#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল মিহির
[৩৬]
দরজার উপর পাশে দাঁড়িয়ে আছেন অংকুরের বাবা অলীউর রাহমান, সুপ্তি বেগম ও রাকিব। শেফালী চুপচাপ দরজা থেকে সরে দূরে এসে দাঁড়ালো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তাদের দিকে। মনে মনে বিস্মিত হলো বেশ। তার মানে সত্যি সত্যি জিমি দেখতে এসেছে বুবুকে? রাকিব মিথ্যে বলেনি। খুশি খুশি লাগছে তার।
জুলফিকারের প্রশ্নে সৌজন্যমূলক হাসি দিলেন অলীউর রাহমান। এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম মিঃ জুলফিকার।’
জুলফিকার নিজেও স্বাভাবিক ভাবে নম্রতার সাথে হাতে হাত মিলিয়ে বললেন, ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম।’
‘আমাদের কি দরজায় দাঁড়িয়ে রাখবেন নাকি? বাসায় আসতে বলবেন না?’
এতোক্ষণে বোধহয় হুশিয়ার হলেন জুলফিকার। ব্যস্ত হয়ে তাদের ভিতরে নিয়ে বসালেন। তারপর রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে আমেনা কে সব বললেন আর নাস্তার আয়োজনের কথা জানালেন। আমেনা প্রথমে বিস্মিত হয়েছিল। অতঃপর ‘যা হবে, ভালোর জন্য-ই হবে’ ভেবে নাস্তার আয়োজন শুরু করলেন। তবে প্রথমে তিনজনের জন্য ঠান্ডা লেবুর শরবত বানিয়ে নিয়ে গেলেন। সালাম দিয়ে কুষলবিনীময় করে রান্না ঘরে চলে আসলেন। ব্যস্ত হয়ে পরলেন অতিথি আপ্যায়নে।
শেফালীর ব্যাপার টা হজম হচ্ছে না। বিস্মিত হয়ে আছে। খুশি তে তার মন হাডুডু খেলছে। জিমি হবে তার দুলাভাই ভাবতেই ভালো লাগছে ভীষণ। হঠাৎ-ই মনে পরলো মিতালীর কথা। বুবু কোথায়? ছকিনা বেশে যদি আবার তাদের সাথে চলে আসে? নো ওয়ে! এমন কিছুই করা যাবে না। চটজলদি পায়ের কদম ফেলে মিতালীর রুমে আসলো। পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে দেখলো সে রুমে নেই। ওয়াশরুম থেকে আওয়াজ আসায় নিশ্চিত হলো শেফালী। অতঃপর আলমারি খুলে শাড়ি চয়েজ করতে লাগলো নিজের মতো। আজ-ও শেফালী সাজিয়ে দিবে তার বুবুকে। এমন কি বিয়ের ব্রাইডাল সাজটাও শেফালী দিবে।
.
কথায় মশগুল হয়ে আছেন জুলফিকার ও অলীউর রাহমান। এমন ভাবে আলাপ জমিয়েছে যেন তারা কতো পূর্ব পরিচিত। রাকিব এক পাশে চুপচাপ বসে রইলো। মাঝে মাঝে তাদের দুইজনের কথার উত্তরে এটা-সেটা বলছে।
সুপ্তি বেগম কিছুক্ষণ নিরবে বসে ছিলেন। অতঃপর উঠে দাঁড়ালেন রান্না ঘরে যাবার উদ্দেশ্যে। ধীর পায়ে আশেপাশে ভালো করে প্রখর করে রান্না ঘরে আসলেন সুপ্তি। দেখলেন মিতালীর মা নাস্তার আয়োজন করতে ব্যস্ত। এগিয়ে গেলেন সামনে। বললেন, ‘বাহ্ আপনার রান্না ঘরটা খুব সুন্দর করে গুছানো।’
সুপ্তি বেগমকে এখানে দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন আমেনা। অস্থির কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘আরেহ্ এখানে কি করছেন আপনি? যান যান গিয়ে বসেন। এখানে প্রচুর গরম।’
সুপ্তি বেগম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বেসিনে রেখে বললেন, ‘রান্নাবাড়া তো আমিও করি। একা একা তিনবেলা সামলানোর অভ্যেস আমার আছে।’
আমেনা কাজের করার মাঝেই বললেন, ‘ওমা। একা একা করেন কেন? কাজের লোক রাখতে পারেন রান্নার জন্য। এই বয়সে রান্নাটা একটু কষ্টকর হয়ে যায়।’
‘কাজের লোকের আর রান্না। বেশ কয়েকজনকে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তাদের রান্না আমার দুই ছেলে তৃপ্তি সহকারে খেতে পারে না। অবশ্য তারা দুইজন মুখে কিছু বলেনি। ওদের খাওয়ার পরিমান দেখেই বুঝে গেছি আমি। অংকুর তো এখনো রাগারাগি করে এই নিয়ে। তবুও আমি রান্নাবান্না কাজের লোককে দিয়ে করাই না। শত-ই হোক মা তো আমি। ওরা খেতে না পারলে আর আমার দিয়ে করবো টা কি? কাজের মেয়েটা অন্য কাজে সাহায্য করে। রান্নাটা আমি-ই করি।’
‘দুই ছেলের বউ আসলে আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না।’
‘সেই ব্যবস্থাই তো করতে এলাম।’
অতঃপর কাজের ফাঁকে বিভিন্ন ধরনের কথা বলতে লাগলেন দুজন। সুপ্তিও হাতে হাতে সাহায্য করতে লাগলেন।
.
মোবাইলে ম্যাসেজের আওয়াজ শুনে পকেট থেকে মোবাইল বের করলো রাকিব। জরুরি ভেবে চটজলদি ম্যাসেজ চেক করলো। জরুরি না হলে বড়দের সামনে মোবাইল ঘাঁটবে না। ম্যাসেজ চেক করে দেখলো অংকুর পাঠিয়েছে।
‘কিরে ভাই? বাসার ভিতরের সিচুয়েশন কেমন?’
সকলের অগোচরে স্মিতি হাসলো রাকিব। জুলফিকার ও অলীউর রাহমান কে ‘আসছি’ বলে এখান থেকে উঠে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর ম্যাসেজের রিপ্লাই দিলো, ‘গরম পরিবেশ ভাই।’
মিতালীদের বাসার নিচে চায়ের দোকানে বসে আছে অংকুর। পরনে তার ফর্মাল ড্রেস-আপ। দুধ চায়ের কাপে চুমুক বসাতে গিয়েও থেমে গেলো রাকিবের রিপ্লাই দেখে। বিস্মিত হলো কিছুটা। চিন্তিত হয়ে ম্যাসেজ দিল, ‘গরম মানে? মিতালীর বাবা রাগারাগি করেছে নাকি? কিছু বলেছে?’
ম্যাসেজ দেখে নিঃশব্দে হেসে উঠলো রাকিব। ঠোঁট কামড়ে ম্যাসেজ ব্যাক করলো, ‘হয়তো।’
‘হয়তো মানে? কি হচ্ছে ভিতরে?’
রাকিব ম্যাসেজের উত্তর দিলো না। অংকুর আবারো ম্যাসেজ দিল, ‘ভাই বলনা টেনশন লাগছে। তোকে কাচ্চি বিরিয়ানি ট্রিট দিব। প্লিজ ভাই বল।’
‘তুই এসে দেখে যা।’
‘না।’
‘কেন?
‘আমার অনেক নার্ভাস লাগছে।’
‘বেডি বেডি ফিলিংস নিয়া বসে আছিস কেন? জামাই তুই। মেয়ে দেখতে আসলি তুই। অথচ ভেতরে আসছিস না।’
‘ভাই আমার লজ্জা লাগতেছে।’
অংকুরের ম্যাসেজ দেখে হুহা করে হেসে উঠলো চায়লো রাকিব। কিন্তু হাসলো না। ঠোঁট কামড়ে কোনো রকমে হাসি থামিয়ে রাখলো। এই প্রথম এক নতুন অংকুরকে দেখতে পেলো রাকিব। যে কিনা সব কিছুতে ফাস্ট ফাস্ট, সে কিনা ভয়, জড়তা, লজ্জায় মিতালীকে দেখতে আসতে চায়নি। ভাবা যায় এগুলা? সকাল থেকে বিকেল অব্ধি অংকুরের পিছু ঘুরেছে রাকিব। অংকুর কিছুতেই রাজি হচ্ছিলো না এখানে আসার জন্য। সে নাকি নার্ভাস, লজ্জা পাচ্ছে। রাকিব বুঝলো না ছেলে মানুষের এতো লজ্জা কিসের? তবে যাইহোক, জোড় করে রাজি করানো হয়েছে অংকুরকে। বাসার নিচে এসেও সে দাঁড়িয়ে পরলো। তার একটাই কথা – আগে মিতালীর বাবাকে রাজি করাক, কথা পাকা করুক, তারপর সে যাবে। আগে আগে যাওয়ার পর যদি রিজেক্টেড হয়? কি লজ্জা! এইসব ভাবতে ভাবতেই ঠোঁট টিপে হাসছিলো রাকিব।
.
ওয়াশরুম থেকে বেরুলে শেফালীকে দেখতে পেলো। খেয়াল করলো তার আলমারি তে কিছু খুঁজাখুঁজি করছে সে। ভ্রুজোড়া কুঁচকালো মিতালী। জিজ্ঞেস করলো, ‘আমার আলমারিতে কি করছিস?’
খুঁজাখুঁজি করা হাতটা থেমে গেলো তাৎক্ষনাৎ। চোখ বড় হয়ে গেলো। মাথায় শয়তানী বুদ্ধি আঁটলে বাঁকা হাসলো। তারপর হাসি মিলিয়ে মলিন মুখে পিছু ঘুরে তাকাল। তার এমন চেহারা দেখে চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করলো মিতালী, ‘কি হয়েছে?’
শেফালী মলিন চোখমুখে বললো, ‘শাড়ি খুঁজছি।’
মিতালী এগিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাতে কাজল নিয়ে বলল, ‘কোনো অকেশন আছে নাকি? তুই পরবি শাড়ি?’
শেফালী মাথা এপাশ থেকে ওপাশ নাড়িয়ে বুঝালো ‘না’। মুখে বলল, ‘তোমার জন্য।’
ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে এলো আবারো। কপালে পরলো সূক্ষ্ম ভাজ। পিছনে ফিরে বলে উঠলো, ‘আমার জন্য মানে? কি হয়েছে সত্যি করে বলতো।’
শেফালী মিনমিনে গলায় বলল, ‘তোমাকে দেখতে এসেছে।’
বিস্মিত হলো মিতালী। কপাট রাগ উঠলো শরিরে। কাজলটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে বললো, ‘মানে কি? দেখতে এসেছে মানে? আব্বু আমাকে জানাল না কেন?’
শেফালী ‘কিছু জানে না’ কিছু বুঝে না’ এমন একটা ভান ধরলো। মিতালীর রাগ আরো বাড়লো। দাঁতে দাঁত লেগে এলো ক্রোধে। কণ্ঠস্বর দ্বিগুণ করে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কি হয়েছে বল? আব্বু আমাকে না জানিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিলো কেন? আব্বু কোথায়? আব্বু?’
জোড়ে জোড়ে বাবাকে ডাকতে দেখে হকচকিয়ে গেলো শেফালী। চোখ বড় বড় করে চটজলদি এগিয়ে এসে মিতালীর মুখ চেপে ধরে বলল, ‘আস্তে বোইন, চেঁচাচ্ছিস কেন? কেলেঙ্কারি বাধানোর শখ হয়েছে নাকি?’
মিতালী শেফালীর হাত ঝামটা মেরে ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে। রাগে শরির কাঁপছে তার। কিছু বলতে যাবে তার আগেই শেফালী বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো, ‘আশ্চর্য মেয়ে তুমি। সম্পূর্ণ কথা না শুনে এভাবে চেঁচাচ্ছ কেন? তোমাকে অন্য কেউ নয়, জিমি দেখতে এসেছে।’
কথাটা বলেই বিছানায় পা তুলে বুকে হাত গুঁজে চেহারা কালো করে বসলো শেফালী। অবাক হলো মিতালী। নিজের কানকে বিশ্বাস করলো না। আবারো জিজ্ঞেস করলো, ‘কে এসেছে?’
ত্যাঁছড়া চোখে তাকাল শেফালী। বলল, ‘একবার বলেছি তো একবারই। বারবার রিপিট করতে পারবো না।’
মিতালী কোমড়ে এক হাত রেখে সিরিয়াস হয়ে বলল, ‘অংকুর এসেছে?’
শেফালীর ত্যাড়া প্রতিত্তুর, ‘অংকুর বাদে আর কে আসবে শুনি।’
চুপ হয়ে গেলো মিতালী। আশ্চর্য হলো বেশ। ঠোঁট কামড়ে স্মিতি হেসে উঠলো। লজ্জাভূতি হলো সে। প্রয়োজন ব্যতিত আবারো ওয়াশরুমে গেলো। সবটাই দেখলো শেফালী। নিজেও হেসে উঠলো শব্দ করে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল গুলো ঠিক করে বের হলো রুম থেকে। ড্রয়িংরুমের কাছাকাছি রাকিবকে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসতে দেখে কপাল কুঁচকালো। আরেকটু ভালো ভাবে খেয়াল করে দেখলো মোবাইলে চ্যাটিং করছে আর হাসছে। গার্লফ্রেন্ড? এই বদলোকের আবার গার্লফ্রেন্ডও আছে? সিরিয়াসলি? কোন মেয়ের এমন কপাল পুড়লো? মনে মনে এইসব ভাবতে ভাবতে রাকিবের কাছে আসলো। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকলেও শেফালীর আগমন টের পেলো রাকিব। তাই অংকুরকে ম্যাসেজ দিল, ‘টেনশন নিস না। ম্যাসেজ দিলে চলে আসিস।’
মোবাইল পকেটে রেখে শেফালীর দিকে তাকালো। শেফালী দুই হাত পিছনে নিয়ে বলল, ‘হুম! গার্লফ্রেন্ড ছিল বুঝি?’
রাকিব ত্যাড়া ভাবে উত্তর দিল, ‘তোমাকে বলবো কেন?’
শেফালী গা-ছাড়া ভাবে বললো, ‘আমার জানার ইচ্ছাও নেই। বাই দ্যা রাস্তা, জিমি কোথায়? মানে মেয়ে দেখতে এসে নিজেই উধাও!’
রাকিব জড়তাহীন গলায় বললো, ‘কে বলেছে অংকুরের জন্য মেয়ে দেখতে এসেছে?’
ভ্রুঁ যুগল কুঁচকালো শেফালী। বলল, ‘তাহলে কার জন্য দেখতে এসেছে? বুবুকে তো জিমি ভালোবাসে। তাহলে বুবুকে তো জিমিই দেখতে আসবে। সোজা হিসেব।’
অল্প শব্দে হেসে ফেলল রাকিব। ডান হাতের তর্জুনী আঙ্গুল দিয়ে ভ্রুঁ চুলকে বলল, ‘অংকুর ছাড়া অন্য কেউ দেখতে আসতে পারে না?’
শেফালী ভ্রুঁ কুঁচকে বলল, ‘আপনার জন্য দেখতে এসেছে?’
রাকিব ঘাড় নাচিয়ে বলল, ‘হতেও পারে।’
শেফালী বুঝতে না পেরে বললো, ‘কিন্তু বুবুকে তো জিমি ভালোবাসে। তাহলে আপনি কেন আসবেন?’
‘মিতালী ছাড়া বাসায় কি আর কেউ নেই? যাকে দেখতে আসতে পারি?’
শেফালী কথার প্রসঙ্গে তাল মিলিয়ে আনমনে বলে উঠলো, ‘আছে তো। যেমন আমি।’
বলেই ভ্যাবাচেকা খেলো শেফালী। প্রকাণ্ড রকমের বিস্মিত হলো সে। চোখ তার কোটর বেড়িয়ে আসার উপক্রম। তার এমন রিয়েকশন দেখে হেসে উঠলো রাকিব। চোখেমুখে হাসি রেখেই বলল, ‘আমার জীবনে এতোটাও ভয়াবহ দিন আসেনি যে তোমার মতো ধানিলঙ্কা কে দেখতে আসবো। স্টুপিড গার্ল।’
নিঃশব্দে ঠোঁটে হাসি রেখেই জুলফিকার ও অলীউর রাহমানের কাছে আসল রাকিব। শেফালী আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে রাগে ফুশতে লাগলো। এভাবে অপমান? এতো অপমান?
চলমান…#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির
[৩৭]
লম্বা চুল গুলো খোঁপা করে বেধে তাতে লাল গাজরা আটকে দিলেন আমেনা। দুই হাতে সোনালি রঙের দুই মুঠো চুড়ি পরিয়ে দিলেন। চোখে দিয়ে দিলেন গাঢ় কাজল। ঠোঁটে হালকা লাল-খয়েরি লিপস্টিক। অবশেষে শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় ঘোমটা টেনে দিলেন। আয়নায় তাকিয়ে পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টি মেলে দেখলেন বড় মেয়েকে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে তার মেয়েকে। তার বড় রাজকন্যা কে। মুচকি হেসে প্রশান্তিময় কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘মাশাআল্লাহ! মাশাআল্লাহ!’
লাজুক হাসলো মিতালী। পিছু ফিরে মা কে জড়িয়ে ধরলো একবার। আমেনা মেয়ের গালে আদুরে এক হাত রেখে বললেন, ‘সারাজীবন সুখি থাকো দোয়া করি।’
‘এহেম! এহেম! আদর শুধু বড় মেয়েকে করলেই হবে না। এখানে ছোট মেয়েও উপস্থিত আছে।’
শেফালীর কথা শুনে তার দিকে তাকালো আমেনা ও মিতালী। দুইজনই অল্প শব্দে হেসে উঠলো। আমেনা ইশারায় শেফালীকে কাছে ডাকলো। আদর নিতে শেফালী চটজলদি মায়ের কাছে চলে আসলো। অতঃপর দুই মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন আমেনা। চোখের কোণে তার জল চিকচিক করছে। মেয়ে দুটো কতো বড় হয়ে গেলো। আজ বাদে কাল দুইজন-ই নিজেদের সংসার সাজাতে শ্বশুরবাড়ি যাবে। ভাবতেই কেন যেন এখন-ই বুকে ব্যাথা হচ্ছে।
আমেনার মলিন চোখ দেখে মিতালী বুঝে গেলো মায়ের মন ভালো নেই। মায়ের চোখের কোণে জমে থাকা পানি এক হাতে মুছে বলল, ‘আম্মা? কাঁদছেন কেন? আপনি কাঁদলে ভালো লাগে না।’
এতোক্ষণে মায়ের চোখ দুটো খেয়াল করলো শেফালী। ঠোঁট উল্টালো সে। আমেনার পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে মন খারাপ করে বলল, ‘আম্মু? আজকে কতো খুশীর দিন বলো তো। ওই দিনে তুমি কাঁদবে? তোমার মন খারাপ আমাদের ভালো লাগে বলো?’
দুই মেয়েকে পাশে পেয়ে শান্তি পেলেন আমেনা। পরিতৃপ্তি হাসি দিলেন একটা।
.
রাকিব ও অংকুর পাশাপাশি বসে আছে। জুলফিকার ও অলীউর রাহমান কথায় ব্যস্ত। মাঝে মাঝে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করছে অংকুর ও রাকিবকে। দুইজন সাবলীল ভাবে উত্তর দিচ্ছে। কথার মাঝেই রাকিব টি-টেবিলের উপর থেকে পুডিং এর বাটি থেকে চা চামচ দিয়ে এক পিস পুডিংয়ের টুকরো নিয়ে মুখে দিলো। বরাবরই সে পুডিং লাভার। চুপচাপ আপন মনে পুডিং খাচ্ছে। পাশ থেকে অংকুর নিচু গলায় ফিশফিশ করে বলল, ‘কিরে? মিতালীকে এখনো দেখাচ্ছে না কেন?’
পুডিং মুখে দিয়ে অংকুরের দিকে তাকালো রাকিব। নিজেও কণ্ঠস্বর নিচু করে বলল, ‘এতোক্ষণ তো বাসায় আসছিলি না। এখন ভাবিকে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে পরছিস কেন?’
অংকুর হালকা গলা ঝেড়ে বলল, ‘তখন অনেক নার্ভাস ছিলাম।’
‘আর এখন ভাবিরে দেখার লাইগা উতলা হইয়া গেছো।’
প্রতিত্তুর করলো না অংকুর। লজ্জা পেলো কিছুটা। এতো বছর জীবনে এমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে কখনো শিকার হয়নি। চুপচাপ বসে রইলো নিরবে। দৃষ্টি তার মেঝের দিকে। কিছুসময় পর খেয়াল করলো রাকিব তার কনুই দিয়ে বারবার গা:ট্টা দিচ্ছে। বিরক্ত হলো অংকুর। সকলের অগোচরে কটমট চোখে তাকালো রাকিবের দিকে। রাকিব আলতোভাবে চোখের ইশারায় সামনে তাকাতে বললো। কথা অনুযায়ী অংকুর সামনে তাকাতেই তার চোখ আটকে গেলো তাৎক্ষনাৎ। মুগ্ধ হয়ে গেলো মিতালীকে দেখে। পার্পল কালারের শাড়িতে মেয়েটাকে ভীষণ রকমের সুন্দর লাগছে। দূর থেকেই অংকুরের চোখে চোখ পরলো মিতালীর। অংকুর কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে লজ্জাভূতি হলো মিতালী। চোখ নামিয়ে নিলো। অংকুর এখনো মুগ্ধকর চোখে তাকিয়ে রইলো মিতালীর দিকে। তখন কানের কাছে রাকিব ধীর কন্ঠে বলল,
‘এখানে আসার আগেও লজ্জা পাচ্ছিলি। সেই লজ্জা ধুয়ে কি এখন পানি খেয়ে ফেলছিস নাকি? হা করে কি দেখচ্ছিস? তোরই বউ হবে। চোখ সরা। বড়দের সামনে কিভাবে তাকিয়ে আছে।’
অংকুর থমথমে খেলো। চোখ সরিয়ে ফেললো তাৎক্ষনাৎ। নিজেকে এবার নিজেই বেহায়াদের তালিকায় ফেলে দিলো। আশ্চর্য বড়দের সামনে এভাবে তাকালো কেন? তবে যাইহোক, মেয়েটাকে আজ অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। গুলুমুলু কিউট।
মিতালী সামনে এসে সবাইকে সাবলীল ভাবে সালাম দিলো। তারপর জুলফিকারের পাশে বসে থাকা জুলেখা খাতুনের পাশে বসলো। শেফালী তার পিছনে এসে দাঁড়ালো। তার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে অনেক খুশি সে। শেফালীর হাসিমুখ দেখে স্মিতি হাসলো রাকিব।
মিতালীর হাত ধরে সুপ্তি বেগম তার পাশে বসালেন। মাথায় হাত বুলিয়ে কথা বলতে লাগলেন। কথা বলছেন অলীউর রাহমান-ও। মোটকথা অলীউর রাহমানের ভীষণ পছন্দ হয়েছে মিতালীকে। প্রসন্ন মনে একে একে এটা-সেটা বলতে লাগলেন। মিতালীও নম্রতার সাথে জবাব দিতে লাগলেন। চুপচাপ বসে রইলো অংকুর। মিতালীকে দেখতে ইচ্ছাপোষন করছে তার মন। কিন্তু বড়দের সামনে বেহায়াদের মতো তাকাতে পারছে না। কিছুসময় পর রাকিবের দিকে হালকা ঝুকে নিচু গলায় বলল, ‘ভাই, আলাদা কথা বলার ব্যবস্থা করে দে একটু।’
রাকিব নিঃশব্দে দাঁত বের করে হেসে ফেললো। সবাই হাসিটা দেখলো। তবে কেউ আমলে নিলো না। যে যার মতো অন্যদের সাথে কথা বলতে লাগলো। রাকিবকে এভাবে হাসতে দেখে অংকুর আরো অস্বস্তিতে পরে গেলো। রাকিব হাসি থামালো। কিন্তু ভিতরে ভিতরে হাসি থামছে না তার। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে এক হাত মুখের সামনে এনে ফিশফিশ করে বলল, ‘বেহায়া দেখেছি। কিন্তু তোর মতো লিমিট ছাড়া বেহায়া আজ প্রথম দেখলাম।’
অংকুর নিচু গলায় দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘সুযোগ বুঝে লুটে নিচ্ছিস? এই দিন তোরও আসবে। তখন দেখিস কেমন লাগে।’
‘তোর মতো এতো বেহায়াগিরি করতাম না দেখিস।’
‘তখন বউ সামনে পাইলে বেহায়া কারে কয় ভুইল্লা যাইবা। দেইখা নিও।’
তাদের ফিশফিশ করে কথা বলা খেয়াল করলো শেফালী। দুজনের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, ‘এতো ফিশফিশ করে কি কথা বলছেন দুইজন? একটু জোড়ে বলেন আমরাও শুনি।’
অন্যরা মিতালীকে নিয়ে ব্যস্ত। আশেপাশের তাদের কথা শুনলেও বেশি আমলে নিচ্ছে না কেউ। রাকিব শেফালীর কথার প্রতিত্তুরে বলল, ‘খুকি, বড়দের কথায় কান দিতে নেই। সব কথা শুনানো যায় না।’
দাঁতে দাঁত পিষলো শেফালী। চোখমুখ শক্ত করে তাকিয়ে রইলো রাকিবের দিকে।
অংকুর মিতালীর দিকে আবারো তাকালো। মেয়েটা কতো সুন্দর মুচকি হেসে হেসে কথা বলছে সবার সাথে। কতো কিউট লাগছে তুলতুলকে। অথচ তার বেলা? তার সাথে মরিচের থেকেও বেশি ঝাল দেখায়। আমার সাথেও তো একটু মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে পারে নাকি?
.
আলাপের এক পর্যায়ে সুপ্তি বলে উঠলেন, ‘যদি কিছু মনে না করেন। তাহলে ছেলে-মেয়ে দুজন আলাদা ভাবে কথা বলুক। এই ফাঁকে আমরা জরুরি আলাপ শেষ করি।’
জুলেখা খাতুন তো বেশ খুশি। তার থেকেও বেশি খুশি তখন হয়েছেন যখন শুনলেন মিতালীকে অংকুর ভালোবাসে। অংকুরকে দেখেও তার পছন্দ হয়েছে। অংকুরের পরিবারের লোকদেরও ভীষণ পছন্দ হয়েছে তার। তিনি মনে প্রাণে চাইছেন নাতনী টা যেন সুখি হয়। সুপ্তি বেগম বলার পর পরই নিজেই সম্মতি দিলেন, ‘হু যাক না। সমস্যা নাই। এই শেফালী? ওদের ছাদে লইয়া যা তো। ছাদে দিয়া আইসা পরিছ। যা যা।’
শেফালী টুল পরা গালের হাসি দিলো একটা। হাসি টা মারাক্তক সুন্দর। এই হাসিতে রাকিব আবারো মুগ্ধ হলো। চোখ সরালো না। শেফালী বলল, ‘জিমি? বুবু? আমার সাথে আসো।’
মিতালী আড়ষ্ট চোখে মায়ের দিকে তাকালো। আমেনা ইশারায় বললেন যেতে। অতঃপর অংকুর ও মিতালী উঠে দাঁড়াল। শেফালীর পিছু পিছু ছাদে আসলো দুজন। শেফালী ছাদের দরজা থেকেই বিদায় নিলো। বলল, ‘এবার নিশ্চিন্তে প্রেম করো। ওই দিকে বিয়ে ফাইনাল হোক।’
চলে গেলো শেফালী। অংকুর আশেপাশে তাকিয়ে পুরো ছাদটা প্রখর করলো। ছাদের এক পাশে মাত্র কয়েকটা ফুলের টব। বাকিটা একদম খালি। অথচ তার বাড়ির ছাদে তার মায়ের বাগানের জন্য দাঁড়ানোর জায়গার অভাব। মিতালীর দিকে তাকালে দেখলো একপাশে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অংকুর স্বাভাবিক ভাবে বললো, ‘রেলিং’এর পাশে আসো।’
বলে হেঁটে গেলো সেখানে। মিতালী মৌনতার সাথে অংকুরের পিছু পিছু ছাদের রেলিং’এর কার্নিশে গেলো।
.
পরিবেশটা থমথমে। নিরবতা ভাস্যমান সবার মাঝে। কারোর মুখে আপাতত কোনো কথা নেই। সবাই নিরব। ড্রয়িংরুমের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে শেফালী। নিরব দর্শকের মতো এক এক করে উপস্থিত সকলের দিকে তাকাচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে মনে মনে দোয়া করছে যেন কোনো ঝামেলা না হয়। সব কিছু যেন ঠিক হয়ে যায়।
জুলফিকার নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন। কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না তিনি। তার ঠিক বিপরীত পাশের সোফায় বসে আছেন অংকুরের বাবা অলীউর রহমান। চেহারায় তার বয়সের ছাপ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গায়ের চামড়া কুঁচকে গেছে। শ্যামবর্ণ গায়ের রঙ। অলীউর রহমানের দুই পাশে বসে আছে সুপ্তি ও রাকিব। দুইজনের মুখেই চিন্তার ছাপ। জুলফিকার কে নিশ্চুপ দেখে ভয়ার্ত আছে তারা। এখন যদি সরাসরি না করে দেয়, তাহলে এর থেকে বড় অপমান আর কিছুই হবে না। ফুঁশ করে নিঃশব্দে একটা নিশ্বাস ছুঁড়লো রাকিব। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে উঠলো, ‘ওই দিন চাচির ব্যবহারের জন্য আমি আবারো ক্ষমা চাইছি আপনার কাছে। প্লিজ এখনো রাগ করে বসে থাকবেন না।’
এতোক্ষণে অলীউর রহমান গম্ভীর মুখে বললেন, ‘দেখুন মিঃ জুলফিকার! ওইদিনের ঘটনার সম্পর্কে আমি জানি না। আপাতত যতোটুকু আন্তাজ করতে পেরেছি, বুঝার জন্য ততোটুকুই যথেষ্ট ছিলো। আমি আমার স্ত্রীর ব্যবহারের কারণে লজ্জিত। সামান্য ঘটনা কেন্দ্র করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত না। ছেলে মেয়ে দুজন যেহেতু একে অপরকে পছন্দ করে তাহলে আমাদের বারণ করা তাদের প্রতি অবিচার হবে। তারা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেদের নেওয়ার অধিকার রাখে। সেখানে আমাদের কিছু বলার নেই। তাদের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া উচিত।’
আলতো করে মাথা ঝুকালেন জুলফিকার। বললেন, ‘আমি আমার মেয়ে কে সব থেকে বেশি ভালোবাসি। ওর খুশি আমার কাছে সবকিছু। মিতালী যেহেতু রাজি তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই। অংকুর ছেলে হিসেবে ভালো। আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। কিন্তু সমস্যা ঠেকছে এক জায়গায়। যেখানে আমার মেয়ের কদর করা হবে না, সেখানে আমি আমার মেয়েকে কিছুতেই দিবো না।’
তাদের কথোপকথনের পুরোটা সময় সুপ্তি বেগম চুপচাপ ছিলেন। জুলফিকারের শেষ কথাটার প্রতিত্তুরে বলে উঠলেন, ‘বেয়াই সাহেব, আমার কোনো মেয়ে নেই। আমি আপনার কাছে পুত্রবধূ না, বরং একটা মেয়ে চাই। যে সবসময় আমার পাশে থাকবে। আমার সংসারটাকে আগলে রাখবে। আপনার মেয়েকে আমি আমার নিজের মেয়ের মতোই দেখবো। কখনো তার অসম্মান করা হবে না।’
‘ঠিক আছে। তাহলে আর কি করার। মেয়ে যখন চাইছেন তখন নাহয় দিয়ে দিলাম। এবার যত্নে রাখার দায়িত্ব আপনার।’
চকচকিয়ে থাকালো শেফালী। সাথে রাকিবও। অবাক হয়ে দুজন একে অপরের দিকে তাকালো একবার। মুহূর্তেই দুজনের মুখে খুশির ঝিলিক ফুটে উঠলো। পরিবারের অন্যরাও মহা খুশি হলেন। সব থেকে বেশি উল্লাসিত হলো শেফালী। ‘ইয়েএএ’ বলে চেঁচিয়ে লাফিয়ে উঠলো একপ্রকার। দৌড়ে এসে জুলফিকারের পাশে বসে জড়িয়ে ধরলো। শেফালীকে এমন প্রফুল্লিত হয়ে নাচতে দেখে বাকি সবাই-ই হেসে উঠলো। জুলফিকার ও অলীউর রাহমান একে অপরকে মিষ্টি খাইয়ে দিলেন। সুপ্তি, আমেনা ও জুলেখা পাশাপাশি বসে আলাপে মশগুল হলেন।
রাকিব পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টি মেলে দেখলো শেফালীকে। পরনে লাল জর্জেট চুড়িদার জামা।ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। কুঁকড়ানো চুল গুলো খোলা। অসম্ভব সুন্দর লাগছে শেফালীকে। পরিবারের অন্যরা উপস্থিত তাই চোখ সরিয়ে নিলো।
অংকুরের বাবা অলীউর রাহমান শেফালীর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘অংকুর আর মিতালীকে নিয়ে আসো যাও। আংটি বদল করিয়ে ফেলি। শুভ কাজে বেশি দেড়ি করতে নেই।’
গালে টুল পরা মিষ্টি একটা হাসি দিলো শেফালী। নিঃশব্দে সম্মতি দিয়ে উঠে দাঁড়ালো ছাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। উত্তেজনায় দ্রুত পা চালালো শেফালী।#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির
[৩৮]
স্নিগ্ধ বিকেলের হাওয়া। চারপাশ একদম কোলাহলমুক্ত। সূর্যের তীর্যক রশ্মি এখন কোমলায়ন। আকাশটা স্বচ্ছ। থেমে থেমে সাদা মেঘ ভাসছে। মৃদু বাতাসে মিতালীর খোঁপা করা চুল থেকে বেড়িয়ে আসা ছোট ছোট অবাধ্য চুল গুলো উড়ছে। পার্পল কালারের শাড়ি পরে আছে সে। দুই হাত ভর্তি রেশমি চুড়ি। হালকা মেকআপে মায়াবিনী লাগছে একদম। এ যেন কোনো অপরূপ আবেদনময়ী। চোখ সরানো সাধ্য নেই অংকুরের। যতোই দেখে ততোই মুগ্ধ হয় সে। পকেটে দুই হাত গুঁজে রেলিং’এ হেলান দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে দেখছে তার ‘ তুলতুল ‘ কে। মিতালীর লাজুক হাসি দেখে অংকুর বলে উঠলো,
‘শহরে ফুটেছে যে ফুলগুলো, তারা কি জানে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ফুল আমার প্রেমিকা?’
লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিলো মিতালী। জড়সড়ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। তার লজ্জা লাগছে ভীষণ। অংকুরের দিকে তাকানোর মতো সাহস হচ্ছে না। বাঁচাল প্রকৃতির লোকটা হঠাৎ এতো বেহায়া হয়ে গেলো কেন? সেই কখন থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কি পায় এতো দেখে? এইসব ভাবলে আশ্চর্য হয় মিতালী। লজ্জাভূতি হয় প্রবল। কাজল কালো আঁখি যুগল তুলে অন্য দিকে তাকালো। লজ্জা মিশ্রিত মুখখানি রক্তিম বর্ণ ধারণ করে আছে। হঠাৎ অংকুরের গানের কন্ঠ ভেসে আসলো কানে। কাজল কালো আঁখি যুগল তুলে অংকুরের দিকে তাকালো মিতালী। অংকুর তারই দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে গাইতে লাগলো।
‘আমি তোমার মাঝে হারিয়ে
মেঘেদের ভাজে লুকিয়ে
জানালার ফাঁকে তাকিয়ে
শুধু দেখি তোমায়।
আমি নিজের মাঝে হারিয়ে
ভেসে থাকা গাঙচিল হয়ে
উড়ো সেই হাওয়ায় ভেসে
শুধুই খুঁজি তোমায়।
আমি হয়তো ভোরের আকাশ
তোমার শিহরণে পাই সুভাশ
আমি হয়তো কোনো বদ্ধ দুপুরের শালিক
আমি রাতের আকাশের তারাময় ঝিলিক।
.
দ্রুত পায়ের কদম ফেলে ছাদে আসলো শেফালী। পুরো ছাদে চোখ বুলালো একবার। দূরে দ্বারপ্রান্তে রেলিং’এর কাছে অংকুর মিতালীকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসলো। চুপচাপ এগিয়ে এসে দুজনের সামনে দাঁড়ালো। শেফালীকে দেখে মিতালী জিজ্ঞেস করলো, ‘কিছু বলবি?’
এক হাত মুঠ করে মুখের সামনে এনে গলা ঝাড়লো শেফালী। তারপর বললো, ‘তোমাদের মাঝে কাবারের হাড্ডি হতে আসি নি। অনেক তো হয়েছে। এবার প্রেম করা বন্ধ করে নিচে আসো। সবাই অপেক্ষা করছে।’
শেফালীর কথা শুনে চোখ পাকিয়ে তাকালো মিতালী। শেফালী পাত্তা দিলো না। গালে টুল পরা হাসি দিয়ে ইশারায় নিচে আসতে বলে চলে গেলো। আলতো শব্দে হেসে উঠলো অংকুর। মিতালীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘তোমরা দুই বোন একদম আলাদা।’
মিতালী মুচকি হেসে বললো, ‘হ্যাঁ। শেফালী সবসময় চঞ্চল প্রকৃতির।’
রেলিং’এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মিতালী। অংকুর এগিয়ে মিতালীর দিকে একটু ঝুকে দাঁড়ালো। হকচকিয়ে গেলো মিতালী। বিস্মিত চোখে তাকালো অংকুরের চোখের দিকে। প্রগাঢ় এই চাহনী। চোখ সরালো না সে। অংকুর স্মিতি হাসলো। মিতালীর চোখে চোখ রেখেই বলল, ‘আর আমার মিলিটা একদম শান্ত স্বাভাবের। যার নাকের ডগাতে রাগ বেশি।’
চোখ সরিয়ে নিলো মিতালী। অন্য দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি দিলো একটা। গাল দুটো লাল হয়ে এলো। মৃদু হাসলো অংকুর। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উড়ন্ত চুল গুলো ঠিক করে বললো, ‘নিচে আসো। সবাই অপেক্ষা করছে।’
বলেই ছাদের দরজার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। মিতালী শাড়ির কুঁচি গুলো ধরে অংকুরের পিছু হাঁটতে লাগলো। পাশাপাশি দুজন। একজন আরেকজনের এক কদম আগে পিছে। মুহূর্তটা মিতালীর কাছে মোহিনীয়। আগে কখনো এমন অনুভূতি হয়নি। আজই নতুন অনুভূতির স্বীকার হলো সে।
বাসায় আসার পর অংকুর ও মিতালীকে পাশাপাশি বসানো হলো। সুপ্তি বেগম তার ভ্যানিটিব্যাগ থেকে দুটো রিং বের করে দুজনের হাতে দিলো। শেফালী ক্যামেরা নিয়ে প্রস্তুত ছবি তুলার জন্য। আংটি বদলের জন্য সবাই বললো। অংকুর নিশ্চুপ থেকে ঠোঁটে হাসি রেখে মিতালীর বাম হাতটা ধরলো। অনামিকা আঙ্গুলে আংটি পরিয়ে দিলো। মিতালীও অংকুরের আঙ্গুলে আংটি পরিয়ে দিলো। খুশি হলো সবাই। একে অপরের মুখে আবারো মিষ্টি তুলে দিলো।
অনেক গুলো ছবি তুলেছে শেফালী। এবার নিজের তুলার পালা। কিন্তু ক্যামেরা কাকে দিবে? অন্যরা ভালো ছবি তুলতে পারবে না। তাই এগিয়ে এসে রাকিবের হাতে ক্যামেরা দিয়ে বলল, ‘ছবি তুলে দেন প্লিজ।’
অংকুর ও মিতালীর পাশে বসে বিভিন্ন এঙ্গেলে ছবি তুললো শেফালী। তারপর উঠে এক এক করে সবাইকে এনে দাঁড়ালো। অবশেষে ক্যামেরাটা স্ট্যান্ডের মাঝে রেখে দুই ফ্যামিলি মিলে ফ্যামিলি ফটো তুললো। ফ্রেমে বন্ধি হলো এক নতুন মুহূর্ত। যা পরবর্তিতে স্মৃতি হয়ে থাকবে।
.
সাঁঝবেলার শুরু। কিছুসময় পর মাগরিবের আজান পরবে। চারপাশ হালকা অন্ধকারাবৃত হচ্ছে। পাখির কোলাহল জানান দিচ্ছে তারা তাদের গন্তব্যস্থলে ফিরেছে। মৃদু শীতল বাতাস প্রভাহমান। মনে অদ্ভুত রকমের ভালো লাগা কাজ করছে। অংকুরের পরিবার কিছুসময় আগে চলে গেছে। বিয়ে পাকা হলো। এইতো, আর মাত্র দশ দিন পর। মাত্র দশ দিন পর সে অংকুরের বৈধ স্ত্রী হবে। অংকুরের অর্ধাঙ্গিনী হবে। ভেবেই লাজুকলতা ভর করছে মনে। আয়নার সামনে বসে গা থেকে অলঙ্কার খুলছে মিতালী। আর মুচকি মুচকি লাজুক হাসছে। প্রথমে গলার হার খুললো। তারপর কানের দুল। অবশেষে চুড়ি। ডান হাতের চুড়ি খুলে বাম হাতের চুড়ি খুলতে গিয়ে অনামিকা আঙ্কুলে আংটিটা চোখে পরলো। মনে পরলো বিকেলের সময়টার কথা। মনে পরলো অংকুরের সাথে ছাদে কাটানো মুহূর্ত গুলো। অংকুরের প্রগাঢ় চাহনী, গাওয়া সেই গানটি। মিতালীকে লাজুক হাসতে দেখে অংকুরের বলা কথাটি।
‘শহরে ফুটেছে যে ফুলগুলো, তারা কি জানে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ফুল আমার প্রেমিকা?’
ভেবেই আনমনে হেসে উঠলো মিতালী। হাতের চুড়ি খোলা শেষে খোঁপার গাজরাটা খুলে রাখলো। তারপর কাভার্ড থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে গেলো শাড়ি বদলাতে।
.
.
বিয়ে ঠিক হওয়ায় যেন জুলেখা বেগম আরো ব্যস্ত হয়ে পরলেন। মিতালীকে বিভিন্ন নিয়ম কানুন জানাচ্ছেন। তার মধ্যে একটি হলো বিয়ের আগে বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষেধ। নাহলে অমঙ্গল হয়। বিপদ আসে। দাদীর কড়া নিষেজ্ঞা ভাঙ্গেনি মিতালী। বাধ্য মেয়ের মতো মেনে নিয়েছে। সেই সুবাধে ইদানীংকাল বাসা থেকে বের হচ্ছে না।
অন্যদিকে আকুলপাকুল হয়ে আছে অংকুরের মন। তার মাঝে অস্থিরতার শেষ নেই যেন। আংটি বদলের পর থেকে আজ পাঁচ দিন হলো মিতালীর সাথে তার দেখা হচ্ছে না। অলীউর রাহমান বাসায় থাকার কারণে রাতে মিতালীদের বাসার নিচেও আসতে পারছে না। কি এক মুসিবত! মিতালীকে হাজার বার বলেও বাহিরে আনতে সক্ষম হয়নি অংকুর। মেয়েটার উপর ভীষণ রাগ হয়েছে তার। অভিমান জমেছে প্রচুর। এতো দিন না দেখে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না। সেটা কি মিতালী বুঝার চেষ্টা করে না? একবার সবার চোখের আড়াল হয়ে দেখা করতে আসলে সমস্যা কোথায়? মেয়েটা পচন্ড ভীতু। তবে বড্ড কিউট। আর সহ্য হচ্ছে না। কোনো না কোনো উপায়ে দেখা করতেই হবে। মনে মনে ফন্দি আটলো অংকুর। কি করবে ভেবে পেলো না। উপায় না পেয়ে রাকিবের কাছে আসলো। সন্ধ্যা হয়েছে কেবল। মাগরিবের নামাজের শেষে রাকিব অফিসিয়াল কাজে বসেছে। তখুনি অংকুরের আগমন তার রুমে। তার এমন উষ্কখুষ্ক চেহারা দেখে রাকিব বলে উঠলো,
‘কিরে? চেহারা এমন হাবলার মতো করে রেখেছিস কেন?’
এক হাতে মাথা চুলকালো অংকুর। এগিয়ে এসে রাকিবের সামনে বিছানায় বসলো। সরাসরি বলতে বিব্রতভাব আসছে তার মাঝে। আমতা আমতা করতে লাগলো। ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থাকলেও ব্যাপারটা খেয়াল করলো রাকিব। সিরিয়াস কিছু ভেবে ল্যাপটপ বন্ধ করলো। বিছানার হেডসাইডে হেলান দিয়ে বুকে দুই হাত গুঁজে স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে?’
‘ছোট একটা সাহায্য চাই।’
ভ্রুঁ জোড়া আপনা-আপনি কুঁচকে এলো রাকিবের। জিভ দিয়ে উষ্ঠধয় ভিজিয়ে জানতে চাইলো, ‘কি সাহায্য?’
অংকুর ইতস্ততবোধ করে বলেই ফেললো, ‘মিতালীর সাথে এখনো দেখা হয়নি। ওর দ’জ্জা’ল দাদী ওকে বাহিরে বের হতে দিচ্ছে না। এখন এমন একটা উপায় বের কর যেন অনায়াসে মিতালীর সাথে দেখা হয়।’
রাকিব কিছুক্ষণ গম্ভীর চোখেমুখে অংকুরের দিকে তাকিয়ে ছিলো। অতঃপর হাসি দমাতে না পেরে হুহা করে উচ্চ শব্দে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বিছানায় শুয়ে পরলো প্রায়। একদম গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা তার। বিরক্ত হলো অংকুর। পাগল নাকি? এভাবে হাসার কি আছে? সে তো আর অন্যের বউ কে দেখতে চাচ্ছে না। তারই হবুবউ কে দেখতে চাইছে। ‘ননসেন্স!’ বিড়বিড় করে বললো অংকুর।
রাকিব হাসিতে চোখমুখ খিঁচে রেখে বলে উঠলো, ‘ভাই! কয়দিন পর তো বিয়েই হবে। তখন তো মন ভরে দেখতে পারবি। এখন এতো উতলা হচ্ছিস কেন?’
রাকিবের হাসিটা এই মুহূর্তে পছন্দ হলো না অংকুরের। কাটা গায়ে নুনের ছিটেফোঁটা পরলো। তাই কপাট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘ফাজলামি করবি না। উপায় থাকলে বল নাহয় গেলাম।’
‘আরে আরে রাগ করতেছিস কেন? বলছি শোন।’
অংকুরের বিরক্তিকর ভাব গেলো। স্বাভাবিক চেহারায় আগ্রহাতিশয় হয়ে তাকালো রাকিবের দিকে। রাকিব বলল, ‘কাল তো বিয়ের শপিং এর জন্য যাচ্ছিস। কাল দেখা হয়েই যাবে।’
বিস্মিত হলো অংকুর। অবাক কন্ঠে বলে উঠলো, ‘কাল শপিং? অথচ আমি জানি না?’
‘হুম। দুপুরে খাবারের টেবিলে না কাকা বললো? কোন দুনিয়াতে ছিলি তখন?’
দ্বিধাগ্রস্ত হলো অংকুর। মাথা চুলকে বলল, ‘বাহ্, যার বিয়ে তার-ই হুশ নাই।’
রাকিব কণ্ঠ স্বর কূটস্থ করে বলল, ‘থাকবো কেমনে? সারাদিন বউ বউ করলে হুশ জ্ঞান থাকে? এখুনি এই অবস্থা। বিয়া হইলে কি হইবো তা আল্লাহ-ই ভালো জানে।’
পাত্তা দিলো না অংকুর। কন্ঠ মলিন করে বলল, ‘কাল তো পরিবারের সবাই থাকবে তাই না? আলাদা ভাবে কথা বলার সুযোগ থাকবে না তাহলে।’
রাকিব গা ছাড়া ভাব নিলো। ল্যাপটপ কোলের উপর বসিয়ে ওপেন করে বলল, ‘আসার সময় মিতালীকে তুই নিয়ে আসিস। তখন আলাদা রাস্তা দিয়ে চলে যাবি। সহজেই অনেকক্ষণ এক সাথে থাকতে পারবি।’
রাকিবের দিকে চকচকিয়ে তাকালো অংকুর। খুশিতে গদগদ হয়ে গেলো প্রায়। এগিয়ে এসে রাকিবকে জড়িয়ে ধরলো। হকচকিয়ে গেলো রাকিব। তড়িঘড়ি করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। অংকুরকে দূর দূর করে বলল, ‘দূরে সর লু’ই’চ্চা। বিয়ের পর বউরে জড়াইয়া ধরিস।’
শব্দ করে হেসে উঠলো অংকুর। হাসতে হাসতে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে।
চলমান…