প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল
২২.
বাড়ির একেকজন সদস্য বেশ দুঃশ্চিন্তায়। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। বাতাস ছেড়েছে প্রবল বেগে। আবহাওয়া ভালো না। তারউপর রাতের আঁধার। দুঃশ্চিন্তায় রয়েছেন দায়িত্বশীল হুশিয়ার সাহেব। বাচ্চাদের চিন্তায় কেউই ঘুমাতে যাননি। ঘড়ির কাঁটা দুটো পঁয়তল্লিশে ছুঁইছুঁই প্রায়। হুশিয়ার সাহেব তাড়া লাগালেন মোস্তফা সাহেবকে,
-‘ আবার কল দেও! দেখ তো…
মুহুর্তেই গাড়ির শব্দ শোনা গেল। পৌঁছেছে তন্ময়দের গাড়ি। বাড়ির বাচ্চারা সহিসালামত পৌঁছেছে দেখে, সকলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আনোয়ার সাহেব খুঁড়ে খুঁড়ে হাঁটা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন। চিন্তিত চোখমুখে পা দেখতে বসেছেন মেয়ের। অরুর দু’পা ফুলে উঠেছে। বৃষ্টিতে ভিজে আরও দুর্গম অবস্থা। লালচে হয়ে গিয়েছে পায়ের গড়ালির চারপাশ। আনোয়ার সাহেব কাউকে কোনো প্রশ্ন করেননি, কী হয়েছে বা কীভাবে তার মেয়ে পড়েছে! নিজের মেয়েকে তিনি ভালোভাবে চিনেন। বরং এই মেয়েটা সহিসালামত বাসায় পৌঁছালে তিনি দুঃশ্চিন্তায় পড়তেন বরং। মোস্তফা সাহেব বললেন,
-‘ খুব রাত হয়েছে। এখন ডাক্তার পাওয়া মুশকিল। কাল সকালেই আসতে বলব। তুই ওকে উপরে নিয়ে যা। আর সুমিতা গরম পানি বসাও। ‘
আনোয়ার সাহেব মেয়েকে নিয়ে নিজের রুমের দিক হাঁটা দিয়েছেন। সুমিতা বেগম রান্নাঘরে ছুটেছেন পানি গরম করতে। একটু গরম ছ্যাঁকা দিলে ফুলা ভাবটা কমতে পারে। মোস্তফা সাহেব বিরক্ত চোখে তাকালেন ছেলের দিক,
-‘ মেয়েটা এভাবে দু’পা ভেঙে এসেছে! তুমি করছিলে কী? ‘
তন্ময়ের পূর্বে কলি জবাব দিলো,
-‘ ভাইয়া তো সর্বক্ষণ দেখে দেখে রেখেছে। অরু নিজেই এদিকসেদিক দৌড়াদৌড়ি করছিলো। এতবড় মেয়েটা…. ‘
হুশিয়ার সাহেব বললেন,
-‘ তোমাকে পাকামি করতে হবেনা৷ নিজের রুমে যাও! ‘
কলি বিষন্ন অনুভব করছে। মেজাজ এভাবেই ভীষণ খারাপ তার। তন্ময় সর্বক্ষণ শুধু অরুর পাশে ছিলো। একটুখানি ছাড় পায়নি লোকটা। বাসায় এসে আবার কথা শুনছে ওই মেয়েটার জন্য! কলি চোখমুখ কালো করে চলে গেল। মোস্তফা সাহেব আনোয়ার সাহেবের রুমের দিক হাঁটা দিয়েছেন। জয়া বেগমও সাথে গেলেন চিন্তিত চেহারায়। মেয়েটার পায়ের কোনো খারাপ অবস্থা না হয়ে যায়! তন্ময় ও তার বাবা-মায়ের পেছন পেছন এসেছে। দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে পড়লো। ভেতরে গেল না। এখন উজ্জ্বল রুমে অরুর পায়ের দিক তাকানো বেশ দুষ্কর।
ডাক্তার জুবায়ের এসেছেন। অরুর পায়ের চেক-আপ করে গিয়েছেন৷ সিরিয়াস ইঞ্জুরি নয়। রেস্ট নিলে সেড়ে যাবে৷ ডাক্তার যেতে না যেতেই অরু খুঁড়ে খুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে রুম থেকে। ড্রয়িংরুমে কেউ নেই। বাড়ির বাইরে থেকে আওয়াজ আসছে। সকলেই নিশ্চয়ই সেখানে! ভালোই হয়েছে। অরুকে ধমকানোর মতো কেউই নেই। সে রান্নাঘরের দিক এগোল। ঠান্ডা পানি খেতে ইচ্ছে করছে! গলাটা শুকিয়ে কাঠকাঠ। রান্নাঘরে শুধু শাপলা বেগম। বেশ খুশি দেখাচ্ছে তাকে। মুখমণ্ডল জুড়ে এক অসাধারণ গ্লো ফুটে উঠেছে। অরুর হাসিখুশি মানুষের মনের অবস্থা শুনতে বেশ ভালো লাগে। সে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করতে করতে বলল,
-‘ কি হয়েছে মামী? আপনাকে এতো খুশি
দেখাচ্ছে যে? ‘
শাপলা বেগম রুটি ভাজতে ব্যস্ত ছিলেন। অরুর প্রশ্নে মুচকি হাসলেন। তারপর শব্দ করে হাসলেন। অরু আরও উদ্বিগ্ন হলো জানার জন্য! কী এমন সুসংবাদ যে শাপলা বেগম এতটা খুশি? অরু বোতল হাতে এগিয়ে গেল। আগ্রহী কন্ঠে শুধালো,
-‘ বলো না! ‘
-‘ বলছি দাঁড়া! রুটি উল্টে নেই। ‘
অরু অধৈর্য ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো। কৌতূহল সে নিতেই পারেনা। এরজন্য পানিটুকু এখনো গিলতে পারছেনা। শুনেই খাবে পানি। শাপলা বেগম ঘুরে দাঁড়ালেন। চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলেন৷ কেউ নেই! তিনি ধীরে বললেন,
-‘ খুব শীগ্রই বিয়ে খেতে চলেছিস! ‘
অরু খুশিতে লাফিয়ে উঠল। চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে তার,
-‘ সত্যি! কার ? ‘
-‘ হলেই জানবি নে৷ ‘
-‘ এই না প্লিজ বলো! আমি উদ্বিগ্ন মানুষ। না শুনলে ঘুমাতে পারবো না। ‘
শাপলা বেগম ধীরে বললেন,
-‘ কথা হচ্ছে বড়দের মাঝে। কলি আর তন্ময়ের বিয়ের তারিখ ঠিক হবে বলে! ‘
কথাটুকু বলেই তিনি নিজমনে হাসলেন। মেয়ের জন্য এমন ভালো এবং আপন ছেলে পাবেন, ভাবতেই পারেননি। তাদের তন্ময় তো চাঁদের টুকরো। এই ছেলেকে মেয়ে জামাই পাবেন ভেবেই তিনি উদ্বিগ্ন প্রায়৷ রান্নাঘরে সে মুহুর্তে প্রিজ হাতে কলি ঢুকে। মায়ের কথা শুনে সে লুকিয়ে পড়ে। লজ্জায় তার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। বুকে হাত চেপে ওড়নায় মুখ লুকাল। যেতে নিয়েও গেল না। দাঁড়িয়ে রইলো আরও কিছু শোনার জন্য। অরু নিজের কানকে তখনো বিশ্বাস করতে পারেনি। হাসিখুশি মুখমণ্ডল মুহুর্তেই আঁধারে পরিনত হয়েছে। ঠোঁটের হাসিটুকু হারিয়ে ফেলেছে। বুকটা ধুক করে উঠছে ক্ষনে ক্ষনে। অস্পষ্ট স্বরে বলল,
-‘ কী? ‘
-‘ আরে বাবা, আমাদের কলি আর তন্ময়ের বিয়ের শানাই বাজতে চলেছে খুব দ্রুত। ‘
অরুর হাত থেকে কাঁচের বোতলটা শব্দ করে পড়ে গেল। পড়েছেও ঠিক তার পায়ের উপর। যতটা উচ্চতা অনুযায়ী বোতল পড়েছে, এতক্ষণে অরুর পা ধরে চিৎকার করার কথা৷ কিন্তু কোনোপ্রকার চিৎকার, আর্তনাদ তার মুখ থেকে শোনা গেল না। বোতল ভেঙে তার পায়ের পাতা রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছে। অরর বদলে শাপলা বেগম চেঁচিয়ে উঠেছেন। তার চেঁচানোর শব্দে দৌড়ে ছুটে এসেছেন জয়া বেগম। পরপর শাবিহা। তখনো অরু ঠাঁই দাঁড়িয়ে! বিষ্ময়, অবিশ্বাস তার মুখশ্রী’তে ভেসে। কিছু মুহূর্তের জন্য তার ভেতর থেকে রুহ চলে গিয়েছে যেমন। আশপাশে কোনোকিছুরই ধ্যান নেই। কানে বেজে চলেছে শাপলা বেগমের বলা কথাটি। তন্ময়ের বিয়ে হবে! পরপর সুমিতা বেগমও দৌড়ে ছুটে এসেছেন। মেয়ের রক্তাক্ত পা দেখে আর্তনাদ করে বসলেন। আয়’হায় বলতে বলতে তিনি অরুকে টেনে বুকে নিলেন। জয়া বেগম দ্রুত হাতে অরুর পায়ের পাতা থেকে কাঁচের টুকরো গুলো সরাতে ব্যস্ত। রক্তে তার হাতও লাল হয়ে গেছে। আনোয়ার সাহেব স্ত্রীর চেঁচামেচি এবং কান্নার শব্দ শুনে দৌড়ে এসেছেন। কিছু বুঝে উঠবার আগেই, মেয়েকে কোলে উঠিয়ে ছুটেছেন রুমের দিক। মোস্তফা সাহেব আবারো কল করলেন ডাক্তার জুবায়েরকে। এতবড় তান্ডব করা অরুকে এখন কেউই শাসন করার মনমানসিকতায় নেই। সবাই আশ্চর্যের শেষ সীমানায়। তন্ময় এবং অয়ন মাত্রই
বাড়িতে ফিরেছে । তারা গিয়েছিল পুকুর পাড়ে। সকলকে এমন রান্নাঘরে জড়সড় হয়ে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। তন্ময়ের নজর গেল ফ্লোরে। রান্নাঘরের মেঝে এখনো রক্তাক্ত। শাবিহা লালচে চোখজোড়া নিয়ে বলল,
-‘ অরুর পায়ে কাঁচের বোতল পড়েছে। খুব… ‘
তন্ময় নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো। শাবিহার কথাগুলো বুঝতে যেমন তার সময় লাগলো। পরপর ছুটে চলে গেল। পুরো বাক্যটি শোনার মতো ধৈর্য তার হলোনা। পিছু অয়ন ও ছুটেছে।
অরু জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। জুবায়ের সাহেব কিছুক্ষণ আগেই এসেছেন। অরুর পায়ের অবস্থা দেখে বললেন,
-‘ হাসপাতাল নিতে হবে। ‘
দু’পায়ের অবস্থাই বেশ দুর্গম। প্রখর ভাবে কেঁটেছে। বোতলের এক টুকরো কাঁচ ভেতরে ঢুকে গিয়েছে। রক্ত পড়াও কমছে না। আনোয়ার সাহেব মেয়েকে পুনরায় বুকে জড়িয়ে নিলেন৷ গাড়ির দিক ছুটেছেন। মোস্তফা সাহেব ও গিয়েছেন সঙ্গে। সুমিতা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়েছেন মেঝেতে। কিছুক্ষণের জন্য মেয়েকে একা রেখে গিয়েছেন। এতটুকু সময়ের মধ্যে এই কী করে বসলো মেয়েটা! জয়া বেগম সুমিতা বেগমের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-‘ সব ঠিক হয়ে যাবে। ‘
-‘ কীভাবে? গতকাল পায়ের কেমন অবস্থা হয়েছিলো! তাকানো যাচ্ছিলো না। আর আজ.. ‘
বলেই তিনি কাঁদতে লাগলেন।
হাসপাতালে ওয়েটিং রুমে দাঁড়িয়ে তন্ময়। পাশেই শাবিহা এবং অয়ন। মোস্তফা সাহেব ডাক্তারের সাথে কথা বলছেন। আনোয়ার সাহেব বড়ো ভাইয়ের পাশেই। ডাক্তার জুবায়ের বললেন,
-‘ যেভাবে বাচ্চা মেয়েটা পায়ের উপর জুলুম করছে! পায়ের না কিছু হয়ে যায়! দেখেশুনে রাখবেন
কিছুদিন। ‘
কথাবার্তা শেষ করে পেসেন্ট রুমে ঢুকেছেন আনোয়ার সাহেব এবং মোস্তফা সাহেব। অয়ন ও গিয়েছে তাদের পিছু। তন্ময় শুধু দাঁড়িয়ে! শাবিহা ধ্যান মেরে তন্ময়ের চোখের পানে তাকিয়ে। ওই লালচে চোখজোড়া একদম ভিন্ন৷ এই চোখ সে কখনোই তন্ময়কে ব্যবহার করতে দেখেনি৷ শান্তশিষ্ট তার ভাইকে আজ ছন্নছাড়া এবং অশান্ত দেখাচ্ছে। এক অসীম পরিবর্তন লক্ষ্য করছে তার ভাইয়ের মাঝে৷ এই তন্ময়কে দেখে এক অদ্ভুত যন্ত্রণাও অনুভব করছে সে। আলগোছে তন্ময়ের কাঁধে হাত রেখে বলল,
-‘ দেখতে যাবে না ভাইয়া? ‘
তন্ময়ের জবাব এলো না। তাই শাবিহা তন্ময়ের হাত ধরে নিজের সঙ্গে টেনে নিয়ে গেল। শাবিহার টানেও ভেতরে ঢুকলো না তন্ময়। দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। অরুর জ্ঞান ফিরেছিল। ডাক্তার ঘুমের টেবলেট খাইয়েছে। ঘুম ভাঙতে দেরি আছে৷ তবে ঘুম ভাঙলেই তাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন আনোয়ার সাহেব। হাসপাতালে রাখবেন না মেয়েকে। ভাইকে বললেন,
-‘ ভাইয়া আমি অরুকে নিয়ে ঢাকা ফিরে যাই। আপনারা আরও কিছুদিন থেকে যান৷ ‘
মোস্তফা সাহেব কিছুক্ষণ ভাবলেন। অরুর যা অবস্থা এখানে থেকেও মেয়েটা ঘুরতে বা আনন্দ-ফুর্তি করতে পারবেনা। নিজেদের বাড়িঘরে আরও দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে৷ তিনি বললেন,
-‘ আজ থাক। কাল সবাই মিলে রওনা হবো। ‘
-‘ আপনার এখানকার ঝামেলা শোধবোধ হয়েছে? সবকিছু মিটমাট করে তারপর ফিরলে ভালো হয়৷ ‘
মোস্তফা সাহেবকে চিন্তিত দেখাল। তার আসলেই আরও এক দুদিন থাকা প্রয়োজন। তবে আপাতত আর বিষয়ে কথা বললেন না। এড়িয়ে গেলেন।
__________
অরুকে আজ খুব অদ্ভুত লাগছে। এতটাই অদ্ভুত যে আনোয়ার সাহেব বেশ কিছু বার মেয়েকে ধমকাতে গিয়ে থেমে গিয়েছেন। হাসপাতাল থেকে নিয়ে এসেছেন অবদি একটি শব্দ করেনি মেয়েটা। চুপচাপ শুয়ে আছে। চোখ অবদি খুলছে না। একেক করে সবাই অরুকে দেখে চলে গিয়েছে। এখন শুধু সুমিতা বেগম এবং তন্ময় দাঁড়িয়ে। সুমিতা বেগম প্লেট গুলো নিয়ে বেড়িয়ে গেলেন। তন্ময় দাঁড়িয়ে রইলো। সে জানে অরু জেগে। অথচ অরু কিছু বলছে না! জেগে থেকেও এভাবে চুপ করে কেন আছে? অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে? নাহলে তো এভাবে চুপ করে থাকার মেয়ে অরু নয়, যেখানে তন্ময় তার সামনে একা দাঁড়িয়ে। তন্ময় সময় নিয়ে ডাকল,
-‘ অরু? ‘
সাঁড়াশব্দ করলো না অরু। চুপচাপ শুয়ে রইলো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তন্ময় যাবার জন্য পা বাড়ালো। যেতে নিয়ে ফিরে আসলো। চাদর অরুর শরীরের উপর টেনে দিয়ে গেল। তন্ময় যেতেই অরু চোখজোড়া খুলল। মুহুর্তেই চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো চোখের পানি। বুকের তীব্র যন্ত্রণা অবশ করে দিয়েছে সকল প্রকার চিন্তাভাবনা। এখনো বিশ্বাস করতে পারছেনা, শাপলা বেগমের কথাগুলো। এই কারণে তারা সিলেট এসেছে? এই কারণে তন্ময় তাকে সবসময় এড়িয়ে চলেছে? এরজন্যই কখনো তাকে মেনে নেয়নি। তার এতো প্রচেষ্টা সব বিফলে গিয়েছে এরজন্য। অথচ সে নির্লজ্জের মতো তন্ময়ের পিছু ঘুরেছে। চোখজোড়া বুঝে ফেললো। ডুকরে কেঁদে উঠলো। অস্পষ্ট শব্দ বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে। তার তন্ময় তার নয়। বরং অন্যকারো। তাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে৷ ভাবতেই বুকে কিছু একটা বিঁধছে। রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে ভেতরটা। যন্ত্রণায় ছটফট করছে হৃদয়। এই যন্ত্রণা উপলব্ধি করা ছাড়া কোনো উপায় যে নেই।
সকালে ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরোবেন ভেবেছিলেন আনোয়ার সাহেব। কিন্তু মেয়ের বলা ‘ আমি এক্ষুনি যেতে চাই। আমার ভালো লাগছেনা। ‘ কথাটি শুনে তিনি তখনই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবেন জানালেন। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে আনোয়ার সাহেব রাত বারোটায় গাড়ি চড়েছেন। আশ্চর্যজনক ভাবে কোথাও তন্ময় নেই। আনোয়ার সাহেব গাড়ি স্টার্ট করার আগে বলে গেলেন,
-‘ তন্ময়কে পেলাম না। ভাইয়া ওকে জানিয়ে দিও। চিন্তা করতে হবেনা। ধীরেসুস্থে ফিরে এসো। ‘
গাড়িটা ধীরে আঁধার রাতে হারিয়ে গেল। তন্ময় যখন ফিরেছে বাড়ির সকলে তখনও রাস্তায়৷ শাবিহা বলল,
-‘ ছোট চাচ্চুরা ঢাকা চলে গেছে। ‘
তন্ময়কে স্তব্ধ দেখাল। তার দৃষ্টি খানিকক্ষণের জন্য হতবাক! শাবিহা স্পষ্ট খেয়াল করলো তন্ময়ের হাতের বক্সটা। নিশ্চয়ই অরুর মন ভালো করতে কিনে এনেছিল? তন্ময় রাগী স্বরে বলল,
-‘ চলে গেছে মানে? ওর পায়ের এই অবস্থা! এসময় জার্নি করার কী খুব বেশি দরকার ছিলো? পায়ের অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে। ‘
মোস্তফা সাহেব কিছু বলবেন পূর্বেই তন্ময় তাড়াহুড়ো কন্ঠে বলল,
-‘ বাবা তুমি রাজি হলে কীভাবে? কল করে বলো ফিরে আসতে! বেশিদূর হয়তো যেতে পারেনি। থাক আমি কল দিচ্ছি! ‘
মোস্তফা সাহেব বাঁকা চোখে ছেলেকে দেখে
বললেন,
-‘ অরু এখানে কম্ফোর্ট ফিল করছে না। ও ফিরতে চেয়েছে ঢাকা। এক্ষুনি! ‘
বলেই তিনি ভেতরে ঢুকে গেলেন। তন্ময় তর্ক করার ভাষা’ই হারিয়ে ফেললো। পকেট থেকে ফোন বের করতে থাকা হাতটিও মাঝপথে থেমে গেল।
____________
আকাশে আজ চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। হয়তো মেঘে ঢেকে। তবুও আকাশের পানে তাকিয়ে শাবিহা। ভাইয়ের জন্য চিন্তা হচ্ছে তার। সাথে অরুর জন্যও৷ পাশে কাউকে অনুভব করতেই ফিরে তাকাল। অয়ন এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে একটু দূরত্ব রেখে ৷ নজর দূর আসমানে! দুজনের মধ্যে কোনো কথাবার্তা নেই শুধু নিস্তব্ধতা বিরাজমান। অয়ন একসময় হুট করে বলে বসলো,
-‘ তন্ময় ভাই অরুকে পছন্দ করে! ‘
অয়ন প্রশ্ন করেনি। ডিরেক্ট বলেছে। শাবিহা অবাক হলো খানিক। বলল,
-‘ তুমি জানলে কীভাবে? ‘
অয়ন স্মিথ হাসলো,
-‘ ভালোবাসার মতো ফাঁদে যারা পড়েছে তাদের পক্ষে নিজের মতো একজনকে চিনতে পারা কঠিন
বিষয় নয়। ‘
শাবিহা চুপ রইলো। অয়ন দূর আসমানেই নজর রেখে বলল,
-‘ তন্ময় ভাই খুব গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। এধরণের মানুষদের প্রেম চোখে ভাসে মুখে নয়। দুদিন ধরে আমরা একসাথে। অথচ তার অরুর প্রতি দুর্বলতা বুঝতে আমার ঘন্টাখানেক লেগেছে মাত্র। ‘
শাবিহা অশান্ত সুরে বলল,
-‘ ভাইয়া খুব আগ থেকেই ওকে পছন্দ করে। ‘
-‘ তোমরা সবাই জানো? ‘
-‘ না। আমি বাবা আর মা৷ অরু নিজেও জানে না। ‘
-‘ অরুও তো পছন্দ করে তন্ময় ভাইকে। ‘
-‘ সত্যি? ‘
-‘ খেয়াল করোনি? করবে কীভাবে! তুমিতো আমাকে দেখতে ব্যস্ত! ‘
বলেই হাসলো অয়ন। শাবিহা নাকমুখ কুঁচকে
বলল,
-‘ জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছ? ‘
-‘ হ্যাঁ। আই লাভ টু ওয়াচ ড্রিমস।’
শাবিহা এই ছেলের সাথে তর্কে পারেনা৷ চোখমুখ অন্ধকার করে নিচে নেমে গেল। তবে অয়ন গেল না। সে দাঁড়িয়ে রইলো। পকেট থেকে সিগারেট বের করলো। শাবিহার আশেপাশে থাকলে এই জিনিসটার কথা তার মনেই থাকেনা। একা থাকলে দিনে দশ বারোটা খেয়ে ফেলে। অথচ আজ সারাদিনে সে সবে মাত্র একটা হাতে নিয়েছে। বাহ!
চলবেপ্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল
২৩.
শাহজাহান বাড়ির সামনে গাড়ি থেমেছে ভোর পাঁচটায়। আনোয়ার সাহেব পেছনে তাকালেন। ব্যাক সিটে অরু একইভাবে শুয়ে আছে। পুরোটা রাস্তা জুড়ে এক ভঙ্গিতেই শুয়ে! নড়ছে না কিছু বলছে না। সুমিতা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছেন। অরুর মুখশ্রী দেখে ভাবলেন মেয়ে তার ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই ফিসফিসিয়ে স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,
-‘ পা মনে হয় খুব বেশি ব্যথা করছে! সারারাত নিঃশব্দে কেঁদেছে। ‘
আনোয়ার সাহেবের তা মোটেও মনে হচ্ছে না! মেয়েটা তার সম্পুর্ন ভিন্ন আচরণ করছে। মনে হচ্ছে, এটা তার মেয়ে নয়। তার মেয়ে হলে, এই ব্যথাটুকু সইতে পারতো না নিঃশব্দে। আসমান জমিন কেঁদে ভাসিয়ে দিত। এক মুহুর্তের জন্য শান্তি দিত না তাদের। কি এমন হয়েছে? সত্যি কী ব্যথায় এমন নেতিয়ে পড়েছে? মনের কোণে খটকা রয়েই গেল আনোয়ার সাহেবের। তিনি অরুকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকছেন। সিঁড়ির সামনে এসে থেমে গেলেন। অরুকে সোফায় শুইয়ে দিয়ে বললেন,
-‘ নিচের গেস্ট রুম খুলে দাও। এই পা নিয়ে উপরে কিছুদিন না থাকাই শ্রেয়! ‘
এখনের জন্য অরুকে গেস্ট রুমের দিক নিয়ে গেলেন। বিছানায় টানটান ভাবে শুইয়ে দিয়ে, পায়ের নিচে বালিশ গুঁজে দিলেন। তারপর মেয়ের পাশে বসলেন আনোয়ার সাহেব। অরুর লাল, ফোলা চোখজোড়া আধোঘুমে খোলা। মাথায় হাত বুলিয়ে আনোয়ার সাহেব শুধালেন,
-‘ বেশি ব্যথা করছে? ‘
বাবার প্রশ্নে অরু ধ্যান মেরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এক ফোঁটা চোখের পানি কোণ বেয়ে গড়িয়ে গেল। অস্পষ্ট দুর্বল স্বরে বলল,
-‘ অনেক ব্যথা করছে বাবা। ‘
আনোয়ার সাহেব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। ডাক্তার ডাকবেন নাকি কী করবেন বুঝতে পারছেন না! অরু ঘুমানোর প্রচেষ্টা করেছে। কিন্তু ঘুম আসছে না। বুকের চিনচিন ব্যথা তাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না। এই ব্যথা সেকেন্ডে সেকেন্ডে বেড়ে চলেছে।
-‘ আমি ঘুমাতে পারছিনা। আমাকে একটা ঘুমের টেবলেট দিবে? ‘
আনোয়ার সাহেব অস্বস্তি অনুভব করছেন। অসহায় সুরে বললেন,
-‘ না মা। ঘুমের ওষুধ নেওয়া ভালো না। ‘
-‘ আজকের জন্য। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। ‘
-‘ এইযে বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। দেখবে চট করে ঘুম চলে আসবে। ‘
বলতে বলতে অরুর মাথার কাছটায় বসলেন। মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন৷ অরু চোখজোড়া বুঝল। বন্ধ চোখের কোণ ঘেঁষে যাচ্ছে চোখের জল। আনোয়ার সাহেব দু’একবার হাতের তালু দ্বারা জল মুছে দিয়েছেন। তবে ফায়দা হলোনা। পুনরায় সেই একই ভাবে কোণ ঘেঁষে জল নামছে স্বেচ্ছায়। একপর্যায়ে বাবাকে স্বান্তনা দিতে অরু বুকে একরাশ যন্ত্রণা নিয়ে স্মিথ হাসল। ঠোঁটে স্মিথ হাসি ঝুলিয়ে বললো,
-‘ বাবার হাতে জাদু আছে। ‘
-‘ তাই বুঝি? আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে? ‘
-‘ হু। ‘
আনোয়ার সাহেব হাসলেন। সুমিতা বেগম দু’একবার উঁকিঝুঁকি মেরে গিয়েছেন। তিনি এসেই রান্নাবান্না বসিয়েছেন৷ কাজকর্ম করছেন। রেস্ট নেওয়ার সময় নেই।
বলতেই হয় আনোয়ার সাহেবের হাতে জাদু আছে। এইযে ছটফট করতে থাকা অরু কেমন ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়ে ফেললো। আজ তার ঘুমের দেশে বৃষ্টি এসেছে। বৃষ্টি রূপ নিয়েছে ঝড়ের। সবকিছু ভিজিয়ে, উড়িয়ে চুরমার করে দিয়ে গিয়েছে। এখন শুধু শুন্যতা রয়েছে চারপাশে।
বিকেল দিকে তড়িৎগতিতে কেউ কলিংবেল বাজাচ্ছে। সুমিতা বেগম আঁচলে হাত মুছতে মুছতে দৌড়ে এসেছেন দরজার সামনে। দরজা মেলে সামনে দেখতেই অবাক হয়ে গেলেন। মোস্তফা সাহেবরা ফিরে এসেছেন। দীপ্ত ছোট পুতুলের কাঁধ ব্যাগ ফেলে ‘ আপু, আপু ‘ বলে ছুটে গেল। বড়দের মাঝে সে ঠিকভাবে অরুকে দেখতেই পারেনি। একটু যে কেঁদে চশমা ভেজাবে সে উপায় টুকু কেউ রাখেনি। শাবিহাও ছুটেছে অরুর রুমের দিক। অরু তখন হেডবেডে হেলান দিয়ে বসে। চোখজোড়া বন্ধ করে আছে। হাতে একটি বই! বইয়ের দিক একটু নজর বুলিয়ে আবার চোখজোড়া বন্ধ করে নিচ্ছে। দীপ্ত ‘ হু হু ‘ স্বরে কান্নার অভিনয় করে অরুর মাথাটা নিজের ছোট বুকে জড়িয়ে নিয়েছে। অরুও দীপ্তকে মনমতো যা ইচ্ছে করতে দিল। দীপ্তর বাহুতে চোখবুঁজে পড়ে রইলো। শাবিহা চিন্তিত সুরে বলল,
-‘ কীভাবে ফেলেছিস বোতল টিমটিম? কিছু কী হয়েছিল? ‘
-‘ আবার ফেলে দেখাব? ‘
-‘ আল্লাহ! খবরদার এসব বাজে কথা মুখেও আনবি না বান্দর মেয়ে। কতটা ভয় পাইয়েছিস জানিস? ‘
-‘ মাত্র জানলাম। ‘
-‘ ভয়ে পেয়েছিস না? ঠিক হয়ে যাবে! এখনো ব্যথা করছে? ‘
-‘ একটু৷ ‘
সে মূহুর্তে আকাশ রুমে ঢুকল। তার সঙ্গে রুবি। রুবি অরুর পাশে এসে বসেছে। ক্রমাগত চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আকাশ ফাজলামো সুরে বলল,
-‘ তুই একটু বলছিস তারমানে একটুও ব্যথা অনুভব করছিস না! আমরা জানি৷ ‘
তার গলার স্বর ফাজলামো শোনালেও চোখমুখে চিন্তার ছাপ৷ অরু স্মিথ হাসার চেষ্টা করেও হাসলো না। নজর ঘুরিয়ে ফেললো। আকাশের পেছন তন্ময় এসেছে। তন্ময়ের পেছনে আশ্চর্যজনক ভাবে কলি দাঁড়িয়ে। এই মেয়েটাও এসেছে। অরু ভাবেনি এই আপদ সঙ্গে আসবে। অবশ্য আসবেই তো। এটা তার হবু শ্বশুরবাড়ি। আসবে, যাবে হয়তো একসময় চিরকাল তার চোখের সামনে থাকবে। ঘুরঘুর করবে তার তন্ময়ের সাথে! আহ, এই কী বিশাল যন্ত্রণা! অরুর শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় বুক চেপে মাথাটা এলিয়ে দিলো। নিজেকে কাঁথায় মুড়িয়ে বলল,
-‘ আমার পায়ে যন্ত্রণা হচ্ছে খুব৷ একটু রেস্ট নেই প্লিজ। ‘
শাবিহা ‘ আচ্ছা ‘ বলে উঠে দাঁড়ালো। সবাইকে একেক করে রুম থেকে বের করে দিল। তবে তন্ময় তখনো দাঁড়িয়ে। যাচ্ছেনা! দাঁড়িয়ে রয়েছে ঠাঁই। শাবিহা ধীর স্বরে বলল,
-‘ চলো ভাইয়া! ও রেস্ট নেক! ‘
তন্ময় বেড়িয়ে গেল। শাবিহা আবছা দরজা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সকলের পেছনে গেল না৷ তার মনে একটা অদ্ভুত সন্দেহ ঝেঁকে বসেছে কাল থেকে। সন্দেহ পাকাপোক্ত হতে সময় লাগলো না। কারণ পরপর সে অরুর কান্নার শব্দ শুনতে পেল৷ সেই কী এক ভয়াবহ আর্তনাদ তার কান্নার মাঝে। দরজায় রাখা শাবিহার হাতটা কেঁপে উঠলো। কী হয়েছে? কেন এভাবে কাঁদছে মেয়েটা? শাবিহা কি দৌড়ে রুমে ঢুকে অরুকে জড়িয়ে ধরবে? আস্থা দিবে? শাবিহা ঠিক কি করবে বুঝতে পারছেনা! কিছু একটা হয়েছে তবে তা কী? কিন্তু আপাতত অরুকে একা ছাড়া দরকার। কেঁদে নিক প্রাণ ভরে! সে নিজের রুমে চলে এলো। দীপ্ত তার বিছানায় বসে বাদাম খাচ্ছে। তার সামনে গিয়ে শাবিহা পায়চারি করছে। এদিক থেকে সেদিক যাচ্ছে। পায়চারি করতে থাকা শাবিহার দিক তাকিয়ে বিড়বিড় করে দীপ্ত বলল,
-‘ আমার ওই আপুটাকে ভাল লাগেনা! ‘
-‘ কোন আপু? ‘
-‘ কি যেন নাম! ফলি না যেন টলি। ‘
-‘ কলি! ‘
-‘ হ্যাঁ আমার তাকে ভালো লাগেনা। ‘
-‘ কেন? ‘
-‘ এম্নেই। দেখলে ওই ফলিটলি আপু আমাদের সাথে আসার জন্য কি কাহিনি গুলো করলো? ছ্যাচড়া! ‘
-‘ এভাবে বলেনা দীপ্ত৷ সে আমার মামাতো বোন৷ ‘
পুনরায় বিড়বিড় করে দীপ্ত বলল,
-‘ তাইতো কিছু বলছি না৷ ‘
শাবিহা হেসে গাল টেনে ধরলো দীপ্তর। দীপ্ত মন খারাপ করে বলল,
-‘ মন টিকছে না কিছুতেই। অরু আপুর হট্টগোল ছাড়া ভালোই লাগছেনা। শুন্য শুন্য লাগছে সবকিছু! ‘
প্রতিত্তোরে শাবিহা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
___________
সামনে অরুর ইন্টারের ফাইনাল এক্সাম। কলেজ না গেলেও পড়তে তো তাকে হবে? অরু আনোয়ার সাহেবকে বলেছেন, তার হোম টিচারকে আসতে বলতে। সাধারণত সে টিচারের কাছে খুব কম পড়েছে। বেশিরভাগ সময় তন্ময়ের কাছে পড়তে গিয়েছে। তবে এখন থেকে আর যাবেনা। কি দরকার? কোনো দরকার নেই। সন্ধ্যায় তার টিচার আসে। ডাক্তারের স্ট্রিক্ট নির্দেশ পা নড়ানো থেকে বিরত থাকতে কিছুদিন। তাই বিছানায় বসে পায়ের নিচে বালিশ গুঁজে পড়তে বসেছে অরু। পড়াশোনার এক ফাঁকে তন্ময়কে অরুর রুমের দরজার সামনে দেখা গেল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গিয়েছে। অরুকে পড়িয়ে শিক্ষক গিয়েছে নয়টায়৷ শিক্ষক যেতেই সুমিতা বেগম খাবার নিয়ে রুমে এসেছেন৷ অরু খেয়েদেয়ে বলল,
-‘ মা লাইট ওফ করে দিয়ে যেও। আমি ঘুমাব৷ ‘
সুমিতা বেগম চিন্তিত সুরে বললেন,
-‘ সারাদিন ঘরে আছিস। একটু বাহিরে আয়। তন্ময় হুইলচেয়ার এনেছে। এটাতে বসেও তো আসতে পারিস। ‘
-‘ ভালো লাগছেনা মা৷ ‘
সুমিতা বেগম উঠে দাঁড়ালেন। লাইট বন্ধ করে দরজা লাগিয়ে চলে গেলেন। অন্ধকার রুমে অরু তাকিয়ে রইলো। ড্রয়িংরুম থেকে হাসিঠাট্টার শব্দ শুনতে পারছেন৷ সবাই হাসিখুশি, ব্যস্ত! অরু হুট করে ঘুরে চোখজোড়া বন্ধ করে ফেললো। সে শব্দ শুনতে পেয়েছে। কেউ তার রুমের দরজা খুলছে! পরপর রুমের লাইট জ্বলে উঠলো। তন্ময়ের শান্ত ডাক শোনা গেল,
-‘ অরু? ‘
অরুর জবাব নেই৷
-‘ ঘুমিয়ে পড়েছিস? ‘
এবারও অরু জবাব দিলো না। তন্ময় ও আর ডাকল না। তবে সে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। রুম থেকে গেল না। ঘড়ির কাঁটা এগারোটা পঁয়তাল্লিশে। তন্ময় সম্পুর্ন একঘন্টা দাঁড়িয়ে আছে একইভাবে। অরুও বিছানায় একইভাবে শুয়ে। এবার তন্ময় নড়ল। শব্দ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় সজোরে দরজা লাগিয়ে গিয়েছে। তার শক্তির জোরে দরজার লকার ভেঙে মেঝেতে শব্দ করে পড়লো।
শুক্রবার ছুটির দিন। এ’দিনে শাহজাহান সাহেবরা বাসায় থাকেন। এই দিনে দুপুরের লাঞ্চ একত্রে করা সকলের জন্য বাধ্যতামূলক। ভাঙা পায়ের ছুতোয় এতদিন অরু নিজের রুমে খেয়েছে সারাদিন রুমেই থেকেছে। আজও ভেবেছে এই ছুতোয় বেরোবে না। তবে তাকে এবার কোনোপ্রকার সুযোগ দেওয়া হলোনা। কারণ অরুর রুমে স্বয়ং মোস্তফা সাহেব হাজির হয়েছেন। হাত বাড়িয়ে বললেন,
-‘ চাচ্চুর সঙ্গে আসো। এভাবে সারাদিন শুয়ে বসে থাকলে পা ভালো হবে কীভাবে? দেখি…’
বলে মোস্তফা সাহেব অরুকে উঠতে সাহায্য করছেন। অরু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। সকলের কথা ফেলতে পারলেও সে মোস্তফা সাহেবের কথা ফেলতে পারেনা। মুখের উপর বলতে পারবেনা, ‘ আমি যাবো না। ‘
অরু ধীর পায়ে টেবিলের সামনে এসেছে। সবাই বসে গিয়েছে। শুধু তন্ময় দাঁড়িয়ে। যেমন কারো অপেক্ষা করছে। এদিকে জয়া বেগম, মুফতি বেগম খাবার পরিবেশন করছেন। মোস্তফা সাহেব অরুকে নিজের পাশে বসিয়েছেন। অরু বসতেই তার পাশের খালি চেয়ার টেনে তন্ময় বসল। সে আলগোছে টেবিলের চারপাশ থেকে, তরকারির বাটি গুলো অরুর সামনে ঠেলে দিতে সাহায্য করছিল। দেখা গেল অরু তন্ময়ের পাস করা একটা তরকারির বাটিতে হাত লাগালো না। সে শুধু সাদা ভাত গিলতে লাগলো। নিজের সামনের তরকারি গুলোকে অগ্রাহ্য করে, মোস্তফা সাহেবের পাতের থেকে তরকারি নিয়ে খাচ্ছে। মোস্তফা সাহেব কেশে উঠলেন। আঁড়চোখে ছেলের দিক তাকালেন। তন্ময়কে একদমই ভালো দেখাল না। সে এখনো মুখে এক নালা ভাত তুলেনি। সেভাবেই শব্দ করে চেয়ার সরিয়ে হনহনিয়ে চলে যেতে লাগলো। তন্ময়কে পিছু ডাকল জয়া বেগম। মোস্তফা সাহেব, আনোয়ার সাহেবও ডেকেছেন। কিন্তু তাদের ছেলে ডাক শোনেনি যেমন। অরুও পরপর উঠে গিয়েছে। খুঁড়ে খুঁড়ে নিজের রুমে চলে গেল। ডাইনিং টেবিল জুড়ে নিস্তব্ধতা বিরাজমান।
________
দেখতে দেখতে অরুর পরিক্ষা সামনে চলে এসেছে। পায়ের ব্যান্ডেজও খোলা হয়েছে। ব্যথা কমেছে, সে পা নাড়াতে পারছে। পরিক্ষার দিন হেঁটে গিয়ে পরিক্ষা দিতে পারবে মনে হচ্ছে। মনপ্রাণ দিয়ে পড়াশোনায় ডুবে থাকা অরু সবকিছু ভোলার চেষ্টায়। তবে বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা অগ্রাহ্য করা যাচ্ছেই না। এই ব্যথা ক্রমাগত তাকে আঁকড়ে ধরছে। বিকেলে ছাদে উঠেছে বই হাতে। এতগুলো সিঁড়ি বেয়ে উঠেছে বিদায় পায়ের পাতায় চিনচিন ব্যথা অনুভব করছে। দোলনায় গিয়ে বসবে ভেবেছিল। আগ থেকেই সেখানে কলি বসে। মাস খানেক হয়ে গিয়েছে এই মেয়ে এখানে। অরুর সামনাসামনি তেমন পড়েনি। বেশিরভাগ সময় সে নিজের রুমে। সামনাসামনি হবে কীভাবে? অরুকে দেখে কলি উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে এসে কিছু একটা বলতে চাইল৷ তবে অরু শুনল না৷ আরাম করে দোলনায় বসে বই খুলেছে। কয়েকটি শব্দ পড়ে চোখবুঁজে নিচ্ছে। আবার খুলে কিছুটা পড়ে নিঃশব্দে বিড়বিড় করছে। তার পড়ার ধরন ও পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। কলি দাঁড়িয়ে রইলো। একপর্যায়ে এগিয়ে এসে বলল,
-‘ তোমার সাথে একটু কথা বলা যাবে? ‘
-‘ কাল বাদে পরশু আমার বোর্ড এক্সাম আপু! ‘
কলি চুপসে গেল। চোখমুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইলো। অরু পড়ছে। সন্ধ্যার আজান দিবে দিবে ভাব। চারপাশ সোনালী আলোয় আলোকিত। কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্য ডুবে যাবে বলে। আজান দিতেই কলি নিচে নেমে গেল। কলি যেতেই অরু বই বন্ধ করে দোলনায় মাথাটা হেলান দিয়ে রাখল। তার দৃষ্টি স্তব্ধ, বিমুঢ়। অরু কতক্ষণ এক ধ্যানে বসেছিল জানেনা তবে একপর্যায়ে তন্ময়ের কন্ঠের স্বর শুনতে পায়।
-‘ কার পারমিশন নিয়ে ছাঁদে উঠেছিস? ‘
অরু জবাব দিলো না। নজর বইয়ে রেখে বসে আছে। তন্ময় তাড়াহুড়ো পায়ে অরুর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রশ্ন করলো,
-‘ এই পা নিয়ে তুই ছাঁদে কেন আসছিস? ‘
অরু উঠে দাঁড়ালো। বই নিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। তন্ময় পেছন থেকে ডাকল। অরু শুনছে না দেখে পিছু ছুটেছে৷ ধরবে বা কিছু বলবে তার পূর্বেই অরু অনুভুতিহীন কন্ঠে বলল,
-‘ আমার থেকে দূরে থাকুন। ‘
মুহুর্তেই তন্ময়কে স্তব্ধ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।
চলবে ~~