যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ
~মিহি
১৬.
‘ ওর চাচার বাড়ি ওর জন্য নিরাপদ নয়, আপা। ওর খালা ওর চাচার কাছে খবর পাঠিয়েছে যে সন্ধি নাকি কোন এক ছেলের সাথে টাকা নিয়ে পালিয়েছে। সন্ধির চাচা প্রচণ্ড রেগে আছেন। সন্ধি ওখানে গেলে ওর খালার কাছে সহজেই ধরা পড়বে।’ জসীমের কথা শেষ হলে শ্রাবণী শিকদার তাকে যেতে বলল। সন্ধিকে বিষয়টা বোঝানো একটু কষ্টকর কিন্তু বোঝাতেই হবে। শ্রাবণী সন্ধির কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। মেয়েটা বুঝলেই শান্তি! সন্ধিকে সবার সাথে হাসাহাসি করতে দেখে অনেকটা স্বস্তি পেল শ্রাবণী। হাসিমুখে ঘরে প্রবেশ করতেই সবাই ‘মামণি’ বলে ছুটে এসে ঘিরে ধরল তাকে। তিনিও হাসিমুখে সবার মাথায় হাত রাখলেন। সন্ধি তার দিকে এগোতে নিলে ইশারায় থামালেন তাকে। নিজেই গিয়ে বসলেন সন্ধির পাশে।
– ‘সন্ধি, তোমার চাচার বাড়ি তোমার জন্য নিরাপদ নয় এখন। তোমার খালা ওখানেই আগে খুঁজবেন তোমায়। তুমি বিপদে পড়তে পারো।’
– ‘আমি তাহলে কোথায় থাকবো?’
– ‘আপাতত এখানেই থাকো। পড়াশোনাটা চালিয়ে যাও। তাছাড়া তুমি কি চাও চাচার উপর নির্ভর করে থাকতে? নাকি নিজেই কিছু করতে চাও?’
– ‘আমি নিজে কিছু করতে চাই মামণি, নিজেকে যোগ্য করে তুলতে চাই।’
– ‘বেশ তো। যোগ্য হয়েই সবার মুখোমুখি দাঁড়াবে তুমি।’
শ্রাবণী সন্ধির মাথায় হাত রাখতেই স্নেহের মাহাত্ম্য অনুভব করল সন্ধি। মা-বাবা দুজনকেই হারানোর পর সন্ধি ভাবেইনি এই স্নেহ কখনো তার নসিব হবে। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সন্ধি। মাহিদের কথা বড্ড মনে পড়ছে তার। মাহিদও তো এমন করেই স্নেহ করতো তাকে। সাধ্যের বেশি করেছে সে সন্ধির পড়াশোনায় সাহায্য করার জন্য।
– ‘কী ভাবছো সন্ধি?’
– ‘না মানে আগের স্কুলের কথা মনে পড়ছে।’
– ‘চিন্তা করো না। তোমার বয়সী বেশ কয়েকটা মেয়ে আছে এখানে। ওদের সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলো। আর আমি তোমার স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করি। আগের স্কুলের টি.সি থাকলে ভালো হত। সমস্যা নেই, বাংলাদেশে এসব ব্যাপার না। তুমি কেবল মন দিয়ে পড়াশোনা করো।’
ফুল নামের একটি মেয়েকে সন্ধির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি। ফুল আর সন্ধি সমবয়সী। দুজনের আলাপচারিতা ভালোই জমতে দেখে তিনি সরে এলেন। আশেপাশের সবার দিকে চোখ বুলিয়ে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। নিজেকে নিয়ে আর কোনো অভিযোগ নেই তার। জীবনটা পরিপূর্ণতার দিকে ক্রমশ ধাবিত হচ্ছে। এখন এসব মেয়েদের মধ্যে একজনও যদি ভবিষ্যতে এই আশ্রমের দায়িত্ব নিতে পারে তবেই তিনি নিশ্চিন্তে মৃত্যুর স্বাদ নিতে পারবেন।
__________________
সন্ধির শ্বশুড়বাড়িতে আসার অভিজ্ঞতা মোটেও ভালো ছিল না মাহিদের। রাস্তায় একজনকে সন্ধির কথা জিজ্ঞাসা করতেই মহিলা মুখ কুঁচকে চলে যান। কোনো উত্তরই দেন না। খুঁজতে খুঁজতে সন্ধির শ্বশুরবাড়ির দরজার সামনে আসে। পরপর দুবার দরজা ধাক্কাতেই একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রমহিলা দরজা খোলেন। মাহিদ অনুমান করে এটাই সন্ধির শাশুড়ি। সালাম দিয়ে কথা শুরু করার চিন্তা করে সে।
– ‘আসসালামু আলাইকুম খালাম্মা।’
– ‘কে তুমি?’
– ‘আমি আসলে সন্ধির স্কুলের টিচার। ও অনেকদিন যাবত স্কুলে আসে না। তাই খোঁজ নিতে…’
– ‘চলে যাও। এই নামে এখানে কেউ থাকে না। দূর হও।’
মাহিদ কিছু বলার আগেই মাহিদের মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দেয়। মাহিদ অবাক হওয়ার সুযোগটাও পায় না। পাশ থেকে এক লোক এসে মাহিদের পাশে দাঁড়ায়। লোকটার মুখ পান চিবোনোর কারণে লাল হয়ে আছে। বিশ্রি দেখাচ্ছে। লোকটার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিল না মাহিদ কিন্তু লোকটা আগ বাড়িয়ে কথা বলতে শুরু করলো।
– ‘যেই মাইয়ার কথা কইলেন, হেই মাইয়া তো পলাইছে কাইল রাতে। টাকা বেমাগ লইয়া গেছে।’
– ‘কী বলছেন কী?’
– ‘হাছা কইতাছি। এসব আবার কাউরে কইয়েন না।’
– ‘সন্ধি এখন কোথায়?’
– ‘কোই আবার থাকবো! আছে নয়া প্রেমিকের লগে।’
মাহিদের ইচ্ছে করছে লোকটার মাথা ফাটিয়ে দিতে কিন্তু তেমন কিছুই করে না সে। সন্ধি যে কাউকে না পালায়নি সে বিশ্বাস মাহিদের আছে তবে সন্ধি কেন পালালো? কোনোভাবে বিপদে পড়েনি তো সে? সন্ধি যদি কাল রাতে পালিয়ে থাকে, তবে কেউ না কেউ তো দেখবে তাকে। মাহিদের কাছে সন্ধির একটা ছবি আছে। সন্ধি মনোযোগ দিয়ে লিখছে, এমন সময় লুকিয়ে ছবি তুলেছিল মাহিদ। রাস্তায় সন্ধির ছবি দেখায় সে পথচারীদের। জিজ্ঞাসা করে কেউ তাকে দেখেছে কিনা কিন্তু কেউ সন্ধিকে দেখেনি। অনেকটা রাস্তা হেঁটে মূল রাস্তায় আসতেই একটা চায়ের স্টল দেখতে পায় মাহিদ। ক্লান্তিতে তেষ্টা পেয়েছে বেশ। এক কাপ চায়ের অর্ডার করে বেঞ্চে বসে সে। ফোনে সন্ধির ছবি দেখে চোখ বোঁজে সে। চা দিতে এসে ফোনের স্ক্রিনে চোখ পড়ে চা’অলা লোকটার।
– ‘আপনে কি এই আপারে খুঁজতাছেন?’
– ‘হ্যাঁ, আপনি দেখেছেন ওকে?’
– ‘জ্বে! কাল রাতে এই আপা দৌড়াইতেছিল। তার পেছনে কয়ডা পোলা পইড়া আছিল। শেষে সাক্ষাৎ ফেরেশতা হইয়া শ্রাবণী আপা আসে। পরে শ্রাবণী আপাই তারে নিয়া গেছে।’
সন্ধির খোঁজ পেয়ে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠে মাহিদ। তড়িৎ গতিতে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে।
– ‘আপনি ঠিকানা দিতে পারবেন আমাকে?’
– ‘হ, আপার ঠিকানা তো সবাই জানে।’
লোকটার থেকে শ্রাবণী শিকদারের ঠিকানা নেয় মাহিদ। মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে মাহিদ। এবার উদ্দেশ্য শ্রাবণী শিকদারের বাড়ি।
______________________
‘ চায়ে চিনি ক’চামচ নিবে?’ শ্রাবণী শিকদারের প্রশ্নে ধ্যান ভাঙলো মাহিদের। ‘এক চামচ’ উত্তর দিল সে। চায়ে চিনি দিয়ে এক কাপ মাহিদের দিকে বাড়িয়ে অন্য কাপ নিজে নিয়ে মুখোমুখি বসলেন তিনি। মাহিদ ইতোঃমধ্যে বলেছে সে সন্ধিকে কেন খুঁজছে। অকপটে সে এটাও স্বীকার করেছে সে সন্ধিকে ভালোবাসে। শ্রাবণী শিকদার বিষয়টা বুঝলেন। চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দিলেন তিনি।
– ‘সন্ধি কোথায় ম্যাম? আমি ওর সাথে দেখা করতে চাই।’
– ‘তোমায় কিছু বলতে চাই। এরপর তোমায় একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
– ‘জ্বী বলেন।’
– ‘সন্ধি এখনো এস.এস.সি কমপ্লিট করেনি। বাচ্চা বয়সে। এখন আপনার সাথে দেখা হলে ও আপনার ওপর নির্ভরশীল হতে চাইবে। পড়াশোনা ছেড়ে দেবে তা বলছি না তবে স্বাবলম্বী হতে পারবে না। ওকে শক্ত থাকতে হবে যেটা আপনার সাথে থাকলে সম্ভব না। আপনি বরং ওকে পাঁচটা বছর সময় দিন। ও নিজেকে গড়ে তুলুক। তারপর যদি ও আপনাকে চায়, আমি নিজ হাতে ওকে আপনার হাতে তুলে দিব।’
– ‘কিন্তু ও যদি আমাকে না চায়?’
– ‘বিশ্বাস রাখতে হবে আপনার। এখন বাকিটা আপনার সিদ্ধান্ত।’
– ‘আমি ওকে সাহায্য করতে চাই শুধু।’
– ‘এই সাহায্যটাই ওকে আপনার প্রতি নির্ভরশীল করে তুলবে। এই বয়সটাই এরকম। আপনাকে দেখলেই ও এক্সপেক্ট করতে শুরু করবে যে আপনি ওকে নিজের সাথে নিয়ে যাবেন, ওর প্রতি সিমপ্যাথি দেখাবেন। এসব এ বয়সের চাওয়া। আপনি তো পারবেন না ওকে নিজের কাছে রাখতে এখন অন্তত সমাজের চোখে তা দৃষ্টিকটু লাগবে। উপরন্তু সন্ধির বিরুদ্ধে তার খালা যে অপবাদ ছড়িয়েছে তাও এক হিসেবে সত্যি হয়ে যাবে। আপনাকে ব্যাপারটা বুঝতে হবে।’
– ‘দূর থেকে দেখতে পারি একবার?’
– ‘দূর থেকে দেখলে আপনি তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়বেন না কি? এখন এসব না ভেবে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে মনোযোগ দিন। নিজেকে যোগ্ত করে গড়ে তুলুন। অন্তত ভবিষ্যতে সন্ধির পাশাপাশি যেন আপনাকে মানায়।’
– ‘আমি বোঝার চেষ্টা করছি ব্যাপারটা কিন্তু আমার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। অনেকদিন থেকেই ও চোখের আড়ালে আছে।’
– ‘একটা বিখ্যাত ভাষণ সবাই দেয় যে যাকে ছাড়া চার/পাঁচ বছর থাকা যায় তাকে ছাড়া নাকি সারাজীবনও থাকা যাবে। এক্ষেত্রে ভালোবাসাটা মিথ্যে অথচ ভালোবাসার জন্য একদিনও ধৈর্য ধরে না থাকতে পারাটা সত্যিকারের ভালোবাসা? বোঝান আমায়। আপনি একটা মেয়েকে ভালোবাসলে তার সফলতার জন্য তার থেকে দূরে থেকে অপেক্ষা করতে পারবেন না?’
– ‘পারবো। অবশ্যই পারবো।’
চলবে…