#টক_ঝাল_মিষ্টি (শেষ পর্ব)
নুসরাত জাহান লিজা
অনিকেত শ্বশুরবাড়ি এসেছিল ক্ষুব্ধ স্ত্রীর মান ভাঙাতে, অথচ জ্বরে কাহিল হয়ে পড়ে আছে। যে সে জ্বর নয়, গা কাঁপানো ধুম জ্বর। জার্নি করে এসে খেয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে রাত তিনটা পেরিয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ আগে ঘুম ভেঙেছে, মাথা দপদপ করছে ব্যথায়। উঠে বসলে চোখে অন্ধকার দেখছে। শায়লা, জামান বার কয়েক এসে দেখে গেছেন। অনিকেতের ইচ্ছে না থাকা সত্বেও তার ধমকে অল্প করে খাবার খেয়ে ওষুধ পর্যন্ত খাওয়া হয়েছে, মাথায় পানিও ঢেলেছেন৷ কিন্তু যার জন্য এখানে এসেছে তার দেখা নেই।
প্রথমে নিজের ভাগ্য বিড়ম্বনায় আফসোস হলেও সহসাই তা দূর হলো। সে তো যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল, কিন্তু প্রতিপক্ষ প্রবল পরাক্রমশালী। লাবণ্য নিশ্চয়ই একজন অসুস্থ সৈনিকের সাথে যুদ্ধে নামবে না! ওর উদ্দেশ্য সহজে সফল হবে তবে। এই জ্বরকে শাপেবর মনে হলো। জ্বর এলে আর কী হয়, গায়ের তাপমাত্রা নাহয় কয়েক ডিগ্রি ফারেনহাইট বাড়লই, মাথায় নাহয় একটু ব্যথাই করুক, শরীরে একটু আধটু দুর্বলতা ভর করলই নাহয়, বিনিময়ে লাবণ্য ফিরুক ওর জীবনে!
এসব সাতপাঁচ ভাবনার মাঝেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল, সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেলল। সত্যি কথা বলতে লাবণ্যকে সে ইদানিং ভীষণ ভয় পায়! বউকে একটু-আধটু ভয় পাওয়া খারাপ কিছু নয় বোধহয়! নিজের ভাবনায় হাসি পেল, কিন্তু মুখ খিঁচে হাসিটাকে মনে আটকে রাখল, এখন ভীষণ বিপদের মুখে আছে। বলা তো যায় না ওই মেয়ের মনে কী আছে!
কপালে একটা কোমল হাতের স্পর্শ পেল। ছেলেবেলায় অসময়ে টিউটর পড়াতে আসলে যখন ঘুমের ভান করে পড়ে থাকত, আর কিছুক্ষণ পরপর চুরি করে চোখ মিটমিটিয়ে দেখার চেষ্টা করত শিক্ষক চলে গেলেন কিনা সেভাবে সে লাবণ্যকে দেখার চেষ্টা করছে।
“জ্বর বাধালে কী করে?”
অনিকেত মটকা মেরে পড়ে রইল, চোখ খুলে ঝাড়িটা এখনই হজম করে নেবে কিনা বুঝতে পারছে না। ও এই দোলাচালে যখন দুলছিল তখন আবারও শুনল,
“অনিকেত, আমি জানি তুমি জেগে আছো। চাইল্ডিশ এটিটিউড বাদ দিয়ে কথা বলো।”
ফট করে চোখ খুলে ফেলল অনিকেত, লাবণ্য কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে। সে কী জ্বর ইচ্ছে করে বাধিয়েছে নাকি। এটা কেমন প্রশ্ন! ওর হুট করে ‘আমি তো প্রেমে পড়িনি’ গানটা মাথায় ঘুরতে থাকল। বলল,
“আমি তো জ্বর বাধাইনি। জ্বর আমাকে বাঁধিয়েছে। এখন জ্বরকেই জিজ্ঞেস করো সে কী কী পদ্ধতি অবলম্বন করেছে!”
লাবণ্যর মুখের কাঠিন্য গাঢ় হলো, অনিকেত মনে মনে বলল, “মেয়েরা হবে শান্ত নদীর মতো, মন জুড়ে এক পৃথিবী মায়া বিরাজ করবে। তা না, এই মেয়ের মনে সমুদ্র নেই, আছে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি যা ভিসুভিয়াসের চাইতে ভয়ংকর।” অনিকেত কেমন ভস্ম হয়ে যায়!
“তুমি তো বাচ্চা ছেলে না অনিকেত, একটা দামড়া ছেলে ঢং করছে, ন্যাকামি করছে বিষয়টা খুবই দৃষ্টিকটু লাগে। আগেও বলেছি, আবার বলছি, বি ম্যাচ্যিয়ুর্ড।”
“তাহলে তুমি আমার সাথে ফিরবে?”
“তোমার বিশ্রাম প্রয়োজন, ঘুমাও। পরে আসব আবার।”
হুট করে অনিকেত লাবণ্যর হাত দুটো ধরে ফেলে বলল,
“লাবণ্য, তুমি তো জানো আমি গাধা, ষ্টুপিড, নির্বোধ, হাঁদারাম আরও যা আছে সব। আমি প্রতিনিয়ত ভুল করি। এবারও ভুল করে ফেলেছি। আমাকে একবার সুযোগ দেয়া যায় না?”
লাবণ্য হাতটা ছাড়িয়ে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেল। অনিকেতের এবার সত্যিই খুব ক্লান্ত লাগছে। ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।
***
লাবণ্য নিজের ঘরে এসে আবারও কাঁদল। ছেলেটা এমন কেন? চেহারার কী বেহাল দশা করেছে। বেশ কয়েকদিন ধরে গজানো অবিন্যস্ত দাঁড়ি, মুখটায় জ্বরের একটা হলদেটে আভা, কিছুটা শুকিয়েও গেছে মনে হলো, চোখের নিচে কালি গাঢ় হয়েছে। নিজের একটু যত্ন নিলে কী হয়! নাকি চালাকি করে এই সময় এসেছে, বলতে চাইছে, “দেখো, তুমি কী নিষ্ঠুর! আমাকে এই অবস্থায় ফেলে এসেছিলে।”
লাবণ্য কী ইচ্ছে করে এসেছে নাকি, নিজেই তো বলল তার স্বাধীনতা চাই, মুক্ত জীবন চাই। চোখের পানি মুছে দাঁতে দাঁত চেপে লাবণ্য অস্ফুটস্বরে অথচ দৃঢ়তার সাথে বলল,
“জ্বর গায়ে নিয়ে এখন ঢং করা হচ্ছে! ঢং ছুটাচ্ছি।”
গতকাল রাতে ঘুম হয়নি, ফজরের নামাজের পরে ঘুমিয়েছে একেবারে। তাই অনেক বেলা করে মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙেছে। মা যখন হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন,
“তুই এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস, ওদিকে ছেলেটা জ্বরে কাতরাচ্ছে! মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। কী চেহারা, কী হয়ে গেছে! তুই ওই ঘরে যা, আমি রাহেলা আপা আর শফিক ভাইকে খবর দেই।”
মা এমনভাবে তাকিয়ে কথাগুলো বললেন যে মনে হলো এই জ্বরটা বুঝি লাবণ্যর কল্যাণে হয়েছে! মায়ের উপরে রাগ হলেও অনিকেতের জন্য মন কেমন করে উঠল। কোনোমতে চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে সেখানে ছুটে গিয়েছিল। ইচ্ছে করছিল পরম মমতায় জ্বরক্লিষ্ট মুখটা ছুঁয়ে দিতে, কিন্তু এই ছেলে যে ঘুমের ভাব ধরে মটকা মেরে কাঠ হয়ে পড়ে আছে তা বোঝাই যাচ্ছে! এমন শিশুসুলভ আচরণ কেউ করে! দেখতেও কেমন আদুরে লাগছে, এই বুড়ো বাচ্চা সামলানো কঠিন হবে, ভীষণ দুষ্টু বুড়ো বাচ্চা!
জ্বর দেখার ছলে কপাল ছুঁয়ে দিল, গা পুড়ে যাবার মতো গরম। এতগুলো কথা অনিকেত শুনিয়েছিল, তারপরও এই মানুষটার জন্য এক হিমালয় মায়া কেন হচ্ছে! চোখ ভিজে আসতে চাইছে। এই যে স্যরি বলছে তাতেও বা কী করে বিশ্বাস করবে! বড্ড এলেবেলে ছেলে, তার মনটাও তেমন। আবার যদি ছেলের মনে খেয়াল চাপে, সেই খেয়ালের বসে আবারও রূঢ়ভাষী হয়ে বসে, তখন লাবণ্য কী করবে! আবারও ভেঙে পড়বে? জীবন তো এভাবে চলে না! তাই উত্তর না দেয়াই রয়ে যায়, কান্না দেখাতে চায় না বলেই চলে আসা।
***
রাহেলা আর শফিক আঙ্কেল এলেন, অনিকেত আর লাবণ্যকে নিয়ে যেতে চাইলে সুবোধ ছেলেটি হয়ে অনিকেত বলল,
“আমি এখানেই থাকব মা, লাবণ্য না গেলে আমি কোথাও যাব না।”
এহেন নির্লজ্জতায় ভীষণ রাগ হলো লাবণ্যর, শেষে সবার অনুরোধে রাহেলা দুই রাত এখানে থেকে গেলেন। অনিকেতের জ্বর কিছুটা কমতেই তিনি চলে গেলেন। যাবার আগে দুজনকে একসাথে ডেকে বলে গেলেন,
“সম্পর্ক হলো প্রকৃতির মতো, প্রকৃতিতে যেমন কখনো ঈশান কোণে মেঘ জমে, কখনো কালবৈশাখী ঝড়, তো কখনো আবার ঝকঝকে রোদ। সম্পর্কের মধ্যেও এমন অনেক মুহূর্ত আসে। প্রকৃতি যেমন করে ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হবার পরে আবার সামলে নেয়, রূপ বদলায়, তেমনি সম্পর্ককে সময় দিতে হয়ে। সময়ই আবার কিছু নড়বড়ে সুতো মজবুত করে। দৃঢ়তা দেয়। একটু ভেবে দেখিস।”
**
লাবণ্য বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা বই পড়ছিল, বাবা এসে দাঁড়ালেন।
“কী করছিস?”
“এই তো, তুমি বসো বাবা।” লাবণ্য উঠে বসল।
বাবা পাশে বসলেন, “কী ভাবলি? অনিকেতের তো ছুটি শেষ, জ্বরের জন্য বাড়তি ছুটি নিয়েছিল। কাল না গেলেই নয়।”
লাবণ্য ম্লান হেসে বলল, “বাবা, অনিকেত এত কনফিজিউজিং একটা পার্সোনালিটি যে আমার আশঙ্কা হয়।”
“মা রে, সব মানুষ যেমন আলাদা, তাদের দৃষ্টিভঙ্গীও আলাদা, ভালোবাসার ধরন আলাদা। কেউ হয়তো সারাদিন ভালোবাসি বলে, কেউ আবার বলেইনি কখনো, কিন্তু তাই বলে কী সে ভালোবাসে না? আমার আর তোর মাকে দেখ, আমরা বিয়ের পরে একটা সময়ে এসে দেখলাম আমাদের সবই আলাদা, মতের মিল হয় না। কিন্তু সবকিছুর পরেও কিন্তু আমাদের ভালোবাসার অভাব নেই। দূরে গেলে এখনো আগের মতো টান পড়ে যায়। অনিকেত কিন্তু মানুষ হিসেবে ভীষণ চমৎকার। তুই তো বলেছিস কত ভাবে জ্বালিয়েছিস ওকে। ছেলেটা বিরক্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটা বাজেভাবে প্রকাশ করেনি কখনো। হ্যাঁ, রাগের মাথায় কিছু বেঠিক কথা বলে দিয়েছে। তারজন্য সে অনুতপ্ত। ছেলেটার মুখে অনুতাপ দেখা যাচ্ছে। ওর ভালোবাসাও হরেকরকম ভালোবাসার মধ্যে এক রকম।”
বাবা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন, লাবণ্য ভাবতে বসল। তিনজন বয়ঃজ্যোষ্ঠ মানুষের কথা মাথায় ঘুরতে থাকল।
***
এই ঠান্ডায় রাতের বেলা ছাদে আসতে বলেছে অনিকেত। আগামীকাল চলে যাবে বলে খুব করে অনুরোধ করেছে একবার অন্তত আসতে।
আকাশের দিকে বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনিকেত, এমন বিমর্ষ অনিকেতকে কখনো দেখেনি লাবণ্য।
“আমি চলে যাচ্ছি লাবণ্য। তুমি কিন্তু এখনো সিদ্ধান্ত জানাওনি।”
“তোমার অবচেতন মনের যে অংশ আমাকে শত্রু মনে করে সে যদি আবার শত্রুতা করে বসে!” অনিকেতের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল লাবণ্য।
অনিকেত দিশেহারাবোধ করল, মুহিতের মাথা ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করল। এই কথাটা কেন বলেছে? ঘরের শত্রু বিভীষণ! ব্যাটাকে একবার পেলে খবর আছে!
“আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। তাই লিখে এনেছি। পড়বে?”
এমন ব্যকুলতা মিশিয়ে প্রশ্ন করল যে লাবণ্য আনমনেই হাত বাড়িয়ে দিল।
ওর হাতে দুটো কাগজ ধরিয়ে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল অনিকেত। এটা পড়ার সময় সে এখানে কিছুতেই থাকতে পারবে না!
একটা কাগজ সে চিনতে পারল, ‘সাংসারিক সমঝোতা স্মারক’। সেটাই আগে খুলল। লাবণ্যর লেখাগুলোর নিচে অনিকেতের সিগনেচার জ্বলজ্বল করছে। অপরপৃষ্ঠায় লেখা,
“আমি নিজে তো কবিতা লিখতে জানি না, তাই ‘জয় গোস্বামী’র কবিতাটা ধার করলাম।
‘পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন
এর চোখে ধাঁধা করব, ওর জল করে দেব কাদা
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু’কদম।
অশান্তি চরমে তুলব, কাক-চিল বসবে না বাড়িতে
তুমি ছুঁড়বে থালা বাটি, আমি ভাঙব কাঁচের বাসন…
মেঘে মেঘে বেলা বাড়বে, ধনে পুত্রে লক্ষ্মী লোকসান,
লোকাসান পুষিয়ে তুমি রাঁধবে মায়া প্রপন্ঞ্চ ব্যঞ্জন।’
নিজে একটা লাইন যুক্ত করি, আমার সাথে টক ঝাল মিষ্টি জীবন কাটাতে রাজি থাকলে তুমিও একটা সই করে দিও পাগলী, আমি করে দিয়েছি।”
সিগনেচারের নিচে ছোট্ট করে লাবণ্যর একটা রাগী মুখের স্কেচ আঁকা, হস্তাক্ষর যাচ্ছেতাই হলেও বেশ ভালো আঁকে তো ছেলেটা। যাক, একেবারে মাকাল ফল নয়! স্কেচের পাশে ছোট্ট অক্ষরে লেখা,
“মায়াবতী আগ্নেয়গিরি ইজ ইকুয়েল টু আমার মায়াগিরি”
লাবণ্য হেসে ফেলল, রাগ পড়ে যাচ্ছে, এত দ্রুত রাগ কেন মিলিয়ে যাচ্ছে ভাবতেই রাগের ওপরেই রাগ হলো ওর!
অন্য কাগজটা খুলল, শুনেছিল যারা ছবি আঁকে তাদের নাকি হাতের লেখা ভালো হয়, এই ছেলে কথাটা ভুল প্রমাণ করেছে। চিঠিটা পড়তে শুরু করল,
‘সম্বোধনে যদি তুমি রেগে যাও তাই সেটা ছাড়াই শুরু করলাম৷ আমার নিজের উপরে একটু বেশিই আত্মবিশ্বাস ছিল, ভাবতাম আমি বুঝি পারফেক্ট। দুই তিনবার রিলেশনশিপে জড়াতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কোনোটাই লং-টার্ম এগোয়নি। ওরাই এগিয়ে এসেছে, ওরাই আবার ছেড়ে গেছে। আমি ভাবতাম ওরা আমার জন্য নয়, আমি একটু বেশিই ইউনিক কিনা, তাই সাধারণ ওরা মানিয়ে নিতে পারেনি। এখন বুঝতে পারি নিজের অহমে আঘাত লেগেছিল বলেই বোধহয় মনে মনে ওদের তুচ্ছ করে নিজেকে বড় ভেবে আনন্দ খুঁজতাম। শুধু আমি নই, জগতের বেশিরভাগ মানুষই বোধহয় নিজের ভুলগুলো খুঁজে পায় না, বরং কেউ এসে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে তার প্রতি ক্ষুদ্ধ হয়, শত্রু ভেবে বসে। অথচ নিজের ভুল নিজের চোখে ধরা দিলে তবেই না নিজের ভেতরের আমিকে খুঁজে পাওয়া যায়। নিন্দা করতেই হোক কিংবা ভালোর জন্যই হোক যারা এসে বলে তোমার চলাফেরা ভুল, দৃষ্টিভঙ্গি ভুল, তুমি ভুল তারা কিন্তু আমার বন্ধুই। কিন্তু আমরা এভাবে ভাবতে পারি না, ভাবি নিন্দুকের নিন্দাই করতে হবে, শত্রুতা বয়ে বেড়াতে হবে।
আমিও ব্যতিক্রম নই, আমি ভীষণ তুচ্ছ এক সাধারণ মানুষ, তাই তোমাকে শত্রু ভেবে বসলাম। তুমি আমাকে ছেড়ে চলে আসার পরেই না বুঝতে পারলাম আমি কতটা ভ্রমের জগতে ছিলাম এতটা কাল। মিছে অহংবোধে অন্ধ ছিলাম, আমি নিজেকে নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেই আমার আমি স্পষ্ট হলো চোখের সামনে। নিজের ভেতরটাকে দেখে বুঝতে পারলাম এতদিন যে আমিত্ব গর্বের ছিল সেটা কতটা ভ্রান্ত! আমার দর্পচূর্ণ হলো, একেবারে ভেঙে চূরচূর!
আমি কোনো মহাপুরুষ নই, দোষে গুণে ভরা অতি সাধারণ একজন মানুষ। কিছু ভুল শুধরে নিতে চাই তোমার সহায়তায়, কিছু ভুল আজীবন বয়ে বেড়াতে চাই, তোমার ওই আগ্নেয়গিরির মতো ফুটন্ত চোখটা দেখার জন্য। কেমন করে যেন ভীষণ অপছন্দের ও-ই অভিব্যক্তিটাকেই বড্ড ভালোবেসে ফেললাম! একই ছাদের নিচে থাকতে থাকতে একটা সময় হয়তো মুগ্ধতা ফুরিয়ে যায়, আলু, পটলের দাম বাড়া কমা, কিংবা ওষুধগুলো ঠিকঠাক খাওয়া হয়েছে কিনা, ছেলে-মেয়ের স্কুলের পরীক্ষার কেমন প্রিপারেশন হলো, কোনো দুষ্টুমি করল কিনা, নানাবিধ প্রয়োজনীয় আলোচনা প্রাধান্য পেতে থেকে। কোনো এক বিশেষ মুহুর্তে হয়তো আবার সুপ্ত ভালোবাসা জেগে উঠে তার জানান দিয়ে যায়! কিন্তু আমি কোনো অনুভূতি ঢাকা পড়ুক তা চাই না। তোমার কড়া শাসনের আড়ালে লুকানো ভালোবাসাটা আমি অনুভব করতে চাই, তাই কিছু ভুল আজীবন করে যেতে চাই।
হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো আমাকে শাস্তি দিতে আমার সর্বস্ব নিয়ে চলে এলে, আমার তো এখন বাঁচা দায়। এখন আমার ঘর ভরা শূন্যতা, হৃদয় জুড়ে শূন্যতা, আমার পৃথিবী জুড়ে অসীম শূন্যতা, এই শূন্যতার ভার আমি আর বইতে পারছি না লাবণ্য, ফিরে এসো প্লিজ! আমার হৃদয় পূর্ণ হোক, আমি পরিপূর্ণ হই, তুমি আমি মিলে আমরা হই এবার।
আমি জীবনে কোনোকিছুই গুছিয়ে করতে শিখিনি, চিঠি লেখা তো আরও কঠিন। চিঠি অগোছালো বলে বিরক্ত হবে না কিন্তু, কারণ এটা শুধু চিঠি নয়, আমার একান্ত অনুভূতি, বিলাসী অভিলাষ। আমার সমস্ত হৃদয় দিয়ে তোমাকে আরেকবার আহবান করছি, ফিরো এসো।’
চিঠি পড়ে লাবণ্যর মন আর্দ্র হলো, অভিমানের শেষ পর্দাটুকুও মিলিয়ে গেল। এমন বাজে হস্তাক্ষরের বেশকিছু ভুল বানানের চিঠিটাই যে এত প্রিয় হবে ভাবতে পারেনি। এত আনন্দও বুঝি মানুষকে এভাবে কাঁদায়। চোখের জল মুছতে চেষ্টা করল না। অনিকেতকে থামাতেও গেল না। ওকে তো কতটা কষ্ট দিয়েছে, ছেলেটা নাহয় আর একটা রাত ভালোবাসার যাতনা বুঝুক।
লাবণ্য এই চিঠিটা আরও পড়বে, বহুবার পড়বে৷ শব্দগুলো হৃদয়ে গাঁথবে এরপর সমস্ত ভালোবাসাটুকু সুদ সমেত ফেরত দেবে। লাবণ্য আজ তার ভালোবাসার সমস্ত সঞ্চয় একত্রিত করবে, এরপর শুধু পাগল ছেলেটাকে সঞ্চিত ঝুলি থেকে মায়া দেবে, যেটুকু পাবে তা আবার ঝুলিতে জমাবে, কোনোদিন সেই ভালোবাসার জাদুর ঝুলি শূন্য হবে না! সৃষ্টিকর্তার কাছে এই দোয়া চাইল মনে মনে।
***
অনিকেত ভেবেছিল লাবণ্য চিঠি পড়ে একবার হলেও আসবে। কিন্তু এলো না, সারারাত আকুল হয়ে জেগে বসে রইল দরজার কড়া নাড়ার শব্দ শোনার আশায়। কিন্তু সব বৃথা গেল বুঝি৷
সকালে তৈরি হয়ে বের হলো, রাহেলা এসেছেন। জামান বা শফিক সাহেবকে কোথাও দেখা গেল না। বের হওয়ার আগে এদিক-ওদিক চাইল, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষটার দেখা পেল না। রাহেলা বললেন,
“লাবণ্য বাসায় নেই। জামান ভাই আর তোর মামা ওর সাথে গেছে।”
অনিকেতের মুখটা বিমর্ষ হলো, কী এমন অপরাধ যে মাফ পাওয়া যায় না৷ কেউ লাবণ্যকে একটু বুঝালোও না! পুরো পৃথিবীর উপরে অভিমান হলো। এই প্রথম সত্যিকারের হৃদয় ভাঙা অনুভূতি হলো। কষ্টেরা পাজর ভেঙে উঠে আসতে চাইছে। কাউকে আর কিছু বলতেও পারল না। ব্যাগ নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে এলো।
বাসস্ট্যান্ডে এসে রিকশা থেকে নামতেই দেখল শফিককে দেখল,
“মামা, তুমি এখানে এসেছো?”
“হ্যাঁ, এই নে টিকিট। ভালো থাকিস।”
অনিকেত বিদায় নিয়ে বাসে উঠে নিজের সিটে বসতে গেলে জীবনের সবচাইতে বড় চমকটা পেল। লাবণ্য দাঁড়িয়ে আছে৷ চশমা খুলে আবার চোখে দিল। লাবণ্যর কথায় সম্বিত ফিরল,
“চশমা বারবার খুললেই দৃশ্য বদলে যাবে না। এখন তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকে বসো, দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না এতক্ষণ।”
অনিকেতের বিস্ময় এখনো কাটেনি, লাবণ্যকে কী যে মিষ্টি লাগছে। শাড়ি পরেছে, চোখে কাজল দিয়েছে, একটা টিপ কপালে। চোখ সরাতে পারছে না, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে প্রাপ্তির আনন্দে। আরাধ্য প্রাপ্তির আনন্দ বুঝি এমন প্রবল হয়! বাস ছাড়ার সময় গতি জড়তার জন্য যে ঝাঁকিটা খেল তাতে লাবণ্য আর অনিকেত দুজনেই সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে গেল। লাবণ্য অনিকেতের কাঁধের শার্ট খামচে ধরে ভারসাম্য রক্ষা করল, অনিকেত সিটের সাথে হেলে পড়েছে। দুজনেই সিটে এসে বসল।
লাবণ্য কিছু একটা এগিয়ে দিল, অনিকেত হাত বাড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কী এগুলো?”
“কী মানে? তুমি আদা চেন না?” বিস্মিত গলা লাবণ্যর।
“আদা চিনব না কেন? কী হবে এটা দিয়ে?”
“চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে। যখন যখন বমি পাবে তখন তখন খাবে।”
“চা ছাড়া আর কোথাও আমি আদা খাই না।” মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করল অনিকেত।
“খাও না, কিন্তু এখন থেকে খাবে৷ হাতে বা পকেটে রেখে দাও। ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকতে বলিনি। এখন একটু মুখে দাও।”
অনিকেত একটা টুকরো মুখে দিয়ে চিবোনোর সাথে সাথে ঝাঁঝ গলা আর কানে গিয়ে লাগল। কিন্তু লাবণ্যর কাঠিন্যে পরাস্ত হয়ে মুখে নিয়ে বসে থাকল, ফেলে দেবার সাহস করল না।
অনিকেত এটা সেটা কত কী বলছে, কিন্তু এই মেয়ে একটা কথাও বলছে না৷ এভাবে এতটা পথ যাওয়া যায় নাকি! এমন আনরোমান্টিক কেন!
“আমি খুব খুশি লাবণ্য, আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝি আর ফিরবে না। কতটা খুশি…”
“এত খুশি হওয়ার প্রয়োজন নেই, তোমার মুক্ত আকাশ, বাতাস কী কী বলেছিলে সেসব তো আর হলো না। মা আমাকে বলেছে, তিনি তিনমাস পরে আসবেন। এরমধ্যে তার ছেলেকে মানুষ বানিয়ে দিতে। সেই দায়িত্ব আমি খুশিমনে পালন করব। নেহায়েত জ্বর এসেছিল বলে অল্পে রক্ষা পেয়েছো।”
অনিকেতের এবার আর রাগ হলো না, লাবণ্য যে ওর বলা কথাটা মনে রেখে দেয়নি, তাতেই খুশি। অভিব্যক্তিতে কপট ভীত ভাব ফুটিয়ে তুললেও মনে মনে সে একচোট হেসে নিল, নির্মল বাতাস টেনে নিল। প্রাণ খুলে গাইতে ইচ্ছে করল, ‘আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে।’
কিছুদুর যাবার পরে অনিকেত বমি করল, লাবণ্যর আজ রাগ হলো না, বরং অনিকেতের বুকে মাথায় হাত দিয়ে কষ্ট কমানোর চেষ্টা করতে লাগল। ইশ! কী কষ্ট হচ্ছে ছেলেটার! কেমন মায়া হলো, চাইলেও বাকিপথ আর মুখ কঠিন করে রাখতে পারল না। কিছুদূর গিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল, লাবণ্য ঘুমন্ত অনিকেতের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। ভেতরে, বাইরে একইরকম সুন্দর এই ছেলের। কবে একটা মায়ার ছোট্ট চারাগাছ জন্মেছিল মনে, সেটা এখন ডালপালা মেলে মহীরুহ।
পরিশিষ্টঃ
দুজনের টোনাটুনির সংসার ধুন্ধুমার চলছে। লাবণ্য এতদিনে এটা বুঝতে পেরেছে এই বুড়ো বাচ্চার ভেতরে একটা শিশু বাস করে। কোনো জামা-কাপড়ের খোঁজে কাবার্ডে হাত দিলে গুছানো অবস্থার দফারফা হয়ে যায়৷ এখন অনিকেতের কী প্রয়োজন তা লাবণ্য নিজেই বের করে দেয়।
এই তো সেদিন যা করলো, লাবণ্য ঘুম থেকে উঠল নাকে একটা পুড়া গন্ধ ঢুকতে, হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘরে এসে দেখল, পুরো একটা গোয়াল ঘর বানিয়ে রেখেছে অনিকেত। কড়াইতে তেলের মধ্যে ডিম আর নুডলস দিয়ে নাড়াচ্ছে, কিন্তু সেটা নিচে লেগে বাজে অবস্থা। চুলার আঁচ একদম বাড়ানো। পাশের চুলায় উঁকি দিয়ে দেখল তাতে সবজি সেদ্ধ করতে দিয়ে হয়তো ভুলে গিয়েছিল, পানি শুকিয়ে সেটা পুরো কালো হয়ে আছে। গন্ধের উৎস সেটাই। লাবণ্য চুলাটা বন্ধ করে দিল।
অনিকেত নিজের চেহারায় যতটা সম্ভব নির্দোষ ভাব ফুটিয়ে তুলে ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করল,
“আজকে তো ছুটি। ভাবলাম প্রতিদিন তুমি রান্না করো, আজ আমি একটু করি। নুডলস আমি আগেও বানিয়েছিলাম কয়বার, আজ এমন হলো কেন বুঝতে পারছি না।”
“যেটা পারো না, সেটা করতে কে বলেছে তোমাকে?”
“না, মানে, ভাবলাম তোমার যদি একটু হেল্প হয়…”
“হেল্প করতে এসে আমাকে উদ্ধার করেছেন আপনি, এখন এগুলো আমি কী ভাবে পরিষ্কার করব?” মাথায় হাত দিয়ে প্রায় কেঁদে ফেলার জোগাড় লাবণ্যের।
“আমি পরিষ্কার করে দে..”
কথা শেষ করতে পারল না, লাবণ্য হিসিয়ে উঠলো, “তুমি এই মুহূর্তে রান্নাঘর থেকে বের হও। আর একদিনও এখানে আসবে না।”
অনিকেত মুখ কালো করে বেরিয়ে গেল, তাতে লাবণ্যর কী! এত কাজ যে বাড়িয়ে দিয়ে গেল তার বেলা! তবে এমন ছোটখাটো পাগলামিগুলোতে আধপাগল ছেলেটার ভালোবাসাটুকু অনুধাবন করা যায়!
নিজের খেয়ালটাও রাখতে সেখেনি, দেখতে দেখতে গ্রীষ্ম চলে এসেছে, রাহেলা একেবারে আসলেও সেখানকার মায়া পুরোপুরি কাটাতে পারেননি, এখানে বিশ দিন থাকলে দশদিন ওখানে থাকেন। লাবণ্য অনিকেতকে অফিসে যাবার সময় ছাতা হাতে ধরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু সে বাসায় এসেছে বৃষ্টিতে ভিজে।
লাবণ্য জিজ্ঞেস করল, “তুমি না ছাতা নিয়ে গেলে, তাহলে?”
অনিকেত সহসা মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলল, “ও, হ্যাঁ, ছাতার কথা মনেই ছিল না। আমি আরও শুধু শুধু ভিজলাম।”
লাবণ্য কড়া কথা শোনাতে চেয়েও পারল না, কারণ ততক্ষণে তার হাঁচি শুরু হয়ে গেছে।
আজ এসেছে অনিকেতের এক কলিগের বিয়েতে, সস্ত্রীক দাওয়াত বলে লাবণ্যকে আসতে হয়েছে। খাওয়ার পরে হঠাৎ করে অনিকেত গায়েব, লাবণ্য আশেপাশে খুঁজল অন্য এক কলিগের সহায়তায়, শেষে দেখা গেল ছাদের এক কোণায় মাথা এলিয়ে বসে আছে, লাবণ্য এসে দেখে তার মাথা, কপাল ঘেমে একাকার।
ওকে দেখে অনিকেত বলল, “শখ করে জর্দা দিয়ে একটা পান খেয়েছিলাম। মাথাটা এমন ঘুরছে। জর্দা বোধহয় বেশি খেয়ে ফেলেছি।”
পানি খাইয়ে, হাত-মুখ ধুয়ে দিয়ে তবেই কিছুটা সুস্থির হলো।
অনিকেত একটু বেশি অপরিপক্ক, সংসার সেভাবে বোঝে না, কিন্তু কোনো আড়াল নেই, মুখোশ নেই, খোলা বইয়ের মতো স্পষ্ট! এই ছেলেকে ভালো না বেসে পারা যায়! দিন দিন এই পাগলের পাগলামির সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে কেমন গেছে! টক ঝাল মিষ্টি জীবনটা দারুণ উপাদেয়! কী অদ্ভুত এক প্রশান্তিময় জীবন!
……………
(সমাপ্ত)
(