#সোহাগী
#পর্ব :৮
Lutful Mehijabin
স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো জুবায়ের। ডিম্বাকার হলদে আলো ক্রমশ তার দিকে এগিয়ে আসছে। দেখে মনে হচ্ছে হ্যারিকেনটি হাওয়ায় ভাসছে! যদিও এসব ভৌতিক কান্ডে জুবায়েরের ভয় হচ্ছে না তবুও অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতর কুঁ ডাকছে। তাহলে কী তার সামনে অশরীরী কিছু ধেঁয়ে আসছে!
জুবায়েরের সম্পূর্ণ ধারনা অযৌক্তিক প্রমাণ করে দিয়ে কোন এক মানবী এগিয়ে এলো তার সামনে। একদম কাছাকাছি আসতেই অজ্ঞাত মানবী তার মুখের সামনে হ্যারিকেনটি উঁচু করে ধরলো। চমকে উঠলো জুবায়ের! হ্যারিকেনের হলদেটে আলোতে মানবী কে চিনতে মোটেও অসুবিধা হয়নি তার। সে আর কেউ নয় এই বাড়ির গৃহকর্মী নূরী। যাকে প্রায়শই প্রিয়ার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা যায়।
— ডরায়েন না মাস্টার মশাই।
আকস্মিক নূরীর ফিসফিস আওয়াজে আঁতকে উঠে জুবায়ের। নূরীর আচরণ প্রথম থেকেই অদ্ভুত লাগে তার। মহিলাটা তাকে প্রতিদিন নিয়ম করে নাস্তা দিতে আসে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনোই তার কন্ঠস্বর শুনতে পাই নি জুবায়ের! নূরীর মুখ ভঙ্গি তাকে ভীত করে বারংবার! অদ্ভুত গম্ভীর এবং রহস্যময় মুখশ্রী।
— মাস্টারমশাই,,
নূরীর দ্বিতীয় ডাকে জুবায়েরের ধ্যান ফিরে এলো। শুকনো ঢোক গিললো সে। অতঃপর ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে জড়তা মাখা গলায় বলে,
— হ্যাঁ,, অন্দর মহলে বিদ্যুৎ নেই কেনো খালা?
নূরী জুবায়েরের কথার প্রেক্ষিতে মুচকি হাসে। যা অস্কুট, ঝাপসা আলোতেও দৃশ্যমান হয় জুবায়েরের। কিন্তু নূরী তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিজের কোমরে হাত দিলেন। আঁচলের ভাঁজ থেকে কাগজের মতো কিছু বের করেন। অতঃপর জুবায়েরের সামনে কাগজটা এগিয়ে ধরে বলেন,
— প্রিয়া মা আপনারে এডা দিবার কইছে। আর কইছে আপনার সব চিন্তার মুক্তির পথ এই কাগজে আছে। এডার কথা কাউকে বলবেন না কিন্তু, সাবধান! সোজা যেখানে যাইতেছেন সেখানে যান। আমি এবার আসি। আমার কাম শেষ।
কাগজটা হাতে নিয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। সে কিছু বুঝে ওঠার পূর্বে নূরী এবং তার হাতে থাকা হ্যারিকেন মূহুর্তেই আঁধারে মিলিয়ে গেলো। তৎক্ষণাৎ বিষ্ময়কর ঘটনা ঘটে বসলো। মিনিট খানিকের মধ্যে সম্পূর্ণ অন্দরমহল আলোকিত হয়ে উঠলো। বিদ্যুৎ চলে এসেছে! অবাকের চূড়ান্ত সীমান্তে চলে গিয়েছে জুবায়ের। তাহলে কী জুবায়েরের সাথে ঘটে যাওয়া সম্পূর্ণ ঘটনা কী কারো নিখুঁত সাজানো অভিলাষ! অর্থাৎ কারো পরিকল্পনা মতো কি এসব ঘটলো।
নূরীর দেওয়া সাদা রঙের কাগজটা যে চিঠি তা বুঝতে অসুবিধা হলো না জুবায়েরের। চিঠিটি হাতে নিয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো জুবায়ের। তার শরীর থেকে ঘাম ঝরছে অবিশ্রান্ত ধারায়! প্রিয়ার মায়াবী মুখশ্রী এক পলক দেখার জন্য তার চোখ মরিয়া হয়ে উঠছে। মেয়েটার কন্ঠস্বর শ্রবণের জন্য কান জোড়া হয়ে উঠছে তৃষ্ণার্ত! অস্থিরতা যেন আষ্টেপিষ্টে আলিঙ্গন করেছে জুবায়ের কে। চিঠিতে কী লিখা রয়েছে? প্রিয়া কোথায়, সে নিজে কেন চিঠি দিতে আসেনি? রিমার কি হলো? এসব প্রশ্ন জুবায়েরের মস্তিষ্ক ঘুরপাক খাচ্ছে। লাঠি ভর করে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। পা জোড়ার ধাবিত করার শক্তি লোপ পেয়েছে।
— এই যে মাস্টারমশাই,,
পিছন থেকে কারো পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠে জুবায়েরে। সাবধান চিঠির কথা কেউ জানতে না পারে! কথাটা মনে পড়তেই, তড়িঘড়ি কাগজটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেললো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে সংযত করলো। অতঃপর দ্রুত পিছন ফিরে কন্ঠস্বরের মালিকের মুখে দৃষ্টিপাত ফেললো। তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে এ অন্দরমহলের ঝাঁড়ুদার রহমত আলী। জুবায়েরের কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রহমান বললো,
— আমার সাথে আহেন মাস্টারমশাই,, কর্তা আপনারে খুঁজতেছেন।
রহমতের শেষোক্ত বাক্য শুনে জুবায়েরের ভ্রূ আপনা আপনি কুঁচকে এলো। এই বাড়ির কর্তা অর্থাৎ প্রিয়ার বাবা আজাদ ভুঁইয়া তাকে খুঁজছেন? তিনি কী করেন জানলেন জুবায়েরের অন্দরমহলে প্রবেশ করেছে।
— আহেন,,
তৎক্ষণাৎ লাঠিভর করে রহমতের তালে তালে আনমনে পা চালালো জুবায়েরে। খানিকটা পথ এগিয়ে যেতেই দালাল ঘর দৃশ্যমান হলো। জুবায়ের স্পষ্ট দেখতে পেলো আজিজ ভুঁইয়া কে! যিনি কোমল গতিতে পায়ের উপর পা তুলে আয়েশ করে বসে রয়েছেন। তার পাশে দু জন স্বাস্থ্যবান ব্যক্তি দাঁড়িয়ে।
জুবায়েরের কে দেখে আজিজ তার পাশে অবস্থানরত দু জন ব্যক্তিতে বিদায় দিলেন। মুচকি হেসে কিছুটা দূর থেকেই জুবায়েরের উদ্দেশ্য বলে উঠেন,
— কেমন আছেন মাস্টারমশাই? ইশ, আপনার চোখ মুখের এমন অবস্থা কেন? খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করেন না নাকি? সারাদিন ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে পড়ে রইলে চলবে কি করে?
আচমকা আজিজের প্রশ্ন মোটেও প্রত্যাশা করেনি জুবায়েরের। গম্ভীর মুখের আজিজ যিনি কিন্তু প্রয়োজন ব্যতীত কারো সঙ্গে কথা বলেন না। তার থেকে এমন কথা অবশ্যই কাম্য নয়। খানিক পূর্বের ঘটনা মস্তিষ্ক থেকে বের করে নিজেকে সংযত রাখার প্রয়াস চাললো। শুকনো ঢোক চেপে স্বল্প হেসে প্রত্যুত্তরে বললো,
— আসালামু আলাইকুম। জী ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
জুবায়েরের প্রশ্নে শুনে আজিজের মুখশ্রীতে গম্ভীর্য ফুটে উঠে। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির রেখে নিমিষেই হাওয়াই মিলে যায়। আজিজ গম্ভীর গলায় বলে উঠেন,
— ভালো নেই।
আজিজের উত্তর পেয়ে ভরকে যায় জুবায়ের। আজিজ পুনরায় বলে উঠেন,
— বলেন তো ভালো থাকি কী করে! মেয়েগুলো দুষ্টুমি শুরু করে দিয়েছে। কথা একদমই শুনতে চাই না। প্রিয়া যা অবুঝ হয়েছে বলে বোঝাতে পারবো না।
প্রিয়ার সম্বন্ধে শুনে জুবায়েরের বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। ঠোঁট জোড়া জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে জড়তা মিশ্রিত কন্ঠে বললো,
— সবকিছু ঠিক আছে তো?
জুবায়ের কে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্ররখ করলেন আজিজ। তিনি তৎক্ষণাৎ গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠেন,
— আপনি ঘামছেন কেন মাস্টারমশাই? এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে লাঠি রেখে বসুন।
আকস্মিক আজিজের এমন কথা শুনে কিছুটা থমকে গেলো জুবায়েরের। তড়িঘড়ি মুচকি হেসে গদিতে গিয়ে বসলো।
জুবায়েরের অবস্থান লক্ষ্য করে তপ্তশ্বাস ফেলেন আজিজ। জুবায়েরের চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত ফেললেন। অতঃপর ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে আক্ষেপের সঙ্গে বলেন,
— আপনার ছাত্রীদের বিয়ে এসেছে শহর থেকে। পাত্ররা দুই ভাই। দু জনই বিদেশে থাকে। বুঝেছেন মাস্টার, বেশ ভালো পরিবার থেকে বিয়ে এসেছে তাই বিয়েটা হাতছাড়া করতে চাইছি না। কিন্তু মেয়ে দুটো কিছুতেই রাজি না। রিমা তো রেগে মেগে নানী বাড়িতে চলে গিয়েছে। আর প্রিয়া আরেক ঝামেলা করছে। খাওয়া দাওয়া করছে না। তাই বাধ্য হয়ে মা’ইর দিয়ে খাওয়াতে হচ্ছে। কি আর বলবো মাস্টার, আমি দিশেহারা। কি করতে পারি বলুন তো মাস্টার? আর যাই হোক এতো প্রভাবশালী ছেলে হাতছাড়া করতে পারবো না।
কথাগুলো বলে মুচকি হাসেন আজিজ। জুবায়ের কিংকর্তব্যবিমূঢ়! প্রিয়ার বিয়ের কথা শুনে তার পৃথিবীতে যেন আঁধারে ছেয়ে গিয়েছে। তাহলে কী তাদের একসঙ্গে পথ চলার স্বপ্ন কোনদিনই পূরণ হবে না? তার এখন কি করা উচিত কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে। তার অন্তরালে একই প্রশ্ন বারংবার ঘুরপাক খাচ্ছে। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়ে জন্মানো কী পাপ! সৃষ্টিকর্তা কেন তাকে প্রভাবশালী পরিবারের পাঠালেন না? কেন তাকে পঙ্গু বানালেন? প্রিয়াকে অর্জন করার ক্ষমতা কেন তাকে দিলেন না? বুকের ভেতর চাপা যন্ত্রণা চেপে রেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলো জুবায়েরে। প্রিয়াকে এক পলক দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছে। যে করেই হোক প্রিয়াকে একটি বারের জন্য দেখেই ছাড়বে সে। তাই নিজেকে সংযত রাখা প্রয়োজন। নিজের পরিকল্পনা সফল করতে জুবায়েরের আচমকা বলে উঠে,
— আপনি যা ভালো মনে করেন তাই করবেন। আজ প্রিয়ার পরীক্ষার সাজেশন দিয়েছে তাই ওর সঙ্গে সাক্ষাৎ করাটা প্রয়োজন। যদি একটু ডেকে দিতেন।
(চলবে)
[