সোহাগী পর্ব -০৬+৭

#সোহাগী
#পর্ব: ৬
Lutful Mehijabin

চৌকির এক কোণে দু হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে বসে রয়েছে সোহাগী। টকটকে লাল রংয়ের শাড়ি পরে আছে তার পায়ের সামনে। তার পিঠ ভর্তি চুলগুলো থেকে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ছে। এতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই সোহাগীর। সে আপন মনে ভাব বিলাসী হয়ে! অপরুপ হাতের নকশা করা শাড়িতে, তার টলমলে চোখের দৃষ্টি গোচর হয়েছে। তাকে এই অসহায় অবস্থায় রেখে কোথায় গিয়েছে তার আব্বা? তখন আমেনা সোহাগীর প্রশ্নের উত্তর দেন নি। বলেছে রাশেদ কোথায় গিয়েছেন তা তিনি নিজেই জানেন না! বাবার কথা মনে করে বুক চিরে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে। তাকে ছেলের বাড়ি থেকে দেখতে আসবে? বিষয়টা একটা অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ের জন্য কতোখানি যন্ত্রনার তা হয়তো বলে বোঝানো যাবে না। অজানা আতঙ্ক সোহাগীর বুকটা ভরে গিয়েছে।

দরজা চাপানোর মৃদু আওয়াজ কর্ণপাত হতেই কেঁপে উঠলো সোহাগী। কে এসেছে! চোখ তুলে সামনে থাকা মানবীর মুখশ্রীতে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকালো। আমেনা এসেছে। অর্ধ বয়স্ক মহিলার চোখে মুখে উপচে পড়া আনন্দের রেখা! আমেনা ধীর পদে চৌকির সামনে এসে দাঁড়ালেন।

— কিরে মাইয়া এহনো চুল মুছোস নাই? তাগাদা কর মেজবাইন চইলা আইছে। আই দেহি উঠ শাড়ি পড়াই দেই।

কথাগুলো শেষ করেই চৌকির উপর থেকে শাড়ি তুলে হাতে নিলেন আমেনা। শাড়িটাতে একবার ঠোঁট ছুঁইয়ে আনমনে বলে উঠেন,

— জানস সোহা, তোর মাইরে যেদিন তোর আব্বাই বিয়া করলো হেদিন এই শাড়ি পড়ছিল তোর মা। তাই আজ তোরে এইডা দিয়া সাঁজামু। উঠ তো শেমরি।

সোহাগী ছলছল নয়নে আমেনা মুখের দিকে তাকালো। তার মোটেও শাড়ি পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। আকস্মিক একরাশ সাহসের জোয়ার বয়ে গেলো সোহাগীর অন্তরালে! আকস্মিক তেজি গলায় সে বলে উঠলো ,

— আমি শাড়ি পড়বো না নানী। আর কোথাও যাব না। আমি পড়তে চাই। বিয়ে করতে চাই না।

— চুপ একদম চুপ।

আমেনা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন। ঠোঁট আঙুল রেখে ধমকের স্বরে বললেন,

— তুই চাস তোর মাই কষ্ট পাক? কতো কষ্ট সহ্য কইরা সোহানা তোরে মানুষ করলো। আর তুই এর এই প্রতিদান দিতেছিস। বয়স হইছে বিয়া তো দিতেই হইবো। এখন তোর খারাপ লাগবো মানছি কিন্তু যখন বিয়া হইবো তখন স্বামীর সোহাগে সব দুঃখ ভুইলা যাবি। তখন কবি তোর নানীই ঠিক কইতো। মাইগো জীবন হইলো রংধনুর মতোন। স্বামী, সন্তান তাগো সবচায়তে বড়ো ধর্ম। এগো পালতে পালতে কবরে যাইতে হইবো, বুঝছিস? পড়ালেখা কইরা লাভ নাই। হাজার পড়ালেহা করলেও তোরে উনুন জালাইতে হইবো। বরের কাছে বন্দি থাকতে হইবো।

সোহাগী আহত দৃষ্টিতে আমেনার দিকে তাকিয়ে রইলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো,

— নানী আমি তো কালকে রাতে তোমাকে কথা দিয়েছি যে কোন ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে থাকবো না। ছেলেদের সঙ্গে কথা বলবো না। তাহলে কেন নানী? কেন আমার বিয়ে দিতে চাইছো? আমি অনেক দূর অবধি পড়তে চাই।

আমেনা আর কথা বাড়ালেন না। অনুমতি ব্যতীত সোহাগী কে তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সর্বপ্রথম সোহাগীর চুলগুলো আঁচড়াতে শুরু করলেন। সোহাগী কিছু বললো না। ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে স্থির রাখতে চেষ্টা করলো। আমেনা নিজের কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। হঠাৎ মুচকি হেসে সোহাগী কে বলে উঠলেন,

— এমন মুখ করে থাহিস না সোনা। ভুঁইয়া বাড়ি তোর বিয়া হইবো। ওখানকার মানুষ মেলা ভালো। তারা তোরে পড়তে দিবো।
___________

রাশেদের তৈরি কৃত শক্ত কাঠের চেয়ারে বসে রয়েছে আমিরুল। লোকটার চোখে গম্ভীর্য দিয়ে ভরপুর। বয়স তাঁর বছর পঁয়ত্রিশ কিন্তু তাকে দেখে বোঝা মুশকিল! লোকে বলবে যৌবনের শেষ প্রান্তে পা রেখেছে আমিরুল। রাশেদের ঘরে প্রবেশ করার পর থেকেই ঘেমে একাকার সে। সোহাগীর ছোট ভাই লোকটা কে হাত পাখা নাড়িয়ে বাতাস করে যাচ্ছে অবিরাম! কিন্তু আমিরুল অস্থির হয়ে বারংবার দৃষ্টিপাত ফেলছে হাত ঘড়িতে। তার চোখে মুখে বিষন্নতা ছেয়ে।

আমিরুলের পাশে বসে রয়েছেন তার মা আসমা ভুঁইয়া। তারা মা ছেলে দু জন সোহাগী কে দেখতে এসেছে।‌ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে একজন ড্রাইভার। যে চৌরাস্তায় গাড়ি ভেতর ঝিমুচ্ছে।‌ আসমা কে হাত পাখা দ্বারা বাতাস করেছেন সোহানা। তার চোখে মুখে পুলকের রেখা স্পষ্ট! আজ মেয়ের একটা ব্যবস্থা করতে পারলেই হলো।

— আম্মা মেয়ে কোথায়? আমার ইমপটেন্ট কাজ আছে। একটু জলদি আনতে বলো।

আমিরুলের কথা শুনে সোহানার হাসির রেখা মলিন হয়ে এলো। জড়তা মাখা কন্ঠে সে বলে উঠলো,

— এইতো আব্বা, এখনই আইসা পড়বো। ওর নানী ওরে আনতে গেছে। তুমি একটু বইসো।

আসমা ছেলের দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ম কন্ঠে বলেন,

— আহ্ আমিরুল এতো উত্তেজিত হচ্ছো কেন!

শান্ত হয়ে বসলো আমিরুল। সোহাগী কে এখনো আসছে না দেখে সোহানার ভেতরে আগুন জ্বলতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। নিশ্চই জেদ ধরে রয়েছে সোহাগী! আজ একবার অতিথি বিদায় হোক সোহাগীর খবর করে ছাড়বেন সোহানা!

সোহাগী কে চুল মুঠি ধরে টেনে আনার জন্য অগ্রসর হচ্ছিলেন সোহানা। মুহুর্তেই আমেনা সঙ্গে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে সোহাগী। আমেনা সোহাগীর বাহু ধরে আসমার সামনে এনে দাড় করালো।

সোহাগীর দিকে দৃষ্টিপাত ফেললো আমিরুল। ইয়া বড়ো এক হাত ঘোমটা দ্বারা মুখ ঢেকে রেখেছে মেয়েটা। সোহাগীর মুখ না দেখতে পেরে বিরক্ত হলো আমিরুল! স্থির মস্তিষ্কে ভালোভাবে পরখ করলো।‌ সোহাগীর দেহের গড়ন মোটেও পছন্দ হলো না তার। অতিরিক্ত স্বাস্থ্যবান মেয়ে!

আসমা সোহাগী কে লক্ষ্য করে উঠে দাঁড়ান। আস্তে করে সোহাগীর ঘোমটা তুলে দেন। অতঃপর সোহাগী কে পেছন ঘুরিয়ে আমিরুলের মুখমুখি দাঁড় করিয়ে শক্ত গলায় বলেন,

— দেখো বাবা কেমন লাগে? চলবে তো!

আমিরুল সোহাগীর মুখের দিকে তাকাতে হতবাক হয়ে গেলো। মোটা মেয়েরা এতো সুন্দর হয় বুঝি! সোহাগীর চোখ জোড়া হরিণের চোখের ন্যায় এক সাগর মায়ায় ভরপুর। লম্বা, সরু নাক। স্বল্প লাল রংয়ের পাতলা, চিকন ঠোঁট। আমিরুল সবচেয়ে বড়ো ধাক্কা খেলো সোহাগীর ভ্রূ জোড়া লক্ষ্য করে। জোড়া ভ্রু কিন্তু খুবই চিকন। যার দরুন মেয়েটা অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী বলে বলা চলে।

— কি হলো বাবা! পছন্দ হয়েছে তো?

আসমার কথাই আমিরুলের ধ্যান ভাঙল। তৎক্ষণাৎ সোহাগীর মুখশ্রী হতে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। শুকনো ঢোক চেপে নিজেকে সংযত রেখে বললো,

— জী আম্মা। বাকিটা তোমার হাতে। তোমার পছন্দই আমার পছন্দ।

সামনে অবস্থানরত ব্যক্তির গম্ভীর কন্ঠস্বর পেয়ে কেঁপে উঠলো সোহাগী। লোকটা উত্তর শুনে সোহাগীর হাত পা অসাড় হয়ে এলো নিমিষেই! মাথা তুলে লোকটা মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করার মতো সাহস জুটে নি তার হৃদয় মনে।

আমিরুলের কথা শুনে আনন্দের উৎসারিত হয়ে গিয়েছেন আমেনা এবং সোহানা। খুশিতে দাঁত বের করে নিরবে হেসে চলছেন তারা। অপরদিকে একই অবস্থা আসমার। ছেলের উত্তরে ভীষণ পুলকিত তিনি। অবশেষে অনেক খোঁজাখুঁজির পর দ্বিতীয় কোন এক মেয়ে কে তার ছেলের মনে ধরেছে! ঠোঁটের কোণে লম্বা এক হাসির রেখা ঝুলিয়ে রেখে আসমা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সোহাগী কে দেখতে লাগেন। ঘোমটা তুলে চুলগুলো হাত দিয়ে মেপে দেখেন। হঠাৎ সোহানা কে আতঙ্ক করতে বলে উঠেন,

— মেয়ে তো পছন্দ হয়েছে কিন্তু,,,

চমকে উঠেন সোহানা। মুহুর্তেই আতঙ্কিত কন্ঠে বলেন,

— কিন্তু কী আপা?

সোহানার প্রশ্নের জবাবে আসমা তুচ্ছতাচ্ছিল্য স্বরে বলে উঠেন,

— কিন্তু মেয়ে যে অতিরিক্ত মোটা আর খাটো। আর চুলগুলোর অনেক গুচ্ছ আছে কিন্তু পিঠ পর্যন্ত কেন?

কথাগুলো শুনে ক্ষুন্ন হলেন সোহানা। লহমায় আমেনা উত্তেজিত হয়ে দ্রুত বলেন,

— আমার নাতি ছয় মাস আগেও এমন ছিলো না। হঠাৎ চৌদ্দ তে পা দিতেই ফ্যালফ্যালাই বড়ো হইয়া গেছে। মোটাও হইয়া গেছে। আপনারা এসব লইয়া চিন্তা করবেন না। আর চুল বড়ো হয় নাই তো কি হইছে! এহন থাইকা চুল রাইখা বড়ো করবো।

আসমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনমরা হয়ে বলে উঠেন,

— ঠিক আছে। আপনারা তো জানেন না আমার বউমার অনেক বড়ো চুল ছিলো। গায়ের রং ছিলো ধবধবে সাদা। কিন্তু এই মেয়ের গায়ের রং ময়লা ,,,

আসমার শেষোক্ত বাক্য সম্পূর্ণ শেষ করার সুযোগ দিলেন না সোহানা। নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেন,

— আমার মাইয়ার গায়ের রং কইলাম শ্যামলা না। ও আমার মতো ফর্সা। দেখেন আমার হাত। আমার মতো আমার মাইয়ার গায়ের রং। সোহা খালি গ্রাম ঘুইরা বেড়ায়, নিজের যত্ন নেই না তাই এমন ময়লা হইয়া গেছে।

আসমা সত্যি সত্যি সোহানার হাত খুঁটিয়ে দেখলেন। মেয়ে মাইয়ের মতোই গায়ের রং পেয়েছে। অযত্নের ফলে সোহাগী একটু শ্যামলা। আসমা সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে বলেন,

— ঠিক আছে বুঝলাম। কিন্তু বিয়ের পর কিন্তু গ্রাম ঘুরা বন্ধ করতে হবে। শুনেন খালা, আমার বউ যদি বাঁচা থাকতো তাহলে কখনোই আপনাদের ভিটায় পা রাখতাম না।

— আহ্ মা। এসব বাদ দেও তো। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব দিন তারিখ ঠিক করো। আমাকে আগামী সপ্তাহে কম্পানির কাজে নেপালে যেতে হবে। তাই আমি চাইছি দু তিন দিনের মধ্যে শুভ কাজ সেরে ফেলতে।

আমিরুলের লাগামহীন কথাগুলো শুনে লজ্জায় রঞ্জিত হলো আমেনা মুখশ্রী। এ কেমন ছেলে, লাজ লজ্জা ভুলে বিয়ের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে! আসমা ছেলের কথা উপেক্ষা করে আচমকা সোহাগীর থুতনিতে স্পষ্ট করলো। মুহুর্তেই সোহাগীর জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কথাগুলো বলতে আরম্ভ। যা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না সোহাগী।

— নাম‌ কি যেন তোমার, একবার বলো তো? জানো মা, অনেক সময় দেখা যায় ভালো করে খোঁজ খবর নিয়ে বিয়ে করার পর বাসর ঘরে জানা যায় যে বউ কথা বলতে পারে না। তাই আমি সেই ঝুঁকি একদমই নিতে চাইছি না। আমার একমাত্র ছেলে বলে কথা।

আসমার কথা বলার ভাব ভঙ্গি পছন্দ হলো না সোহাগীর। কিন্তু মায়ের কথা ভেবে মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস পেলো না সোহাগী। তার বুক ফেটে কান্না আসছে। আব্বা তুমি কোথায় বলে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার! এখন যে খুব করে রাশেদের উপস্থিতি তার প্রয়োজন। নিজেকে ধাতস্থ রেখে সোহা কাঁপা কাঁপা গলায় প্রত্যুত্তর করে,

— আমার নাম মোসাম্মত সোহাগী।

সোহাগীর কন্ঠস্বর শুনে আমিরুল ফিসফিসিয়ে কিছু বললো। কিন্তু তা কারো কান অবধি পৌঁছাতে পারলো কি সন্দেহ! আসমা হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। মুচকি হেসে সোহাগীর মাথায় হাত রাখলেন। অতঃপর ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে মলিন কন্ঠে বলে উঠেন,

— শোনো খুকি, আগে থেকেই তোমাকে বলে রাখা ভালো। আমি বা আমার ছেলে চাই না বিষয়টা তুমি বিয়ের পরে জানতে পারো। তুমি আমার ছেলের দ্বিতীয় বউ হতে চলছো। আমার বউ মা মাস ছয়ের আগে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার মারা যায়। শুধু তাই নয় আমার বউমার একটা পুত্র সন্তান আছে। মূলত তার জন্যেই তোমাকে ঘরে তুলেছি। আর যাই করো না কেন আমার নাতির যত্ন আত্মি করতে হবে তোমাকে। সৎ মায়ের মতো আচরণ করলে একদম বাপের বাড়ি ছুড়ে ফেলে দিবো। যদি নিজের মা হয়ে উঠতে পারো তাহলে আমরা সবাই তোমাকে ভালোবাসবো।

আসমার কথাগুলো শুনে চমকে উঠলো সোহাগী। পরিশেষে তাকে কিনা এক ছেলের বাপ কে বিয়ে করতে হবে! সে যদি লোকটার বাচ্চা কে লালন পালন করে তাহলে সে পড়বে কখন? এরা কি তাকে পড়তে দিবে না? ইতিমধ্যে সোহাগীর মাথা ঘুরতে আরম্ভ করেছে।

আমিরুলের অতীত সম্পর্কে আমেনা এবং সোহানার পূর্বে থেকে অবগত ছিলো যার দরুন তারা অবাক হয় নি। অবশ্য আমিরুল বিবাহিত শুনে প্রথমে রাজি হন নি আমেনা। কিন্তু সোহানার অযৌক্তিক বানী শুনে, নাতীনের সুখের কথা চিন্তা করে তিনি রাজি হয়েছেন।

আসমা ছেলে কে ইশারা করে কিছু দিতে বলেন। আমিরুল তৎক্ষণাৎ মুচকি হেসে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। পকেটে থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকার বানডেল বের করে মায়ের হাতে দিলেন। আসমা টাকার বানডেল নিয়ে তড়িঘড়ি সোহাগীর হাতের মুঠোয় পুড়ে দিলেন। পুনরায় বলে উঠলেন,

— আর একটা কথা আগে থেকেই বলে রাখি, বিয়ের পর কোন সন্তান নেওয়া যাবে না। আমার নাতির মুখে মা ডাক শুনে তোমাকে মাতৃত্বের স্বাদ নিতে হবে চিরকাল। আশা করে বুঝতে পেরেছো?

আসমার কথাগুলো শুনে হতবম্ব হয়ে পড়লো সোহাগী। বিষয়টা বুঝতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে তার। আসমার এতো বড়ো মারাত্মক কথার সারমর্ম বুঝতে ব্যর্থ হলো সোহাগী। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এখন থেকে এই মানুষ গুলোর সামনে থেকে সরে যেতে বড্ড ইচ্ছে করছে তার। অন্যদিকে আমিরুল মায়ের কথায় সম্মতি জানিয়ে ভদ্র ছেলের মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আসমার কথাগুলো প্রাধান্য দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে নি সোহানা। তিনি লোভনীয় দৃষ্টিতে সোহাগীর অবস্থানরত টাকাগুলোর উপর তাকিয়ে রয়েছেন। কিন্তু আসমার বলা বাক্যগুলো মোটেও পছন্দ হলো না আমেনার। তার নাতি কোনদিনই নিজের গর্ভের সন্তানের মা ডাক শুনতে পারবে না!
#সোহাগী
#পর্ব :৭
Lutful Mehijabin

আমিরুলরা চলে গিয়েছে কিৎক্ষণ পূর্বে। যাওয়ার আগে আসমা বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে গিয়েছেন। আগামী পরশু আমিরুল এবং সোহাগীর আকাদ সম্পূর্ণ হবে। এতো বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সোহানা কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে রাশেদের কোন পাত্তা নেই! মেয়ের বিয়ে অথচ বাবা নেই? উঠানের মধ্যেখানে হাত পা ভাঁজ করে বসে রয়েছে সোহাগী। তার চোখে মুখে অসহায়ত্ব স্পষ্ট! আমেনা সোহাগীর পাশে দু হাঁটুর মাঝে মুখ দিয়ে বসে রয়েছেন। তিনি বিমূঢ়! আসমার শেষাক্তো বানী অর্থাৎ সোহাগী কোনদিনই মা হতে পারবে না বিষয়টা মানতে পারছেন না। কিন্তু সোহানার কর্মে বাধা দেওয়ার মতো ক্ষমতা বা সাহস কোনটাই নেই। সে যে অক্ষম, সোহানার উপর নির্ভর করে তাকে বাঁচতে হয়। এই বার্ধক্য বয়সে জামাতার অর্থে তার প্রয়োজন মিটাতে হয়। যার দরুন ইচ্ছে থাকলেও সোহানা কে কিছু বলতে পারেন না। যদি সোহানা তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। তাহলে! এই অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথায় গিয়ে উঠবে! পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ স্বার্থপর। আমেনার ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয়! তিনি নিজ স্বার্থে প্রতিবাদ না করে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন।

অপরদিকে নিজের কাজে ব্যস্ত সোহানা। বিয়ে বাড়ি বলে কথা, মা হিসেবে তার তো দায়িত্ব কম নয়। আমিরুল দের বিদায় দিয়ে, তৎক্ষণাৎ সোহাগীর হাত থেকে টাকা নিয়ে কোমরে গুঁজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলেন। মাত্র ফিরলেন। কোথায় গিয়েছিলেন তা সবার অজানা! উঠানে পা রাখতেই তার প্রাণবন্ত মুখশ্রীতে আঁধার নেমে এলো। সোহাগী এবং আমেনা কে উঠানে মলিন মুখে বসে থাকতে দেখে সোহানার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। তিনি দ্রুত সোহাগীর নিকট উবু হয়ে অদ্ভুত কান্ড করে বসেন। আচমকা সোহাগীর খোপা বাধা চুলের গোছা শক্ত করে চেপে ধরেন। দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,

— এই ভরা হাজে তুই দুয়ারে জাবর দিয়া বইসা আছিস কেন? শাড়িডা যে নষ্ট হইতেছে সেই খেয়াল আছে তোর?

আকস্মিক আক্রমণে ভরকে উঠলো সোহাগী। ইতোমধ্যে ব্যথার তার চোখ জোড়া আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মুখ থেকে নির্গত হচ্ছে অস্কুট আর্তনাদ! আমেনা কিছু বুঝে ওঠার আগে উত্তেজিত হয়ে দ্রুত সোহানাকে ছাড়তে চেষ্টা করলেন।

— সোহানা ওরে ছাইড়া দে। ছাড় কইতেছি।

সোহানা আমেনার কথার ভ্রক্ষেপ করলেন না। একই অবস্থায় রইলেন। ক্রোধ মাখা কন্ঠে বলেন,

— চুপ করো আম্মা। তোমার জন্য আইজ মাইয়াডা আমার অবাধ্য হইছে। সরো, আমার কামে বাধা দিয়ো না।

— সোহানা তুই ওরে মারতেছিস কেন? সোহাগী কি করছে!

সোহানা কিছু একটা মনে করে লহমায় সোহাগী কে ছেড়ে দিলেন। আবহাওয়ার ন্যায় তার আচরণের পরিবর্তন ঘটলো। নিমেষেই শক্ত হৃদয় কোমল হয়ে উঠলো। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রেখে সোহাগীর থুতনিতে হাত রেখে নরম গলায় বলেন,

— উঠ মা। আর কয় দিন ই বা আমার বাড়ি থাকবি! পরশু দিনের পর থাইকা আমার বাড়ির মেজবান হইয়া আইবি। তখন এক দেয়াল সৃষ্টি হইবো আমাগো মাঝে। এই দুই দিন লক্ষি মাইয়া হইয়া থাক না মা। তুই যে শাড়ি নষ্ট করছোস এই শাড়িটা আমার বহুত পছন্দের। এই শাড়ির প্রতি আমার মেলা লোভ। তাই তাড়াতাড়ি উইঠা শাড়ি ছাড়।

সোহাগী নিরবে দু ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিলো। মায়ের কোমল কন্ঠস্বর যে তার খুবই প্রিয়। শত হাহাকার ভরা খরার মধ্যে যেমন এক ফোঁটা বর্ষণ মানুষের প্রাণ শীতল করার মতো ক্ষমতা রাখে ঠিক তেমনি মায়ের মধুর বানী হৃদয়ের উত্তপ্ত খরা শীতল করার মতো শক্তিশালী হয়ে থাকে। সোহাগী বিতৃষ্ণাময় মনে বাধ্য মেয়ের মতো উঠে দাঁড়ালো। শাড়ির আঁচল ঠিক করে নিজেকে সংযত রাখতে চেষ্টা করলো। মুহূর্তেই সোহানার মুখে অসহায়ত্ব চাহনি নিক্ষেপ করলো। মেয়ের চোখের ভাষা বুঝতে মোটেও অসুবিধা হলো না সোহানার। কিন্তু তিনি সোহাগী কে প্রাধান্য দিলেন না। অতঃপর সোহাগী কাঁপা গলায় বললো,

— আম্মা, আব্বা কোথায় গেছে? কখন আসবে?

সোহানার মেয়ের প্রশ্ন শুনে শুকনো ঢোক গিলেন। জড়তা সম্পূর্ণ কন্ঠে উত্তর দেন।

— তা,, তোর জানা লাগবো না শেমরি। সময় হইলে আইসা পড়বো।

— বলো না আম্মা, আব্বা আসে না কেন? আমার আব্বা কোথায়? তাকে দেখার জন্য আমার বুকটা দাউদাউ করে জলছে যে।

আকুতি ভর কন্ঠে কথাগুলো শেষ করলো সোহাগী। এবার বোধহয় সোহানার খানিকটা মায়া হলো সোহাগীর উপর। তড়িঘড়ি তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলেন,

— তোর আব্বা গন্জে গেছে সপ্তা খানিকের জন্যি। আগামী সপ্তায় আইবো। এর আগেই তোরে বিয়া দিবার পারলি বাঁচি।

মুহূর্তেই ডুকরে কেঁদে উঠে সোহাগী। কান্নারত অবস্থা বলে উঠলো,

— আম্মা, আমি বিয়েতে রাজি কিন্তু আব্বা না আসলে আমি বিয়ে করতে পারবো না। দরকার পড়লে আমি পালিয়ে যাবো।

সোহাগীর শেষোক্ত কথার ভিত্তিতে ক্ষেপে গেলেন সোহানা। তৎক্ষণাৎ সোহাগীর কোমল গালের উপর আঘাত হানা দিলো। সোহানা সজোরে থা’প্পড় মা’রেন তার ডান গালে। ব্যথায় কুঁকরে উঠলো সে। আমেনা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে!

— বিয়াদপ শেমরি! এমন চিন্তা মাথায় ও আনবি না। এই কথার পরিনতি কইলাম ভালো হইবো না।

কথাগুলো বলে তপ্তশ্বাস ফেলেন সোহানা। অতঃপর পুনরায় বলে উঠেন,

— আম্মা তোমার আদুরের নাতি রে ঘরে নিয়া গিয়া সোহাগ করো। মুখের উপর যে চ্যারাং চ্যারাং কথা বলে শিখছে তোমার নানি এমন হইলে দেখো গিয়া স্বামীর ঘরে টিকে নাকি। আমি আগেই সাবধান করতেছি আমার বাড়িতে কিন্তু সোহাগীর কোন জায়গায় নাই।

তৎক্ষণাৎ উঠান থেকে ঘরে চলে গেলেন সোহানা। সোহাগীর দৃষ্টি মাটিতে পলক হারিয়েছে! আমনা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেন না। স্বার্থ পরের মতো নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন।

__________________

বিকেল গড়িয়ে চারপাশের আঁধার নেমেছে। পশু পাখি আপন নিরে ফিরে যাচ্ছে। গৌধুলির লগ্ন! রাখালরা মাঠে থেকে গরু নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। দূর পান্ত থেকে আযানের সমধুর প্রতিধ্বনি ভেসে আসছে। দোকানদাররা দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরছে। সন্ধ্যা বলতে যেন চৌদি ডাংগি গ্রামের সকল কর্মরত মানুষগুলো আপন গন্তব্যে পৌঁছতে দ্রুত পা চালান। সৃষ্টিকর্তার হুকুম পালনে আযানের ডাকে মসজিদের দিকে ধাবিত হয় আদর্শ ব্যক্তিগন। অবশ্য রাত হলেই গ্রামটা সবার জন্য অনিরাপদ বলে মানুষ গুলোর বাড়ি ফেরার তাড়া যেন বড্ড বেশি!

ভুঁইয়া বাড়ির সদর দরজায় সামনে পায়চারি করছে জন চারেক দেহবান শক্তিশালী দ্বাররক্ষী। প্রতিদিন দু জন থাকলেও আজ ব্যতিক্রম! জুবায়ের মাস্টার আজ ভর সন্ধ্যায় প্রিয়াকে পড়াতে এসেছে। সারাদিন স্কুল করিয়ে অবশেষে ভুঁইয়া বাড়ি উপস্থিত হতে পেরেছে সে। কিন্তু চারপাশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে অজানা আতঙ্কে তার ভেতরটা দাউদাউ করে জ্বলছে। প্রিয়ার কথাগুলো যদি সত্যি হয়! সত্যিই কী তাদের আজ শেষ দেখা? রিমাই বা কোথায়? সে কী বেঁচে নেই এই ধরণীর বুকে!

দারোয়ান গুলো আজ বেশ কঠোর হয়ে পায়চারি করছে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে দু জন ব্যক্তি কে জুবায়ের প্রতিদিন এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তারা আজ নেই! ইতোমধ্যে জুবায়ের কে দু প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকতে লক্ষ্য করে দারোয়ান গুলো নিজেদের মধ্যে কানঘুষা করলেন। মিনিট পাঁচেক পর একজন হাতে লাঠি নিয়ে জুবায়েরের সামনে এলেন। আকস্মিক প্রগাঢ় ঝাঝালো কন্ঠে বললো,

— কে আপনি?

হঠাৎ লোকটার আগমনে সামান্য ভরকে গেলো জুবায়ের। এভাবে লোকটা এসে পড়বে তা সে কল্পনা ও করে নি।

জুবায়ের কিছু বলতে ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করার পূর্বেই লোকটা বলে উঠে,

— আপনি মাস্টার মশাই তাই তো?

জুবায়ের নির্ভীক থেকে এক গাল হেসে জবাব দিলো।

— হ্যাঁ, কিন্তু আপনি চিনলেন কীভাবে?

— আপনি যে ল্যংড়া বড় সাহেবের কাছে থেকে শুনেছি। যাইহোক এভাবে চোরের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে ভেতরে প্রবেশ করুন। বড়ো সাহেব আপনাকে সোজা দালান ঘরে ঢুকতে বলেছেন। অন্য দিকে পা বাড়ানো নিষেধ। যান।

লোকটার শুদ্ধ ভাষা শুনে খানিকটা আবাক হলো জুবায়ের। অতঃপর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো। এখন কথা বাড়ানো মানেই বোকামি বৈকি অন্য কিছুই নয়!

অন্দরমহলের ভেতরে প্রবেশ করতেই চমকে উঠলো জুবায়ের। সম্পূর্ণ বাড়ি জুড়ে শুলশান নিরবতা। প্রতিদিন চারপাশ আলোকিত থাকলেও আজ আঁধারে আচ্ছন্ন! বাড়িতে মানুষ জন নেই নাকি! কোথায় গিয়েছে সবাই? জুবায়ের কিছুটা পথ এগিয়ে যেতেই সম্পূর্ণ অন্দরমহল ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুব দিলো। অর্থাৎ বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে। গা ছিমছাম মুহূর্ত। অন্ধকারে হাঁটতে পারছে না জুবায়ের। তাকে বিস্মিত করে, অদ্ভুত কান্ড কারখানা ঘটতে আরম্ভ করলো। যা স্বাভাবিক বলে মনে হলো না তার নিকট! আচমকা একধরনের বিকট শব্দ শুনতে পেলো সে! মুহূর্তেই জুবায়েরের সর্বাঙ্গের লোমকূপ দাঁড়িয়ে উঠলো। সামনে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তার লক্ষ্য হলো একটা হ্যারিকেন হলদেটে আলো তার নিকট এগিয়ে আসছে। সবকিছু মিলিয়ে যেন ভুতুরে পরিবেশ!

(চলবে)
[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here