মন মহুয়ায় শূন্যতা পর্ব-১১+১২

#মন_মহুয়ায়_শূণ্যতা
#পর্বঃ১১
#Tasfiya_Nur

‘উনি মহিমা আফরোজ,আমার বড় চাচার মেয়ে।বিয়ে হয়েছে টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক শাদিয়াত শেখের সাথে যে নিজেই রাহাদ শেখের চাচার ছেলে।আমি তখন সদ্য নাইনের এক্সাম শেষ করে বেরুনো ছাত্রী।পরিক্ষা শেষ হওয়ায় বাড়িতে ফ্রি সময় যাচ্ছিলো।আপার কাছে ফোন করি যেন আমাদের বাড়িতে যায়।একা একা তেমন ভালো লাগছিলোনা বলে।আমি ছোটো থেকে যথেষ্ট পর্দার ভিতর বড় হয়েছি।এর পিছনে কারণটাও আমার সৌন্দর্য। জানোয় তো জান্নাত কালো হওয়া মেয়েদের জন্য সমাজের মানুষ যেমন অভিশাপ বানিয়ে দেয়,অধিক সৌন্দর্যও তেমনি সর্বনাশের কারণ হয়।কেননা কালো হলে মেয়েদের সর্বক্ষেত্রে হেয় করে সমাজের মানুষ, আবার সুন্দর হলে মোটামুটি সবারই নজর থাকে ইজ্জতে হাত দেওয়ার।গ্রামে মোটামুটি এই সৌন্দর্যের খাতিরে আমাকে চিনতো।গ্রামের চাচিরা যারা দেখতো অন্যখানে গিয়ে খেজুরে আলাপ জুড়ে দিতো, অমুকের মেয়ের গায়ের রং এত ফর্ষা, দেখতে এত সুন্দর, এসব আলোচনা চলতো সবসময়।যাই হোক বাদ দেই সেসব কথা।মহিমা আপু আমাদের বাড়ি আসায় দুবোন আড্ডা, এটা ওটা তৈরি করা, সময় ভালো যাচ্ছিলো।গ্রামেই নদী কিন্তু সেভাবে ঘুরতে যেতে পারিনি আম্মার জন্য। তাই আপা আসলে আপাকে সাথে নিয়ে নদীর ধারের দিকে বেড়াতে যাই।সময়টা তখন প্রায় বিকেলের শুরু।ঘুরতে ঘুরতে দুবোন প্রায় নদীর যেখানে ঘাট করা মাছের নৌকার সেদিকে চলে যাই কখন যে খেয়াল ছিলোনা।কিন্তু খেয়াল ছিলোনা সেই ঘাটে শুধু মাত্র রাহাদ শেখ আর আরফাজ শিকদার নৌকা রাখে ওখানে অন্যদের নৌকা রাখা নিষিদ্ধ অন্যদের।বের হইনি কখনও, তাই চিনতাম না।কিন্তু বড় আরদ থাকার জন্য সাথে নদী থেকে মাছের ব্যবসার জন্য রাহাদ শেখ আর আরফাজ শিকদার মানে তোমার ভাসুরের খুব নামডাক ছিলো গ্রামে।সেদিন জানিনা কোন কুলক্ষণে দিন ছিলো।আপা আর আমি ঘুরতে ঘুরতে সেখানে পৌছালে খেয়াল হয় সন্ধ্যা হয়ে আসতেছে।নদীর ধার সূর্য অস্ত যাওয়া সাথে নদীর ঠান্ডা বাতাস ভালোয় লাগছিলো। তাই হাটতে হাটতে দুজনে ঘাটের অদূরে কাঠ বাগান দেখতে পাই।সেদিকে ঘুরে দেখে বাড়ি যাবো বলে মনস্থির করি দুই বোন।সময়টা মাগরিবের আজান দিচ্ছে এমন,ঠিক তখনই বাগানের কাছাকাছি পৌছালে দেখতে পাই রাহাদ শেখ সাথে দুজন লোক সহ লাশ বস্তায় ভরছে।মহিমা আপু তখন তার ফোনে কল আসায় দূরে কাঠবাগানের অপরপ্রান্ত সেখানে গিয়ে কথা বলতে লাগে পারসোনাল কল এসেছে এটা বলে।আমি ওরকম দৃশ্য থেকে হতবুদ্ধি হয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখে যাচ্ছিলাম।ওখান থেকে যে চলে যাবো এই উপায় ছিলোনা।এতটাই তটস্থ হয়ে গিয়েছিলাম লাশ দেখে।আমি সাধারণত নিজের রক্ত ব্যতিত অন্য কারোর রক্ত দেখতে পারিনা। মাথা ঘুরে,হাত পা অবশ অবশ লাগে।নদীর ধার, সময়টাও সন্ধ্যা আর এমন এক জায়গা যেখানে রাহাদ শেখের অনুমতি ছাড়া ঐ এরেয়ায় প্রবেশ নিষেধ। সব মিলিয়ে আমার অবস্থা তখন খারাপ হয়।ততক্ষণে রাহাদ আমায় দেখে নিয়েছে। চোখ বড় বড় করে রাহাদ সহ ওর লোকেরা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।মহিমা আপুও তখন কথা বলা শেষ করে আমার দিকে এগিয়ে আসছিলো তখুনি আমি কেন জানিনা আপুর ফোনে নিজের ফোন দিয়ে মেসেজ লিখে পাঠিয়ে দেই যেন আমার কাছে না আসে।বিপদে আমি আছি সে না পড়ুক।এই চিন্তা করে আপুকে মেসেজটা লিখেছিলাম বোধ হয়।সেজন্য আজ আমি টসব ঝামেলায় আর আপু আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে।রাহাদরা তখন আমার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো বলে মহিমা আপুকে খেয়াল করেনি।ওরা আমার সামনে এসে দাড়ালে আমি আরও জমে যাই ভয়ে।রীতিমতো আমার কাপাকাপি উঠে গেছে তখন।আরও ভীতু ছিলাম তো।সামান্য কিছুতেই ভয় পেতাম।তো রাহাদ আমার সামনাসামনি এসে দাড়িয়ে জিগাসা করে,

‘কে তুমি?আর এই রাহাদ শেখের জারিকৃত জায়গায় কেনো এসেছো।জানোনা এই জায়গায় আসেনা কেউ।মরার ইচ্ছে আছে।আর এতক্ষণ যা দেখলেসব ভুলে যাও নয়তো খুব খারাপ হবে।’

রাহাদের মুখে প্রথম ওর নাম শুনে বুঝতে পারি ও রাহাদ শেখ।আমি তখনও চুপ হয়ে ছিলাম। রাহাদ আমার উত্তর না পেয়ে হাতে থাকা চাকুটা আমার মুখের সামনে এনে ধরে বলে উঠে,

‘খুন হতে চাও এই রাহাদ শেখের হাতে?উত্তর দাও না কেনো?তুমি সুন্দরী বলে কিছু বলছিনা।তারমানে এই না তোমায় ছাড় দিবো!’

রাহাদের এমন কথায় আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রই ওর দিকে।রাহাদ ততক্ষণে ওর লোকদের লাশটা নদীতে ফেলার হুকুম দিয়ে চলে যেতে বলে।ওরাও রাহাদের কথামতো কাজ করে।তারপর ও আমার মুখোমুখি দাড়িয়ে বলে উঠে,

‘পরিচয় বলবে নাকি খুন হবে বলো!’

আমি রাহাদের কথায় ভয় পেয়ে কাপা গলায় উত্তর দেই,

‘আমি এই গেরামের রাঙা মিয়ার মেয়ে মহুয়া।’

রাহাদ আমার কথা শুনে সেদিন অবিশ্বাসও চোখে তাকিয়েছিলো।ওরনা হিজাবের মতো পেচিয়ে পড়েছিলাম বিধায় মুখ হালকা দেখা যাচ্ছিলো।রাহাদ একটু পড়ে সামনাসামনি দাড়িয়ে আমার ওরনায় টান ফেলে মুখের উপর থেকে সরিয়ে দেয় ওরনাটা।মুখের উপর থেকে ওরনাটা সরে গেলে রাহাদ এক পলক আমায় দেখে নেয়।তারপর বিরবির করে সামনেই বলে,”আমার জীবনে কেউ না থাকলে বিশ্বাস করো তোমায় জড়াতাম।বাট আফসোস আমার বউ আছে।” কাছে থাকায় কথাটা স্পষ্ট শুনি আমি।

একদমে কথাগুলো থামে মহুয়া।জান্নাত নিষ্পলক চাহনীতে তাকিয়ে আছে।মহিমাও চুপ করে বসে আছে।মহুয়া টেবিল থেকে পানির গ্লাস থেকে পানি খেয়ে নেয়।জান্নাত আবার বলে,

“তারপর কি হয় মহুয়া ভাবী?’

মহুয়া দম ফেলে। আবার বলতে শুরু করে,

‘তারপর রাহাদ সেদিন একটা লোককে ডেকে আমার পিছনে থাকতে লাগিয়ে দেয়।সাথে হুমকি দেয় মুখ খুললেই যেন আমার পরিবার সহ আমায় মেরে ফেলে।আমিও ভয়ে সিটিয়ে যাই।এরপরে কেটে যায় একমাস।দশমের ক্লাস শুরু হয়।একদিন স্কুলের সামনে রাহাদকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আত্মা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম।রাহাদ আমায় ইশারায় স্কুলের পাশে একটা ক্যান্টিন ছিলো সেখানে ডাকে।আমিও যাই।এরপর শুরু হয় ওর আসল খেলা।আমায় প্রস্তাব দেয় আরফাজকে বিয়ে করতে হবে।নয়তে আমার পরিবারকে রাতের আধারে জানে মেরে দিবে।আমি রাজী ছিলাম না।তারপর আমার ভাইয়ের একসপ্তাহ পর দেখা যায় খেলতে গিয়ে আর আসেনা।পরে রাহাদ লোক দিয়ে খবর পাঠায় আমার ভাই তার লোকের কাছে।রাজী হলেই সহী সালামতে পৌছে দিবে।ব্যস রাজী হই,দুইদিন পরই আরফাজ এসে দেখে যায় পরিবার সমেত।সেখানে রাহাদও ছিলো।তার তিনদিন পরই বিয়ে হয়ে যায়।তখনও জানতাম না বিয়ে কেনো করালো আরফাজকে তাও আমার মতো গরীব ঘরের মেয়ের সাথে। আর রাহাদ ছিলো আমার ননদের স্বামী এটাও জানতাম না। বিয়ের পর জানতে পারি।আরফাজকে প্রশ্ন করেছিলাম রিঠি ছোটো বিয়ে কেন দিয়েছন।উত্তরে বলেছিলো রাহাদ খুব ভালো,ওর বোনকে ভালো রাখবে তাই বিশ্বাস করে দিয়েছি বিয়ে।কিন্তু ও তো জানতোনা রাহাদ কি খারাপ মানুষ।বিয়ের একমাস পর রাহাদ জানায় তার আসল উদ্দেশ্য। আরফাজকে ড্রাগস দিতে হবে।যেন সে ড্রাগস নেওয়া অবস্থায় আমি ঝগড়া লাগালে নিজে গিয়ে সুইসাইড করে বা শহর ছাড়ে এমন টাইপ কথা বলতে বলে আমায়।আরফাজকে স্বামী হিসেবে আমার পারফেক্ট মনে হতো।সেজন্য এসব শুনে মাথায় হাত পরে আমার।কিন্তু ও ছিলো প্রচুর আত্মসম্মান বোধ সম্পন্ন মানুষ।ওর আত্মসম্মানে আঘাত দিয়ে কথা বললে ও ভেঙে গুড়িয়ে যেত।রাহাদ এটারই ফায়দা নেয়।একটা ভালো মানুষকে কিভাবে মারা যায়।পরে ভয় দেখায় শিকদার পরিবারেরও ক্ষতি করবে।দ্যান বাধ্য হয়ে আরফাজকে রাহাদের দেওয়া ড্রাগস রাতের খাবারল মিশিয়ে দিতাম।ও কাছে আসতে চাইলে ঝগড়া লাগাতাম।মরতে বলতাম,বিয়ে করে জীবন নষ্ট করছে আমার এসব বলতাম।প্রথমে বাচ্চা মেয়ে বলে এড়িয়ে যেত বা ড্রাগস নেওয়া অবস্থায় পড়ে পরে ঘুমাতো।ওর পরিবারও আমায় যথেষ্ট আদর করতে করতে মাথায় তুলে রাখতো।কিন্তু আমার এসব ব্যবহার যখন একবছরেও যায়না তখন সবাই অতিষ্ঠ হয়ে আমায় বকে।সেদিন রাহাদ রিঠিকে নিয়ে এসেছিলো বেড়াতে বাড়িতে।তাই জেনেবুঝে সেদিন আমাকে আরও বড় ঝগড়া লাগাতে বলে।সেইদিন টাই ছিলো আমার জন্য কালস্বরুপ।রাতে সবাই ঘুমালে আরফাজের সাথে শুরু হয় ঝগড়া।ফিসফিসানি ঝগড়া চলছিলো যেনো বাড়ির কেউ না শুনে।তারপর কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে বলে উঠি “মরতে পারিস না,মরলে মুক্তি পাই” এই কথা শুনার পর আরফাজ চুপ হয়ে যায়।আমার কাছে এসে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলে,”নদীতে মরতে যাচ্ছি, ব্লক বেধে মরবো কেউ টের পাবেনা।ভালো থেকো।” কথাটা বলে আরফাজ দরজা খুলে হনহনিয়ে চলে যায় বাইরে। আর ফেরেনি। তখন শিখা আপু মানে আমাদের সাইফ ভাইয়ার বোন গ্রামে আসছিলো বেড়াতে।উনি প্রেম করে বিয়ে করায় পরিবার আজও মানেনি।কারণ অন্যখানে বিয়ে ঠিক করায় উনি পালিয়ে যান।আর আরফাজ সাহায্য করেছিলো তাতে।এজন্যই গ্রামে এসে বারবার ফোন দিচ্ছিলো শহরে যাওয়ার আগে দেখা করবে বলে।আরফাজ ফোনটা ফেলে যাওয়াতে আমি নিয়ে বলে দেই উনাকে বাচাতে।তারপর জানিনা কি হয়েছে। সেদিনের পর সকালে গ্রামে হইচই উঠে শিকদার বাড়ির বড় ছেলে আরফাজ শিকদার নদীতে ডুবে মরছে।এই খবর ছড়িয়ে দেয় নদীতে মাছ ধরে আমাদের জাল দেখতো আবুল চাচা।ব্যস এরপর শুরু হয় ঝড় তুফান আমার উপর।পুলিশ কেস, বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া সব মিলিয়ে পরিস্থিতি খারাপ ছিলো।এরমাঝে রাহাদ একদিন জানায় আমাকে চলে যেতেই হবে।শিকদার বাড়ির সম্পত্তির ভাগীদার কমে গেলো একটা।আমি বুঝতে পারি সম্পত্তির লোভে এই মানুষ সবাইকে মারতেও ভাববেনা দুবার।তাই ততদিনে আরফাজকে যে ড্রাগস দেওয়ার জন্য ড্রাগস আমায় দিতে আসতো বিয়ের পর হাতে স্মার্টফোন পাওয়ায় ভিডিও ফুটেজ করতাম লুকিয়ে।যেদিন ড্রাগস দিতো সেদিন মহিমা আপুকে খবর দিতাম।সেই লুকিয়ে ভিডিও করতো।কারণ যা হতো সব আপুকে বলতাম।সেই প্রমাণের জোড়ে রাহাদকে থামাই কিছুটা।ওকে বলি শিকদার বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে।তবে আগের মতো আদর কদর থাকেনা।হাত থেকে ফোন খুইয়ে ফেলি।মেমরিটা খুলে কোনোরকম লুকিয়ে আপুকে দেই।হাতে দেয় বাটন ফোন যেটা দিয়ে বাবা মার সাথে কথা হতো।কিন্তু জানতাম না ফোন ট্র্যাক করা ছিলো।তারপর এভাবেই চলছে দিন।মাঝখানে শিখা আপুর সাথে যোগাযোগ হলে জানতে পারি উনি আরফাজকে সাথে করে শহরে নিয়ে গেছেন।যোগাযোগটা আরফাজের সিম কার্ডে থাকা আপুর নাম্বার নিয়ে।আরফাজের ফোনটা লুকিয়ে আমার কাছে রাখা ছিলো।কিন্তু আমি যত্নে তুলে রেখেছি তার স্মৃতি।শিখা আপুর থেকে জানতে পার এরপরে নাকি আরফাজ কোথায় চলে গিয়েছে। আজও খুজতেছি বাট পেলাম না খুজে।রাহাদ আমাকে শিকদার বাড়িতে চুপচাপ থাকতে দেখে ভেবেছে আমি থেমে গেছি।কিন্তু ও জানেনা ওপর পাপের রাজ্য ধ্বংস করতে প্রমাণ জোগার করতে শুরু করেছি।ওর কাছেরই বিশস্ত লোককে আরফাজের দেওয়া কাবিনের টাকা সাথে বিয়ের পর টাকা রাখতে দিতো সেগুলো দিয়ে হাতে রেখে সব ইনফর্মেশন পেতাম।পরে ঐ লোকটাকেই পুলিশের ভয় দেখিয়ে সব কাজ করে নিতে থাকি।পরে শুনি এতদিনে এসে আরমানের ক্ষতি করতে পারে।কারণ আরমান না থাকলে সব সম্পত্তি দখল করা যাবে্ তাই এবার নিজে নেমেছি মরণের খেলায়।হয় মারবো নয়তো মরবো।তোমাদের বিয়ের দিন রাতে বাড়ি ফাকা থাকায় নিজে রাহাদের লঞ্চে যাই।রাহাদকর বিশ্বস্ত লোকটার নাম রাহিব।ওর সাহায্যে সবাইকে অজ্ঞ্যান করে রাহাদের লঞ্চে ব্যবহৃত মেয়েদের তুলে আনি। সেদিন মহিমা আপু আর দুলাভাইও সাথে ছিলো।এখন বলতে পারো মহিমা আপুর সাথে কিভাবে রাহাদের বিয়ে হলো।আসলে আমি আপু সহ আরফাজ চলে যাওয়া পর রাহাদের সাথে দেখা করতে যাই রাতে প্রমাণ দেখাতে। আপু আড়ালেই ছিলো।রাহাদ চলে যেতে আপুর সাথে বাড়ি ফিরতে ধরে সেদিন ভাইয়ার সাথে দেখা হয়।উনিও নিজের ভাইয়ের কৃতকর্মের প্রমান জোগাড় করতে লুকিয়ে গিয়েছিলেন।পরে আমাদের ওর সাথে দেখা করতে দেখে ভেবেছিলেন আমরাও যুক্ত। তাই রাহাদ চলে গেলে কথা বলতে আসেন আমরা বাড়ি ফিরে আসতে ধরলে।পরে সব খুলে বলা হয় উনাকে।আপুকে পছন্দ হয়।লুকিয়ে বিয়ে করে নিয়ে শহরে রাখেন।এরপর থেকে চলছে গোপন অভিযান রাহাদের বিরুদ্ধে প্রমান যোগার করার।মাছের ব্যবসার নামে মাদক ব্যবসা,মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে জোড় করে রেপ করে অন্যদের কাছে লেলিয়ে দেওয়া, আর যেই বাধা হবে তাকেই সরিয়ে দেওয়া এটাই রাহাদের কাজ।আরফাজ বাধা হয়েছিলো কিন্তু আত্মীয় বলে কিছু করেনি নাকি অন্য ব্যাপার জানা নেই। আর এসবের প্রমাণ তোমার দেখা ঐ ল্যাপটপে।আমি নিরীহ বোকা মেয়ে ভেবে রাহাদ তেমন গুরুত্ব দিতোনা।তাই তো আমার সব প্রমাণ যোগার করা সহজ ছিলো।আর ফোনটা ট্র্যাকমকরা জানতে পারি শিখা আপুর সাথে বলা কথাগুলো ও এসে আমায় রিপিট করে বললে।তাই আপুকে দিয়ে ফোন আর ল্যাপটপ কিনে নেই।আর আপু কে তো রাহাদ তেমন ভাবে দেখেনি তাই সন্দেহও করেনা।এই নাও ল্যাপটপ সব প্রমান দেখো।’

কথাগুলো বলে শেষ করে মহিমার আনা ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বের করে তা এগিয়ে দেয় জান্নাতের দিকে এগিয়ে দেয় মহুয়া।জান্নাত ল্যাপটপ ওপেন করে সব একটা একটা করে দেখতে শুরু করে।তারপর নিজেই স্তব্ধ হয়ে যায়।একটা মানুষ এতটা খারাপ হতে পারে বলে ধারণা ছিলোনা জান্নাতের।
#মন_মহুয়ায়_শূণ্যতা
#পর্বঃ১২
#Tasfiya_Nur

‘তোর সাথে আমার কথা হয়না একসপ্তাহ হলো জান্নাত।তবুও ভুলেও একবার আপুকে মনে করলি না?’

মাঝখানে কেটে গেছে একটা সপ্তাহ।এরমাঝে জান্নাত বাবার বাড়ির কারোর সাথে তেমন কথা বলেনি।সময়টা সকাল,জান্নাত একটা দরকারে তোর্ষাকে কল করে।তখন তোর্ষা উক্ত কথাটি বলে।তোর্ষার এমন প্রশ্নে চুপ করে আছে জান্নাত। কি উত্তর দিবে সে।উত্তর আদৌ আছে কি কোনো।ভেবে পেলো জান্নাত।তোর্ষা বোনকে আবারও জিগাসা করে বসে,

‘কিরে চুপ যে?’

‘কিছু হয়নি আপু, এমনিই মন ভালো ছিলোনা।তুই একটু আসবি এখানে।ঢাকায় যাবো আমি, আমার শ্বাশুড়িকে একটু বুঝিয়ে বলে নিয়ে যা প্লিজ।জানিসই তো উনি একমাসের আগে আমায় যেতে দিবেন না।নতুন বউ শরীর থেকে এখনও হলুদের গন্ধ যায়নি।জ্বীন-ভুতের আছর লাগবে বলে উনার ধারণা।উনি পারলে আঠারো মাসের আগে তো বাড়ি থেকে নড়তেই দিতোনা।অনেক কষ্টে আরমান পড়াশোনার জন্য বুঝিয়ে বলেছে।রাজী হয়েছে তারপর।বাট আমার দরকারী কাজ আছে।যেতে হবে,প্লিজ আপু।’

জান্নাত মৃদু স্বরে কথাটা বলে তোর্ষাকে।তোর্ষা বোনের আকুতি শুনে শব্দ করে দম ফেলে।তারপর উত্তর দেয়,

‘কাল যাই।সমস্যা হবে তাতে?’

‘না তুই আসিস কাল।আমি সবাইকে জানিয়ে রাখবো।রাখি তবে!’

বোনের সাথে কথা বলা শেষ করে ফোনটা কেটে দেয় জান্নাত।বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।নতুন বউ হওয়ার দরুণ তেমন একটা কাজ করতে না দিলেও সকালের নাস্তাটা সবাইকে তারই দিতে হয়।বাকিরা অন্য কাজ করে।জান্নাত নাস্তা দিয়ে এসে তোর্ষাকে কল করে কথা বললো এতক্ষণ। বিছানায় শুয়েই ফোনে সময় দেখে নেয়।নয়টা পয়তাল্লিশ বাজে প্রায়।দশটায় সবাই ভাত খায় এই বাড়ির মানুষ।সকালের নাস্তায় চা-বিস্কুট সাথে ডাল,ডিম ভাজি,পরোটা খায়।ভোর ছ’টায় উঠে সেসব বানিয়েছে জান্নাত। সাথে মহুয়া সাহায্য করেছে।রিঠির উপর প্রচন্ড রাগ জমে আছে জান্নাতের।শ্বশুরবাড়ি রেখে বাপের বাড়িতে আসা যাওয়া বেশি তার।যেজন্য রাহাদও ঘনঘন শিকদার বাড়িতে আসে। রাহাদকে দেখলেই রাগে শরীর জ্বলে জান্নাতের।সকালে উঠার দরুণ চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে জান্নাতের। কিন্তু বাইরে হইচই শুনে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ায় জান্নাত।বাড়িটা চিড়িয়াখানার থেকেও জঘন্য, সবসময় হইচই লেগেই থাকে।জান্নাত বিরক্তিমাখা মুখে উঠোনে পা রাখে।উঠোনের মাঝখানে মহুয়াকে মাথা নিচু করে একসাইডে দাড়িয়ে থাকতে দেখে জান্নাত।তার সামনে রিঠি,নাজমা বেগম,আর তার বড় জা শান্তনা বেগম মহুয়াকে বকে যাচ্ছে।জান্নাত ধীর পায়ে সেখানে যায়।সবাই জান্নাতকে খেয়াল করে থেমে যায়।জান্নাত সবার উদ্দেশ্যে জিগাসা করে,

‘কি হয়েছে? মহু ভাবীকে এভাবে ধমকাচ্ছো কেনো তোমরা?’

‘আমি ভাবীকে সকালে বলেছিলাম লাউ চিংড়ি করে দিতে।অথচ ভাবী তেমন কিছু করেনি উল্টো আমার অপছন্দের রান্না করেছে।’

রিঠি পাশ থেকে উত্তর দেয়। জান্নাত তার কথা শুনে রাগে হাত মুঠো করে নেয়।নাজমা বেগম আর শান্তনা বেগম জান্নাতকে এমন শক্ত হয়ে দাড়াতে দেখে হা করে তাকিয়ে দেখে।জান্নাত তখন বলে উঠে,

‘তা রিঠি তোমারও তো ননদ আছে।সে কি এসে এভাবে তোমাকে নিজের পছন্দের কথা বলে?আর না পেলে তোমায় মতোয় অসভ্যের মতো বড় ভাইয়ের স্ত্রীর উপর চিল্লাতে থাকে?’

রিঠি মুখটা পানসে করে ফেলে জান্নাতের উত্তরে।তারপর ওখান থেকে চলে যেতে ধরলে জান্নাত বলে উঠে,

‘যাচ্ছো কোথায়? উত্তরটা দাও।শুনো রিঠি বড় ভাবী সে।হতে পারে অন্যায় করেছে, অন্যায়টা আমার অজানা। কিন্তু সে কিন্তু যথেষ্ট শাস্তি পাচ্ছে এতদিন ধরে।তোমাদের জন্য এখানে পরে আছে সে।একটু সম্মান দাও দেখো আর সমস্যা হবেনা।’

জান্নাতের কথা টুকু শুনে রিঠি চলে যায়।উত্তর দেয়না।নাজমা বেগম আর শান্তনা বেগমও জান্নাতের কথা শুনে মুখটা পাংশুটে করে চলে যায়।শান্তনা বেগম তো জান্নাতের উপর বিরক্ত হয়ে রেগে বকতে বকতে চলে যায়।জান্নাত সব দেখেও না দেখার ভান করে মহুয়ার সামনে যায়।গিয়ে মাথাটা হাত দুগালে রেখে উচু করে।মহুয়া কাদছিলো ফুপিয়ে ফুপিয়ে, চোখের কার্নিশে তখনও পানি।জান্নাত এসব দেখে জোড়ে ধমক দিলো মহুয়াকে।তারপর হাত ধরে টেনে আনে নিজের রুমে।তারপর বিছানায় বসিয়ে ধমকিয়ে বলে উঠলো,

‘সব জায়গায় এত সাহস বের হয়, তা তোমার মুখের উপর প্রতিবাদ করতে কি মুখ ব্যাথা করে?’

জান্নাতের ধমকানিতে মহুয়ার কান্নার দমক আরও বেরে যায়।মহুয়ার ফুঁপানির শব্দ বেড়ে চলেছে।জান্নাত বিরক্ত হয়ে মহুয়ার সামনে বসা থেকে উঠে ওয়ারড্রবের সামনে যায়। ওয়ারড্রবের ড্রয়ার ওপেন করে বিস্কুটের প্যাকেট ছিলো, সেখান থেকে বিস্কুট এনে মহুয়ার সামনে গিয়ে গাল টিপে ধরে।তারপর বিস্কুট ঢুকিয়ে দেয় মুখের ভিতর।তারপর বলে উঠে,

‘নাও খাও আর কাঁদো। এনার্জি ভালো পাবে।ফাজিল মহিলা হচ্ছো দিনদিন।যার স্বামীর জন্য আজ রসায়তলে ঢুবে আছো,তারই ফরমায়েশ খাটতে গিয়ে কেঁদেকেটে একাকার করছো।বলি লজ্জা করেনা অপমানিত হতে।যেখানে জানো তোমার দোষ নেই,সেখানে বেক্কলের মতো অপমানিত হতে যাও কেনো?ভালো সেজে মানুষের কাছে ভালো থাকার দরকার নেই কোনো সেটা অন্যায় জানার পরও।তার থেকে ভালো মুখের উপর জবাব দিয়ে অভদ্র হওয়া।পেয়েছে কি ওরা?এসে থেকে দেখছি কথায় কথায় এই ভুল ঐ ভুল।বলি তুমি কি মানুষ না নাকি?ওহ ভুলে গেছি তুমি মানুষ কেনো হবে!তুমি তো রোবট,যার অনুভূতি নেই।থাকলে নিজের স্বামীকে কখনো মরতে যেতে বলে।বলতে চেয়েছিলাম না এভাবে কিন্তু বললাম।কারণ কি জানো?অন্যের কথার উপর যদি জিদ থাকে তো তুমি অনুভূতি নামক মায়ায় আবার আবদ্ধ হয়ে যাবে।তাতে যদি অপমানের জবাব দাও।’

মহুয়া মুখের ভিতর বিস্কুট নিয়ে অটোমেটিক বসে ছিলো।না চিবুচ্ছিলো না কাদছিলো।হা করে শুধু জান্নাতের কথা শুনে গেলো।জান্নাত ততক্ষণে বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে চলে যেতে পা বাড়িয়েছে।যাওয়ার সময় মহুয়ার জন্য পানি আনতে যাচ্ছে বলে গেলো।

💞💞
ভরদুপুরের সময়টায় একটু একটু রোদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে।শীতের সময়টায় রোদের দেখা পাওয়া যেন অনাকাঙ্ক্ষিত বস্তু।শিখা কলেজ ছুটি হওয়ার পর রাস্তার ধারে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে।আরফাজের কাছে যেতে হবে তার।কয়টা দিন হলো যাওয়া হয়না সেখানে।নানান ব্যস্ততা আর কলেজে নিউ স্টুডেন্টের ভর্তি হওয়ার ঝামেলা থাকায় সময় সুযোগ হয়নি তার।প্রায় আধাঘন্টার মাথায় শিখার সামনে ফুল ব্ল্যাক কালার একটি প্রাইভেট কার এসে থামে।শিখা দ্রুত তাতে উঠে পরে।শহর থেকে প্রায় অনেকটা দূরে লোকালয়ের অন্তরালে তৈরি করা গুদামঘরটায় প্রবেশ করে শিখা।দুইঘন্টা লাগে এখানে আসতে।নামেমাত্র গুদামঘর বানিয়ে রেখেছে রাহাদ।ভিতরে সব আভিজাত্যে পূর্ণ করা। কেউ যেন বুঝতে না পারে ভুলেও সেইজন্য এত সব ব্যবস্থা করা।শিখাকে দেখে আরফাজ বিছানায় শুয়েছিলো, শোয়া থেকে উঠে বসে।এ ক’দিনে আরফাজের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে রেখেছে শিখা।আরফাজ যেন পালাতে না পারে তারও সব ব্যবস্থা করেছে,তবেই বাঁধন খুলে দিয়েছে। আরফাজও পালানোর চেষ্টা করেনি।জীবনের উপর থেকে মায়া উঠে গেছে তার।সবকিছুই মূল্যহীন লাগে আরফাজের কাছে।শিখা গিয়ে আরফাজের মুখোমুখি বসে।হাতে থাকা সাইড ব্যাগ থেকে নিজের হাতে বানানো খাবারটুকু বের করে আরফাজের সামনে রাখে।আরফাজ তা দেখে হো হো করে হেসে উঠে। শিখা ভ্রু কুচকে তাকায় তা দেখে।আরফাজকে জিগাসা করে,

‘হাসছো কেনো এভাবে?বন্দী থাকতে থাকতে কি পাগল হয়ে গেলে?’

‘হাসছি তোমার কান্ডে শিখা। আটকে রেখে এত আদর কেনো বলোতো?মেরে দাওনা প্লিজ।আমি বেচে থেকেই বেচে নেই।আমার জীবনআমার কাছে বোঝা মনে হয়।প্লিজ মেরে ফেলো আমায়।এভাবে বাচার থেকে মরে যাওয়া ভালো।’

শিখার মনের মধ্যে ধড়ফড়ানি উঠে যায় আরফাজের কথায়।তবুও কিছু বলেনা আর।হাত ধুয়ে আরফাজের মুখের সামনে ভাত তুলে ধরে।আরফাজ ছলছল চোখে তাকায়।শিখা ভ্রু নাড়িয়ে ইশারা করে খেতে।আরফাজ মুখে ভাত নিয়ে চিবোতে চিবোতে অস্ফুট স্বরে বলে,

‘রিঠিকে মনে পড়ছে খুব শিখা।ওউ তো আমায় এভাবে খাওয়াতো মাঝে মধ্যে। ‘

শিখা আরফাজের বলা কথাটা রিঠির নাম শুনে বুঝতে পারে।তাদের জীবনটাও তো এমন হাসিখুশী দিয়ে ভরপুর ছিলো।তবে আজ কেনো এত যন্ত্রণা। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শিখা।তারপর আবারও ভাত আরফাজের সামনে ধরে।আরফাজ মুখে পুরে নিলে শিখা ধীর স্বরে বলে উঠে,

‘তুমি কি জানতে আরফাজ, তুমি বাড়িতে থাকাকালীন সবসময় তোমার পিছনে তোমাকে অনুসরণ করার জন্য রাহাদ লোক লাগিয়ে রাখতো।তুমি ভেবেছিলে রাহাদ ভালো হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা কিভাবে হয় বলো?কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয়না।মাঝখানে তোমাকে বাচাতে গিয়ে আমি ডুবেছি পাপের রাজ্যে।জানিনা কপালে কি আছে।কিন্তু আমার বাচ্চাটার যে কি হবে জানিনা।আমি তো জেলে যাবো এটা নিশ্চিত থাকো।মহুয়া আটঘাট বেধে নেমেছে সব ডুবিয়ে দিতে।খুব শিগগিরই সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো।’

শিখার কথায় চমকে উঠে আরফাজ।এসব হচ্ছে কি তার সাথে কিছু মাথায় ঢুকছেনা। আরফাজ চকিতে শিখাকে প্রশ্ন করে,

‘যা বলবে খোলাশা করে বলো প্লিজ! আর এত চিন্তা নিতে পারছিনা বিশ্বাস করো।’

আরফাজের আকুতি ভরা মিনতি উপেক্ষা করতে পারেনা শিখা।ভাতের থালা সরিয়ে হাত ধুয়ে আরফাজের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে,

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here