#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ১৫
দুপুরের রোদে ছাদ টাকে ধূ-ধূ মরুভূমি মনে হতো। যদি সেখানে যত্ন করে আগলে রাখা সাদা গোলাপের বাগানটা না থাকতো। রোদের তেজে বাইরে তাকানো যাচ্ছে না। তীব্র আলো ঝলসে দিতে চাইছে চোখ গুলো। তপা বিছানায় বসে হাত দিয়ে ওড়নায় গিট বাঁধছে আবার খুলছে। যেন তার সমস্ত মনোযোগ এখন এই ওড়নাতেই সীমাবদ্ধ। পলক এত নীরবতায় বিরক্ত হলো। কি এমন বলবে যার জন্য এত হেজিটেশন।
সিজান গলা খাঁকারি দিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইল। সফলও হলো। সকলের উৎসুক দৃষ্টি নিপতিত হলো তারই উপর। এক পা দুপা করে এগিয়ে গেল তপার সম্মুখে। তপা তখনও নির্বিকার। সিজান নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে তপার মুখশ্রীতে।
“আমি জানি আমি অপরাধী। কিন্তু আমার শেষ কয়েকটা কথা শুনবি বোন? ফাঁসির আসামীকেও শেষ ইচ্ছের কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু আমি তো গত কয়েকটা বছর ধরে অনবরত, বিরামহীন ভাবে ফাঁসির দড়িতে ঝুলছি। আমার কি মুক্তি হবে না কখনো?”
তপা মুখ তুলে তাকাল সিজানের দিকে। সিজানের মুখটা বড্ড মলিন দেখাচ্ছে। তপার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। বাকি কথাগুলো শোনায় জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে রইল সে।
সিজান আবারও বলল,
“সেদিন তোকে এলোমেলো অবস্থায় প্রান্ত ভাইয়ের সাথে দেখে আমি তোদের খারাপ খারাপ কথা বলেছি। মায়ের কাছে বলেছি তোদের মধ্যে নিষিদ্ধ সম্পর্ক আছে। আমি কিন্তু মায়ের কানে আগে তুলিনি এই কথাটা। সেই পশুটাই মায়ের কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে এক ঝুড়ি মিথ্যে বলেছে। নিজের অপরাধ চাপিয়ে দিয়েছে অন্যের ঘাড়ে। আমি শুধু ওদের কথায় তাল দিয়েছি। সেদিন তোদের বিরুদ্ধে বলা কথাগুলো শুধু আমি বলার জন্য বলেছি। মন থেকে বলিনি। আমি জানি তোদের পবিত্র সম্পর্কের কথা। প্রান্ত ভাই তোকে পৃথার মত করেই ভালবাসে সেটাও আমি জানি, বুঝতে পারি। আমি যখন বাড়িতে ফিরি তখন তুই প্রান্ত ভাইয়ের বুকে হাউমাউ করে কাঁদছিলি। আমি জানি সেই কান্নার কারন। কিন্তু তুই জানতি না তোর অগোচরে, বাবার অগোচরে এক কুৎসিত, বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ আমার মায়ের ব্রেন ওয়াশ করে রেখেছিল। হ্যা দোষ আমার মায়েরও আছে। সে কেবল একতরফা বিশ্বাস করে তোর ছোট বেলাটা বিষিয়ে দিয়েছে। সে চাইলেই পারতো তোকে মেয়ের মত বুকে আগলে রাখতে। কিন্তু সে করেনি। সে তো তার নিজের রক্তকেই কেবল আপন মনে করেছে। বাকি সবাই ভুয়া, মিথ্যেবাদী, অপয়া। মা তো তোকে ভাল বাসেনি। বরং তোকে ভালবেসে আগলে রাখার অপরাধে আমাকে বাড়ি ছাড়া করার পায়তারা করছিল।”
তপা চমকে তাকাল। সাথে তাকাল পৃথাও।
“সেদিন এমনি এমনি আমি মিথ্যেগুলো বলিনি রে। আমি যদি মিথ্যে বলে তোর মনে আমার জন্য ঘৃণা না জন্মাতাম তাহলে তুই আমার আগে বাড়ি ছাড়তি? ছাড়তি না আমি জানি। তোকে আমি সেই জন্ম থেকে চিনি। মরে গেলেও বাড়ি থেকে বের হতি না তুই। তাই তো সেদিন মিথ্যে বলেছি। কালি লাগিয়েছি তোর চরিত্রে। কলঙ্কিত করেছি তোদের পবিত্র ভাইবোনের সম্পর্ককে। ঝলসে দিয়েছি আমার প্রতি থাকা তোর বিশ্বাস আর ভালবাসাকে।আমার আর উপায় ছিল না রে। মা আমাকে বাড়ির বাড় করলো। কারণ বাড়িতে থেকে নাকি লেখাপড়া হয় না, হচ্ছিল না। আসল কারণ তো তার আদরের রক্ত ছিল। তার কথাতেই এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যেখানে বাবার আপত্তিও শোনেনি।আমি বাড়ি থেকে বের হলে তোকে কে রক্ষা করতো বল? কে বাঁচাতো তোকে ওই নোংরা স্পর্শ থেকে। তুই বড় হলেও নিজেকে বাঁচাতে পারতি না। যে দিনের বেলাতেই কেউ না থাকার সুযোগে এত জঘন্য কাজ করার সাহস পায় সে রাতের আধারে কতটা ভয়ানক হতে পারে সেটা তোর থেকে কেউ ভালো জানে না। বাবা নিজের কাজ সামলে তোকে কি করে আগলে রাখতো? মাঝে মাঝেই তো বাড়ির বাইরে থাকতে হতো বাবাকে। সেদিন? সেদিন কি হতো বোন? আমি কি বাড়ি ফিরে তোর জ্যান্ত লাশ দেখতাম? নাকি মৃত লাশ? তাই তো সেদিন জীবনের সবচেয়ে নোংরা কাজটা করেছিলাম। মিথ্যে বলেছিলাম। কলঙ্কে ঝলসে দিয়েছিলাম তোকে। কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম। তখন এর বাইরে অন্য কিছু আসেনি আমার ছোট্ট মস্তিষ্কে। তুই চলে আসার পরের দিনই আমি চলে এসেছি বাড়ি ছেড়ে। আর কোনো পিছুটান ছিল না ওই বাড়ির প্রতি। তাই তো বছরেও ফিরতাম না একবারও। কিন্তু আমি তখন বুঝতে পারি নি ভালো করতে গিয়ে আমি আমার ছোট্ট বোনটাকে একেবারে হারিয়ে ফেলব।পারলে মাফ করে দিস আমাকে। আর যদি না পারিস তবে পাপের বোঝা মাথায় নিয়েই ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে আমাকে। আমি মরে গেলেও ওই বাড়িতে তুই আর যাস না বোন। ওই নরক থেকে একবার বেরিয়েছিস। আর ওই যন্ত্রণা পোহাতে যাস না তুই। যদি পারিস প্রান্ত ভাইকে বলিস আমায় মাফ করতে। চলো বাবা।”
বলেই দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মোর্শেদুল হক তপার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“আসি রে মা। সাবধানে থাকিস। নিজের যত্ন নিস। পৃথা মা তপার খেয়াল রাখিস।”
তপা কাঁপা গলায় বলল,
“মামা। ভাই?”
মোর্শেদুল হক মুচকি হেসে বললেন,
“নিজেই ডাক। দেখ হয়তো কাঁদছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।”
তপা বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। পলক দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে একহাতে বাহু ধরে আগলে নিল। মোর্শেদুল হক তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে তুললেন মুখে। মনে মনে বললেন,
“মেয়েটা এবার ভাল থাকবে। আল্লাহ ভাল রেখ ওকে।”
তপা কে ধরে ধরে সিজানের কাছে নিয়ে গেল পলক। সিজান তখনও উল্টো দিকে ফিরে আছে। তপা কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকল,
“ভাই।”
সিজান থমকে গেছে এতগুলো দিন পর তপার মুখে ভাই ডাক শুনে। ছোট ছোট হাতে সিজানের হাত আঁকড়ে যখন ভাই বলে ডাকতো তখন মনে হতো জীবনটা বুঝি সার্থক। এতগুলো দিন এই ডাকটা থেকে বঞ্চিত ছিল। তপা এক বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,
“ভাই। তাকা না আমার দিকে।”
সিজান ঘুরে দাঁড়াল। কাঁপা হাতে তপার গাল স্পর্শ করে বলল,
“আমায় মাফ করে দে বোন। আমি তোর ভালো করতে গিয়ে অনেক বেশি আঘাত করে ফেলেছি। আমি চাইনি তোকে এভাবে কাঁদাতে। কিন্তু আমার আর উপায় ছিল না বিশ্বাস কর। সেদিন ওই মিথ্যেগুলো না বললে তুই আমাদের ছেড়ে চলে যেতি?”
তপা মাথা নাড়ালো। সে যেত না। সত্যি যেত না।পুরো পৃথিবী তপা কে নোংরা বললেও তপা যেত না।যদি মামা আর সিজান দুজনের মধ্যে কেউ নোংরা না বলতো।
সিজান এবারে তপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“তোকে বাড়ি থেকে না সরালে আজ হয়তো তুই এভাবে আমার সামনে থাকতিই না। বেঁচে থাকলেও হয়তো জ্যান্ত লাশ হয়ে থাকতি। তোকে না সরালে আমিও যেতে পারতাম না। কিন্তু যেতে তো আমাকে হতোই। মায়ের মাথার দিব্যি ছিল যে। জানি এসব কুসংস্কার। কিন্তু মা যে বিশ্বাস করে। মায়ের অবাধ্য হলে মা তোর উপর আরও চড়াও হতো। তোর জীবনটা আরও নরক করে দিত। তাই তোকেই কষ্ট দিলাম। আমি সত্যি অনুতপ্ত। আমাকে মাফ করিস বোন। নয়তো মরেও শান্তি পাব না।”
তপা মৃদু স্বরে বলল,
“আমি কি তোকে জড়িয়ে ধরবো ভাই?”
সিজান চোখে জল মুখে হাসি নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। তপা বিনা দ্বিধায় আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
পেছনে দাঁড়িয়ে নীরব অশ্রু বিসর্জন দিল পৃথাও। মোর্শেদুল হক পৃথার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“সব ঠিক হয়ে যাবে মা। হয়তো হয়েও গেছে। কাঁদিস না আর। আমার বোকা ছেলেটা বোনের ভালো করতে গিয়ে সবদিক ভুলে গিয়েছিল। এবার সব আগের মত হয়ে যাবে।”
কয়েক বছর আগের কথা।
তপা তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী। সবে টেস্ট পরীক্ষা হয়েছে। রেজাল্ট তখনও বের হয় নি। তপা সেদিন যথারীতি স্কুলে গিয়েছিল। সিজান, সিজানের বাবা, মা কাছাকাছিই একটা দাওয়াতে গিয়েছিল। তপার স্কুল ছুটির সময় ছিল বিকাল চারটা। সেদিন কোনো কারন বশত একটার মধ্যেই ছুটি হয়ে যায়। তপা বাড়ি ফিরে কাউকে দেখতে না পেয়ে নিজের জন্য বরাদ্দ ঝুপড়ি ঘরে প্রবেশ করে। কিন্তু সে জানতো না তার বিছানায় বসে দানবটা তারই ব্যবহার করা জামা কাপড় নিয়ে খেলছিল । বিশ্রী এক খেলা। বিকৃত মস্তিষ্কের দানবটা তপাকে দেখতেই ঠোঁটে বিকৃত হাসি ফুটিয়ে তুলল। তপা চকিত ভঙ্গিতে তাকাল বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা তার জামাগুলোর দিকে। একটা জামা দানবটা হাতে নিয়ে নাকে ছোঁয়ালো। নাক টেনে নিশ্বাসের সঙ্গে ভেতরে নেওয়ার চেষ্টা করল জামায় জড়ানো তপার শরীরের ঘ্রাণ। তপা যেন নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছে। পা দু’টো অবশ হয়ে গেছে। তপার মস্তিষ্ক বলছে তপা পালা। নইলে আজ আর বাঁচতে পারবি না। কিন্তু পা দু’টো তাতে সায় দিচ্ছে না। নড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তপার মনে হলো পাতাল দেশ থেকে কেউ হয়তো টেনে ধরেছে তার পা দু’টো। নড়ার শক্তি না পেয়ে ভয়ার্ত চোখে তাকাল সামনের দানবের দিকে। দানবটা তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তপা কে গিলতে শুরু করে দিয়েছে। পা থেকে মাথা অবধি নোংরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বাম হাতে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে হাসল ভয়ংকর মানুষ রূপী দানবটা।
তপা শরীরের সাথে যুদ্ধ করে পিছিয়ে গেল। কিন্তু দরজা ঠেলে বাইরে বের হওয়ার আগেই দানবীয় হাতটা তাকে আঁকড়ে ধরল। তপা ছটফটিয়ে উঠল। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে নিজেকে ছাড়াতে চাইছে তপা। কিন্তু ছোট্ট একটা প্রাণ কি পারে দানবের থেকে মুক্তি পেতে?
উপায় না পেয়ে তপা চেঁচাতে শুরু করল। প্রথমে মামা, তারপর ভাই। অবশেষে মামির নাম ধরেও অসংখ্য বার ডাকল সে। কিন্তু সে কি জানতো বাড়িতে দানব ছাড়া কেউ নেই।
তপা কে টেনে হিঁচড়ে বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জামাগুলোর উপর ছুঁড়ে ফেলল। তপা ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে। বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করতেই শুরু হলো দানবের দানবীয় হাতের অত্যাচার। ধস্তাধস্তি শুরু হলো বিশালাকার দানব আর ছোট্ট একটা প্রাণের সাথে।
ছোট্ট নাজুক শরীরটা নেতিয়ে পড়ার আগেই বাড়ির উঠোনে পা পড়ল প্রান্তর। কাউকে দেখতে না পেয়ে তপার ঘরের দিকে পা বাড়াতেই কর্ণকুহরে প্রবেশ করল তপার আর্তনাদ। নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে শেষ শক্তিটুকু দিয়ে চেষ্টা করছে সে। শতাধিক বার আল্লাহ কে স্মরণ করার পর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল প্রান্ত। দানবের তখন অন্য দিকে খেয়াল নেই। সে মত্ত নিজের বিকৃত মস্তিষ্কের বিকৃত কার্য সম্পাদন করতে।
প্রান্ত গিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করতেই তার হুঁশ ফিরল। প্রান্তকে দেখে তাড়াহুড়ো করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘর ছাড়ল সে। তপা উঠে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। প্রান্ত দ্রুত পায়ে তপার সামনে বসে বুকের ভেতর আগলে নিয়ে বলল,
“কিচ্ছু হয় নি দেখ। ভাইয়া চলে এসেছে তো। সব ঠিক হয়ে গেছে তাকা আমার দিকে। এই পাগলি তাকা না। সব ঠিক হয়ে গেছে তো।”
তপা প্রান্তর পিঠ আঁকড়ে ধরে কাঁদছিল। হঠাৎ হাতের বাঁধন ঢিলে হতে হতে পড়ে গেল হাতটা। প্রান্ত আস্তে করে তপার মুখটা এক হাতে ধরে সামনে আনতেই বুঝতে পারল মেয়েটা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। প্রান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে তপার গায়ে ওড়না জড়িয়ে দিয়ে বাইরে প্রবেশ করার জন্য দরজার কাছে আসতেই দেখল দরজার বাইরে সিজান বাবা মা সহ দাঁড়িয়ে আছে।
প্রান্ত কিছু বলার আগেই স্ব শব্দে চড় বসিয়ে দিল হাজেরা বেগম। যিনি সিজানের মা।
প্রান্ত গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে বলল,
“খালা মণি!”
হাজেরা বেগম আঙুল উঁচু করে বললেন,
“খবরদার ওই পাপ মুখে আমায় খালা মণি ডাকবি না।আমার কোনো ভাগ্নে নেই। তোর মা তো ওই কালনাগিনী কে ভাল বাসিনা বলে বড় বড় বুলি শোনাতো। কিন্তু এখন? তার শিক্ষার এই নমুনা? কালনাগিনী কই? তাকে বের হতে বল। তার চুল ন্যাড়া করে আজ আমি বাড়ি ছাড়া করব। ডাক নবাবজাদী কে।”
প্রান্ত আকস্মিক এই ঘটনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে তাকিয়ে রইল। কি বলবে আর কি বলবে না সেটা বুঝতেই কেটে গেল কয়েক প্রহর।
প্রান্ত কে ঠেলে ভেতরে ঢুকে অজ্ঞান তপার চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলল। তপা চোখ খুলছে না দেখে সিজান কে পানি আনতে বলল।
সিজান দ্রুত পায়ে পানি এনে দিলে সবটুকু পানি তপার মুখের উপর ঢেলে দিল। তবুও চোখ বন্ধ দেখে নাক মুখের উপর ওড়না চেপে ধরল। নিশ্বাস আঁটকে আসায় অতি দ্রুত চোখ পিটপিট করে খুলে ফেলল তপা। তপার জ্ঞান ফিরতে দেখে আবার চুলের মুঠি ধরে বলল,
“এতক্ষণ অজ্ঞান হওয়ার নাটক করছিলি? দুজনের ইচ্ছায় পাপ করে এখব অজ্ঞান হওয়ার নাটক করে একজনের উপর চাপিয়ে দিতে চাইছিলি? তোর নাটক বহুত দেখছি আমি। আজ এক্ষুনি বাড়ি থেকে বের হবি তুই।”
তপা কিছু বুঝতে না পেরে বলল,
“কি পাপ করেছি আমি?”
হাজেরা বেগম অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে বলল,
“তুই ওর সাথে ছিলি না? তোর অবৈধ সম্পর্ক নেই প্রান্তর সাথে? তোর এই এলোমেলো অবস্থার জন্য তোরা দুজন দায়ী না?”
তপা নিজের দিকে তাকিয়ে দেখল গায়ে স্কুল ড্রেসের উপর একটা ওড়না জড়ানো। প্রান্তর দিকে তাকিয়ে দেখল প্রান্ত একরাশ ক্রোধ নিয়ে তাকিয়ে আছে হাজেরা বেগমের দিকে।
তপা গুটি গুটি পায়ে প্রান্তর পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে বলল,
“ভাইয়া কি হয়েছে?”
প্রান্ত মাথা নিচু করে ফেলল। কি করে বলবে সে তাদের চেনা মানুষগুলো তাদের পবিত্র সম্পর্কটাকে নোংরামোয় রূপ দিয়েছে। তপা আবারও বলল,
“ভাইয়া বলনা কি হয়েছে?”
প্রান্ত মুখ খুলার আগেই সিজান বলল,
“তোরা দুজন একসাথে ছিলি। নোংরা খেলায় মেতেছিস তোরা। অস্বীকার করতে পারবি?”
তপা যেন আকাশ থেকে পড়ল। তার প্রাণপ্রিয় ভাই একথা বলছে এটা সে বিশ্বাস করতে পারছে না। প্রান্ত তেড়ে এসে সিজানের কলার চেপে ধরল। হাজেরা বেগম ছুটে এসে আবারও চড় লাগিয়ে দিল প্রান্তর গালে। বাদ পড়ল না তপাও। তপা কে আঘাত করতে দেখে প্রান্ত সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“ওর গায়ে আর একটা আঁচড় পড়লে খুন করে ফেলব আপনাকে। ভুলে যাব আপনি আমার মায়ের বোন।”
হাজেরা বেগম চকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“তোর কাছে এই মেয়েটা এত আপন হয়ে গেল যার জন্য তুই তোর মায়ের মত খালাকে খুন করতে চাইছিস।”
“মা কথাটা আপনার মুখে শোভা পায় না। আর সিজান, আমি ভাবতাম আংকেলের পর তুই অন্তত তপা কে ভালবাসিস। কিন্তু আমি ভুল। তোরা সবাই এক। সবকটা অমানুষ। ”
মোর্শেদুল হকের সামনে দাঁড়িয়ে তপা নরম গলায় বলল,
“মামা তুমিও বিশ্বাস করো?”
“পৃথিবী উল্টে গেলেও আমি বিশ্বাস করব না রে মা।”
তপা মৃদু হাসল। তার আর কিছু দরকার নেই। একজন তো বিশ্বাস করেছে তাকে। প্রান্তর দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাইয়া চলো এখান থেকে।”
হাজেরা বেগম গলা উঁচিয়ে বললেন,
“চলো মানে? কোথায় যাবি? আগে তোর নাগরের বাপ মা ডাকি। তারপর তো যাবি। একেবারে চিরবিদায়।”
প্রান্ত নিজেই ফোন বের করে মায়ের নম্বর ডায়াল করে বলল,
“মা ইমিডিয়েটলি মোর্শেদ আঙ্কেলের বাড়ি এসো। তোমার বোন সার্কাস শুরু করেছে। তাড়াতাড়ি এসো। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে আমি তাকে খুনও করে ফেলতে পারি।”
#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ১৬
আয়েশা হাজেরা বেগমের সামনে দাঁড়িয়ে শক্ত গলায় বললেন,
” তুই মেয়েটার সাথে এত জঘন্য একটা কাজ করলি কি করে? কেন করলি বল তো? ওর গায়ের রঙ কালো। ওর বিয়েতে তোকে মোটা টাকা গুনতে হবে যৌতুক হিসেবে সেজন্য? তুই যে বাড়িতে এত দাপট দেখাচ্ছিস সেই বাড়ির অর্ধেকটার মালিক যে তপা সেটা ভুলে গেছিস? তোর শ্বশুর মানে তপার নানা যে তপার মায়ের নামে এই বাড়ির অর্ধেক অংশ লিখে দিয়েছে সেটা জানিস না তুই? নাহ না জানার তো কথা নয়। তপার জন্মের আগে যখন তপার বাবা মায়ের মধ্যে ঝামেলা হচ্ছিল তখন তো তুই এবাড়িতেই ছিলি।তখন তোর শ্বশুর যে বাড়ি লিখে দিল তখন সেটা ভালো করে মগজে গেঁথে নিতে পারিস নি? নিজের টাকায় তপার খরচ নাই-বা চালালি। অন্তত ওর মায়ের অংশ থেকে কিছুটা বিক্রি করে নাহয় ওর খাওয়া পড়ার খরচ চালাতি। বাকিটা বিয়ের জন্য রেখে দিতি। কিন্তু তা না করে তুই মেয়েটার চরিত্রে কলঙ্ক লাগিয়ে দিলি? তোর কলিজা একবারও কাঁপল না? এই তুই মায়ের জাত?”
হাজেরা বেগম চেঁচিয়ে বললেন,
“তোর চোখে শুধু আমার অবহেলা ধরা পড়ল। আমার দোষ ধরা পড়ল। নিজের ছেলের অন্যায় দেখলি না? ওই কালনাগিনী যে তোর ছেলের মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে সেটাও দেখলি না। তোর ছেলেরও চরিত্রের দোষ আছে। যেই সুযোগ পেয়েছে হামলে পড়েছে। ”
“আমার ছেলে মেয়ের চরিত্র সম্পর্কে আমার যথেষ্ট ধারণা আছে। তোর কাছে আমি সার্টিফিকেট চাইতে আসি নি।”
তপার সামনে গিয়ে বললেন,
“চল মা। এই নরকে আর তোর থাকতে হবে না। আমার সাথে আমার বাড়ি চল। বাবা ছাড়া যখন নিজের দুটো সন্তান মানুষ করতে পারছি তোকেও পারব।”
তপা শেষবারের মত সিজানের সামনে গিয়ে মলিন গলায় বলল,
“তুই কিভাবে বিশ্বাস করলি এই জঘন্য কথাটা?”
সিজান শক্ত গলায় বলল,
“আমি নিজের চোখে দেখেছি।”
“কি দেখিছিস?”
“তোরা দুজন জড়িয়ে ধরে ছিলি।”
তপা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“জড়িয়ে তো আমি তোকেও ধরি ভাই। তবে কি তোর সাথেও আমার নোংরা সম্পর্ক?
সিজান অসহায় চোখে তাকাল তপার মুখশ্রীতে। কি বলবে সে?
হাজেরা বেগম এসে তপার চুল ধরে টেনে সরিয়ে নিল সিজানের সামনে থেকে। কঠিন গলায় বলল,
” আমার ছেলের সামনে গিয়ে ন্যাকা কান্না করছিস তুই? নাটক করে আবার আমার ছেলের মন গলাতে চাইছিস। লাজ লজ্জা কি আল্লাহ একটুও দেয় নি?”
আয়েশা তপা কে সরিয়ে নিল। হাজেরার উদ্দেশ্যে বিক্ষিপ্ত গলায় বললেন,
“আজ এই ব্যবহার করছিস তো তুই। আজ বুঝলি না বুঝবি সেই দিন। যেদিন তোর মাথায় বারি পড়বে। দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষছিস তুই। তোর অবলা কালসাপ যেদিন তোর দিকে ফণা তুলবে সেদিন লুকোনোরও জায়গা পাবি না। আল্লাহ না করুন তোর না তপার পায়ে পরতে হয়। কিন্তু সেদিন দেখবি তপা এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে তুই হাজার চেষ্টা করে ওর পাটাও ছুঁতে পারবি না।”
এবার সিজানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন আয়েশা।
“তুই তো মেয়েটা কে ভালবাসতি বাপ। কি এমন হলো যে তুই ও মায়ের কথায় তাল দিচ্ছিস? সত্যি কি ভালবাসতি নাকি ভালবাসার নামে ভান করেছিস।”
সিজান অসহায় চোখে তাকিয়ে মৃদু আওয়াজে বলল,
“ওকে তুমি নিয়ে যাও খালা মনি। এই নরকে আর আসতে দিও না ওকে। আমি জানি তোমার কাছে ও ভাল থাকবে।”
আয়েশা কিছু বলার আগেই সিজান গলার জোর বাড়িয়ে আবারও বলল,
” আমি নিজের চোখে দেখেছি ওদের দুজন কে একসাথে। নিজের চোখ কে কি করে অবিশ্বাস করব?”
“সিজান নাহয় মিথ্যে বলছে।কিন্তু মামুন? ও কি মিথ্যে বলবে? ওতো অবলা, অসহায় মানুষ। একহাতে জোর নেই। পায়েরও খারাপ অবস্থা। ভালো করে হাঁটতে পর্যন্ত পারে না। সে কিসের স্বার্থে মিথ্যে বলবে? আমরা বাড়িতে না থাকলেও মামুন তো বাড়িতেই ছিল। ও নিজের চোখে দেখেছে ওদের নোংরামো। আমরা বাড়ি পৌঁছানোর আগেই ও ছুটে গিয়ে রাস্তায় বলেছে ওদের কথা। তারপর তো সিজানও এসে দেখেছে দুজনকে ঘরে। আমরাও এসে তোর ছেলেকে ওই ঘর থেকে বের হতে দেখেছি। তপার তখন এলোমেলো অবস্থা। এরপরেও বলবি মিথ্যে কথা?”
তপা হাজেরা বেগমের কথা শুনে দু’হাতে কান চেপে ধরে বসে পড়ল মাটিতে। আয়েশা এসে তপাকে টেনে তুলে বাইরের দিকে পা বাড়ালো।
প্রান্ত যেতে যেতে হাজেরা বেগমের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলল,
“এই দিন দিন নয় আরও দিন আছে, এই দিন নিয়ে যাবে সেই দিনের কাছে।”
সেদিন চলে আসার পর এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত কেটেছে পৃথার সাথে একঘরে থেকে। সেদিনের পর আর তপা কোনো সম্পর্ক রাখে নি তো ওই পরিবারের সাথে। কেবল তার মামা বাদে। প্রান্ত ক’দিনের মধ্যেই চলে যায় ভার্সিটির হলে। তপা এসএসসির পর কলেজে ভর্তি হয়ে হোস্টেলে চলে যায়। পৃথার কলেজের জন্য শহরে চলে যায় আয়েশাও। তপা ইচ্ছে করেই ভর্তি হয় অন্য শহরে, অন্য কলেজে। নয়তো আয়েশা তার সাথে থাকতেই বাধ্য করবে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? নিজের চেষ্টায় জীবন গড়তে শুরু করে তপা। দু-তিনটে টিউশনি আর মামার পাঠানো সামান্য কিছু টাকা দিয়েই চলে যেতে থাকে তার দিনগুলো। দিনগুলো চলে গেলেও রাতের আধারে নেমে আসে বিপর্যয়। ছোট বেলা থেকে শুরু করে কিছুদিন আগের ঘটনা নামক দূর্ঘটনা গুলো দুমড়ে মুচড়ে দিতে থাকে তার জীবনটা। রাতগুলো চলে যায় নির্ঘুম ভাবে। যদিওবা একটুখানি দুচোখের পাতা এক করতো তখনই হানা দিতো ভয়ঙ্কর স্বপ্নগুলো। তমসায় ডুবিয়ে দিত তাকে।
বেশ কয়েকমাস পর কাকতালীয় ভাবে দেখা হয় সিজান পৃথার। শৈশবের খুনসুটি কৈশোরে গিয়ে রূপ নেয় প্রণয়ে।চাতক যেমন আশায় থাকে বৃষ্টির ঠিক তেমন দুজনে আশায় থাকতো একটুখানি সাক্ষাতের। যাকে দেখলে ওষ্ঠযুগল প্রসারিত হতো লজ্জালু হাসির দাপটে। সেই তাকে দেখেই পৃথার ভ্রুযুগলের মাঝের জায়গাটায় দুতিনটে ভাজ পড়েছিল। অনাকাঙ্ক্ষিত সাক্ষাতে সিজান কিছু বলার চেষ্টা করলেও লাভের লাভ কিচ্ছু হয় নি। উল্টো শুনতে হয়েছে কটুকথা। মেনে নিতে হয়েছে অপমান। ভালবাসার প্রত্যাখান।
সেদিনের পর আর সিজান পৃথার সামনে আসে নি। কিছু বলার চেষ্টাও করে নি। পৃথার কথা মনে হতেই কর্ণকুহরে কেবল একটা কথাই প্রতিধ্বনিত হতো বারংবার।
“যে নিজের বোনের সম্মান নিলামে তুলতে পারে, সে তো কাল পুরো আমাকেই নিলামে তুলে দিবে।”
নিজের ভাই, প্রাণপ্রিয় বোনরূপী বান্ধবীর উপর অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া কলঙ্ক পৃথা মেনে নিতে পারে নি। কি হতো সেদিন একটুখানি তপার হয়ে কথা বললে? কি হতো সেই দানব টাকে সবার সামনে নিয়ে আসলে?
আয়েশা বোনের বাড়ির দিকে ফিরে না তাকালেও হাজেরা বেগম সব ভুলে ঘেঁষতে থাকেন বোনের গা। মনে রাগ থাকলেও তা অপ্রকাশিতই রেখে দেন আয়েশা। শত হোক একই মায়ের সন্তান তারা। দুবোন একসাথে জায়গা ভাগ করে থেকেছে মায়ের পেটে। প্রান্ত প্রথম দিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতো হাজেরা বেগম আসলে। পরে মুখ ফিরিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঘরবন্দী হয়ে থাকতো। শুধু দেখা হতো না পৃথা, প্রান্ত, তপা আর সিজানের। একটা ঘটনা পুরো জীবনের মোড়টাই ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
পলক হাতের ফোনটা সিজানের দিকে বাড়িয়ে দিল। সিজান ভ্রু কুঁচকে তাকালে পলক ইশারায় কথা বলতে বলল।
” এক বোনের রাগ ভাঙালে হবে না। আমার আরও একটা বোন আছে। সেও এক আকাশ সমান অভিমান নিয়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিচ্ছে।”
সিজান অবাক হয়ে বলল,
“ভাইয়া!”
“এত খুশি হয়ে লাভ নেই। আগে আমার বোনদের রাগ ভাঙা। আমি সবটাই শুনেছি। পলকের ফোনের সাথে কানেক্টেড ছিলাম।”
সিজান মলিন কণ্ঠে বলল,
“তাহলে মাফ করবে তো?”
প্রান্ত থমথমে গলায় বলল,
“আমি আমার বোনদের জন্য হাসিমুখে প্রাণও দিয়ে দিতে পারি।”
সিজান মন খারাপ করে ফেলল। সে তো পারে নি। ছোট বয়সের একটা ভুল জীবনটা ঝাঁঝড়া করে দিচ্ছে। কিন্তু তারই বা কি করার ছিল। পরিস্থিতি তো তার অনূকূলে ছিল না। অনেক আগেই হাতের বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল। সে তো শুধু হ্যা তে হ্যা মিলিয়েছে। আর কিছু না। তার বিশ্বাস অবিশ্বাসে কি আদৌ কিছু যেতো আসতো?
খাওয়ার সময় সিজান বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাবা তুমি একা ফিরতে পারবে?”
মোর্শেদুল হক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“কেন তোর জন্মের আগে কি আমি বাড়ি থেকে বের হই নি? নাকি বাড়ি ফিরি নি?”
সিজান কণ্ঠ খাদে নামিয়ে নরম গলায় বলল,
“তা না বাবা। এখন তো বয়স হচ্ছে তোমার।”
“আমাকে দেখে বুড়ো মনে হয় তোর?”
সিজান এক হাতে কান ছুঁয়ে বলল,
“আমার ভুল হয়ে গেছে। মাফ করো। এখন বলো আমি যদি পরে যাই কোনো সমস্যা হবে?”
মোর্শেদুল হক খানিক সময় ভেবে বললেন,
“সমস্যা তো হবে না। কিন্তু তুই ফিরবি কখন? বিকেল তো হয়েই এলো। পরে গাড়ি পাওয়া যাবে না তো।”
” মামা ও আজ এখানেই থাক। কাল নাহয় সকাল সকাল চলে যাবে।”
পলকের কথা শুনে মোর্শেদুল হক কিঞ্চিৎ ভেবে বললেন,
“কিন্তু এখানে তো তপা, পৃথা দুটো মেয়ে থাকে। ও এখানে থাকবে কি করে?”
পলক মৃদু হেসে বলল,
“দ্বিতীয় তলায় আমার ফ্ল্যাটের দুটো রুম প্রায় খালিই পড়ে থাকে মামা।”
পলকের কথা শুনে তপা মৃদু স্বরে বলল,
“আপনি মামা বলছেন কেন? আংকেল বলুন।”
পলকও তপার মত ফিসফিস করে বলল,
“তোমার মামা তো আমার মামাই হবে না?”
তপা কিছু না বলে নিজের মত বিরবির করতে শুরু করল। পলক স্পষ্ট কিছু শুনতে না পারলেও বুঝতে পারল বিরবির করে তপা তারই পিন্ডি চটকাতে ব্যস্ত।
মাগরিবের নামাযের পর ছাদের এক কোণে রাখা দোলনায় চুপচাপ বসে আছে পৃথা। পাশে বসে পশ্চিম আকাশের রক্তিম আভা মিশে যাওয়ার দৃশ্য দুচোখ ভরে দেখছে তপা। গোধূলি আকাশের আগুন রঙা আলোর ছটা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে দূর দেশে। কিয়ৎক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ধরণী ছেয়ে গেল আধো আলো আধো অন্ধকারে। মৃদু আলোয় সাদা গোলাপ গুলোকে অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে। তপার ইচ্ছে করছে আলতো হাতে গোলাপের পাপড়ি গুলো ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু পায়ের যে নাজেহাল অবস্থা। পৃথার দিকে তাকিয়ে দেখল সে নির্বিকার। নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে সম্মুখপানে। তপা যে তার পাশে বসে আছে সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই তার।
পলক এসে অকস্মাৎ তপাকে কোলে তুলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। তপা নিজেকে ধাতস্থ করার আগেই দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল। তপা ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে দু’হাতে পলকের গলা আঁকড়ে ধরলো।
” আস্তে নামুন।”
পলক পায়ের গতি কমিয়ে বলল,
“কেন?”
“পড়ে যাব তো।”
“আমি থাকতেই?”
“আপনিও পড়বেন। সেজন্যই তো আস্তে নামতে বললাম।”
পলক ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
“পড়ে গেলে তো ভালোই হবে। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে ধাপে পড়ার সময় তুমি লেপ্টে থাকবে আমার বুকে। দু’হাতে আঁকড়ে ধরবে আমার পিঠ। দুজনের শরীরে শরীর ছুঁয়ে দেবে। ছুঁয়ে দেবে দুজনের দেহের সমস্ত শিরা উপশিরারা।বেশ রোমান্টিক রোমান্টিক একটা ব্যাপার হবে তাই না?”
তপা কিছু বলল না। এখন কিছু বলা মানেই লজ্জার চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া।
তপা কে বিছানায় বসিয়ে পলকও পাশে বসল। তপা মৃদু স্বরে বলল,
“আমাকে এখন এখানে কেন নিয়ে এলেন?”
পলক শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল,
“বাসর বাসর পাচ্ছিল। তাই বাসর করতে তুলে নিয়ে এলাম। হবে নাকি একটুখানি?”
তপা মৃদু হেসে বলল,
“আপনি কি আমাকে ভয় দেখাতে চাচ্ছেন? দুঃখিত। আমি এই মূহুর্তে ভয় পাচ্ছি না।”
পলক অবাক হয়ে বলল,
“সত্যি পাচ্ছো না? কিন্তু কেন? এত সাহসী তো তুমি নও।”
তপা মলিন হাসল।
“দানবের হাত থেকে বেঁচে ফিরেছি। আপনি তো মানুষ।”
পলক কিছু বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“মানে?”
তপা কথা ঘুরিয়ে বলল,
“কিছু না। কেন নিয়ে এলেন বললেন না কিন্তু।”
পলক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“নিজে তো প্রেমের ঘোর বিরোধী। নিজে নাহয় প্রেম করবেই না। সেটা তোমার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু অন্য কারো প্রেমে ব্যাগড়া দেওয়াটা নিশ্চয়ই শোভনীয় নয় তাই না?”
তপা চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“আমি কার প্রেমে ব্যাগড়া দিলাম?”
“সিজানের প্রেমে। তুমি জানো না ওরা এখন মান অভিমানের পালা শেষ করে ভালবাসা বাসি করবে।”
তপা অবাক হলো। পলকের দিকে তাকিয়ে সন্দীহান গলায় বলল,
“আপনি কি করে জানলেন ওরা দুজন দুজনকে ভালবাসে?”
পলক মুচকি হাসল।
“প্রেমিক পুরুষেরা চোখ দেখলেই বুঝতে পারে কে প্রেমে পড়েছে আর কে পড়েনি।”
তপা পলকের চোখের দিক থেকে নজর সরিয়ে নিল। তা দেখে পলক মৃদু গলায় গাইল,
“কাজল কালো ওই দুটি চোখ
ও চোখে জাদু আছে
চোখের আড়াল হতে গেলে
পড়ে যায় চোখের কাছে।”
” তুমি নজর সরিয়ে নিলেই কি আমি চোখ পড়তে পারব না? তোমার পা থেকে মাথা অবধি আমার মুখস্থ, কণ্ঠস্থ, ঠোটস্থ। বুঝলে?” বলে অন্য রুমে চলে গেল।
তপা অবাক হয়ে চেয়ে রইল। মুখস্থ, কণ্ঠস্থ, ঠোঁটস্থ। মানে কি? তবে কি তপার মনের উথাল-পাথাল ঢেউয়ের খবর রাখে পলক? এই যে এই মূহুর্তে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তপার অনূভুতি নামক গাছগুলো। এটা কি পলক টের পাচ্ছে। সর্বনাশ!
শার্ট বদলে টিশার্ট পড়ে তপার সামনে আসতেই তপা মৃদু স্বরে বলল,
“এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে দিবেন প্লিজ। তৃষ্ণা পেয়েছে।”
পলক বুকের বা পাশে হাত রেখে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,
“চাইলে তো জীবনটাও দিয়ে দিতে পারি। ”
তপা মুখ টিপে হেসে বলল,
“পানির অপর নাম জীবন। সেদিক থেকে জীবনটাই তো চাইলাম।”
পলক ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তুমি ভীষণ চালাক হয়ে যাচ্ছো কৃষ্ণময়ী।”
পানি এনে তপার হাতে দিতেই মৃদু আওয়াজে বেজে উঠল পলকের ফোন। ফোনটা কানের কাছে নিতেই ওপাশ থেকে পায়েল তাজওয়ার ঝাঁঝালো গলায় বললেন,
“বিয়ে করে কি সংসার পাতিয়ে ফেলেছো ওখানে?”
পলক তপার দিকে তাকিয়ে বলল,
“একা একা কি সংসার পাতানো যায় মা? যার সাথে পাতাতে চাইছি সে তো পাত্তাই দিচ্ছে না।”
পায়েল তাজওয়ার অবাক হয়ে বললেন,
“পলক তাজওয়ার কে পাত্তা দিচ্ছে না। কে সে? একবার দেখে চক্ষু সার্থক করার সুযোগ পাবো তো?”
পলক মৃদু হেসে বলল,
“দেখবে দেখবে। একসময় উঠতে, বসতে, খেতে, শুতে শুধু তাকেই দেখবে।”
“খুব সুন্দরী নাকি? নেতা সাহেব দিওয়ানা হলো যে।”
পলক মলিন কণ্ঠে বলল,
“আমি আর নেতা সাহেব নেই মা।”
পায়েল তাজওয়ার ছেলের যন্ত্রণা বুঝতে পারলেন বোধহয়। কথা ঘুরিয়ে বললেন,
” বল না। খুব সুন্দর দেখতে?”
পলক তপার দিকে অপলক তাকিয়ে বলল,
“হ্যা। একদম আমার মনের মত। স্নিগ্ধ, স্বচ্ছ, পবিত্র।”
তপা আঁতকে উঠল। স্নিগ্ধ, স্বচ্ছ, পবিত্র! কিন্তু সে তো পবিত্র নয়। শরীরটা যে পঁচে গেছে। গন্ধ ছড়ানোর অপেক্ষা মাত্র।
পলক কথা শেষ করে তপার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে পানির বাকি অংশটুকু গলাধঃকরণ করে গ্লাসটা পাশের টেবিলে রেখে তপার পাশে সোজা হয়ে শুয়ে পড়ল।
চোখ বন্ধ করে বলল,
“তুমি তো খুব চালাক হয়ে যাচ্ছো আজকাল।”
তপা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আবার কি করলাম?”
পলক ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল,
“তুমি জানতে না ভাগ করে খেলে ভালবাসা বাড়ে? ইচ্ছে করেই পানি রেখেছিলে আমার জন্য তাই না? কিন্তু আমার দিক থেকে তো যথেষ্ট পরিমাণ ভালবাসা আছে। বরং তোমার আমার খাওয়া জিনিস বেশি বেশি করে খাওয়া উচিৎ। যাতে ভালবাসারা উপচে পড়তে পড়তে ছাদ থেকে তাজমহল পর্যন্ত আসে।”
তপা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইল। এই মানুষটা একটা সাধারণ ব্যাপার কোথা থেকে ঠিক কোথায় নিয়ে যেতে পারে তা আগে থেকে কেউ ধারণা করতে পারবে না। জিনিস এক পিস।
কিয়ৎকাল পর তপা মৃদু স্বরে বলল,
“আপনার কোনো ভাইবোন আছে?”
পলক একহাতে ভর করে মাথা উঁচু করে বলল,
“নাহ। আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। কেন বলো তো?”
তপা বিরবির করে বলল,
“ঠিকই ভেবেছিলাম। ওয়ান পিস মেড কারিগর ডেট। এক্ষেত্রে কারিগর বেঁচে থাকলেও প্রসেসিং বন্ধ আছে।”
পলক তপাকে বিরবির করতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তুমি কি আবার আমার পিন্ডি চটকাচ্ছো?”
তপা হেসে ফেলল পলকের মুখে এহেন কথা শুনে।
“আসলে ভাবছিলাম।”
পলক ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি?”
“এই যে আমার মত আর কতজনের কপাল পুড়ছে সেটা।”
পলক অবাক হয়ে বলল,
“আমি তোমার কপালে জুটে তোমার কপাল পোড়াচ্ছি?”
তপা মৃদু হেসে বলল,
“নিজেই ভেবে নিন। এইতো কিছুক্ষণ আগে বললেন আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত আপনার মুখস্থ, কণ্ঠস্থ, ঠোঁটস্থ। তাহলে নিশ্চয় মনটাও মুখস্থ। নিজেই বুঝে নিন।”
পলক ঠোঁট কামড়ে ধরে আবার সোজা হয়ে শুয়ে পড়ল। মসৃণ কণ্ঠে বলল,
“এখন তো শুধু কপাল পোড়াচ্ছি। একবার আমার নামে দলিল করে নেই। তারপর তোমার সর্বাঙ্গ পোড়াবো।”
চলবে…
।)