গোধুলীর শেষ প্রহরে পর্ব -১৭

#গোধুলীর_শেষ_প্রহরে
#পর্বঃ১৭
#রাউফুন (ছদ্মনাম)

কলেজ থেকে বাড়ি ফিরেই কুহুর মাথাটা আগুনের মতো গরম হয়ে উঠলো। ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছে সুপ্রিয়। ক্যাবলার মতো দাঁত বের করে হাসছে ওই সুপ্রিয় নামের তার অত্যন্ত অপ্রিয় ব্যাক্তি। সাথে শাম্মী আন্টিও আছেন দেখছি। কুহু আর মুহু দুজনেই বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। কোনো কথা কেউই বলে নি। কুহু সোজা চলে গেলো রান্না ঘরে মা’য়ের কাছে। আর মুহু চলে গেলো ফ্রেশ হতে। কুহু জানে এখন মাকে রান্না ঘরেই পাবে। নিশ্চিত অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা চলছে। কুহুকে দেখে প্রিতি হেসে বললেন,

‘এসে গেছিস? আমরা তো তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।’

‘আমরা মানে? ওরা এখানে কেন আসছে মা? আমি বারন করা সত্ত্বেও ওই দাঁত কে’লা’নো, ম’দ’না লোকটার সাথে আমার বিয়ের কথা চলছে নাকি? একদম এসব করবে না। খবর দার বলে দিলাম তোমাকে।’

প্রিতি কপট রেগে বলেন, ‘আচ্ছা ওই নিপাট ভদ্র ছেলেটা কে দেখে তুই ওমন ক্ষেপে যাস কেন বল তো? আর একি ভাষার ছিরি! আমার মেয়েরা তো এভাবে কথা বলে না। ওর সাথে বিয়ে হলে তো তুই সুখিই হবি। আমি মা হয়ে বলছি তোকে। তুই আমার কথা শুনবি না কুহু।’

‘আমি ওরকম নিপাট ভদ্র লোককে বিয়ে করবো না মা। ওঁদের কে বিদেয় করো এক্ষুনি।’

‘ওরকম করিস না মা। আমারও তো একটা মান সম্মান আছে কলিগের সামনে। চল আমার সাথে চল একটু না হয় বসেই থাকবি আমাদের সাথে।’

‘তোমাদের কি আজকে হসপিটালের কোনো ইমার্জেন্সি অটি নেই নাকি? সাথে ওই সুপ্রিয় নামের অপ্রিয়র ও অফিস ছুটি হাহ্? ব্যাপার টা ঠিক হজম হচ্ছে না মা।’

‘আচ্ছা পরে এর কারণ বিশ্লেষণ করবি। এখন চল না মা। আমাদের সাথে একটু বসবি।’

মায়ের চোখে কি রকম একটা মায়া ভরা অনুনয় ছিলো। যা কুহু উপেক্ষা করতে পারলো না। বাধ্য হয়ে গিয়ে বসলো ওঁদের সাথে। ক্ষনে ক্ষনে মনের মধ্যে তৌহিদের কথা উঁকি দিচ্ছে। বক্ষস্থল যেনো চৌচির হয়ে যাচ্ছে! এই ব্যথা উপসমিতি করার জন্য বাড়িতে তাকে সব টা জানাতে হবে। তৌহিদ কে ছাড়া সে কিছুতেই অন্য কাউকে ভাবতে পারে না। নিজের ভালোবাসা এভাবে আর চেপে রাখবে না। জানিয়ে দেবে সব টা মা বাবা কে। তারা যদি না মানে সে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।

মুহু জামা কাপড় পালটে ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে সালাম দিলো শাম্মীকে। শাম্মী মুহুর সালাম নিয়ে প্রিতিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, ‘ও আপনার ছোট কন্যা বুঝি? এসো আমাদের সাথে বসো। ক’দিন পর থেকে তো যাওয়া আসা লেগেই থাকবে। সংকোচ করো না পাশে বসতে।’

ভেতর টা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠছে কুহুর। কিন্তু তবুও ও নিরব রইলো সে। মুহু লাজুক হেসে বুবুর কাছে গিয়ে বসলো। সবাই এক সাথে গল্প করছে কিন্তু সুপ্রিয়র দৃষ্টি রয়েছে শুধু কুহুর দিকে। তার দৃষ্টি কেমন রহস্যময়। বিবাগী তার হাব ভাব। এমন প্রখর দৃষ্টি কেন তার? কি এই দৃষ্টির মানে? জেলের মধ্যে কয়েদিদের যেমন লাগে ঠিক তেমন অবস্থা এখন কুহুর। কিন্তু মায়ের চাপে বসতেই হলো তাকে। মা কে তো আর না বলা যাবে না। যা নরম মনের মানুষ। কেঁদেকেটে একশা করবেন তাহলে। প্রিতি বলে উঠলেন,

‘যাহ না কুহু। সুপ্রিয়কে তোর ঘর টা দেখিয়ে নিয়ে আয়।’

কুহু একবার মায়ের দিকে কটমট করে তাকিয়ে সুপ্রিয়র উদ্দেশ্য বললো, ‘চলুন ঘর দেখবেন।’ কিন্তু মনে মনে সে বললো,
‘সখ কম না তোমার বাপু। দাড়াও না, সময় আসুক দেখাবো মজা।’

ঘরে ঢুকেই সুপ্রিয় বললো, ‘বাহ অপুর্ব করে সাজিয়েছেন তো ঘরটা। আমার ঘর মা গুছিয়ে রাখেন। ওতোটাও সুন্দর হয় না। আপনি যখন যাবেন তখন না হয় এরকম ভাবেই সুন্দর করে গুছিয়ে রাখবেন।’

কুহু তাচ্ছিল্য হাসলো। সুপ্রিম ঠোঁট বাকা করে হাসলো কুহুর হাসি দেখে। তাকিয়ে রইলো একটু অন্য ভাবে। দুর্বোধ্য সেই চাহনি। কুহু দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘আপনার এই ধারণা হলো কিভাবে যে আমি আপনাকে বিয়ে করবো?’

‘আপনি নয় আমি বিয়ে করবো। সেটাতে কোনো সন্দেহ রাখবেন না।’

নাড় পী’ত জ্বলে গেলো সুপ্রিয়র এই কথায়। পরক্ষণেই সুপ্রিয় একটা ছবি দেখিয়ে বলে,

‘এই ছবির মানুষ টাকে আমি প্রথম যেদিন দেখেছি সেদিনই ভেবেছিলাম আমি ওঁকেই বিয়ে করবো। ওঁকেই ভালোবাসবো!’

ছবি দেখে কপাল কুচকে গেলো কুহুর। এরপর তাদের কথোপকথনে এমন কিছু কথা হলো যাতে করে কুহু সুপ্রিয় কে বিয়ে করার জন্য রাজি হয়ে গেলো।

সুপ্রিয় এসে সবাইকে জানালো, ‘আমরা দু’জনেই বিয়েতে রাজি। এক সপ্তাহের মধ্যেই আমরা বিয়েটা করতে চাইছি।’

বিয়েতে রাজি শুনে খুশিতে সবার মুখ ঝলমল করে উঠলো। আরও বেশি খুশি হলো মুহু। কিন্তু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি যখন অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তির মুখোমুখি হলো তখন যেনো তার দুনিয়ায় অন্ধকার নেমে এলো। সুপ্রিয় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি কে দেখে বলে, ‘ তুমি এখানে?’

মুহু সহ বাকি সবাই দরজার দিকে তাকালো। মুহু হাসি মুখে এগিয়ে এসে বলে, ‘তানহা তুই কখন এলি? ঠিক সময়ে এসেছিস। আজকে অনেক খুশির দিন। জানিস বুবুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সামনের সপ্তাহেই বিয়ে।’

তানহা স্তব্ধ তবে মুখে মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলে, ‘কি বলছিস বাহ! এটা তো খুব আনন্দের কথা। আমি এখানে না এলে অনেক কিছুই মিস করে যেতাম দেখছি।’

‘হ্যাঁ একদম! আমি তো কিছুক্ষন বাদে তোর কাছেই যেতাম।’

‘আচ্ছা শুন আমি এসেছিলাম কিছু প্রয়োজনীয় নোটস কালেক্ট করতে তোর থেকে। কিন্তু এখানে এসে তো আরও অনেক বেশি প্রয়োজনীয় কথা শুনলাম। নোটস গুলো নিয়ে আয় তো।’

‘ঠিক আছে তুই ভেতরে এসে বস আমি আনছি।’

মুহু চলে গেলো নোটস আনতে। তানহার চোখ ছিলো অন্য একজন ব্যাক্তির দিকে। সুপ্রিয় ও তাকিয়ে আছে তানহার দিকে। এভাবে কেন দেখা হলো ওর সঙ্গে। তাও এরকম একটা ঘটনার সম্মুখে। প্রিতি হাত ধরে টেনে আনলেন তানহাকে। মিষ্টি এনে তানহার হাতে দিলেন খাওয়ার জন্য। কিন্তু তার মিষ্টি খাওয়া যে হবে না। এখানে আসতেই যে তিক্ততা তাকে ঘিরে ধরেছে সেটার কি হবে? সে তো জানতো কুহু বুবু তার ভাই তৌহিদ কে ভালোবাসে। তাহলে এই বিয়ে টা করতে কেন রাজি হচ্ছে বুবু? তবে কি সব মিথ্যা। তার চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে চোখের পানি বার বার আটকে রাখার জন্য। কুহুর বিয়ের খুশিতে এখানে সবাই ভুলেই গেছে সুপ্রিয়ই প্রথমে তানহাকে দেখে বলেছিলো, ‘তুমি এখান?’ অর্থাৎ এই কথায় তারা যে পুর্ব পরিচিত সেটা উল্লেখ পেলো। তবে কেউই বুঝতে দিলো না তারা পুর্বের পরিচিত। এই বিষয় টা ভুলেই গেছে উপস্থিত সবাই। তানহা শুধু সালমান হোসেনকে দেখতে পেলো না। হইতো অফিসে আছেন তিনি। এই মুহুর্তে সবাই ব্যস্ত কুহুর বিয়ের আলাপচারিতা নিয়ে। প্রিতি এটাও জানালেন তিনি দুই মেয়ের বিয়ে একই দিনে দিচ্ছেন।

তানহা আরও অবাক হয় মুহুর বিয়ের কথা শুনে। মুহুও তাকে বলে নি কিছুই। প্রিয় বান্ধবীর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে আর এটা সে এখন জানতে পারছে। ভেতর থেকে একটা চাপা অভিমান জন্ম নিলো। তবে কিছুই বলে নি সে এখনো অব্দি। কুহুও একদমই নিরব। তানহাকে এক নজর দেখলো শুধু সে। মুহু নোটস আনতে যাওয়াই সে জানলোই না একই দিনে তারও বিয়ে। নোটস আনলে মুহুর থেকে সেগুলো নিয়েই বেরিয়ে এলো। সবার অদ্ভুত লাগলো বিষয় টা। প্রিতি বলেন,

‘কি রে মুহু মেয়েটা এভাবে চলে গেলো কেন?’

‘জানি না মা।’ বলেই মুহু তানহার পেছনে পেছনে আসলো। ওঁকে আটকে জিজ্ঞেস করে,

‘এই তানহা কি হয়েছে তোর? এভাবে বেরিয়ে এলি কেন?’

‘কিভাবে বেরিয়ে এলাম। আমি বাইরের মানুষ তোদের নিজের লোকেদের মাঝে আমার থাকাটা ঠিক না। আমারও ভালো লাগেনি তাই চলে এলাম!’

মুহু বুঝলো তানহার অভিমানী বুলি। সে বান্ধবী কে আগলে ধরতে গেলে বাধা দিলো তানহা। সে আরও একটা কঠিন কথা বলে,

‘দূরে থাক আমার থেকে। বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে সে কথাটা তুই ও আমাকে জানালি না? কেন রে আমি কি এতোটাই পর হয়ে গেছি। থাক তুই আমি গেলাম। একদম কথা বলার চেষ্টা করবি না আমার সাথে।’

বলেই তানহা চলে এলো। মুহু ছলছল করে তাকিয়ে রইলো তানহার যাওয়ার পানে।


সন্ধ্যার পর তৌহিদ বাড়ি ফিরলে তানহা ছুটে এসে ভাইকে জাপ্টে ধরলো। ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। হঠাৎ বোনের এভাবে জড়িয়ে ধরায় বেশ ঘাবড়ে গেলো তৌহিদ। আবার কোনো অঘটন ঘটলো না তো তার অনুপস্থিতিতে? ভেতর থেকে কেঁপে উঠলো তার শরীর! সে ঝটপট অফিস ব্যাগ কাধ থেকে নামিয়ে রেখে বোনের দুই চিবুক ধরে বলে,

‘কি হয়েছে বোন? কাঁদছিস কেন এভাবে?’

তানহা কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে,

‘ভাইয়া কুহু বুবু আর মুহুর এক দিনেই বিয়ে। কুহু বুবু বিয়ে করছে ভাইয়া।’

‘কিহ? কুহুলতা বিয়ে করছে?’ অবাক হয়ে জানতে চাইলো তৌহিদ।

‘হ্যাঁ সামনের সপ্তাহেই বিয়ে। আচ্ছা তুমি আর কুহু বুবু তো একে অপরকে ভালোবাসো তাই না? তাহলে কুহু বুবু এই বিয়ে টা কেন করছে?’

তৌহিদ বেশ কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। এরপর বোনকে শান্ত করার জন্য বললো,

‘ধুর পা’গ’লি! এই জন্য তুই কাঁদছিস? এভাবে কেউ কাঁদে। যাহ আমার জন্য এক কাপ কফি করে নিয়ে আয়! মাথাটা ধরেছে খুব।’

ভাইয়ের এমন ভাবলেশহীন ভাব দেখে তানহার অদ্ভুত লাগলো। অতিব শোকে হইতো তার ভাই পা’গ’ল হয়ে গেছে। না হলে ভালোবাসার মানুষের বিয়ের কথা শুনেও সে কোনো রকম রিয়েকশন কেন করবে না।
তানহাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তৌহিদ বলে,

‘আরে যাহ না এক কাপ কফি করে নিয়ে আয়। আর দেখ এটা তো হওয়ারই ছিলো। কুহুলতার বিয়ে হবেই এটা নিয়ে এতো ভাবার কি আছে।’

‘ভাইয়া তোমার কষ্ট হচ্ছে না?’

‘কষ্ট কেন হবে? আচ্ছা কুহুলতা কি কখনোই আমাকে বলেছে সে আমাকে ভালোবাসে? তাহলে কষ্ট হওয়ার কোনো মানেই হয় না।’

‘তাই বলে এভাবে সব ছেড়ে দেওয়া যায় ভাইয়া? কিভাবে পারছো তুমি সহ্য করতে?’

‘এতো ভাবিস না তুই! কফি করে নিয়ে আয় না!’

‘যাহ ইচ্ছে করো। কিছুই বলবো না আমি।’

বলেই তানহা চলে গেলো কাঁদতে কাঁদতে।
তৌহিদ নিনির্মেষ ভাবে মুড়াতে বসে পা থেকে মোজা খুলে জুতাই রেখে দিলো। তার বোন টা বড্ড নরম মনের। সে ফোন হাতে নিয়ে তার কুহুলতার নাম্বারে সঙ্গে সঙ্গে একটা ম্যাসেজ লিখলো।

‘আজকে রাত দশটায় আপনার বাড়ির কৃষ্ণচুড়া গাছের নিচে দাঁড়াবেন। জরুরি কথা আছে।’

কুহু ম্যাসেজ টা দেখে রিপ্লাই করলো, ‘সময় মতো চলে আসবেন তবে। আমি থাকবো সেখানে।’

রাত দশ-টা। কুহু দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। মুহু ঘুমাচ্ছে বেঘোরে। রাত দশ-টা পাঁচ বাজে এখন। মোবাইলে সময় দেখে তাকালো সামনের দিকে। আজকে সে পেছনের গেটের তালা খুলে রেখেছে। সেদিক দিয়েই আসবে তৌহিদ। ওই তো তৌহিদ আসছেন। অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো তবে।উনি এতো রাতে এখানে আসলেন কেন? কেনই বা ওই ভাবে ম্যাসেজ লিখলো সে। সে কি জানে না? মানুষ টার একটা ডাকে সে যেকোনো স্থানে ছুটে যেতে পারে বিনাবাক্যে। তৌহিদ আলতো পায়ে হেটে এগিয়ে আসছে। তার দিকেই তাকিয়ে আছে মানুষ টা। তার এই চাহনিতে কবে যেনো শ্বাস বন্ধ করে মরেই যাবে সে।

তৌহিদ ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার কুহুলতার দিকে। বাগানের লাইটের হলদে নীলাভ আলোই কুহুলতাকে আরও স্নিগ্ধ লাগছে। আজকে আরও বেশি করে কাছে টানতে ইচ্ছে করছে তার কুহুলতাকে। বাদামী চুলে জ্যোৎস্নার আলোই চিকচিক করছে মেয়েটির চুল। মৃদু মন্দ বাতাসে ওর কপালে লেপ্টে থাকা খুচরো চুল গুলো উড়ছে। এক ধ্যানে নিবিষ্ট রইলো সে তার পানে। আজ যেনো চোখ সরাতে ভুলে গেছে তৌহিদ। মনের সুপ্ত অনুভুতি, গুপ্ত কথা উগড়ে দিতেই এসেছে সে। আজ সে খালি হাতে ফিরবে না এমনই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ নিজের মনের কাছে। ভালোবাসার চিহ্ন একে তবেই এখান থেকে সে প্রস্থান করবে। ভাবতে ভাবতেই সে কুহুর ঠিক সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরলো।

কুহুর ভেতর থেকে একটা চাপা আবেগ উথলে পড়তে চাইছে। বার বার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। কিন্তু নিজেকে যথাসাধ্য কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। লুকাতে চাইছে নিজের চোখের অশ্রুকে। দৃষ্টি তার নিষ্প্রাণ, দুর্বল। তৌহিদ আর তার মাঝে দুরত্ব খুবই কম। চার পাশে ঝিঝি পোকার ডাক আর মাঝে মাঝে নিরবতা ভেঙে পাখির গুঞ্জন ভেসে আসছে। তাদের বাড়ির বাগানের এই দিক টাই বড় একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ রয়েছে। সেই গাছের কিছু টা দুরেই রয়েছে ল্যাম্পপোস্ট। বাড়ির সীমানায় এমন ল্যাম্পপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে বাগানের অন্ধকার ঘুচানোর জন্যই। নিরবতা ভেঙে কুহুই আগে বলে,

‘কি জন্য ডেকেছেন আমাকে? তারাতাড়ি বলুন কেউ যদি দেখে ফেলে ব্যাপারটা মোটেও ভালো দেখাবে না জানেন নিশ্চয়ই?’

‘আপনাকে আমি ডাকলাম আর চলে এলেন? একা একটা মেয়ে আপনি যদি ভুলভাল কিছু করে ফেলি?’

কুহুর ঠোঁটে নির্মলেন্দু হাসি। ঠোঁট আরও একটু প্রসারিত করে বিগলিত হেসে বলে,

‘আপনাকে আমি বিশ্বাস করি। আপনার দ্বারা আমার কোনো সর্বনাশ হবে না এটা আমি নিশ্চিত। কিন্তু আমার দ্বারা যে আপনার কোনো সর্বনাশ হবে না এটা আপনি নিশ্চিত তো তৌহিদ?’

‘আমার কেন সর্বনাশ হবে!’

‘হতেও তো পারে। আচ্ছা বললেন না তো কি জন্য ডেকেছেন?’

কুহুর কথায় তৌহিদ কিছু ভাবলো। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে ওর বাম হাত তুলে ধরলো নিজের মুখের কাছে। একটা আলতো চুম্বন একে দিয়ে ওর অনামিকা কনিষ্ঠা আঙ্গুলটিতে তার হাতে থাকা সোনার আংটি টি গেথে দিলো সন্তর্পণে। আকষ্মিক এরকম ঘটনায় কেঁপে উঠলো কুহু। বুকের ধুকপুক তথাপি বেড়ে গেছে কয়েকশত গুন। দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো ওর। ওর মনে হচ্ছে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে বোধহয় এক্ষুনি। মুখ দিয়ে রা টিও সরছে না ওর। কুহু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তৌহিদের দিকে। এটা সে কি করলো? তাকে আংটি পরিয়ে দিলো তৌহিদ। যেখানে সামনের সপ্তাহে তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই তৌহিদকে তানহা ওর বিয়ের ব্যাপার টা বলেছে। তাহলে জেনেশুনে তৌহিদ কেন এমন করলেন? তৌহিদ কুহুর হাত টা ছেড়ে দিয়ে প্রসন্ন গলায় বলে,

‘এই কাজ টা বাকি ছিলো বলেই ডেকেছিলাম আপনাকে। মনে রাখবেন এই জীবনে আপনি শুধুই এই তৌহিদের আর কুহুলতার জীবনে শুধুই তৌহিদের বসবাস থাকবে অন্য কারোর নয়।’

কুহু স্তব্ধ হয়ে গেছে তৌহিদের এহেন কাজে। তৌহিদ এমন কিছু করবে ওর ধারণার ও বাইরে ছিলো। তার মানে মনে মনে তৌহিদ ও তাকে ভালোবাসতো। ও বুঝতে পারেনি তৌহিদ কে। তৌহিদ চলে যাচ্ছিলো কিন্তু আবার ফিরে এসে বলে,

‘আরও কিছু কাজ বাকি আছে।’

বলেই কুহুর কোমড় চেপে ধরলো এক হাতে আর এক হাতে ওর কুর্তির কলার ধরে টেনে নিয়ে এলো একদম ওর কাছে। দুজনের নিঃশ্বাস মিলেমিশে একাকার। তৌহিদ চমৎকার ভাবে নিজের অধর মিলিয়ে দিলো কুহুর অধরে। কুহু হাত দিয়ে মুঠো করে আঁকড়ে ধরলো তৌহিদের শার্ট। দু চোখ বন্ধ দুজনেরই। দুজন দুজনকে অনুভব করতে ব্যস্ত এই সুন্দর সময় টাই। কিয়ৎক্ষনের জন্য সব কিছু নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে। থেমে গেছে ঝিঝি পোকার ডাক! থেমে গেছে পাখির মৃদু গুঞ্জন। মিনিট দুই পর তৌহিদ কুহুকে ছেড়ে দিয়ে নিজের নরম ঠোঁট মুছে বলে,

‘এইটা আমার ভালোবাসার আরেকটা চিহ্ন! আর অর্ধেক বিয়ে হয়ে গেছে আপনার আর আমার। তাই এটুকু অধিকার আমার আছে। আর আমি জানি আপনি আত্মসমর্পণ একজন ব্যাক্তি। এরপর আপনি আর কোনো দিন ও আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ের কথা ভাবতেও পারবেন না। আপনাকে পাকাপাকি ভাবে আপনার বাবা মায়ের কাছে থেকে ছিনিয়ে আনবো আমি আর বেশি দেরি নেই। এরকম আগ্রাসী চুম্বন আমি রোজ বার বার নেবো। সেটাও আপনি আমার একেবারে পার্মানেন্ট হওয়ার পর।’

লজ্জায় কুহুর গাল গুলো টগবগ করছে। মনের মধ্যে অজানা খুশিতে নেচে উঠছে মন। নুপুরের ছন্দের ন্যায় তার হৃদয় প্রফুল্ল হচ্ছে। সে হা করে শুধুই তৌহিদের যাওয়ার দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে রইলো।

তারপরের দিন সাহিরাকে দেখে প্রিতি অনেক টা অবাক হয়ে গেলেন। কারণ তার পিছনে আরেকটা ছেলে আর সাথে সারাফ। এমন সময় সাহিরার না বলে আসার কথা না। হঠাৎ এসময় সাহিরা? কিন্তু কি কারণ তা উদঘাটন করতে সক্ষম হয়না প্রিতি। সাহিরা ভেতরে এসে রয়ে সয়ে আমতা আমতা করে। এরপর সাহস করে বলেই ফেলে শৈবাল আর কুহুর বিয়ের কথা। এই কথাটি বজ্রপাতের ন্যায় আঘাত হানলো উপস্থিত সবার মস্তিষ্কে। কুহু, মুহু, শিউলী আপা, সালমান হোসেন, প্রিতি প্রত্যেকে অপ্রত্যাশিত কিছু শুনে ‘থ’ মেরে বসে আছে। কুহু শৈবাল কে দেখেই ভীষণ ভাবে আঁতকে উঠলো। বিরবির করে বলে,

‘শৈবাল সাহিরা খালামনির ছেলে?কিন্তু খালামনি এসব কি বলছে?’

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here