প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব -০১+২

খালাতো বোনের বিয়ে খেতে এসে আকস্মিকভাবে নিজের বিয়ে হবে যাবে তা কস্মিনকালেও ভাবতে পারে নি ধারা। এখনো যেনো সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে। বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সম্মুখে বসে থাকা অতিউৎসাহী মানুষদের দিকে। তাদের মুখে এতোটুকু অনুশোচনা নেই। একটি মেয়েকে জো/র/পূ/র্ব/ক বিয়ে দেওয়া হয়েছে অথচ তাদের আহ্লাদের সীমা নেই। অবশ্য জো/র/পূ/র্ব/ক কথাটি সম্পূর্ণরুপে ভুল। তারা মোটেই ধারাকে জো/র করে নি, করেছে ইমোশনাল ব্লা’ক’মে’ই’ল। কথাটা ভাবতেই হৃদয়ের অন্তস্থলে তিতকুটে অনুভূতিটা মাথাচড়া দিলো। এমনটা তো হবার কথা ছিলো না। খালাতো বোন আফিয়ার বিয়েতে বউ যাত্রী হয়ে এসেছিলো সে। অথচ আজ নিজের ই বিয়ে হয়ে গেলো।

ঘটনার সূত্রপাত হয় চারদিন আগে। বিয়ের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছিলো, হুট করেই ধারার নানাভাই জামাল আহমেদ বুক চেপে ধরেন। প্রচন্ড ব্যাথায় তার মুখ নীলাভ বর্ণ ধারণ করে। ছটফট শুরু করেন তিনি। অবস্থার অবনতি দেখে ধারার বড় মামা রাজ্জাক আহমেদ তাড়াতাড়ি প্বার্শবর্তী হাসপাতালে তাকে ভর্তি করান। বাড়ির সকলের মুখ থমথমে। শুভ অনুষ্ঠান না কালো প্রহরে পরিণত হয়! করিডোরে থমথমে মুখে বসে ছিলো ধারা। হৃদয়ের ভীষণ প্রিয় নানাভাইকে অসুস্থতা তাকে ভেতর থেকেই দূর্বল করে দিচ্ছিলো। ঘণ্টাখানেক বাদে ডাক্তার বের হন, তিনি জানান,
“উনার অবস্থা এখন মোটামুটি ভালো। ব্যাথা প্রশমিত করতে ঔষধ দিয়েছি। তবে আমার মনে হয় উনার হার্ট এট্যাক হয়েছে। কিছু টেস্ট দিয়েছি, রিপোর্ট আসলে বলতে পারবো”

ডাক্তারের কথায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন রাজ্জাক সাহেব। বয়স সত্তরের গোড়ায় হলেও বাবা তার যথেষ্ট স্বাস্থ্যসচেতন। দৃষ্টি খানিকটা ক্ষীণ ছাড়া তেমন কোনো রোগ-ব্যাধি জামাল সাহেবের নেই। সঠিক সময় ভোজন এবং নিয়মিত হাটাচলা করাই তার স্বভাব। সেখানে এতো বড় রোগ তার শরীরে জন্ম নিয়েছে, অথচ ছেলে হিসেবে তার এই সম্পর্কিত জ্ঞান নেই। বেশ ভেঙ্গে পড়লেন তিনি। নিজেকে একজন ব্যর্থ ছেলে মনে হতে লাগলো। এর মাঝেই নার্স জানিয়ে যায় জামাল সাহেব নিজের পরিবারের লোকেদের সাথে দেখা করতে চায়। প্রথমে রাজ্জাক সাহেব এবং সুভাসিনী বেগম ভেতরে গেলেন। মিনিট পনেরো বাদে থমথমে মুখে বের হলেন। গম্ভীর রাশভারি কন্ঠে বললেন,
“বাবা অনল এবং ধারার সাথে দেখা করতে চান”

অনল ধারার মামাতো ভাই। সে রাজ্জাক সাহেব এবং সুভাসিনী বেগমের একমাত্র ছেলে এবং জামাল সাহেবের বড় নাতী। তৃতীয় প্রজন্মের বড় ছেলে বিধায় এই বাড়িতে তার দাপট ও বেশ কড়া। হবে নাই বা কেনো! সর্বদা ভালো ছাত্রের ট্যাগ যে লাগানো। শুধু তাই নয় সুদর্শন পুরুষ হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা আছে ধারার বান্ধবী মহলে। কেউ কেউ তার জন্য প্রেমপত্র লিখেছে। কিন্তু সে নির্বিকার চিত্তে তা প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে। তার মনে কেউ তার যোগ্য নয়। ধারার ঠিক কারণেই লোকটিকে অপছন্দ। নিজেকে যথারীতি প্রিন্স উইলিয়াম ভাবা ব্যাক্তিটি সর্বদাই যেনো তার উপর নিজের আধিপত্য খাটাতে চায়। ধারা আড়চোখে অনলের দিকে তাকালো। লোকটি যেনো নির্বিকার। মোবাইলটা পকেটে পুরেই দাদার কেবিনের দিকে পা বাড়ালো সে। ধারাও একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস গোপন করে পিছু নিলো তার। কেবিনে প্রবেশ করতেই শুভ্র বিছানায় শায়িত নানাভাইকে দেখে নিজেকে আটকাতে পারলো না ধারা। প্রিয়মানুষটিকে হারানোর অনুভূতি হুল্লোড় করলো। ধারা ছুটে গেলো দাদার কাছে। সে চায় না মায়ের মতো দাদাকেও হারাতে। নানাভাই নিস্প্রভ হাসি একে বললেন,
“কি গো ধারারানী, কান্দো নাকি! কাইন্দো না! সবার ই তো যাইতে হয়”
“এসব কথা না বললে নয় দাদাজান? আপনি যথেষ্ট ফিট। ইনশাআল্লাহ কিছু হবে না”

নির্লিপ্ত স্বরে কথাটা বললো অনল। ক্ষীন বিরক্তিও ছিলো। তাকে বিচলিত দেখালো না। অপরদিকে ধারার কেঁদে কেটে একসার। আর তার কান্না যেনো অনলের বিরক্তির উৎস। এবার বেশ আবেগী কন্ঠে জামাল সাহেব বললেন,
“আমার ম/র/তে ভয় নেই। শুধু একখান চিন্তাই দূর্বল করে দিচ্ছে৷ আমি চলে গেলে আমার ধারারানীর কি হইবো?”
“নানাভাই, এভাবে বলবেন না”

জড়ানো কন্ঠে ধারা কথা বলছে, কাঁদতে কাঁদতে তার হিচকি উঠবার জোগাড়। এদিকে ভ্রু কুচকে উঠে অনলের। সে খানিকটা বিস্মিত স্বরে বলে,
“ধারার কি হবে! ও তো বানের জলে ভেসে নেই। এতোকাল যেমন আমাদের কাছে থেকেছে আজ ও তাই থাকবে”
“তুমি বোঝো না অনল, এতোকাল ওর বাপ আমার উপরে কথা কইতে পারে নি। তাই ওরে নিতে পারে নি। কিন্তু আমি ম’র’লে ও হয়ে যাবে লাগাম ছাড়া ষা’ড়। জো’র করে ধারারানীকে লয়ে যাবে। আর তুমি কিছু করতেও পারবা না। ধারারানী ওই মহিলার কাছে থাকতে পারবে না। আমার ভাইবেই মন বইসে যায়। তাই আমি একখান সিদ্ধান্ত নিছি। ধারারানী, আমারে তুমি ভালোবাসো না?”
“খুব খুব, ভালোবাসি নানাভাই”
“তাইলে আমার এক খান কথা রাখবা? নানাভাই কে শেষ কথা”
“আপনি যা বললেন তাই রাখবো”
“তাইলে তুমি অনলরে বিয়া করবা। কথা দাও, তোমাদের সুখী সংসার দেখে ম’ই’রেও শান্তি পাবো”

কথাটা বজ্রপাতের মতো ঠেকলো ধারার কাছে। স্নায়ুকোষ কাজ করা বন্ধ করে দিলো। কথাটা মস্তিষ্কে পেন্ডুলামের ন্যায় ঘুরতে লাগলো। বিমূঢ় কন্ঠে বলে উঠলো,
“জ্বী?”
“এইটাই একমাত্র উপায়। তোর বাপ আজ কখনো তোরে জো’র করতে পারবো না। আর রাজ্জাকের ও জো’র থাকবে। তার ভাগনীরে নিতে পারবে, পুত্রবধুরে না”
“অসম্ভব”

জামাল সাহেবের কথার তীব্র প্রতিবাদ জানালো অনল। ক্ষীন কন্ঠে বলে উঠলো,
“পা’গ’ল নাকি! ধারা আর আমি, অসম্ভব। আমি এই বিয়ে করবো না। আমাদের বয়সের ডিফারেন্স দেখেছেন। ও কেবল উনিশে পা রেখেছে। আর এদিকে আমি আঠাশ। এতো বয়সের ডিফারেন্সে বিয়ে করা অসম্ভব। উপরন্তু ও এখন কেবল ভার্সিটিতে উঠেছে। বিয়ে করে সংসার করার থেকে ওর এখন পড়াশোনা করা বেশি জরুরি। আর আপনার নাতনীর মতো একটা স্টু’পি’ড মেয়েকে বিয়ে করে নিজের জীবনের জ্বলাঞ্জলি দেবার ইচ্ছে নেই। আমি এসব আবদার মানতে পারবো না। আপনি রেস্ট নেন৷ ইনশাআল্লাহ আপনার কিছু হবেও না”

বলেই হনহন করে বেড়িয়ে গেলো অনল। অনলের স্টু’পি’ড কথাটা কর্ণপাত হতেই কান গরম হয়ে গেলো ধারার। অন্যসময় হলে চার কথা শুনিয়ে দিতো। কিন্তু অবস্থা অনুকূলে নেই। তাই চুপ থাকাই শ্রেয়। উপরন্তু সে যে মূর্তি রুপে সে বের হয়েছে তাতে বিয়ে হবে না। তাই মূহুর্তে উঠা রাগ জল হয়ে গেলো। অপরদিকে জামাল সাহেব নাতির ঝাড়ি খেয়ে চুপ মেরে গেলেন। ধারা স্মিত হেসে বললো,
“নানাভাই, ঘুমান। আমি আসছি”

ধারা ভেবেছিলো বিয়ের ফাড়াটা হয়তো কেটে গেছে। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করলেন জামাল সাহেব। তিনি কঠোর প্রতিজ্ঞা নিয়েছেন, বিয়েটা দিয়েই ছাড়বেন। জামাল সাহেবের রিপোর্ট এলো, হার্টে ব্লক ধরা পড়লো। এই বয়সে অপারেশন করা অসম্ভব। অপারেশনে মৃ’ত্যু ঝুকি আছে বিধায় ডাক্তার মানা করে দিলেন। এদিকে জামাল সাহেব ছেলে ও ছেলের বউ এর উপর আবেগী অত্যাচার চালান। ফলে তার দলে রাজ্জাক সাহেব এবং সুভাসিনী বেগম আবেগের তাড়নায় তার দলে ভিড়লেন। অনল অবিচল, সে বিয়ে করবেই না। কিন্তু বিধিবাম, জামাল সাহেবের আবার বুকে ব্যাথা শুরু হলো। ডাক্তার ও তাকে চিন্তামুক্ত রাখতে নির্দেশ দিলেন। ফলে সত্তর বছরের বৃদ্ধের জিদের সামনে হেরে গেলো আঠাশ বছরের যুবকের নীতি। বাধ্য হয়ে নিজ বধুরুপে গ্রহণ করতে হলো ধারাকে। একই মঞ্চে বিনা নোটিশে বিয়ে হয় আফিয়ার এবং অনল ধারার। এখন লাল বেনারসী পড়ে ঘোমটা দিয়ে ফুলসজ্জিত বিছানায় বসে রয়েছে সে। তাও এমন এক ব্যাক্তির প্রতীক্ষায় যাকে দু চোখে সহ্য হয় না।

ধারার বড় মা সুভাসিনী বেগম প্রসন্নমুখে ঘরে প্রবেশ করলো। ধারা টলমলে দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। তিনি ধারার মনোস্থিতি ঠাহর করতে পারলেন হয়তো। সবাইকে বের হতে বললেন কয়েক মূহুর্তের জন্য। তারপর ধারার পাশে বসলেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম স্বরে বললেন,
“রাগ করেছিস বড় মার উপর?”
“হু, খুব রাগ করেছি। কেনো করলে তোমরা এমন? এভাবে ইমোশনাল ব্লা’ক’মে’ই’ল কেনো করলে?”
“কি করবো বল, বাবার শরীরটা তো ভালো নেই। তার ইচ্ছের দামটুকু যদি না দিতে পারি সারাজীবন দায়ী থেকে যাবো। আর সত্যি বলতে, আমিও মনে মনে চাচ্ছিলাম যেনো তুই আমাকে ছেড়ে কোথাও না যাস। তোকে বিয়ে দেবার কথা ভাবলেই বুক কাঁপতো। তাই অমত করলাম না। জানি আমার ছেলেটা একটু দাম্ভিক, একটু তেতো স্বভাবের। কিন্তু ও তোকে খুব সুখে রাখবে দেখিস! আচ্ছা তুই খুশি নস, আমার কাছেই সারাজীবন থাকবি”

বড়মার আবেগী স্বরে বলা কথাটার সম্মতি না দিয়ে পারলো না। ধারার বয়স তখন কেবল ছয় যখন তার মা সুরাইয়া বেগম ইন্তেকাল করেন। তখন থেকেই নানাবাড়িতে তার বেড়ে উঠা। মায়ের মৃ’ত্যুর পর অনাথ ধারাকে সামনে বসে থাকা নারীটি মাতৃস্নেহে মানুষ করেছে। তাই তাকে কষ্ট দেবার কথা ভাবতেই অস্থিরতা সৃষ্টি হয় ধারার মাঝে। মনে হাজারো অভিযোগ থাকলেও কিছুই বলে না সে। সুভাসিনী বেগম ধারার ললাটে চুমু একে বলেন,
“চিন্তা করিস না, ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে”

সুভাসিনী বেগমের প্রস্থানের পর ডুকরে উঠে ধারা। অনুভূতিগুলো লাগাম ছাড়া হয়ে যায়। কিশোরী হৃদয়ের মাঝে যে প্রণয়ের অঙ্কুরোদগম হয়েছিলো তা এখন পরিস্ফুটিত হয়ে ফুটন্ত গোলাপের রুপ নিয়েছে। সেখানে অনলের আগমন সে ফুলটিকে ঝড়িয়ে দিতে সক্ষম। এই অযাচিত সম্পর্কটিকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ধারা৷ মুখশ্রীতে হাত দিয়ে কিছুসময় কাঁদে সে। ভাগ্যের এমন প্রহেলিকায় যেনো নিজেকে অসহায় লাগছে ধারার, বড্ড অসহায়!

সময় অতিবাহিত হতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছে টেরটিও পায় নি। সেই বেনারসী, সেই সাজেই বিছানায় উপর হয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো সে। অবশ্য ঘুমাবে নাই বা কেনো, এই চারদিন বিয়ের টেনশনে এক বিন্দুও ঘুম হয় নি। ধারার মনে হচ্ছিলো এসব একটা বিশ্রী দুঃস্বপ্ন হলে মন্দ হতো৷ ঘুম থেকে চোখ খুলতেই দেখবে সব মিথ্যে, কিছুই ঘটে নি। কিন্তু তা হলো না। তন্দ্রা কাটতেই ধাতস্থ হলো, সে ভারী কিছুর উপর শুয়ে আছে। চোখ না খুলেই হাতড়ালো কিছু সময়। কিন্তু বুঝতে পারলো না এটা কি বিছানা নাকি মেঝে। তখন ই শীতল কন্ঠ কানে এলো,
“স্পর্শ করা শেষ হলে হাতটা সরা”

শীতল কন্ঠ কর্ণপাত হতেই ঘুম পেছনের জানালা দিয়ে পালালো। শিরদাঁড়া বেয়ে হীম বয়ে গেলো। তড়াক করে চোখ খুললো ধারা। চোখ খুলতেই দেখলো যাকে সে মেঝে ভাবছিলো সেটা ছিলো অনলের বলিষ্ঠ বুক…………
#প্রণয়_প্রহেলিকা
#২য়_পর্ব

তন্দ্রা কাটতেই ধাতস্থ হলো, সে ভারী কিছুর উপর শুয়ে আছে। চোখ না খুলেই হাতড়ালো কিছু সময়। কিন্তু বুঝতে পারলো না এটা কি বিছানা নাকি মেঝে। তখন ই শীতল কন্ঠ কানে এলো,
“স্পর্শ করা শেষ হলে হাতটা সরা”

শীতল কন্ঠ কর্ণপাত হতেই ঘুম পেছনের জানালা দিয়ে পালালো। শিরদাঁড়া বেয়ে হীম বয়ে গেলো। তড়াক করে চোখ খুললো ধারা। চোখ খুলতেই দেখলো যাকে সে মেঝে ভাবছিলো সেটা ছিলো অনলের বলিষ্ঠ বুক। সে এতোসময় অনলের বুকের উপর ঘুমাচ্ছিলো। মাথা তুলতেই অনলের গভীর কালো নয়নে আটক হলো তার নয়নজোড়া৷ শান্ত অথচ সুগাঢ় দৃষ্টি হৃদয়ের অন্তস্থলে এক অসহ্য অনুভূতি ডানা মিললো৷ কিশোরী হৃদয়ে শিহরণ জাগালো। এই প্রথম কোনো পুরুষের এতোটা সন্নীকটে এসেছে সে। এ যেনো এক না বলা অনুভূতি। কোমল গালজোড়ায় রক্ত জমলো, ধীরে রক্তিম হয়ে উঠলো। অনলের সুগভীর নয়নে তাকিয়ে থাকার সাহস হলো না। তড়িৎ গতিতে সরে পড়লো সে। বিছানায় অপর কোনায় গুটিসুটি মেরে বসলো। দৃষ্টি মেঝেতে নিয়ে গেলো। অনল ও উঠে বসলো। তার মনোস্থিতি ঠাহর করা দুষ্কর। শ্যাম মুখশ্রীটা নির্বিকার বরাবরই। ধারার মনে হয়, মানুষের মুখশ্রী তার মনের দর্পন। এই বাক্যটি খাটে না কেবল অনলের ক্ষেত্রে, কারণ তার মুখশ্রী দেখে মনের ছিটাফোঁটাও বোঝা যায় না। ডান্ত চাহনী, নির্লিপ্ত ভঙ্গিমা। অবিচল, অনড় অনল। ধারা আড়চোখে একবার চাইলো তার বরটির দিকে। অন্যদিকে তাকিয়ে রয়েছে, বেশ ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। হয়তো এতোটাসময় ধারাকে বুকে নিয়ে রেখেছে বিধায় কষ্ট হয়েছে। কিন্তু একটা ব্যাপার ধারার কিশোরী মনে প্রশ্ন সৃষ্টি করলো, অনল ভাই এর কানজোড়া কেনো রক্তিম দেখাচ্ছে! তার কি কানে ব্যাথা! নাকি আজ বিয়ের দিন ও বড়মা তার কান মুলেছে! প্রশ্নটা মুখ ফসকে বের হতে যেয়েও হলো না। কারণ প্রিন্স উইলিয়ামকে এখন চটানো যাবে না! এর থেকেও কঠিন প্রশ্ন তাকে করতে হবে। সে প্রশ্ন হলো বৃহৎ প্রশ্ন দশ মার্কের। এই এক দু মার্কের প্রশ্ন করার মানেই নেই। অনল মুখ গোল করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ঈষৎ বিব্রত স্বরে বললো,
“তুই এখানে ঘুমা, আমি বাহিরে যাচ্ছি। ওরা কেউ নেই বাহিরে। এখন বাহিরে গেলে সমস্যা হবে না। সব কয়টা হয়েছে মীর জাফর। আমাকে পাহারা দেওয়ার জন্য দাদাজানের কাছে ঘু’ষ খেয়েছে। ভালো লাগে না। যার বিয়ে তার হুশ নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই।”

অনল উঠে দাঁড়ালো। সাদা পাঞ্জাবীর হাতাটি কনুই অবধি ঘোটালো। এলোমেলো অবিন্যস্ত চুলগুলো বা হাত দিয়ে টেনে পেছনে নিলো। বিছানার পাশের টেবিলে অবিহেলিত ভাবে রাখা মানিব্যাগ এবং সিগারেটের প্যাকেটটা পকেটে পুরে বাহিরের দিকে পা বাড়াতেই ধারা থমথমে স্বরে বলে উঠলো,
“কেনো বিয়েতে রাজী হলে তুমি অনল ভাই? তুমি না বলেছে এই বিয়ে তুমি করবে না। তাহলে কেনো রাজী হলে?”
“ধারা সারাদিন খুব ক্লান্তি গেছে। আমরা এসব নিয়ে কালকে কথা বলবো। তুই রেস্ট নে”

বেশ শান্ত এবং ধীর কন্ঠে কথাটা বললো অনল। সে মোটেই এখন এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছে না। দাদাজানের ইমোশনাল ব্লা’ক’মে’ই’ল এর কাছে পরাজিত হবার পর অনাকাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যত নিয়ে তার ভাবতে ইচ্ছে হয় নি। সে সত্যি জানে না অদূর ভবিষ্যতে তার এবং ধারার পরিণয়ে প্রণয়ের ছাপ থাকবে কি না। নাকি কেবল প্রহেলিকা হয়েই থেকে যাবে এই বিয়েটুকু। ধারার কিশোরী মনটি যে এখনো অবুঝ। অনলের উত্তরটি ধারাকে শান্ত করার বদলে আরোও অস্থির করে তুললো। ভেতরের জমায়িত অভিমানগুলো ক্রোধের রুপ নিলো। চুপ করে সহ্য করা সম্ভব হলো না। বিদ্রোহ করে উঠলো কিশোরী ধারা। অভিমানী স্বরে বললো,
“কাল কেনো! আমার আজ ই বিহিত চাই। নানাভাই এর সামনে তো খুব বলছিলে আমার মতো স্টু’পি’ড মেয়ের জন্য জীবন জ্বলাঞ্জলি দিতে পারবে না। সেই সিদ্ধান্তের কি হলো! নাকি বিয়ের পর মত বদলে নিয়েছো? এক দিনেই মন বদলে গেলো নাকি। আমি এই বিয়ে মানি না, পারবো না আমি এই অযাচিত সম্পর্ক বয়ে নিতে। অনল ভাই আমার ও ইচ্ছে আছে, পছন্দ আছে। নানাভাই বৃদ্ধ মানুষ সে না হয় বুঝে নি। কিন্তু তুমি! তুমি কি করে পারলে? আমার জীবনটাকে নিয়ে জু’য়াখে’লা খেলতে একবারও বিবেকে বাধলো না। তুমি নাকি অতিশিক্ষিত মানুষ! তোমার মতো বিচক্ষণ মানুষ আর হয় না! কি হলো সে সবের? কেনো এমনটা করলে তুমি! নাকি আমার সাথে শোধ তুলতে করলে এমনটা! তোমাকে বিরক্ত করার শোধ! আমি উত্তর চাই অনল ভাই! উত্তর দেও। এখন দিবে, আজ ই দিবে”

অনল এতোসময় হাতমুষ্টিবদ্ধ করে শুনছিলো। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। সারাদিনের ধকলে শরীর এবং মন উভয় ই ক্লান্ত। তার মাঝে এই তীক্ষ্ণ প্রশ্নগুলো যেনো শান্ত মস্তিষ্কে আগুন ধরিয়ে দিলো। শান্ত অনল অগ্নিমূর্তি ধারণ করলো। পেছনে ঘুরেই ঝুকে দাঁড়ালো ধারার দিকে। ধারার চোখে চোখ রাখলো। অনলের এমন কাজে খানিকটা ভড়কালো ধারা। ঈষৎ কেঁপে উঠলো সে। অনলের জ্বলন্ত চোখজোড়ার তাকাতেই গলাটা শুকিয়ে গেলো ধারার। কিন্তু সেদিকে অনলের ভ্রুক্ষেপ হলো না। তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“তোর কি মনে হয়, আমি তোকে ভালোবাসি? আমার বুকের মধ্যখানে তোর জন্য অনুভূতিরা জোয়ার আনে? আমার বদ্ধ মস্তিষ্কে তোর নামের সুপ্ত আবেগ আছে! যা প্রতিনিয়ত আমি লালন করি পরম যত্নে! আত্মজেদি, দাম্ভিক মানুষের মাঝে যে র’ক্ত’মাং’সের হৃদযন্ত্রটা তা তোর জন্য স্পন্দিত হয় প্রতিক্ষণ। স্পন্দনগুলো বেসামাল হয়ে যায় তোর জন্য! তোর তাই মনে হয়?”

ধারা বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অনলের দৃষ্টির দিকে। শান্ত দিঘীর মতো চোখজোড়া জ্বলছে, ছাই ছাপা আগুনের মাঝে জ্বলন্ত সেই কয়লাটির মতো জ্বলছে। ধারা উত্তর দিলো না। তবে এক তীক্ষ্ণ হাহাকার করে উঠলো ভেতরটা। অনল সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ক্রোধ সংবরন করলো বড় বড় শ্বাস ছেড়ে। তারপর শীতল কন্ঠে বললো,
“তোর যেমন হাতপা বাঁধা, আমারো। দাদাজানের শরীর খারাপ। সে অসুস্থতাকে ঢাল বানিয়েছে। আর সত্যি বলতে তোকে সে মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসে। আমি চাই না, তোর জন্য অযথা চিন্তা করতে করতে সে অসুস্থ হোক। আমি চাই না, বেলাশেষে একজন ব্যর্থ নাতীর ট্যাগ মাথায় নিতে। তার কিছু হলে নিজের কাছে অপরাধী হয়ে যাবো। আর বাকি রইলো এই বিয়ে। আমি আমার সর্বস্ব দিবো, যেনো তোর কোনো অসুবিধা না হয়। আমার পক্ষ থেকে কখনোই কোনো অসুবিধা হবে না। তুই আমার স্পেস এ প্রবেশ করবি না। আমিও তোর স্পেসে যাবো না। এতোকাল যেমন ছিলাম সেভাবেই থাকবো। এই সম্পর্কটার শেষ বাক্য বলার অধিকার শুধু তোর। কথা দিলাম”

ধারাকে কোনো উত্তর দেবার সুযোগটি দিলো না অনল। হনহন করে বেড়িয়ে গেলো সে। নীরব আঁধারে বসে রইলো ধারা। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে উঠলো পরিবেশ। নিবিড় নিস্তব্ধতা বিরাজ করলো ঘরটিতে। ধারা উঠে দাঁড়ালো জানালার কাছে। আকাশ দেখা যাচ্ছে। আজ চাঁদটাও গা ঢাকা দিয়েছে বিক্ষিপ্ত কালো মেঘের আড়ালে। এক হাহাকার বিদ্ধমান। হাহাকারটি কি তার হৃদয়ে নাকি প্রকৃতিতে জানা নেই। তবে চোখ গুলো শান্ত রইলো না। বিষাদসিন্ধু উপচে উঠলো। অনলের কথাগুলো অবিবেচকের মতো ন্যায়। তবুও কেনো যেনো অশান্ত হয়ে উঠলো নিবৃত্ত চিত্ত। মানুষটি সত্যি প্রহেলিকা, যাকে বোঝাই দায় হয়ে উঠেছে তার সাথে সারাটিজীবন কি করে পার করবে ধারা, জানা নেই। কিছুই জানা নেই_______

পরদিন ধারার ফোলা চোখমুখের জন্য হাজারো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো সুভাসিনী বেগমের কাছে। কিন্তু কোনো উত্তর দিতে পারলো না। চুপ করে খাবার টেবিলে বসলো সে। সেখানে অনলের মুখোমুখি হলো। তারও মুখশ্রীতে বিষন্নতার ছাপ পেলো, নির্ঘুম রক্তিম চোখ জোড়া নামিয়ে রাখলো সে। অপরদিকে জামাল সাহেবকে দেখা গেলো অতিপ্রসন্ন। কে বলবে তার চার দিন আগে হার্ট এট্যাক হয়েছিলো। তিনি দিব্যি রুটিতে ভাজি পুরে খাচ্ছেন৷ অবশ্য চিন্তা না থাকলে সবাই ই সুস্থ থাকে। এই দুশ্চিন্তাই সকল রোগের উৎস। নাস্তার টেবিলে সকলে বসলে অনল থমথমে গলায় বলে উঠে,
“আমাদের আজ ঢাকা যেতে হবে। তোমরা জানো আমার নতুন চাকরি। আগামীকাল জয়েন না হলে বিপদ হবে। এই বিয়ের অজুহাতে অহেতুক এক সপ্তাহ পিছিয়েছি। উপরন্তু ধারার ও ক্লাস আছে। এভাবে অফ দিলে ফেল মারবে নিশ্চিত। তাই বিয়ের যেহেতু সব অনুষ্ঠান শেষ তাই আমাদের ঢাকা যাওয়া উচিত”
“বৌভাত ছাড়া বিয়ে হয়? আফিয়ার পরশু বৌভাত। আর তোদেরটাও তাও বাকি”

সুভাসিনী বেগমের কথা শেষ না হতেই অনল বাধ সাধলো। হিনহিনে স্বরে বলে উঠলো,
“আর কতো? ফাজলামির লিমিট থাকা উচিত। দাদাজানের অসুস্থতার কথা ভেবে বিয়ে করেছি বলে তোমরা আমাদের নিয়ে সার্কাস শুরু করবে সেটা তো মানতে পারবো না। প্লিজ এবার রেহাই চাই। এবার ক্ষান্ত হও। প্লিজ। হাত জোর করছি”

অনল কথাটা বলেই হনহন করে ভেতরে চলে যায়। নাস্তার টেবিলে এক অস্থির নীরবতা নেমে আসে। জামাল সাহেব অপরাধী নজরে তাকিয়ে থাকেন নাতোর যাবার পানে। জিদ দেখিয়ে কি ভুল করে ফেললেন! প্রশ্ন উঁকি দিতেই জেদী অন্তরাত্না প্রতিবাদ করলো। যা করেছেন নাতী-নাতনীর খুশির জন্য করেছেন, ওরা এখন না বুঝলেও একদিন ঠিক বুঝবে। অপরদিকে ধারা চিন্তিত হয়ে উঠলো। চিন্তার কারণ ভার্সিটি, বিয়ে খেতে এসে নিজের বিয়ে হয়ে যাবার মতো নাটকীয় ঘটনাটি প্রকাশ পেলে বন্ধুমহলে নিউজ হয়ে যাবে সে। বিশেষ শিরোনাম হবার ভয়টা তাকে প্রচন্ডভাবে নাড়িয়ে দিলো। আরোও একটি ভয় ও মাথাচড়া দিয়ে উঠলো। সাথে সাথে প্রচন্ড তিতকুটে একটা যন্ত্রণা অনুভূত হলো। যন্ত্রণাটির নাম জানা নেই ধারার_______

ভার্সিটির কৃষ্ণচূড়া গাছটা নুয়ে পড়েছে। স্বর্ণালী সকাল, লাল কৃষ্ণচূড়া, নীল অম্বর, মৃদু বাতাস— এ যেনো কবির লেখা কোনো কবিতার পটভূমি। এতো সৌন্দর্যের মাঝেও এক মনরাখাপ বিরাজমান। বিষন্নতা যেনো সৌন্দর্যকে আরোও ভয়ানক সুন্দর করে তোলে। কিন্তু ধারা উপেক্ষা করলো এই সৌন্দর্য্য। ব্যাগটা শক্ত করে ধরে এলোমেলো পায়ে সে হাটছে ক্লাসের দিকে। ঘুমহীন আরোও একটি রাত কাটলো, তাও আবার অনলের ঘরে। যে ঘরটিকে বা’ঘে’র ডেরা মতো মনে হতো সেই ঘরে ঘুম না আসাটাই স্বাভাবিক৷ আরোও একবার নানাভাই এর জন্য ধারাকে অনলের ঘরেই যেতে হলো। একই বিছানায় থেকেও যেনো তাদের মাঝে ছিলো ক্রোশের মতো দূরত্ব। ঘুমহীন রাতটি শেষ হলেই যেনো বাঁচে সে। পূব আকাশে রক্তিম সূর্যটি নিজের অস্তিত্বের জানান দিতেই উঠে পড়লো ধারা। তারপর নিজ ঘরে প্রস্থান করলো। ঘুমন্ত অনল টের পেলো কি না কে জানে। তারপর নয়টা বাজতেই চলে এলো ভার্সিটিতে। নানাভাই এর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায় না সে। ক্লাসে আসতেই মাহির দেখা মিললো। ধারার ভালো বান্ধবী বিধায় দুজনের মাঝে বেশ সখ্যতাও আছে। মাহি হুট করে প্রশ্ন ছুড়লো,
“কি রে বিয়ের কি অবস্থা?”

প্রশ্নটি শুনেই বেশ চমকে উঠলো ধারা। ওরা কি জেনে গেছে! মাহি তখন বললো,
“আরে আফিয়া আপুর বিয়ে”

ধারা যেনো হাফ ছাড়লো। ছোট একটা “হু” বলেই বসলো বেঞ্চে। ধারার বিষন্নতা ভাবালো খুব মাহিকে। কিন্তু সে ঘাটালো না। উল্টো বললো,
“আজ আমাদের নতুন স্যার আসবে। আবদুল্লাহ স্যার তো কানাডা চলে গেলেন। উনার হাফ কোর্স নতুন লেকচারার পূরণ করবে। মেয়েরা বলছিলো না কি বেশ সুদর্শন। তুই দেখেছিস?”

মাহির কথাগুলো যেনো বাস্পের মতো উড়ে যাচ্ছে। ধারার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে নিজের বিবাহবিভ্রাটের সত্যতা নিয়েই চিন্তিত৷ এর মাঝেই দশটা বাজলো। আজকের দিনের মতো ক্লাস শুরু হলো। নতুন স্যারের আগমন ঘটলো। নতুন স্যার প্রসন্ন চিত্তে বললেন,
“গুড মর্নিং”

কিন্তু গুড মর্নিংটি ধারার চিন্তার জোয়ারে আঘাত হানলো। বাস্তবে ফিরতেই দারুণ বিস্ময় তাকে ঘিরে ধরলো। যথারীতি তার মাথায় বজ্রপাত হলো। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকলো সামনের মানুষটির দিকে। অস্পষ্ট স্বরে মুখ থেকে অজান্তেই বের হলো,
“অনল ভাই”…….

চলবে

[ক্ষীন বিলম্বের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। ইনশাআল্লাহ পরবর্তী পর্ব আগামীকাল দিবো]

মুশফিকা রহমান মৈথি
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here