#মেঘের_আড়ালে_বৃষ্টি
#ঊনিশ
#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা
জীবনে কখনো কখনো রক্তের সম্পর্ক ও বিছিন্ন হয়ে যায়। ইগো আর জেদের কাছে সম্পর্ক হেরে যায়। ঠিক তেমনই রোদেলার বাবা আর জেঠুর সম্পর্ক এতটা খারাপ। মায়ের পেটের ভাই হয়েও তারা আজ একে অপরের মুখ পর্যন্ত দেখে না। প্রায় ২৮ বছর হতে চলল। অথচ এক সময় দুই ভাই দুজনকে ছাড়া থাকতে পারতো না। কারণ একটাই ভালবাসা। ভালবাসার অপরাধে এক ভাই অন্য ভাই থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে।
ইগো নামক ঘুনপোকা যখন আমাদের সম্পর্কে ঢুকে যায় তা আর সুন্দর ভালবাসাময় থাকে না।
ইগোই পারে একটা সুন্দর স্বাভাবিক সম্পর্ককে নিমেষেই শেষ করে দিতে।
রোদেলা বাবা সাইফুর রহমান আর রোদেলা মা মিনু রহমান বসে আলাপ করছে রোদের জেঠুর সম্পর্কে। তাই রোদ বুঝতে পেরে চলে এসেছে সেখান থেকে। রোদ তার জেঠুকে দেখেনি কখনো। এত বড় হয়ে গেছে, কেন তিনি তাদের সাথে দেখা করেন নি তাও রোদ জানে না। জানে না তার বাকি দুই ভাইবোন। কারণ তাদের বারণ করা হয়েছে এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করতে।
কয়েক বছর আগের কথা রোদের বড় ভাই সাইফুর রহমানের কাছে জানতে চাইলেন কেন তারা তাদের জেঠু আর তার পরিবারের সাথে কথা বলতে পারেনা। কিংবা দেখা করতে পারে না।
প্রতি উত্তরে তার বাবা যে হুঙ্কার দিয়ে উঠেছিলেন তা আর কোনদিন তারা দেখেনি। ছোটবেলা থেকে সন্তানদের কাছে সাইফুর রহমান এক আদর্শ। তিনি সন্তানদের উপর কখনো কিছু চাপিয়ে দেন নি। আবার তাদের প্রতি দ্বায়িত্ব কিংবা ভালোবাসা কোনো কিছুর অভাব রাখেননি। যেখানে ধমক দিয়ে কথা বলেনি। সেখানেই আজ এমন বাঘের মত গর্জন করে উঠা উনার ছেলে মেয়ে কেউই সহজভাবে নিতে পারেননি।
সেদিন তিনি বলেছিলেন,
“তোমরা আমার সন্তান। যা তোমাদের না জানলে চলবে না তা তোমরা নিশ্চয়ই জানতে পারবে।আর যা তোমাদের এখতিয়ারের বাইরে তা নিয়ে কখনো প্রশ্ন তো দূর, একটা টু শব্দটি করবে না।”
সেদিনের পর রোদেরা তিন ভাইবোন কখনো বাবাকে কিছুই বলেননি। তবে তার বাবা আর জেঠুর মাঝে ঠিক কি হয়েছে তারা তা আজও জানে না।
একটা বিষয় আজ রোদকে খুব ভাবাচ্ছে তার বাবা আর মা যখন ড্রয়িংরুমে কথা বলছিলো একটা নাম বলেছে সেই নাম তার চেনা চেনা লাগছে মনে হচ্ছে কোথাও এর আগে সে শুনেছে। কিন্তু কোথায় মনে করতে পারছে না।
এদিকে প্রয়াস কল দিয়েছে রোদকে।
রোদ কল রিসিভ করতেই বলে,
“এই মেয়ে কল রিসিভ করতে এতোক্ষণ লাগে?”
“সরি, একটু ব্যাস্ত ছিলাম। ”
“শুনো কাল আমরা সি আর বি যাবো।”
“কী বলছেন কেন?”
“আবার আপনি?”
“ওহ সরি, আর ভুল হবে না। আচ্ছা আমি কিন্তু কোথাও যাচ্ছি না,তুমি চাইলে যেতে পারো। আমি বাসায় বলতে পারব না।”
“আরে আমরা কলেজ থেকে যাব। প্লিজ রোদ ম্যানেজ করো না।”
“আমি করতে পারব না। তুমি জানো আমি বাসায় মিথ্যা বলি না।”
“আচ্ছা তুমি শুধু বলে আসো যে কলেজে যাচ্ছো ব্যস। আমরা কলেজ ছুটি হওয়ার আগে চলে আসব। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”
“আচ্ছা দেখি বলে ফোন রেখে দিলো রোদ।”
★★★
সকাল আর সাবা বন্ধু হলেও তারা অন্যান্য বন্ধুদের চেয়ে দুজন দুজনের প্রতি অধিক নির্ভরশীল। কিন্তু সাবা তার যেকোনো বিপদে সবার আগে সকালকে কল দেয়। সারাদিনের সব কথা যেন একে অন্যকে তারা বলতে না পারলে শান্তি পায় না।
সাবার মনে সকালের জন্য সেই ছোট বেলা থেকে একটা ভালোলাগা আছে। যেটা সে কোনোদিন কাউকে বুঝতে দেয় নি। কারণ সে চায়নি,তাদের এই বন্ধুত্বে কোন কিছুর আঁচ আসুক। এমন বন্ধুত্বের জন্য এমন শতশত কথা মনের গভীরে লুকিয়ে রাখতে পারে সে।
সকাল সব সময় একটা বেখেয়ালি ছেলে। হাসি ঠাট্টা নিয়ে তার জীবন কখনো সিরিয়াস কোন প্রেম সে করেনি। মাঝে মাঝে দুই একটা সম্পর্কে জড়ায় সে। তাও আবার দুই-একদিনের মাঝে ব্রেকআপ হয়ে যায়। আর ব্রেকআপের কারণ গুলো খুব অদ্ভুত।
একদিন সে সাবাকে এসে বলে,
” দোস্ত আমার ব্রেকআপ হয়ে গেছে।”
“কী এক সপ্তাহ না হতেই ব্রেকআপ হয়ে গেছে! ক্যামনে দোস্ত! না মানে এটা ক্যামনে সম্ভব?”
“আরে দোস্ত কইস না। ওই মেয়ে আমারে কয় কী বাবু তুমি কয়টা ঘুম থেকে উঠেছো? কী খাইছো, একটা ছবি তুলে দাও? মানে আমি যাই করি তারে ছবি তুলে দিতে হবে! আজব তুই বল আমি কেন তারে সবসময় ছবি তুলে দিতে যাবো?
আরে আমি ওইদিন বাথরুমে গেছি সে আমারে কয় বাবু কি করো?
আমি কইলাম, হাগু করি।
সে আমারে কয়,
ওয়াও বাবু তুমি হাগু করতেছো? আমাকে একটা ছবি তুলে পাঠাও?
সাবা খিলখিল করে হাসছে।
“চিন্তা কর তুই সাবা। এটা মেয়ে না চিড়িয়াখানা? মানে এরা ক্যামনে পারে এসব বলতে বল? আমি হাগু করছি এটা নাকি ওয়াও। চিন্তা কর একবার কি লেবেলের নেকা মাইয়া। অসহ্য লাগে আমার।
তাই সাথে সাথে ব্রেকআপ করে দিছি। এভাবে আসলে হয়না দোস্ত। ”
এ-ই হলো সকালের অবস্থা। আরেকটি তো তিনদিন ও টিকেনি। মেয়েটা নাকি দাত ব্রাশ করে আসে না। কথা বলতে গেলেই কি যে দুর্গন্ধ আসে। তাই তার সাথে ব্রেকআপ। সকাল এসে বলে, ” এই মেয়ের সাথে কথা বলা তো দূর। আমি বিয়ের পর কিস করতে গেলেই বমি আসবে দোস্ত।”
সেদিন সাবা শুধু হেসেই কাটিয়েছে। এই ছেলে এমন কেন? কিসব কথা বলে উফ!”
তারপরেটা আরও আজব, যেমন এই নাকি সম্পর্কের দুদিনের মাথায় বলে,
“ক্যান আই কিস ইউ?”
এইটা শুনে সকাল দেয় এক দৌঁড়, বাপের জন্মে শুনেনাই কোনো মেয়ে প্রেম শুরুর দু’দিনের মাথায় এমন একটা অদ্ভুত কথা বলবে।
সাবা এসব ভাবছে আর হাসছে।
সাবার মা এসেছেন তার রুমে।
“কিরে মা কি করছিস?”
“কই মা কিছু না,তুমি কিছু বলবে?”
“কেন কিছু না বললে বুঝি আসতে পারি না?”
“কেন পারবে না মা? আসো বোসো মা।”
” জানিস রাকিব কাল দেশে ফিরছে।”
“কী বলছো মা! রাকিব ভাইয়া দেশে ফিরছে? এত খুব খুশীর খবর মা। এতোদিন পর ভাইয়াকে দেখব। আমার খুব ভাল লাগছে মা।”
“রাকিব দেশে আসছে বিয়ে করবে তাই।”
“কী বলো মা এটাতো ডাবল খুশীর খবর।” সাবা খুশি হয়ে বলল।
তার মা ইতস্তত হয়ে বললেন, “মা রে তোর খালা খালু আর আমরা চাই তুই আর রাকিব বিয়ে করিস। তোকে বিয়ে করবে বলে রাকিব দেশে আসছে।”
সাবা খুব অবাক হয়।
“কী বলছো এসব আমার বিয়ে আর আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করোনি তোমরা? আমার বিয়ে হবে আমার মতামত নিতে পারতে।”
“সাবা আমরা ভাবছি তোরা ছোট থেকে দুজন- দুজনকে পছন্দ করিস,তাই কিছু বলিনি তোকে।”
“মা ছোট বেলায় কাজিনদের সাথে খেলা আর বড় হয়ে বিয়ে করে নেয়া এক না।”
“তোর অন্যকোথাও পছন্দ থাকলে বল? আমরা সেখানে তোর বিয়ে দিবো।”
এবার সাবা একটু থামলো এতক্ষণ যে রাগ হচ্ছিল তা একটু কমলো।
“আচ্ছা মা আমাকে কয়েকটা দিন সময় দাও। আমি ভেবে দেখছি।”
“আচ্ছা মা তুই ভেবে দেখ। রাকিব খুব বেশী সময় নিয়ে আসছে না।”
“আচ্ছা মা ঠিক আছে।”
★★★
রোদ প্রয়াস বসে আছে সি এন জি তে।
রোদের একটু অস্বস্তি হচ্ছে একা প্রয়াসের সাথে সিন এন জি তে বসে থাকতে। এই প্রথম কোনোছেলের সাথে একা বসে আছে রোদ।
“নার্ভাস লাগছে রোদ?”
“নাতো।”
“লাগছে আমি জানি।”
“তুমি আগে থেকে আমার সব বুঝে যাও কিভাবে বলোতো?”
“আমি তোমার মন পড়তে পারি তাই।
বলেই মুচকি হাসে প্রয়াস।”
রোদ বলে,
” ঠিক আছে। তাহলে এখন বলুনতো আমার মনে কঈ আছে?”
“এখন তোমার মনে আছে, প্রয়াস, প্রয়াস আর প্রয়াস।”
রোদ চমকে গেল! সত্যিই তো তাই। কিন্তু সে তা মুখে স্বীকার করল না।
“আচ্ছা স্বীকার করতে হবে না। তুমি এভাবে আমাকে মনে রাখলেই হবে।”
“ইশ, আমার বয়েই গেছে আপনাকে মনে রাখতে।”
প্রয়াস বলে,
“উফ! এভাবে ইশ বলবে নাতো, আমি মরেই যাবো।”
” ইশ বললে মরে যাবেন এটা কেমন কথা?”
“এই আবার আপনি শুরু করছো? তুমি যখন ইশ বলো,মানে তোমার ইশ বলার ভঙ্গিটা জাস্ট ওয়াও।আমার খুব আকর্ষণীয় লাগে। এই কথাটা।”
রোদ লজ্জা পেল। প্রয়াস আলতো করে রোদের হাত ধরে।
রোদ একটু কেপে উঠে এই হঠাৎ স্পর্শে।
এক অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করে তার মনে।
ভালবাসা এক অদ্ভুত অনুভূতি, যখন আসে তখন খুব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়কেও মনের গভীরে ভীষণভাবে নাড়া দেয়।শান্তি দেয়। এই শান্তি আর কোথাও পাওয়া যায় না। যে শান্তি ভালবাসা কিংবা প্রেমের শুরুতে তা আর কোথাও নেই। তখন মনে হয় ভালবাসাই জীবন, জীবনই ভালবাসা।
চলবে,