কৃষ্ণময়ীর অলংকার পর্ব -২৫+২৬

#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ২৫

কপালের বামপাশ থেকে গড়ানো দুফোঁটা র*ক্ত হাতের সাহায্যে মুছে ভ*য়া*র্ত চোখে তাকিয়ে রইল পলকের দিকে। পলক তখন অ*গ্নি*শর্মা হয়ে তপার দিকেই নিষ্পলক চেয়ে আছে। তপা শুকনো গলায় ঢোক গিলে নিচের দিকে তাকাল। হাত কচলাতে লাগল অনবরত। চমকে উঠল আকষ্মিক হাতের কবজি শক্ত হাতের বাঁধনে বাঁধা পড়ায়। চোখ তুলে দেখার আগেই হেঁচকা টান পরল হাতে। প্রায় দৌড়ে যেতে লাগল পলকের পিছুপিছু। পলক গিয়ে থামল একেবারে লাইব্রেরীর সামনে। দরজা হাট করে খোলাই ছিল। ভেতরে জনা বিশেক ছাত্র ছাত্রী।

ভেতরে ঢুকে গলা ঝেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“ঝামেলা মিটে গেছে। তোমরা যেতে পারো এখন।”
দিরুক্তি করতে চাইলেও পলকের মুখাবয়ব দেখে সাহস করল না কেউই।
তপা কে বসিয়ে নিজেই কাঁধ থেকে ব্যাগ টেনে নিল। চেইন খুলে খুঁজে নিল কাঙ্ক্ষিত বক্সটি। মিনি ফার্স্ট এইড বক্স। তপা মাথা নিচু করে থাকলেও আড়চোখে দেখল পলকের কান্ড কারখানা। বক্স খুলে তুলো নিয়ে পরিষ্কার করতে লাগল কে*টে যাওয়া জায়গাটুকু। তপা নড়াচড়া করলে মুখে কিছু না বলে চোখ দিয়ে শাসাল। এতে তপা ইচ্ছে করে আরও বেশি করে নড়তে শুরু করল। ভাব করতে লাগল এমন, যে সে ব্যথা পাচ্ছে। শুধু ব্যথা নয়। একদম ম*রে যাচ্ছে এমন ব্যথা।
পলক একটু নরম হলো এবারে। ওষুধ লাগিয়ে দেওয়ার সময় মুখ এগিয়ে ফু দিয়ে দিল। তপা পুলকিত হলো। এক নজরে তাকিয়ে রইল পলকের মুখের দিকে। পলক বোধহয় বুঝতে পারল তপার দুষ্টুমি। আবার অ*গ্নি*মূর্তি ধারণ করল চোখের পলকেই।

“আমি বারণ করার পরও তুমি বের হওয়ার সাহস কোথায় পেলে?”
গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে এহেন কথা শুনে তপা কেঁপে উঠল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। শুকনো গলায় আবারও ঢোক গিলল।
পলক হুংকার দিয়ে বলল,
“আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোমাকে। সাহস হলো কি করে? যদি কিছু অঘটন ঘটে যেত? বলেছিলাম আমি আসছি। পাকনামি করতে কে বলেছে?”
তপা মাথা নিচু করে মিনমিনে গলায় বলল,
“যদি আপনার কিছু হয়ে যেত, তবে?”
একটা বাক্যেই পলক কিছুটা শান্ত হলো যেন। চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“আমার কি হবে? আর হলেই বা তোমার কি?”
“আপনি যখন আসার কথা বলছিলেন তখনও বোধহয় ঝামেলা থামেনি। আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিৎ। আপনি জানেন না কতটা নৃ*শং*স ভাবে মে*রে*ছে ওরা কয়েকজন কে। র*ক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল তাদের শরীর। আমি দেখে রুমে এসে ঘাপটি মেরে বসে ছিলাম। হাত পা কাঁপছিল ওদের দেখেই। কিন্তু এরমধ্যে আপনি বললেন আসবেন। আমি বুঝতে দিতে চাই নি এখানে ঝামেলা হচ্ছে। কিন্তু আপনি তো আগেই জেনে বসে আছেন। আপনার আসার কথা শুনে আমি দিকবিদিক ভুলে বেরিয়ে পরেছিলাম। ওরকম র*ক্তা*ক্ত অবস্থায় আপনাকে দেখলে আমি সইতে পারব না । তাই তো হন্য হয়ে চেষ্টা করছিলাম আপনি আসার আগেই বের হতে। কিন্তু যেতে আর পারলাম কই? তার আগেই সিঁড়ি থেকে পড়ে মাথা ফা*টি*য়ে বসে আছি।”
পলক ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বলল,
“তুমি আমার সেফটির জন্য নিজে বিপদে পরতে যাচ্ছিলে? আর এত দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামতে কেন গেলে? তোমার কি কিছু মনে থাকে না তিয়াশা? কিছুদিন আগে পা ভে*ঙে ঘরে বসেছিলে ভুলে গেলে? এত কিসের তাড়া তোমার? আজ যদি পড়ে না যেতে তাহলে বাইরে মা*রা*মা*রির ভীরে তুমিও আ*ঘা*ত পেয়ে বসতে। ওরা যদি তোমাকে অ্যা*টাক করত তাহলে?”
তপা মৃদু হাসল। ঠোঁটের কোণে সুক্ষ্ম হাসির রেখা ধরে রেখেই বলল,
“আপনি আমায় হারানোর ভ*য়ে সিটিয়ে গেছেন। অথচ আপনার আমি ছাড়াও সবই আছে। মা, বাবা, পরিবার সব। কিন্তু আমার? আমার তো এই পলক টা ছাড়া আর কিচ্ছুটি নেই। আঁকড়ে ধরে বাঁচার মত একটা শিকড়বাকরও নেই। শিকড়হীন আমি তো কেবল আঁকড়ে ধরার জন্য আপনাকে পেয়েছি। কি করে বসে থাকতাম?”
পলক নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল। কা*টা জায়গায় ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়ে বলল,
“যাই হয়ে যাক না কেন আর কখনো এরকম খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত নেবে না। তোমার কোনো ধারণা আছে, তোমাকে ওভাবে টালামাটাল পায়ে হাঁটতে দেখে আমার কি অবস্থা হয়েছিল?”
এতটুকু নরম গলায় বললেও আবার কঠিন হলো কন্ঠস্বর। থতথমে গলায় বলল,
“আর একদিন সিঁড়ি দিয়ে নামলে আমি নিজ দায়িত্বে তোমার পা ভে*ঙে ঘরে বসিয়ে রাখব। পলক তাজওয়ার কখনো শুকনো থ্রে*ড দেয় না। মাইন্ড ইট।”
তপা পলকের চোখের আড়ালে ঠোঁট টিপে হাসল। মুখটা উঁচু করে পলকের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির উপর টুক করে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে দিল। চমকে তাকাল পলক। চোখে জড়িয়ে আছে একরাশ বিষ্ময়। তপা পলকের চাহনি দেখে মিটিমিটি হাসছে।
“এসব কোত্থেকে শিখলে?”
তপা ভ্রু কুঁচকে বলল, “কোন সব?”
পলক মৃদুস্বরে বলল,
“এই যে রাগ ভাঙাতে চুমু দেওয়া। এসব তো আমি শেখাই নি।”
তপা ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
“শিখেছি আর কি।”
পলক চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। বলল,
“সেটাই তো। কে শেখালো?”
তপা বাঁকা হেসে বলল,
“ওই তো, আমাদের ব্যাচমেট একটা ছেলে আছে, সে।”
পলক ভ্রু কুঁচকে ফেলল। চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“চড়িয়ে গাল লাল করে দেব। বেয়াদব বউ। আমাকে ছেলের গল্প শোনানো হচ্ছে?”
তপা মুখ এগিয়ে গাল পেতে দিয়ে বলল,
“প্লিজ।”
পলক মৃদু হাসল। বলল,
“চলো। এখানে মা*রা যাবে না। বাসায় চলো তারপর দেখছি, কতক্ষণ এই টসটসে গাল দুটো লোড নিতে পারে।”
তপা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। পলক পুনরায় বলল,
“রাগ ভাঙানোর টেকনিক তো তুমিই শেখালে। এবার বুঝবে পলক তাজওয়ার কি জিনিস।”
তপা হাসল। চুল ঠিক করার ভান করে বলল,
“ভুলে যাবেন না আমিও পলক তাজওয়ারের বউ। তিয়াশা তাজওয়ার। সো আমার সাথে নো পাঙ্গা।”

তপা সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় বেখেয়ালি হয়ে পা পড়ে যায় দুধাপ পরের সিঁড়িতে। যার দরুন কপাল গিয়ে লাগে রেলিংয়ের সাথে। মূহুর্তেই চাপা আর্তনাদ করে উঠে তপা। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থেকে আবার উঠে দাঁড়ায়। টালমাটাল পায়ে এগিয়ে যার গেইটের দিকে।
পলক ভার্সিটির প্রধান ফটক পেরিয়ে দেখতে পায় গুটিকতক ছাত্র ছাত্রী তর্ক বির্তক করছে। পলক আসার আগেই পুলিশ এসে ব্যাপারটা সামলে নিয়েছে। অ্যা*রে*স্ট হয়েছে কিছু শিক্ষার্থী। কিছুজন হসপিটালে। আ*ত*তা*য়ী হামলার রেশ ধরে সং*ঘা*তে লিপ্ত হয়েছে ভার্সিটির দুই ছাত্র দল। একপক্ষের দাবি অপর পক্ষ ভার্সিটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশন আ*ত*তা*য়ীদের কাছে লিক করে দিয়েছে। অপরপক্ষের দাবি তারা একাজ করে নি। বরং অপরপক্ষই জড়িত এই আকষ্মিক হা*ম*লার সঙ্গে। এটা নিয়েই চলছে বাক বিতর্ক। একপর্যায়ে হাতাহাতি। তারপর হঠাৎই হামলা করেছে আ*ত*তা*য়ীরা। প্রথমে ক্যান্টিনসহ কিছু রুম তালাবন্ধ করে দিয়েছে। তারপর অতর্কিত আ*ঘা*ত করেছে।
জনবহুল জায়গা পেরিয়ে আসতেই তপার দেখা পায় পলক। ছোট ছোট পায়ে দ্রুত এগিয়ে আসার প্রয়াস চালাচ্ছে সে। পলক সামনে দাঁড়াতেই চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে রইল। পলকের চোখ প্রথমেই আঁটকে গেল কপালের কা*টা জায়গাটাতে। খানিকটা র*ক্ত লেগে আছে বাম ভ্রুর উপর। ক্ষ*ত তেমন গভীর না হলেও র*ক্ত ঝরেছে স্বল্প পরিমাণে।
তপা পলককে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
“আপনি ঠিক আছেন?”
পলক কিছু না বলে চোখ ছোট ছোট তাকিয়ে রইল কপালের দিকে। মূহুর্তেই রগগুলো দপদপ করে উঠল।
গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে বলল,
“কপালে র*ক্ত কি করে বের হলো?”
তপা কেঁপে উঠল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“কে*টে গেছে।”
পলক ফুঁসে উঠল। কণ্ঠের তেজি ঠাট বজায় রেখেই বলল,
“কা*ট*লে র*ক্ত বের হয় সেটুকু বোঝার মত জ্ঞান আমার আছে। কা*ট*ল কি করে সেটা জিজ্ঞেস করেছি।”
“সিঁড়ি থেকে অসাবধানতা বশত পড়ে গিয়েছিলাম।”
আর একটা শব্দও করে নি পলক। কেবল অ*গ্নি*দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

কেন্দ্রীয় কা*রা*গা*রের অন্ধকারাচ্ছন্ন স্যাতসেতে রুমে বসে আছে মামুন। ভা*ঙা হাতের আঙুলগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে সে। সাদা ব্যান্ডেজের ভেতরে কুটকুট করে কামড়াচ্ছে সারাক্ষণ। থালায় পরে থাকা দুটো মোটা রুটির দিকে তাকিয়ে রইল অনিমেষ।
হাজেরা বেগম অনুমতি পেয়ে মামুনের কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ালেন। চোখে আজ মায়ার বদলে ঘৃ*ণা ঝরে পড়ছে তার। একরাশ ক্রো*ধ নিজেদের শক্তিতে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
সামনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মামুন চোখ তুলে তাকাল। হাজেরা বেগম কে দেখে আবার মাথা নিচু করে ফেলল। হাজেরা বেগম নিজের ভেতরে থাকা ঘৃণার পাহাড় সরিয়ে রেখে ডাকল,
“মামুন।”
মামুন তাকাল। তবে তার কণ্ঠনালী থেকে উচ্চারিত হলো না কোনো শব্দ।
হাজেরা বেগম আবারও ডাকলেন। কিন্তু মামুন এলো না। নিরাশ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে এলেন তিনি। দশ বছরের বিনাশ্রম কা*রা*গা*র জীবনের মাত্র সপ্তম দিন চলছে। বাকি আরও নয় বছর তিনশত আটান্ন দিন।

“আপনি কি আজ আসতে পারবেন?”
পলক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“কোথায়?”
তপা ওড়নায় গিট দিতে দিতে বলল,
“তাজমহলে। মানে আজ এখানে থাকতে পারবেন?”
পলক কিছুক্ষণ ভাবল। অতঃপর বলল,
“পারব। কিন্তু আসতে রাত হবে। অনেক কাজ পেন্ডিং হয়ে আছে।”
তপা মাথা নাড়িয়ে অভিজ্ঞদের মত বলল,
“ঠিক আছে। আমি অপেক্ষা করব।”
বাইক স্টার্ট দিয়ে আবার চলে গেল পলক। এসেছিল তপা কে পৌঁছে দিতে। পৌঁছেই আবার চলে গেল নিজ গন্তব্য অফিসে।

আসমানী রঙা শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে তপা। ভীষণ লজ্জা লজ্জা করছে তার। ইচ্ছে করছে কম্বলের তলায় লুকিয়ে থাকতে। যেন মুখটা আবৃত থাকে এই ধরাধামের প্রতিটি সৃষ্টির থেকে।

কলিং বেল বাজতেই তপা হকচকিয়ে গেল। মনে মনে নিজেকে সাহস যোগালো। আর অপেক্ষা করতে লাগল পলকের রিয়াকশন দেখার।
আচ্ছা সে কি চমকাবে? একটু খানি থমকে দাঁড়াবে? নাকি ঘোর লাগা চোখে মোহনীয় কণ্ঠে বলবে, ‘ ধ্বংস আজ আমি তোমাতেই।’
#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ২৬

লতিয়ে চলা লজ্জাবতী লতিকার মত লাজে রাঙা রূপে নিজেকে উপস্থাপন করেছে তপা। নাহ সে চায়নি এমন লজ্জা রাঙা রূপে নিজেকে রাঙাতে। প্রকৃতি চেয়েছে। তাই তো দরজা খুলে পলকের অবাক হওয়া মুখশ্রী দেখেই নিজের লাজে রাঙা রূপ বেরিয়ে এসেছে। উস্কে দেবার জন্য পলকের দুষ্টু চোখের দুষ্টু নজর তো আছেই।

কলিং বেলের শব্দ পেয়ে গুটি গুটি পায়ে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছে তপা। পলক এক নজর তাকিয়ে আর চোখ ফেরানোর সুযোগ পায় নি। আঁটকে গিয়েছে তপার উপর। নিবদ্ধ হয়েছে সেখানে। তপা লাজুক হেসে খোলা চুলগুলোর একাংশ কানের পেছনে গুঁজে নিল। পলক ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল,
“আমাকে কি মে*রে ফেলার পায়তারা করছো তুমি?”
তপা কিছু বলল না। কেবল ঠোঁট প্রসারিত করে হাসল।
দরজার সামনে থেকে খানিকটা সরে পলকের আসার জায়গা করে দিল। পলক ভেতরে ঢুকে ল্যাপটবের ব্যাগ রাখতেই নজর গেল বিছানার উপর। সেখানে লাল চাদরের উপর শোভা পাচ্ছে অসংখ্য সাদা গোলাপের পাপড়ি। শোভা বর্ধনের পাশাপাশি সুগন্ধিতেও ভরে যাচ্ছে হৃদয়। পলক বিছানা থেকে নজর সরিয়ে তপার দিকে তাকাল। সে চাহনিতে মাদকতা মেশানো। তপার অন্তরাত্মা কেঁ*পে উঠল। এতক্ষণ অদম্য সাহসী সৈনিকের মত থাকলেও এখন পরাজিত সৈনিকের মত গুটিয়ে যাচ্ছে।
পলক বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে ফেলল। তপার দিকে তাকিয়ে হাসফাস করতে লাগল সে। কণ্ঠে কোমলতা যোগে বলল,
“সত্যি মে*রে ফেলবে নাকি আজ?”
তপা কিছু বলল না। কি বলবে ভেবে পেল না। এতক্ষণ মনে মনে কথার পশরা সাজিয়ে রাখলেও পলকের সামনে তা কণ্ঠনালী ভেদ করে বাইরে নিঃসৃত হতে পারছে না।
তপা পেছালো। এক পা দুপা করে পিছিয়ে রুমের বাইরে বেরিয়ে এলো। চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। বিয়ে হয়ে গেছে অনেকগুলো দিন তো হলো। আর কত? এবার পলকের কাছে ধরা দেওয়াটা জরুরী। পায়েল তাজওয়ারের কথাগুলোও মাথায় ঘুরতে লাগলো তার। তাকে ভালবাসতে আর কার্পণ্য করবে না তপা। সেটা হোক শারীরিক বা মানসিক। তপার মনের গোপন কক্ষে পলক বেশ পাকাপোক্ত ভাবেই নিজের জায়গা করে নিয়েছে। সেটা স্বীকার করতে আর কোনো সংকোচ নেই তপার। আজ ভার্সিটিতে ঘটা ঘটনার পর তপার আর কোনো দ্বিধাও নেই ভালবাসা নিয়ে। তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে বসে আছে পলক। আজ সে চিৎকার করে পুরো পৃথিবী কে জানিয়ে দিতে পারে তার ভালবাসার কথা। সে ধন্য আজ। ধন্য তার মনের সুপ্ত অনূভুতিরা।

নৈশভোজের পর তপা মৃদু স্বরে শুধালো,
“আপনাকে কিছু বলার ছিল আমার। বলব?”
পলক চোখ বন্ধ করে সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছিল। তপার কথা শুনে চোখ খুলল। মসৃণ কণ্ঠে বলল,
“আমাকে কিছু বলতে হলে তোমার অনুমতি নিতে হবে না। যখন যা ইচ্ছা অনায়াসে বলে দেবে।”
তপা দুদণ্ড জিরিয়ে নিল। হাত কচলাতে লাগল অনবরত।
পলক ভ্রু কুঁচকে ফেলল। উৎকণ্ঠিত গলায় বলল,
“তুমি কি কোনো কিছু নিয়ে আপসেট? তিয়াশা কি হয়েছে? আর হঠাৎ করে তুমি এমন আচরণ করছোই বা কেন? শাড়ি, ফুল এসব কেন? আমি কিন্তু তোমাকে এসব নিয়ে কিছু বলছি না এখনই। তোমার যতদিন সময় লাগে তুমি নাও। আগে নিজেকে সামলে নাও। ধাতস্থ করো এই সম্পর্কে। আমার অস্তিত্ব ধারণ করো নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে। আগে আমাকে ভালবাসো নিজের সবটুকু সত্তা দিয়ে। তারপর নাহয়… ”
“আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি।” চোখ বন্ধ করে বলল তপা।
পলকের কথা মাঝপথেই থেমে গেল। বিষ্ময়কর লেচনে তাকিয়ে রইল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“কি বললে?”
তপা এবার পলকের চোখে চোখ রাখল। দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“আমি ভালবাসি আপনাকে। জানিনা কখন, কিভাবে। কিন্তু ভালবাসি। হয়তো বিয়ের আগে থেকেই অথবা বিয়ের পর। কিন্তু ভাল যে বাসি এটা সত্যি। আপনি ছাড়া আমি অচল। এটা খুব ভাল করে টের পেয়েছি আজ। ভার্সিটিতে কিছু সময় আমার মনে হচ্ছিল আমি বোধহয় ম*রে যাচ্ছি। এরকম দম*বন্ধ কর পরিস্থিতিতে আমি কখনোই পড়িনি। আপনাকে হারানোর ভ*য় আমাকে গিলে ফেলছিল। আমি নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সবটা বোধহয় আপনাতেই উৎসর্গিত হয়ে গেছে। হারানোর ভ*য় পাওয়া, কাছে এলে খুশির জোয়ারে ভাসা, নিজের অস্তিত্বে ধারণ করা, কিছু সময় না দেখলেই মনটা উচাটন করা এগুলো কি ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ? একেই কি ভালবাসা বলে? এটা যদি ভালবাসা হয় তাহলে আমি আপনাকে ভালবাসি। প্রচন্ড রকম ভাবে ভালবাসি।”

পলক নিষ্পলক চেয়ে দেখল তপার আবেগ জড়ানো মুখ। মগ্ন হয়ে শুনল আবেগ ঝরে পড়া কণ্ঠস্বর।
মুখে কিছু না বলে দু’হাত বাড়িয়ে দিল সম্মুখে। তপা যেন অপেক্ষা করছিল এই মূহুর্তটার। আস্টেপিস্টে জড়িয়ে গেল পলকের বাহুডোরে। পলকও পরম আদরে আগলে নিল উষ্ণ আলিঙ্গনে।
কিছু সময় অতিবাহিত হলো এভাবেই। উষ্ণ স্পর্শে লেপ্টে থেকে। একে অপরের ভালবাসা অনুভব করে। পাল্লা দিয়ে চলা বুকের ভেতরের কাঁপনগুলো গুনে।

কয়েক প্রহর পর তপা পলকের লোমশ বুকে নাক ঘষতে ঘষতে জড়ানো গলায় বলল,
“আমার কালো রাতগুলো রঙিন আলোয় ভরিয়ে দিন । নির্ঘুম ভ*য়া*ব*হ রাতগুলোকে কোমল স্পর্শে সাজিয়ে দিন। ভ*য়ংক*র স্বপ্নগুলোকে সরিয়ে নতুন প্রাণ সঞ্চার করুন। আমি সব ভুলে বাঁচতে চাই মিস্টার তাজওয়ার। আপনার ভালবাসায় মাতোয়ারা হতে চাই। আপনার স্পর্শের আ*গু*নে জ্ব*লে পু*ড়ে ভ*ষ্ম হতে চাই।”

পলক যেন অপেক্ষা করছিল এই ক্ষণের। এতক্ষণ বিড়ালছানার মত গুটিশুটি মেরে লেপ্টে থাকা তপায় মগ্ন হলো সে। গাঢ় থেকে গাঢ়তর হলো স্পর্শ। সোফা ছেড়ে ঠাঁই হলো গোলাপে জড়ানো বিছানায়। কাল বৈশাখী ঝ*ড়ের তান্ডবে বিশালদেহী গাছের পাতা যেভাবে উড়ে, ভাসে তার থেকেও বেশি জোরে উড়ছে, ভাসছে দু’জনে। ভাসিয়ে নিয়ে গেল কিছু উষ্ণ আলিঙ্গনে পিষে। গভীর সমুদ্রের অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে লাগল অনবরত। উষ্ণ আলিঙ্গনে চাপা পড়ল কিছু অব্যক্ত কথা, কিছু সুখময় আ*র্ত*না*দ।

পলকের ঘন হয়ে যাওয়া কণ্ঠে কেবল উচ্চারিত হয়েছিল কিছু শব্দ।
“আমি কোনো ভুল করছি না তো কৃষ্ণময়ী?”
উত্তরে কোনো শব্দ উচ্চারিত হয় নি তপার কণ্ঠনালী ভেদ করে। কেবল আঁকড়ে ধরল পলকের পিঠ। পিষে ফেলল নিজের সাথে। মাঝে রইল না এক সুতো পরিমাণ ফাঁকফোকড়। পলক নিজের উত্তর পেয়ে গেল। তাকে আর পায় কে। মূহুর্তেই যেন চঞ্চল হয়ে উঠল সে। ডুবিয়ে, ভাসিয়ে, উড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগল নিজের অনূভুতির রাজ্যে। মাতিয়ে দিতে থাকল উষ্ণ পরশে।

সকালের প্রথম প্রহর। অন্ধকারকে বিদায় জানিয়ে আলোর ছটায় ভরে গেছে ধরিত্রী। সূর্য মামা প্রহর গুনছে উদিত হওয়ার। পাখিরা কিচিরমিচির করে জানান দিচ্ছে ভোর হওয়ার। তপা চোখ পিটপিট করে তাকাল। নিজেকে শ*ক্ত হাতের বাঁধনে আঁটকে থাকতে দেখে ঘাবড়ালো না আজ। বরং রাতের করা পাগলামির কথা স্মরণে আসতেই লজ্জা রাঙা হলো। কান গরম হয়ে গেল মূহুর্তেই। পলকের বাহুডোরে থাকতেও ভীষণ লজ্জা করছে তার। কৌশলে বাহুডোর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলেও সম্ভব হলো না। আরও শক্ত বাঁধনে বাঁধা পড়ল। পলক ঘুমের ঘোরেই কোলবালিশের মত পেঁচিয়ে ধরল তাকে। তপার শ্বাস আঁ*ট*কে আসার উপক্রম। বাধ্য হয়ে নড়াচড়া করতে শুরু করল। পলক ঘুমের ঘোরেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল। তপা তা দেখে মিটিমিটি হাসছে। আঙুল চালিয়ে কপালের ভাজগুলো অদৃশ্য করার চেষ্টায় সে।
চোখ বুলিয়ে পলকের কপাল থেকে শুরু করে ভ্রু, চোখ, নাক, গাল, ঠোঁট স্ক্যান করতে লাগল। হঠাৎ চোখ আঁ*ট*কে গেল ঠোঁটের উপর। উপরের ঠোঁটে কা*টা দাগ। মনে পড়ল সেদিনের বলা কথা।
বিরবির করে বলল,
“কোন মেয়ে চুমু দিয়েছে? শুধু চুমু না। আবার চিহ্নও রেখে গেছে।”
তপার অভিমান হলো কিঞ্চিৎ পরিমাণ। কিন্তু অভিমান একপাশে সরিয়ে রেখে আবার নজর দিল পলকের মুখে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল।
পলক ঘুমের ঘোরে অস্বস্তি অনুভব করে চোখ পিটপিট করে তাকাল। তপাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসল। হাতের বাঁধন আলগা করতেই তপা সরে যেতে চাইলে আবার কোমর চেপে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল।তপা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল।
পলক হেসে বলল,
“কি?”
তপা কিছু বলল না। তাকিয়েই রইল।
পলক আবারও বলল,
“কি হয়েছে? এভাবে দেখছো কেন?”
তপা মৃদু স্বরে বলল,
“আপনার গার্লফ্রেন্ড ছিল? আপনি কাউকে ভালবাসতেন?”
পলক হঠাৎ প্রশ্নে চকিত ভঙ্গিতে তাকাল। বলল,
“হঠাৎ এমন প্রশ্ন?”
তপা অধৈর্য্যের ন্যায় বলল,
“বলুন না। ছিল?”
পলক মাথা নাড়িয়ে না জানালো। মুখে বলল,
“ছিল না। আর না আমি কাউকে ভালবাসতাম। আমার জীবনের প্রথম ভালবাসা তুমি। শেষও তুমিই হবে। কিন্তু হঠাৎ জানতে চাইছো কেন? কিছু হয়েছে?”
তপা পলকের ঠোঁটের কাটা জায়গা স্পর্শ করে চোখ পিটপিট করে বলল,
“তাহলে এই দাগটা কি করে হলো? সেদিন কেনই বা বললেন গার্লফ্রেন্ড কে চুমু খেতে গিয়ে হয়েছে?”
পলক ঠোঁট কামড়ে হাসল। বলল,
“ওটা তো তোমাকে ক্ষ্যাপাতে বলেছিলাম।”
তপা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
“তাহলে কাটলো কি করে?”
পলক মৃদু হাসল। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
“বলতে পারি। কিন্তু একটা শর্ত আছে।”
“কি শর্ত?”
পলক ঠোঁটের উপর আঙুল ছুঁয়ে বলল,
“যদি তোমার উত্তর টা পছন্দ হয় তবে তুমি নিজে এখানে একটা চুমু দেবে। রাজি থাকলে বলো।”
তপা চোখ পিটপিট করে তাকাল। পলক ভ্রু উঁচিয়ে বোঝালো রাজি কিনা। কৌতুহল দমাতে না পেরে অগ্যতা রাজি হলো তপা।
পলক হেসে বলল,
“ছোট বেলায় হোমিওপ্যাথি ঔষধ চুরি করে খেতাম। একবার খেতে গিয়ে শিশি ভেঙে ফেলেছিলাম। পরে আবার ভাঙা শিশি থেকে খাওয়ার সময় ঠোঁটে লেগে কেটে গেছে।”
তপা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। পরক্ষণেই মিটিমিটি হাসতে লাগল।
পলক ঠোঁট পাউট করে বলল,
“এখন চুমু দাও।”
তপা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আমার তো উত্তরটা পছন্দ হয় নি।”
পলক ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তবে মিটিমিটি হাসছিলে কেন?”
তপা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। বলল,
“কেন হাসতে গেলে কি ট্যাক্স দিতে হবে?”

পলক বুঝতে পারল এ মেয়ের ত্যাড়া রূপ বেরিয়ে আসছে। মূহুর্তেই তপার উপর আধশোয়া হয়ে বলল,
“দেবে? নাকি রাতের মত আবার অ্যাটাক করব?”
তপা হকচকিয়ে গেল। কিন্তু নিজেকে সামলে বলল,
“আপনি কিন্তু চিটিং করছেন। উত্তর পছন্দ হয় নি আমার। হলে আমি নিশ্চয়ই চুমু দিতাম।”

পলক ঠোঁট কামড়ে হাসল। থুতনিতে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে তপার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“উত্তর টা কোনো মেয়ে ঘটিত হলে খুশি হতে?”
“আমি কি সেটা বলেছি?”
পলক এবার চিবুকে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তপা কেঁপে ওঠে পলকের হাত খামচে ধরল। বিরবির করে বলল,
“আপনি টর্চার করছেন আমার উপর।”
পলক হেসে বলল,
“রোমান্টিক টর্চার। এখন ভালোয় ভালোয় আমার পাওনা মিটিয়ে দাও।”
তপা মৃদু হাসল। ঠোঁট ছুঁয়ে দিল ঠিক কাটা দাগটাতে। পলক পরম আদরে জড়িয়ে নিল। মেতে উঠল চরম দুষ্টুমিতে।

“ভাই ওই মালডার কি খবর?”
ফোন ধরেই এহেন কথা শুনে পলক ভ্রু কুঁচকে ফেলল। কঠিন গলায় বলল,
“কোন মালের কথা বলছিস তুই?”
সজল হেসে বলল,
“যারে কয়দিন আগে থেরাপি দিলেন।”
“কার কথা বলছিস? বুঝতে পারছি না।”
সজল অবাক হওয়া গলায় বলল,
“ভাই আপনি কি প্রতিদিন থেরাপি দেন যে মনেই নাই কার কথা কইতাছি?”
পলক বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল,
“ক্লিয়ার করে বলবি না চড় খাবি?”
সজল ঘাবড়ে গিয়ে বলল,
“মামুন, মামুন।”
পলক ঈষৎ রেগে যাওয়ার ভান করে বলল,
“খামোশ। সে আমার সম্মানিত মামা শ্বশুর হয়। সম্মান করে কথা বল।”
সজল বুঝতে পারল পলক মজা করছে।
তাই সেও বলল,
“মাননীয় তাজওয়ার সাহেবের মাননীয় মামা শ্বশুর মামুনের খবর জানতে চাইছি আমি।”
পলক হাসল। বলল,
“সে এখন নেটওয়ার্কের বাইরে। তাই আপাতত তার খবর আমরা ধারণ করতে পারি নি আমাদের ক্যামেরায়। দয়া করে কিছুদিন অপেক্ষা করুন।যদি জানতে পারি তবে অবশ্যই আপনাদের জানানো হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। আর মনের শান্তির জন্য চোখ বন্ধ করে বারবার কল্পনা করুন থেরাপির সময়কার দৃশ্য।”

চলবে…
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here