যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ পর্ব -০৬

যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ (৬)
~মিহি

৬.
রাফির ভেজা শার্টটা হ্যাঙ্গারে ঝুলছে। খালি গায়ে থাকতে কিছুটা বিব্রত লাগছে তার কিন্তু উপায় নেই। তূর্ণার দিকে তাকাতেই মুখটা আরো চুপসে যায় রাফির। সন্ধ্যে ছ’টা বাজতে চললো। মেয়েটা বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। একটু আগে বমি করে রাফির পুরো শার্ট নষ্ট করে ফেলেছে। বেচারা রাফি শার্ট খুলতেও দ্বিধা করছিল তূর্ণার সামনে। বমি করে তূর্ণা বিছানায় পড়েই ঘুম। তারপর রাফি তূর্ণার মুখ, নিজের শার্ট সব পরিষ্কার করেছে। কাবার্ডের চাবিটা থাকলে আরেকটা শার্ট বের করে পড়া যেত কিন্তু চাবিও আনেনি সে। মাগরিবের আযান কানে আসতেই লাফ দিয়ে ভেজা শার্টটাই গায়ে জড়ালো রাফি। তাড়াহুড়ো করে তূর্ণাকে ঘুম থেকে তুলল।

– ‘তূর্ণা! এই, উঠো! আমার শাশুড়িমা কিন্তু আর বাড়িতে তুলবে না তোমাকে।’

– ‘মা..মানে! কয়টা বাজে?’

– ‘ছ’টা। তাড়াতাড়ি চলো।’

– ‘তুমি এরকম শার্টের বোতাম খুলে রেখেছো কেন? এই তুমি কী করেছো আমার সাথে? ছিঃ! তোমায় আমি ভালো ভাবতাম। (কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে)

– ‘বাহ বাহ! নিজেই আমার ইজ্জত নিয়ে কুতকুত খেলে আমাকেই দোষ দেওয়া হচ্ছে? তুমি আমার সাথে কী কী করেছো জানো?’

– ‘আমি করেছি? আমি আবার কী করলাম?’

– ‘শার্ট খুলবো? দেখবা বুকে কয়টা নখের দাগ বসাইছো? ঠোঁট তো কামড়েই শেষ করলা।’

– ‘ছিঃ! মিথ্যাবাদী। আমি কেন করবো এসব?’

– ‘আচ্ছা বাবা, স্যরি। এসব কিছু হয়নি তবে হতে পারতো। তুমি নিজের জ্ঞানে ছিলে না, পাগলামি করছিলে। তারপর বমি করে আমার শার্ট নষ্ট করেছো। এজন্যই শার্ট ধুয়ে দিয়েছিলাম। এখন চলো বাড়িতে।’

– ‘সত্যি কিছু হয়নি তো?’

– ‘উমম..একটা চুমু খেয়েছিলাম। এর জন্য যা শাস্তি দিবেন মাথা পেতে নিব।’

রাফির কথায় প্রচণ্ড লজ্জা পেল তূর্ণা। দুহাতে মুখ ঢাকলো। রাফি মুগ্ধ নয়নে সেদিকে তাকালো কিছুক্ষণ।

– ‘লজ্জাবতী লতা, এত লজ্জা আগে কোথায় ছিল? এখন বাড়িতে চলেন প্লিজ।’

– ‘হুহ।’

উঠে দাঁড়াতেই পড়ে যেতে ধরলো তূর্ণা। রাফি আলতো হাতে ধরলো তাকে। তূর্ণা ইশারায় বোঝালো সে ঠিক আছে। এ অবস্থায় তূর্ণাকে বাইকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে না রাফি কিন্তু এখন এই এলাকায় গাড়িও পাওয়া যাবে না। বাধ্য হয়েই তূর্ণাকে বাইকে বসতে বলে সে। তূর্ণা বেশ শক্তি করেই রাফিকে ধরে রাখে। রাফির চোখেমুখে আতঙ্ক। একে তো সন্ধ্যে পেরিয়েছে তার উপর তূর্ণাকে ঠিকমতো বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার চিন্তা।

বিকেলে বাড়ি ফিরেই নয়নের মুখটা দেখতে হয়েছে সন্ধিকে। এ নিয়ে সে রীতিমতো বিরক্ত। সপ্তাহ পেরোলেই তার পরীক্ষা অথচ মা কিনা উটকো ঝামেলা ঘরে এনে বসিয়ে রেখেছেন। এই মুহূর্তে সন্ধির যে পরিমাণ রাগ হলো, তার তাপে নয়নের ঝলসে যাওয়ার কথা। নয়ন সন্ধিথ রাগের মাত্রা বুঝলো না উল্টো গালগল্প জুড়ে বসলো। সন্ধির ইচ্ছে করছিল লোকটাকে মুখের উপর বেরিয়ে যেতে বলতে কিন্তু নিতান্তই ভদ্রতার খাতিরে বলতে পারলো না। নয়নের বকবক চলছে তো চলছেই, সেসব এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করছে সন্ধি।

– ‘সন্ধি, কিছু বলছো না যে?’

– ‘আসলে নয়ন ভাই, আমার সামনে পরীক্ষা।’

– ‘তুমি কী বিরক্ত আমার উপর?’

– ‘আমি তা বলিনি তবে এইমুহর্তে আমি আপনার সাথে গল্প করার মতো অবস্থায় নেই। দয়া করে আমার পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগ অবধি এ বাড়িতে আসবেন না।’

– ‘এটুকু ব্যাপার? আচ্ছা বেশ।’

নয়ন বেশ হাসিমুখে কথাগুলো বলে গেলেও দ্বিধা কাটলো না সন্ধির। মাহিদ স্যার এক গাদা কাজ দিয়েছে করতে। না করলে নাকি শাস্তিও দেবে। প্রচণ্ড বিরক্ত লাগছে তার। ফ্রেশ হয়ে বই নিয়ে বসতেই চেঁচামেচির শব্দ কানে আসে। তূর্ণার ক্রন্দনরত কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে চটজলদি বাইরে আসে। দেখতে পায় তূর্ণার মা বেশ রুক্ষ কণ্ঠে চেঁচাচ্ছেন তূর্ণার উপর।

– ‘কী হয়েছে চাচী? আপনি এভাবে বকছেন কেন তূর্ণাকে?’

– ‘কী করবো এই মেয়েকে নিয়ে বলো। এই সাঁঝবেলায় বাড়ি ফিরেছে। সারাদিন কোথায় ছিল কোনো খোঁজ নেই।’

– ‘চাচী, ও তো লাইব্রেরিতে ছিল। স্যার ওকে লাইব্রেরির বই সেট করার দায়িত্ব দিয়েছেন।’

– ‘তাই? কই, ও তো বলছিল না কিছু।’

– ‘ভয়ে হয়তো। বেচারীকে এভাবে বকা দিয়েন না আর।’

সন্ধির কথায় আশ্বস্ত হলেন তূর্ণার মা। তূর্ণার দিকে বক্রচোখে তাকিয়ে বললেন, ‘এসো! খেয়ে উদ্ধার করো আমাকে।’ তূর্ণা সন্ধির দিকে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘরে ঢুকলো। সন্ধি চাইলেই সত্যিটা বলতে পারতো তাতে তূর্ণা হয়তো এ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারত কিন্তু তাতে তূর্ণা সারাজীবন সন্ধিকে ভুল বুঝে যেত। এর চেয়ে সে নিজেই সময়ের সাথে সাথে উপলব্ধি করুক যে এখনি সম্পর্কে জড়ানোটা উচিত নয় তার জন্য। বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়াল সে। মাহিদ স্যারের দেওয়া এক বস্তা হোমওয়ার্ক করতে হবে এখনো। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সন্ধি।

তূর্ণার গলা দিয়ে খাবারটাও ঠিকমতো নামল না। পড়ার কথা বলে মায়ের থেকে বেশ তাড়াহুড়ো করে ফোনটা নিয়ে ঘরে ঢুকল। পরপর বেশ কয়েকবার রাফির নম্বরে কল করলো। কল ঢুকছে কিন্তু রাফি রিসিভ করছে না। অজানা আশঙ্কায় হৃদস্পন্দন হ্রাস পেতে থাকলো তার। একে তো নিজেকে রাফির সাথে ঐ অবস্থায় দেখা, তার উপর রাফির এখন ফোন না ধরা, চিন্তায় গলা শুকিয়ে আসছে তূর্ণার। ফোনটা হাতে নিয়েই শুয়ে পড়ল সে।

রাত একটা। ফোনের ভাইব্রেশনে ঘুম ভাঙতেই লাফ দিয়ে উঠলো তূর্ণা। রাফির নম্বর দেখে তাড়াতাড়ি রিসিভ করলো।

– ‘রাফি..কল রিসিভ করোনি কেন তুমি? জানো আমি কত টেনশনে ছিলাম?’

– ‘স্যরি পাখি। বাইকে ছিলাম।’

– ‘এতক্ষণ?’

– ‘বাড়িতে গিয়েছিলাম। বাবা একটা কাজে পাঠিয়েছিল বাইরে। ফিরতে ফিরতে রাত হলো। মাত্র বাসায় ফিরলাম তারপর তোমায় কল দিলাম।’

– ‘আচ্ছা তাহলে খেয়ে ঘুমাও।’

– ‘পেট তো তোমার চুমুতেই ভরে গেছে।’

– ‘লজ্জা দিও না তো। ঘুমাও।’

বলেই কল কাটলো তূর্ণা। লজ্জায় গাল লাল হয়ে এসেছে তার। এতক্ষণ যে আশঙ্কায় মন স্তব্ধ হয়েছিল তার, তা এখন আর নেই। নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়ে সে।

মাহিদের ফোনে টেক্সট আসা বন্ধ হয়েছে। তবে মাহিদ সন্ধির কল এক্সপেক্ট করছিল। সন্ধিকে সে বলেছিল কোন সমস্যা থাকলে যেন কল করে। সন্ধিকে নম্বরও দিয়েছিল কিন্তু মেয়েটা কল দিল না। মাহিদের নিজের উপর হাসি পাচ্ছে। বাচ্চা একটা মেয়ের কলের জন্য এমন পাগলামি করছে সে। কী অদ্ভুত!

সন্ধির প্রতি মাহিদের অনুভূতি রঙ বদলাচ্ছে ইদানিং। সন্ধিকে গ্রামার বোঝাতে গিয়ে নিজেই অনুভূতির রঙ বেরঙের গ্রামার শিখছে। সন্ধি এমনিতে চুপচাপ থাকলেও একবার ফ্রি হয়ে গেলে প্রচুর কথা বলে। মাহিদ যা উপলব্ধি করছে। সন্ধি এখন নিজের দিনরাত ২৪ ঘণ্টার এক মুহূর্তের কথাও মাহিদের সাথে শেয়ার না করে থাকে না। অনেকটা ফ্রি হয়ে গেছে এক সপ্তাহের মধ্যেই। কাল থেকে পরীক্ষা শুরু। এতদিনে একদিনও মাহিদের ফোনে সন্ধির কল আসেনি। পরীক্ষার আগের রাতে সাড়ে দশটা নাগাদ মাহিদের ফোনে সন্ধি কল করলো। সন্ধির মা বাড়িতে নেই। তিনি গেছেন তার বোনের সাথে দেখা করতে। সন্ধির বাবা এক কাজে শহরের বাইরে আছেন তাই মা যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। সন্ধি বাড়িতে একা বলেই কল করার দুঃসাহসটা করতে পেরেছে। মা ফোনটা রেখে গেছেন যেন কোনো বিপদ হলে সন্ধি কল করতে পারে।

অপরিচিত নম্বর দেখে প্রথমবার কল রিসিভ করলো না মাহিদ। পরক্ষণেই সন্ধির কথা মনে পড়লো। কল ব্যাক করলো সে। সাথে সাথে রিসিভ করলো সন্ধি।

– ‘বলো সন্ধি।’

– ‘আপনি কী করে জানলেন আমি কল করেছি?’

– ‘গেস করলাম। যাই হোক, বলো কী সমস্যা।’

– ‘আমি কিছু বুঝছিনা স্যার। এত কঠিন কেন ইংরেজি?’

– ‘কোথায় সমস্যা হচ্ছে বলো। কিভাবে সাহায্য করতে পারি?’

– ‘কালকের পরীক্ষার প্রশ্নটা দিয়ে দেন আমাকে।’

– ‘প্রশ্ন তো আমি একা করিনি। করলেও দেওয়াটা আমার ক্ষমতার বাইরে, বুঝলা পিচ্চি? এখন পড়ো।’

– ‘আমার দ্বারা হচ্ছে না। আমি নির্ঘাত কাল ফেইল করবো।’

– ‘এসব আজগুবি চিন্তা বাদ দিয়ে পড়ো রে পাগলী।’

– ‘আচ্ছা।’

মাহিদ কল কেটে দিল আচমকা। সন্ধির মন খারাপ হয়ে গেল। পড়া সে শেষ করেছে। কালকের পরীক্ষায় আরামে পাশ করতে পারবে কিন্তু মাহিদের সাথে কথা বলার জন্য সে বাহানা খুঁজছিল অথচ মাহিদ তার কথা না শুনেই কল কেটে দিল। মন খারাপ করে ফোন বন্ধ করে দিল সন্ধি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here