যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ পর্ব -০৮

যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ (৮)
~মিহি

৮.
লোকজনের চেঁচামেচির শব্দে ঘুম ভাঙে সন্ধির। ঘর ছেড়ে বেরোতেই বাকরুদ্ধ হয়ে যায় সে। বাবাকে পাটিতে শুয়ে রাখা হয়েছে। হাতে জখমের চিহ্ন। বাবা একটু পর পর কাশছেন। পাশে দুজন মোটামতন লোক দাঁড়িয়ে। মা একরকম কান্নাকাটি চালু করেছেন। সন্ধি বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। কান্নাগুলো যেন গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে আসছে। কাঁপতে কাঁপতে বাবার হাতে হাত রাখে সন্ধি।

– ‘বাবা, কী হয়েছে তোমার? হাতে রক্ত কেন?’

– ‘কিছু হয়নি মা। ঘরে চলো।’

বাবা লোকগুলোকে ধন্যবাদ দিয়ে ঘরে ঢুকলেন। মা মুখে আঁচল গুঁজে কিছুক্ষণ কাঁদলেন আরো। বাবা ঘরে এসে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলেন। সন্ধি পাশেই বসে।

– ‘এখন বলো তো বাবা, কী হয়েছে তোমার? এত আঘাত কেন হাতে? আর তুমি কেন বাড়ি ফেলে ওভাবে রাগ করে চলে গেলে? যদি তোমার কোনো বিপদ হত?’

– ‘আর বলিস না। রাস্তায় এক ডাকাতের খপ্পরে পড়েছিলাম। ঐ বড় সাঁকোর পাশের রাস্তা তো চিনিস! ঐদিক দিয়ে ফিরছিলাম, ডাকাতরা ধরলো জাপটে। ঐ দুটো ভালো লোক ছিল বলে ফিরতে পারলাম।’

– ‘আর কখনো এমন রাগ করে যেও না, আচ্ছা বাবা?’

বাবা সন্ধির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মাথা নাড়লেন। বাবা শোয়ার পর ঘরে ফিরলো সন্ধি। বাবার রাগ করে চলে যাওয়াটা সন্ধির মনে নানান চিন্তার জন্ম দিচ্ছে তার উপর রামিলা খালার কথাগুলোও সুবিধের নয়। শীঘ্রই কোন বিপদ আসার শঙ্কা করছে সন্ধি।

পরদিনটা খারাপ গেল সন্ধির। সারাদিন জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করলো সে। বাবাও অসুস্থ। মা একা মানুষ না পারতেও সব সামলাচ্ছেন। রাতের দিকে একটু বই নিয়ে বসলো সন্ধি। বাটন ফোনটা আবার হাতে পেয়েছে সে। মা নতুন ফোন কিনেছেন তাই পুরোনোটা এখন তার। কোনোরকম বই রিডিং পড়ে ঘুমোতে যাবে এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো। রাতের নিস্তব্ধতা ঘিরে রয়েছে সারা বাড়ি। ট্যাপ থেকে পানি পড়ার শব্দও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, সেখানে কল ধরে কথা বললে তো এলাহি কাণ্ড ঘটবে। কল কেটে নম্বরটা খেয়াল করলো সন্ধি, মাহিদ স্যারের নম্বর। কাঁপা কাঁপা হাতে মেসেজ লিখলো সন্ধি, ‘কল ধরা সম্ভব না, কিছু বলবেন?’ ফিরতি মেসেজের আশা করেনি সন্ধি তবে মিনিট ঘুরতেই টুং করে একটা শব্দ হলো।

– ‘কাল তো পরীক্ষা, তাই অল দ্য বেস্ট জানানোর জন্য কল করেছিলাম। যাই হোক, ঘুমাও। শুভ রাত্রি।’

– ‘শুভ রাত্রি।’

আরো কিছু বলার ইচ্ছে ছিল সন্ধির কিন্তু মাহিদের বিদায়বার্তার বিপরীতে নতুন কিছু বলতে পারল না। তাছাড়া বাবার অসুস্থতার পর তারও মন ভালো নেই। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই রাজ্যের ঘুম এসে বাসা বাঁধে সন্ধির চোখে।

‘রাতের বুকে তারা কত
স্বপ্ন ছড়ায় গগণজুড়ে,
তাহার মতন তুমি কেন
আলো ছড়াও না আমার স্বপ্ননীড়ে।’

মাহিদ হাসে নিজের উপর। আজকাল সন্ধির কথা ভাবলেই তার মাথায় ছন্দরা ভর করে। প্রেমে পড়লে নাকি মানুষ কবি হয়ে যায়। মাহিদেরও কী তবে সেই দশা? ডায়েরীভর্তি হাবিজাবি কী কী যেন লিখছে সে। সন্ধির উপর প্রতিনিয়ত যেন একটু বেশিই দুর্বল হয়ে পড়ছে মাহিদ। ফোন থেকে চোখ সরাতেই মাহিদ খেয়াল করলো তার চাচা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। মুহূর্তেই ফোন ফেলে এগিয়ে আসে সে।

– ‘চাচাজান, আপনি? বাইরে কেন? ভেতরে আসুন।’

– ‘কিছু কথা বলতে এসেছি মাহিদ। কথাগুলো গুরুত্বপূর্ণ।’

– ‘জ্বী চাচা। সেকশন সি-এর জন্য নতুন ইংরেজি ম্যাম আসছে। আমার বন্ধুর মেয়ে, খুবই ভদ্র মেয়েটা। তোমার বাবা-মাও তাকে দেখেছিল। এখন আমার ইচ্ছে তোমার সাথে তার বিয়েটা সম্পন্ন হোক। তোমার কি অভিমত?’

– ‘চাচাজান, আমার তো পড়াশোনাই শেষ হয়নি। তাছাড়া উচ্চতর শিক্ষার শখ আমার আছে। এসবের মধ্যে বিয়ে নিয়ে ভাবতে চাচ্ছি না।’

– ‘বেশ, তবে মেয়েটার সাথে কথা বলো কিন্তু। ও সপ্তাহে একদিন সি সেকশনে ক্লাস নেবে। খুব ভদ্র ও সাহসী মেয়ে। তোমার সমবয়সী। দুজনের ভালো বন্ধুত্ব হবে দেখো। আর হ্যাঁ একটা কথা।’

– ‘জ্বী।’

– ‘সন্ধিকে নাকি অতিরিক্ত সময় নিয়ে পড়াচ্ছো। এটা করো না। এটা গ্রাম এলাকা, বাইরের কেউ জানলে বিষয়টা মোটেও ভালো চোখে দেখবে না।’

– ‘ও ইংরেজিতে বেশ দুর্বল চাচাজান যার জন্য পরীক্ষার আগে ওকে বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম।’

– ‘আচ্ছা বেশ। পরবর্তীতে খেয়াল রেখো।’

সামাদ উদ্দিন চলে যেতেই চিন্তিত ভঙ্গিতে বিছানার উপর বসে মাহিদ। তার আর সন্ধির কথা চাচাজানের কাছে কে বললো? কেউ না বললে তো চাচাজান এমন করে বলবেন না। কপালে চিন্তার ভাঁজ খেলতে লাগলো মাহিদের।

____________

রাফির পরীক্ষা ভালো যায়নি গতদিন। সেজন্য বড্ড মন খারাপ তার। তূর্ণার সাথে দেখাও করতে পারেনি। সকাল থেকে তূর্ণা একটাবার কলও করেনি। মেজাজ ক্রমশ খারাপ হচ্ছে রাফির। আর কিছুক্ষণ পর বাংলা পরীক্ষা শুরু হবে। তূর্ণা কি এসেছে স্কুলে? দরজার দিকে এগোতে যাবে এমন সময় নতুন একটা ম্যাম ঢুকলো রুমে। চেহারাটা অপরিচিত। যদিও রাফি বাইরে যেতে চাইলে তাকে যেতে দিতে বাধ্য সকলে কিন্তু রাফি জোর খাটালো না। কারো সামনে অযথা অভদ্রতা করার কোনো মানে হয় না। চুপচাপ নিজের সীটে বসে পড়লো সে। একটু পর মাহিদও আসলো রুমে। অপরিচিত মেয়েটিকে দেখে খানিকটা চমকালো। মেয়েটি প্রসন্ন মুখে এক হাত বাড়িয়ে দিল।

– ‘আমি নেহা, নতুন ইংরেজি টিচার। আপনি মেইবি মাহিদ?’

– ‘জ্বী।’

– ‘নাইস টু মিট ইউ।’

মাথা নাড়াল মাহিদ। বাড়তি একটা কথাও বললো না। নেহা তাতে বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।

ক্লাসভর্তি সব নাইন-টেনের ছেলে। অর্ধেকের নজর খাতার দিকে তো অর্ধেকের নজর নতুন ম্যামের দিকে। নেহা একমনে তাকিয়ে আছে মাহিদের দিকে- এটাও কারো দৃষ্টির আড়াল হচ্ছে না। ছেলেপেলেরা হুটহাট ‘ওওওও’ করে উঠছে, আবার কখনো ‘লা লা লা লালা’ গেয়ে উঠছে। মাহিদের ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। বার দুয়েক ধমকও দিল সে কিন্তু কাজ হলো না। নেহার সাথে কথা বলতিও বিশেষ ইচ্ছে নেই মাহিদের। সন্ধিকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব কিন্তু এভাবে হুট করে তো আর ঐ ঘরে যাওয়া যাবে না। মন খারাপ করে রইল মাহিদ।

পরীক্ষা শেষ করে রুম থেকে বেরোতেই মাহিদের উপর চোখ পড়ে সন্ধির। একটা মেয়েকে বাহুতে ধরে রেখেছে। পেছনে ছেলেরা সমানে চেঁচাচ্ছে। মেয়েটিকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আচমকা হেসে ফেলে মাহিদ। পরস্পর চোখে চোখে কী যে কথা হয় তাদের ধরতে পারে না সন্ধি তবে মাহিদের উপর প্রচুর রাগ হয় তার। অধিকার নেই রাগ করার তবুও রাগ হয়। অধিকারহীন এ রাগের আদৌ কোন ব্যাখ্যা আছে সন্ধির কাছে?

সন্ধিকে বেরোতে দেখেই মাহিদ এগোনোর তাড়া দেখাচ্ছিল। আচমকা নেহার সাথে ধাক্কা খায়। নেহা পড়ে যেতে নিলে আলতো ভাবে ধরে মাহিদ। তাতেই আশেপাশে শোরগোল শুরু। নেহাকে ছেড়ে সন্ধির দিকে লক্ষ করতেই মাহিদ খেয়াল করলো সন্ধির রাগী মুখ। ইচ্ছে করেই নেহার দিকে তাকিয়ে হাসলো মাহিদ। সন্ধিকে আরেকটু রাগানোর চেষ্টা করছিল আর কী কিন্তু সন্ধি যে এতটা রেগে যাবে বুঝতে পারেনি মাহিদ। সন্ধির রেগে প্রস্থান করা দেখেই সেদিকে দৌড় দিল মাহিদ।

– ‘এই সন্ধি শুনো।’

– ‘আমার কাছে কী দরকার আপনার?’

– ‘আরে থামো রে।’

মাহিদের কথা উপেক্ষা করে আরো দ্রুত হাঁটতে থাকে সন্ধি। বটতলার কাছে আসতেই মাহিদ সন্ধির হাত ধরে টান দেয়। সন্ধি কিছুটা বিরক্ত হয়ে তাকায় মাহিদের দিকে। মাহিদ খেয়াল করে সন্ধির চোখ ছলছল করছে। নিজের উপর অসীম রাগ হয় মাহিদের। সন্ধিকে রাগাতে গিয়ে কষ্ট দিয়ে ফেলল! এ কষ্ট এখন মুছবে কী করে? সন্ধি মেয়েটা মারাত্মক আবেগী হয়ে পড়েছে ইদানিং। কী করে সামলাবে এই পিচ্চিকে সে?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here