দুর্বোধ্য ইন্দ্রজাল পর্ব -০২

গল্প: #দুর্বোধ্য_ইন্দ্রজাল
লেখিকা:#স্বর্ণা_সাহা_রাত
||পর্ব ২||

বর্তমানে,
তন্দ্রা আর আঁধার চুপচাপ বসে আছে। তন্দ্রার হঠাৎ করে মনে পড়লো সেই শেয়ালের মৃতদেহর কথা। তন্দ্রা পাশে তাকাতেই দেখে সেই মৃতদেহটা ওখানে আর নেই!তন্দ্রার এবার ভয় হতে শুরু করে, মনের মধ্যে নানা ধরণের চিন্তা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। ও মনে মনে ভাবতে শুরু করলো,
‘আশ্চর্য বিষয়!এসব হচ্ছেটা কি আমার সাথে? এরকম কান্ডকারখানা আগে তো কোনোদিন হয়নি, আচ্ছা জায়গাটা কি ভালো না?’

আঁধার তন্দ্রাকে এরকম চুপচাপ দেখে বলে ওঠে,
‘চুপ করে আছেন যে, কিছুই তো বলছেন না।’

‘কি বলবো? আসলে বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘আচ্ছা আপনি বলছিলেন না, আপনাকে কে একজন সারাক্ষণ অনুসরণ করে, আপনি যখন ঘুমিয়ে থাকেন তখন আপনার দিকে তাকিয়ে থাকে?’

কথাটা শুনতেই তন্দ্রা একটা ঘোরে চলে গেলো, আনমনে বলে উঠলো,
‘হুম!’

‘তো কিভাবে সিউর হলেন যে আপনাকে কেউ অনুসরণ করে, তখন তো আপনি বলতে গিয়েও থেমে গেলেন।’

তন্দ্রা ঘোরের মধ্যে থেকেই বলা শুরু করলো,
‘আমার একদিন মনে হলো ঘুমের মধ্যে কেউ আমাকে দেখছে, খুব নিখুঁতভাবে! ঠিক তখনি আমার ঘুমটা ভেঙে গেলো, চোখ খুলতেই দেখি আমার সামনে কেউ নেই, বলে রাখা ভালো আমি আমার ঘরে একা থাকি!সেদিন মনে করেছিলাম হয়তো আমার মনের ভুল কিন্তু তারপর থেকেই আমার মনে হতে শুরু করে কেউ আমাকে সর্বক্ষন অনুসরণ করছে, আমার কাছাকাছি আছে। আমাকে দেখছে, সেদিন থেকে ঘুমোলেও অনুভব করতাম কেউ আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। সে আমার আশেপাশে থাকলে আমি এক ঘোরের মধ্যে চলে যাই, আমার মধ্যে এক প্রকার অস্বস্তি কাজ করে।’

‘আচ্ছা আপনি তো আমাকে চেনেন না, তবুও নির্দ্বিধায় আমাকে সব কথা বলে দিচ্ছেন?’

‘জানিনা, কেনো যেনো আপনাকে খুব চেনা মনে হচ্ছে, তাইতো সব আপনা-আপনিই মুখ থেকে বেড়িয়ে আসছে। তবে একটা কথা কি জানেন আমি যখন একা থাকি ঠিক তখন তখনি সে আমার আশেপাশে ঘুর ঘুর করে। ঠিক সেই কারণেই আমি ইদানিং সবসময় জনসমক্ষে থাকতে চেষ্টা করি, যদিও সব সময় সেটা সম্ভব হয়না কিন্তু আমি চেষ্টা করি।’

তন্দ্রার কথা শুনে আঁধার দুলতে দুলতে রাগান্বিত ভারী কণ্ঠে বলে ওঠে,
‘তুমি এটা মোটেও ঠিক করোনা তন্দ্রা, তুমি এটা মোটেও ঠিক করোনা।’

তন্দ্রা আঁধারের এরকম কণ্ঠস্বর শুনে তন্দ্রা আঁধারের দিকে তাকালো, তন্দ্রার ঘোর যেনো কেটে গেলো। আঁধারকে ওরকম এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে দুলতে দেখে তন্দ্রা ঘাবড়ে গেলো, আর বললো,
‘কি হয়েছে আঁধার আপনি এরকম করছেন কেনো?’

কথাটা বলেই আঁধারের ঘাড়ে হাত দিয়ে তন্দ্রা চমকে ওঠে, চট জলদি নিজের হাত সরিয়ে নেয়। বরফের মতো ঠান্ডা শরীর। মনে হচ্ছে বরফের বাক্স থেকে ওকে বের করা হয়েছে। তবুও নিজের দ্বিধা কাটাতে আঁধারের হাতে হাত রাখলো, হাত ছুঁয়ে দিয়েই তন্দ্রা ঘাবড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়ালো, এ যেনো কোনো মৃতদেহের মতো ঠান্ডা দেহ। তন্দ্রা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলো,
‘ক কে আপনি?’

আঁধার সেই একভাবে দুলতে দুলতেই বলে উঠলো,
‘আপনার সেই অদৃশ্য মানব দেখতে কেমন ছিলো তন্দ্রা?’

তন্দ্রা কাঁপা কাঁপা গলাতেই উত্তর দিলো,
‘তার মাথায় একটা কাটা দাগ আছে, আমি শুধু সেটাই দেখেছি এর বেশি কিছু দেখিনি।’

‘কাটা দাগটাকি এরকম তন্দ্রা?’

কথাটা বলেই আঁধার পেছনে ঘুরতেই তন্দ্রা চিৎকার করে ওঠে, কি ভয়ঙ্কর রূপ! আঁধারের চোখজোড়া থেকে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে, রক্তাক্ত ঠোঁটজোড়া, দেহের বাপাশটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন। তন্দ্রা খেয়াল করে আঁধারের মাথায় সেই অদৃশ্য লোকের মতো একই দাগ, যার থেকে তর তর করে তাজা রক্ত বের হচ্ছে। আঁধার এই রূপে আসতেই আঁধারের রূপের সাথে সাথে তার গাড়িটাও অদৃশ্য হয়ে গেলো।

তন্দ্রার আর বুঝতে বাকি থাকেনা আঁধার কোনো মানুষ নয়। তন্দ্রা ভয়ে কাঁপতে শুরু করে, আর ভাবতে থাকে এখন কি করবে ও? তন্দ্রা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে,
‘ক কে আ আপ আপনি?’

আঁধার হাসতে হাসতে বলে ওঠে,
‘এতো সহজে ভুলে গেলে আমায়, এই তুমি আমায় ভালোবাসতে তন্দ্রা?’

তন্দ্রা আঁধারের কথা শুনে ঘাবড়ে যায়,
‘কি যা-তা বলছেন আপনি? আপনি কে? আমি আপনাকে চিনি না, আর আপনি তো মানুষ নন আমি কেনো আপনাকে ভালোবাসতে যাবো?’

তন্দ্রা কথা বলতে থাকে আর আস্তে আস্তে পেছনে যেতে থাকে। আঁধার তন্দ্রার কথা শুনে রেগে যায় আর চিৎকার করে বলে ওঠে,
‘এখন আমায় চেনো না তাইনা? আগেরবার তো খুব বলেছিলে তুমি আমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবেনা তাহলে এখন কি হলো? মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে সেদিনকে আমায়?’

‘আমি সত্যি আপনার কোনো কথাই বুঝতে পারছিনা।’

‘বুঝতে হবেনা তোমায়, তুমি শুধু আমার হবে এটাই আসল কথা, কিন্তু তার জন্য যে তোমাকে মরতে হবে তন্দ্রা, তুমি নিজের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও তন্দ্রা, তুমি আজকেই আমার হবে। আমার এতো বছরের প্রতীক্ষার ফল পাবো আমি আজকে, আমার ভালোবাসাকে আজকে আমি নিজের করে পাবো ফাইনালি আজকে তুমি আমার হবে, শুধু আমার!’

কথাটা বলে আঁধার তন্দ্রার কাছাকাছি আসতে শুরু করে, আঁধার যত এগোতে থাকে তন্দ্রা ততই পেছনে যেতে থাকে। তন্দ্রার বুঁকের মধ্যে শুধু ধুকপুক করছে, এভাবে কোনো পিশাচের সম্মুখীন হবে, সেটা ও ভাবতেও পারেনি। ওর মনের মধ্যে শুধু এখন একটাই চিন্তা ঘুরছে, নিজেকে বাঁচাতে হবে, যে করেই হোক নিজেকে বাঁচাতে হবে, তার জন্য যা করতে হয় তন্দ্রা করবে।

তন্দ্রা ধীরে ধীরে নিজের গাড়ির কাছে আসে, তারপর নিজের ব্যাগ থেকে লোহার ছুরি বের করে আঁধারের দিকে তাক করে ওর সামনে ধরে। তারপর চিৎকার করে বলে,
‘খবরদার আমার দিকে এগোবেন না, আমি জানি আপনারা লোহা দেখে ভয় পান, আমার কাছে আসলে কিন্তু আমি আপনার গায়ে এটা ছুঁড়ে দেবো আঁধার। তাই খবরদার আমার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করবেন না।’

তন্দ্রা আঁধারের সাথে কথা বলতে বলতে মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে থাকে।
লোহার ছুরি দেখতেই আঁধার যেখানে ছিলো সেখানেই দাঁড়িয়ে যায়, আর সাথে তন্দ্রার মুখে সৃষ্টিকর্তার নাম শুনেও ভয় পেয়ে যায়। আঁধার তন্দ্রাকে বলতে শুরু করে,
‘দেখো ওটা নিচে ফেলে দাও তন্দ্রা, আমাকে এসব দেখিয়ে কোনো লাভ হবে না কিন্তু। আমি তোমাকে ঠিকই ধরে নেবো।’

‘আপনি সেটা পারবেন না, কারণ তার আগেই আমি এখান থেকে বেরিয়ে যাবো।’

‘এতোই সহজ নাকি তন্দ্রা, আমার বিছানো ইন্দ্রজাল থেকে বের হওয়া কি এতোই সহজ? আমি বেরোতে দিলে তো তুমি বেরোবে!’

তন্দ্রা আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে ওঠে,
‘আপনার এই ইন্দ্রজাল থেকে বেরোতে পারবো কি-না জানিনা কিন্তু আজকে এখান থেকে তো আমি বেরোবোই এটা নিয়ে আপনি নিশ্চিত থাকুন।’

তন্দ্রা আঁধারের দিকে ছুরি তাক করেই কথাগুলো বলতে থাকে, কিন্তু এভাবে কতক্ষন থাকা যায়, হাতেও তো এর প্রভাব পড়ছে!তন্দ্রা গাড়ির দরজা খুলতে শুরু করলো। আঁধার তন্দ্রাকে গাড়ির দরজা খুলতে দেখে বললো,
‘গাড়ির দরজা খুলে কোনো লাভ নেই, তোমার গাড়িও তো নষ্ট!’

তন্দ্রা আঁধারের কথা শুনে বাঁকা হাসলো, তারপর গাড়ির দরজা এক টানে খুলে বলে উঠলো,
‘তোর এই মায়াজাল আমি বুঝে গেছি, সৃষ্টিকর্তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে উনি আমাকে বুঝদান করেছে।’

কথাটা বলেই তন্দ্রা গাড়িতে ঢুকে গাড়ি স্টার্ট দিলো, আর নিজের হাতেই ছুরিটা রেখে দিলো, আর এবার গাড়ি ঠিকঠাক মতোই স্টার্ট হয়েছে। তন্দ্রা একটানে গাড়ি নিয়ে ওই জঙ্গল পার হয়ে যেতে শুরু করলো, আর মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নাম নিতে থাকলো। পেছন থেকে আঁধার বলতে থাকে,
‘আজকে বেঁচে গেলে জন্য যে প্রতিদিন বেঁচে যাবে সেটা হবেনা, আমি তোমাকে ধরেই নেবো তন্দ্রা। তুমি প্রস্তুত থাকো।’

গাড়ি চালাতে চালাতে তন্দ্রা বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস নিতে থাকে। আর মনে মনে ভাবে,
‘ভাগ্যিস, সেদিনের কথাটা মনে পড়েছিলে নাহলে আজকে যে আমার কি হতো, আমি নিজেই জানিনা। ভাগ্যিস আগেরবার গ্রামে গিয়ে অশরীরীরা লোহা দেখে ভয় পায় এটা শুনেছিলাম নাহলে যে কি হতো আমার সাথে! সেদিন ব্যাপারটা হেসেই উড়ে দিয়েছিলাম কিন্তু উপায়টা যে আমার এভাবে কাজে লেগে যাবে সেটা বুঝিনি।’

চলবে…!

সবাইকে হ্যাপি নিউ ইয়ার ❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here