প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
|১|
প্রথম অধ্যায়
ছোটবেলায় খুব হুমায়ূন পড়তাম। হঠাৎ একদিন লাইব্রেরির কোণে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটা বই পেলাম। তারপর থেকেই ধ্রুব নামটা হয়ে উঠল খুব প্রিয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই নামটা কীভাবে যেন মনের মধ্যেখানে গেঁথে গেল। আমি এই নামের প্রেমে পড়ে গেলাম। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, ধ্রুব নামের কোনো ছেলের সাথেই প্রেম করব। আকাশ-বাতাস মিথ্যে হয়ে যাওয়ার মতো উত্তাল প্রেম। সেই প্রেমের কথা ভাবতে ভাবতেই কিশোরী থেকে যুবতী হলাম। কাটিয়ে দিলাম আঠারোখানি বসন্ত। কলেজের পাট চুকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। আর তখনই ভীষণ আশ্চর্য এক ঘটনা ঘটল।
আমি তখন ময়মনসিংহে একা থাকি। আনন্দমোহন কলেজের সামনে একটা বাড়ির চার তলায় আমার ঘর। নতুন উঠেছি। বাড়ির মালিকের সাথে পরিচয় নেই। সকাল করে ক্লাসে যাই। বাকিটা সময় ঘর আর বারান্দায় পায়চারি করি। লেখালেখি করি। কখনোও-বা রাজ্যসম বইয়ের মাঝে ডুবে থাকি। তবে একদিন অন্যরকম কিছু ঘটলো। ক্লাস শেষে বন্ধুদের সাথে বসলাম। ছোলা-বাদাম দিয়ে আড্ডা শুরু হয়ে ফুসকা দিয়ে শেষ হওয়ার আগেই পেছন থেকে কেউ ডাকল,
‘ আরে ধ্রুব! কী অবস্থা? কখন এলি?’
আমি চমকে উঠলাম। এই প্রথম সত্যিকার কোনো মানুষকে ‘ধ্রুব’ বলে ডাকতে শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। হঠাৎ কিশোরী বয়সের সেই লাল-নীল অনুভূতিরা ঝাঁপিয়ে পড়ল বুকে। একটু লজ্জা, একটু কৌতূহল নিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম। কিন্তু হায়! এতো ছেলের ভিড়ে ধ্রুব নামক মানুষটিকে শনাক্ত করা হলো না। আমার মন খারাপ হলো। কিছুটা অন্যমনস্ক হলাম। বন্ধুদের বললাম,
‘পেছনে খেয়াল রাখ। সবগুলো ছেলের চেহেরা একদম মুখস্থ করে ফেলবি। কোন ছেলেটা ধ্রুব জানতে হবে। জানতেই হবে। মিশন ধ্রুব স্টার্টস নাও। মিশন সাকসেসফুল হলে ফুসকার বিল আমার।’
বন্ধুরা বেশ মজা পেলো। নতুন কোনো এডভেঞ্চারে আগ্রহ যেন উতলে উঠার জোগার। ছেলেগুলো প্রায় আধঘন্টা মতো বসে তিন-চার কাপ চা শেষ করল, গল্প করল অথচ একবারও ধ্রুব নামে কাউকে সম্বোধন করল না। আমি তাদের দিকে পিঠ করে বসে ছিলাম। অধৈর্য হয়ে বললাম,
‘ হেই সোলজারস্? এনি ক্লু?’
বন্ধুরা মাথা নেড়ে আকাশসম ধৈর্য নিয়ে বসে রইলো। আশেপাশের সব পুরুষের উপর কুটিল দৃষ্টিতে নজর রাখতে লাগল। দীর্ঘ অপেক্ষার এক পর্যায়ে শেষমেশ আবারও সেই নাম উচ্চারিত হলো। কেউ একজন চেঁচিয়ে বলল,
‘ এই ধ্রুব? ফোনে জানাস কিন্তু।’
সাথে সাথেই হৈ হৈ করে উঠল বন্ধুরা। হঠাৎ হৈচৈ-এ আশেপাশের মানুষগুলো যেন চমকে উঠল। ঘাড় ফিরিয়ে অবাক চোখে চাইতেই সব ক’টা শান্ত হয়ে বসল। চাপা গলায়, উল্লসিত কন্ঠে বলল,
‘ ওই, ওইযে ওই ছেলেটা। মিস্টার চেইক চেইক।’
আমি ঝটপট ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। ‘মিস্টার চেইক চেইক’ এর চেইক চেইক শার্ট আর ঘড়ি পরা হাত ছাড়া কিচ্ছুটি চোখে পড়ল না। ছেলেটা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতেই পেছনে ফেলে যাওয়া বন্ধুদের উদ্দেশ্যে থাম্পস্ আপ দেখাল। তারপর হারিয়ে গেল রাস্তার মোড়ে। আমার আবারও মন খারাপ হলো। সেই সাথে হলো আফসোস। সন্ধ্যার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় বন্ধুদের এক উল্লসিত ঝড় বয়ে গেল। সবাই মিলে ‘মিস্টার চেইক চেইক’ কে নিয়ে আলোচনায় বসল। কারো মতে, ছেলেটা ভারি মিষ্টি। কারো মতে, চলনসই। কেউ একজন ক্রাশড তো বাকিরা কোয়াইট রিজার্ভড!
দিন তিনেক ধ্রুবকে নিয়ে বিরাট হৈচৈ হলো। কল্পনা জল্পনা হলো। তাকে খোঁজার জন্য মিশন ইম্পসিবলের মতো ভয়াবহ সব পরিকল্পনা করে ফেলা হলো। তবে সেই সব পরিকল্পনার একটিও এক্সিকিউট হলো না। চারদিনের মাথাতেই ক্লাস আর পরীক্ষার চাপে স্টিলের মতো সোজা হয়ে গেলাম। সুড়সুড় করে কমে গেল উত্তেজনার বহর। জীবন নামক রেলগাড়ীটা আবারও চলতে লাগল হেলেদুলে। একদম ঘটনাহীন ভাবে কেটে গেল আরও সাতটি সকাল। কিন্তু তার পরের সকালেই ঘটনাসমূহ নিয়ে আবির্ভূত হলো ধ্রুব। প্রিয়তাকে নিয়ে গাঙিনাপাড়ের রাস্তা ধরে হাঁটছি। হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ। হঠাৎ প্রিয়তা ডানহাতটা খামচে ধরে চেঁচাল,
‘ নিশু! নিশু! মিস্টার চেইক চেইক। ওই তো, ওই তো মিস্টার চেইক চেইক।’
ব্যস্ত পথচারীরা প্রিয়তার হঠাৎ চিৎকারে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। তাকাল প্লেইন টি-শার্ট গায়ে লম্বাচওড়া ছেলেটাও। চোখে চোখ পড়ল। কাটলো কিছু মুহূর্ত। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দেখলাম শ্যামলা মুখে বড় বড় বিস্মিত দুটো চোখ। কিন্তু ধ্রুবরা তো শ্যামলা হওয়ার কথা না। ধ্রুবরা হবে বলিষ্ঠ শরীরে, টকটকে গৌড় বর্ণ। শ্যামলা গায়ে ধ্রুব নামটা যেন ঠিক মানাল না। ছেলেটা এগিয়ে এসে বেশ গম্ভীর কন্ঠে শুধাল,
‘ আমাকে ডাকলেন?’
প্রিয়তা চোখ-মুখ কুঁচকে যেন আকাশ থেকে পড়ল। বলল,
‘ কী আশ্চর্য! আপনার নাম কী মিস্টার চেইক চেইক?’
ছেলেটা থতমত খেয়ে বলল,
‘ না।’
‘ তাহলে?’
কথাটা বলে ভ্রু নাচাল প্রিয়তা। ছেলেটা কয়েক সেকেন্ড বিস্ময় নিয়ে চেয়ে থেকে পাশ কাটাতেই প্রিয়তার বাহুতে চড় বসালাম আমি,
‘ পাগল তুই? এভাবে কেউ চেঁচায়? যদি বুঝে যেতো?’
প্রিয়তা পাত্তাহীন কন্ঠে বলল,
‘ ধূর! ছেলেদের অতো বুদ্ধি আছে নাকি আজকাল? আর বুঝলেই বা কী? কী এমন হতো?’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ঘাড় ফিরিয়ে ধ্রুবর হেঁটে যাওয়া সেই রাস্তার দিকে চাইলাম। মনের মাঝে কিছু একটা হলো, আগ্রহ। কৌতূহল। নাকি অন্যকিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। প্রিয়তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। সিঁড়ি ভেঙে চার তলায় নিজের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। ধ্রুব খুব দ্রুত পায়ে চারতলা পেরিয়ে পাঁচ তলায় উঠে গেল। আমি আর প্রিয়তা চোখ বড় বড় করে একে অপরের দিকে তাকালাম। প্রিয়তা আমার হাত খামচে ধরে বলল,
‘ সর্বনাশ নিশু! এই ছেলে কী আমাদের ফলো টলো করছিল নাকি রে? ইয়া মা’বুদ! এতো ভালো ছেলেটা এমন খারাপ কাজ করতে পারে? এখন আমাদের কী হবে? ইয়া আল্লাহ! আজকালকার ছেলেগুলো কী জঘন্য!’
আমি চোখ রাঙিয়ে তাকালাম। হাতটা ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
‘ তুই দিন দিন চূড়ান্ত বলদ হচ্ছিস প্রিয়। এমন বলদামো কথা আমার সামনে বলবি না। ছেলেটা যদি আমাদেরই ফলো করতো তাহলে চারতলা ফেলে পাঁচ তলায় কেন যেতো? পাঁচ তলায় নিশ্চয় তার শ্বশুর বসে নেই? সেখানে তো মালিক আঙ্কে…..’
কথাটা বলতে বলতেই থেমে গেলাম আমি। আবারও বড় বড় হয়ে গেল দু’জনের চোখ। বিস্মিত চোখে একে অপরের দিকে চেয়ে থেকেই চেঁচিয়ে উঠলাম,
‘ পাঁচতলায় মালিক আঙ্কেলরা থাকে!’
প্রিয়তা হতাশ ভঙ্গিতে ঠোঁট উল্টাল,
‘ কাহিনি কী বল তো? ছেলেটা কী মালিককে বিচার টিচার দিবে নাকি আবার? ফট করে বাসা ছেড়ে দিতে বললে কী হবে? কোথায় যাব? জেঠিমণি তো একদম খুন করে ফেলবে।’
আমি দরজার লক খুলতে খুলতে বললাম,
‘ আরে ধূর! বিচার কেন দিবে? আমার মনে হয় ছেলেটা বোধহয় মালিক পক্ষের আত্মীয় টাত্মীয় হবে। বেড়াতে এসেছে।’
কথা বলতে বলতে দরজাটা খুলতেই লাফিয়ে ঘরে ঢুকে গেল প্রিয়তা। হাতের ব্যাগগুলো এদিক ওদিক ছুঁড়ে ফেলে ফাঁটা বাঁশের মতোই চেঁচিয়ে গাইল,
‘ ছিলে তুমি চান্দির উপর
দেখা কেন দাওনি?
ও পরাণ পপপপাখি… দেখা কেন দাওনি?’
আমি জুতো খুলতে খুলতে বিরক্ত হয়ে বললাম,
‘ সুরের থেকেও জঘন্য লিরিক্স। এমন ফালতু লিরিক্স কোথায় পাস তুই?’
আমার ভয়াবহ সমালোচনায় প্রিয়তার খুব একটা যায় আসলো বলে মনে হলো না। সে কুটিল হাসি দিয়ে আমার দিকে চাইল। আমি ভ্রু কুঁচকে ধমক দিলাম,
‘ কী?’
প্রিয়তা লাফিয়ে আমার সামনের চেয়ারটাতে বসলো। দাঁত বের করে হেসে বলল,
‘ ওইযে! তুমি ছিলা চান্দির উপর। চান্দি থেকে বুকে কী করে নামাবে বন্ধু? হু হু?’
আমি সামনে থেকে সরে যেতে যেতে বললাম,
‘ অশ্লীল!’
তারপর থেকে রোজ সকালেই কোনো না কোনোভাবে একদম ভূতের মতো আমার চোখে চোখ পড়ে যেতো ধ্রুবর। আমি বারান্দায় বসে বই পড়তাম। সে গেইট দিয়ে বেরুতো। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতো। কখনো বা ক্যাম্পাসের চায়ের স্টলগুলোতেও দেখা যেতো তাকে। বাসার পাশের গার্লস কলেজের সামনে দিয়ে যখন ধ্রুব হেঁটে যেত কলেজ পড়ুয়া মেয়েগুলোর ফিসফিস কথা। তাদের উল্লাসও চোখে পড়তো মাঝে মাঝে। ধ্রুবর মাথা নিচু করে চুপচাপ হেঁটে চলা। কারো ডাকে আশ্চর্য সুন্দর করে হাসা। সবই যেন একরাশ মুগ্ধতার মতো আভা ছড়াতো। আর সেই আভা ছিটকে এসে পড়তো আমার চোখে, মুগ্ধতা মাখা মুখে। আমি মুগ্ধ হতাম। খেয়াল করতাম তার মুখ, চিবুক, ঠোঁট, গাল আর থুতনির কাছের ওই কালো তিল। কিন্তু সেই মুগ্ধতা মুগ্ধতা পর্যন্তই আটকে ছিল। খেয়াল করা পর্যন্তই থমকে ছিলো। তাকে জীবনে জড়ানোর বিন্দুমাত্র পরিকল্পনা আমার ছিল না। কিন্তু ভাগ্য বিধাতার গল্পটা বোধহয় ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না। কোথাও একটা ফাঁকা, নিঃসার লাগছিল। তাই কোনো এক দুপুরে, পাঁচ তলার সিঁড়ির গোড়া থেকে এক সম্বোধনে থমকে গেলাম আমি। অবাক হয়ে চাইলাম। তরতর করে পাঁচতলার সিঁড়িটা পেরিয়ে, খুব ছটফটে ভঙ্গিতে আমার সামনে এসে দাঁড়াল ধ্রুব। খুব পরিচিত ভঙ্গিতে বলল,
‘ ভাবী? তুমি নাকি ভাইয়ার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকো? ব্যাপারটা তো ভালো না। তুমি আর ভাইয়ার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকো না। তুমি তাকালে ভাইয়া তাকাতে পারে না।’
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। অসহায় চোখে প্রিয়তার দিকে চাইলাম। প্রিয়তাও চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে। চোয়ালখানি ঝুলে পড়ার জোগাড়। আমি আবারও ঘাড় ফিরিয়ে ধ্রুবর দিকে তাকালাম। এতোগুলো দিনে ধ্রুব আর আমার প্রথম কনভারসেশনেই সে আমায় ডিরেক্ট ভাবী ডেকে ফেলল? কী আশ্চর্য! আমার ধ্রুবকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করল,
‘ শুনো ভাই? বিশ্বাস করো। তোমার কোনো বড় ভাই টাইকে আমি চিনি না। দয়া করে আমাকে অজ্ঞাত কোনো মানুষের বউ বানিয়ে ফেলো না।’
কিন্তু বলা হলো না। কেন জানি গলা দিয়ে কোনো কথাই বেরুলো না। আকস্মিক শকে স্তব্ধ হয়ে ধ্রুবর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। ধ্রুবর চোখে তখন ছেলেমানুষী কৌতূহল।…
(চলবে)