#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ১৫
-মিসেস স্পৃহা হয়তো আর কখনোই মা হতে পারবেন না!
কথাটা বারবার কানে বাজছে আদ্রের। দুই হাতে নিজের চুল আঁকড়ে ধরে বসে আছে সে। এই সত্যিটা কীভাবে মেনে নেবে ও? ভাবতেই নিজেকে নিঃস্ব মনে হচ্ছে আজ। সে কখনো পিতৃত্বের আনন্দ উপভোগ করতে পারবে না। অথচ কতো স্বপ্ন ছিল তার! ঘর আলো করে একটা এঞ্জেল আসবে, তাকে সে নিজের বুকে আগলে রাখবে সবসময়, নিজের আঙুল ধরিয়ে হাঁটা শেখাবে, কথা বলা শেখাবে- এসব শুধু স্বপ্ন-ই রয়ে যাবে আজীবন। কোনোদিনও বাস্তব রূপ নেবে না। এই ভয়ংকর সত্যটা আদ্র যেন মানতেই পারছে না। ফুপিয়ে কেঁদে উঠে নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
-এমনটা কেন হলো, মা? কেন হলো? কী পাপ করেছিলাম আমি যার জন্য আমায় এতো বড় শাস্তি পেতে হলো?
মিসেস সামায়রা গম্ভীর ভাবে বসে আছেন। তার মৌনতা দেখে আদ্র আবার বললো,
-চুপ করে আছো কেন? আমি কোনোদিন বাবা হতে পারবো না, এর থেকে বড় শাস্তি আর কী হতে পারে?
-তুই বাবা হতে পারবি না, এটা কে বললো? সমস্যা তো স্পৃহার! তোর তো কোনো সমস্যা নেই!
আদ্র কান্না থামিয়ে অবাক চোখে তাকালো। বিস্মিত কন্ঠে বললো,
-এসব তুমি কী বলছো? স্পৃহা আমার স্ত্রী। ও মা হতে না পারলে আমি কীভাবে বাবা হবো? আর তাছাড়া …
-তোর বউকে তুই অনেক ভালোবাসিস সেটা আমি জানি। কিন্তু ভাগ্য এখন এমন জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে যে, তোকে যেকোনো একটা দিক বেছে নিতে হবে। হয় স্পৃহাকে, নয়তো পিতৃত্বের সুখের জন্য ওকে ছেড়ে আরেকটা বিয়ে করতে হবে।
আদ্র স্তব্ধ হয়ে গেল! ওকে এমন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিসেস সামায়রা ম্লান হেসে বললেন,
-স্পৃহা খুবই ভালো একটা মেয়ে। তুই ওকে অনেক ভালোও বাসিস। তাই আমার মনে হয় না এই একটা কারণের জন্য তোর ওকে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে! তবে জীবনটা যেহেতু তোর, সিদ্ধান্তটাও তোর-ই হওয়া উচিত। তোর কাছে যেটা প্রাধান্য পাবে, তুই সেটাই করবি। এখন ভেবে দেখ কী করবি?
থম মেরে বসে আছে আদ্র। এ কেমন গোলকধাঁধায় পড়েছে সে? স্পৃহা নয়তো বাচ্চা, যেকোনো একটা বেছে নিতে হবে তাকে। তবে তার তো দুটোই চাই! পরিস্থিতি কোথা থেকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে তার জীবনটাকে! গতদিনও এই ধরনের কথা কল্পনায় আনতে পারতো না সে। আর আজ! এখন স্পৃহার বলা সেই কথাগুলো কান বাজছে আদ্রের …
•
[-আপনার খুশিতেই আমি খুশি। আপনার হাত ধরেই আজীবন বাঁচতে চাই। অতীতের সবকিছু ভুলে নতুনভাবে বাঁচতে চাই আমি। আপনি সবসময় ভালোবাসবেন তো আমায়?
-ভালোবাসি, স্পৃহা। ভবিষ্যতেও বাসবো!
স্পৃহা জোরে একটা শ্বাস নিয়ে বললো ,
-ব্যাস! আমায় কখনো দূরে ঠেলে দেবেন না, মাঝপথে আমার হাত ছেড়ে চলে যাবেন না আর আমায় ভুলে যাবেন না।
আদ্র স্পৃহাকে সোজা করে ওর গালে হাত রেখে অবাক কন্ঠে বললো,
-এসব কী বলছো তুমি? আমি তোমায় ভুলে যাবো কেন?
-ভয় হয় আমার। বাস্তবতাটা ভয়ংকর রকমের নিষ্ঠুর! কখন, কোথায়, কীভাবে, কোন পরিস্থিতিতে মানুষকে দাঁড় করায়, সেটা আপাতদৃষ্টিতে বোঝা যায় না।
আদ্র স্পৃহার দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
-সেরকম কোনো পরিস্থিতি আসবে না। আর এলেও… তখন আমি তোমায় দূরে ঠেলে দেবো না। ভরসা আছে আমার ওপর?
স্পৃহা মলিন হেসে বললো,
-আপনার ওপর ভরসা আছে বলেই তো এখনো বেঁচে আছি আমি। এই বিশ্বাসটা কখনো ভাঙবেন না। আমার অনুরোধ রইলো। আপনি বিশ্বাস ভাঙলে এবার আমার কী হবে জানি না। শুধু এটুকুই জানি যে… আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে, আদ্র। ]
•
কথাগুলো ভাবতেই আদ্রের ভেতরটা ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে যেন! ভাবনা-চিন্তারা সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। বারবার চোখ ভিজে উঠছে তার। স্পৃহার সামনে দাঁড়ানোর সাহসটাও ও পাচ্ছে না, আর না পারছে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে।
___________________________
কপল বেয়ে অনবরত গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ নোনাজলের ধারা। বেডে হেলান দিয়ে নিঃশব্দে ও নিষ্পলক চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে স্পৃহা। মুখে কোনো কথা নেই, কোনো কথা বলার ইচ্ছেও নেই।
-আমি চাই না তুই আর ঐ বাড়িতে গিয়ে সংসার কর!
স্পন্দনের বলা গাম্ভীর্য পূর্ণ কথাটা শুনে স্পৃহা নড়েচড়ে উঠলো। চোখ ঘুরিয়ে স্পন্দনের ক্রোধান্বিত মুখের ওপর দৃষ্টি স্থাপন করে কম্পিত স্বরে বললো,
-মানে?
-মানে এটাই যে, ঐ বাড়িতে আর তোকে পাঠাচ্ছি না আমি। যেখানে তোর কোনো যত্ন নেই, কোনো মূল্য নেই, কোনো স্নেহ নেই ; সেখানে আমি তোকে যেতে দেব না। পারলে আদ্রকে বল তোকে আলাদা রাখুক!
স্পৃহা হতভম্ব হয়ে বললো,
-ভাইয়া, এসব কী বলছো তুমি? আমাকে আলাদা কেন র্…
স্পন্দন রাগী গলায় বললো,
-দেখ, একদম ন্যাকামি টাইপ কথা বলবি না এখন! তোর শাশুড়ী তোকে একবেলা শান্তি দিয়েছে এতো দিনে? আর আদ্র! ওর মতো ব্যক্তিত্বহীন মানুষ আমি দুটো দেখিনি। নিজের মাকে বিশ্বাস করে, ভালোবাসে, এটা ঠিক আছে। কিন্তু অন্ধবিশ্বাস কেন করবে? অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিছু না বলে মুখ বন্ধ কেন রাখবে?
স্পৃহা অবাক হয়ে বললো,
-তুমি এসব কীভাবে জানো?
-সবটাই জানি। এতো যত্নে তোকে বড় করেছি আমি! তোকে শশুর বাড়ি পাঠিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে নাকি? তোর প্রতি মুহূর্তের আপডেট আমি নিতাম। সো, এখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আমি। ঐ বাড়িতে আর মরতে পাঠাবো না আমি।
-কিন্তু ভাইয়া, আমি আদ্রকে বলতে পারবো না, আমায় আলাদা রাখতে আর.… এটা অন্যায় হবে।
স্পন্দন দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-হলে হোক অন্যায়! তোর জীবন বাঁচাতে এসব ছোট খাটো অন্যায় করতে আমার বাঁধবে না।
স্পৃহা চোখ বন্ধ করে নিল। স্পন্দনের কথাগুলো এখন ওর গায়ে কাঁটার মতো বিঁধছে। চোখ বন্ধ রেখেই বললো,
-ভাইয়া, আমি জানি, তুই আমার ব্যাপারে অনেক সেনসিটিভ। কিন্তু এতো ডেস্পারেট কেন হচ্ছিস?
স্পন্দন হাতে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বসলো। শক্ত চোখে স্পৃহার দিকে তাকিয়ে বললো,
-তোকে ছোট থেকে বুকে আগলে বড় করেছি, পিহু। তোর কিছু হলে আমার কী অবস্থা হতো, তুই কল্পনা করতে পারবি? সেই তোকেই দুদিন আগে ওমন অবস্থায় দেখে আমি কীভাবে সহ্য করেছি একবার ভেবে দেখ! মৃত্যুর মুখ থেকে বেচে ফিরেছিস তুই।
বলেই ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো স্পন্দন। নিজেকে ধাতস্থ করে আবার বললো,
-কী দরকার ছিল আদ্রকে বিয়ে করার? আহির বিয়ে করেছে বলে তোকেও বিয়ে করতে হবে? আমি তো জানতাম আহির একাই তোকে ভালোবাসে! কিন্তু পরে বুঝলাম, তুইও ওকে ভালোবাসতি। একবার আমার সাথে শেয়ার করতে পারতি সবটা!
স্পৃহা ফট করে চোখ খুলে ফেললো। বিস্ময়ভরা চাহনিতে তাকিয়ে রইলো স্পন্দনের রাগী চেহারার দিকে। স্পন্দন আগে থেকেই সবটা জানতো? ভাবতেই অবাক লাগছে ওর। ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্পন্দন থমথমে গলায় বললো,
-তোকে আর কোনো ভুল করতে দিচ্ছি না আমি। তুই স্বেচ্ছায় মানলে তো ভালোই, আর না মানলে জোর করে হলেও আমার কাজ করে ছাড়বো আমি। হয় আদ্র নিজে তোর দায়িত্ব নেবে, নয়তো সম্পর্কটার ইতি টানবি তুই!
স্পৃহা স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-অসম্ভব! আমি আদ্রকে ছাড়তে পারবো না।
স্পন্দন তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
-তোর ছাড়তে হবে না। এমন যদি হয়, আদ্রই সম্পর্কটা ভেঙ্গে দিলো!
কথাটা শুনে স্পৃহা চমকে উঠলো। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-এমনটা কখনো হবে না! আর হলে আমি তোমার কথাই মেনে নেব।
স্পন্দন কিছু বলার আগেই আদ্র কেবিনে এলো, আর তার পেছনে মিসেস সামায়রাও প্রবেশ করলেন। তাদের দুজনকে দেখে স্পন্দন দাঁত চেপে রাগ দমিয়ে বসে রইলো। আদ্র এগিয়ে গিয়ে স্পৃহার পাশে বসলো। স্পৃহার চোখে এখনও পানি জমে আছে। ওর মাথায় হাত রেখে বললো,
-ইউ উইল হ্যাভ টু বি স্ট্রং, স্পৃহা। এভাবে কেঁদো না!
স্পন্দন গম্ভীর কন্ঠে বললো,
-তোমায় আমার একটা কথা মানতে হবে, আদ্র।
আদ্র জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-কী কথা?
স্পন্দন মিসেস সামায়রার দিকে একপলক তাঁকিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
-ডিরক্ট-ই বলছি। তোমার মা যেভাবে অনাদরে, অবহেলায় আমার বোনকে রেখেছে, সেটা আমি আর টলারেট করতে পারবো না।
আদ্র ভ্রু কুঁচকে নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
-মা স্পৃহাকে অবহেলায় রেখেছে মানে?
মিসেস সামায়রা হকচকিয়ে গিয়ে বললেন,
-ম্ মিথ্যে কথা। আমি তো ওকে দেখেশুনেই রাখতাম।
স্পন্দন হেসে বললো,
-আচ্ছা?? সেটা তো আপনার কথা বলার ধরণ-ই বলে দিচ্ছে কতো দেখেশুনে রাখতেন। সে যা-ই হোক! আমি সাফ কথায় বলে দিতে চাই, আমার বোনের দায়িত্ব নিজ কাঁধে যদি নিতে পারো, ওকে যদি আলাদা রাখতে পারো, তবেই আমি পিহুকে তোমার কাছে পাঠাবো। নয়তো…
আদ্র হতভম্ব হয়ে বললো,
-নয়তো…
স্পন্দন কিছু না বলে ওর সাইড ব্যাগ থেকে তিন পেইজের একটা পেপার বের করে আদ্রের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
-এটায় সাইন করে আমার বোনকে মুক্তি দাও।
আদ্র কাগজটার দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। স্পৃহা ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে আছে। তার বিশ্বাস, আদ্র এটায় সাইন কখনোই করবে না। আদ্র তো তাকে কথা দিয়েছিল! কোনো পরিস্থিতিতেই তাকে ছেড়ে যাবে না।
আদ্র থম মেরে বসে আছে। প্রচন্ডভাবে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সে। স্পৃহাকে ও কীভাবে ছেড়ে দেবে? এটা ভাবলেই নিজেকে অস্তিত্বহীন বলে মনে হয়। জীবন-মরণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখন তাকে। অনেকক্ষণ ভাবনাচিন্তা করার পর, আদ্র ধরা গলায় বললো,
-আমার একটু সময় দরকার। এখনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না আমি।
স্পন্দন বার কয়েক মাথা দুলিয়ে বলল,
-ওকে। টেইক ইয়র টাইম।
#চলবে…
✘কপি করা নিষেধ✘