন।”
“স্পষ্ট করেই তো বললাম। আপনি নিশ্চয়ই বলবেন না যে এই প্রবাদ এর আগে শোনেননি?”
“আপনি কী জানেন, আপনি একটা চূড়ান্ত ফালতু লোক? একটা অপরিচিত মেয়ের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় জানেন না!”
“আপনি কিন্তু বেশি বেশি বলছেন।”
“একদম নয়, বরং খুবই কম বলছি। আপনার মতো এটেনশন সিকারদের আমার বহুত চেনা আছে। এভাবে প্রথমে একটু ঝগড়া, তারপর স্যরি বলে বন্ধু সাজার চেষ্টা, এরপর দুই একটা পুতুপুতু কথা বলে বলবেন, ‘আপনার ফেসবুক আইডিটা দেয়া যাবে?’ নয়তো বলবেন, ‘আপনার ফোন নাম্বারটা দিন প্লিজ, বন্ধু তো হয়েই গেলাম!’ এরপর কিছুদিন কথা বলবেন, এরপর প্রপোজ করে বসবে। এসব ছ্যাবলা ছেলেদের আমি হাড়ে হাড়ে চিনি।”
একটানা এতগুলো কথা দাঁতে দাঁত চেপে বলে অনিকেতের দিকে তাকালো লাবন্য, ছেলেটার নাকের ডগা টকটকে লাল হয়ে গেছে। চোখ দুটোতে আগুন ঝরছে, কিন্তু চশমার জন্য উত্তাপটা সরাসরি লাবণ্যর গায়ে লাগছে না। নইলে অনিকেতের চোখের উত্তাপেই এতক্ষণ লাবণ্য ঝলসে যেত৷ কিন্তু লাবন্য এসব পাত্তা দেয় না। বহুক্ষণ থেকে চুপচাপ সহ্য করছে, আর কাহাতক সহ্য করা যায়!
“নিজেকে কী মনে করেন? মিস ইউনিভার্স? মিস ওয়ার্ল্ড? আপনার সাথে কথা বলার জন্য, প্রেম করার জন্য আমি মরে যাচ্ছি? জগতে মেয়ের অভাব পড়ে নাই, বুঝলেন! নেহায়েত একটা ইনসিডেন্ট ঘটেছে, তেমন বড় কিছুও নয়, যার জন্য আপনি এভাবে বলতে পারেন। আমাকে এটেনশন সিকার বললেন না, আসলে সেটা আপনার নিজের জন্যই প্রযোজ্য। যে যেমন সে দুনিয়ার সবাইকে তেমনই মনে করে।
“কী বলতে চান আপনি? প্রথম থেকে আপনার প্যানপ্যান সহ্য করতে করতে কান ঝালাপালা। ন্যুনতম ম্যানার জানেন না আবার বড় বড় কথা। আপনার সাহস কীভাবে হয় আমাকে এসব বলার?”
“ঢিল মারলে পাটকেল তো খাবেনই। দুনিয়ার সব সাহস শুধু আপনার একার সম্পত্তি, আর সবাই আপনাকে হুজুর হুজুর করবে? আসলে কি জানেন? আপনার মাথায় বিশাল গণ্ডগোল আছে। একটা সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান। ফ্রিতে এত ভালো টিপস আর কেউ দেবে না। আমি দিলাম, আমার আবার দয়ার শরীর তো, কারোর কষ্ট সহ্য করতে পারি না।”
“পায়ে পারা দিয়ে ঝগড়াটা আপনি আগে শুরু করেছেন। আসলে আমারই ভুল, বাবা ঠিকই বলে, ‘নির্বোধ আর মূর্খ লোকের সাথে তর্কে জড়াতে নেই।’ আর আপনি তো নিরেট মূর্খ। কেন যে আপনার কথার উত্তর দিতে গেলাম! আমি আসলেই গাধা।”
“যাক, তাও ভালো নিজের সম্পর্কে একটা অন্তত সত্যি কথা বলেছেন।” অনিকেতের এই কথায় লাবণ্যর মাথায় আগ্নেয়গিরি জ্বলে উঠল।
“আর একটা ফালতু কথা বললে আপনার খবর আছে!”
“কী করবেন শুনি?”
লাবণ্যর ইচ্ছে করছিল চুলের ক্লিপটা খুলে এই জ্বলজ্যান্ত বাঁদরটার চোখ গেলে দিতে। নয়তো নাক বরাবর একটা ঘুষি মেরে টকটকে নাকটা ফাটিয়ে দিতে। কিন্তু এতটা অমানবিক হতে পারল না, দু’হাতে মাথা চেপে ধরে কানে হেডফোন ভালো করে ঢুকিয়ে নিয়ে চোখ বুজল। সত্যি সত্যি মাথা ব্যথা করছে, তাই ত্যাঁদড়টা বেয়াদবি করে পার পেয়ে গেল, নইলে দেখিয়ে দিত লাবণ্য কী জিনিস!
***
লাবণ্য বাসায় এসে পৌঁছাল সন্ধ্যা নামার মুখে। বাড়িতে বেশ অতিথি সমাগম। কেমন একটা উৎসব উৎসব আমেজ বিরাজ করছে। দেখতে আসা উপলক্ষে যেটা বেশ বেমানান। কিছুটা খটকা লাগল এতে। সবার সাথে কথা বলে ভেতরে গেল। গোসল করে বেরিয়ে আসতেই দেখল, মা খাবার নিয়ে এসেছেন।
“আয় আয়, বোস। খাইয়ে দিই।”
“মা, সত্যি করে বলো তো, তোমাদের মতলবটা কী?” লাবণ্য মায়ের হাত থেকে ভাত খেতে খেতে শান্ত গলায় বলল।
“মতলব আবার কী হবে?”
“শোনো মা, আমি না বাচ্চা নই। ছেলে ভুলানো কথা বলে আমাকে ভুলাতে পারবে না।”
“এই যে মাত্রই বললি বড় হয়ে গেছিস। তাহলে বিয়েতে তোর এত আপত্তি কীসের? কয়দিন পরে বুড়ি হয়ে যাবি তো।”
লাবণ্য আর কথা বাড়ায় না, জানে লাভ নেই। মা বরাবরই এমন, সহজ কথা এমন ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে বলেন যে তর্ক করে জেতা প্রায় দুষ্কর! যদিও বাবা মাঝেমধ্যে এই অসাধ্য সাধন করেন।
লাবণ্য শুধু বলল, “মা, শোনো, তোমাদের কথা যেহেতু আমি মেনে নিচ্ছি, তাহলে আমার একটা কথা তোমাদেরকেও মানতে হবে।”
“কী কথা?”
“ছেলে পক্ষ বাসায় আসার আগে আমি নিজে কোনো রেস্টুরেন্টে আলাদা করে ছেলের সাথে কথা বলতে চাই। হাজার হোক, তার সাথে সারাজীবন আমাকে থাকতে হবে। সে কেমন হবে, আদৌ তার সাথে মানিয়ে নিতে পারব কিনা, এসব দেখতে হবে তো! নাকি এসবেও তোমাদের আপত্তি আছে?”
শায়লা কিছুক্ষণ একটা কিছু ভাবলেন, এরপর লাবণ্যর মুখে ভাত তুলে দিতে দিতে শান্ত গলায় বললেন, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি ব্যবস্থা করব। তবে কোনো বাজে অজুহাত দিতে পারবি না বলে দিলাম।”
পরেরদিন ঘুম থেকে উঠতেই লাবণ্যকে নিয়ে ঘষামাজা শুরু হলো। দেখতে যেন সুন্দর লাগে, রূপে মুগ্ধ হয়ে ছেলে যেন একেবারে লাট্টু হয়ে পিছে পিছে ঘুরে, ওর শ্যামলা রঙটা যেন সেভাবে না বোঝা যায় আরও কত কী বলতে লাগল বাড়িতে উপস্থিত আত্মীয়-স্বজনরা। লাবণ্যর অবশ্য এতে কোনো হেলদোল নেই। তবে এসব বাড়াবাড়িতে সে চরম বিরক্ত। শেষমেশ একটা লাল রঙের সালোয়ার কামিজ পরে দু’জন বন্ধুসম কাজিন তনু আর শান্তাকে সাথে নিয়ে রেস্টুরেন্টে চলে এলো।
আশেপাশে তাকিয়ে ফোন বের করে নির্দিষ্ট নাম্বারে কল করল।
“আমি চলে এসেছি, আপনি কোথায়?”
“আমি ভেতরেই আছি, আসছি..”
বলতে বলতে যে ছেলেটা সামনে এসে দাঁড়ালো, তাকে দেখে নিজের মাথা নিজের হাতে ফাটাতে ইচ্ছে করল। ওর সাথের কাজিন দুজন ইশারায় নিশ্চিত করল, এই সেই গুণধর রাজপুত্র, যার সাথে ওর বিয়ের কথা বলা হচ্ছে।
পৃথিবীতে এত্ত ছেলে থাকতে এই ত্যাঁদড়টাকেই কেন এখানে আসতে হবে! এর প্রশংসা করে পুরো একদিন ওর মাথা খাওয়া হয়েছে ভাবতেই রাগ মাথায় চড়ে বসল। অপমানটা এখনো বড্ড তাজা, গায়ে লেগে আছে! ঢিল আর পাটকেল নিয়ে লেকচার দেওয়া হয়েছিল। এবার পাটকেলের জায়গায় অনিকেতকে বোমা ছুঁড়ে মারা যায় কিনা এবং কীভাবে মারা যায় সেটাই ভাবতে লাগল লাবণ্য!
…….
(ক্রমশ)
(