#স্নিগ্ধ_গাংচিল
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১২
আদ্রিনের আজ ভার্সিটি’তে ক্লাস ছিল। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সে ক্লাস করতে যেতে পারলো না। কারণ বিজনেসের কাজে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। অন্য একটা বড়ো কোম্পানির সাথে জরুরি মিটিং থাকার কারণে ভার্সিটি যেতে পারেনি। যার ফলে আজ সে তার প্রাণসীকে দেখতে যেতে পারেনি। প্রতিদিন তার চাঁদকে এক পলক দেখা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যে করেই হোক, কাল ভার্সিটিতে উপস্থিত হতে হবে। আদ্রিনের টিচিং পেশাটা পছন্দের নয়, সে শুধুমাত্র মুনকে দেখার জন্যই এই টিচিং পেশাটায় জয়েন করেছে। শুধুমাত্র মুনের জন্যই সে এই বিরক্তিকর পেশাটা নিয়েছে। মুনকে অগোছালো-রূপে প্রথম যেদিন এয়ারপোর্টে দেখেছে সেদিনই আদ্রিন মুনের মধ্যে আটকে গিয়েছে। এরপর কুইন্সে দেখে মুনের মধ্যে পুরোপুরি আদ্রিন নামক মানুষটা আটকে গিয়েছে। আদ্রিন মুনের মায়ায় আবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। সেদিন সাদা গ্রাউনে মুনকে আদ্রিনের দিকে দৌড়ে এগিয়ে আসতে দেখে আদ্রিনের শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ জেগে উঠেছিল, মুনের স্পর্শ, ভয় পাওয়া সবকিছুতে আদ্রিন আটকে গিয়েছিলো। আদ্রিন তার এই অনুভূতিটাকে প্রথমে মোহ ভেবে মুনকে না চাইতেও বিভিন্ন বাজে কথা বলেছিলো কিন্তু দিন যতই যায় আদ্রিন বুঝতে পারে – এটা তার মোহ নয়।
আদ্রিন মিটিং শেষ করে বাসায় ফিরে নানীমার সাথে আগে দেখা করলো। এরপর নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে তার দেয়ালে আটকানো সেদিনের ছবিটাতে হাত বুলিয়ে দেখতে থাকলো। আরেকটা দিন। কাল সকালে গিয়েই আদ্রিন তার মনের কথা মুনকে বলে দিবে। সে যে এভাবে লুকোচুরি করতে আর পারবে না। অনেক তো হলো লুকোচুরি। এই টিচিং পেশাটা অনেকদিন মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে করেছে এখন আর করতে পারবে না। কাল গিয়েই মুনকে সব কথা বলে টিচিং পেশাটা ছেড়ে দিবে।
———–
ইরা-মুন দেশে ফিরেই আফজাল শেখের সাথে আগে হাসপাতালে চলে গিয়েছে। মুনের মা রাশিদা ইসলামের জ্ঞান ফিরেছে। তিনি জানতো না, মুনের দেশে ফেরার কথা।
মুন গিয়ে ক্যাবিনের সামনে দাঁড়াতেই ডাক্তার বেরিয়ে এসে আফজাল শেখের উদ্দেশ্যে বলল,
-‘রোগী বেশি টেনশন করে। এতো চিন্তা মাথায় প্রেসার পড়ে। সবসময় মন ভালো রাখতে চেষ্টা করবেন। যদি এমন-ভাবেই চলতে থাকে তাহলে হিতে-বিপরীত হবে।’ বলেই ডাক্তার নিজ গন্তব্যে চলে গেল।
মুন ধীরে ধীরে পা ফেলে রাশিদা ইসলামের পাশে বসে ডাক দিল। তিনি মুনের ডাক শুনে ফিরে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তিনি বুঝতে পারছেন না -এটা কী তার স্বপ্ন না-কি ভ্রম! তিনি তার হাতটা ধীরে ধীরে এগিয়ে মুনকে ছুঁয়ে দেখে কান্না করে দিল। মুনও মা’কে এভাবে দেখে আর কান্না আটকিয়ে রাখতে পারলো না।
মা-মেয়ে অনেক্ষন কান্না-কাটি করে ঠিক হতেই মুন ইরার কথা বলল রাশিদা ইসলামকে। দূর থেকে ইরা ঝাপসা চোখে মা-মেয়ের কথোপকথন দেখছে। তার এখন ভীষণ করে মায়ের সান্নিধ্য লাভ করতে ইচ্ছে করছে। মুন ইরার চোখ দেখে মা’কে ইশারায় কিছু একটা বুঝালো। রাশিদা ইসলাম আস্তে আস্তে উঠে বসে ইরাকে হাত দিয়ে ইশারায় কাছে ডাকলেন। ইরা এগিয়ে যেতেই তিনি হাসিমুখে ইরাকে জড়িয়ে ধরলেন আর বললেন – তাকে যাতে মায়ের মতোই মনে করে, যখন যেটা ইচ্ছে ঐটা খাওয়ার আবদার ধরতে মুনের মতো। ইরা হাসিমুখে মাথা নাড়লো। মুনকে দেখে রাশিদা ইসলাম আর হাসপাতালে থাকতে চাইলো না। ডাক্তারও হাসিমুখে চিকিৎসা করে বলল, রোগী সুস্থ আছে মুটামুটি, দুইদিন ব্যাড রেস্টে থাকলেই হবে।
অবশেষে সবকিছু নিয়ে মুন-ইরা সহ হাসপাতাল থেকে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। এতকিছুর মাঝে তাদের প্রীতির উপর আর কারো খেয়াল ছিল না। বাসায় গিয়ে দেখল প্রীতি নেই। হয়ত কোনো কাজে বাইরে গিয়েছে ভেবে সবাই চুপচাপ ছিল কিন্তু রাত হয়ে যাওয়ার পরেও প্রীতির না ফেরা দেখে সবার মাথায় দুঃচিন্তা ভর করলো। রিফাতকে খবরটা দিতেই সে মাথা চেপে ধরে বসে পড়ল।
সবারই দুঃচিন্তা, শুধু একজন ছাড়া। সে হলো আফজাল শেখ। তিনি জানতেন এমন কিছুই হবে। তার মোটেও মেয়েটিকে সুবিধার মনে হয়নি, আর তার এই ছেলের প্রাপ্য শাস্তি মেয়েটিই দিয়ে দিল। আফজাল শেখকে উপরে চিন্তাগ্রস্ত দেখা গেলেও মনে মনে তিনি মহা-খুশি। তবুও সবার এরূপ চিন্তাগ্রস্ত মুখ দেখে তিনি থানায় জিডি করে আসছেন। বাসায় এসে দেখে প্রীতির সাথে সাথে রিফাত প্রীতিকে যা অর্থ জমা দিয়েছিলো – সেগুলোও গায়েব। সবার আর বুঝতে বাকি রইলো না -কাহিনী কী!
আফজাল শেখের অর্থ বা প্রীতির জন্য কোনো চিন্তা নেই। তিনি এতদিনে একটা মন-ভরে শ্বাস ফেলল,’যাক বাবা! এতদিনে একটা মনের মতন কাজ হলো!’ আপনমনেই বিড়বিড় করে হেসে উঠল। প্রীতি নিজে থেকে এই বাড়ি থেকে বের না হলেও আফজাল শেখ বের করতো। ‘যেমন ছেলে তেমন মেয়ে’ বলে মনে মনে হাসলেন।
মুন বাসায় এসে এগুলোতে মাথা না দিয়ে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল। ইরা সহ আসার পরে রাতে খেয়ে শুয়ে পড়ল দুইজনেই। সারাদিন এতো ক্লান্তির ফলে চোখ বন্ধ করতেই দুজনেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো।
এদিকে রিফাতের চোখে ঘুম নেই। ঘুমের জন্য চোখ বন্ধ করে এপাশ-ওপাশ করেও চোখে ঘুম ধরা দিলো না। এই না যে- সে প্রীতির চলে যাওয়াতে কষ্ট পাচ্ছে। সে বিয়ের কয়েকদিনের মাথায় বুঝতে পেরেছিল, প্রীতি তার ভালোবাসা ছিল না, ছিল শুধু মোহ। তাই সেও প্রীতির প্রতি তেমন আকর্ষণ-বোধ দেখাতো না। কয়েকদিন ধরে প্রীতির সবকাজ তার চোখে ধরা পড়েছে কিন্তু সে ততটা পাত্তা দেয় নাই, প্রীতির অনেক রাত পর্যন্ত অনলাইনে থাকা – সেটাও রিফাতের চোখ এড়াতো না কিন্তু রিফাত নিজের মতো করে থাকতো। রিফাত এপাশ-ওপাশ করে ঘুম না আসাতে শোয়া থেকে উঠে পড়লো। এরপর আরেকটা বন্ধুকে কল দিল। কল দিয়ে যা শুনল তা শুনে রিফাতের পায়ের নিচ থেকে মাঠি সরে গিয়েছে মনে হয়েছে। সে নিজের মাথার চুল নিজে ছিড়তে লাগলো। শেষপর্যন্ত রিফাতকেই বোকা বানালো সবাই। মাঝখানে গিয়ে রিফাত ওদের গুটির পাল্লায় পড়ে মুনকে কষ্ট দিয়ে পরিবারের কাছে খারাপ হলো। রিফাত গুনাক্ষরেও তার বন্ধুর এমন কুৎসিত চাল ধরতে পারেনি। নিজেদের স্বার্থের জন্য রিফাতকে কত্ত বড়ো বোকা বানাল তারা। মাঝখান থেকে রিফাতের সবকিছু হারাতে হলো,পরিবারের এত্তো এত্তো ভালোবাসা জলে ভাসিয়ে দিলো রিফাত, মুনের বিশ্বাস ভঙ্গ, বাবা-মা’কে কষ্ট দেওয়া আর নিজের সম্পর্কে যা বিশ্বাস এতদিন মানুষের কাছ থেকে অর্জন করেছিল তা সব এক নিমিষেই সেদিন শেষ হয়ে গিয়েছিলো। সবকিছু মিলিয়ে রিফাতের মনে হলো এতো মানসিক যন্ত্রনা সহ্য করার চাইতে মৃত্যুই শ্রেয়।
সে একটা কাগজ আর কলম নিয়ে কিছু একটা লিখতে বসে পড়লো। এরপর কিছু একটা লিখে কাগজটা -টেবিলে এক সাইটে রেখে হাতে কিছু একটা নিয়ে ফ্যানে বেঁধে গলায় পেঁচিয়ে নিলো। শেষবারের মতো আশেপাশে তাকিয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে আফজাল শেখের নম্বরে কল দিল কিন্তু অপরপাশ থেকে রিসিভ হলো না। রিফাত মোবাইলটা ছুড়ে মারলো। ‘ক্ষমা করে দিও বাবা, তোমার যোগ্য পুত্র হয়ে উঠতে পারলাম না,’ বলেই বিড়বিড় করে মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসলো রিফাত এরপর পায়ের নিচের ছোট টুলটা পায়ে ঠেলে ফেলে দিতেই পুরো নিস্তব্ধ রাতটাতে ঝনঝন করে কিছু একটার শব্দের সাথে গোঙ্গানির শব্দে মুহূর্তের মধ্যে চারপাশটা ভারী হয়ে উঠল। কিছুসময় পর আবারো আগের মতো শান্ত হয়ে গেল রাতটা। শুধুমাত্র কোনো একটা প্রাণের অস্তিত্ব চিরতরে বিলীন হলো।
———–
সকালে নিচ থেকে প্রচুর চেঁচামেচি শুনে মুন ঘুম থেকে উঠে কাহিনী কী দেখার জন্য এলোমেলো চুলে বাইরে যেতেই স্তব্ধ হয়ে গেল।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।