মন মহুয়ায় শূন্যতা পর্ব-০৯+১০

#মন_মহুয়ায়_শূণ্যতা
#পর্বঃ৯
#Tasfiya Nur

‘মাগো, কোমড় গেলো।এভাবে কেউ বিছানায় ফেলে আজব?সমস্যা কি আপনার?’

সন্ধ্যায় আরমানের জন্য গরম গরম ভাপা পিঠা নিয়ে ঘরে আসে জান্নাত।কাল সকালে আরমান ঢাকায় ফিরে যাবে।সেজন্য বাড়িতে পিঠাপুলির ধুম লেগেছে। সেই পিঠা নিয়ে রুমে আসে জান্নাত। আরমান প্রয়োজনীয় সব জিনিস ব্যাগে ভরছিলো বলে ব্যস্ত সে।জান্নাত পিঠা রেখে চলে যেতে নিলে জান্নাতের হাত ধরে খাটে ফেলে দেয় আরমান।তখনই জান্নাত উক্ত কথাটি বলে। আরমান জান্নাতের কথা উপেক্ষা করে ঠোট কামড়ে জান্নাতের উপর ঝুকে তার দিকে তাকায়।জান্নাত অবাক হয়ে আরমানের কর্মকান্ড দেখে যাচ্ছে।আরমান জান্নাতের দুই হাতে হাত দিয়ে বন্দী করে নিয়ে চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে,

‘এত পালাই পালাই করো কেন জান?কাল তো চলে যাবো মা তো তোমাকে নিজের কাছে কিছুদিন রেখে তারপর ঢাকা যেতে দিবে।তো বরের সাথে সময় না কাটিয়ে পুরো বাড়ি এমন আরশোলার মতো উড়ে কেনো বেড়াচ্ছো, বলোতো?

‘ছেলেরা এত আজগুবি কথা কিভাবে বলুন তো?আমি তো জানি ছেলেরা গম্ভীর হয়।কিন্তু আপনি তার পুরো উল্টো।বিয়ের পর থেকে শুরু করছেন।ভাঙা রেডিও-র মতো বেজেই যাচ্ছেন।এভাবে ধরছেন কেনো? জানেন তো আমার রাগ বেশি।তোর্ষা আপা বলেনি আপনাকে?ছাড়ুন বাইরে যাবো।’

আরমান জান্নাতের উত্তরে আরও কিছুটা ওর দিকে ঝুকে বলে উঠে,

‘সময় চেয়েছো, নাও সময়,সমস্যা নেই। কিন্তু ফ্রি হওয়ার চেষ্টা করো।নয়তো সম্পর্কটা সেই জড়িয়ে ধরা অব্দিই থেকে যাবে।বাচ্চা পয়দা করতে হবেনা।আমার মা আমার মাথা নষ্ট করবে নাতী-নাতনীর জন্য। তাই যত তাড়াতাড়ি ফ্রি হতে পারবে ততই ভালো।নয়তো পরে জোড় করে কাছে গেলে তোমার চোখে আমার জন্য সম্মান থাকবেনা।কিন্তু আমাকেও তো বুঝার চেষ্টা করো।আমি তো পুরুষ মানুষ বলো।সামনে জলজ্যান্ত বৈধ স্ত্রী অথচ তাকে জড়িয়ে ধরা ছাড়া কিছুই করতে পারিনা।এই জীবন খড়ের গাদায় গা ভাসিয়ে চুলকানি সৃষ্টি করার মতো হয়ে গেলো বলো!’

জান্নাত আরমানের কথা শুনে হাসবে না কাদবে ভেবে পেলোনা।রাগ উঠে যাচ্ছে তার।এমনিতেই তার রাগ আকাশচুম্বি।কিছু হলেই ঘরের মধ্যে জিনিস ভেঙে গুড়ো না করতে পারলে শান্তি হয়না।সেখানে আরমান ওকে শুরু থেকে রাগ তুলিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু আরমানের কথা গুলোও ফেলে দেওয়ার মতো না।এটা ভেবেই জান্নাত নিজের রাগ দমন করার চেষ্টা করে।আরমান অপলক জান্নাতের রাগী চেহারা দেখছে।তার বউকে রাগলে ভালোয় লাগে।মুচকি হাসে আরমান।কপালে চুমু খায় টুক করে।কপালে আরমানের ছোয়া পেয়ে চোখ বন্ধ করে নেয় জান্নাত।আরমান বন্ধ চোখের পাতাতেও চুমু দেয়।জান্নাতের উপর থেকে সরে গিয়ে জান্নাতকেই বুকে টেনে নেয়।জান্নাত মোচড়ামুচড়ি করে প্রথমে।কিন্তু সম্পর্কটাকে আগানোর কথা ভেবে থেমে যায়।নিজেই আরও একটু সেঁধিয়ে যায় আরমানের বুকে।লোকটা মন্দ নয় মোটেও।একজন পারফেক্ট স্বামী হবে তার।সম্পর্কটাকে সুযোগ দিলে সুন্দর একটা পরিবার হয়ে যাবে তারা।জান্নাত এসব ভেবেই মৃদু হাসিতে মেতে উঠে।আরমান জান্নাতের সাড়া পেয়ে আরও একটু শক্ত করে ধরে জান্নাতকে।
কিছুটা সময় এভাবে যেতেই উঠানে শিখার ভাই সাইফের ডাকে জান্নাতকে ছেড়ে উঠে দাড়ায় আরমান।জান্নাত বিছানায় উঠে বসে।আরমান ওকে বলে উঠে,

‘তুমি বাইরে যাবেনা আমি আসছি।’

কথাটা বলেই আরমান বাইরে চলে যায়।জান্নাত গাল ফুলিয়ে বেড সাইড টেবিল থেকে পিঠা নিয়ে খেতে থাকে।তার শ্বাশুড়ির হাতে জাদু আছে।পিঠা গুলো বেশ লাগছে খেতে।খাচ্ছে আর গাল ফুলিয়ে এসব ভাবছে জান্নাত।তখনই মহুয়া পানির গ্লাস আর কিছু কাটা ফল ট্রে-তে সাজিয়ে রুমে ঢুকে।জান্নাত মহুয়াকে দেখে খাওয়া বন্ধ করে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে।মহুয়া জান্নাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।তারপর আস্তে আস্তে বলে,

‘আপু কাল আরমান ভাইয়া যাওয়ার সময় আম্মাকে বলবা তোমার কিছু জিনিস কিনতে হবে।তাই তুমি আরমান ভাইয়ার সাথেই বেরুবে।ভাইয়া গাড়িতে উঠবে তুমি মার্কেটে যাবে।সাথে করে আমায় নিবে।কাল রাতে যা বলতে পারিনি, কাল তা মার্কেটের নাম করে কোনো একটা রেস্টুরেন্টে বসে বলবো।কারণ বাড়িতে আমাদের দুজনকে একসাথে কথা বলতে দেখলে সন্দেহ করবে সবাই।হয়তো ভাববে সংসার ভাঙার বুদ্ধি দিচ্ছি আমি।তাই কথা বলতে নাও দিতে পারে সেভাবে।কাল আমিও আব্বার সাথে দেখা করতে যাবো বলে বেরুবো। তারপর আমাদের বাজারে গিয়ে একত্রিত হয়ে শহরে যাবো।মনে থাকে যেনো হ্যা।সাইফ ভাইয়া আসবে হয়তো ঘরে।তাই রেখে গেলাম এগুলো দিয়ে দিও।বাইরে সবাই কাজে ব্যস্ত, রিঠি তো যায়নি এখনও, রাহাদ ভাইও আছে।ভয়টা ওদের নিয়েই বেশি।তাই যেমনে পারো বের হইও।দাদী আর আম্মা পারছেনা সব সামলাতে। আসছি।’

জান্নাত গালে হাত দিয়ে বসে মহুয়ার কথা শুনছিলো।মহুয়া কথাগুলো বলেই হনহনিয়ে চলে।যায়।এগুলো কি বলে গেলো মহুয়া।রাহাদকে।কিসের ভয় তার।সব আউলিয়েযাচ্ছে কেনো।জান্নাত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে কালকে রাতের কথা ভেবে। কাল রাতেই মহুয়া জান্নাতকে হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে কথা বলতে গেলে আরমান হাজির হয় দরজা খোলা পেয়ে।তারপর জোড় করেই জান্নাতকে রুমে নিয়ে আসে।মূলত আরমানও চায়না মহুয়ার সাথে জান্নাত কথা বলুক।সেজন্য আরমান একপ্রকার রাগারাগি করে জান্নাতকে মহুয়ার পাশে দেখে।রাতে একদফা তর্কাতর্কি করে রাতটা পার করেছে জান্নাত আর আরমান।রুমে সাইফ আর আরমান একসাথে ঢুকলে জান্নাত বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ায়।ভাসুর সম্পর্কিত সাইফকে দেখে মাথায় আঁচল টেনে ঘোমটা টেনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।আরমান দেখেও কিছু বলে না।সাইফের সামনে ফলের ট্রে রেখে ভাপা পিঠা নিয়ে বসে দুভাই মিলে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পরে।

💖💖
পুরো চব্বিশ ঘন্টা পার হয়ে গেছে আরফাজকে খুজে পাওয়া যাচ্ছেনা।কিন্তু এসব ব্যাপারে কোনো হেলদোল নেই শিখার।স্ত্রীর এই ছন্নছাড়া ভাবটা ভালো লাগছেনা রিহানের।রাতের খাবার ডাইনিং টেবিলে দিচ্ছিলো শিখা।তখনই রিহান এসে শিখার হাতটা চেপে ধরে রুমে আনে।তারপর দরজা ভেজিয়ে দিয়ে এসে শিখার মুখোমুখি দাড়ায়।শিখা শীতল চাহনীতে স্বামীর দিকে তাকায়।স্বামীর এহেন কাজেও তার হেলদোল নেই।রিহান চরম অবাক তার স্ত্রীর এরুপ শান্ত ব্যবহারে।অথচ সেই ছিলো আরফাজকে নিয়ে যথেষ্ট যত্নশীল অথচ আরফাজ বাসায় না থাকা সত্বেও তার কোনো চিন্তা নেই।রিহানের শিখার এই শান্ত ব্যবহার মেনে নিতে পারলোনা।কিছুটা ঝাঁজালো শাসানি স্বরে শিখাকে জিগাসা করে,

‘সমস্যা কি তোমার?ভাই নিখোঁজ, তুমি এত শান্ত।আমার মনের মধ্যে যে ঝড় বইছে তা বুঝতে পারছোনা তুমি।তোমরা ভাইবোন এত কেনো পেইন দিচ্ছো বলোতো?’

শিখা তখনও নির্বাক।রিহানের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে ওয়ারড্রবের উপর থেকে চার্জার থেকে ফোনটা খুলে এনে কিছু একটা বের করে।তারপর রিহানের হাতে তা ধরিয়ে দিয়ে বাইরে চলে যায়।রিহান হতবিহ্বল হয়ে সেখানেই দাড়িয়ে থাকে।তারপর ফোনের স্কিনে তাকায়।সেখানে জ্বলজ্বল করে শো আরফাজের নাম্বার থেকে আসা টেক্সট মেসেজ। তাতে লিখা,”আমি দেশের বাইরে চলে গেলাম।সরি তোদের না জানিয়ে চলে যাচ্ছি,কিন্তু কি করবো শিখার জোরাজুরিতে দেখা যেত বাসায় ফিরতে হতো আমায়।কিন্তু আমি মহুয়ার মুখোমুখি হতে চাইনা আর।তোদের জানালে আমায় যেতে দিতিনা। তাই জানালাম না।ভালো থাকিস,পারলে ক্ষমা করিস।”
মেসেজটা পড়ে রিহানও থম মেরে যায়।আরফাজ এই কাজ কিভাবে করলো মাথায় ঢুকছেনা তার।আদৌও সত্যি এটা!আরফাজ তাদের না জানিয়ে চলে গেলো!মানতে কষ্ট হচ্ছে রিহানের।শতহোক প্রাণের বন্ধু বলে কথা।রিহান এতক্ষণে শিখার চুপ থাকার ব্যাপারটা বুঝতে পারে।কাল রাতে তার নাইট শিফট ছিলো তাই জানতে পারেনি আরফাজ বাসায় নেই।পরে সকালে বাসায় এসে শিখাকে পায়নি।তাি জিগাস্যা করা হয়নি আরফাজ কোথায়।শিখা বাসা আসে সন্ধ্যায়।তারপর থেকে সে রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকায় তখনও কিছু বলতে পারেনি রিহান।পরে বাবুকে নিয়ে বসার পর থেকে আরফাজের কথা জিগাসা করে শিখা এড়িয়ে গেছে।এজন্য শিখার উপর বড্ড রাগ লাগছিলো রিহানের।কিন্তু এতক্ষণে যখন জানলো সে নিজেও থমকে গেছে। আরফাজ ওর এতটাই ভালো বন্ধু যে তার ছন্নছাড়া জীবন মেনে নিতেও দম আটকে আসতে ধরে রিহানের।সে তো ভালো আছে, কিন্তু যে ভালো থাকার মানুষটার সাথে তাকে এক করেছে তার জীবনটা এমন কেনো হলো!ভেবে পেলোনা রিহান।শিখার ডাকে ভাবনাচিন্তা রেখে খেতে যায় ডাইনিং এ।

🥰🥰
খাটের মাঝে পায়ের ভিতর মাথা গুজে বসে আছে আরফাজ।হাত দুটো পিছনে বাধা।মুখে কাপড় দিয়ে বাধা ছিলো তা খুলে দিয়েছে মেয়েটা সকালে এসে।কিন্তু তাকে আটকে রেখে কার কি লাভ চিন্তা করেও খুজে পেলোনা আরফাজ।রাহাদের সাথে তসর ঝামেলা মিটে গেছে সেই দুবছর আগেই, তবে সেই বিষয় নিয়ে এতদিনে কেনো জল ঘাটাঘাটি। আরফাজ একমনে যখন এসব ভাবছিলো তখনই আবারও সেই মেয়েটা হাজির হয়।খাবার সময় হলে তার দেখা পাওয়া যায় শুধু।আসে খাইয়ে চলে যায়।কিডন্যাপই যখন করেছে সেখানে আদর করার কি প্রয়োজন।মেরে দিলেই তো হয়।মুক্তি পাওয়া যায় তবে।আরফাজ মাথা তুলে তাকিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে এসব ভাবছিলো।হঠাৎই পুরে গুদাম ঘরটায় লাইটের আলো ঝলমল করে উঠলো। এতক্ষণ হালকা ঝাপসা আলোর লাইট জ্বলছিলো, হঠাৎ এত ঝলমলে আলোয় চোখ বন্ধ করে নেয় আরফাজ।মেয়েটা হেসে উঠে স্বশব্দে।আরফাজ চোখ তুলে তাকিয়ে আলোটা চোখ সওয়া করে নেয়।মেয়েটা আজ তেমন কথা বলেনা।চুপচাপ খাইয়ে দেয়।আরফাজ খেয়ে নেয় এই ভেবে তার শরীরে শক্তি প্রয়োজন এসব থেকে বেরুতে গেলে।মেয়েটা সব শেষ করে চলে যেতে ধরলে আরফাজ ধীর স্বরে বলে উঠে,

‘ এভাবে ভীতুদের মতো আড়ালে থেকে কেনো আঘাত দিচ্ছো।পারলে মুখোশ খুলে সামনে এসে আঘাত দাও। জানোয় তো মানুষের আসল রুপে করা আঘাতটা গভীর হয়।কারণ মানুষ যত চেনা তার দেওয়া সামান্য আঘাতও অনেক গভীর।’

‘আঘাত সইতে পারবে তো আরফাজ?’

আরফাজের কথায় মেয়েটির উত্তর শুনে আরফাজ জোড়ে হাসে।তারপর হাসতে হাসতেই উত্তর দেয়,

‘ভালোবাসার মানুষের মুখে মরণের কথা শুনে সহ্য করতে পারলে তোমার আঘাতটাও সহ্য করতে পারবো।তোমাকে চেনা চেনা লাগে জানো।কিন্তু মুখটা না দেখে সিওর হতে পারছিনা।একরকম গঠনের অনেক মানুষই তো থাকে বলো।’

মেয়েটা মৃদু স্বরে হাসে।আরফাজের কথা গুলো হাড়ে হাড়ে সত্যি মেয়েটাও জানে।তাই মুখ থেকে মাস্কটা সরিয়ে ফেলে। আরফাজ মেয়েটাকে দেখে মুচকি মুচকি হাসে।তারপর আবারও হাসিরত অবস্থায় উত্তর দেয়,

‘সন্দেহই সত্যি হলো।তা এসব কেনো করছো শিখা?এত রাতে এখানে আসলে,রিহান জানে তো।বাচ্চাটার কি কষ্ট হয়না মাকে ছাড়া এত রাতে থাকতে বলোতো?’

‘পরে জানাবো সময় করে।সময় আসেনি এখনও।আসি থাকো।’

মেয়েটা চলে যায় আরফাজকে রেখে।গার্ডদের বলে দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিতে।আরফাজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাধা অবস্থাতেই শুয়ে পরে।
#মন_মহুয়ায়_শূণ্যতা
#পর্বঃ১০
#Tasfiya_Nur

সকাল প্রায় পৌনে দশটা।পুরো শিকদার বাড়িতে আনন্দ যেন হারিয়ে গেছে।আরমান খেয়ে দেয়ে রেডি হচ্ছে।এগারোটায় চলে যাবে সে।জান্নাত রুমের ড্রেসিং টেবিলটার কোণ ঘেষে আরমানের দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে আছে।আরমান গোসল সেরে এসে রেডি হচ্ছে।জান্নাত আরমানের রেডি হওয়া শেষ হতেই ওকে বলে,

‘আপনার সাথে আমাকেও নিয়ে যাবেন শহরে।আমার শপিং করার দরকার।আপনি বাসে উঠে যাইয়েন আমি কেনাকাটা করে বাসায় এসে পড়বো।’

জান্নাতের কথা শুনে আরমান জান্নাতের দিকে ফিরে তাকায়।জান্নাতের দুবাহু ধরে ওর মুখপানে তাকায়।জান্নাত চোখ তুুলে তাকায় আরমানের দিক।আরমানের চোখে চোখ পরে যায় জান্নাতের।জান্নাত তাকিয়ে থাকতে পারেনা আরমানের দিকে।চোখ দুটোর গভীরতা বেশি মনে হচ্ছে তার কাছে।চোখ নাকি অনেকনা বলা কথা তুলে ধরে,আরমানের চোখেও কি সেই অব্যক্ত কথাগুলো ভেসে বেড়ায়, যেগুলো আরমান তাকে বলতে পারেনা।এজন্যই কি আরমানের চোখে এত গভীরতা! ভেবে পেলোনা জান্নাত।আরমানের সাড়াশব্দ না পেয়ে আবারও চোখ তুলে তাকালো।আরমানকে আগের মতোয় তাকিয়ে থাকতে দেখে জিগাস করে বসে,

‘কি হলো?কিছু তো বলুন!হ্যাঁ অথবা না,দুটোর একটা।’

আরমান জান্নাতের কথার উত্তর না দিয়ে জান্নাতকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।জান্নাত বোকাবনে যায়।সে বললো কি আর উত্তর এলো কি!এসব ভেবেই মাথা ঘুরানোর উপক্রম জান্নাতের।জান্নাত স্তম্ভিত হয়ে দাড়িয়ে থাকে।তারপর নিজেও নিজের হাত দুটো আরমানের পিঠে রাখে।জান্নাতের সাড়া পেয়ে আরমানের ঠোটে মুচকি হাসি ফুটে উঠে।জান্নাতের কানে কাছে ফিসফিস করে বলে,

‘এই যে আমার জান্নাত আফরিন জুই।আমার জুঁইফুল, যাচ্ছি তো আজ,মিস করবেনা কি আমায়।কল দিলে রিসিভ করবে তো?দম আটকে আসবে কিন্তু তোমার ভয়েস না শুনতে পারলে।দিনে অন্তত একবার ভিডিও কলে আসিও।তোমার মায়াবতী,লজ্জা রাঙা মুখটা না দেখলে ঘুমিয়েও শান্তি পাবোনা।দয়া করে এই অধমের কথা রাখিও।’

জান্নাত আরমানের ফিসফিসানি স্বর শুনে কেঁপে উঠে হালকা।লোকটা এমন কেনো?তাকে মায়ায় জড়িয়ে নিচ্ছে। লোকটার সাথে তার সম্পর্ক বৈধ।তাই মায়া জন্মানোটা কি এখানেই শুরু!মনে মনে ভাবলো জান্নাত।আরমান আরও কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রেখে বাইরে থেকে ডাক আসায় ছেড়ে দাড়ায়।আরমানের মা নাজমা বেগম ছেলের ঘরে এসে ছেলে খাওয়ার কথা বলেন।আরমানের কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কেদে দেয়।মা তো সন্তানকে দূরে পাঠাতে কষ্ট হবেই।আরমান অনেক কষ্ট তার মাকে থামায়।জান্নাতও নিজের শ্বাশুড়ির পাশে গিয়ে সামলে নিতে হেল্প করে আরমানকে।নাজমা বেগম নিজের কান্না সংবরণ করে আরমানের গালে হাত দিয়ে মৃদূ হেসে বলে উঠে,

‘এক ছেলেকে জানিনা কোন পাপে হারায় ফেলছি।তুই বাবা হারাস না।মইরা যামু আমি আর তোর বাপ।কত সৌভাগ্য আমগোর দেখ।মা বাপ হইয়া ছেলেরে মরতে উস্কানি দেওয়া মাইয়ারে ভাত কাপড় দিয়ে পালতে হইতাছে।সবই কপাল।বলি তুই জানি এমন কিছু করিস না।বউমার সাথে কিছু হইলে আমাগো জানাইস।দুই ছেলের এক ছেলেরে হারাইয়া অর্ধেক মরছি।তোর কিছু হইলে পুরা হইবো মরা।’

আরমান মায়ের কথায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়।জান্নাত কেনো তাকে মরতে বলবে!মহুয়া তার ভাইকে বলতো বিয়ে মানতোনা তাই বলতো।কিন্তু জান্নাত কেনো এমন করবে।সে তো জেনেবুঝে বিয়ে করেছে।মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বেক্কলের মতো এসব ভাবছিলো আরমান।জান্নাতও ভ্রু কুচকে নাজমা বেগমের দিকে তাকিয়ে আছে।নাজমা বেগম ছেলে আর ছেলের বউয়ের অবস্থা দেখে বুঝতে পারেন বেফাঁস কথা বলে ফেলেছেন তিনি।তাই কথা ঘুরাতে বলে উঠেন,

‘আরফাজকে হারাইয়া ভুল কথা মুখ ফসকে বাইর হইয়া গেছে। তোমর মন খারাপ কইরোনা।আরমান আয় খাইয়া ব্যাগ নিয়ে বাইর হইস বাপ।আমি খাবার বাড়ছি আয় তোরা।’

কথাটা বলে নাজমা বেগম হনহনিয়ে চলে যান।দরজার আড়ালে দাড়িয়ে মহুয়া সব কথাই শুনেছে নাজমা বেগমের। সে মূলত আরমান আর তার শ্বাশুড়ির আসতে দেরি হচ্ছিলো বলে ডাকত এসেছিলো আর এসেই এসব শুনলো।নাজমা বেগম যেতেই চোখের কোণে আসা পানিটুকু মুছে নিয়ে সেও পিছুপিছু চলে যায়।জান্নাত আর আরমান নাজমা বেগম চলে যেতেই আরমানের প্রয়োজনীয় সব গুছানো সবকিছু একত্রিত করে খেতে যায়।জান্নাতের মনটা খচখচ করছে আরফাজের নামটা শুনে।তার প্রিয় কারোর নামটাও তো আরফাজ।সেই আরফাজ আর এই আরফাজ এক হবে না তো।পুরো বাড়িতে আরফাজের একটা ছবিও কেউ রাখেনি।কেনো রাখেনি জানেনা জান্নাত।খাবার টেবিলে বসে ভাতের প্লেটে হাত ঘুরাতে ঘুরাতে আনমনে এসব ভাবছে জান্নাত।নাজমা বেগম সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে, মহুয়া সব এগিয়ে দিচ্ছে।খাবার টেবিলে বাবা,দাদা,দাদী সহ খেতে বসেছে আরমান।খাওয়ার মাঝে আড্ডায় তুখোর টেবিলটা।আরমান খেতে খেতেই শূণ্য চাহনীতে তাকায় সবার দিকে।রাতেও হয়তো তার একা খেতে বসতে হবে।কি ক্ষতি হতো সবার সাথে থাকতে পারলে!কিন্তু জীবিকার তাগিদটা যে আছে।যেতে তো হবেই।মানুষের জীবনই এমন।পাখির মতো,এই এখানে তো ঐ ওখানে।
খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে উঠে পরে জান্নাত।তার একটু পরেই আরমানও উঠে।নাজমা বেগম মহুয়াকে নিয়ে খেতে বসেন ওদের খাওয়া শেষে।জান্নাত শহরে যাওয়ার ব্যাপারে আরমানের থেকে উত্তর না পেয়ে শ্বাশুড়িকে বলে।তবে সাথে তোর্ষা যাবে বলে অনুমতি নেয়।তোর্ষাকে পরে বুঝিয়ে বলা যাবে বলে তার কথাই বলে জান্নাত।রুমে এসে আরমানকে সে কথা জানিয়ে রেডি হয়ে নেয় সে। আরমান বাড়ির সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির সামনে দাড়ানো অটোভ্যানে উঠে পরে।এখান থেকে বাজারে, বাজার থেকে সিএনজি করে শহরে গিয়ে বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে উঠে চলে যাবে সে।

💖💖
আরমানরা বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরেই মহুয়ার বাবা রাঙা মিয়া হাজির হয় শিকদার বাড়িতে।সবাই তা দেখেও না দেখার মতো।মহুয়া বাবাকে দেখে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে।বাবার আদরের পরশ গুলো তার কষ্ট ভুলাতে যথেষ্ট।মহুয়ার শ্বাশুড়ি এগিয়ে এসে সম্মানের খাতিরে খোজবার্তা নিয়ে মহুয়াকে বলে খেতে দিতে উনাকে।কিন্তু তিনি বাধ সেধে বলে দেন, মহুয়ার দাদী অসুস্থ মহুয়াকে দেখতে চায় বিধায় সে নিতে এসেছে।মহুয়ার যাওয়ার অনুমতি দরকার উনার।নাজমা বেগম খুশিমনে অনুমতি দেন।অন্তত একদিন মহুয়ার মুখ তার দেখতে হবেনা।মনিরা বেগম মহুয়ার যাওয়ার কথা শুনে আঁতকে উঠেন।গেলে এই মেয়ে ফিরতে পারবে তো।এই ভয় পাচ্ছেন উনি।
সব জল্পনা কল্পনা সেরে মহুয়াও আধাঘন্টা পরে বেরিয়ে পরে।বাসা থেকে কিছুটা দূরে আসতেই সে তার বাবাকে বলে উঠে,

‘বাবা বাড়ি যাও।কৃতজ্ঞ তোমার প্রতি যে বিশ্বাস করেছো।নয়তো আজ বাড়ি থেকে বের হওয়া কঠিন হতো।জান্নাতের সাহায্য দরকার আমার।নয়তো ওকে কিছু জানাতাম না।তুমি বাসায় যাও।আমি আসছি বিকেলের দিকে।’

মহুয়ার কথায় তার বাবা মুচকি হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে চলে যায়।মহুয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।ভাগ্যিস সে তার বাবাকে আরমানের বিয়ের দিন রাহাদের আড়ালে সব জানিয়েছিলো।নয়তো তার বাবা মা আর ভাইকে লুকিয়ে রাখার ব্যাপারে সাহায্য পেত না।অটোরিকশাতে উঠে একমনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে এসব ভাবছে মহুয়া।ফোনটা বেজে উঠায় ধ্যান ভেঙে যায় তার।জান্নাতের ফোন এসেছে।কলটা কেটে দিয়ে সিক্রেট ফোন দিয়ে টেক্সট করে সে আসতেছে।বাজারের কাছে নেমে মহুয়া তার বাবার ছোটো ভাই রুবেল মিয়ার চায়ের আছে সেখানে যায়।বাড়িতে অযুহাত দিয়েছে দাদীকে দেখতে যাবে আর তার দাদী তার চাচার বাসায় থাকে।তাই ফোনটা চাচার কাছে গচ্ছিত রেখে চলে যায় সে।কারণ ফোনের লোকেশন ট্র্যাক করে এই লোকেশনই ধরা পড়বে।আর রাহাদ তো মহুয়ার লোকেশম সবসময় দেখে।মহুয়া বাজারের কাছে এসে আগে থেকে দাড়িয়ে থাকা গাড়িতে উঠে রওনা দেয় শহরের দিকে।জান্নাতকে আবারও একটা রেস্টুরেন্টের ঠিকানা টেক্সট করে চুপ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়।

💖💖
নদীর ধারে দাড়ানো লঞ্চের ভিতরের কেবিনের জিনিসপত্র ভেঙে চুরমার করছে রাহাদ। তবুও তার রাগ কমছেনা।কমবেই বা কি করে,আরমানের বিয়ের দিন থেকে তার ব্যবসার লস শুরু।যেখানেই তার ড্রাগস, ইয়াবা সহ যাবতীয় রকমের নেশাদ্রব্য সাপ্লাই হচ্ছে রিপোর্ট আসতেছে সবকিছুর ভিতর ভেজাল মেশানো।আসল জিনিস সরিয়ে নকল জিনিস দেওয়া হচ্ছে কাস্টমারকে।এত এত কাজের মানুষ থাকতেও এসব ভুল হচ্ছে কিভাবে?ভেবে পাচ্ছেনা রাহাদ।আবার তার ডিলারদের যারা তার ব্যবসার সব মাল সাপ্লাই করে তাদের আনন্দ দেওয়ার মেয়েগুলোকে কোথায় রেখেছে মহুয়া। পুরো সুকনপুর গ্রাম হাতরিয়েও পাওয়া যায়নি তাদের।মেয়েগুলো মুখ খুললে সে যে শেষ এটা খুব করে বুঝতে পারছে সে।শিখাকে দিয়ে আরফাজকে আটকিয়েও লাভ হচ্ছেনা কোনো। মহুয়াকে কিডন্যাপ করার ছবি পাঠিয়েও মহুয়ার কোনো হেলদোল নেই।বলা হয়েছিলো সে মেয়েগুলোকে ফেরত দিলে আরফাজকে ফেরত দিবে।কিন্তু মহুয়া তো মুখের উপর বলে দিয়েছে, যে আরফাজ সবার সামনে মৃত সে না হয় এবার সত্যি মৃত হোক।তোমরা যা পারো করো।যুদ্ধে নেমেছি হয় মারবো নয় মরবো।”মহুয়ার এনন উত্তর আশা করেনি রাহাদ সহ বাকিরাও।শিখাকে দিয়ে আরফাজকে অত্যাচার করার কথা বলেও লাভ হয়নি।শিখা সে তো ভাইয়ের দরদে মারতে রাজী না।কিন্তু এসবের মাঝে মহুয়া এটা এখনও সামনে আনতে পারেনি যে রাহাদের পাটনার শিখা।রাহাদ উত্তরবঙ্গের জেলাগুলো ব্যবসায় ব্যবহার করছে।শিখা ঢাকা সহ আশেপাশের জেলাগুলোতে তার মাদক দ্রব্যের সাপ্লাই করে ছোটো ছোটো মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে।মূলত সে দেশের বাইরে থেকে মাদক দ্রব্য এনে জেলায় জেলায় চড়া দামে বিক্রি করে।
লঞ্চের কেবিনে রাখা সোফায় বসে সিগারেট খেতে খেতে কথাগুলো ভাবছিলো রাহাদ।সবকিছু ধেয়াশা লাগছে তার কাছে। মহুয়া করতে চাচ্ছে কি?মহুয়াকে এসবের মাঝে টেনে এনে সে কি ভুল করলো?মেয়েটা বোকা ছিলো,এত বুদ্ধি তার হবে যে রাহাদ শেখের মুখোশ খুলে ফেলার সাহস দেখাচ্ছে।মরতে তো হবেই এবার। অনেক ছাড় দেওয়া হয়েছে আর নয়।গতকাল সারাদিন দৌড়ের উপর ছিলো।সে।যতগুলো মাল এসেছে নিজে দাড়িয়ে রিসিভ করেছে।এরপরও যদি আবারও ঘাপলা হয়, মহুয়ার মরণ নিশ্চিত।এটা ভেবে লম্বা ভাবে কেবিনে রাখা বেডটায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে।

💖💖

রেস্টুরেন্টে একটা কেবিন বুক করে খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে মহুয়া আর জান্নাত।জান্নাত অনেকক্ষণ ধরে মহুয়ার গা ছাড়া ভাব দেখে বিরক্ত হচ্ছে।কারণ মহুয়া আসার পর থেকে খাচ্ছেআর মোবাইলে কিছু একটা করছে।জান্নাত কিছুটা রাগী স্বরে বলে উঠে,

‘ভাবী সব বলবা?নাকি আমি উঠবো!কতক্ষণ ধরে বসে আছি মাথায় আছে তোমার? ‘

মহুয়া জান্নাতের কথা শুনে ফোনটা রেখে টেবিলে রাখা বিরিয়ানির প্লেটটা সামনে নিয়ে চামচ নিয়ে মুখে দিতে দিতে বলে উঠে,

‘সরি,একটু চেক করলাম প্রমাণ গুলো সব ঠিক ঠিক আছে কিনা।কারণ যা বলবো প্রমাণ ছাড়া মুখ খুলা যাবেনা।যাই হোক শুনো তোমার হেল্প দরকার তাই জানাচ্ছি।কিন্তু মাথায় রেখো আর কেউ যেন না জানে।সময় হলে আমি জানাবো।’

কথাটুকু বলে থামে মহুয়া।জান্নাত বিরক্তি নিয়ে আবারও বলে,

‘আসল ঘটনাটা বলো প্লিজ।টেনশন হয় আমার।’

মহুয়া খাওয়া রেখে মুচকি হাসে।জান্নাত একপলকে তা দেখে নেয়।আগ্রহ সহকারে তাকিয়ে থাকে মহুয়ার দিকে।মহুয়া উচ্চস্বরে পিছন ফিরে বলে উঠে,

‘মহিমা আপু আসো ভিতরে আসো।’

জান্নাত তব্দা খেয়ে বসে থাকে।তাদের কথার মাঝে মহিমা মেয়েটি আসলো কেনো।সেই বা কে?ভাবছে জান্নাত।তার ভাবনার মাঝেই মহিমা নামের মেয়েটা এসে বসে মহুয়ার পাশে।জান্নাত ভ্রু কুচকে জিগাসা করে,

‘মেয়েটা কে?আমার তোমার মাঝে উনাকে কি দরকার?’,

চলবে?

)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here