#মন_মহুয়ায়_শূণ্যতা
#পর্বঃ১৩
#Tasfiya_Nur
মাথা ধরে খাটের সাথে হেলান দিয়ে থমকে বসে আছে আরফাজ। সময়টা মধ্যরাত,শীতের সময়টাতেও আরফাজের শীত অনুভব হচ্ছে না।নিজেকে অনুভূতি শূন্য লাগছে তার।তবুও আরফাজের চোখে ঘুম নেই। শিখার কথা গুলো তার কানে ঝনঝনিয়ে বাজছে।রাহাদ তাকে নিজের রাস্তা থেকে সরাতে মহুয়াকে ব্যবহার করেছে।আবার মহুয়া সবকিছুর পরও যখন তাকে বাচাতে শিখাকে পাঠিয়েছিলো, সেখানেও রাহাদ শিখাকে রিহান, আরফাজ আর শিখার শ্বাশুড়িকে খুন করার ভয় দেখিয়ে নিজের কাজে যুক্ত করেছে। শিখাকে দিয়ে কলেজের ধনী লোকের সন্তানদের মাঝে ড্রাগস সাপ্লাই করিয়েছে।সাথে কোচিং সেন্টার খুলিয়ে সেখানেও ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে প্রথমে বিনামূল্যে চকলেটের কথা বলে তার ভিতর ইয়াবা ঢুকিয়ে তাদের খাইয়ে আসক্ত করে পরে টাকার বিনিময়ে তাঁদের মাঝে ওসব সাপ্লাই করেছে। ইভেন এখনও করে আসছে।মহুয়াকে ব্যবহার করার ঘটনাও বলেছে শিখা আরফাজকে।আরফাজ নিজের চুল টেনে ধরে বসে যায়।মাথায় এত চিন্তা আর ধরছেনা।একটা মানুষ টাকার জন্য এত নিচুস্তরে নামতে পারে।”অনেক হয়েছে এবার আমার রাহাদকে মরতে হবে।সহ্য অনেক করেছি।রাহাদ একটা না শিকদার পরিবার সহ মহুয়ার পরিবার, শিখার পরিবারকেও বিপদে রেখেছে।এবার থামাতে হবে।চুপচাপ থেকে অনেক ভুল করেছি।চলে এসেও ভুল করেছি।এখন আমার পরিবার বিপদে আছে।”
বিরবির করে এসব কথা বলে উঠে দাড়ালো। শিখার রেখে যাওয়া গার্ডদের ডাক দিলো।পানি খাবে এই অযুহাত দিলো।গার্ডরা আরফাজের হইচই শুনে একজন গেট খুলে প্রবেশ করে।আরফাজ দরজার আড়ালে ঘরের ভিতর পড়ে থাকা রডের একহাত টুকরো খুজে পেয়েছিলো।সেটা দিয়েই গার্ডের মাথায় আঘাত করে।গার্ডের চিৎকারে বাকি গার্ড ভিতর আসলে আরফাজ তাদের চোখে একসাইডে পড়ে থাকা বালুর বস্তা থেকে বালু নিয়ে গার্ডদের চোখে ছুড়ে মারে।গার্ডদের ডাকার সময় সে পুরো গুদামঘর দেখে নিয়েছিলো।সেই জন্যই এভাবে গার্ডদের কুপোকাত করতে পারলো সহজে।আর ওরা সংখ্যাতেও ছিলো অল্প,মাত্র চারজন।গার্ডদের এভাবে মারার পর রড দিয়ে আঘাত করে অজ্ঞান করে দেয় আরফাজ।তারপর পকেট হাতরে ফোন বের করে নেয়।তারপর ওদের ফেলে রেখে সেখান থেকে বের হয়ে যায়।লোকালয়ের দেখা পেতে পেতে প্রায় ভোর পেরিয়ে যায় আরফাজের।হাতে থাকা ফোনটা থেকে রিহানের নাম্বারে ডায়াল করতে নেয়।পরক্ষণেই মনে হয় শিখা বলেছিলো তাদের সবার ফোন ট্র্যাক করে রেখেছে।তাই কল আর করলো না।ফোনটা জঙ্গলের দিকে ছুড়ে মেরে মনে মনে স্থির করে নিলো সে সোজা রিহানের অফিসে যাবে।তারপর শিখার ঢাকা শহরের কাজগুলোর যথার্থ প্রমাণ খুজে নিয়ে সে গ্রামে ফিরে যাবে রিহানকে সঙ্গে নিয়ে।যেই ভাবা সেই কাজ।আরফাজ রাস্তার ধারে ওয়েট করতে লাগলো গাড়ির জন্য।
অন্যদিকে রিহান সকাল সকাল উঠে বাসায় শিখাকে খুজলেও পায়না তাকে।বাচ্চাটা কাদছে সেদিকে শিখার বিন্দুমাত্র খেয়াল রাখেনা।শিখা কেমন যেন পাল্টে যাচ্ছে আরফাজ চলে যাওয়ার পর থেকে।হুটহাট বাসা থেকে বের হওয়া,খেতে বসেও ঠিকঠাক ভাবে না খাওয়া,বাসার কাজে অমনোযোগী সবকিছু নিয়েই শিখাকে নিয়ে চিন্তিত রিহান।সকাল নয়টা হবে হয়তো শিখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে বাসায় প্রবেশ করে।রিহানকে ড্রইং রুমের সোফায় বসে থাকতে দেখে একটু বিচলিত হয় সে।রিহানের তো আটটার মাঝেই অফিস চলে যাওয়ার কথা অথচ এখনও যায়নি।কিন্তু কেনো যায়নি ভেবে পেলোনা শিখা।রিহানকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেতে নেয় রুমে।রিহান অবাক হয়ে শুধু শিখার এই পরিবর্তন দেখে যাচ্ছে।শিখাকে রুমে যেতে দেখে নিজেও যায় রুমে।তারপর দরজাটা লক করে শিখাকে রুমের দেয়ালের সাথে দুহাতে হাত রেখে চেপে ধরে।শিখা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে হিজাব থেকে পিন খুলছিলো। আচমকা এমন হওয়ায় সেও বিভ্রান্ত হয়ে যায়।রিহানকে এমন ব্যবহার করতে দেখে শিখা অবাকের চরম পর্যায়ে যায়।রিহান শিখাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
‘পাল্টে কেনো যাচ্ছো?আগের শিখাকে খুজে পাইনা তোমার মাঝে!’
শিখা প্রতিত্তোরে কিছু বলেনা।রিহানের বুকের সাথে মিশে যায় আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।রিহানও আর কিছু বলেনা উত্তর না পেয়ে।শিখা চোখের পানি ছেড়ে দেয় রিহানের বুকে মাথা রেখে।জীবন থেকে শান্তি নামক বস্তটা যেন উড়ে গেছে তার।এত বিপদ কেনোতার জীবনেই আসতে হলো।প্রশ্ন হাজারটা উত্তরের ফলাফল শূণ্য।
💞💞
শিকদারবাড়িতে শোকের যায়।আজমল শিকদারের পা ভেঙে বিছানায় পরে আছে।বয়স্ক মানুষ তার ভিতর এমন অসুস্থ। সবার মনেই চিন্তার ঝোক।তার জন্য জান্নাতের ঢাকায় যাওয়াও আটকে ।আজ দিনটা শুক্রবার।অনেক কষ্টে শ্বাশুড়িকে বুঝিয়ে যাওয়ার জন্য রাজী করিয়ে নিজের ঘরে কাপড় গুছিয়ে নিচ্ছে।মাঝখানে কেটে গেছে একটা সপ্তাহ।তোর্ষা আর সুজন তালুকদার এসে সবাইকে বুঝিয়ে বলে গেছে।জান্নাত ব্যাগ গুছানো শেষ করে ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় দাড়ায়।বাইরের উঠোনে সরিষার মাড়াই কাজে ব্যস্ত সবাই।মহুয়া সকালের রান্নায় ব্যস্ত ছিলো সেও কাজ সেড়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়।শাড়ির আচলে হাত মুছে এগিয়ে আসে জান্নাতের দিকে।জান্নাত ফোনে একটু মেসেজ করছিলো তোর্ষার সাথে সেজন্য বুঝতে পারে না মহুয়া তার সামনে এসে দাড়িয়েছে। মহুয়া যখন তাকে ডাক দেয় হুশ ফিরে জান্নাতের।মহুয়া তখন জান্নাতের হাত ধরে নিজের ঘরের দিকে নিয়ে যায়।দুই জা ঘরে ঢুকার পর দরজাটা বন্ধ করে দেয় মহুয়া।তারপর নিজের বাটন ফোন থেকে ইনবক্সে গিয়ে মেসেজ বের করে জান্নাতের হাতে দেয়।জান্নাত এতক্ষণ নিশ্চুপ মহুয়ার কাজকর্ম দেখে যাচ্ছিলো। হাতে ফোন ধরিয়ে দিতেই সে মহুয়াকে জিগাসা করে বলে,
‘তোমার ফোন আমার হাতে দিলে কেনো?অন্য কারোর পারসোনাল জিনিস আমি কেনো দেখবো?’
‘বোকার মতো কথা বলছো জান্নাত আপু।ব্যক্তিগত হলে তোমায় দেখাতাম না।মেসেজটা পড়ো। ‘
জান্নাত মহুয়ার কথায় মেসেজটা পরে।রাহাদের হুমকি বার্তা পাঠানো মেসেজটায়।আজমল শিকদারের যেমন একটু খানি ক্ষতি হয়েছে মহুয়া না থামলে এক এক করে খুন হবে সবাই।এরকম কিছুই মেসেজে লিখা।জান্নাত চুপচাপ বিছানায় বসে পরে।সে ভেবেছিলো তার দাদা শ্বশুর বয়স্ক মানুষ রাতের আধারে দোকান হতে ফিরতে হয়তো পরে গিয়ে পা ভেঙেছে। কিন্তু এটা যে রাহাদের কাজ এটা তার ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি জান্নাত।মহুয়া জান্নাতের পাশে বসে বলে উঠে,
‘শাহদিয়াত ভাইয়া হাসপাতালে ভর্তি।মহিমা আপুর খোজ রাহাদ পেয়ে গেছে।বুঝতে পারছিনা কিভাবে কি হয়েছে।মহিমা আপু ভাগ্যিস বুদ্ধি করে মেয়েগুলোকে সরিয়ে অন্য জায়গায় পাঠিয়েছিলো।নয়তো রাহাদ ওদের পেয়ে গেলে আপুকে আর দুলাভাইকে মেরে ফেলতো।ভাইয়াকে বাইক এক্সিডেন্ট করিয়েছে আপুকে দুর্বল করতে।রাহাদ ততক্ষণ কোনো ক্ষতি করবেনা যতক্ষণ ওর বিরুদ্ধের প্রমান গুলো আমরা পুলিশকে দিবোনা।কল করে এমন কিছুই বলেছে।বুঝতে পারছিনা কি করবো।’
জান্নাত মহুয়ার কথা শুনে আরও চিন্তিত হয়ে পরে।আরমানের চিন্তা তার মাথায় আসে।আরমানের কোনো ক্ষতি করবেনা তো।দুদিন হলো আরমানের সাথে তেমন ভাবে কথা হয়না জান্নাতের।শুধু আরমানের দুপুরের খাবার ব্রেকে হালকা একটু কথা হয়েছে গতকাল।জান্নাতকে চিন্তিত দেখে মহুয়া বলে উঠে,
‘ঢাকায় চলে যাও।আরমান ভাইয়ার সেফটি দরকার।তুমি থাকলে আমার এদিকে একটু সুবিধা হবে।যা করবো সব সোজাসাপ্টা। ভয় থাকবেনা কোনো।’
জান্নাত উঠে দাড়ায় মহুয়ার কথায়।কিছু বলেনা হনহনিয়ে দরজাটা খুলে চলে যায় নিজের ঘরে।মহুয়াও উঠে দাড়ায়,বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরোয় মহুয়ার।সেও বাইরে বের হয়।নাজমা বেগম সেই মুহুর্তে উঠোনে প্রবেশ করেন।তার মুখে চিন্তার ছাপ।চোখের কান্নার পানি।মহুয়া এগিয়ে এসে জিগাসা করে,
‘কি হইছে আম্মা?কাদতেছেন ক্যা? আপনে এত চিন্তিত কি নিয়ে?’
‘তোমার শ্বশুরে গন্জে দোকানের মাল আনতে যাইতে সময় গাড়ি ধাক্কা দিছে মহুয়া।সাইফ লগে ছিলো বইলা হাসপাতালে নিছে।আমারে একটু শহরে নিয়া যাবা মহুয়া।জানিনা মানুষটার কি অবস্থা। ‘
মহুয়ার প্রশ্নে ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেদে দিয়ে কথাটা বলেন নাজমা বেগম।মহুয়া স্তব্ধ মেরে দাড়িয়ে রয়েছে। এটা কি হলো!শেষে কিনা তার বাবার সমতুল্য লোকটাকেও ছাড়লোনা রাহাদ।রাগে ক্ষোভে মহুয়ার ইচ্ছে করছে রাহাদকে খুন করতে।জান্নাত কান্নার শব্দ পেয়ে বাহিরে আসে।শ্বাশুড়ি আর জা-কে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে।তার সাথে সাথে মনিরা বেগমও বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে।জান্নাত কি হয়েছে জানতে চাইলে মহুয়া সব জানিয়ে দেয়।সব শুনে জান্নাতের মনে আরমানকে নিয়ে আরও ভয় জেকে ধরে।সে তার শ্বাশুড়িকে জানায় তাকে এই মুহুর্তেই ঢাকায় যেতে হবে।একের পর এক ক্ষতি হচ্ছে একেকজনের।আরমানেরও না কিছু হয়ে যায়।সে দৌড়ে গিয়ে ঝটপট রেডি হয়ে আসে ব্যাগ নিয়ে।নাজমা বেগম
জান্নাতের কথার আগামাথা কিছুই বুঝলেন না।তবুও ছেলের কথা ভেবে জান্নাতকে বাধা দিলোনা
জান্নাত সবাইকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পরে ঢাকার উদ্দেশ্যে।মহুয়া আর মনিরা বেগম নাজমা বেগমকে ধরে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিলেন।মহুয়াও জানায় সে হাসপাতালে যাবে।মনিরা বেগমকে নাজমা বেগমকে দেখে রাখার দায়িত্ব দিয়ে সে নিজের ঘরে গিয়ে বোরখা পরে রেডি হয়ে নেয়।রেডি হয়ে উঠোনের দরজায় চেনাপরিচিত মানুষটাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে।মহুয়া শীতের মধ্যেও ঘামতে শুরু করেছে।মানুষটা তৃষ্ণার্ত পথিকের নেয় নিকাবের ফাকে বের হয়ে থাকা চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।মানুষটার পাশে রিহানকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আরও বেশি অবাক হয় মহুয়া।পা যেন চলেনা তার।মানুষটাই তার দিকে এগিয়ে আসছে।মনিরা বেগম নাজমা বেগমের জন্য পানি আনতে বাইরে আসলে মামুষটাকে দেখে চিৎকার করে উঠে।দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে উঠে,
‘আরফাজ ভাই আমার তুই আইছোস!আমার বিশ্বাস হয়না ক্যা রে দাদু! ‘
মানুষটা আরফাজই।সে দাদীর কথা শুনে মৃদু হাসে।রিহান পাশ থেকে বলে উঠে,
‘হ্যা দাদী ওটা তোমার আরফাজ দাদু।’
#মন_মহুয়ায়_শূণ্যতা
#পর্বঃ১৪
#Tasfiya_Nur
রান্নাঘরে আজ রান্নার ধুম লেগে গেছে। সবই আরফাজের পছন্দের খাবার। রাত নয়টা বেজে আসছে তবু রান্না শেষ হওয়ার খবর নেই।মহুয়ার হাত চলছেনা আজ।আরফাজ, রিহান,সাইফ আর আরমান বসে আছে বারান্দায়। সেখান থেকেই বিভিন্ন দরকারে কলপাড়ে পানি আনতে গেলে আরফাজের সাথে চোখাচোখি হচ্ছে মহুয়ার।একারণেই হয়তো আজ সে ধীরস্থির হয়ে গেছে। প্রচুর অসস্থিও হচ্ছে তার।জান্নাতও আজ কাজে অনেকটা সাহায্য করছে।জান্নাত ঢাকা শহরে গিয়ে পৌছাতেও নাজমা বেগম খবর দেন আরফাজ বাড়ি ফিরেছে।আরমানকে নিয়ে যেন বাড়িতে ফিরে আসে।শুক্রবার বিধায় আরমান বাসায় থাকাতে জান্নাতের সাথে তৎক্ষনাৎ ফিরে আসে ভাইয়ের খবর শুনে।একটা বছর পর ভাইকে দেখে শান্তি লাগছে আরমানের।সাতটায় বাড়ি এসে পৌছেছে আরমান আর জান্নাত। আসার সময় সাইফের সাথে যোগাযোগ করে আরিফুল শিকদারকে বাড়িতে এনেছে।আনন্দের জোয়ার বইছে আজ শিকদার বাড়িতে।এতসবের মাঝেও একটা কিন্তু কাজ করছে সবার মাঝে।শুধু আরফাজের কথায় চুপ আছে সবাই।আরফাজকে সবাই যখন প্রশ্ন করছিলো কোথায় ছিলো সে এতদিন কিন্তু আরফাজ সবাইকে চুপ থাকতে বলেছে আর সে ফিরে এসেছে এটা বাড়ির মানুষের মাঝে যেন আবদ্ধ থাকে এটাও বলে দিয়েছে।কিন্তু কথা থেমে থাকে কিভাবে, শিকদার বাড়ির বড় ছেলে ফিরে এসেছে এটা বাতাসের বেগে বোধ হয় গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে।যার দরুন গ্রামে এখন সবার মুখে একটাই কথা বিদ্যমান আরফাজ ফিরে এসেছে।কিন্তু এতদিন কই ছিলো!নিজেকে মৃত বলে সবাইকে জানিয়ে বেচে আছে কিভাবে! সবার মুখে প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে।যার ফলস্বরূপ সন্ধ্যা অব্দি গ্রামের লোকজন বাড়ি বয়ে এসে আরফাজকে দেখে যাওয়ার সাথে সাথে প্রশ্ন গুলোও করেছে।কিন্তু ফলাফল শূণ্য ব্যতিত অন্য কিছু পায়নি কেউ।
রাত দশটায় সবাইকে খাবার টেবিলে বসতে ডাক দেয় জান্নাত।মহুয়া সবাইকে খাবার পরিবেশন করে দিয়ে দাড়িয়ে থাকে এক সাইডে।বাড়ির কর্তা-ছেলেদের খাওয়া হলে বাড়ির বউরা সব খেতে বসবে।যথারীতি ওদের খাওয়া হলে মহুয়া সবাইকে নিয়ে খেতে বসে। ওদিকে আরফাজ খেয়ে উঠে রিহানকে নিয়ে সবার অগোচরে বাইরে বের হয়।এটা কেউ খেয়াল না করলেও জান্নাতের নজর এড়ালো না।মহুয়া জান্নাতের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেও ব্যাপারটা খেয়াল করলো।তবুও চুপচাপ খেয়ে উঠে সব গুছিয়ে যে যার রুমের দিকে চলে যায়।নাজমা বেগম আরফাজের কথা মহুয়াকে জিগাসা করলে মহুয়া ভুলভাল বুঝিয়ে সব ম্যানেজ করে নিয়ে চলে যায় ঘরে।সারাদিন একটার পর একটা ঘটনা দেখে ক্লান্তিতে চোখ জুড়ে ঘুম নামে তার।
💙💙
নদীর ধারে রাহাদ আর শিখার মুখোমুখি হয়ে দাড়িয়ে আছে আরফাজ আর রিহান।শিখার মুখে স্পষ্ট চাপা যন্ত্রণার ছাপ।রিহান পা বাড়ায় শিখার পানে।শিখা তা দেখে দু কদম পিছিয়ে যায়।রিহান থমকে দাড়ায়।সে তো ধোয়াশাকে ধরতে পা বাড়িয়েছে, সেজন্যই কি শিখা পিছিয়ে গেলো?ভেবে পাচ্ছেনা রিহান।আরফাজ আর রাহাদ ওদেরকে দেখে যাচ্ছে।আরফাজ ওদের প্রাইভেসি দেওয়া দরকার ভেবে রাহাদের হাত ধরে নদীর কিনার ঘেষে হাটতে শুরু করে।রাহাদ শুধু ভ্রু কুচকে সব দেখে যাচ্ছে।প্রথমত আরফাজ সাতদিন পর কই থেকে উদয় হলো সে বুঝতে পারছেনা,আবার শিখার সাথে যোগাযোগ করে আজ সরাসরি দেখা করছে রাহাদের সাথে।সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে রাহাদের।সাতটা দিন হলো তন্নতন্ন করে খুজেছে সে আরফাজকে তবুও পায়নি।রাহাদের তাকিয়ে থাকা দেখে আরফাজ বলে উঠে,
‘ভাবছো কোথায় ছিলাম এতদিন? তোমাদের আশেপাশেই। জানোয় তো মানুষ নিজের গুহায় শত্রুর খোজ করেনা।ভাবে শত্রু তার থেকে দূরে। অথচ শত্রু তার ঘরেই থাকে।আমিও কোথাও না শিখার বাড়িতেই ছিলাম আন্টির রুমে।অথচ শিখা আমায় পুরো ঢাকা শহর লড়িয়ে খুজেছে।বাই দ্যা ওয়ে মেইন পয়েন্টে আসি।এসব খারাপ কাজ ছাড়বে কি ছাড়বেনা বলো?’
রাহাদ আরফাজের কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠে।আরফাজ এবার বিরক্তি নিয়ে রাহাদের দিকে তাকায়।ঠাটিয়ে চর মারতে মন চাচ্ছে ওর।কিন্তু যা পরিস্থিতি তা ঠান্ডা মাথায় সামাল দিতে হবে। আরফাজ রাহাদের হাসি থামলে আবারও বলে উঠে,
‘পাগলের মতো হাসা শেষ।তো শুনো আমার কথা।খারাপ কাজ ছাড়ো আর না ছাড়ো তোমার পারসোনাল সমস্যা। শুধু আমার পরিবার,আমার শ্বশুরবাড়ি আর আমার বোন দুটোকে বিপদে ফেলোনা।আমরা তোমার কাজে বাঁধা হয়ে দাড়াবোনা।তুমি আমাদের জীবনে বিপদ আনবেনা আমরাও আর তোমার কাজে বাধা হবোনা।’
‘ডিল করছো আমার সাথে? কিন্তু আমি যা চাই তাতো আমার চাই-ই।আমার দরকার ক্ষমতা।এই সুকনপুর গ্রামের অর্ধেক জায়গা সম্পত্তি মানুষদের জীবিকা কন্ট্রোল করে তোমার বাবা আর আমার শ্বশুর মশাই আরিফুল শিকদার। আমাকে সেইসব কিছু হস্তান্তর করতে হবে।এতে আমার কাজগুলোর অনেক সুবিধা, যখনতখন যেখানে খুশি আমার লোক পাঠাতে পারবো। যাই হোক রাজী তুমি এতে?হলে বলো তাহলে আমি সবার জীবন থেকে বিপদ সরিয়ে দিবো।’
রাহাদ উত্তর দেয় আরফাজের কথায়।আরফাজ শুনে হাসিমুখে বলে উঠে,
‘ ওকে ডান,দুদিন পর শিকদার বাড়িতে উৎসব হবে। উৎসবটা হবে আমি ফিরে আসার আনন্দের আর তোমার হাতে আমাদের জায়গা জমি আর বাবার ব্যবসাটা তুলে দিবো।রিঠীসহ পুরো পরিবারকে নিয়ে চলে আসবে ওকে।আমি আর রিহান শিখাকে নিয়ে যাই তবে।আর হ্যা আমরা যা জেনেছি তা আমাদের জানার মাঝেই বন্দী রাখবে। বেশি লোক জানাজানির দরকার নেই।আমার কাছে আমার কাছের মানুষ গুলো আগে।খেয়েপরে বাচলেই হলো।এত ক্ষমতা আমাদের লাগবেনা।দুদিন পর আমরা স-পরিবারে ঢাকায় চলে যাবো।তুমি তোমার কাজ চালিয়ে যাও সমস্যা নেই।’
রাহাদ খুশি হয়ে যায় আরফাজের কথায়।শিখা আর রিহান ওদের মাঝে কথা শেষ করে আরফাজ আর রাহাদের কাছে আসছিলো বিধায় তারাও আরফাজের কথা শুনতে পায়।রিহান বিশ্বাস করতে পারছেনা আরফাজের জুড়ে দেওয়া শর্ত।শিখাও ভেবেছিলো এবার অন্তত রাহাদের পাপের রাজ্য ধ্বংস হবে।কিন্তু কি হচ্ছে এগুলো!আরফাজ শিখা আর রিহানকে দেখে ওদের সাথে নিয়ে বাড়ির দিকে চলে যেতে পা বাড়ায়।
রাহাদ ওখানেই দাড়িয়ে রয়।তার বুকের মাঝে দীর্ঘশ্বাস। সে কি করে বুঝাবে সে নিজেও ভালো হতে চায়। রিঠীকে নিয়ে সুখে শান্তিতে ঘর সংসার করতে চায়।সে তো আর খারাপ হয়ে জন্ম নেয়নি। কেউ-ই তো খারাপ হয়ে জন্মায় না।তাকে খারাপ পথ প্রদর্শন করেছে বলেই সে আজ খারাপ পথে।আর সে কি করে বুঝাবে তার খারাপ হওয়ার পিছনে স্বয়ং তার বাবার হাত রয়েছে। পুরোনো শত্রুতার জের ধরে তাকে নামিয়ে দিয়েছে এই খারাপ জগৎ এ।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখের কার্নিশে জমা পানিটুকু মুছে নেয় রাহাদ।হোক সে খারাপ তবু তো মানুষ। অনুভূতি তো তারও আছে।তাহলে খারাপ হওয়ার পালা শুধু তার কপালেই কেনো?এতগুলো প্রশ্ন কোথায় গেলে উত্তর মিলবে এর!
💙💙
রাত একটা বাজে রিহান আর শিখাকে রিহানের চাচার বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে নিজে বাড়িতে আসে।উঠোনের গেটটা খোলা ছিলো বলে খুব সহজেই বাড়িতে ঢুকতে পারে আরফাজ।জান্নাত বারান্দায় বসে ছিলো।এতরাতে জান্নাতকে জেগে থাকতে দেখে আরফাজ অবাক হয়।জান্নাত আরফাজকে আসতে দেখে বসা থেকে দাড়িয়ে যায়।আরফাজ উঠোনে তখনও দাড়িয়ে।জান্নাত আরফাজের সামনে দাড়িয়ে বলে উঠে,
‘সে কেমন আছে স্যার?খুজে তো পাইনা আর।সে আমার জীবনের গল্পটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাড়িয়ে আছে স্যার।পারছিনা আর সহ্য করতে না পারছি আপনার ভাইকে মেনে নিতে।’
‘শক্ত হও জান্নাত। আগেও বলেছি এখনও বলছি আরফাজ চৌধুরী বড়লোকের বিগরে যাওয়া সন্তান।আমি শত চেষ্টা করেও পারিনি ভালো করতে।সে এখন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে আছে।’
‘আমি তো জানতাম না স্যার সে ড্রাগস এডাক্টেড।জানলে ভালোবাসা কেনো ঘৃণার অনুভূতিও আসতোনা।জীবনের সবথেকে বড় ভুল শিখা ম্যামের কোচিং সেন্টারে ভর্তি হওয়া।না ওখানে ভর্তি হতাম, না তার দেখা পেতাম, না সে আমার মনে জায়গা করে নিতো।মানুষ আর খুজে পাইনি দুনিয়ায় ঐ অনুভূতিহীন পাথরকেই আমার ভালোবাসতে হয়েছিলো।’
‘অতীত যেমনই হোক সেটা অতীতেই সুন্দর জান্নাত।সেসব বাদ দিয়ে আরমানের সাথে সংসারে মনোযোগ দাও সুখী হবে।বিশ্বাস করো আমার ভাইটা এতটাও খারাপ না যে তোমায় সুখ দিতে পারবেনা।চেষ্টা তো করেছিলাম বলো।আমার নামে নাম দেখে টিচার হয়েও ওকে বন্ধুর মতো মিশে তোমার রিকুয়েষ্টে আমি ভালো হতে বলেছি। কিন্তু আমি তো এটা জানতাম না আরফাজকে ড্রাগস শিখা দিতো।বিনিময়ে মোটা অংকের টাকা নিতো।’
‘শিখা ম্যাম!মানে কি বলছেন এসব স্যার?’
‘দুদিন পর ধামাকা হবে বাড়িতে তখন সব জানতে পারবে জান্নাত, ধৈর্য ধরো।মাঝেমধ্যে শিখার কোচিং সেন্টারে ক্লাস করিয়েছি বলে শিখা অনেক ফাকি দিয়েছে আমায়। রাহাদের সাথে মিলে ও নিজেও ছিলো খারাপ কাজে যুক্ত।আমি যতটুকু জানি মহুয়ার সাথে তুমিও প্রায় সব ইনফরমেশন কালেক্ট করতে সাথে ছিলে তাই জানালাম।মাঝখানের সাতদিনে অনেক খোজ নিয়ে সবটা জেনেছি।এসবে হেল্প করেছে রিহান আর মহিমা।এখন যদি বলো মহিমার খোজ কোথায় পেলাম,তাহলে বলবো মহিমার সাথে মহুয়ার মিল আমি বিয়ের শুরু থেকে লক্ষ্য করেছি।মহুয়ার খোজ নিতে গিয়ে মহিমাকে খুজে বের করেছি তারপর সব জানতে পারি।এখনসব শেষ হওয়ায় অপেক্ষায়।যাই হোক শুনো দুদিন পর বাড়িতে উৎসব হবে।বাট সেই অনুষ্টানে তুমি থাকবেনা সাথে আরমানও থাকবেনা।আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি আর আমার শ্যালক সহ তুমি যাবে তোমার বাবার বাসায়।’
আরফাজের কথায় একের পর এক অবাক হয় জান্নাত।তারপর জিগাসা করে উঠে,
‘বাট আমরা কেনো থাকবোনা স্যার?আর আমরা না থাকলে সন্দেহ থাকবে তো রাহাদের!’
‘সেই সুযোগ আমি দিবোনা।কেনো থাকবেনা এটা জানিয়ে দিবো পরে।আর সন্দেহ করার মতো সুযোগ রাহাদ পাবেনা।সেটা আমি দেখে নেবো।তুমি যাও ঘুমাও।এতরাত অব্দি যে জেগে আছো?আরমান কি টের পায়নি ওর বউ ওর পাশে নেই?’
এতক্ষণ আরফাজের সাথে কথা বলতে লজ্জা না লাগলেও এতক্ষণে হালকা লজ্জা লাগছে জান্নাতের।কিন্তু উত্তর না দিলেও তো চলবেনা।আরফাজ মিটমিটিয়ে হাসছিলো এতক্ষণ। জান্নাতকে ইতস্তত হতে দেখে সে বলে উঠে,
‘আরে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।আমাকে ভাসুর বা স্যার নয় বড় ভাই ভেবে।সব শেয়ার করবে ওকে।যেমনটা আগেও করেছিলে।মনে রেখো সবকিছুতেই বিশ্বাসটা জরুরি।’
‘হুম বুঝেছি আমার বড় ভাইয়া।আসলে আরমান মাথা ব্যাথা করছিলো বলে হালকা ডোজের ঘুমের ওষুধ খেয়েছে, তাই ঘুমোচ্ছে। আমার আপনি আর রিহান ভাইয়া চলে গেলেন দেখে একটু চিন্তা হচ্ছিলো তাই গেট খুলে বসে ছিলাম।মহুয়া ভাবী তো টায়ার্ড ছিলো তাই ঘুমিয়ে গেছে।আপনিও রুমে চলে যান।’
মহুয়ার নাম শুনে মহুয়ার কথা মাথায় আসে আরফাজের।সে জান্নাতকে গুড নাইট বলে রুমের দিকে চলে যায়।জান্নাতও নিজের রুমে চলে যায়।দরজাটা বন্ধ করে আরমানকে একপলক দেখে নিয়ে কম্বলের নিচে ঢুকে যায়।আরমানের বুকের সাথে লেপ্টে শুয়ে ঘুমিয়ে যাও।
অন্যদিকে আরফাজ মহুয়ার সামনে হাটুমুড়ে বসে একনাগারে দেখে যাচ্ছে।কতগুলো পর সে তার প্রেয়সীকে কাছ থেকে দেখছে।কে বলবে এই বাচ্চা মেয়েটার মধ্যে এত কষ্ট চেপে কত মানুষের কথা হজম করে শুধু মাত্র তার পরিবারকে বাচাতে এখানে পরে আছে।আরফাজ উঠে দাড়ায়,মহুয়ার পাশে শুয়ে পরে।মেয়েটা গুটিশুটি হয়ে কম্বলের নিচে ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে।আরফাজ হেচকা টানে তার কাছে টেনে নেয়।মহুয়ায় ঘুমের তালে হাত পা ছুড়াছুড়ি শুরু করে।আরফাজ মৃদু হাসে।মহুয়ার বাচ্চামি স্বভাব এখনও যায়নি।আগেও এমন বুকের মাঝে নিতে চাইলে হাত পা ছুড়াছুড়ি করতো।আরফাজ মৃদুস্বরে ধমকে উঠে মহুয়াকে।মহুয়া চোখ পিটপিটিয়ে তাকায়।আরফাজকে দেখে ঠোট উল্টে কেদে দেয়।আরফাজ তা দেখে হতভম্বের ন্যায় তাকিয়ে রয়।সে কি এমন করলো যে মহুয়া কেদে দিলো।মহুয়া নিজে থেকেই এবার আরফাজের বুকের মাঝে সিধিয়ে যায়।তারপর ফুপিয়ে বলে উঠে,
‘আপনাকে আমি আগেও বলেছি আরফাজ সাহেব, আপনি হীন এই আমি খুবই নিঃস্ব আর কম দামী।এভাবে দূরে চলে কেনো যান?আর যাবেন না বলুন।আমি মরেই যাবো একদম।’
আরফাজ হাসে, আজ তার খুশির দিন।অবশেষে তার ভালোবাসা সফল হতে চলেছে।এখন শুধু সব ঠিক হওয়ার অপেক্ষা।
চলবে?