বাক্সবন্দী চিঠি পর্ব -৩০ ও শেষ

গল্পঃ #বাক্সবন্দী_চিঠি
লেখিকাঃ নিনিকা জামান নূর
পর্বঃ ৩০ ( অন্তিম পর্ব-১)
ইতু ইনটারনশীপ এ জয়েন করেছে একমাস হলো।
তার সাথে মেয়ে আছে চারজন বাকি গুলো ছেলে।
সুমি আর রিমা তার খুব কাছে মানুষ হয়ে গেছে এতোদিনে। বাকি কলিগদের সাথেও তার ভালো সম্পর্ক। শুধু কনা নামের মেয়েটা তার সাথে কথা বলে না। যখনই দেখা হয় বাঁকা চোখে তাকিয়ে থাকে। তার এইভাবে তাকিয়ে থাকার কারন ইতু ভালো করেই যানে। এখানে সিনিয়র যে ডাক্তারগুলো ইতুকে বেশ পছন্দ করে। মাঝে মাঝে তাদের পেশেন্ট এর দায়িত্ব দিয়ে থাকে। কনা ব্যাপারটা একদমই সহ্য করতে পারে না। ঈর্ষান্বিত হয়ে সে সিনিয়রদের আশে পাশে ঘুরঘুর করে।
ইতু আর তার সঙ্গিরা এইসব দেখে মাঝে মাঝে হাসে তার উপর। এই ইনটারশীপ শুধু এক বছরের। এখান থেকেই তাদের চিকিৎসক জীবনের সূচনা হবে। ইতু চায় সে যত ভালো করে শিখবে সে তত মানুষের সেবা করতে পারবে। তার স্বপ্নের শুরু এখান থেকেই।
এইসব ছেলে মানুষি করে এই সময়টা সে নষ্ট করতে চায় না।
ইতুরা হাসপাতালের কেন্টিনে বসে চা খাচ্ছিলো। আজ ইতু,রিমা আর কনার নাইট ডিউটি আছে। হঠাৎ কনা এসে বললো,”আজ তোমাকে যে দিয়ে গেলো সে কে? তোমার ভাই?”
হঠাৎ এসে এইভাবে প্রশ্ন করায় ইতু বিব্রত হয়ে গেলো। এই একমাসে কনা এই প্রথম তার সাথে কথা বলছে। ইতু এতোটাই অবাক হয়েছে যে কথা বলতেই ভুলে গেছে। রিমাও ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
এদের এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে গেলো তার।
কনা বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,”এইভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতে হয় সেটাও যানো না?”

ইতু দীর্ঘঃশ্বাস ফেললো কনার প্রশ্ন বুঝে।
এটা নতুন নয় তার কাছে। আবিরকে দেখে সবাই ভাই অথবা বয়ফ্রেন্ড ভাবতো। ইতু এখনো তার কলিগদের যানায়নি তাদের বিয়ের কথা। ইনটারশীপ শেষ করার পর তাদের বিয়ের প্রোগ্রাম হবে তাই ইতু ইচ্ছা করেই লুকিয়ে রেখেছে।
যখনই কেউ ইতুকে আবিরকে তার সাথে দেখে এমন প্রশ্ন করে। কেউ কেউ তো প্রেমে প্রস্তাব ও দেয় ইতুর কাছে। ইতু সেসব প্রস্তাব আবিরের কাছে পৌঁছে দেয়। আবিরের তখন এক কথা,” আমার এতো সুন্দর ডাক্তার বউ ছেড়ে আমি ওই পেত্নীদের সাথে প্রেম করবো? আমার এই লক্ষীটি আছে আর কারোর দরকার নেই।”

ইতু গলা পরিষ্কার করে বললো,”তুমি হঠাৎ আমার সাথে কথা বলতে এসেছো? তুমি তো আমার ছায়াও সহ্য করতে পারো না। এখন আমি কার সাথে এলাম কার সাথে গেলাম সেটা যেনে তুমি কি করবে?”

কনা অসস্তি নড়ে চড়ে বসলো। সে ইতুকে একদমই সহ্য করতে পারেনা কথাটা ঠিক তবে এই প্রথম কাউকে প্রথম দেখায় ভালো লেগেছে তার। নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারেনি। ছেলেটা কে না জানা পর্যন্ত কোন কিছুতেই মন বসাতে পারছে না সে।

কনা অপ্রস্তুত হয়ে মেকি হেসে বললো,” কি বলছো ইতু! সহ্য করতে পারিনা কে বললো? আমি এমনিতেই কথা বলি না তেমন। তুমি ভুল ভাবছো।
বলো না ছেলেটা কে?”

ইতুর মনে মনে হিংসা হচ্ছে খুব। সবাই কেন তার জামাইটার পিছনে লাগে? আর কাউকে চোখে পড়ে না বুঝি? ইতু বলবে বলবে না করেও ইচ্ছা করলো কনাকে একটা ঝটকা দিতে। মেয়েটা কম জ্বালায়নি তাকে। সব সময় তার নামে বিচার লাগিয়েছে।
ইতু এক গাল হেসে বললো,” সে আমার ভাই নয় কনা।”
কনার কুঁচকানো ভ্রু আরো কুঁচকে গেলো।
“ভাই নয়? তাহলে কে?”
“সেটা জেনে তুমি কি করবে?”
“ছেলেটাকে আমার পছন্দ হয়েছে তাই জিজ্ঞেস করছি।”
কনার সোজাসাপ্টা উত্তর শুনে ইতু অবাকই হলো।
নিজেকে সামলে নিয়ে ইতু বললো,” আমার হাসবেন্ড সে।”
কনা অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকলো ইতুর দিকে।
রিমা চুপচাপ এদের কথা শুনলেও ইতুর উত্তর শুনে “কি” বলে চেঁচিয়ে উঠলো।
“আস্তে রিমা। আমরা হাসপাতালে আছি। এইভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন?”
“চেঁচাচ্ছি মানে? তোর বিয়ে কবে হলো? আমাদের তো কিচ্ছু জানাসনি কেন?”
রিমার কথা শুনে কনা হো হো করে হেসে উঠলো।
“ইতু তুমি আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছো? মানছি তোমার সাথে আমার তেমন ভালো সম্পর্ক নেই। তাই বলে আমি ছেলেটাকে পছন্দ করেছি জেনেও মিথ্যা বলছো কেন? ও তোমার হাসবেন্ড মানে? তোমার বিয়ে হল কখন? নাকি তুমিও পছন্দ করো তাই এইভাবে বলছো? দেখ ছেলেটার উপির ক্রাশ খাওয়া স্বাভাবিক। এতো হ্যান্ডসাম যে কেউ ক্রাশ খাবে। তাই বলে নিজের হাসবেন্ড বলে পরিচয় দেয়াটা লেম।”

ইতুর মেজাজ চটে গেলো। এখন কি এদের কাবিননামা দেখাতে হবে নাকি? যত্তসব।
ইতু কথা না বাড়িয়ে উঠে চলে গেলো।
২০৩ নং কেবিনে একজন বৃদ্ধ মহিলা পেশেন্ট রয়েছে। তাকে একবার রেগুলার চেকআপ করতে হবে।
ইতুকে দেখলেই হেসে কাছে ডেকে বসতে বলেন। তার কিশোর বয়সী কিছু কিছু গল্প বলেন। অনেক কিছুই গুলিয়ে ফেলেন তাও বলেন তিনি। ইতু মনোযোগ দিয়েই শুনে সেসব গল্প।

মধ্যরাতের দিকে একজন গর্ভবতী মহিলাকে হাসপাতালে আনা হলো। ইতু ওটি রেডি করতে বলে সিনিয়র ডাক্তার কে খবর দিতে বললো। নিউকাল কর্ড হয়েছে। বাচ্চার গলায় নাড়ি পেচিয়ে গেছে। যদিও এটা তেমন চিন্তার কারন নয়। গর্ভবস্থায় শিশুরা মুখ বা নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নেয় না। আম্বিলিকাল কর্ড বা নাভিরজ্জুর মাধ্যমে নিঃশ্বাস নেয়। এই আম্বিলিকার কর্ড শিশুর গলায় পেচিয়ে যাওয়াকে নিউকাল কর্ড বলা হয়। মহিলার ডায়বেটিস আছে তাই সি সেকশন করা যাবে না।
সিনিয়র ডাক্তার স্বপ্না এসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বললেন,” বাচ্চার হার্ড বিট একটু কম। মনে হচ্ছে আম্বিলিকার কর্ড শক্তভাবে পেঁচিয়ে গেছে।
মা কে এই ব্যাপারে কিছু জানানোর দরকার নেই। আমার নরমাল ডেলেভারি করবো। তার পেইন উঠার ওষুধ দিতে বলো। আর ও.টি রেডি রাখতে বলো।”
“জি ম্যাম আমি আগেই রেডি করে রাখতে বলেছি।”
“তাহলে পেইন উঠলে আমাকে খবর দিবে আমি অন্য পেশেন্ট দেখে আসছি।”

ভোর রাতের দিকে তার প্রশব ব্যাথা শুরু হলো। ১৫ মিনিট পর ডাক্তার বেরিয়ে এলো একটা ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে। বাবার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, আপনার ছেলে হয়েছে। কংগ্রেস।”
লোকটা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েই কেঁদে দিলেন। এর থেকে সুখের মুহূর্তে বোধহয় আর হতে পারে না।
ইতু সে দিকে তাকিয়ে প্রশান্তি মাখা হাসলো।
সকালে আবিরকে কল দিয়ে জানিয়ে দিলো তায়াকে পিকাপ করে নিতে।
সকাল ছয়টায় ইতু কোনরকমে হেটে গেটের কাছাকাছি এলো। সারারাত জেগে ছিলো সে। শরীর আর চলছে না।
আবির ইতুকে দেখে মুচকি হাসলো। চোখের ইশারায় তাকে বাইকে উঠতে বললো।
ইতু সেদিকে তাকিয়ে হাসলো। একসময় আবির তাকে এই বাইকে নিতে চায়নি। বাইকে ফাঁকা জায়গা অন্য কারোর জন্য বরাদ্দ রাখা ছিল। এখন আবিরের সবকিছুতে শুধু তার রাজত্ব।
ইতু বাইকে উঠে বসতেই আবির বললো,”মেয়েটা কি তোর ফ্রেন্ড? এইদিকেই তো দৌড়ে আসছে মনে হচ্ছে।”
ইতু তাকিয়ে দেখলো কনা আসছে।
এমনিতেই শরীর চলছে না তার তার উপর কনাকে দেখেই মেজাজ বিগড়ে গেলো। সে কনাকে দেখিয়ে আবিরের দিকে আরো চেপে বসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। কনা থমকে দাঁড়ালো। ইতু মুচকি হেসে আবিরের পিঠে ছোট ছোট চুমু দিতে লাগলো।
আবির একবার কনার দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।
“কি করছো ইতু মেয়েটা দেখছে।”
“দেখুক। তুমি চলো তো।”
আবির মেয়েটার লটকানো মুখ দেখেই বুঝে গেলো পুরো ব্যাপারটা। সে মুচকি হেসে ইতুর হাত টেনে তাতে আলতো চুমু দিয়ে বাইক স্টার্ট দিলো।
ইতু আবিরের পিঠে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। তার এখন ঘুম প্রয়োজন খুব।
আবির বুজতে পেরে ইতুকে সতর্ক করে দিলো। কোনমতেই এখন ঘুমানো যাবে না।
আবির বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিলো। ১৫ মিনিটেই তারা বাসায় পৌঁছে গেলো। আবির ইতুকে কোলে নিয়েই বাসায় ঢুকলো।
ইতু আবিরের বুকের উষ্ণতা পেয়েই ঘুমিয়ে গেছে। আবির সে দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। আবির খুব সাবধানে তাকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে এলো।
ফ্রেশ হয়ে এসে আবার ইতুকে জড়িয়ে ধরে তার পাশে শুয়ে পড়ল।
ইতুর ঘুম ভাঙ্গলো ১১টায়। চারপাশে তাকিয়ে দেখে আবির কোথাও নেই। বেডের পাশে তাকিয়ে দেখে সেখানে নাস্তা রাখা আর ছোট একটা কাগজ।
ইতু হাতে নিয়ে দেখলো আবির লিখেছে,” উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নিয়ো। আমি কিছুক্ষনের মধ্যেই ফিরে আসবো।”
ইতু হাসলো সেদিকে তাকিয়ে। ঘড়িতে সময়টা দেখে নিয়ে ফ্রেশ হতে গেলো। আজ তার অফ ডে। তাই ভাবছে আবিরকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসবে। ইনটারশীপ শুরু করার পর থেকে সে আবিরকে একদমই সময় দিতে পারছে।
ইতুর পড়াশোনার জন্য আবির সব ছেড়ে তার সাথে চট্টগ্রাম থাকতে চলে এসেছে। ইতু বারবার বলেছিলো সে হোস্টেলে থাকবে তাও শুনেনি। সে কিছুতেই ইতুকে একা ছাড়বে না।
হাস্পাতালের পাশেই একটা চারতলা ভবনের তিনতলায় ইতু আর আবির থাকে। ইতু ব্যস্ত থাকলেও এই বাসাটা সে তার মন মত সাজিয়েছে। বারান্দায় বাগান করেছে। হরেকরকমের ফুল আর ওষুধি গাছ রয়েছে তার বাগানে।
গাছে পানি দিয়ে ইতু আয়েশ করে সাজতে বসলো।
একটা লেবেন্ডার কালারের জামদানী শাড়ি নিলো সাথে মেচিং ব্লাউজ। শাড়ি পড়ে সবে এক কানে ঝুমকা পড়েছে এই সময় আবির ফিরে এলো।
ইতুকে দেখে কিছুক্ষন থমকে দাঁড়ালো।গল্পঃ #বাক্সবন্দী_চিঠি
লেখিকাঃ নিনিকা জামান নূর
পর্বঃ ৩০ ( সমাপ্তি)

তাদের বিয়ের দুই বছর পাঁচ মাস চলছে। ইতুর এখনো আবিরের সেই নেশা ভরা চোখের দিকে তাকলে বুক শিরশির করে উঠে।
ইতু লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো।
আবির এসে ইতুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে আলতো চুমু খেলো।
ইতু কেঁপে উঠে আবিরের বুকে মুখ লুকালো।
আবির মুচকি হেসে ইতুর চুমু খেলো।
“এইভাবে রেডি হয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছে বলো তো?”
“শুধু আমি না তুমিও যাচ্ছো।”
ইতুর চুলগুলো কানের পিছে গুজে দিতে দিতে বললো,” কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
ইতু কিছুক্ষন ভেবে বললো,”চলো ভাটিয়ারী লেক যাবো।”
আবির ইতুর কানে আরেকটা ঝুমকো পরিয়ে দিতে দিতে বললো,
“ঠিক আছে রেডি হয়ে নাও আমি বাবার সাথে কথা বলে আসছি।”
“ঠিক আছে।”

ভাটিয়ারী লেক যেতে তাদের 30 মিনিটের মতো লাগলো। সেখানে পৌঁছে ইতু বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো।
জায়গাটা এত সুন্দর ইতুর মন ফুরফুরে হয়ে যায়। আবিরকে নিয়ে সে এখানে কয়েকবার এসেছে। সাপের মতো আঁকা বাঁকা লেকটা সানসেট পয়েট থেকে সূর্যাস্ত দেখতে অনেক বেশি সুন্দর লাগে।
এখানে নৌকা ও মাছ ধরার ব্যাবস্থা আছে।
আবির বললো,” চলো আগে ক্যাফেতে গিয়ে কিছু খেয়েনি। লাঞ্চটা শহরে গিয়ে করবো।”
“এখানে লেকের পাশে বসেই খাবো।”
“তাহলে বসো আমি স্যান্ডউইচ নিয়ে আসছি।”
ইতু ভালো একটা জায়গা দেখে সেখানে বসে পড়লো।
আশে পাশে মানুষ তেমন নেই। বাতাস বইছে চারপাশে। ইতু চোখ বন্ধ করে প্রকৃতির গ্রান নিতে লাগলো।
আবির এসে বসলো পাশে।
“এই নাও তোমার চিকেন স্যান্ডউইচ ।”
ইতু আবিরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
মানুষ তার জন্য নিঃস্বার্থ ভাবে করে যাচ্ছে। কখনো তার ওপর বিরক্ত হয়নি। সব সময় আগলে আগলে রেখেছে।
বিজনেসটা আপাতত বাবার হাতে তুলে দিয়ে এসেছে । কিছুদিন হলো চট্টগ্রামেও একটা ব্রাঞ্চ খোলার চেষ্টা চলছে।
এই দু বছরে তাদের সম্পর্ক আরো গভীর হয়েছে। নিজেদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং বেড়েছে। একজন আরেকজনের প্রতি সম্মান বেড়েছে। আর ভালোবাসা যেন প্রতি মুহুর্তে বেড়ে চলছে।
দুই বছর আগে সে ঘটনা তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়াতে পারেনি।

অতিত-

আবির আর কুহুকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে অয়ন। কুহু বাসায় আসার পর আবির তাকে টেক্স করে বলেছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় যেতে। আবির দরজা খোলাই রেখেছে।
অয়ন গিয়ে তাদের এইভাবে পড়ে থাকতে দেখে মাথা কাজ করছিলো না।
তাড়াতাড়ি এম্বুলেন্স কল দিয়ে তাদের হাসপাতালে নিয়ে আসে। ইতু এসেছে 20 মিনিট পরেই। ডাক্তারের সাথে কথা বলে ইতু জানতে পারে আবিরের শরীরে এক ধরনের নে/শা দ্রব্য পাওয়া গেছে। এই ড্রা/গ শরীরে উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলে।
এইসব শুনে ইতু থমকে গেল। কুহু কি করে পারলো এমন একটা কাজ করতে। এতটা নিচে নেমে গেছে সে? কি হতে পারতো ভেবেই বুক কাঁপছে তার।
অনুও স্থির হয়ে গেলো এমন কথা শুনে।
ডাক্তার কুহুর কথা বলতে নিলে ইতু চলে এলো সেখান থেকে।
আবিরের কেবিনের কাছে গিয়ে আবিরকে দেখে নিজের কান্না আর ধরে রাখতো পারলো না।
হুহু করে কেঁদে উঠলো।
এই মানুষটাকে তার থেকে দূরে সরানোর ষড়যন্ত্র চলছিলো। যদি সত্যি সত্যি এমন কিছু হয়ে যেতো? ইতুর কি হতো।
ইতু আর ভাবতে পারছে না।
কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলো।
অনু এসে ইতুর কাঁধে হাত রাখলো।
“আমাদের মনে হয় একবার কুহুর কাছে যাওয়া উচিত। ”
ইতু ক্ষুব্ধ হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ” ওই মেয়ের নামও আমার সামনে নিবি না। তোর দেখার ইচ্ছা হলে দেখা আয় আমকে টানবি না। যে মেয়ে আমার সংসার ভাঙ্গার জন্য এতো নিচে নামতে পারে আমি তার মুখ ও দেখতে চাইনা।”
অনু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “কুহুর বাচ্চাটা মারা গেছে। মেয়েটা পাগলের মতো আহাজারি করছে। মাকে আমকে দেখে বারবার তোর কথা বলছে। একবার চল।”
কুহুর কথা শুনে ইতুর বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। করুন চোখে অনুর দিকে তাকালো। যতই খারাপ করুক কহু একজন মা তার বাচ্চা হারিয়েছে। এইসময় ইতু কুহুকে উপেক্ষা করতে পারবে না।
ইতুর বাচ্চাটার জন্য খারাপ লাগছে। দুনিয়ার আলো দেখার আগেই আল্লাহ তাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেছে।
অনু ইতুকে ধরে কুবুর কেবিনেএ দিকে নিয়ে গেলো।
ইতুকে দেখেই কুহু হুহু করে কেঁদে উঠলো। বেড থেকে উঠতে চাইলে দুইজন নার্স তাকে ধরে রাখলো।
“ইতু আমাকে মাফ করে দাও। ওদের বলো না আমার বাচ্চাটাকে ফিরিয়ে দিতে। ওরা মিথ্যা বলছে আমাকে। আমার বাচ্চার কিছু হয়নি ইতু। তুমি বললে ওরা ফিরিয়ে দিবে। কিছু বলো না ওদের। আমি জানি অনেক রাগ আমার উপর। আমাকে মারো কাটো তাও আমার বাচ্চাটাকে কিছু করো না। তাকে ফিরিয়ে দাও না। আমি তো তার মুখটাও দেখেনি এখনো তাও আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছে ইতু। আমি তোমার অয়ায়ে পড়ি আমার বাচ্চাটাকে ফিরিয়ে দাও।”
ইতু আর এই আহাজারি সহ্য করতে পারলো না।
রুম থেক বেরিয়ে গেলো।
কেভিনের বাইরে দাঁড়িয়ে মুখ চেপে কেঁদে উঠলো। অনুরও চোখে পানি টলমল করছে।
একদিন পর কুহু ইতুকে ডেকে পাঠালো। কুহু বললো,”পুলিশকে ডেকে পাঠাও ইতু। আমি স্বীকারোক্তি দিবো।”
অনু ভ্রু কুঁচকে বললো,” কিসের স্বীকারোক্তি?”
“আবিরকে যে নেশা দ্রব্য দেয়া হয়েছে এবং এই পুরো প্ল্যানটাই ডা.আদিত্যর কাজ। আমাকে দিয়ে ডা.আদিত্য এইসব কাজ করিয়েছে। আমি নিজের দোষ স্বীকার কএছি সাথে আমি ডা.আদিত্যকেও শাস্তি দিতে চাই।”
ইতু কোনো কথা না বলে অনুকে বললো পুলিশকে ফোন করতে।
কুহু ক্ষমা চাইতে গিয়েও নিজেকে আটকালো। ইতুর কাছে ক্ষমা চাইবে কোন মুখে?

আবিরের জ্ঞান ফিরেছিল কাল রাতে।
চোখ খুলে ইতুকে পাশে দেখে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
অতু আবিরের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। এই বুকে মাথা রেখে কাঁদবে বলেই এতোক্ষন নিজেকে ধরে রেখেছিলো।
আবির ইতুর মুখ তুলে তার কপালে চুমু দিলো।
“সরি ইতু। আমার কুহুকে এলাউ করা উচিত হয়নি। অনেক বড় বিপদ হতে পারতো। ”
ইতু নাক টেনে বললো,
“ইটস ওকে এখানে তোমার কোন দোষ নেই আবির। যার দোষ সে শাস্তি পাবে। আমি অয়ন ভাই এর কাছে শুনেছি কুহু আর আদিত্য দার কথা। এই আদিত্যকে আমি কিছুতেই ছাড়বো না।”
আবির ইতুর চোখের পানি মুছে দিয়ে তাকে বুকে টেনে নিলো।
আদিত্যকে সে নিজেও ছাড়বে না।
তারপরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুতই ঘটলো। কুহুর স্বীকারোক্তি এবং ডাক্তারের কথা অনুসারে তারা আদিত্যকে এরেস্ট করে। প্রথমে আদিত্য গা ঢাকা দিলেও আবির আর অয়ন খোঁজ লাগিয়ে তার ঠিকানা বের করে পুলিশের সাথে গিয়ে তাকে ধরে আনে। পুলিশ কেসের কারণে আদিত্যর লাইসেন্স বাতিল করে দেয়া হয়। আদিত্যর ডাক্তারির পেশার সেখানে সমাপ্তি ঘটে।
কুহু তাদের কাছে অনেকবার মাফ চাইলেও আবির আর ইতু কেউই কুহুর প্রতি নরম হয়নি। মেয়ের অবস্থা শুনে কুহুর বাবা তাকে নিয়ে যায়।
কিছুদিন পর অহনার অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। হাজার চেষ্টা করেও শ্রাবণকে কেউ রাজি করাতে পারিনি। যাওয়ার আগে অহনাকে অন্য কোথাও বিয়ের জন্য রাজি করিয়ে গেছে।
শ্রাবণ চায়না অহনার প্রতি ভালোবাসা কমতি থাকুক। শ্রাবণ তাকে পূর্ণ ভালোবাসা দিতে পারবে না তা শ্রাবণ জানে।
সকলের থেকে বিদায় নিয়ে শ্রাবণ কানাডা চলে গেছে।
অহনার বিয়ের ঠিক আগে আগে গড়লো আরেক বিপদ। সে কিছুতেই বিয়ে করবে না। দরকার হলে সে সারাজীবন বিয়ে ছাড়াই কাটিয়ে দেবে তাও সে এই বিয়ে করবে না। তার শ্রাবণ ছাড়া আর কাউকে স্বামীর মর্যাদা দিতে পারবে না।
এই বেলায় অহনার মা তাকে পুরো সাপোর্ট দিলেন। অহনার বাবা রাগারাগি করেও যখন মা মেয়েকে দমাতে পারেনি তখন তিনি নিজেও মেনে নিলেন।
শ্রাবণ এর সাথে যোগাযোগ করে অহনার যেদ এর কথা জানালেন।
অহনার পাগলামি আর তার বাবার অনুরোধে শ্রাবণ কিছুটা নরম হলো। সে তাদের থেকে সময় চেয়ে নিলো।

এক বছর হচ্ছে তাদের মাখো মাখো সম্পর্ক চলছে।
শ্রাবণ কানাডা থেকে আসলেই তাদের বিয়ে হবে।
ইতু আবিরের কাঁধে মাথা রেখে অতিতের কথা ভাবছিলো। হঠাৎ আবির বললো,”আজ সকাল থেকেই দেখছি কিছু একটা ভেবে চলছো। কি হয়েছে আমার পাখিটার?”
ইতু সোজা হয়ে বসে আবিরের চোখের দিকে তাকালো। একটা ঢোক গিয়ে বললো,”আমার বেবি লাগবে।”
আবির প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পেরে বললো,”সব যেনেও কেন যেদ কর?
তোমার ইনটারশীপ শেষ হোক। বিয়ের প্রোগ্রামটা হয়ে যাক তার পর ভাবা যাবে।”
ইতুর চোখ ছলছল করে উঠলো। “আমি বাচ্চা নই আবির। কেন ভুলাচ্ছ আমাকে? আমি নিজেও ডাক্তার। এখন একদম পারফেক্ট সময় বেবি নেয়ার।
প্লিজ আবির।”
“ইতু পাখি। তুমি নিজে ডাক্তার দেখেই বলছি তোমার নিজের হেলথকেয়ার করতে হবে। তোমার ডাক্তার আগেই বলেছে আগে তোমাকে বডি ফিট করতে করতে হবে। তোমার যে শরীর এই শরীরের বেবি কেরি করতে পারবে না।
আমাদের তো সময় আছে এখনো। আল্লাহ চাইলে আমারও বাবা- মা হবো।”
ইতু মনমরা হয়ে আবিরের কাধের মাথা রেখে বললো, ” আজ একটা বেবি হয়েছে হাসপাতালে। এতো কিউট ছিলো। বেবির বাবা তো দেখেই সে কি কান্না তার। সুখে কাঁদছিলো বুঝলে। আমিও চাই তোমাকে এমন সুখ দিতে।”
আবির মুচকি হেসে ইতুর কপালে চুমু দিয়ে বললো,”আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছে আমি তাই দিয়ে খুশি। এখন ওঠো আর কথা নয়।”
ইতু আবিরের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো হঠাৎ।
আবির ভ্রু কুঁচকে বললো,” হাসছো কেনো?”
“আমার না মন বলছে আমাদের একটা ফুটফুটে পরির মতো মেয়ে হবে। ”
আবিরের মুখের হাসিও চওড়া হলো।
লেকের পাশে হাটতে হাটতে ইতু বেবির সাথে কি কি করবে বেবি বড় হলে কি করবে তা প্ল্যান করতে লাগলো। আবির শুধু তার দিকে তাকিয়ে থাকলো মুগ্ধ চোখে। ইতুর সেই বাক্সবন্দি চিঠি গুলোকে আবির এখনো যত্ন করে রেখেছে। সেগুলো এখন আর খুলে পড়া লাগে না তার। চিঠি মালিক নিজেই তার জীবনটা খোলা চিঠির মতো তুলে ধরেছে।
এই খোলা চিঠি যত পড়ে আবিরের মন ভরে না। সারাজীবন এই চিঠি পড়ে যেতে যায়।
আবিরের মনে হয় সে যত ভালোবাসাই দিক না কেন ইতু জন্য তা কম পড়ে যাচ্ছে। সে আরো ভালোবাসতে চায় তাকে। তার ছোট ছোট স্বপ্নগুলো পূরন করতে চায়।
আবির ইতুর হাত ধরে তার দিকে ফেরালো। ইতুর সেই মায়া মাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে বললো,” ভালোবাসি ভাবুকরানী অনেক বেশী ভালোবাসি।”
সমাপ্ত।
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here