যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ (১২)
~মিহি
১২.
নয়ন কথা রেখেছে। সে ঠিকই সন্ধিকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে কিন্তু রামিলা পারভীন যে এতে অখুশি তা দিব্যি বুঝতে পারছে সন্ধি। একদিকে বাবার সাথে যোগাযোগ করতে না পারাটাও তাকে পীড়া দিচ্ছে। মায়ের কথা না শুনে সেদিন পালালেই এ বিয়ের জালে জড়াতে হত না সন্ধির। নিজের করা চরমতম বোকামির জন্য নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না সে। এখন বাবার সাথে কোনভাবে এ যোগাযোগ করে এ বিয়ের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারলেই স্বস্তি পাবে সে। সাতদিন তো হয়েছেই, এখনো কী ফেরেনি বাবা? মা কি বলেনি বাবাকে সন্ধির বিয়ের কথা? অজস্র প্রশ্ন এসে জটলা পাকাচ্ছে সন্ধির মাথার ভেতর। এরই মধ্যে একজন প্রতিমুহূর্তে চেষ্টা করে যাচ্ছে সন্ধির হৃদয় জয় করে নেওয়ার। সেদিকে সন্ধির ধ্যান নেই, এক মন দুজনকে দেওয়া যায় না। তাছাড়া এ বিয়েটা একরকম তার মতের বিরুদ্ধে হয়েছে। সুতরাং এ বিয়ে সে কিছুতেই মানবে না। দরকার পড়লে এ বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে। মাহিদ কী তখন গ্রহণ করবে তাকে? যদি না করে? অজানা আশঙ্কাগুলো ক্রমশ ভীত করে তুলছে সন্ধিকে।
– ‘সন্ধি, রান্নাটা সেরে ফেলো তো মা। মাছের ঝোল করো কিন্তু, নয়নের খুব প্রিয়।’
– ‘খালা, আমি তো মাছ কাটতে পারিনা।’
– ‘চেষ্টা করো যাও। বাড়ির বউ হয়েছো এখন, সবই তো শিখতে হবে। পড়াশোনা তো আর এখন কাজে লাগবে না, সংসার সামলানোটাই আসল।’
মনঃক্ষুণ্ন হলো সন্ধি। খালার এ রূপের সাথে অবগত ছিল না সে। সন্ধি মাছ কাটতে পারেনা, খালা চাইলেই পারে একটু দেখিয়ে দিতে। সেটা তিনি করলেন না। ওড়নাটা কোমড়ে বেঁধে সন্ধি ফ্রিজ থেকে মাছ বের করে ভিজিয়ে রাখলো। এরই মধ্যে রামিলা পারভীন তাকে ঘর সাফ করতে বললেন। সন্ধি ঝাড়ু নিয়ে ঘর পরিষ্কার করতে গেল। সারা ঘর পরিষ্কার করার পর মাছের কথা খেয়াল হলো তার। ঝাড়ু রেখে রান্নাঘরে আসতেই দেখল চুলাতে পাতিল তুলে দেওয়া। তড়িঘড়ি করে পাতিলের ঢাকনায় হাত দিতেই হালকা আঁচ লাগে সন্ধির হাতে। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে সে। নয়ন দৌড়ে এসে সন্ধির আঙুল ট্যাপের পানির নিচে ধরে। সন্ধি বেশ বিরক্ত হয়। ব্যথার চেয়ে নয়নের স্পর্শ তাকে বেশি যন্ত্রণা দেয়। এই লোকটাকে কেন যেন সে কিছুতেই মানতে পারছে না। যতদ্রুত সম্ভব এই লোকটার থেকে পালাতে পারলে শান্তি পাবে সে।
সন্ধির বাবা শফিউর রাহমান বাড়ি ফিরেই জানতে পেরেছেন তার স্ত্রী বাড়িতে নেই। কয়েকদিন ধরেই স্ত্রীর ফোন বন্ধ পেয়েছেন কিন্তু কাজের চাপে খোঁজ নিতে পারেননি। আজ হঠাৎ এ ঘটনা দেখে তিনি বিমূর্ত। তূর্ণার মা তাকে সবটা বুঝিয়ে বলেছেন। সন্ধির বিয়ের খবরটা জানামাত্র শফিউর রাহমান অস্থির হয়ে পড়েছেন। যখন শুনলেন সন্ধির বিয়ে তার খালাতো ভাইয়ের সাথে হয়েছে, তখন আর দেরি করলেন না তিনি। সন্ধির বিয়ের কথা কেউ না জানলেও, তূর্ণার মা জেনেছিল। বাজের দৃষ্টি হওয়ার সুবিধে আর কী। ঠিকই তার চোখে সন্ধির মায়ের এ কীর্তি ধরা পড়েছিল। তূর্ণার মা জোর দেওয়ায় পরে সব বলে সায়েরা জামান। তূর্ণার মা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে থাকেন। এত সুন্দর সুখী পরিবারে এ কোন ঝড় যে উঠলো!
রামিলা পারভীনের বাড়ির ঠিকানা ভোলেনি শফিউর। রামিলা ছিল তার ভার্সিটি জীবনের ভালো বন্ধু কিন্তু একটা ঘটনার জের ধরে বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। রামিলার বাড়িতে গিয়েই সব ঘটনা পরিষ্কার করবে সে। রামিলা কী করে পারলো সন্ধির এত বড় একটা ক্ষতি করতে? একটাবারও ভাবলো না শফিউর তার জন্য কত বড় ত্যাগ স্বীকার করেছিল। এতটা কৃতঘ্ন কী করে হতে পারে একজন মানুষ?
_____________
রামিলা পারভীনের মুখোমুখি বসেছে শফিউর রাহমান। এতদিন পর বাবাকে দেখে চোখের পানি বাঁধ মানছে না সন্ধির। বাবার পায়ের কাছে বসে পড়েছে কাঁদতে কাঁদতে। শফিউর রাহমান তাকে বুঝিয়ে ঘরে যেতে বললেও গেল না সে। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল। শফিউর রাহমানই কথা শুরু করলেন।
– ‘রামিলা, সায়েরা কোথায়? আমার অনুপস্থিতিতে আমার মেয়ের সাথে এই কাজটা কী করে করতে পারলে তোমরা?’
– ‘আপা কই আমি বলতে পারবো না আর তাছাড়া সন্ধিকে আমি যথেষ্ট যত্নে রেখেছি।’
– ‘সন্ধির কি বিয়ের বয়স হয়েছে? হয়নি। তাছাড়া এ বিয়ে আইনসম্মতও হয়নি। সুতরাং নয়ন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সন্ধিকে মৌখিকভাবে তালাক দিক। আমি আমার মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো।’
– ‘এ তুমি কী বলছো শফি? বিয়ে তো হয়ে গেছে। দরকার পড়লে সন্ধি আঠারো হওয়া অবধি ও বাড়িতে থাকুক কিন্তু তাই বলে তালাক?’
– ‘এ বিয়েতে সন্ধির মত নেই তা আমি ওর চোখ দেখেই বুঝেছি। এছাড়াও আমি ওর সাথে কথা বলে দেখবো কিন্তু সন্ধি যদি রাজি না থাকে বিয়ের জন্য তবে নয়ন কিন্তু ওকে তালাক দিতে বাধ্য থাকবে।’
– ‘এ বিষয়ে পরে বসে ভাবা যাবে শফি। ও এখন এ বাড়ির বউ। নয়নের অধিকার আছে ওর উপর।’
– ‘আমি ওর বাবা সেটা ভুলে যাসনা রামিলা।’
– ‘কার সামনে নাটক করছো? তুমিও জানো তুমি ওর বাবা নও আর আমিও জানি।’
কথাটা শোনামাত্র আর আড়ালে থাকতে পারলো না সন্ধি। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ষোলো বছর ধরে যে সত্যি তিনি মেয়ের থেকে লুকিয়ে এসেছেন আজ সে সত্য প্রকাশ হলো। সন্ধির কোমল হৃদয় এভাবে ভাঙতে চাননি তিনি। সন্ধির প্রশ্নের কবলে পড়লেন তিনি।
– ‘বাবা, খালা যা বলছে তা কি সত্যি?’
– ‘…..’
– ‘বাবা! আমি কিছু জিজ্ঞাসা করছি।’
– ‘হ্যাঁ সত্যি।’
– ‘আমি তোমাদের মেয়ে নই?’
– ‘কে বলেছে? তুই আমার কলিজার টুকরো রে মা।’
– ‘সত্যিটা কী বাবা?’
– ‘তোর মায়ের কলেজ লাইফে এক প্রেমিক ছিল। ছেলেটা তোর মায়ের সাথে শারীরিক সম্পর্কের পর তাকে ছেড়ে চলে যায়। সায়েরার পরিবার তা জানার পর ওকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। তখন আমি আর রামিলা ছিলাম ভালো বন্ধু। নয়ন তো মোটামুটি বড়। রামিলা তখন অনুরোধ করলো সায়েরাকে বিয়ে করতে। আমিও প্রথম দেখায় সায়েরা কে ভালোবেসে ফেলেছি কিন্তু আমার বাড়িতে মানলো না। বাধ্য হয়ে বাড়ি ছাড়তে হলো। ছোট থেকে তুই জেনে এসেছিস তোর বাবার কেউ নেই। তোর দাদা-দাদী, ফুপি, কাকা সবাই ছিল। সবাই থাকা সত্ত্বেও তুই জেনেছিস তোর বাবার কেউ নেই।’
– ‘এসব আমাকে আগে বলোনি কেন বাবা?’
– ‘এসব কথা বাদ। তুই ব্যাগ গোছা। আমি আজকেই তোকে নিয়ে তোর দাদাবাড়িতে যাবো।’
এ কথার মধ্যে বাধ সাধলেন রামিলা। তিনি বোঝালেন অন্তত আজকের দিনটা থেকে যেতে। একরকম ইচ্ছের বিরুদ্ধেই রাজি হলেন শফিউর।
সন্ধি ঘরে ঢুকতেই নয়ন এলো তার কাছে। সন্ধিকে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরলো।
– ‘এত অপছন্দ আমাকে? আমায় ছেড়ে যাওয়ার এত তাড়া?’
– ‘নয়ন ভাই, ছাড়েন। আমি প্রথমেই বলছি আপনাকে আমার পছন্দ নয়। বিয়েটা আমি ইচ্ছের বিরুদ্ধে করেছি। আমায় মুক্তি দিন। আল্লাহর দোহাই লাগে।’
– ‘আমার প্রতি একটুও মায়াও হয় না তোমার?’
– ‘নাহ!’
সন্ধিকে ছেড়ে দিল নয়ন। অতঃপর মেঝেতে বিছানা করে শুয়ে পড়ল। সন্ধি মনে মনে খুশি। আজকেই মুক্তি পাবে সে। বাবার সাথে চলে যাবে, তারপর মাহিদের সাথে দেখা করবে। মাহিদ নিশ্চয়ই তাকে ভুল বুঝবে না। মাহিদকে পাওয়ার সবটুকু আশা এখনো হারিয়ে ফেলেনি এই ভেবেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সন্ধি। চোখে ঘুম নেই, মাহিদের সাথে কথা বলার অপেক্ষায় চোখজোড়ার ঘুম নিরুদ্দেশ হয়েছে। এই সাতটা দিন সন্ধির কাছে কেটেছে একেকটা বছরের মতো। এখন এ অনিচ্ছাকৃত বন্ধন থেকে মুক্তির পালা। সবকিছু সুন্দর হবে কিন্তু একটা খটখট শব্দ! মাঝরাতের একটা খটখট শব্দে সন্ধির জীবন বদলাতে চলেছে তা সে বুঝতে পারেনি।
চলবে…