#কলা_পাতায়_বাঁধিব_ঘর
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৫
তিমিরে তলিয়ে যাওয়া গাঢ় রজনী। মিষ্টি ছন্দে তুমুল বৃষ্টিপাত, দমকা অনিল প্রবাহে গাছের ডালে ডালে সংঘর্ষ। নিস্তব্ধ, শান্ত, শুনশান প্রকৃতি। ঘুমাতে যাওয়ার সময় রাউফুন বাঁধা দিয়ে বলল,
-“শোয়ার আগে নাকে স্প্রে করে নাও। নয়তো তোমার হাঁচির প্রবল আ’ঘাতে আমি আজ উড়ে যাবো।”
পুষ্প তেতে উঠে বলল,
-“জেনেশুনেই তো বিয়ে করেছেন। এখন না চাইলেও সহ্য করতে হবে।”
তারপরই নিরব রইলো। নিরবতা কাটাতে রাউফুনই বলল,
-“জানো, আজ আমার বিয়ের প্রস্তাব এসেছে।”
পুষ্প হালকা ঘাড় কাত করে রাউফুনের দিকে ফিরে শুলো। অতঃপর চোখ ছোট করে বলল,
-“তো আপনি কি বলেছিলেন?”
রাউফুন বলল,
-“আমিতো বলে দিয়েছি আমি বিবাহিত, কিছুদিন পর বাচ্চা কোলে করে নিয়ে আপনাকে দেখাবো।”
পুষ্প কাঁথা মুড়ে ওপাশ ফিরে গেলো। জীবনে সে এমন লজ্জার মুখোমুখি হয়নি, বিয়ের পর যতবার হয়েছে।
পুষ্পকে ভড়কে দিতে পেরে মিটিমিটি হাসলো রাউফুন। সে মাথা ঘোরালোনা। পুষ্পর দিকে চেয়েই শুয়ে রইলো। মাঝরাতে একটু বেশি ঠান্ডা অনুভূত হওয়ায় দুজনই গা ঘেষে ঘুমালো। রাউফুনের ঘুম পাতলা। কাছাকাছি আসতেই সে টের পেলো। ইচ্ছে করেই আরেকটু গা ঘেষে পুষ্পর গায়ে একহাত রেখে দিলো। সুযোগ বুঝে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে নিলো পুষ্পর গালে।
সকালে ঘুম ভেঙেই পুষ্প দেখলো রাউফুন তার গায়ের উপর একহাত তুলে আরামসে ঘুমাচ্ছে। হাত সরাতে গেলেই রাউফুন চোখ বুঁজে রেখেই বলল,
-“রাতে তুমি যা লাফালাফি করোনা? ভাগ্যিস আমি একহাতে ধরে রেখেছিলাম, নয়তো সকালে নিজেকে খাটের নিচে দেখতে পেতে।”
ঘুম থেকে উঠেই বেআক্কেল হয়ে নির্বোধের মতো তাকিয়ে রইলো পুষ্প। রাতে ঘুমের ঘোরে লাফালাফি করার রেকর্ড নেই বলে সবার কাছ থেকে এক বস্তা সুনাম কুড়িয়ে নিয়েছিলো পুষ্প। কিন্তু রাউফুন দুই সেকেন্ডে সব সুনাম মিথ্যে করে দিলো। সে বোকার মতো প্রশ্ন করলো,
-“আমি কখন রাতে লাফালাফি করলাম?”
রাউফুন বলল,
-“ওহ্! তাহলে বোধহয় আমি স্বপ্নে তোমাকে লাফাতে দেখে বাস্তবে গুলিয়ে ফেলেছি।”
পুষ্প ঠোঁট গোল করে লম্বা শ্বাস ফেলে মনে মনে বলল “আল্লাহ মাবুদ জানে এই ড্রামাবাজ ডাক্তারের সাথে কিভাবে সংসার করবো।”
মুখে বেশ তাড়া দিয়ে বলল,
-“উঠে ফ্রেশ হয়ে নিন। আপনি হসপিটালে যাবেননা?”
রাউফুন বিছানা ছাড়লোনা। শুয়ে থেকেই বলল,
-“আমি শুক্রবারে রোগী দেখিনা। সপ্তাহে এই দিনটি পরিবারের সাথে কাটাই। তাছাড়া হসপিটালে আমি ছাড়াও আর চারজন ই এন টি স্পেশালিষ্ট আছেন।”
পুষ্প আর ঘাটালোনা। ফ্রেশ হতে চলে গেলো। রাউফুন বিছানা ছাড়লোনা।
★★★
সকালের ব্রেকফাস্ট তৈরী করে রোকসানা ছেলের নাম্বারে ডায়াল করলেন। প্রথমবার রিং হওয়াতেই রিসিভ হয়ে গেলো।
রাউফুন প্রথমেই সালাম দিলো। এটা তার অভ্যেস। কাউকে কল দিলে বা কেউ কল দিলে প্রথমে অন্যকিছু দিয়ে কথা শুরু করতে পারেনা। প্রথমেই সালাম দিয়ে শুরু করে।
রোকসানা সালামের উত্তর দিয়ে বললেন,
-“কেমন আছিস বাবা? আর গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে এখনো বিছানা ছাড়িসনি, ফ্রেশ ও হসনি।”
ওপাশ থেকে রাউফুন বলল,
-“শুক্রবারটা একটু অনিয়ম করতে ইচ্ছে করে। ডাক্তার হলেই কি ধরা বাঁধা নিয়মে থাকতে হবে নাকি? ডাক্তাররা ও তো মানুষ।”
রোকসানা বললেন,
-“ছেলে বিয়ে করিয়েছি বউ ঘরে তুলে তার সাথে সময় কাটাবো বলে। বউ নিয়ে কবে ফিরছিস?”
নিঃশব্দে হাসলো রাউফুন। একবার ওয়াশরুমের বন্ধ দরজার দিকে দৃষ্টি ফেলে বলল,
-“আর কয়েকটা দিন। বিয়ের মাস পেরোনোর আগেই তোমার বউমা শশুর বাড়ি চলে যাবে।”
রোকসানা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। পাশ থেকে রিশা ফোন টেনে বলল,
-“ভাইয়া শুধু নিজের বউ নিয়ে আসলে হবেনা। আমাকে ও বিয়ে দিয়ে দাও। তোমার ছোট্ট শালাবাবুকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে।”
রাউফুন বলল,
-“সে কি রিশা! তুই দেখছি বিয়ে বিয়ে করে পাগল হয়ে যাচ্ছিস। যাহ্ তোকে বিয়ে দিলাম। তোর জন্য পঞ্চাশ বছরের এক ইয়াং যুবক পছন্দ করে রেখেছি। খুবই স্টাইলিস।”
রিশা মেকি রাগ দেখিয়ে নাকি সুরে বলল,
-“ভাইয়া!”
রাউফুন কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো।
রিশা আবার বলল,
-” আচ্ছা, বলোতো আমার বিয়েতে তুমি কি দিবে আমাকে?”
রাউফুন বলল,
-“আমার কাছে পাঁচ টাকার নোট নেই বুঝলি? থাকলে রিস্ক নিয়ে পাঁচ টাকা দিয়ে আজই একটা দামি গিফট কিনে নিতাম তোর বিয়ের উপহার দেওয়ার জন্য।”
রিশা মাকে শুনিয়ে বলল,
-“মা আমি কিপ্টে দেখেছি। কিন্তু তোমার ছেলের মতো হাড়কিপটে দেখিনি।”
-“কি সাংঘাতিক রিশা। তোর কাছে পাঁচ টাকা কম মনে হচ্ছে? তুই দেখছি বিয়ের পর স্টাইলিস ইয়াং ম্যানকে ফকির বানিয়ে ছাড়বি।”
তখনই পুষ্প ফ্রেশ হয়ে বের হলো। তাকে কথা বলতে দিয়ে রাউফুন উঠে পড়লো। নাস্তা করে রাউফুন বলল,
-“রেডি হয়ে নাও। আজ একটু রিকশায় চড়ে প্রেম করবো।”
পুষ্প কথা না বাড়িয়ে রেডি হয়ে নিলো। রাউফুনের সঙ্গ পেতে এখন বেশ ভালোই লাগে। রাউফুন সবাইকে বলে দিয়েছে,
-“ফিরতে রাত হবে।”
কেউই কিছু বলেনি। দুজনে বেরিয়ে পড়লো। পুষ্প আজ একটা শাড়ি পরে বেরিয়েছে। রাউফুন একটা রিকশা নিলো। পাশাপাশি হুডতোলা রিকশায় বসে পুষ্পর একহাত শক্ত করে চেপে ধরলো। পুষ্প কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই সে বলল,
-“যদি রিকশার ঝাঁকুনিতে পড়ে-টড়ে যাও, তাহলে তো আমাকে আরেকটা বিয়ে করতে হবে। আর বিয়েতে মেলা খরচ। আমি রিস্ক নিতে পারবোনা।”
পুষ্প খোঁচা মেরে বলল,
-“তো করুন না বিয়ে। একেবারে ডাক্তারি করা ছুটিয়ে দেবো।”
রাউফুন মিটিমিটি মিটিমিটি হেসে বলল,
-“তুমি কি জেলাস?”
পুষ্প মুখ ফিরিয়ে নিলো। রিকশা থেকে নেমে একইভাবে পুষ্পর হাত ধরে বলল,
-“চলোতো, আজ একটু ফুচকা-টুচকা খেয়ে আসি।”
পুষ্প চোখ বড় বড় করে রাউফুনকে নকল করে বলল,
-“কি সাংঘাতিক! কি সাংঘাতিক! ডাক্তার আবার পথের ধারে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাবে?”
রাউফুন রগড় করে বলল,
-“প্রেমের টানে ভীনদেশী মানুষ বাংলাদেশে চলে আসে। আর বউয়ের টানে আমি একটু ফুচকা খেলেই দোষ।”
পুষ্প হেসে ফেললো রাউফুনের কথা শুনে। সারাদিন ঘোরাঘুরি করে রাউফুন বলল,
-“চলোতো তোমায় এক জায়গায় নিয়ে যাবো।
একজনকে শাড়ি গিফট করার আছে। কিন্তু আমি ভালোমন্দ ঠিক চিনে উঠিনা।”
পুষ্পর পছন্দমতো দুটো শাড়ি কিনে বেরিয়ে পড়লো তারা। বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যার পর। পুষ্পকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আবারও দুজনে রাউফুনের গাড়ি নিয়ে বের হলো। লং ড্রাইভ এ যাবে বলে।
সফট মিউজিক, পাশে পছন্দের মানুষ। পৃথিবীর কিছু সুখের মুহূর্তের মধ্যে একটি মুহূর্ত। পুষ্প মুহূর্তটি উপভোগ করতে ব্যস্ত। তখনই রাউফুন বলল,
-“সম্পর্কে গুরুত্ব দিতে হয়। অবহেলায় ফেলে রাখলে বিপরীত দিক থেকেও একসময় ভালোবাসার বদলে অবহেলাটাই আসে। অবহেলা করলে একসময় সম্পর্কটি ফিকে হয়ে যায়। বিশেষ করে বিয়ের পরবর্তী সম্পর্কটিতে দূরত্ব বাড়াতে নেই।”
পুষ্প মনযোগ দিয়ে কথাগুলো শ্রবণ করলো। মাঝে আর কেউই কথা বললোনা। পুষ্পদের বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে শাড়ির প্যাকেট দুটো পুষ্পর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-“এগুলো তোমার জন্যই নিয়েছি।”
পুষ্প প্রথমেই বুঝে গিয়েছিলো শাড়ি গুলো তারজন্যই কেনা। হাতে শাড়ি নিয়ে বসতেই শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে নিজের দিকে টেনে কপালে গাড় করে অধর ছুঁয়ে দিলো। অতঃপর হালকা হেসে বলল,
-“এবার এসো।”
পুষ্পর ইচ্ছে করলোনা যেতে। মনে হচ্ছে একটু আগেই তো দুজনে বেরিয়েছিলো। মিনমিন স্বরে বলল,
-“আসবো মানে? আপনি আসবেননা বাসায়?”
রাউফুন গাড়ির স্টিয়ারিং এ হাত রেখে বলল,
-“ডাকলেই আমায় কাছে পাবে।”
পুষ্প আর সাহস পেলোনা কথা বলার। শব্দগুচ্ছ গলার কাছে এসেই দলাপাকিয়ে রইলো। বেরিয়ে পড়লো গাড়ি থেকে। কিছুদূর সামনে এসেই ফের পেছনে তাকালো। রাউফুন গাড়ি নিয়ে এখনো যায়নি। তার দিকেই তাকিয়ে আছে। পুষ্প আর পিছু ফিরলোনা।
মাঝখানে কেটে গেলো ছয়দিন। রাউফুনের কোনো খোঁজ নেই। না কল, না মেসেজ আর না একবার ও এ বাড়িতে আসা। প্রথম দুদিন খারাপ না লাগলেও পুষ্প টের পেলো ভেতরের বিশাল অনুভূতিগুলো। সেদিনের রাউফের বলা কথাটি মনে পড়লো। আসলেই তো তার দিক থেকে সম্পর্কে কোনো গুরুত্ব নেই। আজ সাহস করে ফোন হাতে নিলো।
“ডাক্তার আমার সাংঘাতিক অসুখ হয়েছে। আপনি একবার আসবেন?”
টাইপ করে সেন্ড করে দিলো রাউফুনের নাম্বারে।
★★★
সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতেই ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো রাউফুন। মেসেজের টুংটাং শব্দে মস্তিষ্ক সজাগ হলো। স্ক্রিনে চোখ রাখতেই পুষ্পর মেসেজের অর্ধেক দেখে বাকিটুকু দেখার জন্য ট্যাপ করলো।
কাঙ্খিত মেসেজ পেয়ে অধরকোনে খেলে গেলো সূক্ষ্ম হাসি।
#চলবে…….
(ভুল ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইলো। হ্যাপি রিডিং।)