যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ পর্ব -০৭

যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ (৭)
~মিহি

৭.
পরীক্ষার প্রশ্ন দেখে ভ্রু কুঁচকাল সন্ধি। পাস নম্বর অনায়াসে উঠে যাবে কিন্তু লিখতে ইচ্ছে করছে না তার। মাহিদের উপর একপ্রকার চাপা অভিমান কাজ করছে। একবারই তো কল দিয়েছিল, তার জন্য মুখের উপর কল কাটতে হয়? একটুও মায়া-দয়া নেই! প্রশ্ন পড়তে পড়তে কলমের হেড মুখে দিল সন্ধি। হেড কামড়াতে কামড়াতে সামনে চোখ পড়তেই দেখল মাহিদ এ রুমেই আসছে। মানে গার্ডে মাহিদ স্যারও থাকবে! ঢোক গিলল সন্ধি। মাহিদকে দেখলেই তার হাত পা কাঁপতে থাকে। এখন যদি মাহিদ এসে গার্ড দেয়, সন্ধি তো এক হরফও লিখতে পারবে না। কোনোরকম মুখ লুকিয়ে খাতায় লেখা শুরু করল সে।

মাহিদের চোখজোড়া সন্ধিকে খুঁজছে। রাতে ফোন অফ হয়ে যাওয়ার পর চার্জে দিয়ে অনেকবার সন্ধির নম্বর ট্রাই করেছে সে কিন্তু সন্ধির নম্বর বন্ধ ছিল। সন্ধি যে মাহিদের উপর কিছুটা হলেও রাগ করেছে তা স্পষ্টতই বুঝেছে মাহিদ। সন্ধির পাশে এসে দাঁড়ালো সে। সন্ধি একমনে লিখছে। মাহিদের দিকে তার ধ্যান নেই। যেই না পাশ ফিরে মাহিদকে দেখলো, অমনি সন্ধির হাত থেকে কলমটা পড়ে গেল। মাহিদ হালকা হেসে কলমটা তুলে দিয়ে সরে এলো। সারা ঘরে পিনপতন নীরবতা। গার্ডে বিজ্ঞানের শিক্ষক তুরাগ স্যারও রয়েছেন। তার ক্লাস আছে। আধঘণ্টা পেরোতেই তিনি ক্লাসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলেন। মাহিদ একটু পরপর সন্ধির পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে। একটা সময় অনেক দ্ফিধা সংকোচের পর বলেই ফেলে, ‘স্যরি, আমি কিন্তু ইচ্ছে করে কল কাটিনি কাল রাতে। ফোন অফ হয়ে গিয়েছিল। ফোন অন করে তোমায় কল করতে নিয়ে দেখি তোমার নম্বর বন্ধ।’ বলেই সরে আসলো মাহিদ। সন্ধির হাত যেন কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। মাহিদ তাকে কেন কৈফিয়ত দিলো? সে তো কিছু জিজ্ঞাসাও করেনি? মাহিদ কি তবে আন্দাজ করেছে সন্ধির রাগ? মাহিদের কৈফিয়ত দেওয়াটা বেশ ভালো লেগেছে সন্ধির। না চাইতেও ঠোঁটে বারবার হাসির রেখে ফুটে উঠছে। মাহিদ লক্ষ করেছে সেটা।

সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা। পরীক্ষা শুরু হয়েছে দেড় ঘণ্টা আগে। আরো দেড় ঘণ্টা পরীক্ষা। অনেকে খাতা জমা দিয়ে চলে যাচ্ছে। ইংরেজি পরীক্ষা, লেখা কম তাই অনেকেরই শেষ। কেউ কেউ আবার পাস নম্বর লিখেই খাতা দিয়ে চলে যাচ্ছে। ক্লাসে এখন হাতে গোণা দশ-বারোজন মেয়েরা বসে আছে। ছেলেদের পরীক্ষা অন্য রুমে হচ্ছে। ছেলে-মেয়ে আলাদা আলাদা ক্লাস হয়, পরীক্ষাও আলাদা রুমে। একটু পরপর মেঘের শব্দ কানে বাজছে। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ চলে গেল। গ্রামের স্কুল, আইপিএস বা জেনারেটর নেই। স্টুডেন্টরা অল্প আলোতেই পরীক্ষা দিচ্ছে। মাহিদ এবার সন্ধির পাশের বেঞ্চটাতে বসে পড়লো। মাহিদকে পাশে বসতে দেখে সন্ধি বিরক্তিতে ‘চ’ কারান্ত শব্দ করলো। মাহিদ তা বুঝে যেন মনঃক্ষুণ্নই হলো কিছুটা।

– ‘বুঝিনা এটুকু পিচ্চি মেয়ের এত রাগ কেন।’

– ‘বোঝেন না যখন তখন বোঝার চেষ্টা করে লাভ কী? আপনার কাছে তো কেউ কৈফিয়ত চায়নি।’

– ‘বাব্বাহ! কী দেমাগ! এমন করে আমার সাথে আগে কেউ কখনো কথা বলেনি। আমায় দেখতে নাকি রাগী লাগে, সেই আমার মতো রাগী মানুষের সাথে রাগ দেখানোর কি আর সাধ্যি থাকে কারো?’

– ‘আপনার মনে হচ্ছে না আপনি নিজের ঢোল নিজে পিটাচ্ছেন?’

– ‘উহু! আমি তো বলছিলাম শুধু। আর তুমি কীসব লিখছো? কাকের ঠ্যাঙ, বকের ঠ্যাঙ! এই লেখা পড়তে গেলে তো আমার প্লাস পাওয়ারের চশমা পড়তে হবে।’

– ‘তো পড়বেন। চশমা পড়লে আপনাকে খারাপ তো আর লাগবে না, বরং ভালোই লাগবে।’

সন্ধির কথাটা মনে ধরলো মাহিদের। আসলেই কি তাকে চশমা পড়লে ভালো লাগবে? লাগতেও পারে। আনমনে নানা কথাবার্তা ভাবতে ভাবতে সন্ধির সাথে কথা বলতেই থাকলো সে। অনেকটা সময় পেরিয়েছে। আর দশ মিনিটের মতো আছে। সবাই খাতা দিয়ে চলে গেছে। সন্ধি এখনো লিখেই যাচ্ছে, মেয়েটা এত কী লিখছে কে জানে! টাইম শেষ হতেই মাহিদ খাতা কেড়ে নিল। তা নিয়ে সন্ধির রাগ যেন আরেক দফা বাড়লো। আর দুটো লাইন ছিল, তাও লিখতে দিল না! নাকের ডগায় রাগ নিয়ে হলত্যাগ করলো সন্ধি। পেছনে আশাহত দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে সন্ধির পিছনে ফিরে তাকানোর দৃশ্য দেখার জন্য চাতক পাখির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল মাহিদ কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না। সন্ধি তাকালো ঠিকই তবে বেশ রাগান্বিত দৃষ্টিতে মাহিদকে ভেংচি দিয়ে চলে গেল। মাসিদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। অতঃপর হাসতে হাসতে স্টাফরুমের দিকে এগোলো খাতার বান্ডিল হাতে নিয়ে।

__________________

বাড়িতে ঢুকতেই বাবার রুক্ষ কণ্ঠস্বর কানে ভেসে উঠলো সন্ধির। কোনরকম দৌড়ে ঘরে ঢুকতেই দেখল বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া চলছে। এ ঝগড়া নতুন নয় সন্ধির কাছে তবে বাবার রক্তিম মুখ বড়সড় বিপদের আভাস দিচ্ছে। যত রাগই হোক, বাবা কখনো মাকে দোষারোপ করেন না বরং মা বাবাকে বকেন, গালি দেন। বাবা মাথা পেতে নেন সবটা। বাচ্চার অভিমান ভাঙানোর মতো করে মায়ের রাগ ভাঙান। এত ভালোবাসা মায়ের ভাগ্যে অথচ তিনি উপেক্ষা করেন বারংবার। ঘরে প্রবেশ করতেই সন্ধি বুঝলো আজকের ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি রকমের কোন কারণে ঘটেছে। বাবার ফেরার কথা আজ রাতে অথচ বাবা দুপুরেই ফিরেছেন। ফিরে মাকে না পেয়ে তূর্ণার মা কাকীকে জিজ্ঞাসা করেছেন। তিনি বলেছেন মা বাড়িতে নেই। ব্যস! বাবা কোনোভাবে জেনেছেন সন্ধি রাতে একা ছিল বাড়িতে। মা দুপুরে আসতেই এ নিয়ে দুজনের মধ্যে ঝগড়াঝাটি শুরু হয়েছে। বাবার প্রশ্ন একটাই যে মা কোথায় ছিল। এ নিয়ে যত অশান্তি। সন্ধির একবার মনে হলো বাবাকে বলে দেওয়া উচিত যে মা খালার বাড়িতে গিয়েছিল কিন্তু এ কথা যদি সন্ধি বলে তবে তার একটা হাড়ও আস্ত থাকবে না। বাবা রাগারাগি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। মায়ের সমস্ত রাগ এসে পড়লো সন্ধির উপর। দু-চারটে থাপ্পড় থেকে শুরু করে কিল-ঘুষিও বাদ রইল না। কাঁদতে কাঁদতে সন্ধি ঘরে ঢুকে কপাট লাগালো। মায়ের ফোন এখনো বন্ধ। বিছানার কাছে বালিশের নিচে রয়েছে ফোনটা। ফোন চালু করতেই সন্ধি খেয়াল করলো মিসড কল এলার্টে মাহিদের নম্বর। সত্যিই রাতে সে কল করেছিল। সন্ধির কান্না পাচ্ছে খুব। অকারণে এতগুলো মার খেল সে।

দুপুরে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়েছে সন্ধি। এখন সন্ধ্যে নেমেছে, না হয়েছে গোসল আর না খাওয়া। শরীরটাও দুর্বল লাগছে, জ্বর জ্বর ভাব। কাল পরীক্ষা নেই, পরেরদিন বাংলা পরীক্ষা। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বই মেলতে পারছেনা সে। বাটন ফোনটার রিংটোন শুনে লাফিয়ে উঠলো সন্ধি। মাহিদ স্যার ভেবে নম্বর না দেখেই অতি আগ্রহে রিসিভ করে ফোন কানে ধরলো। ‘হ্যালো…’ নয়নের কণ্ঠস্বর শোনামাত্র কল কেটে দিতে ইচ্ছে হলো সন্ধির কিন্তু নয়ন আকুতিমাখা কণ্ঠে বলে উঠলো আবারো, ‘কলটা কেটো না সন্ধি, প্লিজ।’

– ‘হুহ বলেন।’

– ‘পরীক্ষা কেমন দিলে?’

– ‘ভালো।’

– ‘খালা কই?’

– ‘বিকেলের একটু আগেই ফিরেছে মা। আপনাদের বাসায় ছিল বাবা জানতো না। এ নিয়ে রাগারাগি হয়েছে।’

– ‘খালা আমাদের বাসায় ছিল মানে? খালা তো এখানে..’

নয়ন কথা শেষ করার আগেই তার মা রামিলা ফোন কেড়ে নিলেন। অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ রে মা। ঘণ্টাখানেক আগেই বেরিয়েছে। ভালোমতো পৌঁছেছে তাহলে। আচ্ছা রাখ, নয়ন পরে কথা বলবেনি তোর সাথে।’ খালা কল কাটতেই সন্ধির খটকা লাগলো। নয়ন ভাই কী এমন বলতে চেয়েছিল যা খালা তাকে বলতে দিল না? অবশ্যই কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলেন তিনি। ভাবতে ভাবতে ফোন রেখে শুয়ে পড়লো সন্ধি। দরজা এখনো লাগানো। এ অবস্থায় ঘুমানো যাবে না। দরজা খুলে দিয়ে বাইরে উঁকি দিল সন্ধি। মা টিভির ঘরে বসে আছেন। এ সুযোগে সন্ধি ফোনটা বাইরে টেবিলে রেখে ঘরে ঢুকে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে কিন্তু এখন খেতে উঠলে মার ছাড়া কিছু জুটবে না কপালে। অগত্যা খালি পেটেই ঘুমোনোর ব্যর্থ চেষ্টা করে সন্ধি। বড়সড় অঘটনটা ঘটলো মাঝরাতের দিকে…

চলবে…

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here