গল্প: #দুর্বোধ্য_ইন্দ্রজাল
লেখিকা:#স্বর্ণা_সাহা_রাত
||পর্ব ৩||
তন্দ্রা গাড়ি চালাচ্ছে আর ভাবছে,
‘তখন যদি আঁধার আসল রূপে আসার সাথে সাথে আঁধারের গাড়িটা ওখান থেকে অদৃশ্য না হয়ে যেত তাহলে হয়তো বুঝতামই না, আমার গাড়ি নষ্ট হওয়া, সময়ের হেরফের হওয়া এই সবকিছুই আঁধারের মায়া, ওর ইন্দ্রজাল!কিন্তু ভাগ্যিস ওর গাড়ি অদৃশ্য হওয়া আমার চোখে পড়েছিলে নাহলে সব শেষ হয়ে যেত, সবকিছু শেষ হয়ে যেত!থ্যাংক গড আমার কিচ্ছু হয়নি।’
তন্দ্রা গাড়ি নিয়ে সরাসরি ওর বেস্ট ফ্রেন্ডের বাড়িতে চলে আসে, যেহেতু তন্দ্রার বাড়িতে কেউ নেই, সেক্ষেত্রে তন্দ্রার সেখানে একা থাকা নিরাপদ নয়, যদিও এর আগেও তন্দ্রা নিজের বাড়িতে একা থেকেছে কিন্তু আজকের বিষয়টা একেবারেই ভিন্ন!
তন্দ্রা ওর বেস্ট ফ্রেন্ড অর্থীর দরজায় কলিংবেল দিতে শুরু করে। এখন বাজে রাত ৪.৪৫!এসময় অর্থীসহ ওর বাড়ির লোক ঘুমোচ্ছে, তন্দ্রা নিজের ফোন বের করে অর্থীকে ফোন করে, অর্থী প্রথবার ফোন ধরেনা, দ্বিতীয়বার ফোন দিতেই অর্থী ফোন রিসিভ করে ঘুম ঘুম চোখে অনেক রকমের প্রশ্ন আরম্ভ করে,
‘কিরে এই সময় ফোন দিলি তুই, কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?’
‘ সব বলছি, আগে তোদের বাড়ির গেট খোল। আমি তোদের বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে আছি, তুই ফাস্ট আয়, খুব বিপদে পড়েছি আমি।’
তন্দ্রার কথা শুনে অর্থীর ঘুম উড়ে যায়, ও বলে ওঠে
‘কি বলছিস? দাঁড়া এক্ষুনি আসছি আমি।’
অর্থী তাড়াতাড়ি করে বিছানা থেকে নেমে ওদের মেইন গেটে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে তন্দ্রাকে দেখে বললো,
‘কি হয়েছে তোর, এভাবে এইসময় এখানে আসলি যে? ফোনে বললি তুই বিপদে পড়েছিস, কি বিপদ?’
তন্দ্রা ভীত চোখে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বললো,
‘সব বলছি, আগে ভেতরে চল। এখানে থাকা মোটেও সেফ না, ও যখন-তখন এখানে চলে আসতে পারে।’
‘কে যখন তখন চলে আসতে পারে?’
‘সব বলছি তুই আগে ভেতরে চল না, প্লিজ!’
‘আচ্ছা আচ্ছা আয়।’
তন্দ্রা ভেতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলো, তারপর বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। অর্থী তন্দ্রার এরকম অবস্থা দেখে জিজ্ঞাসা করলো,
‘এভাবে ভয় পাচ্ছিস কেনো তুই? বল না কি হয়েছে? তোর এ….’
অর্থীর কথা শেষ না হতেই ওর চোখ যায় তন্দ্রার হাতে থাকা ছুরির দিকে, অর্থী বলে ওঠে,
‘তন্দ্রা, তোর হাতে ছুরি কেনো?’
‘বলছি!’
তন্দ্রা সব কথা অর্থীকে খুলে বললো। অর্থী তন্দ্রার সব কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো। তন্দ্রা আবারও বললো,
‘আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিনা লোকটা আমার পেছনে কেনো পড়লো, আর আমি নাকি ওর ভালোবাসা, ও নাকি আমাকে ভালোবাসে আর আমিও নাকি ওকে ভালোবাসি কিন্তু আমি তো লোকটাকে চিনিনা, কখনো দেখেছি বলেও মনে পড়ছেনা তাহলে লোকটা আমার পিছু নিয়েছে কেনো?’
তন্দ্রার কথা শেষ হতেই বাইরে একটা বিকট আওয়াজ হয়, তন্দ্রা আর অর্থী জানালা দিয়ে দেখে আঁধার ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। তন্দ্রা আঁধারকে দেখে ভয় পেয়ে যায়, ভীত কণ্ঠে বলে ওঠে,
‘ও আবার আমার পিছু নিয়েছে, আমার পিছু নিতে নিতে এই অবধি এসে পৌঁছেছে। ও যদি ভেতরে ঢুকে আসে তাহলে কি হবে?’
অর্থী তন্দ্রার হাত ধরে ওকে আশ্বাস দিয়ে বলে,
‘চিন্তা করিস না, কিচ্ছু হবেনা। ও ভেতরে ঢুকতে পারবেনা, শত চেষ্টা করলেও পারবেনা।’
অর্থীর কথা শুনে তন্দ্রা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অর্থীর দিকে তাকায় আর বলে,
‘কি বলছিস, ও অনেক শক্তিশালী!যেকোনো মুহূর্তে ও এখানে ঢুকে যাবে, এখানেও আমার নিস্তার নেই।’
‘বলছি না ও ঢুকতে পারবেনা, আমাদের বাড়ি বন্ধ করা আছে, কোনো ভুত-প্রেত-পিশাচ চাইলেও এ বাড়িতে ঢুকতে পারবেনা।’
‘সত্যি বলছিস?’
‘হুম!বিশ্বাস নাহলে তুই দেখ, আঁধার অনেক্ষন ধরে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে কি, পারছেনা।’
‘হ্যাঁ তাইতো!’
‘আমার দাদু নিজে মন্ত্র পড়ে এই বাড়ি বন্ধ করে দিয়েছে, এতো সহজ না এই বাড়িতে ঢোকা।’
‘তোর দাদু?’
‘হুম আমার দাদু, আমার মা’র বাবা। উনি বিশাল বড়ো একজন তান্ত্রিক, যেকোনো কিছু করতে পারেন উনি।’
‘আগে তো কখনো শুনিনি!’
‘তো আজকে শুনে নিলি তো! আচ্ছা আন্টি আংকেল জানে তোর এসব কথা?’
‘না, তারা কিছু জানেনা। তাদেরকে ফোন করা হয়নি।’
‘এসব বলবি না ওদের?’
‘বলতে তো হবেই, কিন্তু এই সময় যদি বলি তাহলে তো চিন্তা করবে।’
‘অন্তত পৌঁছানোর খবর তো দিবি নাকি?’
‘এই সময়?’
‘হুম আগে ওনাদেরকে ফোন কর।’
তন্দ্রা ওর মাকে ফোন করলো,
‘আমি পৌঁছে গেছি, আজকে রাতটা আমি বাড়িতে ফিরবো না, আজকে আমি অর্থীদের বাড়িতে থাকবো।’
‘হঠাৎ? তোর তো বাড়িতে ফেরার প্ল্যান ছিলো, অর্থীদের বাড়িতে যাওয়ার তো কথা ছিলো না?’
তন্দ্রা খানিকটা চিৎকার করে বলে উঠলো,
‘এতো প্রশ্ন করার কি আছে? মানুষের প্ল্যানে কি চেঞ্জ আসতে পারেনা নাকি? আমি অর্থীদের বাড়ি থেকেই কাল অফিস যাবো, খুশি?’
‘এতো রেগে যাচ্ছিস কেনো? সোজাসাপ্টা একটা প্রশ্নই তো জিজ্ঞাসা করেছি, এতো রিয়াক্ট করার কি আছে?’
‘জানিনা, যাই হোক আমি ঠিক আছি, আমাকে নিয়ে কোনো টেনশন করোনা, এখন রাখছি।’
‘হুম!’
তন্দ্রা ফোনে কথা বলার পর ধপ করে সোফায় বসে পড়লো। অর্থী তন্দ্রাকে দেখে বললো,
‘অযথা আন্টির ওপর তুই রেগে গেলি, আন্টি তো যেটা জানে সেটায় বলেছে।’
‘আমার মাথা ঠিক নেই, আমি ইচ্ছা করে এরকম ব্যবহার করিনি, হয়ে গেছে।’
‘বুঝতে পেরেছি তোর মনের অবস্থা মোটেও ভালো না, কিন্তু আন্টি তো আর এসব জানেনা তাইনা? তোর এভাবে বলা ঠিক হয়নি।’
তন্দ্রা কিছুক্ষন চুপচাপ থেকে বললো,
‘আচ্ছা অর্থী একটা কথা বলবো?’
‘হ্যাঁ বল!’
‘তোর দাদু আমাকে এই ইন্দ্রজাল থেকে বের করতে পারবে? আমাকে এই সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারবে?’
অর্থী তন্দ্রাকে আশ্বাস দিয়ে বলে,
‘আমি কথা বলবো দাদুর সাথে তোর ব্যাপারে, সকাল হলেই কথা বলবো।’
‘তাহলে সকাল হলে তোর দাদুবাড়ির জন্য আমরা বেড়িয়ে যাই?’
‘সকালে? দাদুবাড়ি যাবো?’
‘তোর যদি অসুবিধা থাকে, তাহলে তোর যেতে হবেনা আমাকে শুধু ঠিকানা দিয়ে দিস আর তোর দাদুর সাথে একটু কথা বলিয়ে দিস তাহলেই হবে। কিরে এটুকু করে দিবি রে?’
‘ধুর, কি যে বলিস না তুই, পারবো না কেনো? কিন্তু তোকে আমার দাদুবাড়িতে যেতে হবেনা।’
‘কেনো?’
‘আমার দাদু পরশুদিনই আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে, উনি এখানেই আছে তাই তোকে আর কষ্ট করতে হবে না।’
‘সব ঠিক হয়ে যাবে তো অর্থী?’
‘চিন্তা করিস না, আমার দাদু যখন আছে তখন সব ঠিক হতে বাধ্য।’
‘অনেক উপকার করলি তুই আমার।’
‘এখন চল, একটু ঘুমিয়ে নে নয়তো শরীর খারাপ করবে।’
‘কিন্তু আঁধার?’
‘তুই নিশ্চিন্তে থাক, আঁধার কেনো আঁধারের বাবাও এইখানে ঢুকতে পারবেনা।’
অর্থী তন্দ্রাকে নিয়ে নিজের রুমে গেলো। তন্দ্রাকে ঘুমাতে বললে তন্দ্রা ঘুমোতে অস্বীকার করে বলে,
‘আজকে আর ঘুম আসবেনা আমার, যতদিন না এই টেনশন থেকে মুক্তি পাবো ততদিন শান্তিতে ঘুমোতে পারবোনা, গত তিন সপ্তাহ যাবৎ আমার সাথে এসব ঘটছে, আজকে তো পুরোপুরিভাবে সব দেখলাম, এসবের কারণটা আমাকে খুব তাড়াতাড়ি জানতে হবে।’
সকালে,
অর্থীর পরিবারের সবাই ডাইনিং টেবিলে তন্দ্রাকে দেখে এটাসেটা জিজ্ঞাসা করে, তন্দ্রাকে সবাই আগে থেকেই চেনে। তন্দ্রার মা বলে ওঠে,
‘কখন এসেছো তুমি আমরা তো জানিইনা।’
অর্থী তন্দ্রাকে কিছু বলতে না নিজেই বলে,
‘মা আসলে ও আমাকে সারপ্রাইস দিয়েছে তাই কেউ জানেনা।’
ব্রেকফাস্ট শেষ করে অর্থী আর তন্দ্রা অর্থীর দাদুর ঘরে আসে। অর্থী ওর দাদুকে বলে,
‘দাদু একটা সমস্যায় পড়ে গেছে আমার বান্ধবী, খুব গুরুতর সমস্যা। তুমিই এখন ওর শেষ ভরসা। ওকে তুমি সাহায্য করো।’
চলবে…!