#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৬৪
#Saiyara_Hossain_Kayanat
রৌদ্র অস্থির হয়ে পড়ছে আরশির কান্না দেখে। বেশ কিছুক্ষন সময় ধরে আরশিকে সামলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। আরশি আগের মতোই ব্যথা কাতরাচ্ছে। মৃদুস্বরে আর্তনাদ করছে আর চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। রৌদ্রর চোখ দুটো পানিতে ছলছল করে ভরে উঠেছে। আরশিকে এভাবে যন্ত্রণা পেতে দেখে তার বুক ফেটে কান্না আসতে চাইছে। একটু পরেই আরশিকে সিজারের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে। রৌদ্র সকল ব্যবস্থা কমপ্লিট করেই আরশির কাছে এসেছে। রৌদ্র আরশির হাত ধরে অস্থিরতার সাথে বলল-
“আরু আর কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরো প্লিজ। একটু পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
তীব্র ব্যথার মাঝেও আরশি মুখে হাসি দেখা দিল। রৌদ্রর হাত শক্ত করে ধরে অস্পষ্টতার সাথে আধো আধো করে বলল-
“একটা কথা রাখবেন রোদ!”
রৌদ্র আরশির হাত তার দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে আশ্বাস দিয়ে বলল-
“তোমার কোনো কথা তো আমি কখনো ফিরিয়ে দেই নি আরু।”
আরশি বড় বড় করে কয়েকবার শ্বাস টেনে নিল। নিম্ন স্বরে জোড়ালো কন্ঠে বলল-
“রোদ.. আর একবার ভালোবাসি বলবেন আমাকে!”
কথাটা বলার সাথে সাথে আরশির চোখ থেকে কয়েক ফোটা গরম অশ্রুজল গড়িয়ে পরলো। রৌদ্র থমথমে চেহারায় আরশির দিকে চেয়ে আছে। প্রচন্ড ভয় করছে তার। আরশিকে হারিয়ে ফেলার ভয়। তাদের ভালোবাসার সন্তান তুলতুলকে হারিয়ে ফেলার ভয়। এভাবেই কি শেষ হবে সব কিছু! না-কি নতুন করে শুরু হবে! এই রৌদ্র রুদ্রাণীর শহরে কি নতুন করে সূর্যের আলো দেখা দিবে! অনিশ্চয়তার মাঝে ঝুলে আছে তাদের ভালোবাসার সংসার। রৌদ্র আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল-
“শুধু একবার না আরু। হাজার বার বলবো। সারাজীবন বলে যাবো আমি তোমাকে ভালোবাসি রুদ্রাণী।”
আরশির মুখে তৃপ্তির হাসি। জড়ানো কন্ঠে বলল-
“আমিও আপনাকে খুব ভালোবাসি রোদ। একটা অনুরোধ রাখবেন! আমার কিছু হয়ে গেলেও আপনি নিজেকে সামলিয়ে নিবেন। আমার অনুরোধ রাখার জন্য হলেও নিজের জীবন নতুন করে শুরু…. ”
রৌদ্র আরশিকে থামিয়ে দেয়। আরশির গালে হাত রেখে উৎকন্ঠিত হয়ে বলল-
“কিছু হবে না তোমার। আমি তোমাকে কিচ্ছু হতে দিবো না আরু।”
রৌদ্র আরশির কপালে গভীর ভাবে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। আরশির কাঁপা কাঁপা ঠোঁট আলতো করে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। আরশিকে ছেড়ে দিয়ে রৌদ্র কেবিনের বাহিরে এসে আবারও ডক্টরদের ডাকতে লাগলো। নার্সরা আসছে। সব কিছুই রেডি হয়ে গেছে। এখনই আরশিকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হবে। আরশিকে ওটিতে ডুকানো হবে কিন্তু আরশি রৌদ্রর হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। ডক্টরা তাড়া দিচ্ছে কিন্তু আরশি রৌদ্রর হাত ছাড়ছে না। চোখের সামনে বার বার সেই দুঃস্বপ্নটা ভেসে উঠছে। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। পুরো মুখ চোখের পানিতে ভিজে আছে। চোখের পাপড়িগুলো একটা আরেকটার সাথে লেগে আছে। আরশি ইশারায় রৌদ্রকে কাছে আসতে বলল। রৌদ্র আরশির একদম কাছে তার মুখ নিয়ে গেল। আরশির নিজের মাথাটা হাল্কা উঁচু করে রৌদ্র কানের কাছে মুখ এনে মৃদুস্বরে বলল-
“তোমাকে ভালোবাসি রোদ।”
আরশি ছেড়ে দিল রৌদ্রর হাত। আরশিকে ওটিতে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। রৌদ্র আগের জায়গাতেই স্থির দাঁড়িয়ে আছে। আরশি তাকে এই রকম পরিস্থিতিতে প্রথম বার তুমি সম্মোধন করে বলবে সেটা রৌদ্র কখনো কল্পনা করেনি। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। বুকে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে তার। অসহ্য ব্যথা, হাহাকার। কান্না করতে চাইলেও কান্না আসছে না। চুপচাপ দরজার পাশে মেঝেতে বসে পরলো। দু হাটুতে হাত রেখে মাথাটা হাল্কা নিচু করে রেখেছে। মিনিট পাঁচেক সময় পেরুতেই নীল, আদ্রাফ, কাসফিয়া, নীলা আর নির্বান আসলো। সবাই অস্থিরতার সাথে রৌদ্রকে নানানরকম কথা জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে। কিন্তু রৌদ্র কোনো কথা বলল না। মুখ দিয়ে টু শব্দও বের করেনি। আর মাথা তুলেও তাকায়নি কারও দিকে। সকলের মুখে চিন্তার ছাপ। কাসফিয়া চেয়ারে বসে আছে। তার পাশেই নীলা সাদাফকে কোলে নিয়ে বসে আছে। নীল আর আদ্রাফ অস্থিরতার সাথে পায়চারি করছে। খানিকটা সময় পর ধ্রুব আসলো। ধ্রুবর মাও তার পেছন পেছন আসছে।
“আরুদি’র কি অবস্থা? কখন বের হবে আরুদি?”
প্রচন্ড অস্থির হয়েই জিজ্ঞেস করলো ধ্রুব। নীল চিন্তিত গলায় বলল-
“কিছুই বুঝতে পারছি না৷ রৌদ্র ভাই তো কোনো কথাই বলছে না।”
ধ্রুব এক ঝলক রৌদ্রর দিকে তাকালো। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চুপচাপ চেয়ারে বসে পরলো। অপেক্ষা করছে সবাই। ঘন্টাখানে সময় পর সকলের অপেক্ষার প্রহরের সমাপ্তি ঘটিয়ে ডক্টর বেরিয়ে আসলো। এবার রৌদ্র নড়েচড়ে উঠেছে। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ডক্টরের সামনে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল-
“আমার আরু কেমন আছে?”
ডক্টর হাসি মুখে বলল-
“আপনার মেয়ে হয়েছে ড.রৌদ্র।”
রৌদ্র আবারও শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো-
“আমার আরু কেমম আছে ডক্টর?”
“মিসেস আরুর ভাগ্য খুবই ভালো হাই রিস্ক প্রেগ্ন্যাসি থাকা শর্তেও সিজারের সময় আমাদের তেমন কোনো প্রব্লেম হয়নি। তবে…”
“তবে কি?”
রৌদ্র উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো। রৌদ্রর উত্তেজনা দেখে ডক্টর কিছুটা ভড়ে উঠলো।
“আসলে বাচ্চার অবস্থা বেশি একটা ভালো না তাই বাচ্চাকে কিছুদিনের জন্য হসপিটালেই রাখতে হবে। তবে চিন্তার কিছু নেই অল্প কয়েক দিনেই আপনাদের বাচ্চা সুস্থসবল হয়ে উঠেবে।”
রৌদ্র কোনো কথা বললো না। নীল, আদ্রাফ, নির্বান আর ধ্রুব একে একে রৌদ্রকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানাচ্ছে। কাসফিয়া আর নীলা খুশিতে প্রায় কেঁদেকেটে একাকার। ধ্রুবর মা সাদাফকে কোলে নিয়ে হাসি মুখে কাসফিয়া আর নীলাকে দেখছে। সবাই খুশিতে প্রায় নাচানাচি করছে। কিন্তু রৌদ্র নির্বাকের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কথা বলছে না। আর হাসছেও না। ঘন্টা খানেক পর আরশিকে কেবিনে শিফট করা হয়। রৌদ্র এক মুহূর্ত দেরি না করে হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে ছুটে আসে। আরশির সামনে এসেই রৌদ্র থমকে দাঁড়ায়। আরশির চোখ মুখ শুকিয়ে আছে। চোখের কোণে শুকিয়ে যাওয়া নোনাপানির দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে আরশি। রৌদ্র আর দেরি করলো না। তৎক্ষনাৎ আরশিকে জড়িয়ে ধরলো আলতো করে। আরশি চোখে মেলে তাকায়। রৌদ্রর পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আরশি গলার কাছে গরম তরল পদার্থ জাতীয় কিছু অনুভব করলো। রৌদ্র কান্না করছে! আরশি রৌদ্রকে ছাড়ানো চেষ্টা করে মিহি কন্ঠে বললো-
“আমরা ঠিক আছি রৌদ্র কান্না করছেন কেন!”
রৌদ্র কোনো কথা বলল না। নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে৷ কয়েক মিনিট পাড় হতেই রৌদ্র সোজা হয়ে আরশির পাশে বসে। বিশ্বজয়ী এক হাসি দিয়ে বলল-
“তুমি জানো! আমাদের মেয়ে হয়েছে আরু।”
আরশি হাল্কা হাসলো। রৌদ্র আবারও বলল-
“আর মাত্র কয়েকদিন পর তুলতুলকে কোলে নিতে পারবো। তুলতুল হাসবে। কান্না করবে। ছোট ছোট হাতে আমার আঙুল আঁকড়ে ধরবে। একদম তোমার মতো হবে ছোট্ট একটা পরি।”
আরশি আবারও হাসলো। রৌদ্রর বাচ্চাদের মতো কথা শুনে আরশি সকল ব্যথা যন্ত্রণা নিমিষেই ভুলে গেল। অপলকভাবে তাকিয়ে আছে রৌদ্রর দিকে। রৌদ্রর চোখ খুশিতে চিকচিক করছে। উৎসাহিত হয়ে একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে। আরশি মনোযোগ দিয়ে রৌদ্রর কথা শুনছে। দু’জনের মুখেই হাসি। তৃপ্তিদায়ক হাসি। রৌদ্রর রুদ্রাণীর শহরে আবারও রোদের আলো দেখা দিলো। রোদের ঝিলমিলি আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে পুরো শহর।
——————————
আজ প্রায় সাত দিন পর তুলতুলকে সাধারণ কেবিনে সিফট করেছে। আরশির পাশেই রাখা হয়েছে তাদের ছোট্ট তুলতুলকে। রৌদ্র একটু পর পর এসে তুলতুলের হাত ধরছে, গাল ছুঁয়ে দিচ্ছে। ছোট্ট বাচ্চাদের মতো বিহেব করছে রৌদ্র। খুশিতে যেন আত্মহারা হয়ে গেছে। হঠাৎই কেবিনের ধরজা খোলার শব্দ পেল। আরশি আর রৌদ্র কৌতুহলী চোখে দরজার দিকে তাকালো। নীল, নির্বান, নীলা, কাসফিয়া, আদ্রাফ দাঁড়িয়ে আছে দল বেধে। হঠাৎই তাদের পেছন থেকে ধ্রুব বড় একটা কালো রঙের বোর্ড নিয়ে বেরিয়ে আসলো। বোর্ডের মধ্যে বড় বড় করে হলুদ রঙের লেখা “YOU ARE MY SUNFLOWER” “ধ্রুবর তুলতুল পাখি” লেখাগুলোর পাশে অনেক গুলো সূর্যমুখী ফুলের ছবি।
#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৬৫(অন্তিম পর্ব)
#Saiyara_Hossain_Kayanat
রৌদ্রর কোলে তুলতুল আর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আরশি। তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আরশির হারামি দল। কাসফিয়ার কোলে সাদাফ তার বড় বড় চোখ দিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। সবাই এখানে দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্ত হলেও সাদাফের মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই। এই ছেলেটা একটু বেশিই গম্ভীর হয়ে উঠছে দিন দিন। বাচ্চা ছেলে চিল্লাচিল্লি করবে তা না দিনের বেশির ভাগ সময়ই চুপচাপ থাকে এই ছেলেটা। খুব কমই কান্না করতে দেখা যায়।
“ধ্রুব ভাই আর কতক্ষন লাগবে তোর? তাড়াতাড়ি দরজা খোল।”
আরশি ক্লান্তিমাখা কন্ঠে ধ্রুবকে বলল। সেই সাথে দরজায় কড়া নাড়লো। ভেতর থেকে ধ্রুব চেচিয়ে বলল-
“আর মাত্র দু মিনিট আরুদি।”
ধ্রুবর কথা শুনে সবাই এক সাথে ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে। তুলতুলকে বাসায় নিয়ে আসার পর থেকেই ধ্রুব এই রুমটা তুলতুলের জন্য সাজানো শুরু করেছে। দু’দিন ধরে ধ্রুবর এই কর্মকাণ্ড চলছে। আরশিদের বেড রুমের অপরদিকে এই রুম। অবশেষে আজ এই রুমটা দেখার সুযোগ দেওয়া হবে তাদেরকে। আর সেই অপেক্ষাতেই চোখেমুখে কৌতুহল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। ড্রয়িং রুমে বড়রা আড্ডা দিচ্ছে। সকলের মুখেই আজ স্বস্তির হাসি। ধ্রুব দরজা খুলে দিলো। সবাই আর এক মুহুর্ত সময় দেরি না করে রুমের ভেতর চলে আসলো। ধ্রুব তুলতুলকে রৌদ্রর কোল থেকে নিজের কাছে নিয়ে নেয়। সবাই মুগ্ধ হয়ে পুরোটা রুম দেখে যাচ্ছে। দেয়ালে বিভিন্ন রকমের ড্রয়িং করা। সূর্যমূখী ফুল এঁকে পুরো রুম সাজিয়েছে ধ্রুব। দেয়ালে তাদের সবার একটা বড় ছবি টানানো। ফ্লোরিং বেডের চাদর থেকে শুরু করে রুমের পর্দা গুলোতেও সূর্যমূখী ফুলের ছাপ। এ যেন কোনো সূর্যমুখী ফুলের দেশ। পুরো রুমে আছে অসংখ্য খেলনা। নির্বান একটা বোকা হাসি দিয়ে বলল-
“তুলতুল যদি হামাগুড়ি দিতে গিয়ে বেড থেকে পড়ে যায় তাই এই ফ্লোরিং বেড দিয়েছি। পড়ে গিয়ে যেন ব্যথা না পায় তাই। এখন বলো তো কেমন হয়েছে!”
আরশি ধ্রুবর কাছে এসে বলল-
“তুই এতো কিছু আমাদের অগোচরে করলি কীভাবে ধ্রুব! একা একা এতো কিছু করেছিস তোর কষ্ট হয়নি!”
ধ্রুব কিছু বলল না। শুধু বোকার মতো মাথা নিচু করে হাসছে। কিছুটা সময় পর মিনমিনিয়ে বলল-
“আমার তুলতুল পাখির জন্য তো এসব কিছুই না।”
“রুমটা অনেক বেশি সুন্দর হয়ে ধ্রুব।”
রৌদ্র ধ্রুবর কাধে হাত রেখে বলল। রৌদ্রর সাথে সাথে নীল আর বাকি সবাই রুমের প্রশংসা করায় ব্যস্ত হয়ে পরেছে। আর আরশি পুরো ঘুরেফিরে দেখছে।
—————————
আজ তুলতুলের নাম রাখা হবে। সেই জন্যই সবাই কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ছেলেরা বাড়ি সাজাচ্ছে আর মেয়ে রান্না করছে। ধ্রুবকে কিছুটা দূর্বল দেখাচ্ছিলো তাই ধ্রুবকে তুলতুলের রুমে চুপচাপ বসে থাকার কড়া হকুম দিয়েছে আরশি। তুলতুলকে ধ্রুবর কোলে দিয়ে আরশি রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। তখনই ধ্রুব শান্ত গলায় আরশিকে ডাক দেয়-
“আরুদি!”
হঠাৎই ধ্রুবর ডাকে আরশি থামকে দাঁড়ায়। আজ কেমন যেন অন্যরকম লাগছে ধ্রুবর কন্ঠস্বর। আরশি বিস্ময় নিয়ে পেছন ফেরে তাকায়। ধ্রুবর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“কিছু বলবি ধ্রুব?”
ধ্রুব হাল্কা হেসে মাথা ঝাঁকালো। আরশি আবারও ধ্রুবর কাছে আসলো। বেডে বসে জিজ্ঞেস করল-
“কি বলবি! বল।”
ধ্রুব এবার দাঁত বের করে হেসে বলল-
“তুমি খুব ভালো আরুদি। তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, বড় বোন, প্রিয়জন সব। তোমাকে আমি অনেক ভালোবাসি। তবে এখন তোমার থেকেও বেশি তুলতুল পাখিকে ভালোবাসি।”
আরশি সরু চোখে ধ্রুবর দিকে তাকালো। ধ্রুব শব্দ করে হাসছে। বিড়ালের মতো চোখ দুটো চিকচিক করছে। তুলতুল ধ্রুবর কোলে থেকে ধ্রুবর শার্টের বোতাম ধরে টানছে। আরশি অভিমানী কন্ঠে বলল-
“তুলতুলকে যখন আমার থেকে বেশিই ভালোবাসিস তাহলে ওকে নিয়েই থাক। এখন থেকে আমাকে আর আরুদি ডাকবি না।”
ধ্রুব আবারও হাসলো। হাসার ফলে তার শ্বাস আটকে আসছে। আরশি কপাল কুচকে ধ্রুবর হাসি দেখছে। ধ্রুব হাসি থামিয়ে বড় করে শ্বাস নিয়ে বলল-
“আরে রাগ করছো কেন! তুলতুল তো আমার একমাত্র কিউটি সানফ্লাওয়ার। আর তুমি হলে আমার আরুদি। তোমার সাথে কি অন্য কারও তুলনা হয় না-কি!”
“হয়েছে হয়েছে বুঝেছি। এখন বল কি বলবি! আর হঠাৎ করে এসব কথা কেন বললি?”
“তেমন কিছু না। এমনিতেই বললাম। তুমি এখন যাও। আমি আছি তুলতুলের কাছে। চিন্তা করো না আরুদি।”
আরশি তুলতুলের দিকে এক নরজ তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। হাল্কা হেসে ধ্রুবর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে রুম থেকে চলে যায়। ধ্রুব আরশির যাওয়ার পথে তাকিয়ে ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। বুক ব্যথাটা বেড়েছে খুব। বুকের দিকের শার্টে টান পড়ায় ধ্রুব মাথা নিচু করে তুলতুলের দিকে তাকালো। তুলতুল ধ্রুবর শার্ট খামচে ধরে আছে। পা দুটো নাড়ছে। চোখের পলক ফেলছে ঘনঘন। তুলতুলকে দেখে ধ্রুবর ঠোঁট প্রসারিত হয়ে গেল।
“ইউ আর মাই সানফ্লাওয়ার। তুলতুল পাখি।”
——————————
প্রায় আধঘন্টা পর আরশি তুলতুলের রুমে আসে। তুলতুল বেডের মাঝে ঘুমিয়ে আছে। আর ধ্রুব তুলতুলের পাশেই চোখ বন্ধ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে। আরশি তাদের দু’জনকে দেখে মুচকি হেসে এগিয়ে আসে। ধ্রুবকে মৃদুস্বরে ডাক দিয়ে বলল-
“ধ্রুব ঘুম আসলে ভালো করে শুয়ে ঘুমা। এভাবে শুয়ে থাকলে ঘাড়ে ব্যথা করবে। কিরে শুনছিস! ধ্রুব…”
ধ্রুবর কোনো সাড়াশব্দ পেল না। আরশি ধ্রুবর পাশে এসে মাথায় হাত রেখে আবারও ডাক দিলো-
“ধ্রুব..”
এবারও কোনো সাড়াশব্দ পেলো না। ধ্রুবর ঘাড়টা আরশির দিকে এলিয়ে পড়লো। আরশি তৎক্ষনাৎ মেঝেতে বসে ধ্রুবকে ধরে ডাকতে লাগলো। কোনো লাভ হলো না। আরশির হার্ট জোরে জোরে ধুপধাপ করে লাফাচ্ছে। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। গলায় স্বর কণ্ঠনালীতেই আটকে যাচ্ছে। কাঁপা কাঁপা গলায় আরশি চিৎকার দিয়ে ধ্রুবকে আবারও ডাক দিলো। আরশির চিৎকারে তুলতুলের ঘুম ভেঙে গেছে। কান্না করছে। ড্রয়িং রুম থেকে সকলে দৌড়ে এসেছে রুমে। পুরো রুমে মুহুর্তের মধ্যেই ভীড় জমে গেল। কিন্তু ধ্রুব উঠছে না। রৌদ্র হন্তদন্ত হয়ে বেড রুম থেকে ছুটে আসলো। গায়ের গেঞ্জিটা ভেজা। হয়তো গোসলের পর শরীরর মোছার সময়টুকু পায়নি। নীলা তুলতুলকে কোলে তুলে নিল। কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। নীল ধ্রুবকে ডাকছে। রৌদ্র নীলকে সরিয়ে দিয়ে ধ্রুবর কাছে আসলো। আরশি অপলক দৃষ্টি তাকিয়ে আছে ধ্রুবর দিকে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে অনবরত। আনন্দমুখর পরিবেশটা যেন নিমিষেই বিষন্নতার প্রখর কালো ছায়ায় ডেকে গেছে। নিমিষেই সকলের হাসি মুখ উদাসিনতায় পরিবর্তন হয়েছে।
—————————
দেড় বছর পর,
মাঝ রাতে আরশির ঘুম ভেঙে যায়। আরশি শোয়া থেকে উঠে বসে। ঘাড় বাকিয়ে পাশে তাকায়। রৌদ্র ঘুমিয়ে আছে অন্য পাশে আর মাঝের ফাঁকা জায়গা দখল করে আছে রৌদ্রর ছোট্ট পরি। তাদের আদরের মেয়ে। ভালোবাসার প্রতিক ধ্রুবা মানে তুলতুল পাখি। আরশি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ধীর পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। বেড রুমের ঠিক অপর পাশের রুমটার কাছে এসেই স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে লক খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। প্রথমেই দৃষ্টি দেয় দেয়ালে টানানো বড় একটা ছবির দিকে। এই ছবিটা তুলতুলকে প্রথম যেদিন হসপিটালের জেনারেল ওয়ার্ডে সিফট করা হয় তখনকার। ধ্রুবর কোলে তুলতুল। দু পাশে দাঁড়িয়ে আছে আরশি আর রৌদ্র। ধ্রুব পেছনে নীল আর আদ্রাফ ধ্রুবর বানানো সেই বোর্ড টা উঁচু করে মাথার উপর ধরে রেখেছে। যেখানে বড় বড় করে লেখা- ‘YOU ARE MY SUNFLOWER’ ‘ধ্রুবর তুলতুল পাখি’ নীলের পাশে নীলা আর নির্বান। আদ্রাফের অপর পাশে কাসফিয়া সাদাফকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সকলের মুখে অমায়িক হাসি লেগে আছে। রুমটা ঠিক আগের মতোই আছে। যেভাবে ধ্রুব সাজিয়েছিলো ঠিক সেভাবেই। আরশি প্রতিদিন আসে এই রুমে। যখনই মন খারাপ হয় তখনই এই রুমটায় চলে আসে। আরশি আলমারি খুলে ধ্রুবর বানানো সেই বোর্ডটা ছুঁয়ে দেখছে। চোখ দুটো ভিজে এসেছে তার। ছেলেটা হঠাৎ করে তার জীবনে আসলো। সাথে করে নিয়ে আসলো এক সমুদ্র সুখের মুহূর্ত। কিছু সুখময় মুহুর্ত, সুপ্ত অনুভূতি আর এক আকাশ সমপরিমাণ ভালোবাসা দিয়ে মায়ায় জড়িয়ে আবারও হঠাৎ করেই হারিয়ে গেল। দিয়ে গেল বিষন্নতার কালো মেঘ। সেই কালো মেঘের আড়ালেই যেন ধ্রুব নামের তারা’টা লুকিয়ে গেছে। আরশির চোখেরজল মুছে আলমারি বন্ধ করতে নিবে তখনই রৌদ্রর দেওয়া রঙিন চিরকুটের জারটায় নজর পড়ে। আরশি জারটা হাতে তুলে নিলো। রঙিন চিরকুট গুলোর মাঝে একটা ধূসর কালো রঙের চিরকুট দেখা যাচ্ছে। আরশি ভ্রু কুচকে ফেলে। রৌদ্রর যখন তাকে এই জারটা দিয়েছিলো তখন তো রঙিন চিরকুট ছাড়া এমন ধুসর রঙের কোনো চিরকুট ছিলো না। আরশি বিছানায় বসে সব গুলো চিরকুট ঢেলে বের করলো ধূসর কালো রঙের চিরকুট। প্রচন্ড কৌতুহল নিয়েই চিরকুটটা খুলে পড়তে লাগলো।
প্রিয় রুদ্রাণী,
ভালোবাসি বলেছিলাম। তোমায় রৌদ্রর শহরের রুদ্রাণী করে রাখতে চেয়েছিলাম। বছরের পর বছর পেরুলো। কেটেছে অনেক গুলো তপ্ত দুপুর। ভালোবাসারা পূর্ণতা পেলো। #রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী ‘র আগমন ঘটলো। পাশের বারান্দায় চিঠি ছুড়ে ফেলার পাঠ চুকে গেলো। হাতে হাত রেখে, পায়ে পা মিলিয়ে পাশাপাশি চলার যাত্রাও শুরু হলো। শুরু হলো জীবনের নতুন এক ভালোবাসার অধ্যায়। পালটে গেলো অনেক কিছু। থেকে গেল তোমার লাজুকলতা। রয়ে গেল অস্বস্তিতে হাত কচলিয়ে লাল করে ফেলার অভ্যেস আগের-ই মতো। ভালোবাসাগুলো দৃঢ় হলো। মনের মাঝে প্রগাঢ় অভিলাষ হানা দিলো। তখনই অনুভব করলাম তোমার মনের হাহাকার। আহ.. কি সেই তীব্র হাহাকার! মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়ার তীব্র অাকাঙ্ক্ষা! ঘুরে গেলো বছর। কেটে গেল দুঃখ। অবশেষে ভালোবাসার কাছে ব্যর্থতারাও হার মেনে নিলো। কষ্টের মাঝে খুশির জোয়ার বয়ে গেলো। নতুন অস্তিত্বের আগমন ঘটিয়ে তোমার ঠোঁটের কোণে তৃপ্তিদায়ক হাসির রেখা দেখা দিলো। মনে ছিল কত সুখ আর কত স্বপ্ন! আচমকাই হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড় হলো। এলোমেলো হলো সব। লন্ডবন্ড হয়ে গেল সকল স্বপ্ন। তছনছ করে দিল সকল অাকাঙ্ক্ষা। তুমি ছিলে অজানায়। আর আমি! আমি ছিলাম ভিষণ ভয়ে। এই প্রথম বুঝি তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলাম? তোমার ইচ্ছে পূরণের বিনিময়ে তোমাকেই বিলিয়ে দিতে হলো। অপূর্ণ থেকে গেলো একসাথে বুড়ো হওয়ার ইচ্ছে। তোমার দাঁত বিহীন হাসি, কুচকে যাওয়া মুখ দেখার লোভ সামলাতে বেগ পেতে হলো খুব। একসাথে বাঁচতে চাওয়ার ইচ্ছে নিমিষেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে মিলিয়ে গেল আকাশে। ভালোবাসি বলেছিলাম। একসাথে বাঁচতে চেয়েছিলাম। একসঙ্গে বাঁচতে পারবো না তাতে কি! হাত ধরে পাশাপাশি মরতে পারার নতুন ইচ্ছে তো মনে পুষতেই পারি! এপাড়ে নয় ওপাড়ে তো এক হতেই পারি! রঙিন চিরকুটের জারটা আগের মতোই থাকবে। ভালোবাসাটাও দৃঢ় হবে। থাকবে না শুধু দুটি প্রান। থমকে যাবে চিঠির আদান-প্রদান। উড়ে যাবে রৌদ্র আর রুদ্রাণী নামক পাখি দুটো। কষ্টের মাঝেও থাকে আত্মতৃপ্তি। বিষন্নতার মাঝেও থাকে তীব্র ভালোবাসা। কিছু গল্প অপূর্ণ হয়েও যেন পায় পূর্ণতা! বেঁচে থাকবে আমাদের ভালোবাসা মৃত্যু আমৃত্যু এই রৌদ্র রুদ্রাণীর উত্তপ্ত শহরে।
ইতি,
তোমার রৌদ্র
চিরকুটটা পড়েই আরশির চোখ থেকে কয়েক ফোটা অশ্রুজল গাল গড়িয়ে পরলো। বিদুৎ ঝলকের মতো মনে পড়ে গেল দেড় বছর আগের সেই ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন। হয়তো রৌদ্র তার আগেই এই চিঠিটা লিখেছে। মনের মধ্যে ইচ্ছে পুষেছিলো একসাথে হাতে হাত রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার। আরশি কি তাহলে রৌদ্রর মনের সেই ইচ্ছেটাই স্বপ্নের মাঝে দেখেছে??
“আরু তুমি এখনো ধ্রুবকে আগের মতোই ভালোবাস তাই না! আর যাই হোক প্রতি রাতে এই রুমে আসা কখনো মিস হয় না তোমার।”
রৌদ্র ঘুম জড়ানো কন্ঠে চোখ কচলাতে কচলাতে কথাটা বলল। আরশি কোনো কথা না বলেই রৌদ্রর কাছে এসে রৌদ্ররকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। রৌদ্র খানিকটা হতভম্ব হয়ে গেছে। অস্থিরতার সাথে জিজ্ঞেস করল-
“কি হয়েছে আরু! হঠাৎ করে জড়িয়ে ধরলে কেন!”
আরশি কিছু না বলেই হাত উঁচু করে চিঠিটা রৌদ্রর দিকে দিলো। আরশি এখানো রৌদ্রকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। রৌদ্র চিঠি হাতে নিয়েই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
—————————
বারান্দায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে আরশি আর রৌদ্র। চারপাশে অন্ধকার। রাস্তার সোডিয়ামের আলোয় আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে রৌদ্র আর আর তার রুদ্রাণীকে। দুজন চুপচাপ রেলিঙের উপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের দৃষ্টি নির্জন রাস্তায় স্থির। শীতল হাওয়া বইছে। গা কাঁটা দিয়ে উঠছে মাঝ রাতের এই হিমশীতল বাতাসে।
চলতি সময়, থমকে দাঁড়ায়
জেগে জেগে স্বপ্ন দেখি হায়
তোমার এই হাত ধরতে চায়
ফাগুন হাওয়ায়।
কি মায়ার কোন, সে নেশায়
বারে বার মন ছুঁতে চায়
চেনা মুখ ঘুরপাক খায় চোখের পাতায়।
আমি বার বার বহুবার তোমাকে চাই
আমি বার বার হাজার বার তোমাকে চাই।
তুমি আমি আর নিরবতা,
শুনতে কি পাও এই মনে কথা
ভোর আঁধারেও তোমায় দেখি,
তুমি কবিতা, তুমি কবি।
আজকাল মন ডুবে যায়
অনুভবে তুমি ভাসো তাই
এই আমি না চিনি আমায়,
চেনা আয়নায়।
আমি বার বার বহুবার তোমাকে চাই
আমি বার বার হাজার বার তোমাকে চাই।
রৌদ্র আরশির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে পুরো গানটা গাইলো। আরশির মনে পড়ে গেল রৌদ্রর কন্ঠে প্রথম গান শোনার দিন। বিয়ের তিনদিন আগেই পুরোনো ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে ঠিক এই গানটাই গেয়েছিল রৌদ্র। ভালোবাসার কথা বলেছিল। পুরনো স্মৃতি মনে পড়তেই আরশি লজ্জায় মাথা নুয়ে ফেলল। হাত কচলানো শুরু করে দিয়েছে। রৌদ্র আরশির অবস্থা দেখে মুচকি হাসলো। আরশিকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল-
“মৃত্যু আমৃত্যু আমি শুধু তোমাকে চাই। তোমার ব্যর্থতা, মন খারাপ সব কিছু চাই। তোমার চোখের অশ্রুজল, তোমার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসি দুটোই চাই। তোমার লজ্জা, অস্বস্তি, রাগ সব কিছু চাই। শুধু তোমার ঘৃণা নয় ভালোবাসাটা-ই চাই।”
আরশি চমকে উঠলো। রৌদ্রর দিকে চেয়ে থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করল-
“আপনার এখনো এই কথা মনে আছে রৌদ্র!”
“তোমার নিয়ে প্রতিটি মুহূর্তই আমার মনে আছে রুদ্রাণী। এই রৌদ্র যে তার রুদ্রাণীকে প্রচন্ড ভালোবাসে।”
রৌদ্র আরশির মাথায় চুমু দিয়ে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তখনই খাঁচার ময়না পাখিগুলো চেচিয়ে বলে উঠল-
“ভালোবাসি রৌদ্র” “ভালোবাসি রুদ্রাণী” “অসভ্য ডাক্তার।”
পাখিগুলোর লাস্টের কথা শুনেই আরশি রৌদ্র এক সাথেই ফিক করে হেসে দিল। তারা আর কিছুক্ষণ বারান্দায় থেকে চলে আসলো ধ্রুবা’র কাছে। তুলতুলের নাম ধ্রুবা রেখেছে আরশি। হয়তো তুলতুলের মাঝেই আরশি তার ছোট্ট ভাই ধ্রুবকে খুঁজে পায় অথবা পেয়ে চায়।
————————
আজ আবারও আরশির ফ্রেন্ডসার্কেল একসাথে হয়েছে। এই কয়েক বছরে বদলে গেছে অনেক কিছু। নীলের ছেলে হয়েছে দু মাস হলো। নাম রেখেছে নিহাল। নীলা দু দিন আগেই জেনেছে সে প্রেগন্যান্ট আর সেই খুশিতেই আজ নির্বানদের বাসায় ছোট্ট একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।। আরশির ফ্রেন্ডসার্কেল, রৌদ্র আর আরশির বাবা-মা আর ধ্রুবর আম্মুও এসেছে এখানে। আরশিরা সবাই ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। তখনই সাদাফ তুলতুলকে দেখে আধো আধো গলায় অস্পষ্ট ভাবে বললো-
“আমার পরি পাখি এসেছে। আমার পরি পাখি।”
সাদাফ কথা গুলো বলেই তুলতুলের গাল ধরে আস্তে করে টান দিল। নির্বান চোখ ছোট ছোট করে বলল-
“এটা আবার কেমন নাম পরিপাখি?”
আরশি হেসে দিয়ে বলল-
“রৌদ্র তুলতুলকে পরি বলে ডাকে, আর আমি ডাকি তুলতুল পাখি। সাদাফ বাবা সেই গুলো শুনেই নাম দিয়েছে পরি পাখি।”
নির্বান ভাবুকতার সাথে বলল-
“ওওও এখন বুঝেছি।”
রৌদ্র তুলতুলকে আরশির কোল থেকে নিয়ে বলল-
“আরু! তুলতুলকে আমার কাছে দাও। আমি তুলতুলকে দেখছি। নির্বান তুই সাদাফ নে। আর শুভ্রতা তুমি নিহালকে নিয়ে আমার সাথে নিচে আসো। ওরা ফ্রেন্ডরা এখনে কিছুক্ষন আলাদা সময় কাটাক।”
রৌদ্রর আরশির দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি দিয়ে ছাদ থেকে চলে যায়।
“এনজয় ইউর টাইম পাশের বারান্দা।”
কথাটা বলেই নির্বান আর শুভ্রতাও বাচ্চা গুলোকে নিয়ে নিচে চলে যায়। এটা রৌদ্রর সব সময়ের কাজ। যখনই আরশির ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই এক সাথে থাকে তখনই তাদেরকে আলাদা কিছুটা সময় করে দেয় যেন তারা নিজেদের মতো মন খুলে আড্ডা দিতে পারে। নীল আরশির চুলে টান দিয়ে বলল-
“দেখেছি আদ্রাফ এই পেত্নীর জামাই মানে আমাদের দুলাভাই কত্তো বুদ্ধিমান। সব কিছুই কত সুন্দরভাবে ম্যানেজ করে।”
আরশি নীলের পিঠে সজোরে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলল-
“আমি পেত্নি হলে তুই কি! রাক্ষস হারামি।”
নীল পিঠে হাত মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো। আদ্রাফ, কাসফিয়া আর নীলা হাসিতে প্রায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। কাসফিয়া হাসতে হাসতে বলল-
“তোরা দু’জন মনে হয় বুড়া হয়ে গেলেও মানুষ হবি না৷ তখন দেখা যাবে তোরা হাতে লাঠি নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে মারামারি করছিস।”
কাসফিয়ার কথায় সবাই একসাথে ঝংকার তুলে হেসে উঠলো। বছরের পর পর পাল্টেছে। ঋতু পরিবর্তন হয়েছে। সময়ের আবর্তনে বদলে গেছে অনেক কিছু। সবার আলাদা আলাদা নতুন জীবন, সংসার শুরু হয়েছে। তবুও যেন তাদের ভালোবাসা আর বন্ধুত্ব আগের মতোই অটুট রয়েছে। এটাই হয়তো তাদের নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব।
__সমাপ্ত__🕊️