যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ পর্ব -১৩

যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ
~মিহি

১৩.
সন্ধির বাবা মারা গেলেন শেষ রাতে। মারা যাওয়ার আগে শেষবার রামিলা পারভীন এসেছিল তার কাছে। সে কথা কেউ জানে না। রামিলা এসেছিল শফিউর রাহমানকে হুমকি দিতে। রামিলার কথার সারমর্ম এই যে শফিউর রাহমান সন্ধির বায়োলজিক্যাল পিতা নন। তিনি যদি সন্ধিকে নিয়ে যেতে চান তবে রামিলা পারভীন বাধ্য হবে সায়েরা জামানকে জানাতে। তগন পুলিশ কেইস হবে কিন্তু দিনশেষে সন্ধি ঐ সায়েরার কাছেই যেতে বাধ্য হবে। কথাগুলো শোনার পর থেকেই বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব করেন তিনি। চিৎকার করার ক্ষমতাও যেন হারিয়ে ফেলেছেন। অনেকটা সময় ব্যথা সহ্য করে শেষরাতের দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বাবার উপর ভরসা করে নিশ্চিন্তে ঘুমানো সন্ধি তখনো জানত না তার ভরসার জায়গাটা চিরতরে হারিয়ে গেছে।

বাবার মৃত্যু সংবাদ জানার পর সন্ধি যেন পাথর হয়ে গেল। কথায় আছে না, ‘অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর’। সন্ধির অবস্থা হলো তেমনি। শুষ্ক চোখজোড়া দিয়ে কেবল বাবার নিথর দেহটা পরখ করতে লাগল সে। কতটা অল্প সময়ের ব্যবধানে তার জীবন পুরোপুরি পরিবর্তিত হলো তা ভাবতে লাগল সে। মা থেকেও নেই, এখন বাবাকে হারালো। তবে কি এখন সে এতিম? কেউ তো আর রইল না তার। এখন কার কাছে যাবে সে? রামিলা চেষ্টা করলেন সন্ধিকে কাঁদানোর। কান্না করলে হালকা অনুভব করবে মেয়েটা কিন্তু সন্ধি কিছুতেই কাঁদছে না। বাধ্য হয়ে নয়ন সন্ধিকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। নয়নের স্পর্শে গা রি রি করে উঠলো সন্ধির। এক ঝটকায় নয়নকে দূরে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল সন্ধি। পৃথিবীতে সবচেয়ে আপন মানুষ হলেন বাবা-মা। বিশেষ করে বাবারাই মেয়েদের কাছে সবচেয়ে আপন অথচ সেই আপন মানুষটাকেই হারিয়ে ফেলেছে সন্ধি। বুকের মধ্যে শুন্যতাগুলোর উপস্থিতি দিব্যি অনুভব করতে পারছে সে। চোখের জল মুছে খালার কাছে গেল সন্ধি।

– ‘খালামণি, বাবার লাশটা দাদাবাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো।’

– ‘করবো। নয়ন, তুই বাইরে যা একটু।’

নয়ন মায়ের কথায় দ্বিমত না করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সন্ধি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

– ‘দেখো সন্ধি, তোমার দাদাবাড়ির খবর এখন আমি ব্যতীত কেউ জানে না। এখন যদি তুমি চাও তোমার বাবার শেষকৃত্য তার পরিবার করুক তবে আমার কিছু শর্ত মানতে হবে তোমাকে।’

– ‘কী শর্ত খালামণি?’

– ‘আর সতেরো দিন পর নয়ন বিদেশে চলে যাবে। এই সতেরো দিন নয়নের স্ত্রীর ন্যায় আচরণ করতে হবে তোমাকে। ওর যত্ন করতে হবে, ভালোবাসতে হবে।’

– ‘জোর করেই সব করাতে চান খালামণি?’

– ‘জোর হলে জোরই সই কিন্তু তোমায় রাজি হতে হবে। এখন তোমার হাতে সব। তুমি বলো শর্ত মানতে আপত্তি আছে কিনা।’

– ‘আমার আপত্তি করবার জোঁ আছে? সব তো পরিকল্পিত। আমি রাজি। এখন দয়া করে আমাদের দাদাবাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন।’

– ‘বেশ। নয়নকে গাড়ি ডাকতে বলো।’

পৃথিবীর সবাইকে আজ স্বার্থপর মনে হচ্ছে সন্ধির। সবকিছু যেন তার বিপরীতে চলছে। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে নয়নকে কী করে আপন করবে সে?

______________________

সন্ধির দাদাবাড়িতে এখন তার দাদা-দাদী বেঁচে নেই। এক কাকা আছেন তার, তিনি তার দুই ছেলেকে নিয়ে থাকেন। বড় ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদে মুষড়ে পড়লেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতে সন্ধির মাথায় স্নেহের পরশ বোলালেন। ভাঙা গলায় বলতে লাগলেন, ‘মা রে, তোর বাবা সেই যে বাড়ি ছাড়ল আর তার খোঁজ পেলাম না আমরা। বাবা-মা কতটা যন্ত্রণা নিয়ে মারা গেলেন! বড় ছেলেকে শেষবার দেখতে না পাওয়ার যন্ত্রণা! মা রে, তোর বাবা কেন লাশ হয়ে এলো রে? এই অল্প বয়সে আমি বড় ভাইটাকে হারালাম রে মা।যে ভাইয়ের কাঁধে চড়েছি ছোটতে, সেই ভাইকে খাটিয়ায় তুলতে বুক কাঁপছে রে মা।’ সন্ধির চোখ জলে ভরে এসেছে। স্তব্ধ হয়ে এসেছে মনের অনুভূতিগলোও।

আসর নামায পর শফিউর রাহমানের জানাযা সম্পন্ন হলো। সন্ধির কাকা আতাউর রাহমান সন্ধির থাকার ব্যবস্থা করছেন। এরই মধ্যে তিনি খোঁজ পেলেন তার ভাতিজির বিয়ের। বিমূর্ত হলেন তিনি। এতটুকুন মেয়ের কিনা বিয়ে দিয়েছে তার ভাই! বেশ ক্রোধের স্বরে তিনি এ বিয়ের কথা জানতে চাইলেন। রামিলা পারভীন দ্বিধান্বিত চোখে সন্ধির দিকে তাকালো। সন্ধি চটজলদি জবাব দিল, ‘চাচা, বিয়েটা আমার মর্জিতেই হয়েছে। বাবা সব ভেবেচিন্তেই আমাকে বিয়ে দিয়েছিলেন যেন আমি ভালো থাকি।’ এমতাবস্থায় নয়ন বেশ অবাক হলো। সন্ধি তো এই বিয়েকে অস্বীকার করেছিল তবে এখন কেন কিছু বললো না? আতাউর রাহমান শত চেষ্টা করেও সন্ধিকে রাখতে পারলেন না। সন্ধি আশ্বস্ত করলো সে অন্যদিন আসবে আবার। বাবার কবরের সামনে শেষবার দাঁড়িয়ে চোখের অশ্রু বিসর্জন করলো সন্ধি। অতঃপর এক অজানা ভবিতব্যের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। এই সংসারের জালে সে কিছুতেই আবদ্ধ হবে না। মায়ের জন্য করা বোকামিটা চিরজীবন বয়ে বেড়ানোর সাহস তার নেই। জীবনটাকে যোগ্যরূপে গড়ে তুলবে সে। নয়ন চলে গেলেই যে তার লেখাপড়া বন্ধ হবে তা নিশ্চিত। রামিলা পারভীনের উদ্দেশ্যটা এখনো ধরতে পারে না সন্ধি। এই মহিলার অবশ্যই কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা রয়েছে অন্যথায় তিনি সন্ধিকেই নিজের ছেলের বউ করার অত তাড়া দেখাতেন না। সেই উদ্দেশ্যটাই জানতে হবে সন্ধির। মনে মনে দৃঢ় সংকল্প তৈরি করলো সন্ধি।

______________

ঘুম থেকে উঠেই মাথার কাছে চায়ের কাপ পেয়ে খানিকটা অবাক হলো নয়ন। বিছানায় তাকাতেই দেখলো সন্ধি নেই। নয়নের মনে হলো সে স্বপ্ন দেখছে। দুবার নিজেকে চিমটি কেটে সে আশ্বস্ত হলো এটা স্বপ্ন নয়।
নয়নকে চিমটি কাটতে দেখে বেশ হাসি পেল সন্ধির। লোকটা বোকাসোকা কিন্তু তার মা যে ধুরন্ধর তা বুঝতে আর বাকি নেই সন্ধির। বাবার মৃত্যুতে সন্ধি ভেঙে পড়েছিল ঠিকই কিন্তু বাবার আদর্শেই নিজেকে গড়েছে সে। নিজের মায়ের করা অপরাধের শাস্তি সে দেবেই। এখন সন্ধির কাছে স্পষ্ট হয়েছে কিছু বিষয়। পরীক্ষার আগের রাতে মায়ের খালার সাথে থাকার নাম করে বের হওয়া, বাবার সাথে ঝগড়া সবটা বুঝতে পেরেছে সে। ভাবতেই ঘৃণা হয় সন্ধির নিজের স্বার্থের জন্য কিভাবে তার মা তাকে বলি দিতে পারলো। রামিলা পারভীনও সুবিধের নন। তিনি সন্ধিকে বিশেষ উদ্দেশ্যে এ বাড়িতে এনেছেন তা অনিবার্য সত্য আর সে সত্যটাই জানতে হবে সন্ধির।

– ‘ভাইজান, তুমি অযথা সন্দেহ করছো। সন্ধি আর নয়ন মাত্র বিয়ে করেছে ঠিকই কিন্তু ওদের মধ্যে অনেক মিল-মোহাব্বত। তাছাড়া আমি চাচ্ছি নয়ন এবার বিদেশের তল্পিতল্পা গুটিয়ে দেশেই কিছু করুক। ওদের একটা সুখের সংসার হোক।’

– ‘তা বুঝলাম। তো দেশে কী করবে ভাবছে নয়ন?’

– ‘ব্যবসা করবে। সন্ধির নামে যে জমিটা বাবা লিখে গেছেন ওটা বিক্রি করে ব্যবসা করবে।’

– ‘সে তো সন্ধির।’

– ‘সংসারটাও তো সন্ধির, স্বামীও সন্ধির। তোমার অত ভাবতে হবে না ভাইজান। তুমি শুধু জমিটা বিক্রির ব্যবস্থা করো।’

কথা শেষ করে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেন রামিলা পারভীন। অবশেষে তার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। তার বোনটা আস্ত গাধা। ক’টা টাকার লোভে মেয়ের বিয়ে দিয়ে প্রেমিক নিয়ে পালালো অথচ মেয়ের নামেই যে লাখ লাখ টাকার জমি তা তো সে জানে না। রামিলা পারভীনের বাবা অর্থাৎ সন্ধির নানা তার মৃত্যুর পূর্বে সন্ধির নামে বেশ কিছু জমি লিখে দিয়ে গেছেন। এত টাকার সম্পত্তি সন্ধি পাবে তা জেনেই সায়েরার সাথে যোগাযোগ করে রামিলা। টাকার লোভ দেখিয়ে সন্ধিকে নিজের বাড়ির বউ করার প্রস্তাব দেয়। সায়েরার মাথায় তখন চলছে অন্য পরিকল্পনা। পুরনো প্রেমিকের সাথে পালানোর ছক কষছিল সে। ব্যস! দুইয়ে দুইয়ে মিলতেই কাজটা হয়ে গেল। রামিলার খুশির কিনারা নেই তবে তার এই উচ্ছ্বাস ভঙ্গিমা দেখে যে দরজার আড়ালে অন্য একজনের মুখে ফুটে ওঠা শয়তানি হাসিটা তার দৃষ্টিগোচর হলো না।

চলবে…

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here