#অন্তরিক্ষ_প্রণয়
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-৯(১ম অংশ)
ঢাকা আসার পর প্রিয়তা রামিসার বাসায় থাকছে। তিনদিন হয়ে গেছে কিন্তু আকাশ প্রিয়তাকে একটা কলও করেনি। প্রিয়তা বারংবার অপেক্ষা করছে, এই বুঝি আকাশ কল করে বললো সব মিথ্যা ছিল! প্রাংক ছিল সব। কিন্তু না। আকাশ কল করেনি। প্রিয়তা একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে। রামিসা প্রিয়তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করে জোর করে একটু খাওয়াতো পারে। রামিসা প্রিয়তাকে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,
–তোমাকে শক্ত হতে প্রিয়তা। তোমাকে আগে এগিয়ে যেতে হবে। কারো জন্য জীবন থেমে থাকে না। তোমাকে নিজের পরিচিতি গড়তে হবে। বি স্ট্রং। মুভ অন করো।
প্রিয়তা শুধু শুনেই যায়। আরো দিন দুয়েক চলে যায়। প্রিয়তার একদিন হুট করে ব্লিডিং শুরু হয়। শরীরের নিম্নাংশ রক্তে ভিজে উঠছে। প্রিয়তার তখন মনে পড়ে সে প্রেগনেন্ট! এই পাঁচদিন সে ভুলেই গেছিলো যে সে প্রেগনেন্ট। আকাশের কাছ থেকে পাওয়া আঘাত এতোটা গাড়ো ছিল যে সে নিজের মধ্যেই ছিলনা। প্রিয়তা যে আকাশকে এতোটা পাগলের ভালোবাসে তা প্রিয়তা আকাশের সামনে প্রকাশ করতো না খুব একটা। তাদের সম্পর্কে খুঁনশুটি, ভালোবাসা, কেয়ার, চিন্তা সব ছিল। প্রিয়তা যে আকাশের সামান্য অনুপস্থিতিতে কতোটা ছটফট করতো তা সে আকাশের সামনে প্রকাশ করতো না। আকাশকে দেখলেই প্রিয়তার মুখে হাসির ঝিলিক ফুটতো।
“আমরা যখন কাউকে অস্বাভাবিক ভাবে ভালোবাসি তখন তা তার সামনে প্রকাশ করতে দ্বিধা হয় কারন মাঝে মাঝে অতিরিক্ত ভালোবাসা দেখলে বিপরীত পাশের মানুষটা আমাদের স্বাভাবিক করতে বা বিরক্ত হয়ে ছেড়ে যায়।”(পারসোনাল অপিনিয়ন)
প্রিয়তার চিৎকারে রামিসা হৃদয়ের সাথে কথা বলা অবস্থায় দৌড়ে আসে। রামিসাও ভয় পেয়ে যায়। রামিসা হৃদয়কে ফোনে বলে একথা। প্রিয়তা তাড়াহুড়ো করে ক্যাব বুক করে। প্রিয়তা শুধু “আমার বাচ্চা” এটা বলেই যাচ্ছে বিড়বিড় করে। রামিসা জলদি করে হসপিটলে নিয়ে যায় প্রিয়তাকে। হৃদয়, সাগর ও ইফাও সেখানে উপস্থিত হয়।
কিছু সময় পর ডাক্তার এসে বল,
–স্যরি! তার মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। ৯ সপ্তাহের প্রেগনেন্সি ছিল। প্রথম বারো সপ্তাহ ক্রিটিক্যাল। অনেকে প্রেগনেন্সি বুঝতো না পেরে অনেক ভারী কাজ ও স্ট্রেস নিয়ে ফেলে বা খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করে না। তখন মিসক্যারেজ হয়ে যায়। উনাকে কেবিনে দেওয়া হবে। উনি একটু বেশি দুর্বল।
প্রিয়তা নিজেও মেডিকেল স্টুডেন্ট। সে সবার বিহেভিয়ার ও নিজের অবস্থা কল্পনা করে বুঝে যায় যে তার বেবিটাও আর নেই। সবাই তাকে একা করে দিয়েছে। প্রিয়তা পুরো বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে একটা শব্দও করেনা। এক ধ্যানে কি যেনো ভাবতে থাকে।
পরেরদিন প্রিয়তাকে রামিসা নিজের বাসায় নিয়ে আসে। রামিসা প্রিয়তার মূর্তির মতো অবস্থা দেখে কান্না করে। ইফারও কান্না করে খারাপ অবস্থা। আর প্রিয়তা! সে তো পাথর হয়ে বসে আছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
দুইদিন এভাবে থাকলেও তৃতীয়দিন প্রিয়তা কোন ফাঁকে বেরিয়ে যায় কেউ বুঝতে পারেনা। এরপর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে আর সবাইকে ইশারাতে কিছু বলার চেষ্টা করে কিন্তু কেউ বুঝেই না। খাবার চুরি করে খায়। তারপর দেখা পায় নিয়ন ও রাত্রির।
_______________________________________________
বর্তমান,,
নিয়ন ও রাত্রি সব শুনলো। ওদের দুজনের চোখেই পানি চলে এসেছে। ওরা তিনজন এখন রাতারগুলের ওয়াচ টাওয়ারে উঠেছে। অনেক উঁচু টাওয়ার। সেখান থেকে রাতারগুলের পুরো ভিউ পাওয়া যায়।
নিয়ন মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসে। কারন আকাশ প্রিয়তাকে যতোটা ভালোবেসেছে সেই লাস্ট ইন্সিডেন্টের আগে তার মতো নিয়ন নিজেও ভালোবাসে না। সবার ভালোবাসার ধরন এক না। প্রিয়তার মুখ থেকে প্রিয়তার জানা দিকটা শুনে নিয়নের মনে সন্দেহ হয়, “আকাশ এমনটা একদিনে কেনো করবে?”
রাত্রি জিজ্ঞাসা করেই বসে,
–তোমার কাছে কি আকাশের বন্ধুরা আকাশের মেহেরকে বিয়ে নিয়ে কিছু বলেনি? মানে ওদের বন্ধু রাতারাতি বিয়ে করে ফেলল আবার ওরাই তোমাকে ঢাকা নিয়ে গেল! ব্যাপারটা আমার কেমন জানি লাগলো।
প্রিয়তা অথৈজলের দিক থেকে নজর সরিয়ে সুবিশাল অন্তরিক্ষে তাকিয়ে সগোউক্তি করে,
“সে ভালোবাসুক বা না বাসুক, আমার অন্তরিক্ষে আমি শুধু তার প্রণয়িনী হয়ে থাকতে চাই। তার ভালোবাসার কিছুটা অংশীদার আমিও। হয়তো সব ছিল ছলনা! তবে আমার হৃদয় আজও তার জন্য। ছলনা করলেও যে এতোটা ভালোবাসা যায় তা সত্যি কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। একদিনে কিভাবে সে আমায় ভুলে গেল! কিভাবে আমায় দূরে ঠেলে দিল তা আজও ধোঁয়াশা। তার প্রণয়ের ছলনায় আমি পাগল হলাম। হারালাম নিজের স্বত্তা।
একটা সত্য,
তার থেকে পাওয়া কিছু অমূল্য প্রণয়ের অনুভূতি আমার সারাজীবনের পাওয়া। তার ধোঁকা আমার কাছে ছলনা। সবটা কুয়াশায় আবৃত।
আজও ভালোবাসি তাকে।”
নিয়ন ও রাত্রি অবাক হয়। কাউকে সত্যি এতোটা কিভাবে ভালোবাসে! পুরো কাহিনী শুনে নিয়ন এটাই চায়, আকাশ ফিরে আসুক! আগলে নিক তার প্রণয়িনীকে। ওদের ভালোবাসা এক অন্তরিক্ষ সমান হোক। যা অসীম।
নিয়ন এবার বলে,
–আমার মনে হয় আমাদের ঢাকা যাওয়া উচিত।
রাত্রি কথার মাঝে বাঁধা দিয়ে বলে,
–আকাশের বাড়ি তো চট্টগ্রাম। তো ঢাকা কেন যাবো? আগে চট্টগ্রাম যাবো।
নিয়ন মাথায় হাত দিয়ে বলে,
–ঢাকাতে আকাশের বন্ধুরা থাকে। আর আমার মনে হয়, আকাশ যদি চট্টগ্রাম থাকেও তার আগে ওর বন্ধুদের সাথে দেখা করা উচিত। সবকিছুর কারন জানতে হবে। কেনো আকাশ মেহেরকে বিয়ে করলো? কি হয়েছিল? আর আমরা যদি চট্টগ্রাম যাই আগে তাহলে মেহেরকে যদি সেখানে পাই তো প্রিয়তা ওকে দেখলে যদি আবারো রিয়াক্ট করে?
রাত্রির এবার বোধগম্য হয়। প্রিয়তা মলিন হেসে বল,
–কিছু হবে না আমার। আমি সহ্য করে নিবো।
নিয়ন উদাস স্বরে বলে,
–সবার তোমার মতো ভালোবাসার ক্ষমতাও থাকে না আর না কারো মতো নিজের ভালোবাসার মানুষটা অন্যে কাউকে পাগলের মতো ভালোবাসে এটা মানার সহ্য ক্ষমতা!
রাত্রি বুঝে এটা। সে তাচ্ছিল্য হাসে। পাঁচ বছর ধরে যারে কারনে অকারনে পাশে থেকে সাপোর্ট করে গেছে আর সে সেটাকে শুধু বন্ধুত্ব মেনে গেলো। লুকিয়ে লুকিয়ে ভালোবাসলো যাতে বন্ধুত্বের মাঝে কোনো প্রবলেম না হয় কিন্তু এখন তো তার মনে অন্য রমণীর বিচরনটাকেও মেনে নিচ্ছে। এটাকে কি বলবে নিয়ন?
পরেরদিনই ওরা সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। প্রিয়তা ঠিকঠাক জানে না আকাশের বন্ধুরা কোথায় আছে তাই ফেসবুকের সাহায্য নিয়েছে। প্রায় চার বছর পর নিজের ফেসবুক একাউন্টের একসেস নিলো প্রিয়তা।
প্রিয়তা ফেসবুক থেকে রামিসা ও হৃদয়ের আইডি খুঁজে বের করে। সেখান থেকে জানতে পারে তারা দুজন ঢাকার মুগ্ধা মেডিকেলে আছে। হৃদয়ের টাইমলাইন স্ক্রোল করতে করতে নিয়ন দেখে তিন বছর আগের একটা পোস্ট। সেখানে লিখা,
“আমাদের বন্ধু আকাশ আহমেদ অন্ত, আজ বাদ আসর ইন্তেকাল করেছে। আমাদের বন্ধুটি ব্লাড ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে ছিল। ছয় মাস আগে জানতে পারে তার ব্লাড ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ। বন্ধু আমাদের এতিম, তার বাবা-মা ছোট বেলায় কার এক্সিডেন্টে মারা গেছিলো এরপর তার পালিত চাচা রাস্তা থেকে ওকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে। এরপর চাচাও ওর মেডিকেলের তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা কালিন মারা যায়। লাস্ট স্টেজ আর বোনমেরু ট্রান্সপ্লেট ছাড়া আর কোনো চিকিৎসা নেই। কেমো থেরাপি দিলেও বোনমেরু ট্রান্সপ্লেট করতেই হতো। যেহেতু আকাশের রক্তের সম্পর্কের কেউ নেই তাই এটা সম্ভব হয়নি। এই ক্যান্সারের কারনে আকাশ তার ভালোবাসা, তার স্ত্রীকে ছলনা করে নিজের থেকে দূরে করেছে। ভালোবেসে পরিবারের অমতে বিয়ে করেছিল মেয়েটি। মেয়েটি যে প্রেগনেন্ট ছিল তা আকাশ নিজেও জানতো না। আকাশ অনেকদিন ধরেই নিজের অসুস্থতা আন্দাজ করে টেস্ট করাতে ভয় পাচ্ছিলো। তারপর যখন জানতে পারে তখন স্ত্রীর থেকে দূরে সরে আসার পরিকল্পনার করে আর তারপর তার স্ত্রীর এক সপ্তাহের মধ্যে মিসক্যারেজ হয়ে যায়। আর দুর্ভাগ্য বশত সেদিন দুপুরে আকাশের রক্ত বমি ও তারপর সেন্সলেস হয়ে যায়। ডাক্তাররা তাকে ঘুমের ইনজেকশন ও এক ব্যাগ রক্ত দেয়। আমরা আকাশকে তার স্ত্রীর মিসক্যারেজের খবরটা জানাতে চাইনি কিন্তু দুইদিন পর আকাশের স্ত্রী বাড়ি থেকে মিসিং হয়ে যায়। মেয়েটা আকাশের ছলনা, মিসক্যারেজ সবকিছুতে পাথর হয়ে গেছিলো। এরপর আমরা পরিচিত সবজায়গায় এমনকি মেয়ের বাবার বাড়িতেও খোঁজ করেও পাইনি। আমাদের বন্ধু নিজের শেষ সময়ে পৃথিবীতে থাকা তার একমাত্র আপনজনকেও দেখতে পারলো না। যদি সেদিন বাচ্চাটা মিসক্যারেজ না হতো তাহলে হয়তো আমাদের বন্ধু এই ইহজগতে নিজের অংশকে দেখে যেতে পারতো।
সবাই আকাশের আত্নার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করবেন।”
নিয়ন পুরো পোস্টটা পড়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। সে প্রিয়তার দিকে তাকায়। প্রিয়তা তখন বাসের জানালা দিয়ে প্রকৃতি দেখতে ব্যাস্ত। নিয়ন রাত্রিকে ইশারাতে ডাকে তারপর মোবাইল এগিয়ে দেয় পোস্টটা পড়ার জন্য।
#অন্তরিক্ষ_প্রণয়
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-৯(শেষাংশ)
রাত্রি পোস্টটা পড়ে নিয়নের দিকে ছলছল দৃষ্টিতে চাইলো। নিয়নও অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। কি করা উচিত বা বলা উচিত তা তাদের মাথায় আসছে না। প্রিয়তাকে এখন বলা ঠিক হবে না। এটাই নিয়ন ভাবলো। ঢাকা গিয়ে ওর পরিচিতরা আস্তে ধীরে বললে হয়তো বুঝবে।
নিয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রাত্রি প্রিয়তার দিকে তাকায় আর চোখের কোনে জমা জলটুকু মুছে নেয়।
_______ঢাকা এসে প্রথমেই রামিসাদের কাছে যায় হসপিটালে। রামিসা তখন রোগী দেখছে আর হৃদয় একটা অপারেশন করছে। দেড় ঘন্টার মতো অপেক্ষার পর রামিসা ফ্রি হয়। তখন নার্স যেহেতু আগে ইনফর্ম করেছিল যে পরিচিত কেউ এসেছে তাই ওরা ভিতরে যায়। প্রায় চার বছর প্রিয়তাকে দেখে রামিসা অবাক হয়ে যায়। ওরা প্রিয়তাকে কতো খুঁজেছে কিন্তু পায়নি আর আজকে প্রিয়তা ওর সামনে। রামিসা গিয়ে প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর হৃদয়কে মেসেজ করে প্রিয়তাকে নিজের পাশে চেয়ার টেনে বসিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
–কোথায় ছিলে তুমি এতো বছর? কেমন আছো? কই হারিয়ে গেছিলে? জানো কতো খুঁজেছি তোমাকে! আকাশও তোমায় অনেক খুঁজেছে।
প্রিয়তা মলিন হাসে। নিয়ন ও রাত্রি ওদের কথা শুনছে আর ভয়ে আছে যে সত্যটা জানলে প্রিয়তা কি রিয়াক্ট করবে!
প্রিয়তা উদাশ কন্ঠে বলে,
–কাউকে অতিরিক্ত ভালোবাসলে যা হয়, আমার সাথে তার ব্যাতিক্রম হয়নি। তোমার বন্ধু আমাকে যেমন ছেড়েছে তেমনি তো থাকার কথা। সে কেনো আমাকে খুঁজেছে? তার জীবন থেকে বের তো করে দিয়েছিল।
রামিসা কিভাবে বুঝাবে প্রিয়তাকে তাই ভাবছে। রামিসা প্রিয়তাকে মলিন কন্ঠে বলে,
–বাহ্যিকভাবে আমরা যা দেখি তা অনেক সময় সত্য নাও হতে পারে। হতে পারে আড়ালে তার কোনো বড় সত্য লুকিয়ে আছে! তোমার মিসক্যারেজের পর যখন তুমি হারিয়ে গেলে তখন তোমাকে খোঁজার জন্য আমরা কতো জায়গায় গিয়েছি কিন্তু পাইনি।
ওদের কথার মাঝে নিয়ন বলে,
–প্রিয়তা এতোদিন পাবনা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। মানসিক ভারসাম্য ও বাকশক্তি কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে ফেলেছিল। আমি তাকে রাস্তায় পাই। তারপর তাকে পাবনা নিয়ে যাই।
রামিসা অবাক হয়ে বলে,
–কি বললেন! প্রিয়তা মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিল!
রাত্রি বলে,
–অতিরিক্ত ভালোবাসা আদান-প্রদানের পর হুট করে এতো কিছু হলে মানসিক ভারসাম্যহীন হতেই পারে। আমি ও নিয়ন ঢাকা থেকে পাবনা যাচ্ছিলাম। আমাদের তখন মেডিকেলে ছুটি ছিল। তখন তাকে কিছু বাজে মানুষের হাত থেকে নিয়ন বাঁচায়। তারপর আমরা ওকে সেখানে নিয়ে যাই।
রামিসা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ততোক্ষণে হৃদয়ও সেখানে হাজির। হৃদয় প্রিয়তাকে দেখে খুশি হয়। এরপর সবটা শুনে হৃদয় রামিসার দিকে তাকায়। রামিসাও হৃদয়ের দিকে তাকায়। চোখে তাদের শঙ্কা! কিভাবে প্রিয়তাকে সত্যটা বলবে! কিন্তু বলতে তো হবে। রামিসাকে হৃদয় ইশারা করে যাতে বুঝিয়ে বলে।
হৃদয়, রামিসা, প্রিয়তা, রাত্রি ও নিয়ন একটু খোলামেলা জায়গাতে যায়। যেখানে প্রকৃতির সৌন্দর্য আছে। ওরা চন্দ্রিমা উদ্যানে যায়। রামিসা প্রিয়তাকে এক বেঞ্চে বসিয়ে লম্বা শ্বাস নিয়ে বলে,
–তোমাকে কিছু কথা বলবো। কিন্তু কিভাবে বলবো সেটাই বুঝতে পারছি না। তুমি কিভাবে নিবে! তোমার মেন্টাল কন্ডিশন মাত্র রিকোভার করলো। এখন যদি আবার ক্ষতি হয়!
প্রিয়তা ভ্রঁ কুঁচকালো। তারপর বলে,
–তুমি বলো। যা খারাপ হবার হয়ে গেছে। এতো সব হবার পরেও আমি আকাশকেই ভালোবাসি। জানিনা কেনো!
রামিসা ধীরে ধীরে বলে,
–আকাশ আর বেঁচে নেই।
প্রিয়তা সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ সে এরকম কিছু শুনবে তার কল্পনাতেও আসেনি। ভালোবাসার মানুষটা দূরে থাকুক তবে সুস্থ থাকুক এটাই তো চাওয়া। প্রিয়তার চোখ দিয়ে বিনা দ্বিধায় অশ্রু গড়াচ্ছে। সে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে,
–কি..কি বললে! আ..আকাশ বেঁচে নেই? মিথ্যা বলছো তাইনা?
রামিসা প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর কান্নারত অবস্থায় বলে,
–নিজেকে সামলাও প্রিয়তা। তোমাকে ভালো রাখতেই আকাশ সেদিন মেহেরকে নিয়ে অভিনয় করেছিল। আকাশ ও তোমার চট্টগ্রাম যাওয়ার পর মেহেরের বিয়ে ঠিক হয় নতুন আসা এক ডাক্তারের সাথে। যে কিনা মেহেরের জন্যই ময়মনসিংহ ট্রান্সফার হয়। মেহেরের সাথে ওর পারিবারিকভাবে বিয়ে ঠিক হয়। তোমরা চট্টগ্রাম যাওয়ার পর থেকে আকাশ নিজের শরীরের লক্ষন গুলো দেখতে থাকে। তারপর ময়মনসিংহ এসে টেস্ট করে। চট্টগ্রাম করলে যদি তুমি জেনে যাও এই ভয়ে। তারপর তো ওর ভয়টাই সত্য হয়। আকাশের ব্লাড ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে ছিল। ওর তো কোনো রক্তের সম্পর্কের কেউ নেই যে ওকে বোনমেরু দিবে। আর কেমো দিয়ে লাস্ট স্টেজে রিকোভার করা পসিবল না। খুব রেয়ার। আর আকাশের অতো টাকা ছিল না যে মাসে মাসে এতো খরচ করে অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকবে। আমাদেরকে বলার সময় মেহের সবটা শুনে ফেলে। আকাশ জানো কিভাবে কাঁদছিল! ও তোমাকে এতো ভালোবাসে যে তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে এটা বলে বলেই হৃদয় ও সাগরকে জড়িয়ে অনেক কান্না করেছিল। ওর কারনে তুমি তোমার পরিবার ছেড়েছো। তখন তুমি যদি এসব জানতে তুমি কখনোই তোমার পরিবারেন কাছে যেতে না। আর তোমার জীবনটা নষ্ট না করার জন্য আকাশ মেহেরকে নিয়ে নাটকটা করেছিল।
প্রিয়তা জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে। রামিসা ওর দিকে পানির বোতল এগিয়ে দেয়। প্রিয়তা পানি খায় তারপর কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে নিজের ভেতরটাকে শান্ত করতে। কতোটা ভুল বুঝেছিল সে আকাশকে। নিজের অনাগত বাচ্চাকেও হারালো।
রামিসা প্রিয়তাকে স্বান্তনা দিয়ে বলে,
–কন্ট্রোল প্রিয়তা, যেদিন তোমার মিসক্যারেজ হয় সেদিন আকাশ হসপিটালে এডমিট ছিল। ওর শরীর হুট করে অসুস্থ ও রক্তবমি হয়েছিল। আমরা ওকে জানাইনি তোমার মিসক্যারেজের কথা। সে প্রতিদিন তোমার খোঁজ নিতো। যেদিন তুমি নিখোঁজ সেদিন আমরা আকাশকে জানাই সবটা। আকাশের সেদিন স্ত্রী-সন্তান হারানোর ব্যাথা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। অসুস্থ শরীর নিয়ে সে তোমাকে খুঁজে না পেয়ে তোমাদের বাড়িতেও দুইদিন পর খুঁজতে গেছিলো। সেদিন তোমার ভাই আকাশের অবস্থা না জেনে ওকে দুইটা ঘুসি পর্যন্ত মেরেছিল তখন আমরা ওকে ধরি। কোথাও পায়নি তোমায়। প্রতিদিন সাগর দেখতো আকাশ কিভাবে রাতে কান্না করতো। ওর শেষ সময়েও সে তোমাকে একবার দেখার জন্য হসপিটালের বেডে ছটফট করেছিল কিন্তু অপূর্ণতা তার সঙ্গী তো কিভাবে সে পূর্ণ হয়ে বিদায় নিবে! চলে যায় আকাশ না ফেরার দেশে। এতিম ছেলেটা নিজের শেষ সময়ে শূন্য হয়ে ফিরে গেলো।
প্রিয়তা এবার মাটিতে বসে চিৎকার করে কাঁদছে। রামিসা ওকে থামাতে পারছে না। প্রিয়তার চিৎকারে আশেপাশের কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে। তারা প্রিয়তার কান্নার কারন না জানলেও ব্যাথিত। ওকে থামাতে না পেরে নিয়ন হৃদয়কে বলে,
–ভাই, আপনাকে বলছিলাম না একটা ঘুমের ইনজেকশন আনতে। ওটা কই? এখনি প্রিয়তাকে দিতে হবে।
হৃদয় জলদি করে রামিসার ব্যাগ থেকে ইনজেকশন বের করে প্রিয়তার শরীরে পুশ করে দেয়। কিছুক্ষনের মধ্যে আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়ে প্রিয়তা।
নিয়ন প্রিয়তাকে কোলে করে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যায়। তারপর গাড়ি করে ওরা রামিসাদের বাড়িতে যায়।
তিন ঘন্টা পর জ্ঞান ফেরে তারপর পর থেকে থম মেরে বসে আছে। সবাই উৎকণ্ঠাতে আছে প্রিয়তার মানসিক অবস্থা নিয়ে। সবাইকে স্বস্তি দিয়ে প্রিয়তা স্বাভাবিক স্বরে বলে,
–আমি চট্টগ্রাম যাবো। ওকে কবর কি চট্টগ্রাম দেওয়া হয়েছে?
হৃদয়রা যেনো স্বস্তি পায় তারপর বলে,
–হ্যাঁ, ওর বাড়িতে দক্ষিন দিকে যে কদম ফুল ও শিউলি ফুলের গাছ আছে সেখানেই ওকে কবর দেওয়া হয়। ওর চাচার কবরটা তো এতিমখানার ভেতরে দিয়েছিল ওর চাচার মর্জিতে। কিন্তু ওর কবরটা সেখানেই দিতে বলেছিল, যদি কোনোদিন তুমি আসো! এই কারনে। মেয়েদের তো কবরস্থানে ঢোকা নিষিদ্ধ। তোমাকে ও শেষ দেখেনি আর না তুমি। তাই ও সেখানেই দিতে বলেছিল। আর বাড়িটা তোমার নামে লিখে দিয়ে গেছে। তোমাকে দেওয়ার মতো আর কিছু ওর ছিলনা। সব তো কেড়েই নিলো!
প্রিয়তা ঢুকরে কেঁদে উঠে। তারপর বলে,
–আমি যাবো। আমার জন্য সে অপেক্ষা করছে।
পরেরদিন,,
চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা করে সকাল সকাল। প্লেনে যাবে। জার্নি করা সম্ভব না এখন প্রিয়তা, রাত্রির ও নিয়নের।
সন্ধ্যাতে ফ্লাইট ছিলো। রাত ৯টার মধ্যে পৌঁছে যায় ওরা। সবার আগে প্রিয়তা আকাশের কবরের কাছে যায়। রাতের বেলা কবরের কাছে থাকা ঠিক না জেনেও প্রিয়তা সবাইকে বাড়িতে যেতে বলে নিজে বসে থাকে সেখানে। কবরের কাছে একটা মোম লাগিয়ে দিয়েছে হৃদয়। বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি তো নেই। কাছের দোকান থেকে মোম নিয়ে এসেছে। প্রিয়তা আকাশের কবরের সামনে বসে চুপ করে এক দৃষ্টিতে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। তারপর নিজে নিজেই বলে,
–কি লাভ হলো বলোতো? তুমি তখন কিভাবে ভাবলে যে আমি তোমার থেকে আঘাত পেলে অন্য কাউকে নিয়ে জীবন সাঁজাবো! আমি তো তোমাকে ছাড়া আর কারো নিকটস্থ যেতেও চাইনা। যতোদিন ছিলে আমরা ততোদিন নিজেদের মাঝে বিলীন থাকতে পারতাম। হয়তো আমাদের বেবিটাও থাকতো। তুমি তোমার অংশকে দেখে যেতে পারতে। এতো ছলনা করেও আমি তোমাকে ঘৃণা করতে পারিনি। কারন আমার মনে তোমার প্রতিচ্ছবি খুবই সরল। আমি ছাড়া তুমি নিঃসঙ্গ। তাও কেনো আমার সাথে ছলনা করলে! পেরেছো আমাকে তুমিহীনা ভালো রাখতে! পারোনি তো! পাগল হয়ে মানসিক হাসপাতালে ছিলাম। সবটা তোমাকে চেয়ে। আর এখন আমৃত্যু আমি তোমার হয়ে থাকবো এখানে।
আবারো নিস্তব্ধ। অনেকক্ষণ হওয়াতে নিয়ন প্রিয়তাকে দেখতে এসেছিল। ভেবেছিল প্রিয়তার আবার কিছু হয়নি তো! কিন্তু এসে শুনতে পেলো,
“আর এখন আমৃত্যু আমি তোমার হয়ে থাকবো এখানে।”
নিয়ন মাথা নুইয়ে হাসে। সে জানে প্রিয়তা তার কখনো হবে না। তাই সে আশা করাও ছেড়ে দিছে। নিয়ন এসে প্রিয়তাকে ডেকে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর প্রিয়তা চলে যায় ভিতরে।
রামিসা ও হৃদয় তিনদিন থেকে চলে যায়। ইফা, সাগর, মেহের, মেহেরের স্বামী এসেছিল। প্রিয়তার কাছে মেহের মাফ চায়। প্রিয়তা মাফ করে দেয়। হৃদয় আকাশের বাড়িতে বিদ্যুৎের ব্যাবস্থা করে দেয়। প্রিয়তা এখানেই থাকবে। পাশের এতিম খানা থেকে বাচ্চা এডপ্ট করবে। কোনো নবজাতক এলে। আর এতিম বাচ্চারা তো আছেই। সবাইকে নিয়ে কেটে যাবে। প্রিয়তার বাবা-মা, ভাই-ভাবি এসেছিল। কিন্তু প্রিয়তা তাদের সাথে যাবে না। প্রিয়তার মেডিকেল রিপোর্ট চট্টগ্রাম মেডিকেলে দেখানো হয় তারপর তারা ওকে আবার পড়তে সুযোগ দেয়। তবে ইরেগুলার হিসেবে।
_________
আটমাস পর,,
রাত্রি ও নিয়নের বিয়ে। প্রিয়তা সেজন্য ঢাকা গিয়েছে। রাত্রি অনেক খুশি। রাত্রির খুশি দেখে নিয়নও খুশি। তার বেস্টফ্রেন্ড যে তাকে ভালোবাসে তা সে ছয় মাস আগে আবারো যখন চট্টগ্রাম এসেছিল রাত্রিকে নিয়ে তখন জানতে পারে। প্রথম ভালোবাসা পায়নি বলে যে মানুষটা তাকে এতো বছর ধরে ভালোবাসে তাকে ফেরানো উচিত না। নিয়ন সায় দেয় রাত্রির ভালোবাসাতে।
কিছুক্ষনের মধ্যে ওদের বিয়ে হয়ে যায়। প্রিয়তা ওদের জন্য নিজ হাতে বানানো বুটিকের পাঞ্জাবি ও শাড়ি গিফট করে। প্রিয়তা পড়াশোনার পাশাপাশি বুটিকের কাজ শিখেছে নাহলে চলবে কি করে! আকাশের জমানো টাকাতে কতোদিন চলবে! আকাশ তার জমানো সব টাকা প্রিয়তার নামে ট্রান্সফার করে গেছে।
বিয়ের পর্বের পর নিয়ন ও রাত্রি প্রিয়তার কাছে আসে। নিয়ন বলে,
–ধন্যবাদ তোমাকে। আমাদের জীবনকে সাঁজিয়ে দেওয়ার জন্য। আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম ঠিক তবে রাত্রিকে ছাড়া নিজেকে কল্পনা করিনি। তাই তো তোমার ব্যাপারে কিছু জানলে রাত্রিকেই আমার লাগতো। আমাদের বন্ধুত্বে ভরসা, বিশ্বাস জিনিসটা বেশি ছিলো। ওকে আমি বন্ধুর নজরে দেখতাম তবে ওকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেয়ে আমি সত্যি অনেক খুশি। ওর মতো করে আমার প্রতিটি পদক্ষেপে আমি আমার পরিবার ব্যাতিত আর কাউকে পাইনি।
প্রিয়তা মুচকি হাসে। তারপর ওদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।
চট্টগ্রামে আকাশের কবরের উপরে শিউলি ফুল পরে আছে। সময়টা শরৎকাল। খোলা আকাশের নিচে প্রিয়তা তার আকাশকে নিয়ে মধুর স্মৃতিচারণে ব্যাস্ত। এক অমলিন অন্তরিক্ষ প্রণয় থাকুক অনুভবে!
______________________সমাপ্ত__________________