যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ পর্ব -০৫

যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ (৫)
~মিহি

৫.
মাহিদ ভেবেছিল সন্ধিকে বেশ কয়েকটা কড়া কথা শোনাবে। এই উঠতি বয়সে আবেগে গা ভাসানো উচিত নয়-এ প্রসঙ্গে লম্বা একটা লেকচারও প্রস্তুত করেছিল সে কিন্তু সন্ধির হাতের ব্যান্ডেজ দেখে আর কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না। বাম হাত ভেঙেছে মেয়েটা সিঁড়ি থেকে পড়ে! অবশ্য যে লাফঝাপ স্বভাবের মেয়ে, সিঁড়ি থেকে পড়বে না তো কী আর হবে! সন্ধির চোখমুখ লাল। শুধু পড়ে যাওয়ার ব্যথায় নয়, হয়তোবা অন্য কোনো কারণ আছে। কারণ উদঘাটনের ব্যর্থ চেষ্টা করলো না সে। ক্লাসে ঢুকেই সবাইকে প্যারাগ্রাফ লিখতে দিল। একসময় খেয়াল করলো সন্ধি লিখছে না। প্রথমে মাহিদ ভেবেছিল হয়তো ইচ্ছে করেই লিখছে না কিন্তু তার অসহায় দৃষ্টি দেখে মাহিদের কিছুটা খারাপ লাগলো। সন্ধির দিকে এগোলো সে।

– ‘সন্ধি, লিখছো না কেন?’

– ‘স্যার, মার্জিন টানতে পারছি না।’

– ‘স্কেল এদিকে দাও।’

মাহিদ মার্জিন টেনে দিল। সন্ধি একটা শুকনো ধন্যবাদ জানালো, বাড়তি একটা শব্দও নয়। মাহিদের বিশ্বাস হচ্ছে না টেক্সটগুলো তাকে সন্ধি করেছে। পিয়নটা নির্ঘাত ভুল নাম বলেছে তবুও সন্ধির থেকে নিশ্চিত হতে পারলে ভালো হত।

– ‘আচ্ছা সন্ধি, বাই এনি চান্স তুমি কি আমায় টেক্সট করেছিলে?’

– ‘আমার নিজস্ব ফোন নেই স্যার আর ফোন ইউজ করা এলাও করেনা বাড়িতে।’

মাহিদ ভ্রু কুঁচকাল। কী যেন ভেবে সন্ধির পাশ থেকে সরে আসলো। সন্ধি যে টেক্সট করেনি এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। মেয়েটা অন্যসব মেয়েগুলোর মতো আবেগী না, বয়সের তুলনায় সবসময় একটু পরিণত।

মাস দুয়েক পেরিয়েছে। সন্ধির হাত এখন ঠিক আছে। দু’মাসে নয়ন বেশ কয়েকবার এসেছিল সন্ধির সাথে দেখা করতে তবে স্কুল-প্রাইভেটের বাহানায় মোটে তিনবারের ব্যতীত দেখা করতে পারেনি। বাবা অবশ্য এখনো নয়নের আসার কথা জানেন না। সায়েরা জামানের কড়া নির্দেশ বাবার কানে যেন এসব না যায়। সন্ধিও মায়ের বাধ্য মেয়ের মতো সব মেনে নিয়েছে। সামনের সপ্তাহে প্রি-টেস্ট পরীক্ষা। অন্য বিষয়গুলোতে মোটামুটি পাশ করার মতো অবস্থা হলেও ইংরেজিতে বরাবরই ডাব্বা মারা ছাত্রী সন্ধি। আগের মাসের সারপ্রাইজ টেস্টেও সে ইংরেজিতে পেয়েছিল চার তাও কিনা পঞ্চাশে। ক্লাসের সবাই যেখানে পেল ত্রিশের উপরে, সেখানে সে একাই কিনা চার! মাহিদ অবশ্য এ নিয়ে সন্ধিকে বকাঝকা করেনি কিন্তু বুঝিয়েছিল ইংরেজি বিষয়টা সহজ না, বুঝে এগোতে হবে। প্রি টেস্টের রুটিন দিয়েছে। প্রথমেই ইংরেজি দ্বিতীয়। সন্ধির ইচ্ছে করছে এক গ্লাস পানিতে ডুবে মরতে। মাহিদ সন্ধির অবস্থাটা বুঝেছে। সন্ধিকে ছুটির পর থেকে বিকাল চারটা অবধি সময়ও দিতে চেয়েছে কিন্তু সমস্যাটা সন্ধির। বাড়িতে দেরিতে গেলে মা তার হাড়গোড় আস্ত রাখবেন না। বিধায় মাহিদের দেওয়া প্রস্তাবটা বৃথা গেল।

ছুটির পর তূর্ণাকে দেখতে পেল সন্ধি। ডাকতে গিয়েও ডাকলো না। তূর্ণা তাকে না দেখার ভান করে তার ক্লাসের দুটো মেয়ের সাথে দিব্যি হেঁটে গেল। মেয়ে দুজনকে ভালোমতো চেনে সন্ধি। একজন ইলা, রাফির বন্ধুর প্রেমিকা, আরেকজন সুরভী, রাফির বেস্টফ্রেন্ড। সন্ধি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। প্রয়োজনের বন্ধু ছিল তারা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্টাফ রুমের পেরোতে নিতেই মাহিদ ডাকলো তাকে। চোখ পিটপিট করে সেদিকে তাকালো সন্ধি। অতঃপর মাহিদের ডেস্কের কাছে এগোলো।

– ‘জ্বী স্যার, কিছু বলবেন?’

– ‘আমার তোমার বাড়িতে কথা হয়েছে। তুমি চারটা অবধি সব ডাউট ক্লিয়ার করে তারপর বাসায় যাবে। পরীক্ষার আগের সাতদিন এটাই তোমার রুটিন।’

– ‘ইন্না লিল্লাহ..কাকে কল দিয়েছেন আপনি?’

– ‘তোমার বাবাকে। যাই হোক, সেসব ভাবা তোমার কাজ না। চুপচাপ খাতা বের করো বসে।’

সন্ধি অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো মাহিদের দিকে। অতঃপর খাতা বের করলো। মাহিদ প্র্যাকটিস শীট থেকে বেশ কয়েকটা গ্রামাটিক্যাল আইটেম বোঝালো সন্ধিকে। করতেও দিল বেশ কয়েকটা, সন্ধি পারলো না খুব একটা। মেয়েটার বোঝার ঘাটতি রয়েছে এখনো। টেনে ওঠা একটা মেয়েকে যদি হাতে ধরে আর্টিকেল বোঝাতে হয়, তাহলে তাকে ট্রান্সফরমেশন, ট্যাগ, সাফিক্স-প্রিফিক্স বোঝাতে যে কী পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হবে ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাহিদ।

_________________________________________________

তূর্ণা-রাফি, ইলা-নিহাল, সুরভী আর তানজীম এসেছে একটা রেস্টুরেন্টে। রাফি মূলত সামনের সপ্তাহে তূর্ণার বার্থডে উপলক্ষে পরীক্ষার আগেই একটা ট্রিটের আয়োজন করেছে। তূর্ণা বরাবরই লজ্জারত অবস্থায় রাফির পাশে বসে আছে। রাফি আড়চোখে তূর্ণার দিকে তাকাচ্ছে। বাকিরা খেতে ব্যস্ত। খাওয়া শেষ করে তূর্ণাকে নিয়ে বাইক রাইডিংয়ে যাওয়ার কথা ছিল রাফির। কিন্তু রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার পরপরই অনেকটা অসুস্থ হয়ে পড়ে তূর্ণা। রাফির বাগানবাড়ি পাশেই। বন্ধুদের থেকে বিদায় নিয়ে সে তূর্ণাকে তার বাগানবাড়িতে নিয়ে আসে।

– ‘তূর্ণা, ঠিক আছো তুমি?’

– ‘হুহ।’

– ‘পানি খাবে একটু?’

– ‘না।’

তূর্ণাকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে বাইরে আসে রাফি। ফাঁকা বাড়িতে কোনোভাবেই তূর্ণার কাছাকাছি থাকতে ইচ্ছুক না সে। বয়সটা খারাপ। রাফি আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও তূর্ণা হয়তো পারবে না। রাফি হাতজোড়া মুষ্টিবদ্ধ করছে বারবার। প্রচণ্ড অস্বস্তি আর যন্ত্রণায় শরীর অসাড় হয়ে আসছে তার। তূর্ণার গোঙানির শব্দে হতচকিত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো সে। তূর্ণাকে বালিশে হেলান দিয়ে বসালো।

– ‘ঠিক আছো তুমি?’

– ‘হুহ। আমি কোথায়?

– ‘চিন্তা করো না। একটু বিশ্রাম নাও। তারপর আমি বিকেলে তোমায় বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবো।’

– ‘আ..আমি ঠিক আছি।’

– ‘আচ্ছা। আমি বাইরে আছি। বিশ্রাম নেও একটু।’

রাফি উঠতে নিতেই তূর্ণা তার হাতটা ধরে। তূর্ণার হাত কাঁপছে। রাফি ইতোঃমধ্যে ঘামতে শুরু করেছে। তূর্ণাকে প্রশ্রয় দেওয়া মানেই বিপত্তি বাঁধিয়ে ফেলা। তূর্ণা রাফির চেয়ে ছোট, আবেগের বশে ভুলের স্রোতে গা ভাসাতে চাচ্ছে কিন্তু রাফির পক্ষেও সম্ভব হচ্ছে না নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা। তূর্ণার কাতর দৃষ্টি ঘায়েল করছে তাকে। তূর্ণার অধরযুগলের দিকে ক্রমশ এগোল রাফি। আলতোভাবে নিজের হাতজোড়া দিয়ে তূর্ণার চোখ ঢেকে ঠোঁটে মৃদু স্পর্শ করেই সরে এলো সে। উঠে বসার আগেই তূর্ণা শক্তভাবে রাফির বাহু চেপে ধরলো। রাফি বসলো পাশে।

– ‘এভাবে কাতর দৃষ্টি ফেলো না তূর্ণা, আমার নিজেকে সামলানো কষ্টকর হয়ে যাবে। তোমার উপর কোনো কলঙ্কের দাগ আমি লাগাতে দিতে পারি না।’

– ‘হুশশশ! চুপ।’

তূর্ণা ছোট্ট বিড়ালছানার মতো রাফির গায়ের সাথে লেপ্টে যাওয়ার চেষ্টা করে। রাফি সরাতে চেয়েও পারছে না। এই বাচ্চা মেয়েকে কেন এখানে আনলো ভেবেই কপাল চাপড়াচ্ছে সে। তার চেয়েও বড় ভুল করে ফেলেছে তূর্ণাকে প্রশ্রয় দিয়ে।

– ‘এই এই সোনা! শোনো না, পিচ্চি?’

– ‘হুহ। শুনছি।’

– ‘বাসায় যেতে হবে না?’

– ‘পরে। তোমার কাছে থাকবো।’

– ‘এক থাপ্পড় দিব রে! সব নেশা কেটে যাবে।’

– ‘এত রুড কেন তুমি?’

তূর্ণার বাচ্চামির কাছে যেন আবারো হতাশ হলো রাফি। তূর্ণার মধ্যে ভাবান্তর দেখা গেল না। রাফির শার্ট কুঁচকে গেছে তূর্ণার হাতের চাপে। দু-চারটে বোতাম যে ছেঁড়েনি এটা রাফির ভাগ্য। নাহ! এভাবে তো সম্ভব না। এই মেয়েটাকে কিভাবে সামলাবে সে।

রাফি ভেবেছিল তূর্ণাকে বুঝিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবে কিন্তু মেয়েটার রাগ সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা ছিল না রাফির। টেবিল ল্যাম্প ভেঙে ফেলেছে মেয়েটা। সারা ঘরে পর্দা টাঙানো। এ পর্দা সরালে নাকি তূর্ণা রাফিকে তুলে আছাড় মারবে। রাফি বেচারা এককোণে বসে দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে আর ভাবছে কী করে এই মেয়েকে বাড়িতে ফেরত পাঠাবে। একটু পর সন্ধ্যে হয়ে আসবে। এখন যদি তূর্ণা বাড়ি না ফেরে, সর্বনাশ হয়ে যাবে। অবশ্য এখানেও সর্বনাশ হওয়ারই প্রস্তুতি চলছে। তূর্ণার এগিয়ে আসা দেখেই বুকের ভেতর ধক করে উঠল রাফির। প্রথমবারের মতো নিজের ইজ্জত হারানোর আশঙ্কা হলো তাও নিজের চেয়ে ছোট একটা মেয়ের কাছে। আতঙ্কে সমানে হেঁচকি উঠতে লাগল তার।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here