#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_১৬
#খাদিজা_আক্তার
শেষ প্রশ্নটি বেশ জোর দিয়েই করল আদী আর এমন প্রশ্ন শুনে রাত্রির মাথায় হুট করেই ইব্রাহিমের নামটি চলে এলো। এমন বাজে পরিস্থিতিতেও তার মন নিজের অজান্তেই হেসে ওঠল। বলল,
—সব পুরুষ এক না হলেও কি অভিন্ন? ইব্রাহিমকে দেখলে যেমন ঘৃণা আসে, তেমন তোমাকে দেখলেও আসে যখন তুমি নেশা করে আমার সাথে জঘন্য কথাগুলো বলো। কিন্তু এসব বললেও নিজেকে কেমন লাগে কারণ আমি তো কোনো পুরুষের সন্তানও।
—এই রাত্রি, কথা কও না ক্যান?
রাত্রি নত দৃষ্টিতে নানান চিন্তায় বিভোর ছিল, কিন্তু এখন আদীর প্রশ্ন শুনে নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে জানতে চাইল,
—কী বলব?
আদীর দুই হাতের বাঁধনে বন্দী রাত্রি। সে বান্ধন আরও শক্ত করে করুণ গলায় আদী বলল,
—কেন বিষ নিয়ে এলে? মাত্র চব্বিশ ঘণ্টাও আমায় বিশ্বাস করতে পারোনি?
প্রশ্ন শুনে রাত্রি নিজের কান্না সংবরণ করে শক্ত গলায় বলল,
—দু’দিন বাদে যে মেয়ের বিয়ে হতে চলেছে, সে এখন অন্য পুরুষের মুখোমুখি এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন তাদেরই বিয়ে হবে। মানুষের অন্যায় আবদার মানতে যে মেয়ে ২৪ ঘণ্টা তার সংস্পর্শে থাকবে, সে মেয়েকে তুমি এ কথা জিজ্ঞেস করছ?
রাত্রির মুখে এমন কথা শুনে আদী নির্জীব হয়ে গেল। হাতের বাঁধন ক্রমশ আলগা হয়ে গেল। আদী দূরত্ব বাড়িয়ে পিছনে যেতে লাগল চোখ নামিয়ে। আদীর চেহারায় এখন এমন প্রতিক্রিয়া ভাসছে যা দেখে রাত্রির মনে হচ্ছে হয়তো আদী এখন কেঁদেই দিবে। কিন্তু না। আদী নিঃশব্দে চলে যাচ্ছে আর তার চলে যাওয়া দেখে রাত্রি ছুটে এসে ডান টেনে ধরে জিজ্ঞাসা করল,
—আমার কথার জবাব না দিয়ে তুমি পালাচ্ছ কোথায়?
আদী উত্তর না দিয়ে চুপ করে আছে। রাত্রি বলল,
—হ্যাঁ, বিষ এনেছি। কিন্তু তোমাকে নরপিশাচ ভেবে আনিনি। আমি জানি মানুষের নেশা করলে হুঁশ থাকে না, তোমারও থাকেনি। তুমি যা পেরেছ সে রাতে আমাকে তাই বলেছ। এমন সব কথা বলেছ যা একজন স্বামী তার স্ত্রীকে বলতে পারে। আমাদের মাঝে তো তেমন সম্পর্ক ছিল না। তাহলে কেন বললে আমায়? তুমি জানো? তোমার প্রতিটি কথা আমার হৃদয়ে বিষ হয়ে ঢুকেছে। যখনই এসব আমার মনে পড়ত আমি পাগলের মতো কান্না করতাম তবুও তোমায় কিচ্ছু বলতাম না কারণ আমি জানি এসব তুমি ইচ্ছে করে বলোনি। এসব কথা শোনার পর তুমি কীভাবে আশা করো তোমাকে আমি নিরাপদ মনে করব?
—তু… তুমি আমার কাছের অনিরাপদ?
এ প্রশ্ন করে অবিশ্বাসের চোখে তাকাল আদী আর নিজের হাত একটু একটু করে রাত্রির কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিলো। রাত্রি আহত হলো আদীর প্রশ্ন শুনে আর আহত হৃদয় নিয়েই কিছু বলতে চাইল। কিন্তু বিধাতা সে সুযোগ রাত্রিকে দিলো না। আদীর ফোন বেজে উঠতেই সে নিজেকে সামলে নিয়ে ফোনে কথা বলতে শুরু করল,
—হ্যালো।
আদী ফোনে কথা বলছে ঠিকই, কিন্তু রাত্রির চোখে চোখ রেখে কেমন যেন থমকে আছে।
—কখন হয়েছে এসব? জহিরকে কি পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে?
আদী প্রশ্ন করল, কিন্তু উত্তর কী এলো রাত্রি শুনতে পেল না। আদী বলে চলেছে,
—আরে ওই মেয়ে তো আমার বাসার সামনেই থাকে… খালি বিয়ে ভেঙে যায়… তুই কি শিওর যে ওই মেয়ে জহিরের জন্য সুই””সাইড করেছে?… ওকে। আমি এখনই আসব, কিন্তু আধঘণ্টা সময় লাগবে।
শেষ বাক্য আদী বলল একদম গাঢ় গলায় তাও রাত্রির পানে তাকিয়ে। যেন তার গলার স্বর বলে দিচ্ছে, আমাকে আধঘণ্টা দে আমি রাত্রিকে সময় দিতে চাই।
আরও দুই মিনিট কথা বলে আদী ফোন রেখে দিলো। এরপর রাত্রিকে বলল,
—ভালোই হয়েছে এখন আমাকে চলে যেতে হবে কারণ যে আমার কাছে নিজেকে নিরাপদ মনে করে না। তার সাথে অন্তত ২৪ ঘণ্টা প্রেমিকের মতো আচরণ করা যায় না।
এ বলে আদী একদম রাত্রি কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। বুকের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া বেদনা নিয়ে নরম কণ্ঠে বলল,
—তোমার সাথে আমার যা সম্পর্ক ছিল রাত্রি। আজ তা নিজের অজান্তেই শেষ হয়ে গেল। আমার জীবনে মেয়ে এসেছে যেমন, চলেও গেছে কোনোরূপ ছায়া না ফেলে। কিন্তু তুমি চলে যাচ্ছ আমার সমস্ত মনকে ছাই করে দিয়ে। আমি তোমাকে কখনো প্রেমিকার নজরে দেখিনি, কিন্তু আমার সবসময়ই একটি চাওয়া ছিল যেন তোমার মতো একটি মেয়ে আমার প্রেমিকা হয়; বউ হয়। কিন্তু আজকে থেকে এ চাওয়াকে আমি নিজ হাতে খু””ন করলাম। তোমার সাথে দেড় কি দুই বছরে আমি অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। তাই আমার মনে হয়েছিল তুমি হয়তো কষ্ট পেয়ে সুই””সাইড করতে পারো কারণ আমি জানি তুমি ইব্রাহিমকে পছন্দ করো না। কিন্তু এ বিষয়েও তুমি নির্জীব রইলে। অবশ্য এখন বললেও আমার কিছু যায় আসে না। যেখানে সম্পর্ক নেই, সেখানে নির্লজ্জের মতো আমি তোমার ওপর অধিকার ফলাতে চাই না। তবে কি জানো? মাঝেমধ্যে বুকের ভেতরে তোমার নামে যে ছন্দপাত হয় তা হয়তো আমি কোনোদিনও থামাতে পারব না।
*
রাত শেষ প্রায়। আলো ফুটছে আকাশে। কিন্তু মনের আলো কাল রাতেই নিভে গেছে। আদী কখনো ভাবতে পারেনি রাত্রি তাকে নিয়ে এমন চিন্তা করতে পারে। তবে আদীর আচরণ যে আহামরি ভালো ছিল তা সে নিজেই স্বীকার করতে অপারগ। তবে একটি বিষয় কাল সকাল থেকেই অনুভব করছে আদী। গৌর বর্ণের ওই মেয়ে তাকে অন্যভাবে টানে। খয়েরি রঙের শাড়ি আর কাজল চোখের দৃষ্টি বুকে জ্বালা ধরিয়ে দিতে যথেষ্ট। কিন্তু এসব চিন্তা এখন করে তো কোনো লাভ নেই।
কালকে রাত দশটা নাগাদ আদী রাত্রিকে তার সেই বান্ধবীর বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল, যার কথা বাসায় বলে রাত্রি এসেছিল আদীর কাছে। বান্ধবীর বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার পরও রাত্রি কোনো কথা বলেনি। পুরো সময় জুড়ে মেয়েটি কেমন তব্দা লেগেছিল। কিন্তু পৌঁছে দিয়ে আদী শেষবারের মতো বলেছিল,
—আমি তো নিকৃষ্টতম মানুষ। তাই তোমার জীবনের মূল্যবান ঘণ্টা আর ব্যয় করলাম না। ভালো থেকো। আজকের পর আর কখনো তোমার সামনে এসে দাঁড়াব না। স্বর্ণালি আমাকে বদলে দিয়ে গিয়েছে অনেকটাই, বাকিটুকু আজ তুমি বদলে দিলে।
এ কথা শেষে আদী বিষাদের হাসি হেসেছিল। তার হাসি রাত্রি দেখেছিল মনোযোগ দিয়ে, কিন্তু জবাব দেওয়ার মতো আগ্রহ তার ছিল না। ফলে শেষ বিদায়েও রাত্রি ছিল একদমই চুপচাপ।
—আদী?
পুলিশ স্টেশনের বাইরে অপেক্ষা করছিল আদী। এ মাত্র সাজ্জাদ এসে পাশে দাঁড়িয়ে ডাকল। আদী ভাবনায় বিভোর ছিল বলে সামান্য নড়েচড়ে ওঠল। তবে কিছু না বলে কেবল সাজ্জাদের দিকে এগিয়ে গেল,
—আমি স্বর্ণালির কেস নিয়ে ঢাকা ছিলাম। এ মাত্র এলাম। জহিরকে শুনলাম অ্যারেস্ট করেছে। কিন্তু তুই সারা রাত ধরে এখানে কেন?
সাজ্জাদের প্রশ্ন আদী বুঝতে পারল তবুও অবুঝের মতো জিজ্ঞাসা করল,
—তাহলে কই থাকব?
—কই থাকবি মানে? তোর না রাত্রির সাথে থাকার কথা?
—ছিল, কিন্তু জহিরের বিপদ তাই…
—কী হয়েছে দোস্ত?
প্রশ্ন করেই সাজ্জাদ আদীর কাঁধে হাত রাখল। আন্তরিক হওয়ার চেষ্টা করে আদীর খবর নিতে চাইল। কিন্তু আদী রাত্রিকে নিয়ে কিছু বলতে চায় না। তাই প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল,
—আরে আমার আবার কী হবে?
—হয়েছে বলেই তো জিজ্ঞাসা করছি। জহির তো পেয়ারের দোস্ত না যে তুই রাত্রিকে ফেলে চলে আসবি। I know man. আমি জানি তুই রাত্রিকে কতটুকু…
আদী বাঁধা দিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
—ছাড় এসব। ওই মেয়ের লা””শ পেলি?
সাজ্জাদ ঠোঁট টিপে মাথা নেড়ে বলল,
—হ্যাঁ, ঢাকা মেডিক্যালে পাওয়া গেছে। স্বর্ণালির মতোই ওর অবস্থা।
(চলবে)#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_১৭
#খাদিজা_আক্তার
আদী আঁতকে ওঠল,
—কী বলছিস তুই এসব?
—ঠিকই বলছি। ওর লা””শের অবস্থা একদম হুবহু স্বর্ণালির মতো। আর আমার ধারণা এটি সিরিয়াল কি””লিং কারণ লা””শের সংখ্যা কাউন্ট করে প্রায় ৭/৮ হয়ে যায়।
—৭/৮ জনকে একই প্রসেসে মারা হয়েছে আর কেউ খবর পায়নি?
—কী করে পাবে? লা””শের তো অন্য গতি করা হতো। স্বর্ণালির জন্য এ রহস্য সামনে এলো।
—তারমানে কি স্বর্ণালির লাশও গু””ম করার চেষ্টা চলছিল?
সাজ্জাদ মাথা নেড়ে বলল,
—হ্যাঁ, কিন্তু তোর জন্য পারেনি আর আমিও কেঁচো খুঁজতে গিয়ে সাপ পেয়ে গেলাম। ইনভেস্টিগেশনে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। তবে এখনো অনেক কিছু জানা বাকি।
—সে আমি জানি যে তুই ঠিক সব খুঁজে বের করেই ফেলবি। কিন্তু জহিরের বিষয়টি কী হলো? ও আমার সাথে ঝগড়া ঝামেলা করলেও ছেলে হিসাবে ভালো। তবে জহির যে আমার বাসার সামনে থাকা মেয়ের সাথে প্রেম করে সেটি অবশ্য আমি জানতাম না। দেখ আমি ওর হয়ে সাফাই গাইছি না। ছেলেটি সত্যিই ভালো। ওর জন্য কেন মেয়েটি সুই””সাইড করতে যাবে? এ মেয়ের তো ক’দিন আগে বিয়ে ভেঙে গেছে। ওর বাপ ভাইয়ের বিষয় নিয়ে ওর জীবন নরক হয়ে ওঠেছে। আমার মনে হয় ওর মৃত্যুর পিছনে অন্য কেউ আছে যারা স্বর্ণালি এবং অন্য লা””শগুলোর সাথে জড়িত। তবে বাপ ভাইয়ের প্রতি প্রতিশোধ নিতে ওকে সুই””সাইড করতে বাধ্য করেছে আর সে দায় জহিরের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।
আদীর কথা শুনে সাজ্জাদ আচমকা ভ্রুকুটি করে বলে ওঠল,
—কী বললি? বাধ্য করেছে! আরে শালা এ বিষয়টি কেমন করে আমার মাথায় এলো না?
—কী হয়েছে?
—Thanks রে। কেস নিয়ে আরও ২০% তুই খোলাসা করতে সাহায্য করলি। বাকি কথা পরে তোকে জানাব। এখন বাড়ি যা। তোর প্রেসার বাড়লে অন্য সমস্যা হতে পারে। তুই গিয়া একটা লম্বা ঘুম দে আর আমি চললাম ঢাকায়।
অবাক হলো আদী,
—এখন আবার ঢাকায় যাবি!
সাজ্জাদ মৃদু হেসে জবাব দিলো,
—ঢাকায়ই তো সব রহস্য কচুরিপানার মতো ভাসছে। নে নে যা এবার। দেরি করিস না।
*
চোখ খুলল আদী। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে তা সে জানে না। ঘরময় অন্ধকার হয়ে আছে। জানালার পর্দায়ও অন্ধকার লেপ্টে আছে মানে দিন ফুরিয়ে রাত হয়ে গেছে। ঘুমানোর আগে সে তার আম্মাকে বলেছিল,
—আমার ক্লান্ত লাগছে আম্মা। দুই দিন অনেক ঝড় গেছে। এখন আমি ঘুমাব। আমায় যেন কেউ বিরক্ত না করে।
—কিছু খেয়ে তারপর না হয় ঘুমা। প্রেশারের ওষুধও তো খাওয়া দরকার।
—আমার এখন কিছু ভালো লাগছে না। ঘুম থেকে ওঠে তারপর খাব।
—কিন্তু বাপ…
আদী তার আম্মার আপত্তি শোনেনি। ঘুমিয়ে পড়েছিল খাবার আর ওষুধ না খেয়ে। এখনো সে ঘুমিয়ে থাকত, কিন্তু হঠাৎ ফোন বেজে ওঠল বলে ঘুমের সমাপ্তি হলো।
বালিশের পাশে থাকা ফোনটি হাতে নিয়ে আদী দেখল অপরিচিত নম্বর থেকে কল এসেছে। ঘুম চোখেও অবাক হলো সে এবং রিসিভ করে বলল,
—হ্যালো।
—আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া।
একটি মেয়েলি কণ্ঠস্বর শুনতে পেল আদী। আরও অবাক হয়ে জবাব দিলো,
—ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কে আপনি? আমি…
আদী আরও প্রশ্ন করার আগে মেয়েটি বলল,
—ভাইয়া, আমি রাত্রির বান্ধবী; শর্মি। কালকে আপনি যার বাসায় রাত্রিকে রেখে গেলেন।
এবার চিনতে পেরে আদী বলল,
—ও আচ্ছা।
জবাব দিতে গিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল আদী। এরপর গা ঝেড়ে বলে ওঠল,
—হ্যাঁ, আপু। চিনতে পেরেছি। বলুন কী জন্যে কল করলেন।
শর্মি একটু সময় নিলো এরপর আমতা আমতা করে বলল,
—ভাইয়া, আপনি কি এক্ষুনি একবার আমাদের বাসায় আসতে পারবেন?
শর্মির এমন প্রশ্ন শুনে হতবাক হয়ে গেল আদী,
—কেন? কী হয়েছে?
এ প্রশ্ন করেই হঠাৎ আদীর মন কেমন করে ওঠল,
—রাত্রি! রাত্রি ঠিক আছে তো?
—আপনি আসুন আগে। এখনই একবার আসুন। আমি ফোনে ঠিক করে সব বলতে পারব না।
—কিন্তু আপনি আমাকে ফোনে কিছু তো বলুন। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
—হ্যাঁ আমি আসছি।
*
—আদী, বাপ আমার। এমন অনিয়ম করিস না। তোর ব্লাডপ্রেশার কিন্তু কমার নামই নিচ্ছে না। এমন চলতে থাকলে একটা অঘটন ঘটতে কিন্তু বেশি দেরি হবে না। তুই চাইছিস আমার ভরা বুক খালি করে দিতে?
আদী বিছানায় শুয়ে আছে কপালে হাত ঠেকিয়ে। তার জীবনে একের পর এক কাণ্ড ঘটে চলেছে। ফলে সে বারংবার দিশেহারা হয়ে পড়ছে। নাওয়াখাওয়া সব যেন উঠে গেছে প্রায়। ফলে ব্লাডপ্রেশারে দেখা দিচ্ছে অস্বাভাবিক তারতম্য। এতে আদীর আম্মা অস্থির হয়ে ওঠছেন, কিন্তু তা নিয়ে আদী কিছু ভাবতে চায় না। বিক্ষিপ্ত মনে আর কতক্ষণ ভাবা যায়?
হঠাৎ ফোন বেজে ওঠল। আদী তার আম্মার কথাবার্তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ফোন রিসিভ করল। এতে ক্ষুণ্ণ মনে আদীর আম্মা চলে গেলেন।
—বল সাজ্জাদ।
—কী বলব? তোর মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে? আমি এত মানা করা সত্ত্বেও তুই কেন ইব্রাহিমের সাথে মারপিট করলি?
আদী চুপ করে আছে। তাই সাজ্জাদ জিজ্ঞাসা করল,
—চুপ করে আছিস কেন?
আদী পালটা প্রশ্ন করল,
—কী বলব?
—কী বলবি মানে? তুই একজন নামি-দামি ডাক্তারের সাথে মারপিট করেছিস। বিষয়টি এত আগে ঘটেছে অথচ আমি কিছু জানলামও না। কেন এমন করলি?
—তো কী করতে বলছিস তুই আমাকে? ওই শালার জন্য আমার রাত্রিকে আমি হারিয়েছি। এরপরও একে ছেড়ে দিবো সে চিন্তার করছিস তুই?
—যা জানিস না তা নিয়ে কথা বলতে আসবি না।
—কোনটি জেনে তোর সাথে আমাকে কথা বলতে হবে? আর তুই আমার বন্ধু হয়ে ওই শালার সাইড নিয়ে কেন কথা বলছিস? রাত্রির বিষয়ে জেনেও তুই…
—তোর মাথা ঠিক নেই আদী। আমি এখন এ বিষয়ে কিচ্ছু বলতে চাই না। আগে স্বর্ণালির কেস মিটে যেতে দে। এরপর জহিরের বিষয় তারপর না হয় তোর বিষয়ে ফয়সালা করব।
আদী কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু সাজ্জাদ তাকে সে সুযোগ দিলো না। রাগ-ক্ষোভ নিয়ে আদী হাতের ফোন বিছানায় ছুঁড়ে দিলো। বেশ কিছু দিনের অস্বাভাবিক ব্লাডপ্রেশার আবার চড়চড় করে বাড়ছে। আদীর অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে পৃথিবী যেন শেষ হয়ে যাবে। দ্রুত সে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। বরাবরের মতো ঝরনা কলে মাথা রেখে নিজের তপ্ত রক্তকে শীতল করতে লাগল। এত উত্তেজনা আর বুকের জ্বালা নিয়েও রাত্রির সে মুখখানা আদীর চোখের সামনে ভেসে ওঠল। খয়েরি রঙের শাড়ি পরা, চোখে কাজল দেওয়া আর ভেজা চুলের এক আস্ত রাত্রিকে এ মূহুর্তে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে আদী ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠল। কাঁদতে কাঁদতে বিড়বিড় করল,
—এমন কেন করলে রাত্রি? আমার কথা একবারও ভাবলে না? আমি যে শেষ হয়ে যাচ্ছি। এত বড়ো শাস্তি দেওয়ার আগে একটিবার ভাবলেও না?
*
রাতের আকাশ আর আকাশে মস্ত বড়ো চাঁদ। স্নিগ্ধতা ছেয়ে আছে সমস্ত চরাচরে। কিন্তু স্নিগ্ধতা সবসময় মনে প্রশান্তি আনে না। মাঝেমধ্যে একরাশ কান্নাও ডেকে আনে। আদীর আজ কাঁদতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ছেলেরা হুটহাট কাঁদতে পারবে না। সমাজে ছেলেদের কান্নাকে কাপুরুষের সরূপ মনে করা হয়। তাই বুকফাটা কান্নাকে আদী আজ পূর্ণিমার রাতে জায়গা দিতে চায় না।
একটি দীর্ঘশ্বাস আচমকা বেরিয়ে এলো আদীর বুক চিরে। আজ সকালে আচমকাই বুশরা মারা গেল। কতশত কষ্ট নিয়ে মেয়েটি পৃথিবী ছেড়ে ভাবতেই আদী যেন ভেঙে পড়ল। মেয়েটি বারবার আদীর কাছে মিনতি করেছিল,
—শুধু একটি দিনের জন্য আমাকে গ্রহণ করো; শুধু একটি দিন।
(চলবে)