#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির
[১৮+১৯]
‘অংকুর ভাই। মা:রতেছেন কেন? আমি তো আপনারে কিছু করি নাই। হুদাই কেন মা:রতাছেন আমারে?’
রাগ আরো আকাশচুম্বী হলো অংকুরের। স্বজুড়ে চড় বসালো ছেলেটির গালে। এমনিতেই থাপ্পড়ের চুটে গাল লাল হয়ে বুতা হয়ে গেছে। তার উপর আবারো এতো জুড়ে থাপ্পড়। পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ স্পষ্ট ভেসে উঠলো। অনার্স পড়ুয়া একটা ছেলে রাস্তায় এভাবে বড় ভাইয়ের হাতে মা:র খাচ্ছে। এর থেকে লজ্জা ও অপ্রীতিকর অবস্থা আর কি হতে পারে?
মিতালী আর বসে রইলো না। হতভম্ব হয়ে রিকশা থেকে নেমে অংকুরের বাহু টেনে ধরলো। একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে আসলো। অংকুর দাঁতে দাঁত চেঁপে তাকিয়ে রইলো আশিকের দিকে। চোখমুখ তার শক্ত হয়ে আছে। কপালের রগ খানি ফুলে নীলচে বর্ণ ধারন করেছে। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললো, ‘আই সোয়ার আশিক্কা! তোকে আবার দেখলে একদম মেরে ফেলবো।’
‘আরে ভাই আমি করছি কি আপনারে? খালি খালি মা:রতাছেন কেন আমারে?’ নাকে, গালে দুই হাত দিয়ে ধরে বললো আশিক। তেঁতে উঠলো অংকুর। এগিয়ে এসে আবারো গালে চপাট একটা চড় মেরে বললো, ‘রাস্তাঘাটে অসভ্যতামি করিস কেন? একটু আগে রিকশায় বসে থাকা মেয়েটাকে কি বলেছিস তুই? বল? সাহস বেড়েছে তাই না?’
মিতালী এগিয়ে এসে অংকুরের বাহু ধরে টেনে আশিকের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে বললো, ‘কি হচ্ছে অংকুর? এভাবে মা:রছেন কেন? থামেন এবার প্লিজ।’
থামলো অংকুর। কিন্তু রাগের মাত্রা কমলো না। বরঞ্চ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলো।
আশিক গালে হাত দিয়ে কাচুমুচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এতোক্ষণে বুঝে আসলো তার। ভুল জায়গায়, ভুল জিনিসের উপর কথা বলেছে সে। আজকের দিনটাই খারাপ। আবারো মাইর খাওয়ার আগে স্যরি হলে দেওয়া বেটার। তাই চেহারা মলিন করে অপরাধীর মতো বললো, ‘স্যরি আপু। আমি বুঝতে পারিনি।’
‘ঠিক আছে! ঠিক আছে! আপনি এখন এখান থেকে যান।’
অংকুরের বাহু ধরে বললো মিতালী। ছেলেটি বিলম্ব করলো না এক মুহূর্তও। দ্রুততার সাথে স্থান ছেঁড়ে পালালো। ফুঁশ করে স্বস্থির নিশ্বাস ছুঁড়লো মিতালী। আশেপাশে তাকালে দেখতে পেলো কয়েকজনের ভীড় জমেছে। তাই সবার উদ্দেশ্যে বললো, ‘দুঃখিত! এখন আপনারা আপনাদের কাজে যেতে পারেন।’
ভীড় ভেঙ্গে মানুষ যে যার কাজের উদ্দেশ্যে চলে গেলো। মিতালী অংকুরের দিকে তাকালো। দেখলো এখনো রেগে আছে সে। বাহু ছাড়লো না মিতালী। অংকুরের হাত ধরে টেনে রিকশায় উঠালো। পাশাপাশি বসে রিকশা চালককে বললো, ‘মামা সামনে চলেন।’
রিকশাচালক অনুমতি পেয়ে পায়ের জোড় দিয়ে রিকশা সামনে এগিয়ে নিতে লাগলো। মুহূর্তেই দমকা শীতল হাওয়ায় চুল গুলো এলোপাথাড়ি ভাবে উড়তে লাগলো দুজনের। মিতালী বেখেয়ালিতে এখনো অংকুরের ডান বাহু ধরে বসে আছে। যখুনি টের পেলো তাৎক্ষনাৎ হাত সরিয়ে ফেললো। নিজের এহেন কান্ডে লজ্জাভূতি হলো বেশ। হাত সরিয়ে ফেলায় অংকুর তার দিকে তাকালো। বললো, ‘হাত সরালে কেন? সংকোচ না করে ধরে রাখো কখনো ছাঁড়বে না। মনে রাখবে একবার ছেঁড়ে দিলে দ্বিতীয়বার ধরার সুযোগ পাবে না।’
ধক করে উঠলো মিতালীর বুক। ভীতিগ্রস্ত হলো মন। এবার বিনা সংকোচে অংকুরের বাহু আঁকড়ে ধরে নিবিড় হয়ে বসলো। এক আকাশ সমান হারানোর ভয় এসে হানা দিলো তার মাঝে। অদ্ভুত অনুভূতির শিকার হলো সে। কিসের এতো ভয় হচ্ছে তার? কিসের হারানোর ভয় ঝুঁকে বসলো মনে? তবে কি নিজের অজান্তে অংকুরকে মনে জায়গা করে দিয়েছে? ভালোবাসা? নিজেই নিজের মনে এইসব আওড়াতে লাগলো মিতালী। অংকুরের বাহু শক্ত করে খাঁমচে ধরলো। আলতো ভাবে হাসলো অংকুর। রিকশাচালক কোথায় যাবে জানতে চাইলে অংকুর মিতালীর বাসার ঠিকানা বলে দিলো। পুরোটা রাস্তা দুজন নিরব ছিলো। একটুকুর জন্যও মিতালী অংকুরের বাহু ছাড়লো না। প্রথমের ন্যায় শক্ত করে ধরে বসে রইলো। নিজের মাঝে এক প্রকার অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব করলো। প্রশান্তি! ভালোলাগা! মুগ্ধতা! অংকুর প্যান্টের সামনের পকেট থেকে একটা গোলাপফুল বের করলো। নিঃসংকোচে মিতালীর কানের পাশে গুঁজে দিলো। কিছুটা বিস্মিত হলো মিতালী। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো অংকুরের দিকে। অংকুর গহীন চাহনীতে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললো, ‘খোলা চুলে কানের পাশে ফুল গুঁজবার অধিকার কেবল আমার। এই অধিকারের হস্তক্ষেপ হতে দিও না।’
পলকহীন ভাবে অংকুরের চোখে তাকিয়ে রইলো মিতালী। কন্ঠস্বরে নমনীয়তা এনে বললো, ‘বিনা অনুমতিতে অধিকার দেখাচ্ছেন কেন?’
অধরে মৃদু মিষ্টি একটা হাসি ফুটালো অংকুর। বললো, ‘যেখানে তুমি মানুষটাই আমার সেখানে অনুমতি চাইতে হবে কেন?’
‘সব কিছুতেই আপনার জোর।’ বলেই চোখ ফিরিয়ে সামনে তাকালো। হাল্কা আওয়াজে হেসে উঠলো অংকুর। সাথে মিতালীও মুচকি হাসলো। কিছুসময় পর অংকুর রিকশাচালক কে থামতে বললো।
‘বাসা তো আরো দূর। থামালেন কেন?’ অংকুর কে রিকশা থেকে নামতে দেখে বললো মিতালী।
এক লাফে রিকশা থেকে নেমে দাঁড়ালো অংকুর। এলোমেলো হয়ে থাকা চুল গুলো হাত দিয়ে ভাঁজে ভাঁজে ঠিক করে নিলো। পকেট থেকে ওয়ালেট বের করতে করতে বললো, ‘তুমি কি চাও তোমার বাসার আশেপাশের মানুষজন আমাকে তোমার পাশে দেখুক?’
ভ্রুঁ কুঁচকালো মিতালী। অংকুরের কথার যথাযথ বুঝতে সক্ষম হলো সে। প্রতিত্তুর করলো না। অংকুর রিকশা চালক কে ভাড়া দিতে দেখে বলে উঠলো, ‘আরে আপনি ভাড়া দিচ্ছেন কেন?’
অংকুর মিতালীর কথায় পাত্তা দিলো না। রিকশাচালক কে বললো, ‘মামা! সাবধানে নিয়ে যাবেন। বুঝেনই তো এখনো সংসার শুরু হয় নাই।’
লোকটা পান খাওয়া বিদঘুটে দাঁত বের করে হাসি দিলো একটা। এই হাসি সরলতার হাসি। সুপ্রসন্নের হাসি। বললো, ‘দোয়া করি বাজান। সারাজীবন ভালা থাকো।’
‘আইচ্ছা! এবার সাবধানে যান।’ তারপর মিতালীর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বাসায় গিয়ে কল দিও। টাটা!’
মুচকি হাসলো মিতালী। চলতে লাগলো রিকশা। অংকুর পকেটে দুই হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে থেকে তাকিয়ে রইলো মিতালীর চলে যাওয়ার দিকে। এতোটা সময় মিতালী তার হাত ধরেছিল? তখন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিলো মনে। উপরে নিজেকে শত ঠিক রাখলেও ভিতরে ভিতরে তার ঝড়ের ন্যায় তোলপাড় চলছিলো। ভেবেই আনমনে শব্দ করে হেসে উঠলো সে।
.
মাগরিবের আজান দিয়েছে প্রায় ঘন্টা খানেক সময় আগে। আজানের আগেই বাসায় ফিরে আসতো মিতালী। কিন্তু রাস্তায় অংকুরের সাথে ঘটা সেই ঝামেলার কারণে এতো দেড়ি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্ততবোধ করছে সে। দুই হাত একত্রে মুষ্টিবদ্ধ করে কচলাচ্ছে। নিশ্চয় এতো দেড়ি করায় তাকে কথা শুনতে হবে। বাবা কি বাসায়? দাদী ঘুমাচ্ছে নাকি সজাগ? দরজা শেফালী না খুলে যদি আম্মা খুলে তাহলে? হায় আল্লাহ! আজ কপালে শনি-রবি-সোম সব দশা আছে। ভয়ে ভয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো মিতালী। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। মূলত সে দাদীর কটুকথার ভয় পাচ্ছে।
কলিংবেল বাজানোর সাথে সাথে দরজা খুললো শেফালী। ফিশফিশ করে বললো, ‘বুবু চুপচাপ রুমে চলে যাও। নয়তো ঘষেটি বেগম দেখে ফেললে রক্ষা নেই। যাও যাও’
বোনের সাবধানতায় নিজেও সাবধান হলো মিতালী। গুটিগুটি পায়ে বাসায় ঢুকলো। নিঃশব্দে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হতে নিলো। তখুনি পিছন থেকে দাদীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো। স্বব্ধ হয়ে গেলো দুই বোন। স্থির দাঁড়িয়ে পরলো তাৎক্ষনাৎ। বিরক্ত হলো শেফালী। নাক মুখ কুঁচকে মুখ কালো করে তাকালো দাদীর দিকে।
‘হাত তালি মারো কেউ। মাইয়া কামাই কইরা বাড়িতে আইছে এতো রাইতে। দিন নাই রাইত নাই বাহিরে বেডা মাইনষের মতো ঘুরাঘুরি করে। লজ্জা নাই মাইয়া? সত্যি কইরা ক তো কোন আকাম কইরা আইছোস?’
প্রথম কথা গুলোর গুরুত্ব না দিলেও শেষের কথাটা কলিজায় বিধলো মিতালীর। অবাক হয়ে তাকালো দাদীর পানে। এমন নিকৃষ্ট একটা কথা দাদীর কাছ থেকে শুনতে হবে তা তার কল্পনাতীত ছিলো। চোখ লাল হয়ে এলো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো, ‘দাদী?’
‘চুপ কর মুখপুরি। শরম নাই? রাইত বিরাইতে নোংরামি করছ? বাপ মা এই শিক্ষা দিছে?’ জুলেখার ঝাঁঝল কণ্ঠস্বর।
তেঁতে উঠলো শেফালী। কন্ঠ শক্ত করে বলে উঠলো, ‘খবরদার দাদী। বুবুকে নিয়ে আর একটাও কথা বলবেন না।’
আরো রেগে গেলেন জুলেখা, ‘মুখে মুখে তর্ক করতাছোস শেফালী?’
‘হ্যাঁ করতেছি। অনেক যহ্য করেছি আপনার এই উগ্র ব্যবহার। আমাকে মোটেও মিতালী ভাব্বেন না। চুপচাপ সহ্য করার মেয়ে আমি না। জুতা মেরে গরু দান আমিও করতে পারি। নিম্নতর মানের লজ্জাবোধ থাকলে নিজের নাতনী কে এমন কথা শুনাতেন না। আর কিসের শিক্ষার কথা বলছেন আপনি? আপনার বাপ-মা আপনাকে অনেক শিক্ষা দিছে তাইনা? এই জন্যই এমন নোংরা ব্যবহার আপনার?’ শেফালীর কাটকাট প্রতিত্তুর।
বিস্মিত হলেন জুলেখা। হতভম্ব হয়ে বড়বড় চোখে তাকিয়ে রইলেন শেফালীর দিকে। এই প্রথম শেফালীর এমন আচরন দেখছে সে।
শেফালী দাদীর দিকে এক কদম এগিয়ে দাঁড়ালো। অতঃপর এক আঙ্গুল তুলে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রুক্ষভাষী গলায় বললো, ‘সাবধান করছি জুলেখা বেগম। বুবুকে নিয়ে আর একটা বাজে কথা বললে আপনার ইজ্জত শেষ করে দিব। ভুলে যাবেন না আমার শরিরে আপনারই রক্ত বয়ছে। কথাটা মাথায় রাখবেন।’
বলেই মিতালীর হাত ধরে তাকে তার রুমে দিয়ে দরজা ভিড়িয়ে দিলো। তারপর দাদীর দিকে ঘৃণিত চোখে তাকিয়ে থেকে নিজের রুমে চলে আসলো। রাগে শরির মৃদু কাঁপছে তার।এই অসুস্থ মস্তিষ্কের মহিলা তার দাদী ভাবতেই ঘৃণা লাগছে তার। চোখ বন্ধ করে জুড়ে জুড়ে নিশ্বাস ফেললো কয়েকটা। নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রান চেষ্টা করলো। তখুনি কানে আসলো মোবাইলের কর্কষ রিংটোনের ধ্বনি। বিছানা থেকে মোবাইল নিয়ে দেখলো আননোন নাম্বার। কল রিসিভ করে বললো, ‘হ্যালো কে?’
অপর পাশ থেকে পুরুষনালীর কন্ঠ ভেসে আসলো, ‘আমি।’
এমনিতেই রেগে আছে শেফালী। তার উপর এই ফোনকল। এবার রাগ তার আকাশচারী হলো। কটমট গলায় বলে উঠলো, ‘আমি? আমি টা কে? নাম নাই? নাকি জন্মের পর বাপ মা আকিকা দেয় নাই ভাই?’
‘একটা থাপ্পড় দিয়ে বত্রিশটা দাঁত ফেলে দিবো বেয়াদব মেয়ে।’
রাকিবের রাগি গলা শুনে তব্দা খেলো শেফালী। চোখ জুড়া তাৎক্ষনাৎ ছানাবড়া হয়ে গেলো তার। কান থেকে মোবাইল নামিয়ে নাম্বার টা ভালো করে দেখে নিলো। বিস্মিত হলো তার চেহারা। কানে মোবাইল রেখে বললো, ‘আপনি? খবরদার আমাকে বেয়াদব বলবেন না।’
রাকিব ত্যাঁছড়া ভাবে হাসলো। বিছানার হেডসাইডে হেলান দিয়ে বসে বললো, ‘তো কি বলবো? ভালো মেয়ে? ব্যবহার এতো খারাপ কেন তোমার?’
শেফালী দাঁতে দাঁত চিবিয়ে প্রতিত্তুরে বললো, ‘অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসলে এমনি হয়। পারমিশন ছাড়া কল দিলেন কেন?’
রাকিব স্বাভাবিক ভাবে বললো, ‘আমি মোটেও অপরিচিত নই।’
শেফালী মুখ বাঁকিয়ে ব্যঙ্গ্য করে বলে উঠলো, ‘ও আচ্ছা! আপনি তো আমার পরিচিত। একদম সোনা, ময়না, জান, কলিজা, মানিক, রত্ন! তাই না?’
উচ্চ হাসিতে মেতে উঠলো রাকিব। হাসি তার থামছে না। ভ্রুঁ কুঁচকালো শেফালী। চেহারায় তার স্পষ্ট রাগের ছাপ। মহা বিরক্ত হলো সে। দাঁত চিবিয়ে কটমট করে বললো, ‘সমস্যা কি? ভ্যাটকাচ্ছেন কেন? তার আগে বলেন কল দিলেন কেন?’
হাসি আওয়াজ থামালো রাকিব। ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হেসে বললো, ‘আমার সাড়ে আটশো টাকা?’
চূড়ান্ত লেভেলের বিস্মিত হলো শেফালী। মুখ হা হয়ে গেলো আপনা আপনি। হতভম্ব হয়ে বললো, ‘সাড়ে আটশো কিভাবে?’
‘এতো দিন দেড়ি করলে যে তাই। যতো দেড়ি করবে ততো টাকা বাড়বে। এবার বলো দিচ্ছো কবে?’
‘এ্যাঁ! মগেরমুল্লুক পাইছেন? বললেন আর আমি নাচতে নাচতে টাকা দিয়ে দিলাম? এতোই সোজা?’
‘হ্যাঁ সোজা। তুমি টাকা দিবে ব্যাস।’
‘আমি দিতে বাধ্য নই।’
‘তুমি দিতে বাধ্য। নাহলে জুলফিকার আঙ্কেলকে বলে দিবো।’
ত্যাঁছড়া কন্ঠে হাসলো শেফালী। কোমড়ে এক হাত রেখে বিদ্রোপ করে বলে উঠলো, ‘বললে বলেন গিয়ে। আপনার আঙ্কেলকে ভয় পাই নাকি আমি? হাহ্ যা খুশি করেন। দরকার পরলে বাসায় এসে বলে যান। তাতে আমার কি?’
কপাল কুঁচকে বিরক্তির নিশ্বাস ছুঁড়লো রাকিব। এই মেয়ের সাথে পেরে উঠা যায় না। ঝগড়ায় এক্সপার্ট। এখুনি এমন; না জানি বিয়ের পর কি হবে। মৃদু হাসলো রাকিব। বললো, ‘তুমি সবসময় ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলো কেন? জন্মের সময় আন্টি মুখে মধুর বদলে নিমপাতা দিয়েছে নাকি? ব্যাপারটা আসলেই অনেক সাংঘাতিক। আন্টির কাছ থেকে জানতে হবে।’
রাগে শরির রিনরিনিয়ে উঠলো শেফালীর। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে উঠলো, ‘আপনি আস্তো একটা বজ্জাত! রাক্ষস, শয়তান ছেলে!’
আর কিছু না বলে কল কেটে দিলো শেফালী। বিরক্তি-সহিত বিছানায় ধপাস করে হাত পা ছুড়ে শুয়ে পরলো। জুলফিকার বাসায় নেই। আমেনা পাশের বাসায় গেছে কাজের মেয়ের খোঁজ নিতে। বাসায় শুধু সে আর জুলেখা ছিলো। এই সুযোগে দাদীকে ইচ্ছে মতো শুনিয়ে দিয়েছে। মূলত এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলো শেফালী। আজ পূরণ হলো। হোক সে দাদী কিংবা পৃথিবীর অন্য কেউ ছেঁড়ে কথা বলবে না। ফুঁশ করে স্বস্থির নিশ্বাস ছুঁড়লো একটা। মোবাইল বের করে গান বাজালো। কানে হেডফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করলো। মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলো The chainsmokers – don’t let me down. ft. daya.
.
হতভম্ব হয়ে বসে আছে জুলেখা। ভাবছে শেফালীর বলা কথা গুলো নিয়ে। নাতনির কাছে এমন কথা শুনে অপমানিত হলো সে। অপমানে মুখ-খানি থমথমে হয়ে আছে। সোফায় সটান হয়ে বসে আছে সেই কখন থেকে। মূলত অপেক্ষা ছেলের। এতো অপমান সে এই জন্মে পায় নি। রাগে ফুঁসছে সে। দাঁতে দাঁত কিড়মিড় করছে বারংবার।
.
ভীতিগ্রস্ত হয়ে আছে মিতালী। শেফালীর ওমন ব্যবহারে সে নিজেও অসন্তুষ্ট। দাদীকে সে যথেষ্ট সম্মান করে। যতোই কটুকথা শুনাক না কেন। বড়রা সবসময় সম্মানের জায়গায় থাকে। তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা অনুচিত। এটাই জুলফিকার তাকে ছোট বেলায় শিখিয়েছে। কিন্তু ছোট বোন হয়েছে তার উল্টো। অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ করতে উঠে পরে লাগে। এখন কি করবে সে? জিভ দিয়ে শুকনো উষ্ঠধয় ভিজিয়ে নিলো। জোরপূর্বক ঢুক গিললো একটা। কাধ থেকে ব্যাগ টেবিলে রেখে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো। দরজা হাল্কা খুলে বাহিরে উঁকি দিলো। দেখলো জুলেখা ড্রয়িংরুমে বসে আছে বিবর্ণমুখে। দরজা লাগিয়ে দিলো আবারো। ফুঁশ করে শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো। টেবিলে এসে বই বের করলো পড়ার জন্য। মাথা থেকে যতো আজেবাজে চিন্তা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলো। সম্পূর্ণ মনোযোগ পড়ায় দিতে চাইলো। কিন্তু পারলো না। ভয়ে হাত পা জমে এসেছে তার। এতো এতো চিন্তার মাঝে অংকুরকে কল দিয়ে জানিয়ে দেওয়ার কথা বেমালুম ভুলে বসেছে সে।
.
রাত্রীর ঘড়ির কাটা প্রায় সাড়ে আটটার ঘরে। টিপটিপ শব্দে সেকেন্ডের কাটা ঘুড়ছে। পরিবেশ থমথমে। একদম নিস্থব্ধ। নিরবতা বিরাজমান পরিবারে। জুলফিকারের মুখ গম্ভীর। সামনে শেফালী গুটিসুটি মেরে বসে আছে। তবে চেহারায় তার বিন্দুমাত্র ভীতিগ্রস্ত নয়। বরঞ্চ স্বাভাবিক! যেন সে এই মুহূর্তের জন্য নিজেকে একদম প্রস্তুত করে রেখেছে। মিতালী একটু দূরে তার মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মলিন তার মায়াবী মুখশ্রী। ভয়ে ভয়ে আমেনার হাত ধরে রেখেছে। বোনকে কি থেকে কি বলবে সেই ভয়ে অসাড় তার শরির। তারই জন্যই ছোট বোনকে এখন শাসন করবে তার বাবা। কান্না কান্না ভাব আসলো তার মাঝে। আমেনা নিশ্চুপ, নির্বিকার। কথা নেই মুখে। দুই হাত বুকে গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার স্বামী ও শাশুড়ির দিকে। বাসায় আসার পর থেকেই জুলেখা আহাজারি শুরু করেছে। জুলফিকার ফিরার পর থেকে তো ন্যাকা কান্নাকাটি। এই মহিলার সাথে এতো বছর একই সংসারে থেকেছে আমেনা। তার স্বভাব চরিত্র সব কিছুই তার জানা। পান থেকে চুন খসলেই ন্যাকামি শুরু। নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আমেনা।
দীর্ঘক্ষণ নিরবতা ভেঙ্গে জুলফিকার গম্ভীর কন্ঠে শেফালীকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি আম্মার সাথে বেয়াদবি করেছো?’
শেফালীর মুখ-খানি নির্বিকার। চিন্তার রেশ বিন্দুমাত্র নেই। স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো, ‘বেয়াদবি করিনি। মুখের উপর সত্য কথা বলেছি। এখন সেটা যদি আপনার বিচারকার্যে বেয়াদবি বলে বিবেচনা করা হয় তাহলে আমার কিছু বলার নেই।’
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মৃদু মাথা দুলালো জুলফিকার। তারপর মায়ের দিকে তাকালেন। বললেন, ‘আম্মা! শেফালী আপনাকে কি বলেছিলো?’
বিমুখ হলেন জুলেখা। ন্যাকা কান্নার সুরে বললেন, ‘কি বলে নাই তোর মাইয়া রে জিগা। মুখে মুখে আমারে অপমান করছে। বলি বাঁইচা থাইকা কি লাভ? এই দিন দেখার লাগি বাঁইচা আছি? নাতনি আমারে অপমান করে। শরমের কথা।’ বলেই শাড়ির আঁচল মুখের সামনে রেখে কান্নার সুর তুললেন।
বিরক্তির মুখ করলো শেফালী। অধৈর্য হয়ে বলে উঠল, ‘আশ্চর্য! এভাবে ন্যাকামি করতেছেন কেন? আপনার মাথায় কেউ ইট মারছে? মারে নাই তো। তাহলে এতো নাটক করতেছেন কেন?’
#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির
[২০]
‘দেখছো দেখছো? মাইয়া কতো বড় বেয়াদব হইছে। ওরে জুলফিকার রে। দেখ তোর মাইয়া আমারে অপমান করে। এই বাড়ি আর থাকমু না। যামু গা আমার মাইয়ার কাছে।’ বলেই শাড়ির আঁচল মুখে টেনে কাঁদতে লাগলেন। নাটকের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলেন জুলেখা।
আমেনা চেহারায় কিছুটা অসন্তুষ্টি আনলেন উভয়ের প্রতি। শেফালীকে ধমকে উঠলেন, ‘শেফালী? দাদীর সাথে এমন ব্যবহারের মানে কি? উনি তোমার বড়। সম্মান দিয়ে কথা বলবে।’
শেফালী ঝাঁঝ মেশালো গলায় উত্তর দিলো, ‘আমি তো মোটেও খারাপ ব্যবহার করিনি। তোমরা উনাকে জিজ্ঞেস করো তখন উনি এমন কি বলেছিলো যার জন্য আমি উগ্র ব্যবহার করেছি। জিজ্ঞেস করো।’
গম্ভীর জুলফিকারের মুখ। শেফালীর থেকে চোখ ফিরিয়ে মায়ের দিকে তাকালেন। জুলেখা ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমি কিছু বলি নাই। তোর মাইয়া দেড়ি কইরা বাসায় আইছে। এর লাগি একটু শাসন করতে গেছিলাম। তোর ছোট মাইয়া আমার সামনে আঙ্গুল তুইল্লা কথা শুনাইলো।’
জুলফিকার নিশ্চুপ রইলেন। প্রতিত্তুর করার আগেই শেফালী বসা থেকে রেগে উঠে দাঁড়ালো। রাগে ফুঁশ করতে করতে বলে উঠলো, ‘একদম মিথ্যে বলবেন না। নিম্নতম মানের লজ্জাবোধ থাকলে মিথ্যে বলতেন না। শাসন করছিলেন আপনি? নাকি শাসনের নামে আমার বোনের চরিত্রে আঙ্গুল তুলছিলেন? নিজের নাতনি কে চরিত্রহীন বলতে বিবেকে বাধে নাই? আমার তো আপনাকে দাদী বলতে ঘৃণা লাগছে এখন।’
তীব্র থেকে তীব্রতর ঘৃণিত কন্ঠে জুলেখাকে বললো শেফালী। রাগে শরিরে মৃদু কাঁপন হচ্ছে তার। জুলফিকার হতভম্ব হয়ে মায়ের দিকে তাকালো। মায়ের এমন ব্যবহারের কথা শুনে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। মিতালীর চরিত্র নিয়ে আঙ্গুল উঠিয়েছে? ছেলের এমন বিস্মিত চাহনীতে বিব্রত বোধ করলেন জুলেখা। চেহারায় কাচুমুচু ভাব আসলো তার। ইতস্ততবোধ করতে লাগলেন।
শেফালী বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘স্যরি টু সে বাবা, এই মহিলার মতো থার্ড ক্লাস ম্যান্টালিটির মানুষ এই দুনিয়াতে আর একটাও নেই। যে আমার বুবুকে নিয়ে বাজে কথা বলবে তাকে এই শেফালী মাহমুদ ছাড়বে না। এমনকি জুলেখা বেগম কেও না।’
দাঁড়ালো না শেফালী। দ্রুত পা চালিয়ে রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো। নিজেকে শান্ত রাখার জন্য বড়বড় কয়েকটা নিশ্বাস ফেললো। দুই হাতে চুল মুঠ করে ধরে মৃদু আর্তনাদ করলো। তারপর ফুঁশ করে নিশ্বাস ফেলে ওয়াশরুম থেকে চোখেমুখে পানি দিয়ে বারান্দায় গেলো। হেডফোন বের করে গান লাগালো একটা। আপাতত রিফ্রেশমেন্ট চায় তার।
আমেনা এতোক্ষণ নিশ্চুপ ছিলেন। শেফালী যেতেই মুখ খুললেন, ‘আম্মা! আপনার সংসারে আসার পর থেকে এখন অব্ধি আমি আপনাকে যথেষ্ট সম্মান করি। আপনি মাঝে মাঝে আমার বড় মেয়েকে নিয়ে বাজে কথা বলেন। কেন আম্মা? মিতালী তো আপনারই বংশধর। তাহলে? আপনার নিজের ছেলের মেয়েকে এভাবে কথা শুনান কেন? আল্লাহ যদি নিজের ইচ্ছায় আমাদের কন্যা সন্তান দান করেন তাহলে এতে মিতালীর কি দোষ? না তো আম্মা। একটু বুঝার চেষ্টা করবেন। বাচ্চাদের এভাবে বললে তারা কষ্ট পাবে। তাদের মন থেকে আমাদের জন্য ভালোবাসা কমে যাবে। শেফালীর হয়ে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। কিছু মনে করবেন না।’
আমেনাও রুমে চলে গেলো। অসহায় হলো মিতালী। কষ্ট লাগছে তার। আজ তার জন্য ঘরে এতো বছর পর অশান্তি এসেছে। শেষ অশান্তি হয়েছিল যখন সে ছোট ছিলো। তার একমাত্র ছোট কাকা যখন আলাদা থাকার কথা বলেছে তখন অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে সংসার ভাঙ্গার কারণে। তার পর থেকে আজ অব্ধি কিছুই হয়নি। এখন তার জন্য। কে সে জন্ম নিলো? কেন মরে গেলো না? কেন? আপন মনে এইসব কথা আওড়াচ্ছে মিতালী।
জুলফিকার মায়ের দিকে গম্ভীর চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘আম্মা আপনি খেয়ে শুয়ে পরেন। মনে করে ঊষুধ খেয়ে নিয়েন।’
জুলফিকার উঠে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন। নিশ্চুপ রইলেন জুলেখা। নাতনির কাছ থেকে ওমন কথা শুনে তিনি বাকরুদ্ধ। ছেলে ও ছেলের বউয়ের নিরবে উপেক্ষা ও অসন্তুষ্টি আচ্ করতে পারলেন। লজ্জিত হলেন। অপরাধবোধ কাজ করলো মনে। চোখ তুলে মিতালীর দিকে তাকালেই দেখতে পেলেন মিতালীর চোখে পানি। জুলেখা তাকাতেই মিতালী এসে তার সামনে বসে বলে উঠলো, ‘দাদী রাগ করো না প্লিজ। শেফালী এখনো ছোট। বুঝতে পারেনি। আমি ওকে বুঝিয়ে বলবো। প্লিজ আমাকে নিয়ে তোমরা কেউ রাগারাগি করো না। মাফ করে দিও দাদী।’
জুলেখার প্রতিক্রিয়াহীন। নিস্প্রভ দৃষ্টিতে মিতালীর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন। তারপর বসা থেকে উঠার প্রয়াস করে বললেন, ‘মিতালী আমারে ঘরে নিয়া চল। রাইত হইছে।’
মিতালী কিছু বললো না। চোখের কোণের পানি মুছে জুলেখা কে তার রুমে দিয়ে আসলো। জুলেখা রুমে গিয়ে দরজা ভিড়িয়ে দিলেন। বাহিরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো মিতালী। এখন কি করবে সে? শেফালীর রুমে যাবে? নাকি বাবা-মায়ের? নাকি নিজের রুমে?
এই মুহূর্তে বাবা-মার রুমে যাওয়া ঠিক হবে না। তাই ভেবে শেফালীর রুমের সামনে এসে দরজায় টোকা দিলো। ডাকলো শেফালীকে। একবার, দুইবার, তিন বারের মাথায় উত্তর দিলো শেফালী।
‘বুবু ডাকবে এখন।
‘খাবার খাবি না?’
‘না খাবো না কিছু। তুমি যাও ডাকবে না।’
আর ডাকলো না মিতালী। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমে চলে আসলো। দরজা লাগিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো। বারান্দায় যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ভাবলো মোবাইল নিয়ে যাবে। তাই বিছানা থেকে হাতে নিয়ে স্কিন অন করে দেখলো অনেক গুলো মিসডকল ও ম্যাসেজ। অংকুর এতোগুলো কল ম্যাসেজ দিয়েছে কেন? প্রশ্ন জাগলো মনে । তাই সাথে সাথে কল ব্যাক করলো। দুই বার রিং হওয়ার পরেই রিসিভ করলো অংকুর।
‘তুমি অনেক খারাপ মিতালী। আমার কথা একটুও ভাবো না।’
অংকুরের চাপা অভিমানি কণ্ঠস্বর। মিতালীর কপালে সূক্ষ্ম চিন্তার ভাজ পরলো। ভ্রুঁ কুঁচকে প্রশ্ন করলো, ‘কেন? কি করেছি আমি?’
অংকুর কন্ঠ মলিন করে উত্তর দিলো, ‘তোমাকে বলেছিলাম বাসায় গিয়ে জানিও। কিন্তু তুমি কল কিংবা ম্যাসেজ কিছুই দাও নি। এইদিকে রাত হয়ে গেছে অথচ এখন অব্ধি কোনো খবর নেই। আমার কল ম্যাসেজের রিপ্লাইও দিচ্ছো না। জানো কতটা টেনশনে পরে গিয়েছিলাম? আরেকটু হলে তোমার বাসায় চলে আসতাম আমি। অলরেডি বাইকে বসে আছি। শুধু স্টার্ট দেওয়া বাকি।’
বিস্মিত হলো মিতলী। প্রকাণ্ড অবাক হয়ে বিছানায় বসলো। বললো, ‘মানে? পাগল আপনি?’
কপাট রাগ উঠলো অংকুরের। চোয়াল শক্ত করে বলে উঠলো, ‘হ্যাঁ পাগল। তাই তো এমন করো আমার সাথে। আমাকে বুঝার চেষ্টা করো না কেন তুমি? তোমার চিন্তায় আমি পাগলপ্রায় হয়ে গেছি। কি এমন কাজ করছিলে তুমি যার জন্য একটা কল দেওয়ারও সময় পেলে না?’
ধাতস্থ হলো মিতালী। অংকুরের রাগি গলার কণ্ঠস্থর শুনে চুপসে গেলোম। কণ্ঠস্বর নিচু করে উত্তর দিলো, ‘বাসায় ছিলাম।’
রাগ আরো বাড়লো অংকুরের। দাঁতে দাঁত পিষলো তাৎক্ষনাৎ। মুখ শক্ত করে বললো, ‘হ্যাঁ তুমি তো বাসায় ছিলে। খুব নিশ্চিন্তে বাসায় ছিলে। এইদিকে বেহুদা আমি অস্থির হচ্ছি। আসলে কি বলো তো? কাউকে একটু বেশি প্রায়োরিটি দিলে তার ভাব বেড়ে যায়। যেমনটা তোমার। থাকো তুমি তোমার মতো। আমার চিন্তা যেহেতু করোই না। সেহেতু আমি হুদাই কেন থাকবো? লাভ নেই। বাই।’
লাইন কেটে দিলো অংকুর। মোবাইল বাইকের উপর রেখে চুল গুলো খাঁমচে ধরলো। চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস নিতে লাগলো। পাশে রাকিব দাঁড়িয়ে ছিলো। এতোক্ষণ বলা সব কথায় তার কর্ণপাত হয়েছে। অংকুর কে শান্ত্বনা দিতে বললো, ‘দেখেছিস আমি বললাম না মিতালী ঠিক আছে। তাও তুই টেনশন করছিলি। আর এখন রেগে লাভ কি? হয়তো মনে ছিলো না তোকে জানাতে। রাগিস না।’
‘চুপ কর তুই। বাসায় যা। আমার আসতে দেড়ি হবে।’
রাকিবকে ধমকে বলে উঠলো অংকুর। আর কথা না বলে মোবাইল পকেটে রেখে বাইক স্টার্ট দিলো। চেঁচিয়ে উঠলো রাকিব।
‘এতো রাতে কোথায় যাবি তুই? অংকুর দাঁড়া আমাকেও নিয়ে যা। অংকুর???’
ফুল স্প্রিডে বাইক চালিয়ে চোখের আড়াল হয়ে গেলো অংকুর। হতবাক হয়ে গেলো রাকিব। অংকুর বেশ রেগেছে। আপাতত তার একা থাকা উচিত। ভাবলো না আর। এক হাতে মাথা চুলকে পকেট থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখলো। শেফালীর কথা মনে পরতেই কল দিলো। রিসিভ হলো না। তাই আবারো কল দিলো এবং রিসিভও হলো।
‘সমস্যা কি? আমাকে বারবার কল দেন কেন আপনি?’
শেফালী ঝাঁঝালো গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো তাৎক্ষনাৎ। মৃদু হাসলো রাকিব। শেফালীকে আরো রাগাতে ত্যাঁছড়া কন্ঠে বলে উঠলো , ‘তুমি এতো গ্যাঁজগ্যাঁজ করো কেন বলো তো?’
শেফালীর আরো রাগ হলো। দাঁতে দাঁত পিষে বললো, ‘তাহলে এই গ্যাঁজগ্যাঁজ করা মেয়েটা না করার পরেও কল দেন কেন? লজ্জা নেই?’
‘ওহ হ্যালো? তোমার সাথে লাইন মারতে কল দেই নাই। আমি আমার টাকা এখনো পাইনি। তাই তাড়াতাড়ি টাকা দাও। আর কল দিব না।’
শেফালী বিরক্তি নিয়ে বললো, ‘আপনাকে দেখে আস্তো ফকির মনে হচ্ছে আমার। মাত্র ছয়শো টাকার জন্য কিভাবে পিছে পরে আছেন।’
‘উহুম সাড়ে আটশো।’
‘ওরে আল্লাহ!’ বলে হতাশ নিশ্বাস ফেললো শেফালী। বিরক্তির চরম শিখরে পৌঁছে গেছে সে। ফুঁশ করে দম ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করলো। বললো, ‘ঠিক আছে। বি-কাশ নাম্বার দেন। আমি টাকা পাঠাচ্ছি।’
ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো রাকিব। এই মেয়ে এতো সহজে টাকা দিতে রাজি হয়ে গেলো? সত্যি সত্যি দিয়ে দিবে নাকি? তাহলে সে কোন অজুহাতে কল দিবে তাকে? চিন্তায় পরে গেলো রাকিব। তবুও বললো, ‘এটাই।’
‘ঠিক আছে।’ বলেই লাইন কেটে দিলো। রাকিব পরেছে মহা বিপাকে। সে মূলত টাকার জন্য শেফালীকে কল দিতো না। বরঞ্চ শেফালীর সাথে কথা বলে বেশ ভালো উপভোগ করতো। অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করতো মনে। কিন্তু শেফালী যদি টাকা দিয়ে দেয় তাহলে? ঠোঁট কামড়ে ভাবতে লাগলো। তখুনি ম্যাসেজ আসলো বি-কাশ এপ থেকে। দেখলো একটা গিফট ম্যাসেজ। অর্থাৎ শেফালী পাঁচ টাকা দিয়ে লিখেছে,,
‘আল্লাহর ওয়াস্তে পাঁচ টাকা দান করলাম। আপনি তো আবার ঢাকার ডিজিটাল ফকির।’
ম্যাসেজ দেখে হুহা করে হেসে উঠলো রাকিব। এতোক্ষণে যেন দেহে তার প্রাণ ফিরে এসেছে। চিন্তামুক্ত হলো সে। শেফালী এই জন্মে টাকা দিবে না। আর সেও এই জন্মে জ্বালানো বন্ধ করবে না। খুশি মনে বাসার ভিতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। গেইটে ঢুকার আগে একবার রাস্তায় তাকিয়ে অংকুরের কথা ভাবলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাসায় ঢুকলো সে।
চলমান..
চলমান..