জলপদ্ম পর্ব -২২

#জলপদ্ম
#কুরআতুল_আয়েন

|২২|
তনায়া আপুর বিদায়ের পর্ব শেষ।আবির ভাইকে এই প্রথম কান্না করতে দেখলাম।কান্নার ফলে,নাকটা লাল হয়ে আছে।তনায়া আপু যেতেই মেজোমা অজ্ঞান হয়ে গেলো।বাসার আমেজ যেনো মুহূর্তেই মিহিয়ে গিয়েছে।তনায়া আপুর বিদায়ে রক্তিম ভাইকে দেখতে পেলাম না।হয়তো,এখানে কান্নাকাটি চলছে বলে আসেন নি।সবার কান্না দেখে আমিও একদফা কেঁদেছি।রাতের বেলায়,একা একা ভালো লাগছিলো না বলে রিমির কাছে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।সকাল হলেই কলেজ যেতে হবে।তার পরের দিন আবার তনায়া আপুর বৌভাত।শুয়ে শুয়ে ভাবছি,রক্তিম ভাইয়ের কথা।সেই যে বিয়েতে দেখেছিলাম,তারপর আর দেখতে পায় নি।রক্তিম ভাইয়ের কথা ভাবতে ভাবতে চোখ দুটোতে ঘুমেরা ভীড় করে দিয়েছে।সেই সাথে হাইও আসছে।সবকিছু বাদ দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে নিলাম।তার আগে একপলক তাকালাম রিমির দিকে।গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে।রিমির ঘুম দেখে আমিও পুনরায় মাথা এলিয়ে দিলাম বালিশে।দু’দিন ভালো করে ঘুম হয় নি বলে হয়তো তাড়াতাড়ি ঘুম চলে এসেছে।তার পরের দিন সকাল সাত টায় ঘুম থেকে উঠে পড়লাম।কলেজের জন্য তৈরি হতে হবে বলে রিমির রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালাম।পাশেই রক্তিম ভাইয়ের রুম।রক্তিম ভাইকে দেখার কৌতূহল জাগছে খুব।আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম করিডোরে তেমন কেউ নেই।এই সুযোগে গুটিগুটি পা’য়ে রক্তিম ভাইয়ের রুমের দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম।দরজায় ধাক্কা দিতেই খোলে গেলো।কিছুটা অবাক হলাম।রুমে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখলাম বিছানাটা খালি পড়ে আছে।শুধু তাই নয়,রুমে বা ওয়াশরুমেও রক্তিম ভাই নেই।তার মানে,রক্তিম ভাই রাতে রুমে ছিলেন না।কথাটা ভেবে চিন্তায় পড়ে গেলাম।কই গেলেন রক্তিম ভাই তাই ভাবছি!কারোর পা’য়ের আওয়াজে আমি দ্রুত গতিতে রক্তিম ভাইয়ের রুমের সামনে থেকে সরে আসলাম।এক দৌড়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজা টা বন্ধ করে দিয়েছি।তাড়াহুড়ো করে ফোনটা হাতে নিয়ে রক্তিম ভাইয়ের নাম্বারে ডায়াল করতেই অপর পাশে বলে উঠলো সুইচড অফ।রক্তিম ভাইয়ের ফোন বন্ধ হয়ে আছে।মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে রক্তিম ভাই গেলেন কই?বাসায় থাকলে নির্ঘাত ঘুমে থাকতেন!কারণ,রক্তিম ভাই ঘুম থেকে উঠতে উঠতে দশ টা বাজবেই।দশ টা না বাজলেও নয়ের ঘর তো পার হবেই।এইসব ভাবনার মাঝেই কলেজের জন্য রেডি হতে লাগলাম।বিনুনির শেষ অংশে রাবার ব্যান্ড লাগিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।তবে,মন খুব অস্থির হয়ে আছে।নিচে নামতেই মা সামনে খাবার ধরিয়ে দিলো।কোনোমতে খেয়ে আমি আর রিমি বেরিয়ে পড়লাম মেইন রাস্তায়।গাছের ছাঁয়ায় দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছি।রিমিকে দেখলাম খুব চুপচাপ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।রিমি যে কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে খুব চিন্তিত তা ঠিক বুঝতে পারছি।কিছুটা কাছে গিয়ে বললাম,
‘রিমি!তুই কি কিছু নিয়ে চিন্তিত?’

রিমি একপলক তাকালো আমার দিকে।মুখটাকে গোমড়া করে রেখেছে।কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
‘রিমঝিম!তুই কি জানিস ভাইয়া কোথায়?’

‘না রিমি!তনায়া আপু চলে যাওয়ার পর থেকে আমি রক্তিম ভাইয়ের কোনো দেখা পায় নি।’

‘আজকে!সকালে মা বললো,ভাইয়া নাকি কাল রাতে বাসায় আসে নি।কোথায় গিয়েছে তাও জানে না।আমি ভাবলাম,তুই হয়তো জানিস তাই তোকে জিজ্ঞেস করেছি।’

রিমির কথা শুনে আমি থতমত খেয়ে গেলাম।আগের থেকে চিন্তা যেনো আরো একটু ঘিরে ধরেছে।আচমকাই মন বলে উঠলো রক্তিম ভাইয়ের কোনো ক্ষতি হয় নি তো!পরক্ষণেই,নিজেই নিজের মনকে শাসিয়ে তুললাম এইসব উল্টো পাল্টা কথা বলার জন্য।চোখ ফেটে পানি বের হয়ে আসার উপক্রম।রুমে থাকলে ঠিকই একদফা কান্না হয়ে যেতো।কিন্তু,রিমি সামনে আছে বলে কিছুটা দ্বিধা বোধ কাজ করছে।তবে,মনে মনে দোয়া করছি,রক্তিম ভাইয়ের দেখা যেনো খুব দ্রুত পেয়ে যাই।আমি আর চিন্তা করতে পারছি না।রক্তিম ভাইকে ছুঁয়ে না দেখা অব্দি আমার শান্তি নেই।রিকশার ক্রিংক্রিং আওয়াজে কিছুটা চমকে উঠলাম।এতোক্ষণ রক্তিম ভাইয়ের ভাবনায় বিভোর হয়ে থাকায় চারপাশের দিকে কোনো খেয়াল ছিলো না।রিকশা থেকে রিমি আলতো গলায় চেঁচিয়ে বললো,
‘এই রিমঝিম!উঠে আয়।দেরি হয়ে যাচ্ছে কলেজের।’

মাথা নেড়ে উঠে পড়লাম।চোখে,মুখে রোদ পড়ায় রিকশার হুড টা তোলে দিয়ে পুনরায় ভাবনায় পড়ে গেলাম।আমি ঢের বুঝতে পারছি আজকে সারাদিন আমার ভাবনায় কাটবে।সেই সাথে চিন্তা আর অস্থিরতা তো আছেই।মনে মনে বিরবির করে বলতে লাগলাম,রক্তিম ভাই আপনি যেখানেই থাকুন না কেনো প্লিজ চলে আসুন।আমার খুব চিন্তা হচ্ছে।একদন্ডও শান্তি পাচ্ছি না।
—-
কলেজ থেকে তাড়াহুড়ো করে বাসায় চলে আসলাম।সোফার এককোনায় বড়’মা চিন্তিত মুখ নিয়ে বসে আছে।বুঝতে আর অসুবিধা হয় নি,রক্তিম ভাই যে এখনো বাসায় ফেরেন নি।বড়’মার সামনে যেতেই বড়’মা আমাকে দেখে শুকনো হাসলো।বড়’মা বুঝাতে চাচ্ছে,আমি যেনো রক্তিম ভাইয়ের জন্য চিন্তা না করি।কিন্তু,তা তো কখনেই সম্ভব না।রক্তিম ভাইয়ের জন্য চিন্তা করার ফলে আজকে কলেজে একটা ক্লাসেও মন বসাতে পারি নি।শুধু তাই নয়,সবুজ স্যার যখন আমাকে দাঁড় করিয়ে বংশগতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন তখনি আমি আরো নেতিয়ে গিয়েছিলাম।মনে করার অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারি নি।কয়েকদিন আগেই পড়েছিলাম।মাথায় শুধু আসছিলো পিতামাতার আকৃতি,চেহারা,দেহের গঠন-প্রকৃতি।সাজিয়ে বলার আগেই সবুজ স্যার দাঁত খিঁচিয়ে বলেছিলেন,বংশবৃদ্ধি করতে হলে বংশগতি কাকে বলে তা জানতে হবে।না হলে,কিন্তু খুব বিপদ আছে।সবুজ স্যারের কথায় তখন আমি কিছুটা লজ্জা পেয়েছিলাম।অবশ্য,সবুজ স্যার অনেকটা রসিকতার মানুষ।ঠোঁটের কোণে সবসময় হাসি লেগেই থাকবে।এমনকি,হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে পানিও গড়িয়ে পড়ে।সোফা ছেড়ে বড়’মা উঠে দাঁড়ালো।আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
‘তুই চিন্তা করিস না।রক্তিম চলে আসবে।আমি জানি,রক্তিমের জন্য তোর খুব কষ্ট হচ্ছে।তুই এখন নিজের রুমে যা।রিমি তো একটু আগেই গেলো।ফ্রেশ হয়ে ভালোমতোন কিছু খেয়ে নে।আমি খাবার রেডি করছি।’

রুমে যাওয়ার পর রক্তিম ভাইকে বেশকিছু বার ফোন দেওয়ার পরও কোনো রেসপন্স পেলাম না।ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লো।চোখের কার্ণিশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।রুমের বাহিরে রিমির গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।রিমি কাছে আসতেই ভাঙা ভাঙা গলায় বলে উঠলাম,
‘আমি খাবো না।বড়মা’কে বলে দিস।’

রিমি মন খারাপ করে চলে গেলো।রক্তিম ভাইয়ের জন্য তারও খুব চিন্তা হচ্ছে।মনে মনে ভেবে নিয়েছি,রক্তিম ভাই আসলে খুব বকে দিবো।আমাদের সবাইকে চিন্তায় ফেলার জন্য।অত্যন্ত বড়মা’কে বলে যাওয়া উচিত ছিলো।
—-
পরের দিন সবাই তনায়া আপুর বৌভাতে গেলেও আমি যাই নি।ইচ্ছে করে নি।আমি যাবো না বলে মাও যেতে রাজি ছিলো মা।তবে,মা’কে কোনোরকম বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি।সারা বাসা জুড়ে পিনপিনে নিরবতা বিরাজ করছে।আমি ছাড়া আর কেউ নেই।তার উপর বাহিরে দমকা হাওয়া চলছে।মাঝেমধ্যে গুড়ুম গুড়ুম করে মেঘ ডেকে উঠছে।দৌড়ে গিয়ে নিচে নেমে আসলাম।লিভিং রুমের পাশের বিশাল বড় জানালা টা লাগিয়ে দিয়ে মেইন দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম।মেইন দরজা লাগানোর আগেই দরজায় কড়া আঘাতের ফলে কিছুটা ঘাবড়ে যাই।কিছুক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর,দরজায় আঘাত টা আর একটু জোরে ভেসে আসলো।কিছুটা ভয় নিয়ে দরজা টা খোলতেই দরজার অপাশে দাঁড়িয়ে থাকা রক্তিম ভাইকে দেখে চমকে উঠলাম।প্রথমে চমকে উঠলেও পরে ঠিকই খুশি হয়েছি।ঝাঁপিয়ে পড়লাম রক্তিম ভাইয়ের বুকে।তবে,রক্তিম ভাইয়ের কোনো সাড়া পেলাম না।বরং,আমাকে ছাড়িয়ে দিয়ে পাশ কেটে চলে গেলো।রক্তিম ভাইয়ের এমন অদ্ভুত আচরণ আমার মোটেও হজম হলো না।আমাকে জানতে হবে,রক্তিম ভাই কাল দুপুর থেকে এখন পর্যন্ত কোথায় ছিলেন।আমিও ছুটলাম রক্তিম ভাইয়ের পিছু পিছু।রক্তিম ভাই রুমে ঢুকে দরজা টা বন্ধ করে দিতে গেলেই সেখানে আমি বাঁধা হয়ে দাঁড়ালাম।আমাকে দেখেই রক্তিম ভাই রাগান্বিত হয়ে বললেন,
‘রিমঝিম!প্লিজ আমাকে একটু একা থাকতে দে।আমি খুবই ডিস্টার্ব।’

রক্তিম ভাইয়ের কথার কোনো পাত্তা দিলাম না।কিছুটা নাছোড়বান্দা হয়েই বললাম,
‘আপনার কি হয়েছে রক্তিম ভাই?আমাকে বলুন তো।কাল থেকে চিন্তায় চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছি।’

‘প্লিজ রিমঝিম!তুই যা এখান থেকে।আমাকে প্লিজ একা থাকতে দে একটু।আমার একটু প্রাইভেসি লাগবে।’

‘তার আগে আপনি শুধু এটা বলুন সারারাত কোথায় ছিলেন।আপনার জন্য তো খুব চিন্তা হচ্ছিলো।’

রক্তিম ভাইয়ের চোখে,মুখে রাগ ফুটে উঠলো।কপালের রগ গুলোও ভেসে উঠেছে।আমার কথার উত্তর না দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিতে গেলেই আমি পুনরায় হাত দিয়ে আঁটকিয়ে দিলাম।কেন জানি রক্তিম ভাইয়ের উপর প্রচুর রাগ কাজ করলো।কিছুটা জোরে চিল্লিয়ে বলে উঠলাম,
‘আপনার সমস্যা কোথায় রক্তিম ভাই?আপনি এইরকম আচরণ করছেন কেনো?আমাকে বলুন আপনি কাল সারারাত কোথায় ছিলেন।’

রক্তিম ভাই ধাক্কা দিয়ে আমাকে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে দিলেন।তাল সামলাতে না পেরে করিডোরের মধ্যিখানটায় পড়ে গেলাম।রক্তিম ভাই দেখেও দেখলেন না।আমার মুখের সামনে ঠাস করে দরজা টা বন্ধ করে দিলেন।এই প্রথম রক্তিম ভাই আমাকে ইগনোর করলেন।দরজায় গিয়ে রক্তিম ভাই বলে চেঁচিয়েও কোনো সারাশব্দ পায় নি।কোনোমতে,চোখের পানি ফেলে নিজের রুমে চলে এসেছিলাম।সেইদিনের পর থেকেই রক্তিম ভাই যেনো চোখের পলকে বদলে গেলেন।আমাকে একপ্রকার ইগনোর করে চলতে লাগলেন।কিন্তু,রক্তিম ভাইয়ের এরূপ আচরণ আমি যেনো কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলাম না।দমবন্ধ হয়ে আসছিলো আমার!!
🍁🍂
ঝিরিঝিরি বাতাসের ফলে রিমঝিম কিছুটা কেঁপে উঠলো।কান গুলো বরফের মতো জমে আছে।বাতাসের কিছু প্রকোপ যেনো গলা ভেদ করে জামার ভিতর দিয়ে ঢুকে সর্বাঙ্গে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে।রিমঝিমের মনে হচ্ছে,তার সাথে দুষ্টু খেলা চলছে।সেই সাথে তুষারপাতও প্রবল বেগে চলছে।রিমঝিম পাশে তাকিয়ে পরোক্ষ করে দেখে নিলো অন্ধকার হয়ে এসেছে।অন্ধকার হতেই কিছুটা ঘাবড়ে গেলো।অতীত লিখতে লিখতে তার বর্তমানের কথা মনেই ছিলো না।তাড়াহুড়ো করে,কলম আর ডায়েরি টা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে পার্ক থেকে বেড়িয়ে পড়লো।ল্যাম্পপোস্টের আলোয় রাস্তা স্পষ্ট বিদ্যমান।তবে,জনমানবশূন্য।মাঝেমধ্যে কিছু গাড়ি শো শো করে চলে যাচ্ছে।একপর্যায়ে এসে রিমঝিম দৌড়তে লাগলো।যতই দৌড়চ্ছে ততই বাতাস তার খেল চালিয়ে যাচ্ছে।রিমঝিমের এখন মনে হচ্ছে,
মাতাব্বরি না করে এহসানের কাছ থেকে মাফলার টা নিয়ে নিলেই ভালো হতো।কিছুটা দূর আগাতেই রিমঝিম পা মচকে রাস্তায় পড়ে যেতে নেয়।কিন্তু তার আগেই একজোড়া হাত রিমঝিমকে সযত্নে আগলে নিলো।আচমকাই এমন হওয়ায় রিমঝিম ভয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো।পরক্ষণেই গলার পাশে ঠান্ডা ছোঁয়া অনুভব করতে চট করে চোখ দুটো মেলে তাকালো।চোখের সামনে মাজহারুল কে দেখে রিমঝিম নিজেকে কিছুটা শান্ত করলো।অত্যন্ত পরিচিত কাউকে পেয়েছে তো।আর,কিছুটা আগালেই বাসা।নিজেকে মাজহারুলের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কিছুটা দূরে সরে আসলো।মাজহারুল কড়া গলায় বলতে লাগলো,
‘এতোক্ষণ পর্যন্ত তুমি কোথাও ছিলে রিমঝিম?আংকেল,আন্টি তোমার জন্য চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছেন তা কি তুমি বুঝতে পারছো?’

রিমঝিম কিছুটা দম নিলো।ঠান্ডায় তার শরীর জমে আসছে।মাজহারুলের কথায় আমতাআমতা করে বললো,
‘আমি বুঝতে পারিনি ভাইয়া।ভুল টা আমার এই ছিলো।’

মাজহারুলের মুখটা নিমিষেই চুপসে গিয়েছে রিমঝিমের মুখে ভাইয়া ডাক টা শুনে।রিমঝিমকে একপলক দেখার জন্যই তাদের বাসায় এসেছিলো।কিন্তু,এসে যখন শুনেছে রিমঝিম বাসায় নেই,তখন সে নিজেই খুঁজতে বের হয়ে গিয়েছে।বের হওয়ার আগে জেনে এসেছে রিমঝিম ভার্সিটিতে গিয়েছিলো।তাই,অনুমান করে এই পথেই আসা।আর,ভাগ্যক্রমে রিমঝিমকে পেয়েও গেলো।মাজহারুল রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে দেখলো শীতে কাঁপছে।নিজের গলার মাফলার টা এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘এইটা পড়ে নাও রিমঝিম।শীতে তো তোমার বেহাল অবস্থা।’

রিমঝিম সামনে এগিয়ে গেলো।পকেটে হাত ঢুকিয়ে বললো,
‘নো থ্যাংকস।আমি একদম ঠিক আছি।’

মাজহারুল আর কিছু বললো না।রিমঝিমের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে লাগলো।হাঁটছে আর কিছুক্ষণ পর পর আঁড়চোখে রিমঝিমকে দেখছে।ঠান্ডায় ঠোঁট দুটো লাল হয়ে গিয়েছে।মাজহারুল ভাবছে,একটা চুমু খেলে কি রিমঝিম খুবই রাগ করবে।পরমুহূর্তেই,নিজের ভাবনার কথা ভেবে মাজহারুল নিজেই থতমত খেয়ে গেলো।নিজের মনকে কয়েকশো বকা দিয়ে রিমঝিমের সাথে এগিয়ে যেতে লাগলো।
—-
থমথমে মুখ করে অফিসের কিছু কাজ নিয়ে ডিসকাশ করছে রক্তিম।এরিমধ্যে ফোন পেয়ে নিজের বাবা সিদ্দিক আহমেদের কেবিনে ছুটে গেলো।একপ্রকার বাধ্য হয়েই যাচ্ছে।রক্তিম ভেবে পায় না তার বাবা কেনো এতো পাল্টে গিয়েছে।রক্তিম তো খুব ভরসা করতো তার বাবাকে।তবে,আজকে কি এমন কারণে সিদ্দিক আহমেদ এতোটা পাল্টে গিয়েছেন তা রক্তিমেরও জানা নেই।সিদ্দিক আহমেদ রক্তিমকে নিজের কেবিনে দেখে হেসে ফেললেন।দিনদিন এই কোম্পানির যেনো উন্নতি বেড়েই চলেছে।তারও কিছু কারণ রয়েছে।রক্তিম চেয়ার টা টেনে বসতে না বসতেই সিদ্দিক আহমেদ বলে উঠলেন,
‘তোমার বিয়ের জন্য আমি তারিনকেই চুজ করেছি।রিমঝিমকে ভুলে গিয়ে নিজেকে তৈরি করে নাও বিয়ের জন্য।’

রক্তিম চোয়াল শক্ত করে নিলো।খুব ঘৃণা হচ্ছে নিজের বাবার উপর।ভাবতেই অবাক হচ্ছে,যে মানুষ টা রিমঝিমকে বিয়ে করার সময় তাকে সাপোর্ট দিয়েছিলো আর আজকে ঠিক তার উল্টো কথা বলছে।বলছে কি না রিমঝিমকে ভুলে যেতে!রক্তিমের জন্য তা তো আদোও সম্ভব না।চেয়ারটায় মাথা এলিয়ে দিলো রক্তিম।ক্ষিপ্ত চোখে সিদ্দিক আহমেদের দিকে তাকিয়ে হিসহিসিয়ে বললো,
‘কেনো এতোটা পাল্টে গেলে তুমি বাবা!তুমি তো জানো আমি রিমঝিমকে ভালোবাসি।ও আমার অর্ধাঙ্গীনী।তার সাক্ষী কিন্তু তুমিও ছিলে।তাহলে,আজকে কেনো আমাকে জোর করছো তারিনকে বিয়ে করার জন্য।’

‘রিমঝিম তোমাকে ভালোবাসলে কখনোই তোমাকে রিজেক্ট করে রাশিয়াতে চলে যেতো না।তুমি তো গিয়েছিলে রিমঝিমের কাছে তাই না,রিমঝিম কি তোমাকে কাছে টেনে নিয়েছে!নেই নি তো।মানছি,তখন তোমার ছোট’বাবার সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়ে গিয়েছিলো,তাও আমার বারণ করা সত্ত্বেও তুমি রিমঝিমকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিলে।তবে,তার বিনিময়ে তুমি কি পেয়েছো রক্তিম?কিছুই না।তোমাকে ভুলে গিয়ে রিমঝিম দিব্বি ভালো আছে।দেখো গিয়ে নতুন কাউকে আপন করে নিয়েছে।’

রক্তিম আর শুনতে পারলো না।বুকটা ধকধক করছে।চোখে ভেসে উঠলো সেদিনের কথাগুলো।রক্তিম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।এইসব কথা শুনতে তার একটুও ভালো লাগছে।বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে।রক্তিম হাত মুঠো করে বাহিরে চলে আসলো।রক্তিম বাহিরে আসতেই সিদ্দিক আহমেদ মুচকি হাসলেন।উনি যা যা চেয়েছিলেন তা সবই হচ্ছে।এবার,রক্তিমের সাথে তারিনের বিয়ের অপেক্ষায় আছেন।মাঝেমধ্যে ব্যবসার উন্নতির জন্য,টাকার জন্য,রক্তের সম্পর্কের সাথেও সবকিছু ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিতে হয়।সিদ্দিক আহমেদ খুব খুশি!এই কোম্পানি টা তো নিজের নামে করে নিতে পেরেছেন।

ফাঁকা মাঠে রক্তিম একা বসে আছে।আজকে বুকে অসহনীয় ব্যথা অনুভব করছে।কচি কচি ঘাস গুলোকে দু’হাত দিয়ে খাঁমচে ধরে রাগ কমানোর চেষ্টা করছে।মনে মনে আওড়াচ্ছে,আমি তোকে কারোর হতে দিবো না রিমঝিম।যাই কিছু করিস না কেনো শেষ পর্যন্ত রক্তিমের মধ্যেই তুই আবদ্ধ থাকবি।
—-
খাবার টেবিলে বসে হুট করেই কেঁদে উঠলেন রক্তিমের দাদি রেহানা বেগম।রক্তিম দাদির কান্না দেখে হাতে থাকা চামচ টা ফেলে দিলো।সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রেহানা বেগমের দিকে।রক্তিমের মা জাহানারা আহমেদ শ্বাশুড়ি কে আগলে ধরলেন।শ্বাশুড়ি যে কেনো কান্না করছেন তা উনার অজানা নয়।সিদ্দিক আহমেদ কিছুটা চিন্তিত হয়ে বললেন,
‘আম্মা!হুট করে কান্না করছো কেনো।শরীর খারাপ।’

রেহানা বেগম কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
‘আমার সাদিক কেমন আছে তা আমি জানি না।কি খাচ্ছে তাও জানি না।রিমঝিমকে কতোদিন হলো দেখি না।এই কয়েকটা বছরে মনে হয় আমার নাতনী টা অনেক বড় হয়ে গিয়েছে।মানছি,বছরের সংখ্যা টা কম।তবুও তা আমার কাছে হাজার হাজার,কোটি কোটি,বছরের মতো।আমি দেখতে চাই আমার ছেলে,ছেলের বউ,নাতনী কে।তোদের এইরকম বিচ্ছেদ হবে তা আমি কোনোদিনও ভাবি নি।আমার সাজানো গোছানো সংসার টা ভেঙে যাচ্ছে।তোদের আব্বা একজন শিক্ষক ছিলেন!উনি তোদেরকে এইরকম শিক্ষা কখনো দেন নি,যার জন্য তোরা আলাদা হয়ে যাবি।ভাই ভাইয়ের সম্পর্ক শেষ করে দিবি।আজকে যদি,উনি বেঁচে থাকতেন তাহলে খুব কষ্ট পেতেন।ফিরে আসতে বল না আমার সাদিককে।আমি তাকে দেখেই মরতে চাই।’

দাদির আহাজারি শুনে রক্তিমের বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো।খাবার গলায় আঁটকে গিয়েছে।ঢোক গিলেও নামছে না।সিদ্দিক আহমেদ তিক্ত মেজাজ নিয়ে তাকালেন মা’র দিকে।ভাইয়ের আসার কথা শুনতেই মেজাজ টা বিগড়ে গিয়েছে।খাওয়া না ছেড়েই উঠে গেলেন।বিরবির করে হাজারো কথার বুলি ফুটিয়ে চলে গেলেন নিজের রুমে।জাহানারা আহমেদ অদূরে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন।সামনে কি হতে চলেছে তা উনার জানা নেই।তবে,খুব করে চাচ্ছেন সব যেনো আগের মতো হয়ে যায়।
—-
বিছানায় হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে রিমঝিম।হাতে উইলিয়াম শেকসপিয়ারের সেই বইটা।গলা অবধি কম্বল টানা।বই টায় কিছুতেই মন বসাতে পারছে না।অগোছালো মন নিয়ে কিছুই করতে ভালো লাগে না।হঠাৎ করেই পাশের সাইড বক্সে রাখা ফোন টা বেজে উঠলো।ফোনের স্ক্রিনে তনায়ার নাম টা দেখে রিমঝিম খুশি হয়ে গেলো।দ্রুত গতিতে ফোন টা কানে চেপে ধরলো।কৌতূহল নিয়ে বললো,
‘তনায়া আপু রিপোর্টে কি এসেছে?আমার ধারণা ঠিক তো।’

তনায়া হেসে ফেললো।চোখে তার পানি।পাশেই বাবু শুয়ে আছে।তারও চোখে পানি বিদ্যমান।প্রথম বাবা হওয়ার অনুভূতি।তনায়া চোখের পানিটুকু মুছে নিয়ে বললো,
‘তোর ধারণা একদম ঠিক রিমঝিম।তুই খালামনি হবি।’

রিমঝিম ইয়াহুহু বলে জোরে চিল্লিয়ে উঠলো।এমতাবস্থায় বললো,
‘বাবু হলে আমাকে আগে ছবি পাঠাবে কিন্তু।আগে থেকেই বলে দিলাম আমি।’

‘সবেমাত্র তিন মাস রিমঝিম।আরো কতদিন বাকি আছে।’

‘তাও!আমাকেই আগে ছবি পাঠাবে।’

তনায়া মন খারাপ করে বললো,
‘তুই কি আমার বাবুকে নিজের চোখে দেখবি না রিমঝিম।একটুও কি ছুঁয়ে দেখবি না।এতো অভিমানী হয়ে গেলি।চলে আয় না বাংলাদেশে রিমঝিম।’

রিমঝিম আমতাআমতা করে বললো,
‘তনায়া আপু মা ডাকছে।পরে কথা হবে।আর,তুমি সাবধানে থেকো।’

রিমঝিম তাড়াহুড়ো করে ফোন টা কেটে দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো।সে আর বাংলাদেশে ফিরে যেতে চায় না।রাশিয়েতেই ভালো আছে।অন্যদিকে,,,রিমঝিম ফোন রেখে দিতেই তনায়া বাবুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।বাবু বুঝতে পারছে তনায়ার মনের অবস্থা।কারণ,প্রতিবারই রিমঝিমের সাথে কথা বলার পর কেঁদে ভাসায়।
চলবে..

#pic:Collected

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here