#মেঘের_আড়ালে_বৃষ্টি
#ঊনত্রিশ
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা
রোদ প্রয়াসের দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকে। সে আসলে বুঝে উঠতে পারছে না তার সাথে কি হচ্ছে। রিমি প্রয়াসের গা ঘেষে দাঁড়ায় প্রয়াসের তাতে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। রোদ খুব অবাক হয়। যে প্রয়াস রোদ ছাড়া অন্য মেয়েদের স্পর্শে আসতে পারতো না। সে আজ রোদেরই সামনে একটা মেয়ের গা ঘেষে দাড়িয়ে আছে!
রিমি প্রয়াসের আরও কাছে যায়। এবার রোদ রিমিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় প্রয়াসের কাছ থেকে। রোদের চোখে মুখে অগ্নিভাব। রাগে তেজে এমন অবস্থা এর আগে কখনো রোদের হয়নি। যা আজ হয়েছে।
হয়তো ভালবাসার মানুষকে অন্যের হতে দেখলে এমনই লাগে। সহজ সরল মেয়েটা ও তখন রাগী তেজি হয়ে ওঠে।
রিমি পড়ে যায় মাটিতে। রোদ এতোটা জোরে ধাক্কা দেয়নি যে এভাবে পড়ে যেতে পারে। কিন্তু রিমি মনে হচ্ছে ইচ্ছে করে পড়ে গেছে।
প্রয়াস রোদের এমন কান্ডে রেগে যায়। বলে, “আমার সামনে আমার কাজিনকে ফেলে দিয়েছো। তোমার সাহস তো কম নয়? স্যরি বলো রোদ রিমিকে!”
রোদের রাগে শরীর কাঁপছে। সে প্রয়াসের কথায় কান না দিয়ে বলে, “এই মেয়ে এতো রাতে তোমার রুমে কি করে? বলো কি করে?”
প্রয়াস নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুই বলছে না।
রোদ এবার প্রয়াসের দুহাতে ধাক্কা দেয় বলে, “কি হলো বলো?”
প্রয়াস এবার রেগে যায়। নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে রোদের গালে থাপ্পর বসিয়ে দেয়। রোদ গাল ধরে বসে যায়।
অবাক হয় খুব অবাক হয়। আজ যেন অবাক হওয়ারই দিবস!
প্রয়াস এবার বলা শুরু করে, “আমি রিমিকে বিয়ে করছি। ভাবছিলাম তোমার কাল বিয়ে তাই তোমার বিয়ের পর বলবো কিন্তু না তুমি যা শুরু করেছো বলতেই হচ্ছে। আমাদের বিয়ে রোদেলা। আমি রিমিকে বিয়ে করছি।”
রোদ থমকায়! অবাক হয়! খুব বেশী অবাক হয়!
পুরো পৃথিবীকে ঠুনকো মনে হয়। প্রয়াসকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু..!
রোদের এতোক্ষনের নিশব্দে বয়ে যাওয়া চোখের পানি মুছে আবার দাঁড়ায়।
প্রয়াসকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুমি আমার সাথে মজা করছো। এভাবে তুমি মজা করতে পারো না। তুমি শুধু আমাকে ভালবাসো। শুধু আমাকে।”
কথাগুলো রোদ একদম পাগলের মত আওড়ায় বারবার। বুকের ভেতর বয়ে যায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বড় ঝড়গুলো।
প্রয়াস আবার রোদকে দূরে ঠেলে দেয়। রিমিকে এক হাত দিয়ে বুকের ডান পাশে এনে বলে, “আমার উপর অধিকার শুধু রিমির আর কারো না। তোমার ও না। এই কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও।”
সেদিন রোদের মাথায় কথাটি ঢুকে ঠিকই তারচেয়ে বেশি ঢুকে মনে।
রোদ মাটিতে বসে কাঁদে অনেক্ষন কাঁদে। তারপর মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
পরেরদিন সকালে জেগে দেখে রোদ তার নিজের রুমে আছে। রাতের ঘটনা মনে হতেই রোদের মনের যন্ত্রনা তীব্রভাবে আঘাত করে।
এমন সময় রিফাত ঘরে ঢুকে বলে, “আমি তোকে কাল বাসায় নিয়ে এসেছি। কেউ জানেনা তুই পালিয়ে গিয়েছিলি। আর জানবে ও না চিন্তা করিস না বোন। রাতে তোর বিয়ে। আর কান্না করবি না।”
কেউ জানেনা শুনে রোদের মন থেকে অনেক বড় পাথর নেমে যায়।
রিফাতকে বলে, “ভাইয়া আমার ফ্লাইটের আর দুইদিন বাকি তাই না?”
“হুম, কেন?”
“আব্বু কই?”
“আছে।”
রোদ রিফাতের কাছে থেকে উঠে বাবার রুমে যায়। দেখা যায় আল মাহমুদ সাহেব বসে কি যেন লিখছে।
রোদ বলে, “আসবো আব্বু?”
একবার চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বলেন আয় মা ভেতরে আয়।
রোদ বাবার ফ্লোরে বসে বাবার পায়ের উপর মাথা রাখে।
আল মাহমুদ সাহেব চমকে যান। উৎকন্ঠা হয়ে বলেন, “কি হয়েছে মা?”
রোদ চুপ থাকে কিছুক্ষন তারপর বলে, “আব্বু আমি বিয়েটা যদি না করি তুমি কি রাগ করবে?”
আল মাহমুদ চমকায়, অবাক হওয়ার সুরে বলেন, “মা রাতে বিয়ে এখন না বললে হয়?”
রোদ কান্নায় ভেঙে পড়ে বলে, “আব্বু প্লিজ আমি পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করতে চাই। আর তোমার পছন্দমত পাত্রকেই করবো। প্লিজ আপাতত তুমি বিয়েটা বন্ধ করো। আমি এখন একদম প্রস্তুত নই বিয়ের জন্য। আর তুমি তো জানো আইন নিয়ে পড়ার কত ইচ্ছে আমার। আমি যে সুযোগ পেয়েছি তা কাজে লাগাতে চাই। প্লিজ আব্বু তুমি আমাকে সাহায্য করো।”
আল মাহমুদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, “তুই রাতুলকেই বিয়ে করবি বললে। তোর বড় আব্বুর সাথে কথা বলে দেখতে পারি। আর রাতুল ও যাবে তোর সাথে। থাকবে আলাদা।”
“আচ্ছা আব্বু।” রোদের চোখে মুখে খুশী ঝিলিক দিয়ে উঠে।
এমন অবস্থায় বিয়ে করলে সে কখনো ভালো থাকতে পারতো না। তাই সময় নিয়ে নিলো। চারবছর পর কি হয় কে জানে। তখন দেখে নিবে।
সেদিন রোদের বিয়েটা হয় না। চারবছর পর হবে বলে।
রোদ সেই দুইদিন মরার কেঁদে কাটিয়েছে। আসার দিন সন্ধ্যায় তার ফ্লাইট ছিলো। সকালে বড় আব্বুদের বাসায় যায় সে। সবার সাথে দেখা করতে। আসল উদ্দেশ্যে ছিলো প্রয়াসের সাথে দেখা করা।
রোদকে দেখে তার বড় আম্মু জড়িয়ে আদর করেন। কাঁদেন ও বলেন, “কতগুলো বছর আর তোকে দেখতে পারবো না রে মা।”
পর্দার আড়ালে কেউ একজন রোদকে দেখছে রোদ সেটা খেয়াল করেনি।রোদের চোখ মুখ ফোলা। যে কেউ দেখলে বুঝতে পারবে। কতটা কেঁদেছে সে।
একদিনে যেন ভেঙে গেছে রোদ। চেহারায় কষ্টের চাপ স্পষ্ট।
রোদ বলে, “প্রয়াস ভাইয়া কোথায় বড় আম্মু?”
“প্রয়াস রুমে আছে, যা দেখা করে আয়। এর মধ্যে আমি তোর জন্য কিছু করি খেতে।”
রোদ একটু একটু করে আসে প্রয়াসের রুমে। এসে দেখে প্রয়াস ঘুমিয়ে আছে। শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে দেখে রাগ হয় রোদের। আবার ঘুমভরা প্রয়াসের মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হয় খুব।
“ভালবাসা বেহেয়া খুব! ভালবাসার মানুষ যত কষ্টই দিক তার জন্য মায়া হয়। খুব মায়া হয়!”
রোদ সাইড টেবিলের উপর রাখা প্রয়াসের ছবি হাতে নিয়ে কয়েক বা হাত বুলায় ছবিতে। তারপর প্রয়াসের দিকে তাকায়। প্রয়াসের ছবিতে ঠোঁট চুইয়ে দেয়।
পরম শান্তিতে চোখ বুজে ছবি বুকে নিয়ে ভাবে মানুষটাকে না পেলো। ছবিটা তো নিজের করতেই পারে তাই না? ছবিটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়।
রোদের হাতের সাথে লেগে টেবিলে থাকা গ্লাস পড়ে যায়।প্রয়াসের ঘুম ভেঙে যায়। রোদকে দেখে খুব অবাক হয়।
প্রয়াস বলে,”তুমি এখানে?”
রোদ বাঁকা হেসে বলে, হ্যাঁ আমি এখানে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি এখানে এসেছি বড় আম্মুকে বলতে। সন্ধ্যায় ফ্লাইট তাই।
“এটা সবাই জানে বলার কি আছে?”
রোদ বলে, “তোমার রিমিকে তো দেখছি না প্রয়াস ভাইয়া? রাতে ঘুমাই নি তোমার সাথে। উপসস তোমরা তো এখনো বিয়ে করো নি তাই হয়তো রাতে থেকে ভোর হতেই অন্য রুমে চলে গেছে।”
প্রয়াস চুপ করে আছে।
রোদ একটু থেমে আবার বলে, “জানো আমি তোমায় মন থেকে ভালবেসেছি তাই আমি তোমাকে ছেড়ে দিলাম। শুধু তাই না। চলে যাচ্ছি অনেক দূরে যেখানে তুমি চাইলেও আমাকে দেখতে পারবে না। আর ডিস্টার্ব করবে না কেউ।
আমি একটা সুখের স্বপ্ন দেখেছিলাম। যে স্বপ্নে শুধু তুমি ছিলে। যে স্বপ্নের প্রতিটা অক্ষর তোমায় ঘিরে। যার চারপাশে ছিলো আলো আর আলো।
আজ মনে হচ্ছে আমার সেই স্বপ্নটা জোর করে ধরে রাখা জোনাকির আলোর মত। রাতের আঁধারে জোনাকির আলো যেমন অল্প কিছু সময়ের জন্য থাকে ঠিক তেমনই।
জোনাকি গুলোকে যদি ধরে একটা জারে ঢুকিয়ে রাখি। একটু ভূলেই হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে যায়। আর জোনাকি গুলো উড়ে যায়। তারপর আবার সেই অন্ধকার। আমার জীবনের স্বপ্নটা ও এমনই। সেই উড়ে যাওয়া জোনাকি। হাত ফসকে জার ভেঙে যা উড়ে চলে গেছে।
আমি তোমার চোখে আমার জন্য সত্যিকারের ভালবাসা দেখেছি। কিন্তু জানিনা কেন তুমি এমন করলে?
আমি তোমাকে শেষবেলায় কোন অভিযোগ করবো না। আমি মনে করি প্রত্যেকটা মানুষের উচিত ব্রেকাআপের সময় ঠিক তেমন আচরণ করা যেমনটা সম্পর্কের শুরুতে করে।
যতই কষ্ট হোক যাতে খারাপ ব্যবহার না করে। অন্তত এমন একটা জায়গা রাখে দুজনের মাঝে যে কখনো দেখা হলে। অন্তত কেমন আছে এই কথাটা জিজ্ঞেস করতে পারে। যে সম্পর্ক হবে না তা তো খারাপ ব্যবহার করে তিক্ততা বাড়িয়ে লাভ কি?
তারচেয়ে একযুগ পরেও দেখা হলে দুজন হেসে একটু কথা বলতে পারে। যাতে দুজন দুজনকে দেখে মুখ ফিরিয়ে না নেয়।”
প্রয়াস বলে, বিয়েটা করো নি কেন?”
“এটা জেনে কি করবে। তারচেয়ে নিজের বিয়ের কথা ভাবো কাজে দিবে। আর হ্যাঁ তোমার বউ খুব ভাগ্যবতী হবে।”
প্রয়াস হালকা হাসে। সেই হাসিতে কিছু একটা ছিলো যেটা রোদ বুঝতে পারে নি।
রোদ বলে, “তুমি খুব সুখী হও এই দোয়া করবো যেখানেই থাকি। যতদুর থাকি।”
“আবার আসবে কবে?”
রোদ ঠোঁট কামড়ে হাসে। উপেক্ষার হাসি! উপহাসের হাসি!! অপমানের হাসি!!
কিন্তু কোন উত্তর দেয় না।
বেরিয়ে আসতে গেলে প্রয়াস পিছু ডাকে। রোদের বুকের ধুকপুকানি শব্দটা বেড়ে যায়। তবে কি প্রয়াস রোদকে আবার কাছে টেনে নেবে তাই ডাকছে।রোদের মনে খুশীর ঝিলিক মারে।
হেসে পেছনে তাকায়।
প্রয়াস নরম হেসে বলে, “ভালো থেকো রোদ। খুব ভালো থেকো।”
রোদের মুখ মুহুর্তেই অন্ধকার ভর করে। কান্না ধলা পাকিয়ে গলায় আটকে যায়।প্রয়াসের সামনে কাঁদা যাবে না। তাই দ্রুত স্থান ত্যাগ করে।
রোদ যদি পেছনে তাকাতো তাহলে হয়তো দেখতে পেতো দুটি অশ্রুশিক্ত চোখ।
প্রয়াসের মা পিছু ডাকে, “কিরে খেয়ে নে।”
রোদ না ফিরেই বলে, “আব্বু কল দিয়েছে অনেক গোছানো বাকি। বেঁচে থাকলে আবার খাবো আম্মু।”
রোদের লাস্ট কথাটা রাহেলা বেগম থমকায়। আম্মু বলছে রোদ। পরে আবার ভাবে হয়তো ভুল করে বলেছে।
রোদ রাস্তায় হাটছে এক বুক কষ্ট নিয়ে আজ দেশ ছাড়তে হবে। প্রয়াসের বদলে যাওয়া মেনে নিতে পারছে না মন। হাতের উল্টো পিঠে বারবার চোখ মুছে। কিন্তু অবাধ্য অশ্রু বাধা মানে না। বারবার ঝরে পড়ে।
প্লেনে বসে আছে রোদ, বুকের ভেতরটায় অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে। একে তো সবাইকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে। তার উপর প্রয়াসের বিরহ সব মিলিয়ে শেষ করে দিচ্ছে মেয়েটাকে। এটুকু মেয়ে এতো কষ্ট কিভাবে সহ্য করবে?
কিভাবে এতো কষ্ট চেপে পড়াশোনা করবে আবার একা সব সামলাতে হবে।
জীবন আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। আমাদের নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যায়। আজ রোদেরও অভিজ্ঞতা হলো। এক আকাশ অভিমান নিয়ে নিজের দেশ ছাড়া কত কষ্টের সে শুধু ভুক্তভোগীই জানে।
আসার সময় সবাই এয়ারপোর্টে এসেছিলো।
বাবা মুখ লুকিয়ে কেঁদেছে। ভেবেছে মেয়ে বোঝেনি। বাবারা এমন কেন? সবসময় সব অনুভুতি লুকিয়ে জেন রাখে?
কিছু অনুভূতি প্রকাশ করলে কি হয়?
আর মাকে তো কেউ ধরে রাখতে পারছিলো না। শুধু কাঁদছে আর বলেছে, “আমার এইটুকু মেয়ে একা থাকবে কি করে?”
ভাইয়া আর মেঘার কথা বাদই দিলাম।
রিফাত ভাইয়া জড়িয়ে ধরে একটা কথাই বলেছে, “তুই অনেক জেদি আমি জানি। তুই অনেক দুর্বল আমি জানি। আবার প্রয়োজনে তুই অনেক কঠোর হওয়ার ক্ষমতা রাখিস সেটা ও আমি জানি।
আমি জানি তুই অনেক বড় হবি। আমাদের সবাইকে তোর নামে চিনবে।
ভালো থাকিস বোন। নিজের খেয়াল রাখিস।
তোর জন্য না হোক। আমাদের জন্য। তুই জানিস তুই আমাদের কাছে কি।”
রোদ কাঁদছে খুব কাঁদছে। যে কান্না গভীর সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মত। কেউ শুনতে পায় না। কিন্তু বয়ে যায় গভীরভাবে।
আজ থেকে রোদের এক নতুন পথচলা শুরু। যেখানে কেউ থাকবে না। কেউ না!
চলবে…