বিচ্ছেদময় সুখ পর্ব -০৯

#বিচ্ছেদময়_সুখ –[৯]
মুনিয়া মিরাতুল নিহা
🚫(অন্য কোথাও পোস্ট নিষিদ্ধ)🚫
______________________

শপিং করতে এসে সবাই দোকানে এসে এটা ওটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। তন্ময় আমার বিয়ের শাড়ি সবকিছু লাল রঙের পছন্দ করে দিয়েছে। লিপি তন্ময় দু’জনই হইচই করে শপিং করে চলেছে আনন্দে। কিন্তু আমি আনন্দ করতে পারছি না আমার মন এসব রঙিন কাপড় ছেড়ে বেরঙিন ওই মানুষটির দিকেই চলে যাচ্ছে বারংবার! অনেক্ক্ষণ যাবত লক্ষ্য করছি উনি দোকানের একটি কালো রঙের শাড়ির দিকে তাকিয়ে আছেন বোধহয় উনার শাড়িটা খুব পছন্দ হয়েছে বিশেষ করে কালো রঙ কি-না। আমি দোকানিকে বলে সেই কালো রঙের শাড়িটা প্যাকেট করতে বললাম। রুহিন তাতেও কিচ্ছু বললো না যেনো কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না। মানুষটি তো নেই থাকুক না তার পছন্দসই শাড়িটি।
গায়ে হলুদের শপিং বিয়ের শপিং সবকিছু করতে করতে দুপুর হয়ে যায়। লিপি আর তন্ময় মিলে জোরাজুরি করতে লাগলো রেস্টুরেন্টে যাবে বলে। অবশেষে একটা রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে ঢুকলাম। আমার পাশে তন্ময় আর সোজাসুজি রুহিন বসে আছে রুহিনের পাশে লিপি বসে আছে। রুহিনের ফোন আসায় একটু দূরে গিয়ে ওঠে গেলো। তন্ময় আর লিপি মিলে খাবার অর্ডার করতে লাগলো আমার সেদিকে মন নেই। সুযোগ পেলেই বে’হায়া চোখদুটো কেনো জানি বারংবার রুহিনের দিকে গিয়ে ঠেকে। খাবার চলে এসেছে। আমাকে দেওয়া হয়েছে স্যুপ যদিওবা আমি নিজেই নিয়েছি খেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না তাই স্যুপ নিয়েছি। লিপি রুহিন আর ওর জন্য বিরিয়ানি অর্ডার করেছে। আমরা সবাই খাচ্ছি। আড়চোখে রুহিনের দিকে তাকালাম, মানুষটা বিরিয়ানি এক চামচ মুখে নিয়ে চামচ দিয়ে বিরিয়ানির প্লেট ঘেঁটে যাচ্ছে! এতোক্ষণ মনে ছিলো না উনি তো বিরিয়ানি খেতেই পারে না, অথচ এই ভর দুপুরবেলা উনাকে বিরিয়ানি দিয়ে বসিয়ে রেখেছে।

-‘ আরে লিপি রুহিন তো বিরিয়ানি খায় না, তুই উনার জন্য অন্য কিচ্ছু অর্ডার করে নে।’

-‘ তুমি কি করে জানলে রুহিন ভাইয়া বিরিয়ানি খায় না অপছন্দ করে?’

তন্ময়ের প্রশ্নে ঘোর কা’ট’লো। প্রশ্নটা নিতান্তই বেহুদা। রুহিনের আগা গোড়া সবটাই জানি আমি। সেখানে এটা জানা তো কোনো ব্যাপারই না?

-‘ আমি জানি তাই বলেছি।’

রুহিন হুট করে ওঠে চলে গেলো। উনাকে ডাকার পরও আসেনি। এখন তো সবে শুরু প্রতি পরতে পরতে উনাকে ভু’গতে হবে নিজের আত্নত্যাগের জন্য! কেউ না জানলেও আমি বেশ বুঝতে পারছি উনি কেনো চলে গেছেন! আমরা বাকিরা খাওয়া দাওয়া শেষ করে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। আপন মনে গাড়ি চালাচ্ছেন রুহিন। আমি গাড়ির কাঁচ ভেদ করে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছি! আশপাশ দিয়ে দ্রুত গতিতে গাড়ি চলে যাচ্ছে সেগুলোই দেখছি। আর তো মাত্র দু’দিন তারপর রুহিন নামক মানুষটির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যাবো! আমার জীবনে আর উনার কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। এই কথাগুলা ভাবতে হয় না এখন এগুলোই সত্যি আর যতোবারই এই সত্যি ভুলে থাকতে চাই ঠিক ততোবারই মনে পড়ে আর ভেতরটা ছা’ড়’খাড় হয়ে যায় দহন যন্ত্রণায়! আমি জানি রুহিনও ভালো নেই, আমিও ভালো নেই তাকে ছাড়া তবুও এই বিচ্ছেদ!

—————————-
লাল, নীল, হরেক রকম আলোকসজ্জায় সেজে ওঠেছে মীরাদের বাড়ি! আলোয় আলোকিতো হয়ে আছে চারিপাশ, চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে একেবারে। খুব সুন্দর করে বাড়ির ভেতর ও বাহির দুই সাজানো হয়েছে। সাজানোরই কথা কারন আজকে রাত্রির পেরোলেই কালকে বিয়ে। বাড়ি জুড়ে আত্নীয় স্বজনরা গমগম করছে। যেহেতু আজকে হলুদ সন্ধ্যা সেজন্য মীরাকে পুরো হলুদ রঙে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হলুদ রঙের শাড়ি, হলুদ রঙের জুয়েলারি, মা’থার চুলেও হলুদ রঙের ফুল, মোট কথা হলুদ রঙের ফুল আর হলুদ রঙের শাড়ি পড়ে মীরা প্রচন্ড সুন্দর লাগছে। বকড়িতে উচ্চস্বরে গান বাজনার আওয়াজ করে চলেছে মীরাকে রেডি করে ছাঁদে বসিয়ে রাখা হয়েছে। হঠাৎ মীরার তন্ময়ের কথা মনে পড়লো! সেই সেদিন যে আংটিটা ফেলে এসেছিলো সেটার জন্য এখন টনক ওঠলো মীরার! এতোদিন বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো ভাগ্যিস আজকে মনে পড়েছে নতুবা কি হতো। আংটিটা মীরা রুহিনের জন্য কিনেছিলো তাই সেটা অন্য কাউকে দিতে চায় না। সেজন্যই তন্ময়ের ফোনে লাগাতার ফোন করে যাচ্ছে মীরা কিন্তু তন্ময়ের ফোন ধরার নাম নেই।
ওই বাড়িতেও গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। রুহিন সেখানে কিছুক্ষণ থাকলেও কেনো জানি পুরোটা সময় ধরে সে বসে থাকতে পারলো না! অজানা কারনে বেরিয়ে আসলো অনুষ্ঠানের থেকে। রুহিন তন্ময়ের রুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। তন্ময়ের বিছানার উপর তন্ময়ের ফোন বাজতে দেখে থমকে দাঁড়ালো। অনেকবার রিং হচ্ছে দেখে এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলো ফোনের স্ক্রিনে মীরার নামটি বেশ জলজল করে ভাসছে! রুহিন কি রকম অদ্ভুত হাসি হাসলো! হয়তো সে মনে করছে মীরা বোধহয় সত্যিই এখনই তন্ময়ের হয়ে গিয়েছে। ফোনটি ধরবে নাকি ধরবে না দ্বিধায় থাকলেও প্রেয়সির কন্ঠস্বর শোনার ব্যাকুল ইচ্ছে মনে জাগতেই ফোনটি রিসিভ করে হ্যালো বললো।

ফোনের ওপাশ থেকে আমি হ্যালো শুনেই বুঝে গেছি এটা তন্ময় নয় রুহিন! রুহিনের কন্ঠস্বর চিনতে আমার কোনো ভূল হতে পারে না কিন্তু তন্ময় ফোন না ধরে উনি ফোন ধরলেন কেনো?

-‘ আপনি কেনো ফোন ধরেছেন?’

-‘ এক ডাকেই বুঝে গেলে মীরা? এটা তোমার তন্ময় নয় রুহিন।’

-‘ হুম বুঝে ফেলেছি। তার সঙ্গে থাকার জন্যই তো আপনার এতকিছু করা, তাহলে সেই মোতাবেক আপনার তো এখন আনন্দ করার উচিত তাই নয় কি?’

রুহিন চুপ করে রইলো ফোনের উপাশ থেকে। সে কি করে এখন মীরাকে বলবে মীরাকে হারিয়ে সে নিজেও যে বিরহ যন্ত্রণায় ভূগছে! এই কষ্ট যে তার অনুভব করবার মতন কেউই নেই। ভাগ্যের পরিহাসে সে একাই তার যন্ত্রণা ভোগ করে চলেছে প্রতিনিয়ত!

এতোক্ষণ রুঢ় কন্ঠে রুহিনের সঙ্গে কথা বলার পর মনে হলো কেনো জানি আর তো মাত্র একটি দিন উপস একটি দিনও নেই পুরো কয়েক প্রহর পেরোলেই আমি তন্ময়ের হয়ে যাবো! রুহিন আমার ধরাছোঁয়ার বাহিরে থাকবে। শেষবারের মতন রুহিনকে দেখার ইচ্ছে জাগলো মনে।

-‘ কাল থেকে তো আমি অন্য একজনের পুরোপুরি ভাবে। শেষবারের মতন একটিবার দেখা করতে পারবেন কি? ‘

রুহিন কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না, নাও করতে পারছে না কারন তার অবচেতন মনও চায় এক পলক মীরাকে দেখতে।।
-‘ কোথায় আসবো বলো?’

-‘ পিছন দিকটার দিকে আসবেন? হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হবার পর? ‘

মীরার কথায় সায় দিয়ে রুহিন ফোন কাটলো। মীরাকে ছাঁদে নিয়ে বসানো হয়েছে। বক্সে হলুদের গান বাজছে, একে একে সবাই মিলে মীরার গায়ে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে গেলো! মীরা যেনো চুপচাপ কাঠের পুতুলের ন্যায় বসে আছে। হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হতেই মেহেদী পরানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে গেলো। পার্লার থেকে লোকেরা মেহদি পড়াচ্ছে মীরাকে। দু হাত ভর্তি করে। মীরার খুব ইচ্ছে ছিলো রুহিন আর তার বিয়েতে সুন্দর করে মেহেদী পড়বে রুহিনের জন্য! কিন্তু সেটা কেবল ইচ্ছেতেই অপূর্ন রয়ে গেলো পূর্ন আর হলো না!

-‘ আপু এই শেপটায় তো আপনার হাজবেন্ডের নাম লিখতে হবে উনার নামটা বলুন?’

-‘ ওটা খালি রেখে দিন লিখতে হবে না। ‘

খুব ইচ্ছে ছিলো এখানে রুহিনের নাম লিখবো কিন্তু কা যখন হচ্ছেই না তখন থাকুক না সে জায়গাটা ফাকা পড়েই!এমনিতেও মনের জায়গাখানিও রুহিনের জন্যই কেবল সীমাবদ্ধ রয়েছে সেখানে হাতে কেনো তন্ময়ের নাম লিখবো? ওটা খালিই থাকবে!

সকল অনুষ্ঠান শেষ করে ফ্রেশ হবার নাম করে গায়ে একটা বড়ো চাদড় পেচিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ির পিছন দিকটায় রুহিনের জন্য!
অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটির দেখা পেলাম এই মানুষটিরইতো হতে চেয়েছিলো কিন্তু হতে পারি নি , গায়ে হলুদের সাজে সেজেছি কিন্তু অন্য কারোর জন্য! রুহিনের জন্য নয় অথচ সেই রুহিন আমার চোখের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে এটা যে কতোটা কষ্টের সেটা আমি কি করে বোঝাবে কাউকে? উনাকে দেখেই কান্না করে দিলাম। দৌড়ে গিয়ে উনার বুকে লুটিয়ে পড়লাম! শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম মানুষটাকে। যেনো বহুদিনের তৃষ্ণা মিটেছে আজকে উনাকে জড়িয়ে ধরে! এ যেনো মরুর শুকনো বুকে তৃষ্ণা মেটানো। এই তো সেই শান্তি, সেই ভালোবাসা যা আমি সর্বদা চেয়ে এসেছি!

#চলবে?

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here