আগন্তুকের আসক্তি পর্ব -১৪+১৫

#আগন্তুকের_আসক্তি
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১৪]

___________
নিরিবিলি পরিবেশটায় হঠাৎ ধস্তাধস্তি শব্দে চোখ ছুটে যায় ইতিকার।ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে।
গতকাল মধ্যে রাতে মাথায় প্রচন্ড ব্যাথায় এক কাপ চা পানের তৃষ্ণা জাগলো তার মনে।ইনান তখন ঘুমন্ত অবস্থায় তার ইতিবউয়ের বাম হাতটা জড়িয়ে রেখেছে।ইতিকা হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়।প্রচন্ড মাথা ব্যাথায় চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে।রক্তিম হয়ে আছে দু’চোখ।হেলেদুলে নিচে নেমে কিচেনে প্রবেশ করে মেয়েটি।পানি নিয়ে চুলায় বসাতে চায়ের পাতার জন্য কৌটা খুঁজতে থাকে।পেয়েও যায় কয়েক মিনিটে।চা বানানো শেষে ছাঁকনি দ্বারা চা ছাঁকতেই অসাবধানতার ফলে উত্তপ্ত সবটা চা ইতিকার হাতে পায়ে পড়ে যায়।অসহ্য ব্যাথায় নিজেকে দমন করতে পারেনি।

নিরিবিলি পরিবেশটায় তৎক্ষনাৎ “আল্লাহ গো” বলে চিৎকার দিয়ে উঠে।তার চিৎকারটা সর্ব প্রথম নাসরিনের কর্ণকুহুরে প্রবেশ করে।ধরফড়িয়ে উঠে বসেন তিনি।তাড়াহুড়ো করে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন।তার তাড়াহুড়ো দেখে ইব্রাহিমো স্থির থাকেন’নি সহসা চোখে চশমা এঁটে রুম থেকে বেরিয়ে যান

চিৎকারে চোখ ছুটে যায় ইনানের।মাথাটা ডানে ঘুরিয়ে ইতিকাকে খুঁজতে থাকে।ফাঁকা বিছানা দেখেই তড়াক করে উঠে বসে।খালি গায়ে তাড়াহুড়ো দেখিয়ে সহসা নিচে নেমে যায়।ইতিকার ক্রদন আঁখি যুগল দেখে বুকের বাম পাশটায় মুচড়ে উঠে।

– ইতিবউ কী হয়েছে আপনার?

ইতিকা চোখ তুলে তাকায়।গাল ফোলানো কান্নায় যেন আবদার করছে ‘আপনি এসে ছুঁয়ে দিন,সারিয়ে দিন আমার অসুখ’।কিন্তু মুখ দিয়ে টু’শব্দ বের করলো না সে।গাল ফুলিয়ে অস্থির ভঙ্গিতে কাঁদতে থাকে।

– মা ইতিবউয়ের হাতে পায়ে মলম দিচ্ছো কেন?কি হয়েছে তার?

ইনানের অস্থির কন্ঠ।

– তুই কই থাকিস?মেয়েটার যে গায়ে জ্বর নিয়ে চা করতে রান্না ঘরে এলো আবার সেই চা হাতে পায়ে ফেলে পুড়িয়েছে।তুই কী শান্তির ঘুমে ছিলি?পাশে ছিলি না তার?

নাসরিনের প্রখর তেজযুক্ত কন্ঠ।

– মা আমি তো….

– চুপ কর।হাত কতখানি পুড়ে গেছে দেখ অসভ্য ছেলে।বউয়ের যত্ন নিতে পারিস না আবার আসছে বিয়ে করতে।বিয়ে কী তোর কাছে বউপুতুল খেলা লাগে’রে হতচ্ছাড়া।

ইনান কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা।সে যে উদাম গায়ে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকেও হেলদোল নেই তার।অপরদিকে ইব্রাহিম ছেলের শরীরের দিকে তাকিয়ে আছে তীর্যক দৃষ্টিতে।ইনানের পিঠে, গলায় এতটা আঘাতের চিহ্ন,কেটে যাওয়ার ক্ষত যে স্বাভাবিক নয় তা তিনি ভালো করেই যানেন।রাস্তা ঘাটে গুন্ডা-মাস্তানের মতো চলা ফেরা করলে অবশ্যই এমনটা হবেই।তার ছেলের যে কত শত্রু আশে পাশে বন্ধু বেশে ঘুরছে তার ইয়াত্তা নেই।
.
সেদিন রাতটি পার হয়ে গেলো।ইতিকার জ্বর এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি।হঠাৎ কাঁপুনি জ্বরে মরণ প্রায় অবস্থা।ইব্রাহিম এবং নাসরিন দুজনেই দূরসম্পর্কের কোন আত্মীয়ের মৃত্যুর খবর শুনে প্রায় সকালেই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যান।তারপর থেকেই ইতিকা এই জ্বর শরীর নিয়ে বাড়িতে একা।অবশ্য তার দেখা শোনার জন্য বাড়ির কাজের মেয়ে রূপসী নিয়োজিত আছে।

নিরিবিলি পরিবেশে ধস্তাধস্তির শব্দে উঠে দাঁড়ায় সে।বেশ কয়েকবার রূপসীকে ডাকতে থাকলো ভাঙ্গা গলায়।কিন্তু মেয়েটির খোঁজ নেই কোথায় আছে কে জানে!ইতিকা দূর্বল শরীর নিয় দোতলায় নেমে এলো।বাড়ির বাইরে গ্যারেজ থেকে ধস্তাধস্তির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।এছাড়া বাড়ির বাইরের পরিবেশটা স্বাভাবিক ঠেকলো না তার কাছে।কেমন যেন সবটা এলোমেলো।কোন গার্ড কিংবা সিকিউরিটিকেও দেখা যাচ্ছে না।বেশ আগ্রহ নিয়ে ইতিকা গ্যারেজের সামনে চলে যায়।

কিন্তু ফ্লোরে রক্তের ছিটে দেখে আতঁকে উঠে সে।ইনানের কুকীর্তির কথা ভেবে মাথার ভেতরটা ফাঁকা লাগছে।নিজের আগ্রহ বশে আনতে না পেরে গ্যারেজের দরজা ফাঁক করে ইতিকা।তৎক্ষাণাৎ ভাঙ্গা গলায় চিৎকার করে উঠে মেয়েটি।থরথর করে কাঁপতে থাকে তার শরীর।চোখের কোন থেকে ঝরছে টপটপ নেত্র বারী।ইনান আততায়ীর গলায় ছুরি ধরে আছে বেশ গভীর ভাবে।চামড়া ছিলে রক্ত পড়ছে লোকটির।মাটিতে লুটিয়ে আছে চারজন ছেলের আহত দেহ।তাদের শরীরে রক্তে মাখামাখি।
ইনানের শার্টের একপাশটা ছিড়ে আছে।রক্ত ঝরছে তার বাহু থেকে।ইতিকার দিকে স্তম্ভিত হয়ে তাকাতেই ইনানের হাতে বন্দী ছেলেটা ছুরি’টি নিজ হাতে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় ইনানকে।ইতিকা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকায় সুযোগ সমেত ধারালো ছুরিটি বেশ গভীর ভাবে বাহুতে পোঁচ দেয়।আরেকটি পোঁচ দেয় ইতিকার গলায়।দুটো আঘাতেই গলগল করে ঝরতে থাকে রক্ত।

ইনান এতক্ষণ স্থির থাকলেও ইতিকার কাতর চিৎকারে হুশ ফিরে তার।

– শু*য়রের বাচ্চা দাড়া তুই।

ইনানের গর্জ উঠে।কিন্তু তার ধরা ছোঁয়ার আগেই পালিয়ে যায় ছেলেটি।

___
ঝুম বৃষ্টি চারিদিকে।বৃষ্টির তোড়ে শীত যেনো হুট করেই নেমে পড়েছে শহর জুড়ে।শেষ বিকেল পশ্চিম আকাশে সূর্যটা লালভাব ছড়িয়ে আছে।নয় তলা বিল্ডিংএর বারান্দায় দাড়িয়ে কফি পানে ব্যস্ত ইনান।খুব আলতো ভাবে কফি মগে চুমুক দিয়ে পাশের ছাদে তাকালো সে।এক জোড়া দম্পত্তি চিলেকোঠার ঘরের পাশে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে দুজনে।ইনানের বারান্দা থেকে তাদের ভিউটা বেশ ভালো ভাবেই দেখা যাচ্ছে কিন্তু তারা হয়তো বা ইনানকে লক্ষ্য করেনি।দম্পত্তি জোড়ার খুনশুটি দেখে ইনানেরো মনের বাসনা জাগে তার ‘ইতিবউকে’ নিয়ে ভেজার।

কিন্তু তার প্রাণ প্রিয় স্ত্রী অচেতন হয়ে বিছানায় শয্যা গ্রহন করেছে।
হঠাৎ মেঘময় আকাশে বিজলি চমকে উঠে।আকাশ চিড়ে বেরিয়ে আসে ভয়ংকর বজ্রপাতের শব্দ।আর সেই শব্দে অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি লেপ্টে যায় তার স্বামীর বুকে।মেয়েটি বেশ ভালোভাবেই ভয় পেয়েছে।ছেলেটি মেয়েটির মাথায় আশ্বাসের হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।নিশ্চই আশ্বাসবাণীও ছুড়ে দিয়েছে মেয়েটির কানে।ইনান তাদের কান্ড দেখে ঠোঁট বাকিয়ে হাসে।।
‘মানুষের ভালোবাসা দেখতেও ভালো লাগে।যদি না থাকে মনে হিংসে বিদ্বেষ।কেননা হিংসাত্মক মানুষের মনে অন্যর সুখ নিশ্চই সহ্য হয়না!’

ইনান তাদের দিকে তাকিয়ে আরেকবার কফির মগে চুমুক দেয়।ইতিবউ তাকে কখনো কী আপন মনে ভালোবাসবে?নাকি সারাজীবন এমন পাক্কা অভিনয় করে ভালোবেসে যাবে?ইনান তো তার ইতিবউয়ের পথ চেয়ে আছে।

হঠাৎ আরেকটি বজ্রের শব্দে কেঁপে উঠে ইনান।বজ্রের শব্দ শেষ হতেই কানে আসে হেঁচকির আওয়াজ।নিশ্চই ইতিকার ঘুম ভেঙ্গেছে।ইনান তড়িঘড়ি করে রুমে প্রবেশ করে।ইতিকা চোখ খিঁচে কাদঁছে।চোখের কোনে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুকণা।গল্পটি লেখনীতে পলি আনান।।ইতিকা যে ঘুমের ঘোরেই কাদঁছে তা বুঝতে পারে ইনান।মেয়েটির পাশে বসে বাম হাতটা আকড়ে ধরে।অন্য হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দেয়।
ইতিকার এখনো জ্বর কমেনি।বরং যেন বেড়েছে।হাতে গলায় মেয়েটির ব্যান্ডেজ।

ইতিকা চোট পাওয়ার পর তাকে নিয়ে ফ্লাটে চলে আসে ইনান।বাড়িতে আজ কেয়ারটেকার ছাড়া কেউ নেই আর সেই সুযোগে ইতিকাকে আবারো নিজের কাছে নিয়ে আসে সে।
.

অলীদের রুমে পার্মিশন ছাড়াই ডুকে যায় ইনান।দ্রুত সিঙ্গেল সোফায় বসে রুষ্ট কন্ঠে বলে,

– ডাক্তার কি মেডিসিন দিয়েছে?কি স্যালাইন দিয়েছে?ইতিবউ এখনো চোখ খুলতে পারছেনা।জ্বর ধীরে ধীরে বাড়ছে।মেয়েটি ঘুমের ঘোরেই হেঁচকি তুলে কাদঁছে মানে বুঝতে পারছিস অলীদ?তার কতটা কষ্ট হচ্ছে।

অলীদ বিছানার সাথে হেলান অবস্থায় ইনানের দিকে একপলক তাকালো।ছেলেটা যে অস্থির হয়ে আছে তা বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে।

– একটু দৈর্য্য ধর সব ঠিক হয়ে যাবে।তোর শরীরে এত প্রেসার কেন দিচ্ছিস?তুই নিজেও অসুস্থ।যা রেস্ট নে।

– আমার কোন রেস্ট নেই।অন্তত ওয়াসিমকে পঙ্গু করা ছাড়া স্থির হবো না আমি।

অলীদ উঠে দাঁড়ায়।জানালার শার্সি ধরে তাকিয়ে থাকে থম মেরে বাইরে বৃষ্টির দিকে।

– তোকে একটা কথা বলা হয়নি আমার ইনান।

অলীদের কথায় চকিতে তাকায় সে।স্থির ভঙ্গিতে আবার সোফায় গা এলিয়ে অলীদকে বলে,

– বল।

– সুফিয়ার পাগলামো আবার বেড়ে গেছে।মেয়েটা ওয়াসিমের জন্য মনে হয় না নিজের মানসম্মান বজায় রাখবে।সেদিন ভার্সিটিতে ওয়াসিমের হাতে চড় পর্যন্ত খেয়েছে।তবুও তার চোখে মুখে আফসোসের কোন সীমা নেই।

স্থির রক্ত প্রবাহ যেন এবার অস্থির হয়ে গেছে।অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেছে রাগটা।ফণি তোলা সাপের মতো ফসফস নিশ্বাসের শব্দ ফেলে উঠে দাঁড়ায় ইনান।সামনে থাকা ছোট্ট টেবিলটাতে জোরে কদমে পদাঘাত করে সরিয়ে দিলো।যেন আজ সারাদিনের রাগ টেবিলটার উপর ঝেরেছে সে।

– ওই গন্ডারের সাহস হলো কী করে সুফুর গায়ে হাত তোলার?

ইনানের রাগী আরক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে স্থির ভাবে তাকিয়ে আছে অলীদ।

– এখানে ওয়াসিমের দোষ নেই।বার বার ওয়াসিমের কাছে প্রেম নিবেদন করার মানে কী?ছেলের কী অভাব পড়েছে দেশে?আগেও ঠিক এমন নাটকটাই করেছে।মাঝামাঝিতে ওয়াসিম বিদেশ থাকায় পরিবেশ স্বাভাবিক ছিল তবে এখন আবার একই।

ইনান শব্দ করে শ্বাস ছাড়ে।দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দৃষ্টি নত করে।

-ঠিক,আগেও ওয়াসিমকে কিছু করা যেতনা।সুফিয়া লেগে বসতো।শালার এই ছেলের মাঝে কী আছে?আমার ফ্রেন্ড,আমার বউ,সব তার জন্য পাগল অদ্ভুত!

ইনানের কথা শুনে স্মিথ হাসে অলীদ।

– ভুল বলছিস ভাই।তোর বউ হওয়ার আগে ইতিকা তার গার্লফ্রেন্ড ছিল।অন্তত যাই হোক ওয়াসিম সত্যি ভালোবাসে ইতিকাকে।আর তুই ইতিকার সঙ্গে যা করছিস তোর মনে হচ্ছে না বেইমানি হচ্ছে?

– কী করেছি আমি?অজপাড়াগাঁ থেকে মেয়েটাকে এনে সব সুযোগ সুবিধা দিচ্ছি এটাই আমার বেইমানি নাকি ভালোবেসে আগলে রাখছি এটা আমার বেইমানি?তার জীবন বাঁচিয়েছি শত্রুর কবল থেকে আর উপহার দিলাম সাজানো গোছানো সংসার, পরিবার।এটা কি আমার বেইমানি ছিল অলীদ?

– না।তবে ওয়াসিম যে বিয়ে করেনি কেন মিথ্যা বললি তাকে?এটা তো বেইমানি।

ইনান কথার উলটো পিঠে আর কথা বললো না।থম মেরে স্থির চিত্তে তাকিয়ে রইলো বাইরের দিকে।

– আর যাই হোক অলীদ ওয়াসিমের কোন ‘প্রিয়’ ব্যাক্তিত্ব আমি টিকতে দেবো না।সব কেড়ে নেবো তার।তোরা অতীতের বিষটি ভুলে যাস কি করে বলবি?আমি তো ভুলতে পারিনা।আমার তো ভাবলে এখনো কান্না পায়।

অলীদ মাথা নুইয়ে নেয়।তার চোখের কোনে পানির এসেছে আর সেই পানি দেখাতে চায় না ইনানকে,তাই ঘুরে জানালার রিলিং ঘেষে দাঁড়ায়।হাত দিয়ে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির পানি নিয়ে মুখে ছিটে দেয়।এ যেন তার কান্না লুকানোর বৃথা চেষ্টা।

– আমি কোন কিছু ভুলিনিরে।শুধু সময়ের সাথে সাথে বিষটি ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করি।আচ্ছা বাদ দে।যা তুই ভাবীর কাছে।তবে একটা কথা শোন আমি যা করার করে নিয়েছি সুফুর বাবাকে সবটা জানিয়েছি।তিনি ভিসা,পাসপোর্ট রেডি করছেন তাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিবেন খুব শীঘ্রই।

– সে যদি ভালো থাকে তবে তাই হোক।

ইনান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে।
___

বৃষ্টির গতিক আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।কেয়ারটেকারের মাধ্যেমে খবর নিয়ে জানতে পেরেছে ওই বাড়িতে এখনো ইব্রাহিম এবং নাসরিন এখনো এসে পৌছায়নি।তারা নাকি আরো একদিন থেকে আসবেন।
মধ্যে রাতে ইতিকার বাম হাতটা জড়িয়ে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে ইনান।বাম হাতের ক্যানলার দিকে তাকিয়ে আছে রাশভারী দৃষ্টিতে।ইচ্ছে করছে খুলে ছুড়ে ফেলে দিতে।নিশ্চই ইতিবউয়ের খুব কষ্ট হচ্ছে।

জ্বরের তোড়ে দু’গাল লালভাব হয়ে আছে।ইনান ইতিকার গালে আলতে করে ঠোঁট ছোঁয়ায়।শুষ্ক ঠোট যুগলের চামড়া ফেঁটে উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে।ইনান সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাকিয়ে হাসে।

– সম্পর্কের চার মাস পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমায় তুমি আজ পর্যন্ত একটা চুমু খেতে দাও নি।কেমন বউ তুমি ইতিবউ?

ইনান বিড়বিড় করে কথাটি বলে নিজেই হেসে দেয়।বালিশে মাথা রেখে ইতিকাকে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে ; গায়ের কাঁথা জড়িয়ে ডান হাতে মোবাইলের বাটন চেপে সময়টা দেখে নেয়।রাত তিনটে ছত্রিশ মিনিট।

__

‘সুখ’ শব্দটা যেন ইনানের জীবনে বেমানান।বেশ বেলা করে ঘুম ভেঙ্গে এমন পরিস্থিতি পড়বে কল্পনাও করেনি সে।ইতিকা তার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখছে।ইনান পাশে বসলেও চিৎকার করে তাকে সরিয়ে দিচ্ছে,
হুট করেই চেনা মেয়েটি যেন অচেনা হয়ে উঠেছে।এদিকে অলীদো বাসায় নেই।ইনান কি করবে ভেবে উঠতে পারছেনা।ইতিকার শরীরের জ্বর এখন নিয়ন্ত্রণে তবে শরীরের দূর্বলতা এখনো কাটিয়ে উঠেনি।

-ইতিবউ সমস্যা কি আপনার?

– আমি বাড়ি যাবো,আমি মিহির কাছে যাবো।

– হঠাৎ গ্রামে যেত চাইছেন কারন কী?

– কিছু না আমি এখানে থাকবো না।আমার ভালো লাগছেনা।

ইতিকার আচরণে কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ে ইনানের।মেয়েটি চোখ তুলেও ইনানের দিকে তাকাচ্ছে না।
ইতিকা কথা শেষ করে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায়।ছুটে পালিয়ে বাচঁতে, অসাবধানতার বশে ক্যানলার সুই ছিটকে বেরিয়ে আসে হাত থেকে।তৎক্ষনাৎ রক্ত ঝরতে শুরু করে,সেদিকে তাকিয়ে ইনান ছুটে আসে।ইতিকার ওড়নাটা নিয়ে দ্রুত তার হাতে চেপে ধরে।

– এত অসাবধান কেন আপনি?কাল এতটা রক্তক্ষরণ হয়েছে আজ আবার….

ইনান তাড়াহুড়ো করে ইতিকার হাতের রক্ত নিয়ন্ত্রণে আনে।কিন্তু ইতিকার ফের অদ্ভুত আচরণ আবার শুরু।ইনানকে হালকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ছুটে পালিয়ে বাচঁতে যায়।লাহমায় রাগান্বিত ইনান ইতিকাকে আটকাতে পেছন থেকে ইতিকার চুল টেনে ধরে।কোমর সমান ঢেউ খেলানো চুলগুলোতে টান পড়তেই সহসা দাড়িয়ে যায় সে।

-আহ লাগছে আমার।

-লাগুক।এতটা অদ্ভুত আচরণ করার মানে কী?কি হয়েছে আমাকে বলবেন তো!নাকি জ্বরের তোড়ে ব্রেনের ভাজে ভাজে তার ছিড়ে গেছে?

ইতিকা উত্তর দিলোনা।বরং ঠোঁট খিচে কেঁদে উঠলো শব্দ করে।

– আমাকে ছাড়ুন প্লিজ।এখানে নিয়ে আসার মানে কী?আমি তো ওই বাড়িতে ছিলাম।তাহলে ফ্লাটে?

– কেন কোন সমস্যা?আমি নিয়ে এসেছি আপনাকে।নিজের সাথে নিজে আপনি এত জোর খাটাচ্ছেন কেন?আপনি এখনো দূর্বল।

– আমার যা ইচ্ছা তা হোক।আমাকে গ্রামে দিয়ে আসুন প্লিজ।আমি আর আপনার জীবনে থাকতে চাইনা।

– আপনার শাশুড়ী আম্মাকে কথা দিয়েছিলেন আমাকেভ ভালো পথে আনবেন।সাংসারিক বানাবেন।এখন পালিয়ে বাচঁতে চাইছেন কেন ইতিবউ?আর আপনার এত অস্বাভাবিক আচরণ আমার মাথায় ডুকছেনা।

ইতিকা চুল ছাড়িয়ে ইনানের কাছ থেকে সরে বসে।

– আপনাকে মানসিক রোগী মনে হয় আমার।কাল কীভাবে ছেলেগুলোকে….উফফ আমি আর ভাবতে পারছিনা।দেখুন আমি সাধারণ গ্রামের মেয়ে আমি চাইনা আর আপনার জীবনের সাথে জড়িয়ে যেতে।তাই আমি আপনাকে ছেড়ে চলে যাবো।

ইতিকার কথায় রুষ্ট হয় ইনান।দুচোখ খিচে বন্ধ করে কপাল তর্জনির আঙুল দ্বারা ঘষে বলে,

– কী বললেন? আবার বলুন।

– শুনতে পাননি?আমি মুক্তি চাই।স্বামী,স্ত্রী বন্ধন থেকে মুক্তি চাই।

ইতিকা কথা ইনানের কানে বিষ ফোড়নের মতো আঘাত করেছে।কথার তীরটা যেন তার বুকের বা’পাশটায় তীর্যক ভাবে ঠেকেছে।পকেট থেকে রিভেলবার নিয়ে ইতিকাকে পেছন থেকে মুছড়ে ধরে।মেয়েটির থুতনিতে রিভেলবারের নল ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে তা গলার নিচে নামিয়ে আনে।

– সরি ইতিবউ, আই নিড ইউ।আমার মৃত্যুর আগে আপনার নিস্তার নেই।কাল কি হলো?আজ কি হলো?সবটা ভুলে যান।আগে যেমন ছিলেন তেমন হয়ে যান প্লিজ।তাছাড়া আপনি অসুস্থ।

– আমার এখানে ভালো লাগছে না আমাকে কিছুদিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে রেখে আসুন।

হঠাৎ ইতিকার কন্ঠ মলিন হয়ে গেছে।তার শান্ত সুরে কথায় স্মিথ হাসে ইনান।

– সরি সেটাও হবে না।আমার কাছে থাকবেন আপনি।

– আপনি আমার কোন কথা রাখেন না কোন কথা মানেন না।অন্তত ওয়াসিম আপনার জায়গায় হলে এতক্ষণে সবটা ছেড়ে আমার কাছেই ছুটে আসতো।

– ওই জা-নো,য়ারের নাম এখানে আসলো কেন?

ইনানের কথার ভাব ভঙ্গিতে তেতে উঠলো ইতিকা।

– সে যাই হোক আপনার মতো অন্তত খুনখারাপি করেনা।

ইতিকার মুখে এমন কথায় আবারো হাসলো ইনান।

– শুনোন বউ আপনার বর আর যাই করুক খুন করেনি আজ পর্যন্ত।আর যা মারপিট করেছি সবটা প্রয়োজনে করেছি।কিন্তু আপনার ওয়াসিম প্রাত্তন যে খুনি সেটা কি জানেন?

ইতিকা ঘাড় ঘুরিয়ে ইনানের দিকে তাকায়।ইনান ইতিকাকে বিছানায় বসিয়ে ল্যাপটপ অন করে।একটি ভিডিও প্লে করে ইশারা করে ইতিকা তাকানোর জন্য।

ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওয়াসিম একটি ছেলের মাথায় পাথর নিক্ষেপ করে।শেষ পর্যায়ে আট তলার বিল্ডিং এর ছাদ থেকে ছেলেটিকে ছুড়ে ফেলে দেয়।
ইতিকা সহসা দুচোখ খিচে বন্ধ করে নেয়।

– ছেলেটি আমাদের ব্যাচের একজন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট।ওয়াসিমের গুন্ডা গিরির জন্য হেড টিচারের কাছে নালিশ করে।পরবর্তীতে আরো বিভিন্ন ঝগড়ায় পুলিশের দপ্তরে মামলাও করে।যার প্রতিশোধ হিসেবে ওয়াসিম কেড়ে নিলো ছেলেটির জীবন।আর ছেলেটির খুনি সাজানো হলো ওয়াসিমের বাবার দলের একজন চামচা লোককে।যিনি এখনো যাবজ্জীবন কারাদন্ডে আছে।তোমার ওয়াসিম ভালো তবে মুখোশধারী ভালো।
চাইলে আমি সবটা খোলাসা করতে পারি কিন্তু আমার চাওয়া যে অন্যকিছু।

ইতিকা নিরুত্তর হয়ে বসে আছে। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার।সহজ-সরল জীবনটায় দুইদুইটা দাগি আসামী জীবনে প্রবেশ করেছে।এই জীবন নিয়ে ভবিষ্যত ভাবাও যেন দুষ্কর।
#আগন্তুকের_আসক্তি
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১৫]

__________
– আসসালামু আলাইকুম কাকিমা সুফিয়া কোথায়?তার সাথে দেখা করতে এসেছি।

গোলগোল চশমার কাচ দিয়ে অলীদের দিকে সুফিয়ার মা তাকিয়ে আছে অবাক দৃষ্টিতে।কিছুক্ষণ আগেই তিনি ঘুম থেকে উঠেছেন।দারোয়ান ফোন করে জানালেন সুফিয়ার বন্ধু অলীদ এসেছে তার সঙ্গে দেখা করতে।তখন বেশ খানেকটা অবাক হন তিনি।কেননা ঘড়িয়ে সবে মাত্র আটটা পাঁচ।এত সকাল সকাল ছেলেটা কি মনে করে আসলো তিনি বুঝতে পারছেন না।

– কাকিমা সুফিয়া কোথায়?

অলীদ বেশ জোরেই কথাটা বলে উঠে।সহসা সামনে বসে থাকা অর্ধ বয়স্ক মহিলাটি নড়ে চড়ে বসেন।

– বাবা তুমি এত সকালে এসেছো তাই ঘাবড়ে গেছি।কোন সমস্যা হয়েছে?

– না আন্টি কোন সমস্যা না।আসলে আজ আমি বাড়ি যাবো।তাই ভাবলাম সুফুর সাথে দেখা করে যাই।তাছাড়া অনেকদিন হয়েছে আমাদের দেখা হলো না।আন্টি আঙ্কেল কী সত্যি তাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবে?

– হ্যা,বাবা।তোমারা তো জানো তিনি এক কথার মানুষ আগেও চেয়েছে সুফিয়াকে দেশের বাইরে পাঠাতে।কিন্তু মেয়ে যেতে চায় নি।এবারো যদি কোন গন্ডগোল করে তবে,হয় তাকে বিদেশ পাঠানো হবে, না হয় বিয়ে দিয়ে দেবেন।মেয়েকে আর এই শহরে একা রাখতে ইচ্ছুক নন তিনি।কোন ইতরের প্রেমে পড়েছে এই মেয়ে ভাবতেই আমার ঘৃণা হচ্ছে।ওয়াসিম ছেলেটার জাত পাত মোটেও সুবিধের নয়।আমাদের সাথে তো কোন দিক দিয়েই যাবে না।

এতক্ষণ সুফিয়ার মায়ের বলা কোন কথায় কানে ডুকলো না অলীদের।সুফিয়ার বিয়ের কথা শুনেই তার চোখে মুখে যেন ধৌঁয়া উড়ছে।সবটা এলোমেলো লাগছে।
মেয়েটাকে নিয়ে তার মনে কেন এত অনুভূতি জমা হলো?ইনান যদি যানে তবে নির্ঘাত দু’চার চড় তার গালে বসিয়ে দেবে।কিন্তু কি করবে সে?সুফিয়ার প্রতি অনুভূতি ভালোলাগা থাকলেও সে নিজেই প্রতিবার সবটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে গেছে।তার বেস্ট ফ্রেন্ড তার মানে এই নয় যে ভালোবাসতে হবে নিজের বউয়ের মর্যাদা দিতে হবে।আর সুফিয়া জানলেও হয়তো বন্ধুত্বের বন্ধনটা আলগা হয়ে যাবে।তাই প্রতিবার চুপ ছিল সে।কিন্তু ওয়াসিমের জন্য কান্না করা,পাগলামো দেখে মনের কোনে হিংসাত্মক ভাব চলে আসছে।কেন হচ্ছে এমন?

– আন্টি সুফিয়ার রুমে কি যাবো নাকি সে আসবে?

– তোমাকেই যেতে হবে।তাকে বাইরে থেকে বন্ধ করে রাখা হয়।

অলীদে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।

.
এলোমেলো চুল চোখের সামনে এসে ছুঁয়ে গালে বেয়ে গলায় আছড়ে পড়ে আছে।দু’ঠোঁট উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে।সুফিয়ার দুগালে কেমন যেন আঙুলের ছাপ ভাসমান।অলীদের কাছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক লাগলো না।

– সুফু উঠ,আমি এসেছি।

বাক্যটা সুফিয়ার কর্ণকুহুরে ঠেকলো কী না কে জানে?সে এখনো ঘুমিয়ে আছে একই অঙ্গভঙ্গিতে।

– এই যে নবাবজাদী উঠুন এবার।গায়ে পানি ঢালতে আমি কিন্তু দু’মিনিটো দেরি করবো না।

সুফিয়া এখনো ঘুমিয়ে আছে।তার বড় বড় শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ রুমে যেন বার বার প্রতিধ্বনি হচ্ছে।অলীদ কিছুক্ষণ মেয়েটার দিকে স্থির ভাবে তাকিয়ে থাকলো।মেয়েটার গালে আঙুলের ছাপ স্পষ্ট ।সুফিয়ার গালে হাত দেবে কী দেবে না।ভাবতে ভাবতে নিজেই অস্বস্তিতে পড়ে যায়।অলীদের সন্দেহের বাতি নিভে যায় খাটের তলায় একটি ঔষুধে পাতা দেখলে,যেটি ঘুমের ঔষুধ।

অলীদ এবার সব বাঁধা ভুলে সুফিয়ার গালে হাত বুলাতে থাকে।

– এই সুফু উঠ।সুফু এই সুফু।

সুফিয়া উঠলো না বরং তার ভারী ভারী নিশ্বাস অলীদের হৃদপিন্ডের গতি বাড়িয়ে তুলছে।দু’বাক্য না ভেবে ঝটকায় সুফিয়াকে কোলে তুলে নেয় অলীদ।দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে গিয়ে ঝরনার নব ছেড়ে দেয়।সুফিয়া এখনো অলীদের বুকে লেপ্টে আছে।পানির ছিটকায় সহসা চোখ খুলে সুফিয়া।হঠাৎ আক্রমণে কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারছেনা সে।

– ঘুমের ওষুধ গিলেছিস কয়টা?

– কে কে?

– তোর যম!

পানির গতিতে চোখে খুলতে পারছেনা সুফিয়া।নিজেকে ভাসমান অনুভব করে ঘাবড়ে গেছে সে।

– ব..বন্ধ করুন।বন্ধ করুন প্লিজ।

সুফিয়া অলীদ দুজনেই ভিজে জুবুথুবু হয়ে আছে।অলীদ ঝরনার নব ঘুরিয়ে দেয় সহসা পানির গতিক থেমে গেছে।পিট পিট চোখ তুলে তাকায় সুফিয়া।অলীদকে দেখে আসমান থেকে পড়ার মতো অবস্থা তার।

– ত..তুই?

– কার কথা ভেবেছিলি?ওয়াসিম?নাকি তোর হবু বরের কথা?

– একদম বাজে বকবি না।আমাকে ভিজিয়ে দিলি কেন?

– তোর ঘুম ভাঙ্গছিল না তাই।এবার বল ঘুমের ওষুধ কয়টা গিলেছিস?

সুফিয়া মাথা নুইয়ে নেয়।
অলীদ তাকে চুপচাপ দেখে এবার বেশ ধমকের সুরেই বলে,

-সুফু কথা বল আমাকে একদম রাগাবিনা। কোলে আছিস আছাড় মারতে বেশ সুবিধা হবে। এক আছাড়া তোর ভালোবাসা কারে কয় ছুটিয়ে দেবো।

সুফিয়া এবার ঘাবড়ে যায়।দৃষ্টি নত রেখে আমতা আমতা সুরে বলে।

– দুইটা খেয়েছি।

– এত কম কেন?আর ছিলনা বুঝি?

– না ওষুধের খোসায় দুইটাই ছিল।

অলীদ ফসফস করে শ্বাস ছাড়ছে।দুজনের মাঝে বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা কেটে যায়।অলীদ ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুফিয়ার দিকে।অপরদিকে সুফিয়া পড়েছে অস্বস্তিতে।এতক্ষণ অলীদের কোলে নিজের অবস্থান দেখতে বড্ড বেমানান লাগছে।

– আমাকে ছাড় অলীদ।

অলীদের হুশ ফিরেছে।এবার নিজেই যেন বেকায়দায় পড়েছে সে।লজ্জায় ইচ্ছে করছে এক ছুটে পালিয়ে যেতে।তার অস্বস্তি ভাব বুঝতে পেরে সুফিয়া ঠোঁট বাকা।অলীদ সুফিয়াকে কোল থেকে নামিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়।

– তোর গালে চড় দিয়েছে কে রে সুফু?

– আর কে মারবে?তোর দাম্ভিক আংকেল মেরেছে।রাগে জিদে তাই তো ওষুধ খেলাম।দাগ বসে গেছে নাকি রে?

– হুম দু’আঙুলের ছাপ স্পষ্ট।চিন্তা করিস না তোর হবু বর আদর করে সারিয়ে তুলবে।

– আমার হবু বর?

– কেন জানিস না আঙ্কেল তোকে বিয়ে দেবেন।পাত্র খুঁজছেন।

– কবুল বলার আগে আমার শরীর থেকে রুহ চলে যাক।আমিন!

সুফিয়া রাগান্বিত স্বরে কথাটা বলে থেমে যায়।হঠাৎ দেয়ালের সাথে বেশ জোরে আঘাত লাগে তার।মেয়েটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে অলীদ, তার দু’গাল চেপে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরেছে।

– আর যদি এই কথা তোর মুখ থেকে বের হয় তবে কসম বাকি গালটাও আর স্বাভাবিক থাকবে না।আমার রাগ,জেদ,শাসন এখনো কিছু দেখিস নি তুই।তোকে সোজা করা আমার সেকেন্ডের কাজ।তাই মাথা থেকে এইসব কু’বুদ্ধি ছেড়ে দে।দুই’সাপ্তাহ পর এক্সাম।পড়াশোনায় মন বসা।

ফর্সা রক্তিম গাল,আরক্ত দৃষ্টি,দাঁতে দাঁত চেপে অলীদের কথার ভঙ্গিতে ঢোক গিলে সুফিয়া।
___

ইনাকে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ তোষামোদ করছে ইতিকা।

– আপনি আসুন প্লিজ আর দুইদিন বাকি আপনার এক্সামের।কিছুই তো পারেন না একটু পড়তে বসুন।

– সরে যান ইতিবউ আমার গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে।না গেলে মামু ভীষণ রাগ করবে।

– করুক রাগ তিনি যাই ইচ্ছে তাই করুক আমি আপনাকে ছাড়ছিনা। আপনি পড়তে বসবেন মানে বসবেন।আর এখন রাত এগারোটা বাজে এত রাতে বের হলে আসবেন রাতের দুই,তিনটায় আমি ভালো করেই যানি।আপনার আর পড়া হবে না।

– আপনার তো আজ এক্সাম শেষ যান চিল করুন আমাকে জ্বালাবে না একদম।

– আমি আপনাকে জ্বালাই?

ইনানের কথায় দুচোখ ছোট করে প্রশ্ন করলো ইতিকা।ইনান ব্লেজার গায়ে জড়িয়ে স্মিথ হাসে।

– অবশ্যই।আমার না পড়লেও চলে।টুকে নিয়ে যাবো খাটি বাংলায় নকল করবো।

– ছিহহ লজ্জা করেনা?আবার বলছেন নির্দ্বিধায়।আমি আপনার জন্য কত কষ্ট করে সব সাজেশন জোগাড় করেছি দেওয়রজির কাছ থেকে আর আপনি বলছেন নকল করবেন।

– আমাকে যেতে হবে।

– আপনাকে আমি বারণ করছি তবুও আপনি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন কেন?

ইনান আরেকবার ইতিকার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে।নিস্তব্দ রুম টায় ভাইব্রেট হতে থাকে ইনানের ফোন।স্কিনে বাহরুল ইসলামের নাম্বার দেখে তড়িঘড়ি করে ফোন রিসিভ করে।

– হ্যা মামু বলো।

– তুই কইরে?সবাই বসে আছে।

-দশ মিনিট আমি আসছি।

ইনান ফোন রেখে।ইতিকাকে টেনে দাড় করায়।মেয়েটার কপালে থাকা চুলগুলো সরিয়ে আলতো করে ভালোবাসার পরশ একেঁ দেয়।

– আমি গেলাম ইতিবউ।দুঃখিত আপনার কথা রাখতে পারলাম না।

নিগূঢ় রাগটা বাইরে থেকে প্রকাশ করলো না ইতিকা।মানুষটা তার কথা রাখেনি?এই তার ভালোবাসা!এই বাড়িতে থাকা যেন তার কাছে বন্দি জীবন লাগে।শশুড়-শাশুড়ী,স্বামীর ভালোবাসা, আদর, যত্ন পেলেও কোথাও যেন নিজেকে বন্দিনি মনে হয় তার কাছে।আচ্ছা ইনান কী সত্যি তাকে ভালোবাসে?না কী ওয়াসিমের সাথে শত্রুতার বর্শে তাকে বিয়ে করেছে?উত্তর অজানা তার।
‘নারী’ জাতীর মন গলানো সবচেয়ে সহজ মাধ্যেম ভালোবাসা।মেয়েরা ভালোবাসায় কাঙাল।একটু আদুরে কথা,আদর যত্ন পেলেই পোষ মেনে যায়।আর সেই কাজটাই কি করেছে ইনান?
আর ভাবতে পারলো না সে।মাথার ভেতরটায় সব প্রশ্নেরা একসঙ্গে খেলা করছে।

দ্রুত পা চালিয়ে নিচে নেমে এলো ইতিকা।ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে মন মরা হয়ে বসে আছেন তার শাশুড়ী মিসেস নাসরিন।

– আম্মা আপনি বসে আছেন কেন?

– খাবি না রাতে?

– আপনার ছেলে তো না খেয়ে গেলো আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।আব্বা কি খেয়েছেন?

– না।

ইতিকা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।পাশের চেয়ার টেনে বসে পড়লো নাসরিনের পাশে।

– একটা কথা বলবো আম্মা?

– বল।

– আপনার আপন ভাই আপনার ক্ষতি করছে।তবে আড়ালে।আপনার একমাত্র ছেলেকে বখে দিয়েছে।সে এখন এক কথায় অবাধ্য সন্তান।অথচ আপনি আপনার ভাইয়ের সঙ্গ দিচ্ছেন?আব্বা আপনার ভাইকে নিয়ে কিছু বললেই তেতে উঠছেন।আপনি কী কিছু বুঝেন না?নাকি না বোঝার ভান করে আছেন?

– মা রে আমি আমার সন্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।ভেবেছি তুই এসেছিস তুই তাকে আচঁলে বেধে নিবি কিন্তু তা আর হলো কই?

ইতিকা মাথা নুইয়ে নেয়।রক্তিম দুচোখের কোনে পানি জমাট বেঁধে গেছে।

– আম্মা তিনি আমার কোন কথাই শুনেন না।রাখেন না আমি কী করবো?আজকেও বার বার বারণ করেছি কিন্তু আমার কথায় তিনি সোপর্দ হননি।মামু ফোন করলো তৎক্ষণাৎ চলে গেলেন।

নাসরিন মনঃক্ষুণ্ণ হলেন।ইতিকার দিকে তাকিয়ে প্রণত হয়ে বলেন,

– আমার পরিবারের শেষ একজন জীবিত আমার ভাই বাহরুল ইসলাম।তাই তার সাথে জোর খাটিয়ে কিছু করছিনা।এক বছর আগে ভাইজানের সাথে রাগারাগি করায় এবং রাত করে বাড়ি ফেরায় জবাব চাওয়ায় ইনান বাড়ি ছেড়েছে।তাই আমি আর মুখ ফুটে কিছু বলি না।আর….

দুজনের কথার মাঝেই মিসেস নাসরিনের ফোন বেজে উঠলো।স্কিনে ‘অলীদ’ নামটা দেখে কিঞ্চিৎ ভ্রু-কুচলালো।

– এত রাতে উনি ফোন করেছে কেন আম্মা?

– ধরে দেখি।

মিসেস নাসরিন ফোন ধরলেন তবে অলীদ কথা বলতে চাইলো ইতিকার সাথে।

– পিচ্চি ভাবী কেমন আছো?

– আলহামদুলিল্লাহ ভালো দেওরজি।আপনি কেমন আছেন?

– ভালো।ইনান কোথায় জানো কিছু?

– মামুর সঙ্গে নাকি কোন মিটিংএ আছেন।

– হাহ তোমার বর মিটিং এ আছে!সত্যি?এই মাত্র দেখে এলাম গোপন আস্তানায় প্রবেশ করতে।আর সেখানে যাওয়া আমাদের সাধারণ মানুষদের জন্য নিষিদ্ধ।

– গোপন আস্তানায় কী হয়?

– বাহরুল ইসলামের বিরুদ্ধে যারা আছে তাদের শায়েস্তা করা হয় ইনানের নির্দেশে।এই ছিল তার মিটিং?ছেলেটা বখে যাচ্ছে।প্লিজ কিছু একটা করো।

-আমি কি করবো, আমার কিছু কি করার আছে?পারলে আপনারা আমায় মুক্তি দিন।

ইতিকা ফোন কেটে দিলো।নাসরিনের কোলে আছড়ে পড়ে দু’চোখের পানি বিসর্জন দিচ্ছে।

– আম্মা আমায় মাফ করে দিন আমার আর ভালো লাগছেনা কিছু।এমন জীবন আমার দরকার নেই।এককথায় এখন আমি পরবাদিনী।আমার উপর থাকা সকল দাবী,চাওয়া পাওয়া তুলে নিন।আমার বাকিটা জীবন পড়ে আছে আমাকে আমার মতো চলতে দিন।

নাসরিন ইতিকার দিকে তাকিয়ে আছে হতাশ দৃষ্টিতে।

– তুই কিছু করতে চাইছিস?

– হ্যা।

– তবে যা,তুই মুক্ত।

___

ইতিকার রগচটা ব্যবহারে সস্তব্দ ওয়াসিম।মেয়েটা পালটে গেছে।হুট হাট রেগে যাচ্ছে অদ্ভুত।

– এত রাতে তুমি এখানে ইতিকা?ইনান কী তোমায় বের করে দিয়েছে?আমার জানা মতে ইনান তোমায় ছাড়ার পাত্র নয়।

– এত প্রশ্ন করছো কেন ওয়াসিম।আমি যা বলছি তার উত্তর দাও।তোমার বউ কোথায়?

– আমার বউ?কিসব বাজে বকছো তুমি?আমি বিয়ে করলাম কবে?

– কেন দেশের বাইরে করেছো।

– রাবিশ ওটা আমার ফ্রেন্ডের বিয়ে ছিল।আমার পাশের মেয়েটি আমার ফ্রেন্ড।

– তাই বলে এত জড়িয়ে ধরবে?ছবিতে আমি স্পষ্ট দেখেছি তোমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছিলে।

– আমেরিকার কালচার সম্পর্কে তোমার ধারনা নেই।জড়িয়ে ধরা,কিস করা তাদের কমন অভ্যাস এটা আমাদের দেশ নয়।আমার ফ্রেন্ডকে আমি জড়িয়ে ধরতেই পারি।

– তার মানে তুমি সত্যি বিয়ে করনি?

– না।তবে আমার হবু বউ আমার সামনে।

কথাটি বলেই মৃদ্যু হাসলো ওয়াসিম।কিন্তু ইতিকার মাথা কাজ করছেনা ইনান তাকে মিথ্যা বলেছে।তার সাথে প্রতারণা করেছে।বিয়ের পরদিন বলেছিল ওয়াসিমের আশা যেন ছেড়ে দেয় ওয়াসিম বিবাহিত।তবে?ইনান প্রতিটি কাজে প্রতিটি ধাপে তার সাথে মিথ্যা ছলনা করছে।

– ইতিকা তোমার চোখে পানি কেন?নিশ্চই আনন্দের,আমার কাছে ফিরে আসার আনন্দের।আই এম সো হ্যাপি তুমি আমার কাছে আবার ফিরে এসেছো।

ইতিকা ছলছল চোখে স্মিথ হাসলো।

– যাবে ওয়াসিম?

– কোথায়?

– এমন জায়গায় ইফতিহার ইনান যেখানে আমাদের হদিস পাবেনা।তবে তার আগে আমি আমার গ্রামের বাড়ি যেতে চাই।

– বেশ তবে তাই হোক।

#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here