কৃষ্ণময়ীর অলংকার পর্ব -২৭+২৮

#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ২৭

দিবসের দ্বিতীয় প্রহর। মাথার উপর প্রকাণ্ড নীলিমা তপ্ত শ্বাস ফেলছে। তেজস্বী সূর্য আর দীপ্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে ধরিত্রীর বুকে। মৃদু সমীরণে কেঁ *পে উঠছে বৃক্ষপত্র। ঝিম মারা রোদে পাখপাখালিরাও বোধহয় গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। পালিয়ে বেড়াচ্ছে সূর্যের তেজস্ক্রিয় রশ্মি থেকে।
মৃদু আলোয় চেয়ারে হাত পা বাঁ*ধা অবস্থায় বসে আছে মামুন। বসে আছে নয়, থাকতে বাধ্য হয়েছে। সামনে চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে পলক। অনবরত পা নাড়িয়ে চলেছে সে। সজল পলকের থেকে হাত দুয়েক দূরে দাঁড়িয়ে তাকে অবলোকন করছে। পলকের শান্ত রূপে ভাবান্বিত হচ্ছে সজল। এ যেন ঝড়ের পূর্বাভাস।
সহসা পলক গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে বলল,
“সজল, তুই এত দায়িত্ব জ্ঞানহীন কবে হলি?”
সজল কিছু বুঝতে পারল না। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
পলক পুনরায় বলল,
“আমার মামা শ্বশুর মশাই কতক্ষণ যাবত অনাহারে বসে আছে। কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা তো করবি নাকি?”

সজল হকচকিয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল,
“জ্বি ভাই!”
পলক তির্যক হেসে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিল। সজল হাতে নিয়ে আবার প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকাল।
পলক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“কি, এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? যা মামু কে খাওয়া। ভ*য় নেই। বি*ষ না। পলক তাজওয়ার খু*ন করতে পারে না।এটা তোর জানা উচিৎ। এতদিন সঙ্গে সঙ্গে আছিস। এইটুকু ভরসা নেই?”

সজল লজ্জা পেল। তাড়াহুড়ো করে বলল,
“আমি এইডা ভাবি নাই ভাই। মালডা খাইতে রাজি হইব তো? যদি না হয়?”
পলক ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কিভাবে খাওয়াবি সেটা তোর ব্যাপার। সেটাও যদি আমি বলে দেই তাহলে তোকে নিয়ে এসেছি কেন?”
সজল আর দ্বিরুক্তি করল না। গাল টিপে খায়িয়ে দিল টাডালাফিল নামক দু’টো ট্যাবলেট।

পলক এবার নজর দিল মামুনের উপর। বাঁকা হেসে বলল,
“মামুর ইঞ্জিন নাকি খুব কড়া। ছোট ছোট বাচ্চা দেখলেই গরম হয়ে যায়। আজ একটু খেলা হোক? দেখি কত গরম হতে পারে।”
মামুন ভীত চোখে তাকাল। সজল অবাক হয়ে বলল,
“ভাই কিসের ঔষধ খাওয়াইছেন?”
পলক হাসল। বলল,
“দেখবি একটু পরে। বুঝতেও পারবি। মামুর ইঞ্জিনের খেলা হবে আজ। দেখ আজ কত গরম হতে পারে মামু। ছোট ছোট বাচ্চার উপর জোর দেখানো। আজ বোঝাবো যন্ত্রণা। কিছুক্ষণেই ছটফট করতে শুরু করবে। তুই শুধু দেখ আর মজা নে।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই মামুন ছটফট করতে শুরু করল। মোচড়ামুচড়ি করে চেয়ার ছেড়ে উঠার চেষ্টা করতে লাল। হাত পায়ের বাঁধনে টান পড়লেও অনবরত ছোটার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মামুন।
পলক আওয়াজ তুলে বলল,
“কি মামু? গরম হচ্ছে? নাকি আরও ডোজ লাগবে? লাগলে বলতে পারেন। আরও আছে স্টকে। আনবো?”
মামুন কিছু বলল না। বাঁ*ধা শরীরের যন্ত্রণায় কেবল ছটফট করতে লাগল।

আধঘন্টা পর পলক অভিজ্ঞ উকিলের মত একের পর এক প্রশ্ন করেই চলেছে। মামুনও সায় দিচ্ছে পলকের কথায়। উত্তর দিয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। কোনো উত্তর পছন্দ হচ্ছে আবার কোনোটা না।
একপর্যায়ে পলক সজলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই এখন বাইরে যা একটু। আমি মামুর সাথে প্রাইভেট মিটিং করব।”
সজল অবাক হলেও কোনো প্রশ্ন করল না। চুপচাপ বেরিয়ে গেল।
পলক মামুনের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল,
“আমার তিয়াশার দিকে হাত বাড়ানোর অপরাধে তোর এই হাতদুটো আমি কে*টে নিতে পারি এক্ষুনি। তোর পুরুষ হওয়ার ক*ল*ঙ্ক ঘুচাতে দ্বিখ*ণ্ডিত করে দিতে পারি অন্ড*কোষ। যে চোখ দিয়ে আমার কৃষ্ণময়ীর দিকে কুৎসিত নজর দিয়েছিস সেই চোখ আমি উপড়ে নিতে পারি। এই পৃথিবীর অতি মূল্যবান অক্সিজেন তোর মত পশুর ফুসফুসে প্রবেশ করছে। আমি চাইলেই পারি এই অপচয়টুকু রোধ করতে। এতে আমার হাত এক ফোঁটাও কাঁপবে না। তোর মত জানোয়ারের বেঁ*চে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমি সেটা করব না। ক্রাইম করে জে*লে গেলে আমার কৃষ্ণময়ী একা হয়ে যাবে যে। আবার তোর মত অন্য শকুনের দৃষ্টিতে পড়বে। তাই জেলে আমি নই যাবি তুই। কিন্তু যে হাত দিয়ে তুই আমার কৃষ্ণময়ীকে ছুঁয়েছিস, আমার কৃষ্ণময়ীর রাতগুলো ভ*য়া*ব*হ করে দিয়েছিস, সেই হাত আমি অক্ষত রাখতে পারবনা। তাহলে আমার বিবেক আমাকে ধিক্কার জানাবে। তাই তোর হাতদুটো আমি ভা*ঙ*ব। ভয় নেই। ব্যথা দেব না। যত্ন করে ভা*ঙ*ব। হাজার হোক মামা শ্বশুর বলে কথা।”

মামুন ভা*ঙা হাতের যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বলল,
“আমাকে ছেড়ে দাও। আমি আর খারাপ কাজ করব না। কোনো মেয়ের দিকে তাকাব না। ছুবোও না। ছেড়ে দাও আমাকে।”
পলক চেয়ারে বসে পা নাচাতে নাচাতে বলল,
“হাতে আর ছোঁয়ার মত অবস্থা আছে নাকি? আর একটু মালিশ করব? ”

মামুন মনে মনে এখান থেকে বের হওয়ার জন্য মনে মনে আল্লাহ কে ডেকে চলেছে। পলক সময় গড়াতে গড়াতে আরও হিং*স্র হয়ে উঠছে।
ফোন বের করে মামুনের সামনে রেখে বলল,
“তিয়াশার সাথে যা করেছিস তা স্বীকার কর। নয়তো বাকি হাত-পা গুলোও ঝুরোঝুরো করে ফেলব। বলবি?”
মামুন রাজি হলো। এক হাতের ব্যথাতেই কুপোকাত সে। তাই গড়গড় করে বলে দিল সব।

রেকর্ড শেষে পলক সজল কে ডাকল। সজলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কাজ হয়ে গেছে। এখন পুলিশ আসুক। এসব নরকের কীটের বাইরে ঘোরা ঠিক নয়।অধিকার নেই এদের।”

বলেই যত্ন করে একটা ইনজেকশন পুশ করে দিল মামুনের শরীরে।
সজল বলল,
“তা ঠিক আছে। কিন্তু ইনজেকশনটা কিসের ছিল ভাই?”

পলক বাঁকা হেসে বলল,
“গরম হওয়ার দিন শেষ,
হিম শীতল বাংলাদেশ।”

সজল বুঝতে পারল না। বলল,
“মানে?”
“মানে মামুর ইঞ্জিন সারা জীবনের জন্য হিম শীতল থাকার ব্যবস্থা করে দিলাম। আর বাচ্চাকাচ্চা দেখে গরম হবে না। বাচ্চাকাচ্চা কি বলছি লাস্যময়ী যুবতী দেখলেও হবে না। আজীবন সম্মাননার মত আজীবন ঠান্ডা করে দিলাম।”
সজল বুঝতে পেরে অবাক হলো। এই হিং*স্র পলককে তার অচেনা লাগছে। বুঝতে পারল পলকের দূর্বল জায়গায় আঘাত করার ফল ভোগ করছে মামুন। অল্পতে পলক রেগে যায় না। এটা এতদিনে বেশ ভালো করেই বুঝতে পেরেছে সজল। তাই আর ঘাঁটল না ব্যাপারটা।
পলক পুনরায় বলল,
“এখন তুই বাড়ি যা। পুলিশ আসবে। তোকেও জিজ্ঞাসা বাদের ঝামেলায় পড়তে হবে। তার থেকে এখনই কে*টে পর।”
সজল অগ্যতা বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। পলক ডায়াল করল স্থানীয় অফিসার ইনচার্জ এর নাম্বার।
মামুনের কে*স কোর্টে উঠলে প্রমাণ ও সাক্ষীর প্রেক্ষিতে সাজা হলো তার। দশ বছরের কারা*দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। প্রান্ত, সিজান, আয়েশা, মোর্শেদুল হক এমনকি হাজেরা বেগম পর্যন্ত সাক্ষী দিয়েছেন মামুনের বিরুদ্ধে। তাই শা*স্তি পাওয়া নিয়ে বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয় নি পলকের।

মাস তিনেক পর। তপা বসে আছে হসপিটালের ওয়েটিং রুমে। তীব্র উৎকণ্ঠার সাথে কাটছে একেকটি প্রহর। গতকালই প্রেগ্ন্যাসি কিট দিয়ে পরীক্ষা করেছে সে। রেজাল্ট পজিটিভ। সেটার উপর ভরসা করে পলককে কিছু জানায়নি সে। হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর হওয়ার জন্য সকাল হতেই হসপিটালে দৌড়েছে । বসে থাকতে থাকতে রীতিমতো ক্লান্ত হয়ে গেছে সে। কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। ওড়নার কোণে ঘাম টুকু মুছতেই একটি মেয়ে রিনরিনে গলায় ডাকল,
“তিয়াশা তপা আছেন?”
তপা কেঁপে উঠল নিজের নাম শুনে। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগেও বোধহয় সে এত নার্ভাস হয় নি। হাত পা রীতিমতো কাঁপছে তার। এখন মনে হচ্ছে পলক কে নিয়ে আসা উচিৎ ছিল। কিন্তু সে তো মহাব্যস্ত। অফিস সামলে দম ফেলবার সময় নেই তার। পৃথাটাও নেই। সিজান কে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে বসে আছে।
মাস দুয়েক আগে ঘরোয়া ভাবে বিয়ে হয়েছে তাদের। মন মেজাজ ভালো ছিল না হাজেরা বেগমের। কোর্টে সাক্ষী দিলেও পিঠাপিঠি ভাই তার। নিজের কাছেই বড় করেছে সে। আগলে রাখতে চেষ্টা করেছে সবসময়। অপরাধী হলেও ভাইয়ের জন্য তার মন কাঁদে। আয়েশা শক্ত মনের মানুষ। ছোট থেকেই মামুনের সাথে তার বেশ দুরত্ব ছিল। নিজের ভাই হলেও বনিবনা হয়নি কখনো। হয়তো তিনি বিচক্ষণ ছিলেন। সেজন্য মামুনের হাবেভাবে ভবিষ্যতের কুৎসিত রূপটার টের পেয়েছিলেন আগে থেকেই। নয়তো বিধাতা তাকে এই কষ্টে জর্জরিত করবেন না বলে আগে থেকেই দুরত্ব বজায় রেখে দিয়েছিলেন। অকালে স্বামী হারিয়ে দুই সন্তান নিয়ে কম কষ্টতো তিনি করেন নি। তাই হয়েতো এই কষ্টটা থেকে আল্লাহ তাকে মুক্তি দিয়েছেন।

“তিয়াশা তপা?”
তপা হকচকিয়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে বলল,
“জ্বি আমি।”
মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলল,
“আসুন। আপনার জন্য ম্যাম অপেক্ষা করছেন।”
তপা জোর করে একটু হেসে বলল,
“চলুন।”

দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল তপা। চেয়ারে বসে তার ফাইলগুলোই ঘাটাঘাটি করছে ডক্টর মিথিলা। তপা কে দেখতেই মুচকি হেসে বলল,
“এসো এসো। সাবধানে বসো।”
তপা মৃদু হেসে মুখোমুখি বসল মিথিলার।
“পলক আসে নি?”
তপা মাথা নাড়ালো। মিথিলা অবাক হয়ে বলল,
“ও তো কেয়ারলেস নয়। তবে আসল না কেন? এই অবস্থায় তোমাকে একা পাঠিয়ে দিল? আমি তো ভাবলাম বাইরে আছে।”
তপা মৃদু হেসে বলল,
“আসলে আপু উনি তো জানেন না। জানলে আমাকে একা ছাড়তেন না।”
মিথিলা প্রশস্ত হাসিতে মেতে উঠল। হাসতে হাসতেই বলল,
“সারপ্রাইজ প্ল্যান করছো নাকি? এর থেকে ভালো সারপ্রাইজ কিন্তু ও জীবনেও পাবে না।”

তপা বুকের কাঁপনগুলো আর সহ্য করতে পারছিল না। তাই মিথিলার কথার উত্তর না দিয়েই বলল,
“পজিটিভ?”
মিথিলা হাসল। বলল,
“হ্যা। পলক কে এক ট্রাক মিষ্টি পাঠিয়ে দিতে বলবে। কিন্তু তুমি এতদিনে হসপিটালে এসেছো কেন? আগে বুঝতে পারো নি? আরও আগেই বোঝা উচিৎ ছিল।”
তপা উৎসাহিত চোখে তাকিয়ে বলল,
“কতদিন আপু?”
” নয় সপ্তাহ।”
তপা চমকাল না। সে জানে তার পিরিয়ড সাইকেল ঠিক দুমাস ধরেই অনিয়ম হচ্ছে। কিন্তু প্রেগ্ন্যাসির কোনো লক্ষ্মণ বুঝতে পারে নি। বুঝবেই বা কি করে? আগে কখনো প্রেগন্যান্ট হয়েছিল নাকি।
মিথিলা পুনরায় বলল,
“কোনো লক্ষ্মণ প্রকাশ পায় নি?”
তপা মলিন কণ্ঠে বলল,
“হয়তো পেয়েছে। আমি বুঝতে পারি নি। থাকি তো একা। আপনার বন্ধু আসে সপ্তাহে একবার অথবা দু’বার। কোনো সপ্তাহে সাতদিনই থাকে। আবার কোনো সপ্তাহে আসতেই পারে না। কিন্তু সে তো আর এসব বুঝবে না। অভিজ্ঞ কেউ থাকলে হয়তো বুঝতে পারতো।”

মিথিলা কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর ধীরে সুস্থে বলল,
“আমার তোমাদের ব্যক্তিগত জীবনে ইন্টারফেয়ার করা ঠিক না। তবুও বলছি এখন আর একা একা থেকো না। এবার পলক কে বলো বাড়ি নিয়ে যেতে। কোন সময় কোন বিপদ হয় বলা যায় না। তাছাড়া তোমার এক্সট্রা কেয়ার দরকার। অফিস সামলে সে তোমার যত্ন করতে পারবে না। একা থাকতে থাকতে তুমি ডিপ্রেশনে চলে গেলে বাচ্চার ক্ষতি হবে। পলক কে বুঝিয়ে বলো তুমি।”

তপা হাসল। বলল,
“সে তো আগেই বাড়ি নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমিই যাই নি। চেয়েছিলাম নিজের একটা পরিচয় তৈরি করে নেই। তারপর যাব। কিন্তু তার আগেই তো অঘটন ঘটে গেল।”
মিথিলা শাসানোর ভঙ্গিতে বলল,
“এই মেয়ে অঘটন কোনটাকে বলছো? এটা তোমার সৌভাগ্য। আর কখনো বলবে না। আল্লাহ নারাজ হবেন।”

তপা মৃদু হাসল। সে তো জানে এটা তার পরম সৌভাগ্য।একটা সুস্থ সবল পরিবার পাওয়ার সৌভাগ্য।

পলক আসতেই তপা হসপিটালের ফাইল এগিয়ে দিল। পলক ভ্রু কুঁচকে তাকাল। তপার আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে বলল,
“হসপিটালে গিয়েছিলে? কি হয়েছে তোমার? ঠিক আছো তুমি? আমাকে কেন বলোনি? তিয়াশা খারাপ কিছু হয় নি বলো?”
তপা মুখ টিপে হাসল। বলল,
“খারাপ কিছুই তো হয়েছে। আমি মুটিয়ে যাব। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকব। যে পেটে আপনি পরম আদরে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দেন। সেই পেটের উপর অনেকগুলো দাগ পড়বে। আর আগের মত মসৃণ থাকবে না। এই হালকা পাতলা আমি, যাকে ইচ্ছে করলেই কোলে তুলে ঘুরতে পারেন তাকে হয়তো আর তুলতেই পারবেন না। মুটিয়ে গিয়ে আর মায়াবী দেখাবে না। পুরো নয় মাস অসুস্থ থাকব আমি। আচ্ছা তখন অসুস্থ আমিটাকেও কি একইভাবে ভালবাসবেন আপনি?”

পলক যা বোঝার বুঝে গেল। তপা পলক ফেলার আগেই কোলে তুলে নিল। ঘুরতে লাগলো অনবরত। তপা ঘাবড়ে গিয়ে দু’হাতে শক্ত করে ঝাপটে ধরল পলকের গলা।

কপালে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল বুকের ভেতর। তপাও বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে গেল। লেপ্টে রইল বুকের সাথে।
দু’হাতে কোমর আঁকড়ে পেটে কান লাগিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে রইল চুপচাপ। তপা পলকের চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে আবার কান পেতে রইল।

কিছুক্ষণ পর।
“আমার না পাগল পাগল লাগছে। কেমন যেন সুখ সুখ লাগছে। তোমারও কি এমন লাগছে বউ?”
তপা তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে তুলল ঠোঁটের কোণে। মুখ নামিয়ে চুমু এঁকে দিল পলকের কপালে।
পলক অপলক চেয়ে রইল। হঠাৎ করেই বুঝি তার কৃষ্ণময়ীর মায়াময়ী রূপ বেড়ে গেছে। ছলকে ছলকে পড়ছে। গা বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। সেই মায়ায় আচ্ছাদিত হচ্ছে তাদের চারপাশ।

“আমরা কাল বাড়ি যাব। ঠিক আছে?”
পলকের এহেন কথা শুনে তপা চমকে উঠল। বলল,
“কালই?”
পলক মৃদু হেসে বলল,
“হুম কালই। আমার বাবা মাকে এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে পারি না আমি। তাই কালই যাব।”
“আমার ভয় করছে যে।”
পলক আগলে নিল তপাকে। চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“ভয় পেও না। আমার বাবা মা তোমাকে হাসি মুখেই মেনে নেবে। সেই ভরসাটুকু আমার আছে। তুমি রিল্যাক্স থাকো।”
তপা কিছুটা শান্ত হলো। কিন্তু পুরোপুরি কাটল না ভয়টা। মনে মনে রেশটা রয়েই গেল।

মাঝ রাতে ফোন বেজে উঠায় পলক ভ্রু কুঁচকে ফেলল। স্কিনে মায়ের নাম্বার দেখে অবাক হলো। কানে তুলতেই কান্নারত কণ্ঠে একটা বাক্য শুনে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ল ফ্ল্যাট ছেড়ে। তপা তাকিয়ে রইল প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে।
#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ২৮

সামান্য উঁচু পেটের উপর পাতলা কাপড়ের আস্তরণে আবৃত। লম্বা চুলগুলো হাত খোঁপার বাঁধন থেকে মুক্ত হয়েছে সেই কখন। অযত্নে অবহেলার সহিত তা বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। পিঠে ভর করে চিৎ হয়ে শুয়ে মৃদুস্বরে গোঙাচ্ছে তপা। চোখের নিচটা দেবে গিয়ে গর্তাকৃতির সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে পড়েছে কাল রঙের প্রলেপ। কত রাত না ঘুমানোর ফলাফল স্বরূপ এই কালশিটে দাগ। চুলের ঝট খোলা হয় নি সপ্তাহ খানেক। শ্যাম্পুর গন্ধ সহ্য করার ভয়ে শ্যাম্পু করা হয় নি দিন পনেরো। চিরুনী ছুঁয়েছে দিন চারেক আগে। কেবল একটা কাজ তপা ঠিকঠাক করেছে। সেটা হচ্ছে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকা। অপলক নয়নে চেয়ে থাকা।

ডান কাত হয়ে পেটের উপর হাত রেখে মৃদু আওয়াজে বলল,
“মাকে আর কত কষ্ট দিবি সোনা? মা তো একা একা সহ্য করতে পারছে না। তোর বাবা টা থাকলে সব সহ্য করে নিতাম আমি। মনোবল খুঁজে পাই না যে এখন। তোরাও যদি এত জ্বালাতন করিস। মা কিভাবে সহ্য করি বলতো? একটু তো শান্ত হয়ে থাকতে পারিস মায়ের মত করে। বাবার মত দুষ্টুমি তখন করিস, যখন বাবা চলে আসে তোর কাছে। তোর মায়ের কাছে। তখন সব কষ্ট আমি সহ্য করে নেব। এখন একটু শান্ত হয়ে থাক না মা।”

মিনিট কয়েক যাওয়ার পর তপা পুনরায় ব্যথায় কুকিয়ে উঠল। গত দুদিন ধরে থেকে থেকে পেটে ব্যথা হচ্ছে তার। ডক্টর মিথিলার সাথে কথা হয়েছে এ নিয়ে। সে বলেছে এটা নর্মাল ব্যথা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কনসিভ করার চার থেকে পাঁচ মাস পর্যন্ত এরকম ব্যথা হতে পারে। ভয়ের কিছু নেই। তবে সেটা সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে ডক্টরের পরামর্শ নিতে হবে।
তপা এখনো দাঁত কামড়ে সহ্য করে নিচ্ছে সব ব্যথা। কিছুদিন যাবত তপা আরও কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। মাছ খেতে পারে না। মাছের গন্ধ নাকে গেলেও বমি করে গা ভাসিয়ে ফেলে। শ্যাম্পুর গন্ধও সহ্য হয় না তার। এরকম আরও কিছু ছোট ছোট জিনিসের উপর রয়েছে মারাত্মক পরিমাণ অনিহা। ধরা বা ছোঁয়া তো অনেক দূর কিছু জিনিসের নাম শুনলেই গা গুলিয়ে উঠে তার।

আয়েশা তপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“আমি কি তোর এতটাই পর?”
তপা আবেশে চোখ বন্ধ করে আছে। ভালো লাগছে এভাবে থাকতে। মনে হচ্ছে কতগুলো দিন পর সে মানুষের সাথে আছে। আপন কারো বাঁধনে আঁটকে আছে। এক স্নেহমহী মায়ের ছায়াতলে আছে। যেখানে সে ও তার সন্তান নিরাপদ।
আয়েশা তপার মৌনাবস্থা দেখে পুনরায় বললেন,
“বল। আমরা কি তোর এতটাই পর? একবার বলতে পারলি না তুই অসুস্থ?”
তপা চোখ পিটপিট করে তাকাল। হাত টেনে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
“তোমরাই তো আমার সব আন্টি। রাগ করো না। দেখো আমি ভালো আছি। তোমরা তো এটাই চাইতে। তাই না?”
আয়েশা দুমিনিট মৌন রইলেন। অতঃপর বললেন,
“চল আমার কাছে থাকবি তুই আজ থেকে। প্রয়োজনীয় কি কি নিতে হবে বলে দে। আমি গুছিয়ে নিচ্ছি।”
তপা ভড়কে গেল। মুখটা কাচুমাচু করে বলল,
“আমি যাব না।”
আয়েশা হাত ছাড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“যাবি। একশবার যাবি। হাজার বার যাবি।”
তপা উঠে বসল। আয়েশার হাত পুনরায় নিজের হাতের মুঠোয় পুরে বলল,
“আন্টি আমি এখানে ভালো আছি। হ্যা মানছি একটু অসুস্থ। ঠিক হয়ে যাব কয়েকদিনেই। কিন্তু দেখো আমার মনটা সুস্থ আছে। এখানে আমি সত্যিই ভালো আছি। এখানে আনাচে কানাচে পলকের স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দেয়ালে তাকিয়ে দেখ ওনার ছবি। মনে হচ্ছে আমি ওনার সাথেই আছি। একা নই। তাছাড়া আমি কথা দিয়েছি এই ফ্ল্যাট ছেড়ে কোথাও যাব না। তুমিই দুটো দিন আমার কাছে থেকে যাও না আন্টি। তাহলেই দেখবে আমি দ্রুত সুস্থ হয়ে গেছি।”

আয়েশা কিছুক্ষণ ভাবলেন। অতঃপর মৃদু স্বরে বললেন,
“পৃথা কে আসতে বলব?”
তপা মুচকি হেসে বলল,
“আন্টি পৃথা এখন সংসারী হয়েছে। ওর নিজের সংসার ছেড়ে আমাকে পাহারা দিতে চলে আসবে?”
“এসে ক’দিন থাকলে কি পৃথিবী উল্টে যাবে? ভেসে যাবে সংসার?”
তপা মলিন কণ্ঠে বলল,
“মামি অসুস্থ আন্টি। তুমি তো জানোই। অসুস্থ শ্বাশুড়ি রেখে আমার কাছে এসে থাকলে চলবে?”
আয়েশা কিছু বলল না। কি’বা বলবে সে।
তপা পুনরায় বলল,
“তিন মাসেরই তো ব্যাপার। দেখতে দেখতে চলে যাবে। তুমি দু’দিন থাকো। আর মাঝেমধ্যে সময় করে এসো। তাহলেই হবে। এত ভেবো না। আমি ঠিক আছি।”

“কথা হয়েছে পলকের সাথে?”
আয়েশার কথা শুনে তপার মুখ মলিন হলো। জোর করে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল,
“সে তো ব্যস্ত আন্টি। যতটুকু সময় পায় কথা বলে। অপারেশন হয়েছে গতকাল। হসপিটালে দৌড়াতে দৌড়াতে তার অবস্থাই শোচনীয়। কথা বলার সময় কোথায়?”
আয়েশা তপার কিশোরী মনের মৃদু অভিমান ভেবে নরম কণ্ঠে বলল,
“অভিমান হয়েছে মা?”
তপা মাথা নাড়ালো। বলল,
“এই সময় অভিমান করলে আমার পাপ লাগবে আন্টি। তার দিক থেকে কোনো কমতি নেই। সে যথেষ্ট চেষ্টা করে চলেছে আমাকে ভালো রাখার। একটুখানি সময় পেলেই কথা বলে আমাকে মাতিয়ে রাখতে চায়। হয়তো পারে না সবসময়। কিন্তু সে চেষ্টা করে আন্টি। আমার প্রায় ধ্বংস জীবনটা সে রঙিন আলোয় সাজিয়ে দিয়েছে। মরে যাওয়া মনটাতে ভালবাসার বীজ বুনেছে। তার জীবনের ভয়াবহ সময়টাতে আমি অভিমান করতে পারি না। তার ক্ষতটাতো এখন আমারও ক্ষত। তার ব্যথাতে আমারও ব্যথা। তার জীবনের ক্রাইসিস তো আমারও আন্টি। তবে কিসের অভিমান? কিসের অভিযোগ?”

আয়েশা কিছু বলল না। কেবল তপা মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। মুখ এগিয়ে চুমু খেলো কপালে।

প্রায় মাস খানেক আগে। পলকের মায়ের ফোন পেয়ে রাতের আধারেই ছুটে চলে যায়। বাড়ি ফিরে হসপিটালে নিতে হয় বাবা রায়হান তাজওয়ার কে। হার্ট অ্যাটাক হয়েছে তার। ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় মাথা ঘুরে পরে যায়। অতঃপর পলক কে ফোনে জানায় পায়েল তাজওয়ার। পলক ফিরে হসপিটালে নিয়ে গেলে কর্তৃপক্ষ জানাল হার্ট অ্যাটাক করেছেন তিনি।
পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তিন তিনটে ব্লক ধরা পড়ল হার্টে। চর্বি জমে হৃদযন্ত্রের রক্তনালী বন্ধ হয়ে গেছে। শুরুতে এনজিওপ্লাস্টি অর্থাৎ রিং পরিয়ে সরু পথ বড় করার ব্যবস্থা করতে চাইলেন। পরে সেটাতে হবে না বুঝতে পেরে পরামর্শ দিলেন ওপেন হার্ট সার্জারী করার। শরীরের অন্য জায়গা থেকে রগ কেটে নিয়ে পুরো বুক চিঁড়ে সেই রগ হৃদযন্ত্রে বসিয়ে দেওয়া হবে।
পলক সিদ্ধান্ত নিল সিংগাপুর নিয়ে যাওয়ার। মায়ের কাছে বলতেই সেও রাজি হয়ে গেলেন। অতঃপর শুরু হলো নতুন যাত্রা।
এক পক্ষকাল যেতেই পলক মা বাবাকে নিয়ে উড়াল দিল সিংগাপুরের পথে। সেখানে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর এগারো দিনের মাথায় শুরু হলো অপারেশন। দীর্ঘ দশ ঘন্টা চলল অপারেশন। তারপর হাসিমুখে বের হলো ডক্টর। পলকও যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল খানিকটা। এতদিনের ধরে রাখা নিশ্বাসগুলো সপাটে বেরিয়ে এলো।

সিংগাপুর যাওয়ার আগের দিন বিকেলে এসেছিল পলক তপার কাছে। দীর্ঘক্ষণ বুকে আগলে রেখেছিল। জড়িয়ে রেখেছিল স্বস্নেহে, মমতায়, ভালবাসায়।
গালে হাত রেখে নয়নে নয়ন মিলিয়ে বলেছিল অনেক অনেক নিষেধ বাক্য। তপা দুচোখ ভরে দেখেছিল প্রিয় মুখখানা। দুকানে মন্ত্রের মত শ্রবণ করেছিল স্বপ্ন পুরুষের কণ্ঠনালী বেদ করে আসা শব্দমালা।

“আমি আমার জানটা রেখে যাচ্ছি এখানে। শুধু দেহটা নিয়ে যাচ্ছি টেনে হিঁচড়ে। তুমি কথা দাও আমার আমানতের খেয়াল রাখবে। বিন্দু পরিমাণ অবহেলা, অযত্ন করবে না। মাত্র তিনমাস কৃষ্ণময়ী। আমি আমার বাবাকে সুস্থ করে নিয়ে আসি। তারপর নিজের বাবা হওয়ার সব দায়িত্ব আমি পালন করব। তিনটে মাস একটু সহ্য করে নাও না কৃষ্ণময়ী। আমি জানি তোমার কষ্ট হবে। হয়তো মাঝেমাঝে ভীষণ কান্না পাবে। কিন্তু তুমি কাঁদবে না। শুধু জানবে তোমার পলক তোমার কাছেই আছে। তোমার পলকের সত্তা তোমার কাছে আছে। তুমি যদি ভাল থাকো। আমার সন্তানের খেয়াল রাখো তবেই আমি ভালো থাকব। ভালো রাখবে তো আমাকে? রাখবে আমার কৃষ্ণময়ী আর আমার আগামী প্রজন্মের খেয়াল?”
তপার চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে যাওয়া জলটুকু সন্তর্পণে মুছে ফেলেছিল। বুক পেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে কান্নাটুকুও গিলে ফেলেছিল।
পলক পুনরায় বলেছিল,
“ফ্ল্যাটের বাইরে যেও না কৃষ্ণময়ী। দরকার হলে প্রান্ত, সিজান ওদের বলবে। পৃথা আর আন্টিও তো আছে। এছাড়াও যদি প্রয়োজন হয় সজলকে বলতে পারবে। ওকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়। জীবন দিয়ে দেবে তবুও তোমাকে রক্ষা করবে। আমি মিথিলাকেও বলে রেখেছি। তোমার রুটিন চেক-আপ করে নেবে। তাছাড়াও প্রয়োজন হলে যেতে পারো। ও তোমাকে অপেক্ষা করাবে না। রান্নার লোক তো ঠিক করাই আছে। এছাড়াও যদি কাউকে লাগে সজল কে বলবে। ও ঠিক যোগাড় করে দেবে। ওয়াশরুমে সাবধানে যাবে। আমি না তোমার চিন্তায় পাগল হয়ে যাব। সত্যি পাগল হয়ে যাব।”

কিছুক্ষণ মৌন থেকে আবারও বলেছিল,
“বলো না কৃষ্ণময়ী। ভাল রাখবে তো নিজেকে? অপেক্ষা করবে তো আমার?”
তপা মৃদু হেসে বলেছিল,
“একসাথে বুড়ো হওয়া বাকি তো। অপেক্ষা না করে কোথায় যাব? আপনি বাবাকে সুস্থ করে নিয়ে আসুন। আমি বাবা মায়ের ভালবাসার কাঙাল। আমি সবার ভালবাসায় বাঁচতে চাই পলক। আমার সন্তান কে একটা সুস্থ পরিবার দিতে চাই। আপনি অতি দ্রুত ফিরে আসুন।”

এরপর আর মুখে কোনো কথা নয়। সময় কেটেছে ঠোঁটের তাপে। কিছু উষ্ণ আলিঙ্গনে। ভালবাসায় আবদ্ধ হয়ে। অনাগত ভবিষ্যতের ভাবনায় কিছু আবেগঘন স্পর্শে।

রাতের আধার কেটেছে প্রায় আধঘন্টা। তপা গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। চোখের কার্নিশে দুফোঁটা জল চিকচিক করছে তার। একহাত সগৌরবে উঁচু হয়ে থাকা পেটের উপর। প্রেগন্যান্সির মাত্র চারমাস চলে। সময়ের তুলনায় পেট অতিরিক্ত বড় হওয়ায় মিথিলার শরণাপন্ন হয়েছিল তপা। কাল বিকেলে একা একাই চলে গিয়েছিল চেম্বারে। মিথিলা মেয়েটাকে তপার বড্ড পছন্দ। খুশি খুশি সংবাদগুলো তো সে-ই দেয় তাকে। যেমন কাল বিকেলে একরত্তি দুশ্চিন্তা নিয়েই গিয়েছিল সে। সময়ের তুলনায় পেট বড় হওয়া নিয়ে চিন্তা হলেও ভেবেছিল বাবুটা বোধহয় তার বাবার মত এখনই সুঠাম দেহ নিয়ে চলে আসবে। কিন্তু মিথিলা সেই একরত্তি দুশ্চিন্তার বদৌলতে একরাশ আনন্দ দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছে তাকে। সেজন্যই তার প্রিয়র তালিকায় মিথিলার অবস্থান হলো আরও একধাপ উপরে।

মিথিলা যখন বলল তপার পেটে একটা নয় বরং দুটি প্রাণ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে। তখন তপার ঠিক কি করতে ইচ্ছে করছিল তা ভাষায় প্রকাশ্য নয়। পলকের ভাষায় পাগল পাগল অবস্থা। সুখী নারীর তালিকায় তপার নিজের নামটা লিখানোর খুব করে ইচ্ছে হলো। পরক্ষণেই মনে হলো নাহ! সে তো এই মূহুর্তে সুখী নয়। সুখী হতো যদি পলক সামনে থাকত। নাম সেদিন লেখাবে যেদিন পলকসহ পুরো পরিবার তপার সামনে আসবে। পলক কে ইচ্ছে করেই জানালো না তপা। থাক না তার জন্য একটুখানি চমক। ঘাবড়ে যাক সে খুশিতে। মাত্রারিক্ত আনন্দে পলক ঠিক কি কি পাগলামি করে তা তপা নিজের চোখে দেখতে চায়। সামনে থেকে অনুধাবন করতে চায়।

পলক আনমনা হয়ে হসপিটালের জানালার ধারে বসে আছে। পায়েল তাজওয়ার ছেলের ক্লান্ত মুখ দেখে পাশে দাঁড়ালেন। গভীর মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। কিঞ্চিৎ সময় পর ধীর গলায় বললেন,
“কি হয়েছে বাবা? মন খারাপ কেন তোর? তোর বাবা তো এখন মোটামুটি সুস্থ। কি নিয়ে চিন্তা করছিস তুই?”

পলক কিয়ৎক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। পরক্ষণেই নরম গলায় বলল,
“আমি কোনো ভুল করলে তোমরা আমাকে মাফ করে দেবে তো মা?”
পায়েল তাজওয়ার মৃদু হেসে বললেন,
“ভুল হলে মাফ করতেই পারি। তবে ভুল টা যদি ভুল হয় তবেই। অপরাধ হলে মাফ করার ক্ষমতা আমার নেই বাবা।”
পলক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে কি ভুল করেছে? নাকি অপরাধ?

চলবে….
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here