#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৪৩)
” আমার হাতে মার খেয়েছিস কখনও? ”
” না। ”
” যদি খেতে না চাস, তাহলে এখনই সব সত্য বলবি আমায়। ”
অনড়া হতচকিত! চোখের চাহনি বিভ্রান্ত। চোয়াল গলার কাছটায় নুয়ে পড়েও উঠে পড়ল। জোর করে দৃষ্টি জোড়া বুবুর দিকে রেখে জিজ্ঞেস করল,
” কোন সত্যি? ”
” যে সত্যি এতগুলো মাস ধরে লুকিয়ে রেখেছিস। ”
” আমি কোনো সত্যি লুকাইনি। ”
” আবার মিথ্যে বলছিস? ”
কোমলের শক্ত কণ্ঠস্বরে মৃদু কেঁপে ওঠল। মুখের আদল কঠিনে রূপ নিতে দৃষ্টি সরিয়ে নিল দ্রুত। বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল চট করে। একটুখানি দূরে হেঁটে গিয়ে বলল,
” আমি মিথ্যে বলছি না, বুবু। ”
” বলছিস। এতদিন ধরে বলে এসেছিস। একটু ছাড় দিয়েছি বলে আমাকে বোকা বানাতে উঠে-পড়ে লেগে গেলি? ”
” তুমি ভুল ভাবছ। ”
” তাহলে ঠিকটা ভাবতে সাহায্য কর। সত্যিটা খুলে বল। ”
অনড়া সামান্য বিরক্তের ভাব দেখিয়ে বলল,
” তুমি কী নিয়ে কথা বলছ আমি তো সেটাই বুঝতে পারছি না। ”
কোমলও মূল কথায় যেতে চাইল। প্রশ্ন করল,
” ঐ বাচ্চাটা কার? ”
” কোন বাচ্চা? ”
” যাকে গুরুদক্ষিণা বানাচ্ছিস। ”
অনড়ার কুঁচকানো কপাল মসৃণ হলো। ভ্রূজোড়া স্বাভাবিক হতেই চাহনি ভীত হলো। দাঁড়ানোর ভাব শিথিল হলো। কণ্ঠ সহজ করে বলল,
” আমার। ”
” আট মাসে বেবি হয়ে গেল? ডাক্তারের সহযোগিতা ছাড়াই? ” তুমি কি চাচ্ছিলে বাবুটা সিজারে হোক? ”
” না। তেমনটা চাইব কেন? কিন্তু আমার জানামতে, নরমাল ডেলিভারি হয় নয় মাসের পর। তোর আট মাসে কী করে হলো? কোনো ব্যথা ছাড়াই। ”
” ব্যথা ছাড়া হবে কেন? ”
” ব্যথা হয়েছে? আমি শুনতে পেলাম না কেন? আমার কানের পাশেই তো ছিলি। ”
” তুমি হয়তো গভীর ঘুমে ছিলে। তাই শুনতে পাওনি। আর আমি ডাকিওনি। ”
” নানিকে ডেকেছিলি, তাই তো? ”
” হ্যাঁ। ”
” নানি সেই রাতে পাশের গ্রামে গিয়েছিল। তোর আর আমার সামনেই ডেকে নিয়ে গেল একজন, মনে আছে তো? তুই ব্যথা নিয়ে পাশের গ্রামে গিয়ে ডেকে এনেছিস নাকি রুমে বসে চিৎকার করে ডেকেছিস? কী আশ্চর্য! আমার কানে সেই ডাকও পৌঁছাল না। মরার মতো ঘুমাচ্ছিলাম নাকি? ”
বুবুর সাথে একনাগাড়ে বাদপ্রতিবাদ চালিয়ে গেলেও এবার থমকে গেল। দিশাহারা ভাবে চেয়ে থাকলে কোমল বলল,
” আচ্ছা মেনে নিলাম, তুই কোনোভাবে নানিকে ডেকে এনেছিস। ব্যথা সহ্য করে বাচ্চা প্রসবও করেছিস। কিন্তু আট মাসের বাবু এত হৃষ্টপুষ্ট হলো কী করে? সবকিছু ঠিকঠাক, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। প্রথম রাতেই নাড়ি পড়ে গিয়ে শুকিয়েও গেছে। এ তো অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপার! ”
অনড়ার কপালে ঘাম জমা হতেই সে হেসে বলল,
” এমন ঘামছিস কেন? আমি জানি তো এসবই আল্লাহর কুদরতে হচ্ছে। এমন রহমত প্রাপ্ত সন্তানকে ফেলে আসে কেউ? চল, বাবুর কাছে যাবি। ”
কোমল বোনের হাত চেপে ধরতে সে ছাড়িয়ে নিল ঝটিতে। চাপা চিৎকারে বলল,
” আমি কোথাও যাব না। তোমরা চেয়েছিলে একটা বাচ্চা হোক। হয়েছে। ব্যস, আর কিছু করতে পারব না৷ এখন তাকে পালবে নাকি অন্যকিছু করবে সেটা তোমাদের ব্যাপার। আমাকে এসবে জড়াবে না। আমার বাচ্চা লালন-পালন করা ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। সেগুলো করতে দেও। ”
” সন্তানের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজও হয়? ”
” হ্যাঁ, হয়। ”
” শুনি কী সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজ? ”
উত্তরে টেবিলে সাজিয়ে রাখা বই-খাতাগুলো এক এক করে ছুঁড়ে মারল বুবুর পায়ের কাছে। দূর থেকেই বলল,
” এসব বিয়ে-সংসার-বাচ্চা নিয়ে পড়াশোনায় অনেকটাই পিছিয়ে গিয়েছি। আমাকে রাত-দিন জেগে সেগুলো পূরণ করতে হবে। ”
কথার ফাঁকে বুবুর কাছে হেঁটে এলো ধীরে ধীরে। হাত ধরে বলল,
” আমি এখন ক্যারিয়ার গঠনে সচেতন হতে চাই। আমার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। একসময় তো তুমিও এটাই চেয়েছিলে, বুবু। তাহলে আজ কেন বাঁধা দিচ্ছ? সেই ছোটবেলার মতো হাতে বই তুলে দেও। দোয়া করে দেও। আমার বাচ্চা না বইয়ের প্রয়োজন। ”
” আমি কখনও তোর শিক্ষক হতে চাইনি। সম্মানির আশায় পড়াইনি। সবসময় ছোটবোনের মতো দেখেছি। তাহলে তুই কেন, আমায় শিক্ষক বানিয়ে দিচ্ছিস? অন্যের বাচ্চাকে আমার হাতে তুলে দিয়ে গুরুদক্ষিণা দিচ্ছিস? ”
” অন্যের বাচ্চা নয়, ওটা আমার বাচ্চা। ”
বাক্যটা শেষ করতেই সজোরে চড় পড়ল অনড়ার বা’গালে। কোমল ক্রুদ্ধ দৃষ্টি ছুঁড়ে বলল,
” তোর একের পর এক মিথ্যে প্রমাণ করে দিচ্ছে, আমাকে যেমন বড় বোন ভাবতে পারিসনি, তেমন শিক্ষকও না। এত বছর ধরে দায়ে পরে বুবু ডেকেছিস আর এখন মিছে নাটক দেখাতে গুরুদক্ষিণা দিচ্ছিস। ”
অনড়ার চোখের শূভ্র অংশ রক্তিম হয়ে ওঠল। অশ্রু জমে টলমল করছে। সেই চোখে চেয়ে থেকে ঘন ঘন নিশ্বাস ছাড়ল কোমল। দ্রুতপদে দরজা আটকে এসে বলল,
” জামা তোল। একজন মেয়ের পেট দেখলেই বোঝা যাবে সে প্রসূতি নাকি। এরজন্য আমায় ডাক্তার হতে হবে না। ”
অনড়ার জন্য অপেক্ষা করল না। সে নিজেই জামায় হাত দিলে অনড়া আচমকা চেঁচিয়ে বলল,
” ওটা আমার বাচ্চা না। ”
কোমল থেমে গেল। জামা ছেড়ে দিয়ে বলল,
” এই তো সত্য কথা বেরুচ্ছে। এবার এক এক করে সব খুলে বল। ”
অনড়ার আটকে থাকা চোখের জল এবার বর্ষার ভারী বর্ষণের মতো বয়তে শুরু করল। ওড়না দিয়ে নাক মুছতে মুছতে বলল,
” তোমার বর আমাকে কখনও স্পর্শই করেনি বাচ্চা আসবে কী করে? ”
কোমল অধৈর্য্য হয়ে বলল,
” আমি প্রশ্ন না উত্তর শুনতে চাই শুধু। ”
অনড়া চোখ মুছে কান্নার গতি কমাল। বিছানায় বসে ধীরে-সুস্থে বলতে লাগল,
” ঐবাড়িতে যাওয়ার পরই জানতে পারি তুমি কখনও মা হতে পারবে না। এ নিয়ে তোমার শাশুড়ির আফসোসের শেষ নেই। সারাক্ষণ আক্ষেপ প্রকাশ করতেন আমার কাছে। সামান্য ব্যাপারে তোমাকে বকা-ঝকা করতেন। তার চালচলন, কথাবার্তা শুনে বুঝে গেছিলাম ছেলের দ্বিতীয় বিয়ের পরিকল্পনা করছেন। কিছুদিন পর তো সেই ইচ্ছে প্রকাশ করেও ফেললেন। তিনি ঠিক জানতেন, তুমি না করতে পারবে না। এজন্যই জোরাজুরি শুরু করলেন। ভুল বুঝ দিতে শুরু করলেন। এসব তো আমার সামনেই ঘটছিল। তখনই আমার মাথায় একটা পরিকল্পনা এলো। তোমাকে বলব সেই সুযোগ পেলাম না। তার আগেই তুমি কী সব কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললে। তোমার বরকে দ্বিতীয় বিয়েতে রাজি করে ফেললে। আবার পাত্রী ঠিক করলে আমাকে। আমি সেই সময়ও ভেবেছিলাম, আমার গোপন পরিকল্পনা তোমাকে বলব, ঠিক তখনই মনে পড়ল, এই পরিকল্পনায় অসংখ্য মিথ্যা বলতে হবে, অভিনয় করতে হবে, পরিশেষে একটা ধোঁকা দিতে হবে। এসব জানলে তুমি রাজি হবে না। তাই পিছিয়ে গেলাম। ঠিক করলাম এই পরিকল্পনা আমি বাস্তবায়ন করব। ছোটবেলা থেকে তুমি আমার জন্য অনেক কিছু করেছ তার বিনিময়ে আমি কিছু দিতে পারিনি। এবার যখন সুযোগ পেয়েছি হাতছাড়া করব না। তাই বিয়েতে রাজি হয়ে গেলাম। আমি জানতাম তোমার বর তোমাকে অনেক ভালোবাসে। আমাকে কখনই স্ত্রী হিসেবে মেনে নিবে না। বাচ্চা তো দূর কাছে ঘেষতেই দিবে না। বিয়ের পর তেমনই হলো। আমার ঘরেই আসছিল না। এমন করে তো পরিকল্পনার মতো কাজ হবে না। তাই জেদ ধরে তাকে আমার ঘরে আনতে চেষ্টা করি। একবার ভেবেছিলাম তাকে বলে-কয়ে সব করব। কিন্তু এই ভাবনাও বাদ দিতে হলো। কারণ, সে ঘোষণা দিল, তার জীবনে কোনো গোপনীয় নেই। তারমানে তোমার কাছে গোপন রাখতে হবে এমন কোনো কাজ সে করবেই না। তাই তার কাছেও গোপন রাখতে হলো। আমাকে একাই সবটা করতে হলো। ”
” কী করেছিস? ”
অনড়া বুবুর দিকে এক পলক চেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল,
” ঘুমের ওষুধ খায়িয়েছি। ”
” সেজন্যই সেদিন তোর রুমে ঘুমিয়েছিল? ”
” হ্যাঁ। সেইরাতে তার কী মনে হয়েছিল কে জানে! আমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছিল। শাস্তি চাচ্ছিল। আমিও সুযোগ পেয়ে শাস্তি দিলাম। পানির সাথে ওষুধ মিশিয়ে খায়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। তোমরা সবাই ভাবলে সে দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে রাত কাটাচ্ছে। আমার এইটুকুই দেখানোর দরকার ছিল। নাহলে তোমার শাশুড়ি বিশ্বাস করত না যে আমার পেটে তার ছেলের সন্তান। ”
” বাড়ি ছাড়লি কেন? ”
” ভয়ে। তুমি ডিগ্রি ছাড়া ডাক্তার, তোমার বর ডিগ্রি প্রাপ্ত ডাক্তার। যদি ধরে ফেল? হাসপাতালে নিয়ে টেস্ট-ফেস্ট করাও? তাই ইচ্ছে করে হোস্টেলে যাই। সেখানে গিয়েও শান্তি নেই। তোমার বর ক্যাম্পাসে এসে পাগলামি শুরু করল। সবাই জেনে গেল আমি প্রেগন্যান্ট! এখন এত মানুষের সামনে নিজেকে প্রেগন্যান্ট হিসেবে প্রমাণ করি কী করে? তারমধ্যে তোমরাও যদি চলে আসো আমাকে ফিরিয়ে নিতে? সেজন্য কাউকে না বলে গ্রামে চলে যাই। নানির সাথে আমার আগেই কথা হয়েছিল। একটা বাচ্চা যোগাড় করে দিলে তোমার দুঃখ ঘুচে যাবে এটা শুনে সে খুব খুশি হলো। তোমাকে তো ভীষণ পছন্দ করে। ভালোবাসে। নিজেকে ঋণী মনে করে। তাই গ্রামে গ্রামে খোঁজ নিয়ে একজন মাকে পেল। যার চারটা মেয়ে। একটাও ছেলে নেই। স্বামীর আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। একটা ছেলের আশায় স্ত্রীর দিকে চেয়ে আছেন। এমতাবস্থায় আর মেয়ে চান না। নানি দেখেই বুঝেছিল মেয়ে হবে। তাই আগে থেকে বলে রেখেছে বাচ্চাটা তাকে দিয়ে দিতে। প্রয়োজনে কিছু টাকাও দিবে। সেই হিসেব মতোই সব চলছিল। সমস্যা করলে তুমি। আচমকা আমার বাড়ি চলে এলে। আবার থাকতেও শুরু করলে। আমাকে তোমার সামনে পোয়াতি সেজে অভিনয় করতে হলো। প্রথম দিকে কষ্ট হলেও একসময় মানিয়ে নিয়েছিলাম। তারপরেই সেই রাত এলো। বলা নেই, কওয়া নেই নানি বাচ্চা নিয়ে চলে এলো। সময়ের হিসেবে ভুল হয়েছে আমি তখনই বুঝে গেছিলাম। সামনাসামনি ধরা পড়ার ভয়ে আবার পালালাম। আর তুমি এবারও ধরে ফেললে! ”
অনড়া যে এমনটাই ঘটিয়েছে আগেই অনুমান করেছিল। তাই খুব একটা অবাক হয়নি। সব ছেড়ে জিজ্ঞেস করল,
” ও তোকে সত্যিই স্পর্শ করেনি? ”
” করলে কি আমাকে এত কষ্ট করতে হতো? ”
কোমল ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। দৈবকর্ণে স্বামীর যন্ত্রণায় জর্জরিত কণ্ঠস্বরে বারংবার শুনতে পেল, ‘ আমাকে অবিশ্বাস করছ? ‘
অনড়া বুবুর পাশ থেকে উঠে গেল। টেবিলের সংলগ্ন ড্রয়ার থেকে কতগুলো চিঠির খাম নিয়ে এসে বুবুর কোলে রেখে বলল,
” তুমি নিশ্চয় আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছ? ভাবছ, তোমার ভালোর জন্য আমার জীবন নষ্ট করে দিয়েছি? তাহলে বলব, একদম চিন্তা করো না। আমার জীবনেও তোমার বরের মতো একজন এসেছে। যে আমার সবটা জেনেও আমাকে ভালোবাসে। বিয়ে করতে চায়। আমি বলে দিয়েছি, তোমার অনুমতি ছাড়া বিয়ে করতে পারব না। আর তুমি তো পড়াশোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অনুমতি দিবেও না, তাই না? তাই অপেক্ষা করতে বলেছি। সে তাতেও রাজি। ”
কোমল চিঠিগুলো নেড়ে-চেড়ে দেখল। খাম খোলা আছে এমন একটা পড়লও। তারপর সব ফেলে উঠে চলে যেতে চেয়েও ফিরে এলো। ঠাণ্ডা স্বরে বলল,
” তোর উদ্দেশ্য ভালো হলেও কার্যপ্রক্রিয়া অনৈতিক ছিল। অসংখ্য মিথ্যার বুনন ছিল। যার জন্য একটা ভালো ও সৎ মানুষ কষ্ট পেয়েছে। প্রকাশ করলে আরেকজনও পাবে। এর দায়ভার কার? আমি একা দুটো মানুষকে কীভাবে সামলাব? ”
অনড়া বুবুকে ধরতে এলে সে পিছিয়ে গিয়ে বলল,
” আমি সত্যিটা মেনে নিয়েছিলাম। আমার অক্ষমতাকে গ্রহণ করেছিলাম। তুই কেন পারলি না? তোর এই অপরাগতার জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে গেছে। ”
” আমাকে ক্ষমা করে দেও, বুবু। ”
” হয়তো মুখে বলছি, ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু মন থেকে করেছি এই মিথ্যাটা বলতে পারলাম না। ”
সুমনা রুমের এককোণে বসে দুইবোনের কাণ্ডকারখানা অবলোকন করছিল। কোমল বেরিয়ে যেতেই বলল,
” তুই আবারও মিথ্যা বলেছিস? ঐ চিঠিগুলো তো তুই পড়েই দেখিসনি। এর মালিক ছেলে নাকি মেয়ে তাও জানিস না। অথচ বুবুকে বলে দিলি, সে তোকে বিয়ে করতে চায়! ”
অনড়া ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
” এই মিথ্যাটা না বললে হয়তো মুখের বলা ক্ষমাটাও পেতাম না। এই মানুষটা শুধু অন্যের কষ্টে কাঁদতে পারে, অন্যের হাসিতেই হাসতে পারে। ”
____________
কোমল শ্বশুরবাড়িতে না গিয়ে সোজা পৌঁছাল নিবিড় যে হাসপাতালে রোগী দেখে সেখানে। তার কেবিনের সামনে অসংখ্য রোগীদের ভীড়। সকলে সিরিয়াল নাম্বারের টোকেন নিয়ে বসে আছে। সে সবাইকে অগ্রাহ্য করে সরাসরি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে চাইলে ওয়ার্ডবয় আটকাল। টোকেন চাইলে সে নেই বলে দিতে রোগীসহ গার্ডিয়ানরা চিল্লাপাল্লা শুরু করে দিল। এই শব্দ শুনে নিবিড় বাইরে বেরিয়ে আসে। কোমল তাকে দেখতে পেয়ে সকলের সামনে ঝাপটে ধরল। চোখের অশ্রু ঝরিয়ে সিক্ত স্বরে বলল,
” আমাকে ক্ষমা করে দাও। ”
#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
#অন্তিম_পর্ব
কোমল অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলল,
” আমাকে ক্ষমা করে দেও। ”
স্ত্রীর এমন কাণ্ডে নিবিড় যারপরনাই বিস্মিত হলো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য জরাগ্রস্ত ও নিশ্চল হয়ে থাকল। পাথরের মতো শক্ত দেহটা অনুভূতি পেল ওয়ার্ডবয়ের কণ্ঠ পেয়ে। সে বলছে,
” স্যার, ইনি কি আপনার পরিচিত? ”
নিবিড় সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সামনের উৎসুক্যে জটলা পাকা শতাধিক চোখগুলোর দিকে তাকাল। দ্রুত দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে রাখল বোরকায় আবৃত কোমলের দেহটায়। কান্নার দমকে মৃদু মৃদু কাঁপছে। আলিঙ্গন হচ্ছে গাঢ়, শক্ত। সংকুচিত। ওয়ার্ডবয়ের প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিজোড়ার দিকে চেয়ে একহাতে জড়িয়ে নিল কোমলকে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
” আমি একটু বিরতি নিচ্ছি। তুমি সামলে নিও। ”
দরজা ভেতর থেকে আটকে দুইহাতে বেঁধে নিল স্ত্রীর নরম শরীরটুকু। আদুরে স্বরে সুধাল,
” কী হয়েছে? ”
কোমল উত্তর দেওয়ার বদলে আরেকটু বিঁধতে চাইল স্বামীর সুপুষ্ট দেহাভ্যন্তরে। আরও কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে বলল,
” আমাকে কঠিন শাস্তি দেও। যেন সারা জীবন সেই শাস্তির যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে পারি। ”
” আচ্ছা দেব। কিন্তু আগে অন্যায়টা শুনি? ”
নিবিড়ের বুক থেকে মাথা তুলল সে। ভেজা চোখদুটি মেলে তাকাতে সে বলল,
” আগে একটু বিশ্রাম করো। ”
বলতে বলতে একটা চেয়ারে বসাল। পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল,
” আগে নিজেকে সামলাও। আমি বাইরের রোগীদের একটা ব্যবস্থা করে আসি। ”
কোমল বোতলের পানি হাতে নিলে সে বেরিয়ে গেল। ফিরে এলো প্রায় দশ মিনিট পর। হাতে পাউরুরি, কলা, খাবার স্যালাইন, গ্লাস। বোতলের পানি গ্লাসে ঢেলে স্যালাইন মেশাতে মেশাতে স্ত্রীর দিকে তাকাল। সে নিজেকে সামলানোর বদলে আরও ভেঙে পড়েছে। চোখের পানিতে নেকাবসহ বুকের কাছটাও ভিজে গেছে। পাউরুটির প্যাকেট হাতে নিয়ে বলল,
” এখানে আমার অনুমতি ছাড়া কেউ প্রবেশ করবে না। বোরকা খুলতে পার। ”
সে বোরকা খোলার বদলে শব্দ কান্নায় ভেঙে পড়ল। পা তুলে নিল চেয়ারে। হাঁটুতে কনুই ঠেকিয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে নিয়ে বলল,
” আমি পাপী। দয়া করে শাস্তি দেও। ”
নিবিড় নিজ হস্তে নেকাব খুলল। বোরকার বোতাম খুলতে খুলতে বলল,
” দেব। আগে খাবারগুলো খেয়ে নেও। তুমি খুব দুর্বল। নিশ্চয় অভুক্ত পেটে এখানে এসেছ। ”
কোমল খাবারের দিকে তাকালও না। আপন ইচ্ছায় অশ্রু বিসর্জন দিয়ে চলল শুধু। নিবিড় নিজেই খাওয়াল। স্যালাইনের অর্ধেক শেষ হওয়ার পর জানতে চাইল,
” এবার বলো, কী পাপ করেছ। ”
স্বামীর অনুমতি পেয়ে অনড়ার ব্যাপারের জানতে পারা সবকিছুই খুলে বলল। সে সবটা শুনে বিন্দুমাত্র অবাক হলো না। সামান্য হেসে বলল,
” আমার কোমল নিজ থেকে ফিরে এসেছে বলে সকল পাপ ক্ষমা করা হলো। যদি আমাকে জোর করে আনতে হতো, তাহলে কঠিন শাস্তি অবশ্যই দিতাম। ”
কোমল অবুঝের মতো পূর্ণদৃষ্টিতে চেয়ে থাকলে সে তার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসল। কোলে মাথা ফেলে বলল,
” আপনি কোনো অন্যায় করেননি। পরিস্থিতির চাপে পড়ে শুধু একটু বোকা হয়ে গিয়েছিলেন। তার শাস্তিতো পেয়েছেন এতগুলো মাস ধরে। স্বামীর কাছাকাছি ছিলেন অথচ ভালোবাসা পাননি। এর থেকে কঠিন শাস্তি কী হতে পারে? ”
” আমাকে শাস্তি দিতে গিয়ে তুমিও শাস্তি পেয়েছ। ”
” তা পেয়েছি। কিন্তু অকারণে নয়। দোষ আমারও ছিল। আপনার বোকামিকে প্রশ্রয় না দিয়ে অন্যভাবেও সমস্যার সমাধান করা যেত। ”
নিবিড়ের চুলে আঙুল ডোবাল কোমল। মুহূর্তে শরীরের সকল ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। মনের ব্যথা মুখ লুকিয়ে পালাল। বেদনার অশ্রু আনন্দের অশ্রুতে রূপ নিতে হিসেব কষল মনে মনে। শত শত দিন পর এই চুলের স্পর্শ পেল অঙ্গুলিদ্বয়ে। হৃদয় জুড়িয়ে গেল বুঝি!
” এবার মায়ের শাস্তি পাওয়ার পালা। ”
স্বামীর বদলে যাওয়া কণ্ঠস্বরে কোমল চমকাল। উচ্চারিত বাক্যের অর্থটা বুঝে আসতে বুক কেঁপে ওঠল। সভয়ে আপনাআপনি উচ্চারিত হলো,
” আম্মার শাস্তি! ”
নিবিড় মাথা তুলে বলল,
” হ্যাঁ। তাকে সকল সত্য জানিয়ে দিয়ে আমরা ঐ বাচ্চাটিকে দত্তক নেব। তার চোখের সামনে অন্য একটি বাচ্চাকে আদর – ভালোবাসা দিয়ে বড় করব। পিতৃপরিচয় দেব। এটাই তার শাস্তি হবে। ”
” না, তাকে এসব কিছু বলবে না। ”
কোমলের এই প্রতিবাদ একদমই পছন্দ হলো না নিবিড়ের। তার থেকে দূরে সরে বলল,
” অবশ্যই বলব। সে অন্যায় করেছে। শাস্তি তো পেতেই হবে। ”
কোমল চেয়ার ছেড়ে ওঠল। স্বামীর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলল,
” অন্যায় না, বোকামি করেছেন। আমি, তুমি যেমন পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছি। তিনিও তেমনই। মা হিসেবে সন্তানের সুখ চেয়েছেন। পরিপূর্ণ সংসার দেখতে চেয়েছেন। ”
নিবিড়ও প্রতিবাদ করতে চাইল। কোমল সেই সুযোগ না দিয়ে বলল,
” সেই বোকামির শাস্তি তিনি পাচ্ছেন। ”
” কীভাবে? ”
” তোমার থেকে দূরে সরে। তুমি কি খেয়াল করোনি? আম্মা সরাসরি তোমার সাথে কথা বলে না? ”
নিবিড় একটুক্ষণ চুপ থেকে ভাবতেই মনে পড়ল। তার মা সত্যিই সরাসরি তার সাথে কথা বলতে আসেন না। কোমলকে মাঝে রাখেন।
” একজন মা সন্তানের থেকে দূরে থাকলে কতটা কষ্ট পায় সেটা হয়তো আমি, তুমি উপলব্ধি করতে পারব না। তাছাড়া তিনি তোমার মা। সন্তান হিসেবে তুমি ভুল ধরিয়ে দিতে পার, শাস্তি দিতে পার না। আল্লাহ নারাজ হবেন। ”
” তাই বলে মিথ্যা বলব? ”
” না। আমরা সত্য-মিথ্যা কিছুই বলব না। যতদিন না নিজ থেকে জানতে পারবে ততদিন লুকানো থাক। ”
নিবিড় সহমত প্রকাশ করছে না। দ্বিমতও না। মৌন থাকলে কোমল আবার বলল,
” তার খুশির জন্য আমরা এতগুলো মানুষ যে ত্যাগ করেছি, কষ্ট করেছি তার একটু মূল্য থাকা উচিত। ”
কথার মাঝে স্বামীর ডানহাতটা চেপে ধরল। অনুরোধের সুরে বলল,
” কথা দেও, নিজ থেকে আম্মাকে কিছু বলবে না? ”
নিবিড় স্ত্রীর দিকে কয়েক সেকেন্ড নীরব দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। তারপরেই হাতঘড়িটার দিকে চেয়ে বলল,
” রাত খুব বেশি হয়নি। বিবি? চলেন, মায়ের একমাত্র নাতনিকে নিয়ে আসি। ”
____________
অনড়ার এল এল বি কোর্স সম্পন্ন হওয়ার পর এল এল এম করার জন্য কানাডার একটি বিশ্বিবদ্যালয়ে আবেদন করেছিল। একাডেমিকে ভালো ফলাফল থাকায় সুযোগও পেয়েছে। সেখানে যাওয়ার তোরজোর চলছিল। সেই ব্যস্ততার মধ্যে এক সন্ধ্যায় নিবিড়ের উপস্থিত ঘটল। সুমনা দুজনকে রেখে বাইরে যেতেই নিবিড় বলল,
” তোমাকে একটা জিনিস দেওয়া বাকি ছিল। দিতে এলাম। ”
অনড়া কিছু বলল না। দূরে অবনত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিবিড় বসা থেকে উঠে তার দিকে হেঁটে গেল। একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল,
” ডিভোর্স পেপার। আমি সাইন করে দিয়েছি। তুমি এখন পুরোপুরি মুক্ত। ”
অনড়া নত অবস্থায় কাগজটা গ্রহণ করল। নিবিড় কিছুক্ষণ নীরব দৃষ্টি রেখে বলল,
” বুবুর উপর রাগ করো না। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে। ”
উত্তরে সে মাথা একপাশে কাত করল। নিবিড় আরও কিছু সময় নীরব থেকে বলল,
” একটা সময় তোমার উপর খুব রাগ হয়েছে। শপথ করেছিলাম, তোমার মুখ আর কখনও দেখব না। ”
অনড়া চোখ তুলে তাকাল। এতটা সময় পর ঠোঁট নেড়ে শব্দ বুনে সুধাল,
” আজ শপথ ভাঙলে কেন? ”
” রাগ নেই তাই। তুমি চলে যাচ্ছ খবর শোনার পরই আমার একটু মনখারাপ হয়েছিল। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, তুমি যেমন আমাদের কষ্ট দিয়েছ, তেমন আনন্দও। তোমার জন্যই আজ আমরা বাবা-মা হতে পেরেছি। একটি পূর্ণ ও সুখী সংসার পেয়েছি। যদিও আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এমনই ছিল। সেই অনিশ্চিত পরিকল্পনা হয়তো এর থেকে বেশি সহজ হতো না। যতটা তোমার জন্য হয়েছে। ”
” ওর নাম কী রেখেছ? ”
” বলব না। ”
” কেন? ”
” আমি চাই, ওর মুখ থেকে শোনো। ”
” কী করে সম্ভব? আমি তো কাল সকালই চলে যাচ্ছি। ”
” একেবারে যাচ্ছ না নিশ্চয়? ”
” ফিরবই এমন নিশ্চয়তাও নেই। ”
” ধরে নিলাম, ওর নাম শোনার টানে একদিন ফিরে আসবে। ”
অনড়া বলার মতো আর কিছু খুঁজে পেল না। চুপ হয়ে গেলে নিবিড় বলল,
” তোমাকে ধন্যবাদ না দিয়ে যদি একটা উপহার দিই গ্রহণ করবে? ”
অনড়া উত্তর দেওয়ার বদলে হাত পাতল। নিবিড় মাঝারি আকারের একটি প্যাকেট দিয়ে বলল,
” আশা করছি তোমার পছন্দ হবে। ”
একটু চুপ থেকে বলল,
” তুমি তো বেশ শান্ত হয়েছ। ব্যবহারেও ভদ্রতা। আমার দেওয়া লাঠিটা আর প্রয়োজন পড়বে না। ফিরিয়ে দিতে পার। ”
অনড়া সত্যি সত্যি লাঠিটা দিয়ে দিল। নিবিড় বিদায় নিয়ে চলে যেতে চেয়েও ফিরে এসে বলল,
” তোমাকে একটা চুমু খাই? ”
অনড়া চকিতে তাকাল। আবদার করল নাকি অনুরোধ বুঝতে পারল না। কয়েক সেকেন্ড বিস্মিত নেত্রে চেয়ে থেকে অনিচ্ছাতে অনুমতিসূচক মাথা নাড়ল। নিবিড় অনুমতি পেয়ে দূর থেকে ঝুঁকে এসে অনড়ার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়াল। সঙ্গে সঙ্গে অনড়ার বন্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। নিবিড় মৃদু হেসে সুধাল,
” স্বপ্ন মনে হচ্ছে? ”
অনড়ার কান্না চোখ থেকে ঠোঁটে পৌঁছাল। মৃদুস্বরে উত্তর করল,
” হ্যাঁ। এত ভালো স্বপ্ন আমি আর কখনও দেখিনি। ”
” তোমার বুবু যখন আমায় ভালোবাসে তখন আমারও স্বপ্ন মনে হয়। প্রতিবারই মনে হয়, এত ভালো স্বপ্ন আমি আর কখনও দেখিনি। ”
কথাটা বলেই হাতের তুড়ি বাজাল নিবিড়। অনড়া চমকে চোখের পাতা মেলল। নিবিড় দুষ্টু হেসে বলল,
” আমাদের শালী-দুলাভাইয়ের সম্পর্ক কিন্তু কাগজ-কলমেও ছিন্ন হবে না। সেই হিসেবে তোমাকে আমি ছোটবিবি বলেই ডাকব। পড়াশোনা শেষ করে জলদি ফেরত আসো। শুনেছি, পাত্র পছন্দ করা আছে। নাম-ঠিকানা দিয়ে যেও। বিয়ের সকল ব্যবস্থা করে রাখব। প্লেন থেকে নেমেই বিয়ের পিড়িতে বসে পড়বে। তারপর গুছিয়ে সংসার করবে। ”
অনড়া হালকা হেসে বলল,
” আচ্ছা। ”
” এবার তাহলে আসি? ”
” আচ্ছা। বুবুকে দেখে রাখবেন। ”
” হুম। ”
নিবিড়কে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। সে রিকশায় ওঠে বলল,
” ভালো থেকো, ছোটবিবি। অপেক্ষায় থাকব। ”
রিকশা যতক্ষণ না চোখের আড়াল হলো ততক্ষণ রাস্তার পানে চেয়ে থাকল অনড়া। রুমে ফিরে এসে বাকি গোছগাছ শেষ করল। ঘুমের জন্য তৈরি হয়ে শুয়ে পড়েও উঠে বসল। কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে বসল,
শ্রদ্ধেয় প্রেরক মশাই,
এই বিদায়বেলায় হুট করেই আপনাকে স্মরণ করছি। মনে হলো, আপনাকে কিছু ব্যক্তিগত কথা বলে গেলে মনটা হালকা হবে। সেজন্যই এই মাঝরাতে কলম হাতে নিয়ে বসা।
আমার মা নেই। বাবা দ্বিতীয় বউ নিয়ে সংসার করছেন। তার জীবনে আমার কোনো অস্তিত্ব নেই। দায় থেকে স্বইচ্ছায় মুক্তি নিয়েছেন। আমিও এই ব্যাপারে কখনও প্রশ্ন তুলিনি। ভুলেই থেকেছি সবসময়। জীবিত আছেন নাকি মৃত জানিও না। কাছের বলতে আমার এক নানি আছেন। পিতা-মাতাহীন এই আমি বড় হচ্ছিলাম তার কাছে। ঠিক সেই সময় এক নারীর চোখ পড়ল আমার উপর। মায়ের মতো মমতা ঠাসা সেই চোখে। স্পর্শ আদুরে। কণ্ঠ দরদভরা। আমাকে এমনভাবে আগলে নিল যে নানির সাথে গাঢ় একটা সম্পর্ক গড়ে উঠার সুযোগ হলো না। দিন-রাত এই মায়ের মতো মেয়েটির কাছেই পড়ে রইলাম। সে যদি আমাকে বুবু ডাক না শেখাত তাহলে হয়তো ভুল করে মা বলেই ডেকে বসতাম। সেই মায়ের মতো বুবুর কাছে আমার সুখ-দুঃখ সবকিছুই জমা রাখলেও মনকে রাখতে পারলাম না। তাকে দান করে বসলাম অপাত্রে। নিষিদ্ধ এক সুদর্শনের কাছে। এই অন্যায়টি আমি আজও বুবুর সামনে আনতে পারিনি। কী করে আনব? সেই সুদর্শন যে আমার বুবুর ভালোবাসা, সুখ, আনন্দ। প্রিয় পাত্র। এরপরের ঘটনাগুলো হয়তো আপনার জানা। যেটা জানা নয় সেটি বলি। এই মানুষটিকে যখন বিয়ে করার প্রস্তাব পাই তখনও আমি শক্ত ছিলাম। একমনে বুবুর সুখ চাচ্ছিলাম। সেই চাওয়া বদলে গেল কবুল বলার পর। আমি দুর্বল হয়ে গেলাম। আমার চোখের সামনে যত আদর্শ স্বামী হিসেবে প্রমাণ দিচ্ছিল তত স্বার্থপর হচ্ছিলাম। একরাতে সুযোগ বুঝে স্বার্থোদ্ধত হয়ে পড়ি। সফল হতে পারিনি। উল্টো ঘুমের ঘোরে দুটো থাপ্পড় মেরে চিরতরে বুঝিয়ে দিল, সচেতন এবং অচেতন সকল সময়েই সে বুবুর অধিকার। সেই অধিকারে আমার আবৃত অথবা অনাবৃত কোনো শরীরই ভাগ বসাতে পারে না। আমার এত রাগ হলো যে তার নগ্ন শরীরে অসংখ্য নখের আঁচড় বসিয়ে দিলাম। সারারাত সেই ক্ষত-বিক্ষত শরীরে চেয়ে ভাবলাম, এমন নিখুঁত পুরুষ মানুষও হয়?
আজ এই নিখুঁত মানুষটা আমাকে গভীরভাবে ভালোবেসে বলেছে আমি নাকি স্বপ্ন দেখেছি। এই মিথ্যা বলার কারণটা আমি বুঝেছি। তাই স্বপ্নই ধরে নিলাম। একদিন বুবুকে বলেছিলাম, আমি তার শুধু বিবি হতে চাই। অথচ আজ বিদায়বেলা যেমন করে ছোটবিবি ডাকল তেমন করে যদি আগে ডাকত তাহলে সারাজীবন ছোটবিবি হয়েই থাকতাম। ভারি আফসোস হচ্ছে। এই আফসোসের কথা জানাতে গিয়ে এতবড় চিঠি লিখে ফেললাম। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
ইতি
আপনার স্নেহের অনড়া।
পুনশ্চ-১ঃ আপনার মনে মনে ঠিক করা নামটা আমি বুঝতে পেরেছি। যদি কখনও দেখা হয় সেই নামে পরিচিত হব।
পুনশ্চ-২ঃ আপনি ঠিকই ধরেছিলেন। নোট পাঠানোর জন্য রাগ করিনি। সাহায্য করছেন বলে রাগ করেছি। ছোটবেলা থেকে অন্যের সাহায্য নিয়ে বড় হতে হতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম।
পুনশ্চ-৩ঃ বিদেশের মাটিতে আপনার চিঠি পাঠানো আমার পছন্দ হবে না। আশা করছি পাঠাবেন না। যদি দোষ দেন, আমি নিষেধ করিনি। তাই দোষ কাটিয়ে দিলাম। আমি ওখানে একা থাকতে চাই। আমার মতো করে বাঁচতে চাই। যদি কখনও হাঁপিয়ে উঠি তাহলে আপনাকে আবারও স্মরণ করব।
অনড়া চিঠিটা ভাঁজ করে একটি খামে ভরল। ঠিকানা লিখতে গিয়ে হেসে ফেলল। মানুষটা তার চিঠি পেয়ে কী পরিমাণ অবাক হবে সেটাই ভাবছে। সে হয়তো ভাবতেই পারেনি, প্রথম চিঠি পেয়েই তাকে চিনে ফেলেছে। নিজ হাতে চিঠিবাক্সে ফেলবে দেখে নিজের কাঁধ ব্যাগে আগেই ভরে রাখল। ঘুমাতে গিয়ে আচমকা মনে পড়ল, সে কি প্রেরক মশাইকে অপেক্ষা করতে বলেছে? এমনটা কি উচিত হলো? যদি তার একা জীবন খুব দীর্ঘ হয়? কখনও হাঁপিয়ে না উঠে? তাহলে এই মানুষটির কী হবে? অনড়া চিন্তিত হতে গিয়েও হলো না। চিন্তা উড়িয়ে বলল, ‘ আপনি তো আর বুবুর বরের মতো না যে এক নারীতেই জীবন পার করে দিবেন। কিছুদিন পরেই মন বদলে যাবে, ভালোবাসার পাত্রটিও বদলে যাবে। ‘
#সমাপ্ত
#