তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ১১
(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )
সন্ধ্যা ছয়টা বত্রিশ। চারিদিক কালো করে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। বাড়ি ফিরতে দেরী হয়ে গেছে সায়রার। নানুভাই তো কিছুতেই একা ছাড়তে চায়নি। একপ্রকার জোর খাটিয়ে সায়রা বেরিয়ে এসেছে। তাড়াহুড়োর ভেতর ছাতাটাও আনা হয়নি। বৃষ্টির কারণে রাস্তাঘাট ফাঁকা। খুব একটা লোকজন নেই। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে হুরহুর করে রিকশা চলছে। বৃষ্টির ছিটাফোঁটায় সায়রার গা ভিজছে। রিকশার উপরের বড় ফোঁটা দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে মাথায় পানি পড়ছে। এতে সায়রার সম্পূর্ণ শরীর ভিজে একাকার। শীতল হাওয়ায় ঠকঠক গা কাঁপছে তার। বাড়ির সামনে রিকশা থামতেই ভাড়া মিটিয়ে দ্রুত পায়ে ভেতরে চলে গেল সে। দুবার বেল বাজাতে আরমিন দরজা খুলল। আরমিনকে দেখে সায়রা প্রশস্ত হাসল। ভ্রু উঁচিয়ে দুষ্টু ভরা ইঙ্গিত দিলো। প্রত্যুত্তরে আরমিন কিছু বলল না। মলিন মুখ করে ভিতরে চলে গেল। ভ্রু কুঁচকে এলো সায়রার। ভিতরে ঢুকতে থমথমে এক পরিবেশ অনুভব করল। ড্রইং রুমেই সবাই বসে অথচ নীরব থমথমে পরিবেশ। ছোট ছোট পা ফেলে নিজের রুমে চলে গেল সায়রা। পাখি বিছানায় শুয়ে পড়ছিল। সায়রাকে দেখে উঠে বসল। চোখে মুখে কৌতূহলের আভাস যেন কিছু বলতে চাইছে সে। কিন্তু ভয় দ্বিধাদ্বন্দ্বে সাহস করে বলতে পারছে না। যদি সায়রাপু ধমক দেয়?
সায়রা চুল মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করল,
— ” কি হয়েছে, বাহিরে কেস কি? এমন থমথমে নিরিবিলি পরিবেশ কেন?”
সায়রার জিজ্ঞাসাবাদে পাখি যেন ভরসা পেল। বড়বড় চোখ করে উৎসাহী স্বরে বলে শুরু করল,
— ” জানো সায়রাপু কি হয়েছে?”
— ” না বললে জানব কি করে?”
— ” আরে শুনোই না! আরমিন আপুকে যারা দেখতে এসেছিল তাদের আপুকে পছন্দ হয়েছে।”
সায়রার ঠোঁটে চওড়া হাসি ফুটে উঠল। গদগদ স্বরে বলল,
–” যাক আলহামদুলিল্লাহ্! ”
–” কিন্তু… বিয়েটা বোধহয় হবে না।”
পাখি আমতা আমতা করে বলল। সায়রার দৃষ্টি গাঢ় হলো। মুখে চিন্তার ভাব স্পষ্ট। উদ্বিগ্নতায় বলে উঠে,
–” হবে না কেন? ছেলে কি দেখতে শুনতে খারাপ নাকি অন্যকোন সমস্যা আছে!”
— “সব ঠিক আছে। কিন্তু ছেলের মা পাঁচ লাখ টাকা দাবী করেছে। বলেছে পাঁচ লাখ টাকা দিলেই তারা এই বিয়েতে রাজি হবে।”
–” দাদী কি বলল?”
— ” দাদী উনাদের প্রস্তাবে পাঁচ লাখ টাকা দিতে রাজি।”
সায়রার দৃষ্টি আরো গাঢ় হলো,
–” বাবা মা কি বলল?”
–” আব্বু আম্মু সাফ মানা করে দিয়েছে! বলেছে , দরকার হলে আমাদের মেয়েকে আজীবন ঘরে বসিয়ে পালবো তবুও এমন লোভী পরিবারের হাতে তুলে দেব না।”
সায়রা ছোট নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
–” ঠিকই তো করেছে বাবা মা। যেই পরিবার বিয়ের আগেই এমন দাবী করে, বিয়ের পর যে আপুর উপর টাকা পয়সার জন্য অত্যাচার করবে না তার কি গ্যারান্টি আছে?”
পাখি জ্ঞানীদের মত মাথা নাড়াল। সায়রা জামা পাল্টে ঘরে আসতেই ড্রইং রুম থেকে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে এলো। দুবোন দ্রুত পায়ে দরজার আড়ালে যেয়ে দাঁড়াল। বাহিরে নূরজাহান বেগম সায়রার মায়ের সাথে রাগারাগি করছে। রাগান্বিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠল,
–” বিয়েটা ফিরিয়ে দিলে কেন? কত ভালো ছেলে কত বড় চাকরী তার।এমন সম্বদ্ধ কি রোজরোজ আসে? কেন এমন করলে? পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে বলে! তোমার মেয়ের বেলায় চাইলে কি না করতে পারতে? ভুলে যেওনা আজ আরমিনের এই দশা তোমার মেয়ের জন্য!”
সিন্থিয়া বেশ শান্ত হয়ে বোঝানোর স্বরে শাশুড়িকে বললেন,
–” এখানে টাকার কথা আসছে কোথা থেকে! মা আপনি আমাদের ভুল বুঝছেন। সায়রা আমার কাছে যেমন আরমিনও তেমনি। দুজনই আমার মেয়ে। এ বাড়িতে সায়রার যতটুকু অধিকার আরমিনেরও ততটাই অধিকার।”
নুরজাহান বেগম ভেঙচি কেটে তাচ্ছিল্য স্বরে বললেন,
–” উম! মুখে বললেই হলো? ননদের মেয়ে কখনো নিজের মেয়ে হয়না। যদি মেয়েই ভাবতে বিয়েটা ফিরিয়ে দিতে না।”
সিন্থিয়া সামান্য উঁচু স্বরে বললেন,
–” মা আপনি বারবার অযুক্তিক কথাবার্তা বলছেন। মেয়েটাকে ঐ লোভী পরিবারের হাতে তুলে দিলেই হলো? বাকি জীবন আরমিনের কি ভাবে কাটবে একবার ভেবে দেখেছেন? যে পরিবার বিয়ের আগেই এমন করছে বিয়ের পর কি কি করতে পারে ভাবেন একবার! ”
সিন্থিয়ার যুক্তিতে নুরজাহান বেগম চুপ করল কিন্তু ক্ষান্ত হলো না। বড় বড় পা ফেলে হনহন করে নিজের ঘরে চলে গেলেন তিনি। পরিবারের এসব ঝামেলা দেখে মন খারাপ হলো সায়রার। এই মুহূর্তে সায়রার মনে হচ্ছে, দাদী যেনতেন করে যারতার হাতে আরমিন আপুকে তুলে দিয়ে নিজের বোজ হালকা করতে চাইছে। অথচ এটা বুঝছে না বহি সৌন্দর্য থেকে ভেতরের সৌন্দর্য বেশি দামী। আরমিনের সামান্য পায়ের ক্ষুদ তার চারিত্র ও ভেতরের সৌন্দর্যকে কমাতে পারবেনা। সেই রাতে খাওয়া হলো না সায়রার। মন খারাপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। বাহিরে তখন অঝোর বৃষ্টি। ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া। খানিক বাদেই চোখের পালায় গভীর ঘুম নামল।
সেই ঘুম ভাঙল গভীর রাতে ফোন বেজে উঠায়। ফোনের রিংটোনে মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। মাথা চেপে বিরক্তির সাথে উঠে বসল সায়রা। ঘুমঘুম চোখে হাতিয়ে ফোনটা খুঁজে বের করল। মোবাইল কানে তুলে আড়ষ্ট স্বরে ‘হ্যালো’ বলতেই অপর পাশ থেকে অস্থির আওয়াজ ভেসে আসে,
–” তুই কোথায় সায়রা?”
সায়রা ভ্রু কুঁচকে নিদ্রা ভারী দৃষ্টিতে মোবাইলে চোখ বুলাল। গোটাগোটা অক্ষরে লিখা ‘আরসাল ভাই’। গতকালই নাম্বারটা সেভ করেছে। আরসালের এমন উদ্ভট প্রশ্নে সায়রা বিরক্ত হলো। তেঁতো মুখ করে জবাব দিলো,
–” রাত তিনটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। এতরাতে নিজের বিছানা ছাড়া অন্য কোথায় থাকব আরসাল ভাই?”
সায়রার ত্যাড়া উত্তরে আরসাল সম্ভাবত বিরক্ত হলো। ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে। আগের তুলনায় দ্বিগুণ অস্থিরতার স্বরে বলল,
–” এখনি তোদের ছাদে আয় আমি অপেক্ষা করছি।”
সায়রা বাচ্চাদের মত কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল,
–” এত রাতে ছাদে যেতে পারবো না। মাথা ঘুরছে আমার।”
অপর পাশ থেকে ক্ষিপ্ত স্বর ভেসে এলো,
–” একদম বাহানা দেখাবি না সায়রা। তুই ছাদে আসবি? নাকি আমি তোর কাছে আসবো?”
সায়রা তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। শুকনো ঢোঁক গিলে বলল,
–” আপনার এত কষ্ট করতে হবেনা। আমিই আসছি!”
ফোনটা কেটে গেল। সায়রা দুইহাতে মাথা চেপে দাঁড়িয়ে আছে। হুট করে ঘুম ভাঙ্গায় বেশ যন্ত্রণা করছে। শরীরেও শীত শীত লাগছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। বিছানার পাশ থেকে পানির গ্লাস তুলে ঢকঢক করে এক নিশ্বাসে পুরোটা পানি শেষ করল। শরীরে ভারী চাদর জড়িয়ে ছোট টর্চ লাইটা নিয়ে আলতো পায়ে ছাদের সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল।
ছাদের দরজা ভিড়ানো। হালকা ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। বৃষ্টি থেমেছে অনেক আগে। জ্যোত্স্নার আলোয় চারিদিক আলোকিত। ছাদের জমে থাকা সচ্ছ পানিতে চন্দ্রসুধার ছাপ স্পষ্ট। আশেপাশে চোখ বুলাল সায়রা। দেখল,
ছাদের শেষ মাথায় রেলিং- এ হেলান দিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। এটা যে আরসাল, তা বুঝতে কষ্ট হলো না সায়রার। ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে সেদিকে গেল।
আরসাল সিগারেটের বিষাক্ত ধোঁয়া উড়াচ্ছে। পরনে ফিনফিনে সাদা শার্ট। শার্টের সামনের কয়েকটা বোতাম খোলা। ফর্সা বুকটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এলোমেলো চুল। আজ মানুষটাকে এত এলোমেলো লাগছে কেন? সায়রা গম্ভীর হয়ে ভাবল! সায়রাকে দেখে আঁধ জ্বলা সিগারেটটা পায়ের নিচে পিষিয়ে নিলো আরসাল। সায়রা জড়সড়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। শীতে কাঁপছে সে। এলোমেলো খোলা চুল গুলো বারবার মুখে এসে পড়ছে। কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা। নীরবতা ভেঙে ধীর আওয়াজে বলল সায়রা,
— ” ডাকছিলেন কেন আরসাল ভাই?”
সায়রার ধীর আওয়াজ কি আরসালের কর্ণপাত হলো? সায়রার অনুমান ‘নাহ’। আরসাল তখনো সায়রার দিকে নিমিষ দৃষ্টিতে চেয়ে। মাথা তুলে তাকাল সায়রা। আরসালের কোন হেলদুল নেই। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। আবারো মাথা তুলে তাকিয়ে। সাহস করে বলল,
— ” আমি কি চলে যাবো?”
এবারো কোন উত্তর নেই। আরসাল দু কদম এগিয়ে এলো। সায়রার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
–” তুই এই বিয়ে করবিনা সায়রা!”
আরসালের কথা সায়রার মস্তিষ্কে খেলল না। বিরবির করল,
–” বিয়ে করব না?”
আরসাল হালকা ধমকে বলল,
— ” হ্যাঁ, তুই বিয়ে করতে পারবি না!”
সায়রার রাগ হলো। এত রাতে কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে এই কথা বলতে ছাদে ডেকেছে? দাঁত কিড়মিড় করে বলল সায়রা,
–” কেন পারবো না আরসাল ভাই?”
— ” আমি মানা করেছি তাই!”
–” আপনি মানা করছেন বলেই কি শুনতে হবে?”
–” হ্যাঁ শুনতে হবে।”
–” পারবো না শুনতে”
বলেই সায়রা পিছ ঘুরল। নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই। আচমকা পেছন থেকে হাতে হেচকা টান পড়ল। সায়রার মাথা ঘুরিয়ে গেল। চট করে আরসালের বুকে যেয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে আছে সায়রা। মাথাটা এখনো ভনভন করে ঘুরছে। ঘাড়ে কারো ভারী তপ্ত নিশ্বাস পড়ছে। কানে আসছে হৃদপিন্ডের টিপটিপ আওয়াজ। নিজেকে ভীষণ এলোমেলো লাগছে সায়রার। অকস্মাৎ, কানে ফিসফিস আওয়াজ ভেসে এলো,
–” একদম,জানে মেরে ফেলবো। কাউকে বিয়ে করতে পারবি না তুই!”
বুকে থুতনি ঠেকিয়ে, পিটপিট দৃষ্টি মেলে আরসালের দিকে তাকাল সায়রা। থম মেরে রইল আরসাল। চন্দ্রসুধা সায়রার মুখশ্রী গ্রাস করছে। আহ! কি মায়া! এই মুখখানায় এত মায়া কেন? এত সচ্ছ সুন্দর চোখ এই ভুবনে দ্বিতীয়টা আছে কি? সায়রা বাচ্চাদের মত করে প্রশ্ন করল,
— ” আমি কাউকে বিয়ে করতে পারবো না কেন আরসাল ভাই?”
— ” কারণ আমি হতে দিবো না!”
আরসালের সোজাসুজি উত্তর। এবার কন্ঠে রাগ নেই। আছে শুধু একরাশ অনুভূতি, অনুরাগ। চোখে কিছু তো আছে তার? হয়তো, কোন এক ভয়ংকর নেশা! না এ চোখে বেশিক্ষণ তাকানো যাবেনা। মাথা ধরছে সায়রার। মাথা নুয়ে আরসালের বুকে মুখ গুজল। সায়রার তপ্ত নিশ্বাস আরসালের বুক চিঁড়ে হৃদয় অবধি পৌঁছাচ্ছে। বুকে প্রচণ্ড বেগে ঝড় উঠেছে তার। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নিশ্বাস উঠানামা করছে। প্রচণ্ড অস্থির লাগছে । সে এসেছিল সায়রাকে শাসাতে। কঠিন গলায় কয়েকটা কথা শুনাতে। দুমড়ে মুচকে দিতে। অথচ এই ঘুম জড়ানো অগোছালো মেয়েটাকে দেখে সে সব ভুলে গেল? নিজেই এলোমেলো হয়ে রইল। এই দেড় ফুট মেয়েটা কিনা তাকেই কাঁপিয়ে ফেলল? এভাবে কাঁপছে কেন সে? আজ সায়রাকে এত নেশালো লাগছে কেন? বারবার ঘোরে চলে যাচ্ছে আরসাল!
এখনো আরসালের বুকে মাথা ঠেকিয়ে আছে সায়রা। চোখ বন্ধ। আড়ষ্ট গলে আসা স্বরে ফিসফাস করল,
–” মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে আরসাল ভাই! শরীরে একদম শক্তি নেই। আমি নিচে যাবো। নিচে নিয়ে যান।”
আরসালের হুশ ফিরল। সায়রাকে বুক থেকে তুলে কপালে হাত দিলো। অস্থির স্বরে বলল,
–” গা গরম কেন? তোর কি জ্বর হয়েছে সায়রা?”
সায়রা উত্তর দিলো না। আবারো আরসালের বুকে ডলে পড়ল। খানিক চুপ থেকে আগের মত গলে আসা স্বরে বায়না করল,
–” জানিনা। আমাকে নিচে নিয়ে যান আরসাল ভাই! প্রচণ্ড শীত করছে আমার।”তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ১২
(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )
প্রত্যেক আঁধার কালো রাতের পর উজ্জ্বল দ্যুতিময় এক ভোরের সূচনা হয়। গত রাতের ঘন বর্ষন চারিদিকে সতেজতার আমেজ ছড়িয়ে গেছে। সোনালি রোদ আর এলোমেলো নিখাদ হাওয়ার উদম এক প্রতিযোগিতা চলছে। সায়রার ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে। জ্বর ছেড়েছে কিন্তু দুর্বলতা রয়েই গেছে। বেশ কিছুক্ষণ চোখ বুঝে আধো আধো ঘুম নিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে। গতরাতের কথা মনে করে ধপ করে শোয়া থেকে উঠে বসে। সে তো ছাদে ছিল! ঘরে ফিরল কি করে? একা এসেছে? কিন্তু কিছু মনে পড়ছেনা না কেন? মাথা চেপে মনে করার চেষ্টা করল সায়রা। আবছা আবছা মনে পড়ছে, সম্পূর্ণ মনে করতে পারছেনা। এমন সময় আরমিন ঘরে প্রবেশ করে। সায়রাকে জাগতে দেখে, চওড়া হেসে বলে,
— ” উঠে গেছিস সায়রা? জ্বর ছেড়েছে? এখন কেমন লাগছে?”
সায়রা ভাবলেশহীন আমতা আমতা উত্তর দিলো,
— ” হুম, আপু আগের থেকে কিছুটা ভালো।”
— ” রাতে তোকে অচেতন দেখে যা ভয় পেয়েছিলাম। ভাগ্যিস আরসাল ভাই দেখেছিল!”
সায়রা তড়াক করে মাথা তুলে আরমিনের দিকে তাকায়। চোখে মুখে ভয়ের আভাস। চটুল স্বরে প্রশ্ন করল,
— ” আরসাল ভাই? উনি আমাকে দিতে এসেছিল? এখানে!”
আরমিন সায়রার খর্খরে ভাব দেখে বিছানায় বসে পড়ে। সায়রার মুখপানে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— ” হ্যাঁ, আরসাল ভাই এখানে এসেছিল। তুই এভাবে রিয়েক্ট করছিস কেন?”
— ” না মানে এতকিছুর পর উনি এখানে। সবাই কি ভাবছে কে জানে!”
— ” কেউ কিছু ভাবছে না। আরসাল ভাইকে কেউ দেখেনি। হুট করে রাত চারটার দিকে আরসাল ভাই ফোন করে বললেন, তুই ছাদে সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছিস। আমি দ্রুত ছাদে চলে যাই। দেখি তুই অচেতন হয়ে আরসাল ভাইয়ের কোলে। উনাকে জিজ্ঞাস করলে বললেন, ঘুম ধরছিল না বলে ছাদে ঘুরাঘুরি করছিল এই ছাদে কাউকে পড়ে থাকতে দেখে সাহায্যের জন্য এসেছিলেন। তারপর তোকে কোলে করে চুপিসারে রুম অবধি নিয়ে আসে। চিন্তা করিস না। বাড়ির কেউ কিছু টের পায়নি।”
ফোঁস করে গলায় আটকে থাকা নিশ্বাস ছাড়ল সায়রা। ভাগ্যিস আরসাল ভাই মিথ্যা বলে সব সামলেছে। ধরা পড়লে কি কাণ্ডটাই না হয়ে যেত! সায়রার ভাবনায় ছেদ পড়ল আরমিনের ডাকে। অনাস্থার স্বরে জিজ্ঞেস করে,
— ” এত রাতে জ্বর নিয়ে ছাদে গেলি কেন?”
সায়রা জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আমতা আমতা করে বলল,
–” রাতে হ্ঠাৎ ঘুম ভেঙেগেছিল। মনে পড়ল, ছাদে কাপড় দিয়েছিলাম আনা হয়েছে কিনা তা দেখতেই ছাদে গিয়েছিলাম।”
–” তুইও না সায়রা! পারিসও বটে। যদি কোন অঘটন ঘটত? ভাগ্যিস আরসাল ভাই দেখেছিল নাহয় কি হতো ভাবতে পারছিস? !”
সায়রা মৃদু হাসল। মনে মনে বলল,” তুমি উনাকে চিনো না আপু! উনি- ই যত নষ্টের মূল। উনার কারণেই তো ছাদে গিয়েছিলাম। নয়তো আমার কি শখ জেগেছিল নিশি রাতে ছাদে গিয়ে ভূতেদের সাথে লুডু খেলার?
আরমিন প্রশস্ত হেসে সায়রার গালে হাত ছুঁয়ে বলল,
–” রুটি ভেজে দিচ্ছি। তুই ফ্রেশ হয়ে নে!”
–” আচ্ছা আপু।”
আরমিন চলে যেতেই ফোন হাতে নিলো সায়রা। আটটা মিসকল! কে করল? আরসাল ভাই। সকাল সকাল কেন? কোন জরুরী দরকার কি? সায়রা থমকে রইল। বিস্ময় কাটিয়ে দ্রুত ফোন লাগাল আরসালকে। একবার রিং বাজতেই ফোন তুলল। যেই ফোনের অপেক্ষায়- ই ছিল। অপর পাশ থেকে আরসালের উদ্বিগ্ন আওয়াজ,
–” তুই ঠিক আসিস সায়রা?”
সায়রার মৃদু উত্তর,
–” হুম!
–” জ্বর ছেড়েছে? কয়টা ফোন করেছি। ফোন তুলছিলি না কেন?”
–” ঘুমাচ্ছিলাম! ফোন সাইলেন্ট ছিল আরসাল ভাই।”
অপর পাশের মানুষটার উদ্বিগ্নতা কমে স্নিগ্ধ কন্ঠ ভেসে এলো,
–” মাথা ব্যথা কমেছে?”
–” হুহ”
— ” হঠাৎ এত জ্বর হলো কি করে?”
–” গত সন্ধ্যায় নানুবাড়ি থেকে ফেরার সময় বৃষ্টির খপ্পরে পড়েছিলাম। তাই হয়তো!”
অপর পাশ থেকে আরসালের স্পষ্টবাক্য,
–” একটু বারান্দায় আয় তো সায়রা!”
সায়রার ভ্রুদ্বয় কুঁচকে এলো। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কাটল। গাঢ় স্বরে বলল,
–” এখন?”
–” হুম”
সায়রা আলস্য পায়ে টলতে টলতে বারান্দার দিকে পা বাড়ায়। শরীর এখনো ভীষণ দুর্বল । বারান্দার দরজায় মাথা ঠেকিয়ে ঠেশ দিয়ে দাঁড়ায় সায়রা। সামনের খোলা বারান্দায় আরসালকে দেখা যাচ্ছে। পরনে রাতের সেই পোশাক। ফিনফিনে সাদা শার্ট। উষ্কখুষ্ক এলোমেলো চুল। নিদ্রাজড় রক্তিম চোখ। সায়রা থমকে গেল। রাতে কি আরসাল ভাই ঘুমায়নি? সারারাত কি এখানেই ছিল?
আরসাল নিমিষ দৃষ্টিতে সায়রার দিকে তাকিয়ে। ঘুম জড়ানো আড়ষ্ট চোখ সায়রার। ঘুম ঘুম আমেজটা এখনো কাটেনি। সকালের সোনালি রোদ সায়রার চোখমুখ ছুঁয়ে দিচ্ছে। এলোমেলো নিখাদ হাওয়ায় বারবার অবাধ্য চুল গুলো মুখে এসে পড়ছে। সায়রা আটকাচ্ছেনা। দরজায় মাথা ঠেকিয়ে ঘুম জড়ানো দৃষ্টিতে অপলক আরসালের দিকে তাকিয়ে আছে। জ্বরের প্রখরতায় তার সৌন্দর্য ছাপাতে পাড়েনি। বরং সকালের সতেজতায় ভোরের ফুটন্ত শুভ্র গোলাপের মতই স্নিগ্ধ লাগছে। সচ্ছ সরল আঁখির ড্যাবড্যাব চাহনি বুকে হিমেল তীরের মত লাগল । এর আঘাতে কোন যন্ত্রণা নেই বরং একরাশ শান্তি মোড়ানো। গত রাত থেকে বুকে জ্বলন্ত অগ্নিগিরিতে যেন হিমেল হাওয়া লাগল। বুক জুড়ে এক সজীবতার আভাস। এই মুখখানায় এত শান্তি কেন?
অপরপাশ থেকে সায়রার ডাকে হুশ ফিরল আরসালের। সায়রা বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
–” আপনি সারারাত এখানেই ছিলেন? ঘুমান নাই আরসাল ভাই?”
–” চেষ্টা করেছি, ঘুম হয়নি!”
–” কেন?”
সায়রা চট প্রশ্ন করল। আরসাল কয়েক পলক সায়রার দিকে নিভৃত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। দুজনের দৃষ্টি মিলল। সায়রা লাজুক ভঙ্গিতে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। কয়েক সেকেন্ড পিনপতন নীরবতা। নীরবতা ভেঙে উৎকণ্ঠা স্বরে বলল আরসাল,
–” তুই এই বিয়েটা করবিনা সায়রা!”
বিয়ের কথা শুনে গত রাতের কথা আবছা মনে পড়ল সায়রার। বিরবির স্বরে বলল,
–” কিসের বিয়ে আরসাল ভাই?”
আরসালের রাগ হলো। প্রচণ্ড রাগ। সায়রা জেনেশুনে তার সাথে না বুঝার ভান করছে? ভান? আরসাল ক্ষিপ্ত স্বরে দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠল,
–” কাল তোকে যারা দেখতে এসেছিল। তোর মায়ের কালিগের ছেলে!”
সায়রার টনক নড়ল। বুঝানোর স্বরে বলল,
–” আপনার ভুল হচ্ছে আরসাল ভাই। কাল উনারা আমাকে না আরমিন আপুকে দেখতে এসেছিল। কাল আমি তো বাড়িই ছিলাম না। নানুবাড়ি থেকে সন্ধ্যায় ফিরেছি।”
সায়রার উত্তরে আরসালের ক্ষিপ্ত মেজাজ মুহূতেই ঠাণ্ডা বরফ বনে গেল। মন নেচে উঠল। উৎসাহী স্বরে বলে উঠল,
–” তুই সত্যি বলছিস সায়রা?”
–” মিথ্যা বলে আমার কি লাভ?”
আরসালের মন ভালো হয়ে গেল। গত কাল থেকে মাথায় ঘুরা চিন্তাটা যেন অবসান ঘটল। বড় নিশ্বাস ছাড়ল। কয়েক সেকেন্ড পর বেশ শান্ত স্বর ভেসে এলো,
–” নাস্তা করা হয়েছে? ”
সায়রা এদিকওদিক মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো,
–” উহু! এখনো করা হয়নি। ”
–” যা ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে মেডিসিন নে।”
আরসালের কথায় সায়রা পিছন ঘুরে ঘরের দিকে পা বাড়াতেই , আরসাল থামিয়ে দেয়। সায়রা পিছন ফিরে তাকায়। দেখল- আরসাল কেমন জানো আবেগ মাখানো অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এই দৃষ্টি কিছুটা চিন্তা আর অনেকটাই সংমিশ্রিত অনুভূতিতে জড়ানো। আরসাল বলল,
–” শরীর সুস্থ হওয়া অবধি বাড়ি থেকে বের হতে হবিনা। টাইম টু টাইম মেডিসিন নিবি। কোন হেলামি করবি না।”
সায়রা এক পলক আরসালের দিকে তাকাল। মৃদু হেসে ধীর স্বরে বলল,
–” আচ্ছা”
ফোন কাটল। সায়রা ভিতরের চলে গেল। আরসাল ঠাই সায়রার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে। সায়রা চোখের আড়াল হতেই আরসাল নিজের ঘরে চলে গেল।
বিছানায় লম্বালন্বি সটান শুয়ে চোখ বুঝল আরসাল। এবার বুঝি চোখের পাতায় ঘুম নামবে!
চলবে……